রফিকউল্লা চৌধুরী (সিএসপি ১৯৬১)
এর সম্বন্ধে প্রাবন্ধিক জাহিদুল হকের কথা দিয়ে শুরু করব। “তিনি ছিলেন ভাল মানুষ রফিকুল্লাহ চৌধুরী স্মরণে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি” নামীয় এক জাহিদুল হক লিখেছেন: “বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মরহুম রফিকউলা সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। যুদ্ধপূর্ব স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে জড়িত থাকার দরূন তিনি চাকুরিচ্যুত হন। স্বাধীনতার পর তাকে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুখ্য সচিব নিয়ােগ করা হয়।”৭০
তােফায়েল সঙ্কলিত আপােষহীন সেই মানুষটি গ্রন্থে মুক্তি সংগ্রামে ছাত্র রাজনীতির যুবরাজ’ উপশিরােনামে স্বয়ং সংকলক জানাচ্ছেন: “উনসত্তরের গণবিস্ফোরণ ও একাত্তরের গণযুদ্ধে আবদুর রব, শাহজাহান সিরাজ, আবদুল কুদুস মাখন, নুরে আলম সিদ্দিকী এবং তােফায়েল আহমদ, ফজলুল হক মণি ও সিরাজুল আলম তথা ছাত্রলীগ ও ছাত্র সমাজের যে বৈপ্লবিক ভূমিকা উহার ধাপে ধাপে অগ্রযাত্রার এক পর্যায়ে এক দশক পূর্বে ১৯৫৪-১৯৫৯-এ রফিক(রফিকউল্লা চৌধুরী) ছাত্রলীগের সভাপতি হিসেবে ছাত্র ও যুব আন্দোলনে তথা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে স্বাধিকারের সংগ্রামে এক অনন্য ভূমিকা পালন করে। তার সাংগঠনিক প্রতিভার স্বাক্ষর দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে অনুষ্ঠিত ছাত্রলীগের সভায় তার ভাষণের সংবাদপত্রে প্রতিবেদন। উল্লেখ্য যে, তার ছাত্রলীগের সভাপতি হওয়ার পিছনে বৃহত্তম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ হাইকমাণ্ড মুজিবের সমর্থন ছিল।”৭১ একই গ্রন্থের মুক্তিযুদ্ধে অবদান’ উপশিরােনামে লিখেছেনঃ “আজীবন সংগ্রাম আর আন্দোলন প্রিয় রফিকউল্লা চৌধুরী ১৯৭০ ও ৭১-এ নীরব ছিল না। মুক্তিযুদ্ধে তার অবদানের কথা বিস্তারিত জানা দুরূহ ব্যাপার। কারণ এমন অনেক কাজ ও কর্মতৎপরতা আছে যা ‘ আমি এই করেছি সেই করেছি ‘ বলে প্রকাশ করা যায় না বা কেউ করতে চায় না। / তবে কিছু কথাকিছু ঘটনার সংক্ষিপ্ত আলাে(ক)পাত করা যায় ঃ- (ক) মার্চ ৭১-এ যখন জয় বাংলার ধ্বনি ও পতাকা চারদিক মুখরিত ও শােভিত তখন এক বাড়িতে রফিকউল্লা চৌধুরী বলেন, ‘ভূট্টোর সাথে, ইয়াহিয়ার সাথে সংলাপ-এ কোন লাভ হবে না। যুদ্ধ ছাড়া বিকল্প নেই। স্বাধীনতাই এখন একমাত্র দাবী। পশ্চিমাদের সাথে পাকিস্তানীদের সাথে আর আপােষ নয়, চব্বিশ বৎসর অনেক হয়েছে। এবার পূর্ণ স্বাধীনতার লড়াই।’ (তথ্য সূত্র ঃ সৈয়দ বদরুদ্দিন হােসেইন, সাবেক রেজিষ্ট্রার,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)। সেদিন স্বাধীনতা শব্দটি উচ্চারণ করতে অনেকেই ভয় পেতেন রফিক চৌধুরী?/ (খ) বাঙ্গালী বিশ্ব সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী বলেছেন ঃ৪ মার্চ ৭১-এ আমরা তিন বন্ধু কী ঘটতে যাচ্ছে বিষয়ে বাজী ধরি, তিন জনই নিজ নিজ ভবিষ্যদ্বাণী বলি, পরে দেখা গেল রফিক(উ)ল্লা চৌধুরীর কথাই টিকলাে। (‘নিরুদ্দিষ্ট নয় মাস কলাম, দৈনিক বাংলা ১৯৭২-৭৪ পরে জনপদে)। (গ) মধ্য ৭১-এ যখন মুজিবের রাষ্ট্রদ্রোহীতার বিচারের জন্য মামলা শুরু করার প্রস্তুতি নেয় তখন রফিকউল্লা চৌধুরী মুজিবের কৌসুলি এ, কে, ব্রোহীকে সাহায্য করার জন্য কয়েকবার কাগজপত্র নিয়ে করাচী যায় । ইহাতে তার জীবনের ঝুঁকি ছিল । (ঘ) ১৯৭৩- এ বাংলাদেশের প্রথম সংসদ- এর প্রথম অধিবেশনে একজন বিরােধী দলীয় সদস্যের প্রশ্ন ছিল : মুক্তিযুদ্ধে রফিকউল্লা চৌধুরীর কী অবদান ছিল যে তাকে সরকারী চাকুরিতে পুনর্বহাল করা হল?/ সংসদ ভবনে প্রধানমন্ত্রীর কামরায় ইহা শুনে কামরা থেকে সংসদে এসে শেখ মুজিবুর রহমান নিজেই উক্ত প্রশ্নের উত্তর দেন ঃ আমি জানি প্রমাণ আছে, মুক্তিযুদ্ধে রফিকউল্লা চৌধুরী কাজ করেছে ।..রফিক চৌধুরী এবং তার সতীর্থরা মুজিব নগরে বা ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করতে পারতাে কিন্তু স্বদেশেও তাদের প্রয়ােজন ছিল। এবং তারা কাজ করেছে সাক্ষাৎ যমদূতের সাথে বাস করেও।” ৭২
সৈয়দ বদরুদ্দিন হােসাইন ‘একটি নীরব মৃত্যু’ নামক রচনায় রফিকউল্লাহ চৌধুরীর মুক্তিযুদ্ধকালে অবরুদ্ধ পাকিস্তানে থাকা সত্ত্বেও তিনি যে সাহসী ও ঝুকিপূর্ণ কাজ করেন, সেসম্পর্কে লিখেছেন: “রফিকউল্লা চৌধুরীও নিষ্ক্রিয় থাকেননি। থাকবার কথাও নয়। এদেশে থেকেই তিনি তার কাজ করে গেছেন অসীম সাহসিকতার সঙ্গে। মুক্তিযুদ্ধে তার প্রধান ভূমিকা ছিল মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে বিদেশী সাংবাদিকদের অবগত করা।”৭৩
মুস্তাফা সারওয়ার তার প্রখর ও কোমল ব্যক্তিত্বের সেই মানুষটি নীরবে চলেগেলেন নামক রচনায় জানাচেছন: “৬৬ সালে ৬ দফা ঘােষণার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে গভর্ণর মােনেম খান, জিলায় জিলায় গ্রেফতার করে আর জামিন হয়ে যাওয়া দেখে একবার সমস্ত ডিসি ম্যাজিস্ট্রেটকে হুমকি দিয়ে কোন এক শনিবার অফিস শেষ হবার পর গ্রেফতারী পরােয়ানা জারি হয়, যেন বঙ্গবন্ধু(কে) রােববার- ১ দিনের জন্য হলেও জেলে পাঠিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট জেলা প্রশাসকের চেয়ে শক্তিমান গভর্ণর মােনেম খানের অস্তিত্ব দেখাতে চান। সেই দিন ঢাকায় কোন প্রশাসক ম্যাজিস্ট্রেট পাওয়া যাচ্ছিল না। জামিন দেয়ার প্রত্যক্ষ এখতিয়ার বহির্ভূত হয়েও ঢাকা প্রশাসনের কর্তা রফিক চৌধুরী প্রায় ১২ জন এডভােকেট উকিল তাঁর হাটখােলা রােডের বাড়ির সিঁড়িতে পৌছামাত্র জামিনের আবেদনপত্রে লিখিতভাবে জামিন মঞ্জুর করেন। যার জন্য রফিকউল্লাহ চৌধুরী মােনম খানের চক্ষুশূল ছিলেন। ইয়াহিয়া খানের আমলে দেশপ্রেমিক বাঙ্গালী সিএসপি কর্মকর্তাদের চাকরি থেকে অপসারণ করার মধ্যে রফিকউল্লাহ চৌধুরীও ছিলেন।”৭৪
তােফায়েল স্বীয় ‘স্বর্ণবর্ষের স্বরগ্রাম ও স্বরলিপি’ শীর্ষক রচনা লিখেছেন: “গত সাড়ে তিন দশক (বাংলার বাণী ও বাংলাবার্তা, আগস্ট ১৯৮৯) ধরে এদেশের ছাত্রমহলে ও প্রশাসনের অন্দর মহলে রফিকউল্লাহ চৌধুরী একটি সুপরিচিত নাম যে নামের কোন পরিচয় বা ভূমিকার প্রয়ােজন হয় না।/ এমন রাজনীতি-সচেতন ও রাজনীতি-সম্পৃক্ত সিভিল সার্ভেন্ট আর দ্বিতীয় টি খুঁজে পাওয়া যাবে না ঢাকা গেজেট, পাকিস্তান গেজেট বা বাংলাদেশ গেজেটে ! রফিক এর এক পরিচয় প্রায় অজানাই রয়ে গেল, তাহলে স্বদেশে মুক্তিযােদ্ধা ১৯৭১। এর সাক্ষ্য দিয়েছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু (দ্রষ্টব্যঃ সংসদ বিতর্ক বিবরণী ১৯৭৩)।”৭৫
Reference: মুক্তিযুদ্ধে সিএসপি ও ইপিসিএস অফিসারদের ভূমিকা