‘আমি দেশকে মুক্ত করার জন্য অস্ত্র হাতে নিয়েছি। বেঁচে থাকার আশায় নয় । অতএব, যে অস্ত্র আমি ধারণ করেছি তা ত্যাগ করব না। যুদ্ধক্ষেত্রে যাবার প্রয়ােজন অনুভব করলেই আমি যুদ্ধে যাব। আর যখন দেশ মুক্ত হবে তখন আমি আমার দায়িত্ব নিজেই নেব।’ এই সমস্ত আবেগের কথাবার্তা আর কি। এটা ১৭ এপ্রিলের ঘটনা। ১৮ এপ্রিল কামরুজ্জামান সাহেব ফোন করলেন। ডাকনাম ধরে বললেন, ‘ঝিলু, কী খবর? তুমি কবে আসছ?’ আমি বললাম, কোথায় ? তিনি বললেন, ‘কেন, কলকাতায়। কলকাতায় এলেই আমাদেরকে পাবে।’ আমি বললাম, “দেখি কী করা যায়।’ হেনা ভাই বললেন, তুমি এই সব কী আরম্ভ করলে, একদম সােজা চলে এস। আমি বললাম, “ঠিক আছে।’ ১৯ তারিখ আমি জীপ চালিয়ে যখন সীমান্তে এসে পৌঁছি তখন পড়ন্ত বিকেল, চারদিকে সন্ধ্যার ছায়া, রক্তিম সূর্য ডুবে যাবার অপেক্ষায়। বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করবে এই বিশ্বাসে অস্ত্রধারণ করেছিল এমন চারটি ছেলেও ছিল আমার সাথে। আমরা জীপ থেকে নামলাম। সূর্যকে দেখছি। সূর্য অস্ত যাচ্ছে বাংলাদেশে। দুটো ছেলে কেঁদে চিৎকার করে বাংলাদেশের মাটিতে ফিরে গেল। এই চিকারের সাথে যেন মিশে ছিল দুটো জিনিস : এক, সীমান্তরক্ষী বাহিনী অস্ত্র রেখে যেতে বলেছে; দুই, যেন শেষ সূর্য ডুবছে। ওদের চিৎকারটা এমন ছিল যে, স্বাধীনতার সূর্য ডুবতে দেব না। হাজার ডেকেও তাদের ফেরাতে পারিনি। কিছুদিন পরে খবর পেয়েছিলাম তারা যুদ্ধে শহীদ হয়েছে। যাই হােক, সে দিন তারা দু’জন যখন বাংলাদেশে ফিরে গেল তখন স্বাভাবিকভাবেই আমাদের মন খুব বিষন্ন হয়ে গেল। আবেগের তাড়নায় মনে হল তারা যা করেছে আমাদেরও তাে তাই করা উচিত। আবেগ ঝেড়ে ফেললাম। কাজ করতে হবে, অনেক কাজ। সরকারের আদেশ আছে আমার জন্য। সীমান্ত অতিক্রম করলাম। আমি জীপ চালাচ্ছিলাম, মনে হচ্ছিল অফুরন্ত পথ। পথ ফুরাচ্ছে না। মনটা ছিল ভারাক্রান্ত। দেশ পেছনে রয়ে গেছে। সম্পূর্ণ অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। কোনদিন এই মাটিতে ফিরতে পারব কিনা জানি না। যুদ্ধের সমাপ্তি কবে হবে, দেশ স্বাধীন হবে কিনা, কিছুই জানি না। সম্পূর্ণ অপরিচিত একটা দেশে যাচ্ছি। আমাদের কারাে কাছে জীবনধারণের কোন উপায় বলতে কিছুই ছিল না। খাবার, টাকাপয়সা কিছুই না। এত অনিশ্চয়তা, অনিশ্চিত পরিস্থিতি। সমস্ত পথ কিছুক্ষণ পরপর পানিতে চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল। গাড়ি থামাতে হয়েছে, চোখ মুছতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত যখন কৃষ্ণনগরে পৌছলাম রাত তখন প্রায় নয়টার মত। আমাদের জীপ দেখে বহু লােক এসে ঘিরে দাঁড়াল। বাংলাদেশের গাড়ি, দেখলেই চেনা যায়। এখানে আর একটি কথা বলে রাখা ভাল, সেই যে টাকাপয়সা ট্রাঙ্ক করে ট্রাকে তােলা হয়েছিল হিসেবের লিস্টসহ, সেগুলাে কিন্তু ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের পর সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছিল। কৃষ্ণনগরে আমাদের জীপটাকে ঘিরে তখন জয় বাংলা স্লোগান চলছে। কিছু লােক এগিয়ে এসে বলল, “আমরা সহায়ক সমিতির লােক। বাংলাদেশের লােকদের সাহায্য করবার জন্য আমরা সহায়ক সমিতি করেছি। এখানে বগা ভাই এবং আমাদের সাথের প্রায় এক-দেড়শ ছেলের সাথে দেখা হল। সহায়ক সমিতির একজন আমাকে সেখানকার ডিসি-র বাংলােতে নিয়ে গেল। রাত এগারােটা/সাড়ে এগারােটায় সাঁতারু ব্ৰজেন দাস এসে হাজির হলেন—সে আর এক ইতিহাস। ব্রজেন দাস আমার খোঁজে গিয়েছিলেন কারণ তিনি শুনেছেন যে আমি মারা গেছি। বিবিসি থেকে আমার নাম ধরে বলেছিল মারা যাবার সংবাদ। তাই জলজ্যান্ত আমাকে দেখে ব্রজেন তাে খুব খুশি। ব্রজেন দাসই আমাদেরকে কলকাতায় নিয়ে যান। কলকাতায় পৌছে ঠিকানা খুঁজে বের করা খুবই কষ্টকর ছিল। শেষ পর্যন্ত খুঁজে পেলাম ২ লর্ড সিনহা রােড । আমাকে ভেতরের একটা রুমে নিয়ে গেল, সেখানে তাজউদ্দীন সাহেব, নজরুল সাহেব এবং ওসমানী সাহেব ছিলেন। আমাকে দেখেই তাজউদ্দীন সাহেব বললেন, “আসুন, নূরুল কাদের সাহেব, বসুন। ওসমানী সাহেব তার স্বভাবসুলভ ইংরেজিতে বললেন, ‘হাউ আর ইউ, মাই বয়?’ ওসমানী সাহেবকে দেখেই আবেগে আক্রান্ত আমি উত্তেজিতভাবে বলেই ফেললাম, ‘স্যার, আপনি তাে এখানে আছেন, আর যুদ্ধক্ষেত্রে ছেলেরা আহত হচ্ছে, চিকিৎসা পাচ্ছে না, রসদ নেই, প্রাথমিক চিকিৎসা নেই কী ব্যবস্থা নিচ্ছেন?’ তিনি বললেন, “আমরা চিন্তাভাবনা করছি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কিছু করবার জন্য।’
এই কথায় আমার মন ভরল না। আমার কাছে তখন অস্ত্র হাতে নিয়ে যুদ্ধ করার অভিজ্ঞতা এবং সমস্ত প্রতিবন্ধকতা সহজে দূর করতে পারা একমাত্র লক্ষ্য। মনসুর ভাইয়ের সাথে, হেনা ভাইয়ের সাথে কথা হল। মনসুর ভাইকে তাে সরাসরি বলেই ফেললাম, এখন তাে সরকার হয়ে গেছে, আপনি সরকারের প্রতিনিধি, মন্ত্রী হিসেবে আমাদের সাথে থাকেন। আমরা যুদ্ধ করব।’ তাজউদ্দীন সাহেবকে বললাম, আপনারা আমাদের সরকার গঠন করেছেন, এখন প্রশাসনিক একটা সরকার, প্রশাসনিক একটা অবকাঠামাে প্রয়ােজন, না হলে লক্ষ্যে কীভাবে পৌছাবাে আমরা!’ অভিমানী মা যেমন রাগ করে ছেলেকে ভর্ৎসনা করেন, আমার ওই কথা শুনে তাজউদ্দীন সাহেব ঠিক সেইভাবে বললেন, ‘কিসের সরকার, কোন কিছুর ঠিক নেই, কিসের সরকার, অ্যাঁ? এত অধৈর্য হলে হবে নাকি!’ আমি তখন বুঝতে পারিনি ব্যাপারটা। সময় লেগেছে বুঝতে। তবে ইতােমধ্যে আমি জেনে গেছি তাজউদ্দীন সাহেব কী অবস্থায়, কোন্ পরিস্থিতিতে সরকারের ঘােষণা দিয়েছেন এবং অনেক ক্ষেত্রেই কিভাবে নাজুক পরিস্থিতির মুখােমুখি হয়ে তা আবার সামাল দিয়েছেন। তাই তিনি হয়ত ভাবছেন, কি জানি নুরুল কাদের এবং অন্যান্যদের কথা শুনে আবার একটা প্রশাসনিক সরকার বসিয়ে আর এক ঝামেলা না হয়। তাজউদ্দীন সাহেব বারবার সংগঠিত হবার উপর জোর দিচ্ছিলেন। বলছিলেন, ‘কোন তথ্য নেই, ডাটা নেই—কোন খবরই নেই, আগে তাে সংগঠিত হতে হবে!’ আমি সেই সূত্র ধরে বললাম, ‘স্যার, আপনি সংগঠিত হবার কথা বলছেন, কিন্তু ভেবে দেখুন কীভাবে হবেন। তথ্য সংগ্রহের জন্য, কাজকর্ম, যােগাযােগ স্থাপনের জন্য মেকানিজম দরকার। আপনার কথামত সবাইকে একসাথে করে দায়িত্ব ভাগ করে দিতে হবে।’ তাজউদ্দীন সাহেব কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ‘বুঝলাম। কিন্তু আজকের দিনটা যাক। কাল আমি বলব।’
আমি বুঝলাম, তিনি সমস্ত জিনিস পরিষ্কার ভাবছেন, বুঝছেন, কিন্তু অন্যান্যদের সাথে আলােচনা না করে কিছু করতে পারছেন না। আমি পরে জেনেছি, সেদিন সন্ধ্যায় তাঁদের একটি মিটিং হয়, সেখানে তাজউদ্দীন সাহেব এটা তােলেন যে, আমাদের একটা প্রশাসনিক দিক যদি আমরা উনন্মাচন না করি তাহলে দ্রুত সংগঠিত হতে পারব না, ইত্যাদি। সিদ্ধান্ত হল, একটি কাঠামাে তৈরি করা হবে। কীভাবে হবে সেই আলােচনাও হয়। তখন তাজউদ্দীন সাহেব বলেন, “আমার কাছে নূরুল কাদের সম্পর্কে রিপাের্ট আছে, এই জন্যই ১৭ এপ্রিল নূরুল কাদেরকে এখানে আসতে বলেছিলাম। আমি নূরুল কাদেরের সাথে আলাপ করেছি, বয়সে নবীন হলেও আমার মনে হয় সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে শৃঙ্খলার সাথে সমস্ত কাজ করতে পেরে সে অধিকার লাভ করেছে এবং সে যে দায়িত্ব গ্রহণ করার উপযুক্ত এ থেকেই তা সহজে অনুমান করা যায়।’ পুরাে ঘটনাটাই আমি পরে কামরুজ্জামান ভাইয়ের কাছ থেকে শুনেছিলাম। তিনি বললেন, নূরুল কাদের, তুমি তাে তাজউদ্দীন সাহেবের মােটামুটি খুব বিশ্বাসভাজন ব্যক্তি। আমি বললাম, “হেনা ভাই, তাজউদ্দীন সাহেব আমার সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে জেনেছেন, আর আমার সাথে তাঁর প্রথম দেখা তাে ১৭ তারিখে। তখন তিনি ঠাট্টা করে বললেন, ‘ঝিলু, তুমিই আমাদের সরকারের প্রথম। ভাল।’ এদিকে আমাদের কর্মকাণ্ড শুরু করবার জন্য ৮ নম্বর থিয়েটার রােডের বাড়িটা ঠিক হল। তাজউদ্দিন সাহেব বললেন, নূরুল কাদের, আপনি একটি অর্ডার লিখে নিয়ে আসেন। তখন আমাদের কাগজ নেই, কলম নেই, টাইপরাইটার কিছুই নেই। একটা লােক এসে বলল, ‘স্যার, আমি ব্যবস্থা করছি। আমি বললাম, আপনি কে ?’ তখন সে বলল, স্যার, আমি ওয়াপদার অ্যাকাউন্টেন্ট ছিলাম। আমি শর্টহ্যান্ডের কাজও জানি।’ সে ছুটে গিয়ে নিজের পকেট থেকে টাকা দিয়ে এক দিস্তা কাগজ নিয়ে এল। লেখা হল : গতকালের ক্যাবিনেট সিদ্ধান্তের অনুসরণে নূরুল কাদেরকে একটি প্রশাসনিক কাঠামাে প্রণয়ন করার দায়িত্বে নিয়ােগ করা হল। ডেজিগনেশান দেয়া হল সচিব, সাধারণ প্রশাসন। তাজউদ্দীন সাহেব সই করলেন এবং এইভাবে বাংলাদেশের প্রশাসনিক সরকারের জন্ম হল। আসাদুজ্জামান তখন কলকাতায়। ওয়ালি, কমল, কামালকে পেলাম। তৌফিকও ছিল। তওফিক ইমাম তখন আগরতলায়। প্রথম ক্যাবিনেট সচিব হিসেবে নিয়ােগ দেয়া হল রাশিদুল হাসানকে। রাশিদুল হাসান রাজশাহীর ডিসি ছিলেন।এখন আমি ঠিক বােঝাতে পারব না, কী কাজের চাপ ছিল তখন। থাকার কোন জায়গা ছিল না। টেবিলের উপরই দু’ঘণ্টা কাত হয়ে বসে বসেই ঘুমিয়ে নিতাম। কাজের কোন শুরু বা শেষ ছিল না। কারাে প্রাথমিক চিকিৎসা লাগবে; কেউ স্টেশনে শুয়ে আছে, তার থাকার ব্যবস্থা করা; কেউ মারা গেছে, তার মৃতদেহের সকারের ব্যবস্থা করা থেকে শুরু করে ক্যাবিনেট মিটিংয়ে যােগ দেয়া, মন্ত্রিসভার আলােচনার একটি সারমর্ম লেখা—সব আর হয়ে উঠছিল না। যাই হােক, এর মধ্যে আসাদুজ্জামানের সাথে ২৮/২৯ তারিখে দেখা। মনসুর আলি সাহেবকে আসাদের কথা বললাম, “সে সিএসপি অফিসার, টাঙ্গাইল বাড়ি, খুব ভাল মানুষ, তাঁকেই আপনার মন্ত্রণালয়ের সচিব করে নেন। তারপর তার অ্যাপয়েন্টমেন্ট হল। প্রথম ট্রেজারি করা হল হােসেন আলি সাহেবের অফিসের। উপরতলার একদিকে একটা রুম এবং নিচতলায় আর একটা রুম নিয়ে। এই রুমে রাখালচন্দ্র মিজি বসত। সে পাবনায় আমারই ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিল। তাকে ট্রেজারি অফিসার করা হল। এক পর্যায়ে সাদাত এলে তাকে মনসুর সাহেবের একান্ত সচিব করা হল। ধীরে ধীরে কামাল, ওয়ালি, কমল সিদ্দিকী এই রকমভাবে আমরা গুছিয়ে নিলাম সরকার। এরপর শুরু হল তাজউদ্দীন সাহেবের সাথে আমার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ও নির্দিষ্টভাবে কাজের পর্ব। আমি প্রায়ই বিভিন্ন প্রশ্নাদি করি, তাে একদিন তিনি হাসতে হাসতে বললেন, ‘নূরুল কাদের সাহেব, আমি তাে সরকার সম্বন্ধে বেশি কিছু জানিটানি না, তাই মনে হয় আপনার ওপর যথেষ্ট নির্ভর করতে হবে।’ আমাকে একটুখানি সন্তোষ দেবার মত করে বললেন, ‘অবশ্য আমি চেষ্টা করছি কিছু সিনিয়র লােকজনকে নিয়ে আসতে। খবরটবর পাঠানাের চেষ্টা করছি। ততক্ষণ পর্যন্ত আপনাকেই কাজ করতে হবে। আমি বললাম, ‘স্যার, আমার জানপ্রাণ হাজির।’ খুব ভাল মুডে ছিলেন তিনি, বললেন, ‘আপনার সাথে কথা হােক, আপনি আমাকে আমাদের সরকারের প্রশাসনিক দিকটা বুঝতে সাহায্য করুন, আমি আপনাকে রাজনীতি শেখাব।’ আমি বললাম, স্যার, আপনাকে কী শেখাতে পারব জানি না, কিন্তু আমি যদি আপনার কাছ থেকে রাজনীতির দীক্ষা পাই তাহলে আমি ধন্য হয়ে যাব।’ প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়, আমি যখন দেশ স্বাধীন হবার পর চাকরি ছাড়লাম তখন আমার ইস্তফা চিঠির ড্রাফটটা তাজউদ্দীন সাহেব করে দিয়েছিলেন। সেদিন তিনি বলেছিলেন, নূরুল কাদের, আমি তােমাকে (ততদিনে তিনি তুমি বলেন) খুব ঠকিয়েছি। আমি বললাম, ‘কী রকম? বললেন, তুমি তাে আমাকে সরকার শিখিয়েছ, আমি তাে তােমাকে রাজনীতি শেখাইনি। আমি হাসতে হাসতে বললাম, “এখনই তাে শেখাবেন। আমি তাে চাকরি ছাড়লাম, এখনই তাে শিখব।’ তিনিও হেসে বললেন, ‘আচ্ছা।’ এরকম সুন্দর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তাঁর সাথে আমার।