হিথরো থেকে দিল্লীঃ শেখ মুজিবের বিমান যাত্রা
৯ জানুয়ারী রাত ৮ টায় লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দর থেকে ব্রিটিশ সরকারের দেয়া কমেট জেট বিমানে করে শেখ মুজিব দিল্লির উদ্দেশে রওয়ানা হলেন। বিমানের গন্তব্যপথ ছিল হিথরো থেকে প্রথমে নিকোশিয়া। সেখান থেকে বাহরাইন। বাহরাইন থেকে দিল্লি হয়ে ঢাকা। সকালে লন্ডন হিথ্রো বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে শেখ মুজিব যখন পৌঁছালেন তখন তাঁকে স্বাগত জানানোর জন্য ব্রিটিশ পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ বিভাগের কর্মকর্তা ইয়ান সাদারল্যান্ড এর সাথে লন্ডনে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার আপা বি পন্থ ও ছিলেন। বিমান বন্দরে অপর ভারতীয় দুতাবাস কর্মকর্তা শশাঙ্ক ব্যানার্জি কে দেখে আবেগাপ্লুত শেখ মুজিব বলেন, ‘ব্যানার্জি, আপনি এখানেও আছেন!(১৯৬২ সালে শশাঙ্ক ব্যানার্জি ভারতের পূর্ব পাকিস্তান কন্সাল অফিসে রাজনৈতিক কর্মকর্তা পদে কর্মরত থাকা কালীন ইত্তেফাক সম্পাদক মানিক মিয়ার মাধ্যমে শেখ মুজিবের সাথে পরিচিত হয়েছিলেন ।শশাঙ্ক ব্যানার্জি থাকতেন ইত্তেফাক অফিসের পিছনেই)’। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে শেখ মুজিবের টেলিফোন যোগাযোগ করিয়ে দেন তখনকার ভারতীয় হাইকমিশনার আপা বি পন্থ। প্রথম দফায় ৩০ মিনিট ধরে চলে ইন্দিরা-মুজিব টেলিফোন আলাপচারিতা। ঘণ্টাখানেক পরে ইন্দিরা গান্ধী আবার শেখ মুজিবের সঙ্গে কথা বলেন। ইন্দিরা গান্ধীর সম্মতিতে শেখ মুজিবের স্বাধীন বাংলাদেশে যাত্রাপথে সহযাত্রী হয়েছিলেন শশাঙ্ক ব্যানার্জি। সঙ্গে ছিলেন, সে সময়ের ভারতীয় হাইকমিশনের ফার্স্ট সেক্রেটারি ভেদ মারওয়া। আরও ছিলেন স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল হোসেন ও তাঁর স্ত্রী হামিদা হোসেন(পশ্চিম পাকিস্তানী )। বিমানে তাঁরা পাশাপাশি আসনে বসেছিলেন। উক্ত ৫ জন ছাড়াও বিমানে সঙ্গী হন শেখ মুজিবের ঘনিষ্ঠ গ্রেট ইস্টার্ন ইন্স্যুরন্স কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম মওলা। তাদের সামনের আসনে বসেছিলেন শেখ মুজিব একা ।তিনি কিছুক্ষন ঘুমিয়ে ছিলেন । ঘুম থেকে উঠার পর এক কাপ চা খেয়েছিলেন ।তার পর তার পাশের আসনে ভারতীয় দুই কর্মকর্তাকে পৃথক ভাবে ডেকে নিয়ে আলাপ আলোচনা করেন । উৎফুল্ল শেখ মুজিবের তখন দেশে ফেরার তর সইছে না। আপ্লুত কণ্ঠে তিনি বলে উঠলেন, ‘স্বাধীন বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ। বিস্ময়ের আরেকটি ব্যাপার ছিল। দীর্ঘদিন কারাবন্দী থাকা সত্ত্বেও শেখ মুজিবকে বেশ চাঙা দেখাচ্ছিল। কামাল হোসেন , শশাঙ্ক ব্যানার্জি , ভেদ মারওয়ার সঙ্গে তিনি দীর্ঘ সময় ধরে টানা কথা বললেন। বিমানে তিনি একা এবং পরে তিনি শশাঙ্ক ব্যানার্জি সহ বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত গেয়েছিলেন । তিনি শশাঙ্ক কে জানিয়েছিলেন এটাই হবে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত (২৬ মার্চের আগেই এটা জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে নির্বাচিত ছিল)। ভারতীয় দুই কূটনীতিক কে তার ভারত সফরের আগেই একটি বার্তা ইন্দিরা গান্ধীর নিকট পৌঁছানোর জন্য অনুরধ করেন ।তিনি তাদের জানান অনেক দেশের স্বীকৃতি ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের উপর নির্ভর করছে ।(তাদের এই বার্তা ইন্দিরার কাছে পৌছার আগেই ইন্দিরা নিজেই এই বিষয়টি সমাধান করে ফেলেন ।ঐ দিনই দুই দেশ যুক্ত বিবৃতি দেয় বাংলাদেশ যেদিন চাইবে সেদিন ই ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করা হইবে ।পররাষ্ট্র মন্ত্রী সামাদ আজাদ তখন ভারত সফরেই ছিলেন )। বিমান জ্বালানী নেয়ার জন্য সাইপ্রাসের নিকোশিয়া তে যাত্রা বিরতি করে ।শেখ মুজিব সেখানে টার্মিনাল লাউঞ্জে বিমানের পাইলট সহ অপর সহ যাত্রীদের সাথে আলাপ আলোচনা করেন । তার পর বিমানটি বাহরাইন যাত্রা বিরতি করে এখানে কেউ বিমান থেকে নামেন নি (ভারতীয় ২ জন বলেছেন বাহরাইন ডঃ কামাল বলেছেন সারজাহ)।বিমানের যাত্রাপথে শেখ মুজিব কে কলকাতা হয়ে দেশে ফেরার অনুরাধ জানিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের বার্তা এল। কলকাতাবাসী শেখ মুজিবের কে দেখতে চায়। তিনি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ফিরতি বার্তায় জানালেন, স্বাধীনতা সংগ্রামে কলকাতাবাসীর সহযোগিতা তাঁকে কৃতজ্ঞ করেছে। কিন্তু দিল্লি হয়ে ঢাকা ফিরতে তাঁর তর সইছে না। তবে শিগগিরই তিনি কলকাতা আসবেন। ১০ জানুয়ারী সকাল ১০ টায় দিল্লি পালাম বিমানবন্দরে পৌঁছার পর শেখ মুজিব কে ব্যাপক সংবর্ধনা দেওয়া হয়।(রাজীব গান্ধীর ২য় সন্তান প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর ভূমিষ্ঠ হওয়র সময় টা ছিল ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ এর কাছাকাছি সময় টা তে । তার স্ত্রী সোনিয়া ইতিমধ্যে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে গেলেন । তার কাছে খবর পৌছে গেলো শেখ মুজিব মুক্তি পেয়ে লন্ডন হয়ে দিল্লী আসছেন ।তিনি এ ঐতিহাসিক সময় টা উপভোগ করতে চাইলেন । বিশেষ এ্যাম্বুলেন্স করে তাকে বিমান বন্দরে নেয়া হয়েছিলো শেখ মুজিবের প্রত্যাবর্তন মুহূর্ত টা উপভোগ করার জন্য ।পরে তাকে হাসপাতালে পাঠানোর দুই দিন পর প্রিয়াঙ্কার জন্ম হয় ।)
সেখানে আয়োজিত ছোট পরিসরে সংবর্ধনা জনসভায় তিনি বক্তৃতা করেন।কলকাতা বাসীকে এখান থেকেই কৃতজ্ঞতার বানী পৌঁছে দিলেন মুজিব । দিল্লি বিমানবন্দরে বিমান অবতরণ করে বিমানবন্দরের টেকনিক্যাল এরিয়ায়, যেখানে কেবল রাষ্ট্র বা সরকার প্রধানদের অবতরণের অনুমতি দেওয়া হয়। তাঁকে একজন প্রধানমন্ত্রী, ভিআইপি, রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানের মতোই সংবর্ধনা দেওয়া হয়। ইন্দিরা গান্ধী তাঁকে অত্যন্ত আন্তরিকভাবে স্বাগত জানিয়েছিলেন। কিন্তু বিষয়টি এমন ছিল, যেন পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে কত দিন পর দেখা হলো! গান্ধীর এই আন্তরিক ভঙ্গিটি ছিল উল্লেখযোগ্য। শেখ মুজিব যখন পালাম বিমান বন্দরে ভাসানি তখন দিল্লীতেই দুজনের দেখা হয়নি।
(প্রথম আলোয় প্রকাশিত ভেদ মারওয়া এবং শশাঙ্ক ব্যানার্জি এর সাক্ষাতকারের আলোকে লিখিত)