You dont have javascript enabled! Please enable it! কামালউদ্দিন সিদ্দিকী (সিএসপি ১৯৬৮) | মুক্তিযুদ্ধে সিএসপি ও ইপিসিএস অফিসারদের ভূমিকা  - সংগ্রামের নোটবুক

কামালউদ্দিন সিদ্দিকী (সিএসপি ১৯৬৮)

ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম কামাল সিদ্দিকী সম্বন্ধে লিখেছেন: “মাগুরার মহকুমা প্রশাসক কামাল সিদ্দিকী মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে সক্রিয়ভাবে কাজ করেছেন। স্থানীয় কর্মীরা তার ভূয়সী প্রশংসা করলেন।/ সিদ্দিকী আমার পূর্বপরিচিত। বিশ্ববিদ্যালয় সমাবর্তন অনুষ্ঠানে অন্যান্য কয়েকজনের সাথে সিদ্দিকীকেও বহিষ্কার করা হয়েছিল। আমি তার পক্ষে মামলার কৌসুলি ছিলাম। পরবর্তীকালে স্বাধীনতা সংগ্রাম চলাকালেও সিদ্দিকী উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালন করেন।”৫২

আব্দুল খালেকের পূর্বোক্ত আত্মজবানিসূত্রে জানা যায়, তিনি মুজিবনগর সরকারে যােগ দেওয়ার আগে সীমান্ত পেরিয়ে যখন বহরমপুর জেলা মাজিস্ট্রেটের সহায়তায় সপরিবারে বালুরঘাট পৌছান তখন সেখানে আগে থেকেই পৌছেছিলেন কামাল সিদ্দিকী। তার ভাষায়, “সেখানে নাটোরের (আসলে হবে নড়াইল) এস ডি ও কামালউদ্দিনের সঙ্গে দেখা হয়। কয়েকদিন আগে তিনি এখানে পালিয়ে আসেন।৫৩

     ওয়াহিদুল হকের মার্চ ১৯৮৪ সময়কার এক আত্মকথনসূত্রে জানা যায়, এপ্রিলের শুরুর দিকে তিনি যখন ভারতের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেছিলেন, তখন পথিমধ্যে কামাল সিদ্দিকী প্রমুখকে পেয়েছিলেন। তার ভাষায়: “২রা এপ্রিল কামাল সিদ্দিকী, কাজী ইকবাল এবং আবুল খায়ের লিটুকে নিয়ে গাড়ীতে করে আমরা রওয়ানা হই। পথে সাভার থেকে আমরা হাসান ইমামকে তুলে নিই।”৫৪

পরে যখন পদ্মায় আরিচা দিয়ে নৌকায় ঝিনাইদহে পৌছান সেখানে গিয়ে দেখা পান জনাব তৌফিক এলাহী চৌধুরী প্রমুখের। তার ভাষায়: “আরিচা দিয়ে আমরা নৌকা পথে ঝিনাইদহ যাই এবং আশ্চর্য হলে (হয়ে) লক্ষ্য করি যে নদীর ওপারে ‘জয় বাংলার’ পতাকা উড়ছে। সেখানে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমার সাথে থানা (আসলে হবে মহকুমা) পুলিশ অফিসার মাহবুবের আলাপ হয়। সেখানে তখন উপস্থিত ছিলেন তৌফিক এলাহী চৌধুরী, কামাল সিদ্দিকী এবং আরাে কয়েকজন । জানতে পারি কামাল সিদ্দিকী প্রায় ১০০ পাকিস্তানী সৈন্যকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেছেন।”৫৫

বাঙালি সিএসপি হলেও কামাল সিদ্দিকী প্রবল জাতীয়তাবাদী ছিলেন এবং বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে যখন অসহযােগ আন্দোলন চলে তখন তিনি মহকুমা প্রশাসকের মতে প্রশাসনিক এককের প্রধান নির্বাহি হওয়া সত্ত্বেও নিজের সরকারি গাড়িতেই কালাে পতাকা তুলেছিলেন এবং সেজন্য পাক সেনাবাহিনীর সঙ্গে পতাকা নামানাে নিয়ে তাঁর বচসা হয়েছিল। স্বয়ং কামাল সিদ্দিকী মার্চ, ১৯৮৪ তারিখের এক আত্মকথায় বলেন: “১১ই মার্চ একটি ঘটনা ঘটে যার ফলে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়। ঐ তারিখে আমি ক্যান্টনমেন্টে কোন কাজে গাড়ি নিয়ে যাই। আমার বাড়িতে (গাড়িতে) কালাে ফ্ল্যাগ ছিল। এই ফ্ল্যাগ দেখামাত্র পাহারারত সৈনিক চীৎকার করে আমাকে নামতে বলে এবং গুলি করতে উদ্যত হয়। গাড়ি থামাবার পর সে আবার বলে কালাে পতাকা নামাও। আমি উত্তর দিই যে, কিছুতেই আমি কালাে পতাকা নামাবাে না। সৈনিকটি তখন বলে কালাে পতাকাসহ ক্যান্টনমেন্টে প্রবেশ করা চলবে না। আমি বলি, কালাে পতাকা ছাড়া ক্যান্টনমেন্টে আমি ঢুকতে পারিনা এবং সেখানে (সেখান) থেকেই ফিরে আসি। এ ব্যাপারে আমি প্রেসে একটি বিবৃতি দিই। তােফায়েল আহমদও এই ঘটনার ওপর একটি বিবৃতি দিয়েছিলেন।”৫৬

এই ঘটনায় স্বাভাবিকভাবে পাক সেনা কর্তৃপক্ষ তার উপর ক্ষুব্দ হয়েছিল। সা’দত হুসাইন লিখেছেনঃ (অসহযােগ আন্দোলন প্রসঙ্গে) দুপুরের খাওয়া সেরে বিছানায় গা এলিয়েছি এমন সময় কামাল ভাই  (ড. কামাল সিদ্দিকী, নড়াইলের মহকুমা প্রশাসক, পরবর্তীতে মূখ্যসচিব) এসে  হাজির।/ কামাল ভাই বললেন আজকের কাগজে তাজউদ্দিন সাহেবের যে বিব্ তি বেরিয়েছে  তা পড়ে তিনি শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। তার মনে হচ্ছে মুজিব-ইয়াহিয়ার আলােচনা ব্যর্থ হয়েছে। শীগগীর যে কোনাে রকম গণ্ডগোল হতে পারে। সামরিক’ জান্তা’ আঘাত হানতে পারে।/ এমতাবস্থায় তার পক্ষে নড়াইল থাকাসমীচীন হবে না। মাত্র কদিন আগে গাড়ি থেকে কালাে পতাকা নামানাে নিয়ে তার সাথে সেনাবাহিনীর বেশ বড় রকমের গােলমাল হয়েছে। সুতরাং তারা মহকুমার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করলে তাকে চরম অপমান করবে। নির্যাতনও বিচিত্র নয়।তিনি ঠিক করেছেন, ট্যুরের নামে কালিয়ায় চলে যাবেন এবং পরে অবস্থা বুঝে  কর্মপন্থা ঠিক করবেন। “৫৭

      জানা যায় পাকিস্তানের অন্য্ায় অত্যাচার  মেনে না নিয়ে বরং প্রতিবাদে  চাকরি ছাড়তেও তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন।বিশেষত সামরিক কতৃপক্ষ কর্তিক ‘স্টেট অব ইমারজেন্সি ডিকলেয়ার কআরে’ মার্শাল ‘ল’ কড়াভাবে জারি  হলে তার মনোভাব ছিল এ রকম (জনাব হুসাইন জানাচ্ছেন); “কামাল ভাই আরোউত্তেজিত হয়ে গেছেন। বলে চলেছেন আমি অফিসে যাব না। এদের চাকরি আমি করব না।”৫৮

        পরে কামাল সিদ্দিকী যেভাবে মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিলেন তার সূচক- প্রেক্ষাপট সম্বন্ধে জনাব হুসাইনের লেখনীতে পাই; “৩০ মার্চ.. দু’তিন মিনিটের মধেই (মধ্যেই) শতশত লােক কোথা থেকে যেন হুমড়ি খেয়ে এসে পড়ল। এদের মধ্যে কিছু সরকারি কর্মচারীও রয়েছে। এতলােকের সমাগমে কামাল ভাই রীতিমত উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। তার বাংলাের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আবেগ আপ্লুত ভাষায় ঘােষণা করলেন : বাঙালি আজ পশ্চিম পাকিস্তানি শত্রু কর্তৃক আক্রান্ত। এমতাবস্থায় আমি নড়াইলের এসডিও হিসেবে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ  থেকে পশ্চিম পাকিস্তানি হানাদার পশুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করলাম। আপনারা এগিয়ে যান, জয় আমাদের হবেই।/ আর যায় কোথায়। উত্তেজিত জনতা শ্লোগান দিতে দিতে সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ল। কিছুক্ষণের মধ্যে শহর লােকে লোকরন্য (লােকারণ্য) হয়ে গেল। চারিদিকে কেমন একটা হুলস্থুল ভাব। আস্তে আস্তে মহকুমার অফিসারবৃন্দ একে একে হাজির হতে শুরু করল। এরা এ কয়দিন পালিয়ে ছিল। আজ এসডিও ফিরে এসেছেন শুনে গর্ত থেকে বেরিয়ে আসল। সেকেন্ড অফিসার (গিয়াসউদ্দিন) থার্ড অফিসার সবাই যুদ্ধ প্রস্তুতিতে লেগে গেল ।.. কামাল ভাই এক মুহূর্তে যুদ্ধের সমস্ত দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। ঠিক হলাে যুদ্ধ সরঞ্জাম সবকিছুই এসডিও’র বাংলােয় জমা হবে। সমস্ত অর্থ সাহায্য ইত্যাদিও  এসডিওর অফিসের মাধ্যমেই সংগৃহীত হবে। অবশ্য এসবের তত্ববধায়নে এবং সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার জন্য কয়েকটি সাব কমিটি গঠন করলেন।  এ সমস্ত কামাল ভাই এবং শহীদ আলী খানের নেতৃতেই চলছিল ।”৫৯

         রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: ৯ম খণ্ড (পৃষ্ঠা৫০৯) সূত্রে লিখেছেন: “পাক সেনাবাহিনী বিশাল কামান নিয়ে নড়াইলের ওপর আক্রমণ চালায় এবং প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি করে। তিনশত মুক্তিফৌজ আনসার কামানের গুলিতে নিহত হয়। পাক বিমান বাহিনী সারাক্ষণ নড়াইলের ওপর গুলী বর্ষণ করে। জনতার হাতে ২৯ মার্চ যশোরে ধৃত ১১৮ জন পাকসেনাকে মহকুমা প্রশাসক কামাল সিদ্দিকী বিচার করে মৃত্যু দণ্ডাদেশ প্রদান করেন এবং কয়েক’শ বন্দীকে গুলী করে এই দণ্ড কার্যকর করা হয়।”৬০

       তিনি আরও লিখেছেন: “উল্লেখ্য কামাল সিদ্দিকী সকল কর্মচারীদের ছয় মাসের অগ্রীম (অগ্রিম) বেতন দিয়ে অফিস বন্ধ করে দেন। সক্ষম যুদ্ধাদের (যােদ্ধাদের) সীমান্ত পাড়ি দিতে নির্দ্দেশ (নির্দেশ) দিয়ে ঢাকায় তার পিতা মাতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসেন। সমূহ বিপদ মাথায় নিয়ে তিনি সীমান্ত পাড়ি দেন ৭ এপ্রিল।”৬১।

       কামাল সিদ্দিকী প্রবাসী মুজিবনগর সরকারে যােগ দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। এ ব্যাপারে তাঁর নিজের ভাষ্য উদ্ধারযােগ্য, যা এ রকম (অংশবিশেষ): “কলকাতায় গিয়ে কীড স্ট্রীটে সমবেত হই। এখানে বহু এমপির সাথে দেখা হয় এবং ১৭ই এপ্রিলের স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘােষণার কথাও জানতে পারি। এর পরে পাকিস্তানী দূতাবাসের জনাব হােসেন আলী এবং আনােয়ারুল করিম চৌধুরীর সাথে দেখা করি এবং সমস্ত ঘটনার বর্ণনা দিই। তাদের বক্তব্যও আমি শুনি। তবে আমার মনে হচ্ছিল যে, কলকাতায় আমার অবস্থানের কোন প্রয়ােজন নেই এবং আমি তখন খুলনা সীমান্তের গজাডাংগা ক্যাম্পে যােগদান করি। এই ক্যাম্পের প্রধান ছিলেন ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন।/ মে এবং জুন মাসে ট্রেনিং এবং ছােটখাট অপারেশন পরিচালনার মধ্যে কাটে । জুন মাসের শেষে জেনারেল ওসমানী এই ক্যাম্প পরিদর্শনে আসেন এবং আমার খোজ করেন। তিনি আমাকে বলেন যে, মুজিব নগর সচিবালয়ে আমার প্রয়ােজন রয়েছে। তাঁর এই সিদ্ধান্তে আমার প্রবল আপত্তি থাকা সত্ত্বেও করার কিছু ছিল না। কারণ তিনি ছিলেন সর্বাধিনায়ক। আমি কলকাতায় ফিরে আসি এবং প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করি। তিনি আমাকে সাধারণ প্রশাসন বিভাগের সচিব জনাব নূরুল কাদের খানের সংগে দেখা করতে বলেন। তিনি আমাকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিব হিসেবে যােগদান করতে আদেশ দেন।”৬২

এখানে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের বক্তব্য উদ্ধার করে আলােচনা শেষ করব। তিনি লিখেছেন: “পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস যে সব অফিসার যোগ দেন এদের মধ্যে উচ্চাভিলাষী লােকের অভাব ছিল না। এদের মধ্যে বেশীর ভাগ অফিসারই অসীম সাহসিকতা ত্যাগ ও করমস্পৃহার পরিচয় দেন।/ মাগুরা (প্রকৃতার্থে হবে নড়াইল) ও মেহেরপুর মহকুমা প্রশাসক  কামাল উদ্দিন ও তওফিক এলাহীর অবদান স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। একজন  ছেলেদের সাথে বন্দুক কাঁধে নিয়ে যুদ্ধে যেতেন, যিনি পরে ঢাকার জেলা জজ হয়েছিলেন।  মুক্তিযুদ্ধ এমন একটি ব্যাপক ও সম্মিলিত আন্দোলন ছিল”। ৬৩

Reference: মুক্তিযুদ্ধে সিএসপি ও ইপিসিএস অফিসারদের ভূমিকা