বাংলার বাণী
ঢাকা: ২১শে ডিসেম্বর, শুক্রবার, ৫ই পৌষ, ১৩৮০
ইতিহাস কথা কয়
বার্তা সংস্থা পরিবেশিত এক সংবাদে প্রকাশ, সিন্ধুর মুখ্যমন্ত্রী জনাব মমতাজ আলী ভুট্টো পদত্যাগ করেছেন। রেডিও পাকিস্তান সংবাদে দিয়েছে যে, জনাব মমতাজ কিছুদিন আগে তার মুখ্যমন্ত্রীত্ব থেকে অব্যাহতি পাবার জন্য প্রধানমন্ত্রী জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টোর কাছে আবেদন জানান, তারই পরিপ্রেক্ষিতে সিন্ধুর গভর্নর বেগম লিয়াকত আলী খান গত ১৯শে ডিসেম্বর জনাব মমতাজের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেছেন। জনাব মমতাজের এই আকস্মিক পদত্যাগের আসল কারণ জানানো না হলেও বা জানা না গেলোও, এর পেছনে যে নিছক স্বাস্থ্যগত কারনের মতো কোনো সামান্য কারণ নিহিত নেই, সে বিষয়ে মোটামুটি একটা আঁচ করা যাচ্ছে।
জনাব মমতাজের এই বিস্ময়কর পদত্যাগের সঙ্গে পাকিস্তানের বর্তমান ঘোলাটে রাজনীতি যে একটা গুরুত্বপূর্ণ মোড় নেবে, সেই বিষয়ে অনেক রাজনৈতিক ভাষ্যকার নানান জল্পনা-কল্পনাও করছেন। এবার পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অচলাবস্থার দিকে একটু আলোকপাত করা যাক। পাকিস্তানে বর্তমানে বেলুচিস্তানের মুক্তিকামী জনসাধারণের সশস্ত্র সংগ্রাম এক ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। জনতার কন্ঠ স্তব্ধ করতে পাকিস্তান বাংলাদেশের বীর জনতার ওপর একদিন কেমন নির্মম নির্যাতন ও তীব্র শোষণের ষ্টিম রোলার চালিয়েছিল, আজ ঠিক সেই চিত্রই দেখা যাচ্ছে সিন্ধু, বেলুচিস্তান ও সীমান্ত প্রদেশের ক্ষেত্রে।
কিন্তু ইতিহাস বলে, নির্যাতনের ষ্টিম রোলার চালিয়ে কখনোই কোনো মুক্তিকামী জনতার কন্ঠরোধ করার নজির নেই। পাকিস্তানের সামরিক জান্তার পষ্ট সরকার বাংলাদেশেও পারেনি তাদের অন্যায় নিয়ন্ত্রণ অটুট রাখতে, আবার পারবেওনা বর্তমানে সংগ্রামরত বেলুচিস্তান সহ পাকিস্তানের অন্যান্য অঞ্চলের সংগ্রামী জনতার ক্ষেত্রে। ন’মাসের সশস্ত্র সংগ্রামের পর স্বাধীন বাংলাদেশের দৃপ্ত ঐতিহাসিক অভ্যুদয় সমগ্র পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষের জন্য এক অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে সার্বজনীন স্বীকৃতি পেয়েছে। ভাবতে আশ্চর্য লাগে বোকার স্বর্গে বিচরণকারী জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো এতো কিছু চোখে দেখেও এবং এতো ভুলের খেসারত দিয়েও আজো পর্যন্ত আন্তরিকভাবে তার আজন্মের ভ্রম সংশোধনের কোনো চেষ্টা করছেন না বা বাংলাদেশের মতো একটি বলিষ্ঠ বাস্তব সত্যকে এখনো পর্যন্ত বুঝতে পারছেন না।
এমন কি সমগ্র পাকিস্তানের জনসাধারণ বার বারই বাংলাদেশের পক্ষে তাদের স্বার্থহীন রায় জানিয়েছে এবং বাংলাদেশ অস্তিত্বকে স্বীকার করে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের পারস্পরিক সম্পর্ককে ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে গড়ে তোলার জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানিয়েছে। কিন্তু ভ্রমান্ধ ভুট্টো সরকার বার বারই মানুষের এ দাবির প্রতি এক হাস্যস্পদ অনীহা দেখিয়ে এসেছে। অবশ্য তাতে আমাদের যে কিছু আসে যায়নি বা তাতে পাকিস্তানের লোকসান ছাড়া কোনো লাভ হয়নি তা’ বাংলাদেশের দ্বিতীয় বিজয় বার্ষিকী উপলক্ষে লেখা লন্ডন টাইমস পত্রিকার একটি সম্পাদকীয় নিবন্ধ পড়লেই স্পষ্ট বোঝা যায়। লন্ডন টাইমস লিখেছেঃ বাংলাদেশ এখন বাস্তব সত্য, সারা বিশ্ব বাংলাদেশকে স্বীকার করে নিয়েছে। সে ক্ষেত্রে পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিল কি দিল না তাতে কিছু আসে যায় না, তবে স্বীকৃতি দিলে তাতে পাকিস্তানেরই লাভ। একথা পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী জনাব কাওসার নিয়াজীও স্বীকার করেছেন।
বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম কালে চীন আমাদের মুক্তি সংগ্রামকে সমর্থন করার পরিবর্তে এর তীব্র বিরোধিতা করে এবং বাংলাদেশে গণহত্যাকারী পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীকে প্রকাশ্যে সাহায্য ও সমর্থন জোগায়। কিন্তু এতো করেও তারা বাঙালির চির স্বপ্ন ও সাধ-আহ্লাদকে ধূলিসাৎ করতে পারেনি। এমন কি যে আরব রাষ্ট্রসমূহের কাছে চীন ও পাকিস্তান এতদিন বৈরী সুলভভাবে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে একতরফা কুৎসা রটনা করে এসেছে, সে আরব রাষ্ট্রেরও এখন বাংলাদেশের বাস্তব অস্তিত্ব সর্বান্তঃকরণে স্বীকার করে নিয়েছে। সাম্প্রতিক মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধে আরবরা স্পষ্ট বুঝতে পেরেছে কে তাদের প্রকৃত বন্ধু। এ জন্যই কথায় বলে, শাক দিয়ে কই মাছ ঢাকা যায় না।
এ প্রসংগে বলা যায়, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতির মধ্যে কোনো অস্পষ্টতা নেই। আমাদের পররাষ্ট্রনীতির মূল লক্ষ্যই হচ্ছে সকলের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সহ অবস্থান। জোট নিরপেক্ষতাই আমাদের নীতি। তবে বিশ্বের সমস্ত নিপীড়িত ও নির্যাতিত মানুষের পাশে আমরা সব সময়েই প্রস্তর কঠিন ঐক্যবদ্ধ। আমাদের এতো আন্তরিকতা সত্ত্বেও যদি চীন ও পাকিস্তান তাদের বর্তমান নীতির পরিবর্তন না করে, তবে তৎজনিত যে কোনো কুফলের জন্য তাদেরই সমস্ত দুর্ভোগ পোহাতে হবে এবং ইতিহাসে সমস্ত দায়িত্ব তাদের ঘাড়েই বর্তাবে। এ কোন কাহিনী বা কিংবদন্তি নয়, এ যুগ-যুগের ইতিহাসের স্বার্থহীন ঘোষণা।
অপারজেয় ভিয়েতনাম, তোমাদের পাশে আছি
শান্তির ঘৃণ্যতম সূত্র মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আজ বিশ্বের প্রতিটি শান্তিকামী দেশ থেকে নিন্দাবাক্য ও জোর প্রতিবাদধ্বনি উচ্চকিত হয়ে উঠেছে। নির্যাতিত ও নিপীড়িত জনগণের মধ্যে অশান্তি জিইয়ে রাখার জন্য মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ দেশে দেশে শিখন্ডী দাঁড় করিয়ে বিশ্বশান্তিকে বিঘ্নিত করার জন্য নানারকম অপকৌশল অব্যাহত রেখেছে। বাংলাদেশ শান্তি পরিষদের উদ্যোগে ভিয়েতনামে ফরসী ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে ভিয়েতনামের জাতীয় প্রতিরোধ সংগ্রামের ২৭তম বার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় উত্তর ভিয়েতনামের রাষ্ট্রদূত মিঃ চু ভ্যান দিয়েন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার অভিযোগ উত্থাপন করেছেন।
রাষ্ট্রদূত মিঃ চু ভ্যান দিয়েন বলেছেন প্যারিস শান্তি চুক্তি বিশ্বের প্রতিটি স্বাধীনতা প্রিয় মানুষের জন্যে একটি মুক্তির সনদ হওয়া সত্ত্বেও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ভিয়েতনামের সে চুক্তি লঙ্ঘন করে চলেছে। প্যারিস শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের দশমাসের মধ্যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এবং তার তাবেদার সায়গন উত্তর ভিয়েতনামে অবাধে মানবতা বিরোধী কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছে। মিঃ চু ভ্যান অভিযোগ করেছেন যে, সায়গনে বর্তমানের চব্বিশ হাজার মার্কিন সামরিক উপদেষ্টা ছদ্মবেশে সাধারণ ভিয়েতনামবাসীদের মধ্যে স্বাধীনতার পরিপন্থী নানাবিধ কাজ কারবার চালিয়ে যাচ্ছে। এতে প্যারিস শান্তি চুক্তির শর্তাবলীকে দেখানো হচ্ছে বৃদ্ধাঙ্গুলি। ফলে, সাম্রাজ্যবাদী এই চক্রান্তের বিরুদ্ধে বিশ্বের প্রতিটি নিপীড়িত জনগণের প্রতিবাদমুখর হওয়া একান্ত দরকার।
ভিয়েতনামের সুদীর্ঘ মুক্তিসংগ্রামে এশিয়ার জনগণকে মুক্তির আলোকে করেছে আলোকিত। সংগ্রামী ভিয়েতনামীদের পাশে বাংলাদেশের জনগণ বারবার একাত্মতা ঘোষণা করেছে, ভবিষ্যতেও আমরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে অপারেজয় বীর ভিয়েতনামীদের সংগ্রামের সাথী হিসেবে তাদের পাশে থেকে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা গ্রহণ করবো। কারণ, ভিয়েতনামের জনগণ আত্মত্যাগ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যে অমিত সংগ্রামের ইতিহাস রচনা করেছেন, ন’মাসের মুক্তি সংগ্রামে আমরাও সেই সংগ্রামী সৈনিকদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে স্বাধীনতার আলোকে হয়েছি স্নাত। তাই, অত্যাচার, শোষণ, বঞ্চনা ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে আমরাও সদা জাগ্রত রয়েছি।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এখনো ভিয়েতনাম থেকে তাদের লোলুপ দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়নি।
প্যারিস শান্তি চুক্তিকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি নানাভাবে বানচাল করতে চাইছে। তাই এ বছর মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ তার তাঁবেদার সায়গনকে পঁচিশটি বোমারু বিমান দিয়েছে। এ ছাড়া পাঁচ লক্ষ হরেক রকম মারণাস্ত্র এবং আর্থিক সাহায্য হিসেবে নগদ তিনশ কোটি ডলার দিয়ে ভিয়েতনামে যুদ্ধের আগুনকে উসকে দেয়ার অপচেষ্টায় নিয়োজিত রয়েছে। যেখানে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, সেখানে এ ধরনের ঢালাও মার্কিন সাহায্য থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ভিয়েতনামীদের দিয়েই ভিয়েতনামীদের বিপন্ন করার কারসাজি করছে। শিখন্ডি শক্তি দাঁড় করানো মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের একটি চিরাচরিত জঘন্য চক্রান্ত। এই সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের কূটজটাজাল সম্পর্কে প্রতিটি শান্তিকামী দেশকেই সজাগ প্রহরীর মতো বলষ্ঠ পদক্ষেপ নেয়া দরকার। বাংলাদেশের জনগণের দরকার মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীর এই ধরনের চক্রান্ত সম্পর্কে তীক্ষ্ণ নজর রাখা। নইলে সুযোগ পেলেই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ শান্তির পথকে কন্টকিত করার কাজে তাদের সমস্ত শক্তি ও ধাপ্পাবাজীতে মগ্ন হয়ে পড়বে। প্যারিস শান্তি চুক্তিকে বাস্তবায়িত করার জন্য বিশ্বের প্রতিটি প্রগতিশীল শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। নইলে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলো ক্রমাগত সাম্রাজ্যবাফী উস্কানীতে চাঙ্গা হয়ে উঠবে এবং পরিণতিতে ডেকে আনবে এক অশান্তির কালোমেঘ। সায়গন সরকার মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের খপ্পরে পড়ে আজ এক প্রতিক্রিয়ার দূর্গে পরিণত হয়েছে। প্রতিক্রিয়ার এই দূর্গের ভিত নাড়িয়ে দিতে হলে, বিশ্বের বুক থেকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে নির্মূল করাই হবে আজকের প্রগতিশীল, শান্তিকামী বিশ্বের জরুরী কর্তব্য। আট দফা প্যারিস শান্তি চুক্তির প্রতি বাংলাদেশের নির্মোহ সমর্থন রয়েছে। ভবিষ্যতেও এই সমর্থন অব্যাহত থাকবে। সংগ্রামী ভিয়েতনামীদের পাশে থেকে আমরাও সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে চিরতরে উৎখাতের সংগ্রামে থাকবো চির অবিচল।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক