You dont have javascript enabled! Please enable it!

স্বাধীন বাংলাদেশে গণমুখী শিক্ষা প্রবর্তন

স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের কার্যক্রম প্রকৃত অর্থে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণার পরমুহূর্ত থেকেই শুরু হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু কতৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণার কয়েকদিন পর বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয় এবং মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাসহ দেশের প্রশাসনিক কাজকর্ম, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, বহিঃর্বিশ্বের সঙ্গে পররাষ্ট্র সম্পর্কবিষয়ক যােগাযােগ ও তৎপরতা এই সরকারের মাধ্যমে শুরু হয়। দেশের অভ্যন্তরীণ প্রশাসনিক কাজকর্মের সঙ্গে অর্থনৈতিক কাজকর্মের দিকেও মনােনিবেশ করতে হয় বাংলাদেশ সরকারকে। দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের দিকনির্দেশনা মূলত পরিকল্পনাবিষয়ক অবকাঠামাের ওপর নির্ভরশীল। এ জন্য স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার মুজিবনগরেই একটি পরিকল্পনা সেল গঠন করে। এই সেলের অধীনে বহু উন্নয়ন পরিকল্পনার মধ্যে স্বাধীন দেশের উপযুক্ত একটি শিক্ষাব্যবস্থাও গড়ে তােলার লক্ষ্যে নীতিনির্ধারণের কাজ শুরু করা হয়। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের নির্দেশে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষানীতি নির্ধারণের কাজ শুরু হয় প্রফেসর আনিসুজ্জামান এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের প্রতি এদের গভীর আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধকালে বাস্তব পরিস্থিতি অনুকূল না থাকার কারণে শিক্ষাবিষয়ক পূর্ণাঙ্গ  নীতিমালা প্রণয়ন করা সম্ভব ছিল না । তাই, এসব বিষ উদ্যোগ নেওয়া হয় স্বাধীনতার  অব্যবহিত পরে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর।  ১৯৭২ সালের ১৫ জানুয়ারির প্রথমেই এক ঘােষণায় ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে অর্থাৎ সমগ্র মুক্তিযুদ্ধকালের ছাত্রবেতন মওকুফ করা হয়। ওই ঘােষণায় শিক্ষক-  কর্মচারীদের বকেয়া বেতন দেওয়ার বিষয় বিবেচনাধীন রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়  কারণ, মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে দেশের শতকরা ৬০ ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই ধ্বংসপ্রাপ্ত নয়তাে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই সময়ে বহু শিক্ষক এবং ছাত্রছাত্রী শহীদ হয়, অসংখ্য শিক্ষার্থী এবং শিক্ষার্থীর অভিভাবক শহীদ হন। সব কিছু বিবেচনায় নিয়ে শিক্ষাব্যবস্থা পুনর্গঠনের প্রশ্নটি সামনে চলে আসে। তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী অধ্যাপক ইউসুফ আলী বঙ্গবন্ধুর সম্মতিক্রমে ১৯৭২ সালের ২০ জানুয়ারি শিক্ষাব্যবস্থা পুনর্গঠনের জন্য ৫১ কোটি টাকা বরাদ্দের কথা ঘােষণা করেন। এর অধিকাংশ অর্থ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পুনর্নির্মাণের জন্য ব্যয় হয়।

—————

১. শিক্ষামন্ত্রীর সাক্ষাৎকার, ১৯ জানুয়ারি ১৯৭২

————

স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম মহান একুশে ফেব্রুয়ারিকে সামনে রেখে ১৯৭২ সালের । ১২ ফেব্রুয়ারি সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে ঘােষণা করা হয়। যে, উচ্চমাধ্যমিকপর্যায় পর্যন্ত শিক্ষার মাধ্যম হবে বাংলা। স্কুল-কলেজের ছাত্রবেতনও পুনর্নির্ধারণ করা হয়। শিক্ষামন্ত্রী ১৯ ফেব্রুয়ারি ঘােষণা করেন যে, পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক প্রদান করা হবে এবং শতকরা ৪০ ভাগ কম দামে ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে। মাধ্যমিক ছাত্রছাত্রীদের বই সরবরাহ করা হবে। এই সিদ্ধান্ত কার্যকরী করতে সরকারকে অসুবিধার সম্মুখীন হতে হলেও তা শিক্ষা ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পেরেছিল। বঙ্গবন্ধুর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে প্রণীত বাংলাদেশের প্রথম বাজেটে প্রতিরক্ষা খাতের অপেক্ষা শিক্ষা খাতে ৩ কোটি ৭২ লাখ টাকা বেশি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। এ থেকে বােঝা যায় যে, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষানীতি পুনর্নির্ধারণে বিশেষ গুরুত্ব আরােপ করেন। বাংলা ভাষার গবেষণা ও উন্নয়নের জন্য পাকিস্তান আমলে প্রতিষ্ঠিত কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বাের্ড, জাতীয় গ্রন্থাগার ইত্যাদির মতাে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে ১৯৭২ সালের গােড়ার দিকে সরকার কর্তৃক অর্থের বিশেষ বরাদ্দ দেওয়া হয়। ওই বছরই মাদ্রাসা শিক্ষার জন্য ১.২৩ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। উল্লেখ্য, পাকিস্তান আমলে শিক্ষার উচ্চস্তরের শিক্ষার্থীদের জন্য বাংলা ভাষায় পাঠ্যপুস্তক রচনার দায়িত্ব পালন করত ষাটের দশকের গােড়ার দিকে প্রতিষ্ঠিত কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বাের্ড। সাবেক পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের শিক্ষা। মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ছিল এটি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর। ১৯৭২ সালের ১৭ মে এই প্রতিষ্ঠানকে সাবেক ‘বেঙ্গলি একাডেমীর সঙ্গে একীভূত করে। নতুনভাবে সমম্বিত “বাংলা একাডেমী” গঠিত হয়। সমন্বিত এই প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ বাংলা একাডেমীর প্রথম মহাপরিচালক পদে সরকার মুক্তিযােদ্ধা অধ্যাপক মযহারুল ইসলামকে নিযুক্ত করে।

সমন্বিত করার আগে প্রতিষ্ঠান দুটির প্রধান পদের নাম ছিল “পরিচালক”  প্রতিষ্ঠান দুইটির প্রধান পদ দুটিকে একটি মহাপরিচালক পদে উন্নীত করা হয়। অন্য পদগুলাে যথাযযাগ্যভাবে পরিচালক, উপপরিচালক, সহপরিচালক, অফিসার, সহ-অফিসার ইত্যাদি মর্যাদায় উন্নীত করা হয়। কাজের ধারাবাহিকতায় স্বাধীন বাংলাদেশে উচ্চস্তরের শিক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তক বাংলাভাষায় প্রণয়নের দায়িত্ব সমন্বিত বাংলা একাডেমীর ওপর স্বাভাবিক নিয়মে বর্তেছিল। এই কর্মসূচি অব্যাহত আছে। বাংলা ভাষার গবেষণা ও উন্নয়ন কাজের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার উচ্চস্তরের জন্য বাংলা ভাষায় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন ও প্রকাশের কাজও জাতীয় প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমী নিরবচ্ছিন্নভাবে করে যাচ্ছে।  স্বাধীনতা-উত্তরকালে বাংলাদেশ সরকার গণশিক্ষা প্রসারের জন্য জরুরি ভিত্তিতে আড়াই কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়। সরকারের মূল উদ্দেশ্য ছিল নিরক্ষরতা দূরীকরণ। সরকার পল্লী উন্নয়ন ব্রিগেড গঠন করে এই অর্থ কাজে লাগিয়ে নিরক্ষরতার বিরুদ্ধে কার্যক্রম শুরু করে। এ কাজ শেষ করার সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছিল মাত্র ৬ মাস । সরকার যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে ঘােষণা করে যে, ১৯৭৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত ছাত্রীদের বেতন দিতে হবে না। নারী-শিক্ষা উন্নয়ন ও প্রসারে এ ছিল বঙ্গবন্ধু সরকারের অনন্য পদক্ষেপ। শত অর্থনৈতিক সমস্যা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুর সরকার শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষানীতি স্বাধীন দেশের উপযােগী করে নিজস্ব জাতীয় স্বকীয়তার প্রতিফলন ঘটিয়ে নির্ধারণ করে। সরকারের গৃহীত পরিকল্পনা অনুযায়ী শিক্ষানীতি প্রণীত হয় এবং শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তনের ধারা সূচিত হয়। দ্বিজাতিতত্ত্বের বিষবৃক্ষ থেকে যে বিষফল পাকিস্তান আমলে বাঙালি জাতির কাঁধে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়, তার বােঝা নামতে শুরু করে বঙ্গবন্ধু সরকারের শিক্ষাব্যবস্থায় বিশেষ দৃষ্টি নিক্ষেপের ফলে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার ১৯৭২ সালের ২৬ জুলাই প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ড. মুহম্মদ কুদরাত-ই-খুদাকে সভাপতি করে ১৯ সদস্যবিশিষ্ট একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করে। এই কমিশন নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে ১৯৭৩ সালে ৮ জুন একটি অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন প্রধানমন্ত্রীর কাছে উপস্থাপন করে। কমিশনের প্রতিবেদনে প্রাথমিক শিক্ষার দ্রুত প্রসার, নিরক্ষরতা দূর এবং বৃত্তিমূলক শিক্ষার ওপর অধিকতর গুরুত্ব আরােপ করা হয়। সরকার কমিশনের এই প্রতিবেদন সাধারণ্যে প্রকাশ করেনি বটে, তবে ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ৯০-দফা প্রশ্নমালা তৈরি করে তার ১০ হাজার কপি সাধারণ জনগণ, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, সাংবাদিক এবং অন্যান্য পেশার মানুষজনের কাছে বিতরণ করা হয়। বিলিকৃত প্রশ্নমালা সম্বন্ধে ঢালাওভাবে মতামত আহ্বান করা হয়। কমিশন ১৯৭৪ সালের মে মাসে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন তৈরি করে। বাঙালি জাতির দীর্ঘ আকাক্ষিত বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার গণতান্ত্রিক নীতিমালা সংবলিত বিধি তথা বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্স ১৯৭৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ঘােষিত হয়। এর মূল বক্তব্য ছিল নিম্নরূপ : বিশ্ববিদ্যালয়ে চিন্তার স্বাধীনতা ও মুক্ত বুদ্ধিচর্চার পরিবেশ সৃষ্টি করা, যার অর্থ হলাে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনে নিরঙ্কুশ সুশাসন প্রতিষ্ঠা, যা মুক্তবুদ্ধি চর্চার পথকে সুগম করবে। এই স্বায়ত্তশাসন কেবল সরকারের সাথে বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরেও এ নীতির প্রতিফলন অবশ্য প্রয়ােজন এবং এই নীতির কথাই বারবার উচ্চারণ করা হয়েছিল The University must honour the principle of collegiate equality in its own accademic structures. শিক্ষানীতি বিষয়ক এই দলিল প্রণয়ন বঙ্গবন্ধু সরকারের একটি মাইলফলক। এর আগে তিনি সরকারের দায়িত্ব প্রত্যক্ষভাবে গ্রহণ করে বাংলাদেশ সংবিধান প্রণয়নের কাজ দ্রুত সম্পন্ন করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ সংবিধান-১৯৭২’ তক্কালীন গণপরিষদে পূর্ণ বিতর্কের পর ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গৃহীত হয়েছিল। বাংলাদেশের সংবিধান ছিল হাতে লেখা। স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র ১৪ মাসের মধ্যে অর্থাৎ ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ বাংলাদেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ জাতীয় সংসদের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে নতুন মন্ত্রিসভা গঠিত হলে স্বাধীন দেশে সরকার শিক্ষাব্যবস্থা গণমুখী এবং সার্বজনীন করার লক্ষ্যে বিনামূল্যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করার পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এমন ব্যবস্থা পাকিস্তান আমলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে কল্পনাও করা যায়নি। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে বিভিন্ন শ্রেণীতে অটো প্রমােশনের জন্য দাবি উঠেছিল। এই দাবি ছিল অযৌক্তিক এবং বিরক্তিকর। সরকার এই অশুভ দাবির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করে। বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন এবং শিক্ষা কর্তৃপক্ষ সরকারের অবস্থানের পক্ষাবলম্বন করে শিক্ষাক্ষেত্রে বিরাজমান নৈরাজ্য দূরীকরণে সরকার দৃঢ়সঙ্কল্প হলেও কিছু শিক্ষার্থী হঠাৎই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কয়েকজনকে ঘেরাও করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম.এ. প্রিলিমিনারি ক্লাসের শিক্ষার্থীগণ অটো প্রমােশনের দাবিতে উপাচার্য, বিভাগীয় প্রধান, ডিন, প্রভােস্ট, প্রক্টর প্রমুখকে প্রায় ছয় ঘণ্টা ঘেরাও করে রেখেছিল। উপাচার্যের কক্ষে অটো প্রমােশন প্রশ্নে তখন এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক চলছিল। বঙ্গবন্ধু ঘেরাও পরিস্থিতির কথা অবগত হওয়ামাত্র অকুস্থলে ছুটে যান এবং বিকেলের মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘেরাওকৃত শিক্ষকবৃন্দকে উদ্ধার করেন। শিক্ষকদের প্রতি এই অসৌজন্যমূলক আচরণ প্রদর্শন করায় তিনি ঘেরাওকারীদের প্রতি খুবই বিরক্ত হন এবং তার ক্ষোভ প্রকাশ করেন। জাতির জনক তাদের উদ্দেশে বলেন, “আমি ছাত্রজীবনে ছাত্ররাজনীতি করেছি। কিন্তু আমি কখনাে এ রকম অসদাচরণ করিনি।” এই ক্ষোভের সংবাদ তৎকালীন জাতীয় দৈনিকপত্রিকাতে ফলাও করে প্রকাশিত হয়। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর বঙ্গবন্ধুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গমনের ঘটনা এটিই প্রথম ছিল। প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ করে প্রাথমিক শিক্ষকগণের বেতন বৃদ্ধির ব্যবস্থা করা হয় বঙ্গবন্ধুর সরকারের সময়। শুধু তা-ই নয়, শিক্ষকদের সরকারি কর্মচারী হিসেবেও মর্যাদাদানের ব্যবস্থা এই সরকারের আমলে ১৯৭৩ সালের জুলাই মাস থেকে হয়। সরকারের এই যুগােপযােগী সুযােগ-সুবিধা প্রদানের ধারাবাহিকতা এখনাে অব্যাহত আছে।

উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে, সরকারের শিক্ষা, সংস্কৃতিবিষয়ক ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের ১৯৭৩ সালের ৬ জুলাই এক বিজ্ঞপ্তি মারফত বেসরকারি ৬৫০০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে সরকারের দায়িত্বে নেয়া হয়। শুধু তা-ই নয়, সরকারের দায়িত্বে গৃহীত ওইসব বিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দকে সরকারি কর্মকর্তার মর্যাদা দান করার এবং অন্যান্য সরকারি সুযােগ-সুবিধা দেওয়ার ঘােষণাও দেওয়া হয় পরবর্তীতে এতদসংক্রান্ত রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ-২২, ১৯৭৩ সালের ৩১ অক্টোবরে বাংলাদেশ গেজেটের অতিরিক্ত সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। আবার ১৯৭৩ সালের ২৮ ডিসেম্বর মন্ত্রণালয়ের ৭ সেপ্টেম্বরের এস ৭/৪৬৮ শিক্ষা সংখ্যক স্মারক দ্বারা গ্রামীণ এবং শহরের সাহায্যপ্রাপ্ত ১,৮৩৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, এম.এফ.পি, স্কুলের ২৬,৭৪৪টি এবং নিয়ন্ত্রিত ৫০৭টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ দায়িত্ব গ্রহণ করা হয়েছিল। স্বাধীনতা-উত্তরকালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কর্তৃক প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ ভারতীয় উপমহাদেশের পূর্ববঙ্গে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়, স্থাপন ও পরিচালনার ইতিহাস অনেক পুরনাে। প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহ প্রধানতঃ বেসরকারি পৃষ্ঠপােষকতায় স্থাপিত ও পরিচালিত হতাে। ১৯৪৭ সালে The Registration of Private Schools (Ordinancc, ১৯৬২ প্রবর্তনের মাধ্যমে একে প্রাতিষ্ঠানিক ও আইনগত রূপ দেয়া হয়।

জন শিক্ষকের চাকুরী সরকারীকরণ করা হয়। স্বাধীন দেশের উপযােগী বিষয়বস্তু-সমৃদ্ধ পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের ব্যবস্থাও বঙ্গবন্ধুর আমলেই সূচিত হয়। ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণীর পাঠ্যবই স্বল্পমূল্যে শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল ওই সরকারের আমলেই। বই বিতরণ যাতে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হতে পারে সেজন্য মুদ্রিত ও প্রকাশিত পাঠ্যপুস্তক সােনালী ব্যাংকের বিভিন্ন শাখার মাধ্যমে বিক্রয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা সহজলভ্য ও গণমুখী করার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু দেশে গণশিক্ষার প্রসারের ব্যাপারে তার দৃষ্টিভঙ্গির কথা তুলে ধরে বলতেন, “আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এ যাবৎ শুধু আমলাই সৃষ্টি করেছে, মানুষ সৃষ্টি করেনি।’ জনগণের হৃদয়ে শিক্ষার আলাে পৌছানাের জন্য তিনি শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের গ্রামে গিয়ে কাজ করার পরামর্শ দিতেন। এ ছাড়া, তিনি মুক্তিযুদ্ধে শহীদ শিক্ষক, অধ্যাপক এবং বুদ্ধিজীবীদের কথা সকলকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলতেন, এসব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষকও জড়িত ছিলেন, তাদের কখনাে ক্ষমা করা যায় না। অধিকন্তু তিনি শিক্ষার্থীদের উপদেশ দিয়ে এ কথাও বলতেন যে, নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য ছাত্ররাজনীতিতে জড়িত হওয়া উচিত নয়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে শিক্ষা গ্রহণকে সব নাগরিকের অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। সংবিধানে শিক্ষাবিষয়ক অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে যে, “ক, একই পদ্ধতির গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক। শিক্ষাদানের জন্য, সমাজের প্রয়ােজনের সহিত শিক্ষাকে সঙ্গতিপূর্ণ করিবার জন্য এবং সেই প্রয়ােজন সিদ্ধ করিবার উদ্দেশ্যে যথাযথ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সদিচ্ছা প্রণােদিত নাগরিক সৃষ্টির জন্য, গ. আইনের দ্বারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিরক্ষরতা দূর করিবার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা করিবে।” আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, ১৯৭২ সালের জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে বাংলাদেশ সরকার বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ড. মুহাম্মদ কুদরাত-ই-খুদার সভাপতিত্বে ১৯ সদস্যবিশিষ্ট একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করে। কমিশন গঠনের উদ্দেশ্য, লক্ষ্য, পটভূমি, কার্যাদি নিয়ে বলা হয় যে, “…এই নবজীবন সৃষ্টির অন্যতম চাবিকাঠি যে শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে নিহিত, সে সত্য এদেশের জনগণ দীর্ঘকাল পূর্বেই উপলব্ধি করেন। এ জন্যই শিক্ষাক্ষেত্রে সংস্কারের দাবি। …ছাত্র সমাজ বারংবার এসব প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে। আজ স্বাধীনতার নতুন প্রভাতে এই শিক্ষাব্যবস্থার পুনর্গঠন, তাই জাতির সম্মুখে একটি মৌলিক দায়িত্বরূপে দেখা দিয়েছে। বাঙালি জাতির প্রত্যাশানুসারে শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে এই কমিশন

——————

২, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান, ১৯৭২, অনুচ্ছেদ ১৭

————–

একটি প্রতিবেদন প্রণয়ন করে তা সরকারের কাছে পেশ করে ১৯৭৩ সালের ৮ জুন  তারিখে তার আগে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী রূপে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর জাতীয় শিক্ষা কমিশনের উদ্বোধন করেন। বাংলাদেশের জনগণের কাক্ষিত সমাজতান্ত্রিক সমাজ সৃষ্টির জন্য পুনর্গঠিত শিক্ষা-ব্যবস্থা সম্বন্ধে স্বাধীনভাবে কমিশনের সদস্যগণকে তাদের সুচিন্তিত পরামর্শ প্রদানের আহ্বান জানান। বাংলাদেশের সীমিত সম্পদের কথা স্মরণ রেখে কমিশনকে দীর্ঘমেয়াদি শিক্ষার রূপরেখা প্রণয়ন করতে বলেন। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেছিলেন যে, কশিমনের প্রণীত রূপরেখা শিক্ষা ক্ষেত্রে সার্থক ও সুদূরপ্রসারী সংস্কার সাধন করতে পারবে বলে তার বিশ্বাস। কমিশন বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস ও পুনর্গঠন সম্পর্কে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা দেয়। কমিশন প্রতিবেদনে বর্ণিত লক্ষ্যার্জনের জন্য অনেকগুলাে কার্যক্রমেরও প্রস্তাব দিয়েছিল। শিক্ষকের মর্যাদা বৃদ্ধি, আর্থিক সুবিধা বৃদ্ধি, সরকারি| বেসরকারি পর্যায়ভুক্ত শিক্ষকগণের বৈষম্য দূর করা তাদের প্রশিক্ষণ দান এবং গবেষণার সুযােগ দানের জন্য কমিশন গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব রাখে। বঙ্গবন্ধুর সরকারের রূপকাঠামাে অনুযায়ী কমিশন ১৯৭৩ সালের জুন মাসে একটি অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদন পেশ করে। প্রতিবেদনের অংশবিশেষ ছিল নিম্নরূপ :

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও তার বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে জনমত যাচাইয়ের জন্য একটি প্রশ্নমালা দেশের বিভিন্ন স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, নানাবিধ সংস্থা, শিক্ষাব্রতী, শিক্ষাবিদ এবং নেতৃবৃন্দের কাছে প্রেরিত হয়। প্রশ্নমালাটি সংবাদপত্র মারফতও প্রচারিত হয়। …বহু শিক্ষা দরদী স্বত:প্রবৃত্ত হয়ে কমিশনে বিস্তারিত স্মারকলিপি পাঠিয়েছেন।… জনমত যাচাইয়ের অন্যতম পন্থা হিসেবে এবং শিক্ষার তকালীন অবস্থার বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জনের উদ্দেশ্যে কমিশন সদস্যবৃন্দ দেশের প্রত্যেকটি জেলার বিভিন্ন অঞ্চল পরিভ্রমণ করেন। এ সময় তারা সর্বস্তরের বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করেন, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং অধ্যাপকগণের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, মেডিক্যাল কলেজ ও বহু সাধারণ কলেজের অধ্যক্ষ ও অধ্যাপকদের সঙ্গে এবং অন্যান্য স্তরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানপ্রধান ও শিক্ষক-শিক্ষিকার সঙ্গে আলাপআলােচনা করেন। বিভিন্ন স্থানে ছাত্র প্রতিনিধিদের সঙ্গেও তাদের আলাপ-আলােচনা হয়। এতদ্ব্যতীত নানা স্থানে শিক্ষাদরদী ও স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলােচনা সভায় তাদের মতামত সম্পর্কে অবহিত হন। এসব সফর থেকে তারা বহু মূল্যবান ইঙ্গিত পান ও শিক্ষা সংক্রান্ত ধ্যানধারণার সঙ্গে পরিচিত হন, শিক্ষায়তনগুলাের অবস্থা প্রত্যক্ষ করেন এবং গণসংযােগ ও জনমত যাচাইয়ের পরিপূর্ণ সুযােগ লাভ করেন। এসব অভিজ্ঞতা রিপাের্ট প্রণয়নে বিশেষ সহায়ক হয়। কমিশন গভীর চিন্তা, দীর্ঘ আলােচনা ও বিভিন্ন মতামত বিশ্লেষণের পর শিক্ষার বিভিন্ন বিষয়ে তাদের সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন। প্রায় চার শ’ জন সদস্য সম্বলিত ৩০টি অনুধ্যান কমিটি ও বিশেষ কমিটির মাধ্যমে শিক্ষাবিদ ও সুধী সমাজের উল্লেখযােগ্য অংশ কমিশনের সুপারিশ প্রণয়নে সহায়তা করেন। বিভিন্ন অনুধ্যান কমিটি ও বিশেষ কমিটির সদস্যবৃন্দ আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সাথে কমিশনকে সর্বতােভাবে সাহায্য করেন। প্রতিবেদনে তৎকালে দেশের সাড়ে তিন কোটি নিরক্ষর মানুষকে অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন। করার যে প্রস্তাব পেশ করা হয়েছিল তা যুগান্তকারী ছিল। এই প্রস্তাব অনুযায়ী মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে ১১ থেকে ৪৫ বছর বয়সী নিরক্ষর মানুষকে অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন করে তােলার  পরিকল্পনা করা হয়। উচ্চশিক্ষা গ্রহণেচ্ছুদের জন্য সাক্ষরতা অভিযান নামে একটি ব্যবস্থা প্রচলন করা হয়েছিল এবং এই অভিযানে তাদের অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক করার সুপারিশ ছিল। সুপারিশে ছাত্র-শিক্ষকগণকে এই কাজে উদ্বুদ্ধকরণ, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে নিরক্ষরতা মুক্তকরণ, দেশের সব শিক্ষক-শিক্ষিকাকে নিরক্ষরতামুক্তকরণের কাজে উদ্বুদ্ধকরণসংক্রান্ত বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল। মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ ধরনের মাধ্যমিক বিদ্যালয় গড়ে তােলার প্রস্তাবও কমিশন করেছিল। শুধু তা-ই নয় মেধাবী দরিদ্র বালক-বালিকারাও যাতে সরকারি বৃত্তি নিয়ে বিশেষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলােয় পড়তে পারে তার সুপারিশও প্রতিবেদনে ছিল। ক্যাডেট কলেজ ও রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুল প্রভৃতি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে কারিগরি  বিদ্যালয় কিংবা উন্নতমানের সাধারণ বা বিজ্ঞান শিক্ষা প্রদানের জন্য শিক্ষাঙ্গন রূপে প্রতিষ্ঠার কথাও এই প্রতিবেদনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কমিশন শিক্ষা খাতে পর্যাপ্ত অর্থ- | বরাদ্দের প্রস্তাবসহ জাতীয় আয়ের শতকরা পাঁচ ভাগ এবং দ্রুত শতকরা সাত ভাগ এই খাতে ব্যয় করার প্রস্তাব করেছিল। উল্লেখ্য, কমিশনের এই প্রস্তাব জাতিসংঘের প্রস্তাবের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে কমিশন যে প্রতিবেদন প্রস্তুত করে তা একটি স্বাধীন দেশের উপযােগী ছিল। বঙ্গবন্ধু তার স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কমিশনকে আগেই। গণমুখী প্রস্তাব ও সুপারিশ প্রণয়নের জন্য পরামর্শ দেন। বৃত্তিমূলক শিক্ষাকার্যক্রম। বৃত্তিমূলক শিক্ষাকার্যক্রম দশম শ্রেণীর পর চালু করার ওপর গুরুত্ব আরােপ করা হয়েছিল। প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল যে, বৃত্তিমূলক শিক্ষার ভিত্তি হবে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাব্যবস্থায়। বৃত্তিমূলক শিক্ষাকার্যক্রমের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ছিল শিক্ষার্থীদের বৃত্তিমূলক শিক্ষায় প্রয়ােজনমতাে প্রশিক্ষণ প্রদান করে পারদর্শী করে তােলা। এভাবে দক্ষ হয়ে ওঠা শিক্ষার্থীগণ কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করে তাদের যােগ্যতা প্রমাণ করতে পারবে এবং স্বাভাবিক জীবনযাপনে স্বচ্ছন্দ হয়ে উঠবে। কমিশন বৃত্তিমূলক যেসব বিষয় সম্বন্ধে প্রস্তাব করে তার । তালিকা নিচে উদ্ধৃত করা হলাে :

প্রস্তাবিত বৃত্তিমূলক বিষয়ে তালিকা ক, কারিগরি শিক্ষা : শিল্পভিত্তিক

(১) কাঠের কাজ, (২) ধাতুর কাজ, (৩) বিজলীর কাজ, (৪) যন্ত্রের কাজ, (৫) ফাউন্ড্রির কাজ, (৬) মােটর গাড়ি মেরামত, (৭) রেডিও মেরামত, (৮) গৃহনির্মাণ, (৯) ড্রাফটস ম্যানশিপ, (১০) মেরিন ডিজেল ইঞ্জিনের কাজ, (১১)

———–

৩, বাংলাদেশ শিক্ষ কমিশন প্রতিবেদন, ১৯৭৪, পৃ. ৪১-৪২

———–

ইলেকট্রোপ্লেটিং ও ধাতব শিটের কাজ, (১২) বয়ন শিল্প, (১৩) সীবন শিল্প ও এমব্রয়ডারির কাজ, (১৪) মুদ্রণ শিল্প, (১৫) গ্রাফিক আর্টস, (১৬) মৃৎ শিল্প, (১৭) চামড়ার কাজ ইত্যাদি। কৃষি ভিত্তিক (১) কৃষিবিদ্যা, শস্য উৎপাদন ও সংরক্ষণ, (২) মৎস্য উৎপাদন ও সংরক্ষণ, (৩) হাঁস-মুরগি ও পশুপালন, (৪) খাদ্য সংরক্ষণ ও পুষ্টিবিজ্ঞান, (৫) কৃষি যন্ত্রপাতি

(রক্ষণাবেক্ষণ) ইত্যাদি। গ. ললিতকলাভিত্তিক

(১) চিত্রাঙ্কন বিদ্যা, (২) কণ্ঠসঙ্গীত, (৩) যন্ত্রসঙ্গীত, (৪) নৃত্য, (৫) অভিনয় ও

আবৃত্তি ইত্যাদি। ঘ. ব্যবসা ও বাণিজ্যভিত্তিক

(১) টাইপ রাইটিং ও স্টেনােগ্রাফি, (২) বুক কিপিং ও হিসাব রক্ষণ, (৩) বাণিজ্যিকপদ্ধতি ও সেলসম্যানশিপ ইত্যাদি। চিকিৎসাভিত্তিক

(১) নার্সিং, (২) প্যারা মেডিক্যাল ইদ্যাদি। চ, অন্যান্য

(১) শিক্ষক শিক্ষণ, (২) ধর্মশিক্ষা, (৩) গ্রন্থাগার সহকারী শিক্ষণ, (৪) খেলনা তৈরি, (৫) প্লাস্টিক শিল্প, (৬) সাবান তৈরি, (৭) বাঁশ বেতের কাজ, (৮)

ক্যাটারিং ও হােটেল ব্যবস্থাপনা, (৯) বই বাঁধাই ইত্যাদি। বিজ্ঞান, কৃষি, বাণিজ্য, চিকিৎসা, আইন, লালিতকলা ইত্যাদি শিক্ষার জন্য বিস্তারিত পরিকল্পনার রূপরেখা পৃথকভাবে কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন প্রতিবেদনে উপস্থাপিত হয়। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য-সংস্কৃতি ঐতিহ্যের সাথে সমান তালে বাঙালি জাতিও যেন শিক্ষাদীক্ষায়, আচার-আচরণে অগ্রসর হতে পারে সে দিকে কমিশন বঙ্গবন্ধুর পরামর্শ অনুযায়ী খুবই সচেতন ছিল। কমিশন প্রদত্ত প্রতিবেদনের সুপারিশে বাংলাদেশে নারী শিক্ষার প্রসারের বিষয়ও বিশেষভাবে গুরুত্ব পায়। বাংলাদেশের জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি নারীসমাজ যাতে মূল্যবান অবদান। রাখতে এগিয়ে আসতে উদ্বুদ্ধ হয় সেদিকেও কমিশন লক্ষ রেখেছিল। বঙ্গবন্ধুর সরকার নারীসমাজকে পশ্চাদপদতা থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে কমিশনের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল। শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ কল্যাণকর করার জন্য কমিশন প্রদত্ত যুগান্তকারী প্রস্তাব সরকার বাস্তবায়নে পদক্ষেপ গ্রহণ করে। মুক্তিযুদ্ধ শেষে শিক্ষাক্ষেত্রে বিদ্যমান জটিল ও বিশৃঙ্খলা অবস্থার কথা উল্লেখ করে শিক্ষা কমিশন জাতীয় চার নীতির প্রতিফলন ঘটিয়ে শিক্ষার সব স্তরে বাংলা মাধ্যম প্রবর্তন, অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলককরণ,

বৃত্তিমূলক শিক্ষার সুযােগ সৃষ্টি, যুবশক্তিকে জাতীয় সেবাকর্মে উৎসাহিতকরণ ইত্যাদি বিষয় এই প্রতিবেদনে জোর দিয়ে উল্লেখ করা হয় কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনের এতদসংক্রান্ত প্রতিবেদনটি নিম্নরূপ ছিল :

শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কারে অগ্রাধিকার বিষয় (১) আমাদের শিক্ষাক্ষেত্র বর্তমানে অসংখ্য জটিল সমস্যায় সমাকীর্ণ। একই সঙ্গে

সকল সমস্যার সমাধান সম্ভব নয় এবং সে প্রচেষ্টা বাস্তবানুগ হবে না। তাই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রধান প্রধান সমস্যার সমাধান করতে হবে। (২) শিক্ষা কমিশন রিপাের্টে যেসব বিষয়ের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরােপ করা হয়েছে সেগুলাে হচ্ছেক. শিক্ষার সর্বস্তরে জাতীয় মূলনীতি চতুষ্টয়ের সার্থক প্রতিফলন সুনিশ্চিত করতে হবে। সর্বস্তরে বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যমরূপে ব্যবহার করতে হবে। এ সুপারিশ বাস্তবায়নের পথে যেসব অসুবিধা রয়েছে সেগুলাে জরুরি ভিত্তিতে দূরীভূত করতে হবে। সরকারি অর্থানুকুল্যে উচ্চশিক্ষার বইপুস্তক, বিশেষ করে বিজ্ঞান, কারিগরি, প্রকৌশল ও বৃত্তি শিক্ষা বিষয়ের

বই-পুস্তক প্রণয়ন এবং অনুবাদের কাজে অবিলম্বে হাত দিতে হবে। গ, প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষাকে চিহ্নিত করে তাকে সার্বজনীন

করতে হবে। ১৯৮০ সালের মধ্যে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত এবং ১৯৮৩ সালের মধ্যে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করতে হবে। প্রাথমিক স্তর থেকেই বিজ্ঞান শিক্ষাকে এবং কৃষি শিক্ষাকে বিশেষ স্থান দিতে হবে এবং তার মান সর্বস্তরে যথাসম্ভব উন্নীত করতে হবে। মাধ্যমিক স্তরে নবম শ্রেণী শেষে বৃত্তিমূলক শিক্ষার ব্যাপক সুযােগ সৃষ্টি করতে হবে, উচ্চস্তরে কারিগরি ও প্রকৌশল শিক্ষার প্রয়ােজনীয় সম্প্রসারণ করতে হবে। বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষাক্রম বাস্তবমুখী করার জন্য এসব শিক্ষায়তন ও সংশ্লিষ্ট কর্মপ্রদানকারী সংস্থাগুলাের মধ্যে গভীর যােগসূত্র প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। সর্বস্তরে কর্মকেন্দ্রিক শিক্ষাক্রমের প্রবর্তন করতে হবে। ১৯৮০ সালের মধ্যে দেশব্যাপী সর্বাত্মক প্রচেষ্টার মাধ্যমে এবং দেশের সমস্ত শিক্ষিত জনের সাহায্যে দেশ থেকে নিরক্ষরতার গ্লানি

দূর করত হবে।

জ, বর্তমান পরিবেশের পরিপ্রেক্ষিতে পরীক্ষা ও মূল্যায়ন-পদ্ধতির বিশেষ

—-

৪. বাংলাদেশ শিক্ষা কমিশন প্রতিবেদন, ১৯৭৪, পৃ. ২৬২-৬৩

——-

ঝ,সংস্কারসাধন করতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষায়তনগুলাের মধ্যে বিরাজমান বর্তমান বৈষম্য যত শীঘ্র সম্ভব দূরীভূত করতে হবে। পর্যায়ক্রমে বেসকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ জাতীয়করণ করার জন্য ১০ বছর মেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। ঞ. শিক্ষাপ্রশাসনের পুনর্বিন্যাস করে তাকে আরাে ব্যাপক ও সুসংহত করতে হবে। শিক্ষার সর্বস্তরে মেধাবী শিক্ষার্থীরা যাতে সুযােগ বা অর্থের অভাবে তাদের প্রতিভা ও প্রবণতা অনুযায়ী শিক্ষা থেকে বঞ্চিত না হয়, সে ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করতে হবে। দেশের যুব শক্তিকে জাতীয় সেবাক্রমে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। শিক্ষকতা কাজে যােগ্যতম ব্যক্তিকে আকৃষ্ট করার জন্য দেশের চাকুরিকাঠামােকে সর্বোচ্চপর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। শিক্ষাকে ব্যয়বহুল সমাজসেবামূলক কর্ম হিসাবে নয়, সম্পদ সৃষ্টির উপায় হিসাবে গণ্য করতে হবে। শিক্ষা খাতে সরকারি ব্যয়বরাদ্দের অনুপাত বর্তমানের শতকরা সাত থেকে অন্তত শতকরা পঁচিশে উন্নীত করতে হবে। এই ব্যয় এখন মােট জাতীয় আয়ের (জি.এন.পি) পাঁচ শতাংশে বর্ধিত

করে যত অল্প সময়ে সম্ভব শতকরা ৭ শতাংশে উন্নীত করা দরকার ।। (৩) শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামােগত পরিবর্তনের বিষয়টিও কমিশনের বিবেচনা লাভ

করে। এগার বছরের স্কুল-ব্যবস্থা এবং তিন বছরের ডিগ্রি কোর্স প্রবর্তনের ব্যাপারে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুপারিশ তারা করেন। এ পরীক্ষার ফল সন্তোষজনক হবে বলে তারা আশা করেন। তখন শিক্ষাব্যবস্থার প্রস্তাবিত কাঠামাে পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তা বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করতে হবে । আমাদের সার্বিক লক্ষ্যের পথে যদি আমরা অগ্রসর হতে পারি, তবে পাঁচ বছরের পর শিক্ষার মানােন্নয়নের সম্যক পর্যালােচনা ও মূল্যায়ন করে দশ বছরের স্কুলব্যবস্থা এবং চার বছরের ডিগ্রি কোর্স প্রবর্তনের বিষয়টি গুরুত্বের

সাথে বিবেচনা করা যেতে পারে। বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণের পর জাতীয় সংসদে গৃহীত ‘বাংলাদেশ সংবিধান-১৯৭২’ নির্দেশিত পথে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার কর্তৃক গঠিত ড. কুদরাত-ই-খুদা কমিশন যে শিক্ষা-প্রতিবেদন উপস্থাপন করে তা ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও জাতীয় আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন। বঙ্গবন্ধুর সরকার কুদরাত-ই-খুদা কমিশনের শিক্ষা-প্রতিবেদন গ্রহণ করে বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করে।

কিন্তু জাতির দুর্ভাগ্য স্বাধীনতাবিরােধী চক্রটি বাংলাদেশের অস্তিত্বে আঘাত হানতে প্রথম থেকে তৎপর ছিল। এই ষড়যন্ত্রকারীরা বিদেশি মদদপুষ্ট হয়ে সাম্রাজ্যবাদ, সম্প্রসারণবাদ ও সাম্প্রদায়িক মতবাদ এ দেশের মাটিতে প্রতিষ্ঠা করার অপচেষ্টায় ষড়যন্ত্র করে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। ষড়যন্ত্রকারীরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কুক্ষিগত করে ফেললে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে T’সােনার বাংলা’ হিসেবে গড়ার বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়ন এবং ওই স্বপ্ন বাস্তবায়নে পুরােধা। অর্থাৎ শিক্ষাব্যবস্থায় সংস্কার কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়ে। আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালের | ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হয়ে | আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে বঙ্গবন্ধু হত্যার রায় কার্যকর করার পদক্ষেপ গ্রহণ করে।

আপিল বিভাগ ২০০৯ সালের ১৯ নভেম্বর রায় চূড়ান্ত করার পর খুনিদের ফাঁসি কার্যকর | হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরােধীদের উৎপাটন করে বঙ্গবন্ধু সরকার সূচিত সব কার্যক্রম বাস্তবায়ন করার পরিস্থি–তি সৃষ্টি হয়েছে।

বঙ্গবন্ধুর সরকার যে শিক্ষা-কমিশন রিপোের্ট জাতিকে দিয়েছিল তাকেই মাইলফলক | হিসেবে গ্রহণ করে বাঙালি জাতির জন্য গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষা-ব্যবস্থা প্রবর্তিত | হবে এমন বিশ্বাস আমি প্রথম থেকেই করেছি। কারণ, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ বংশধরদের | জন্য কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে শিক্ষাব্যবস্থা নির্ধারিত হওয়ার মধ্যেই জাতির ভবিষ্যৎ নিহিত। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সরকার কর্তৃক ২০১০ সালে গৃহীত জাতীয় শিক্ষানীতি বাংলাদেশ সংবিধানের মূলনীতির সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় সমগ্র বাঙালি | জাতির স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। উল্লেখ, কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনের ভিত্তিকেও জাতির সমগ্র শিক্ষানীতি প্রণয়নে মূল স্তম্ভ হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে।

সরকার উৎখাতে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ব্রিটিশ এয়ারফোর্সের বিমানযােগে লন্ডন থেকে দিল্লি হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় আসেন ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে) আয়ােজিত সংবর্ধনা সভায় বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে বলেছিলেন, “গত ৭ মার্চ (১৯৭১) এই ঘােড়দৌড়ের ময়দানে আমি আপনাদের বলেছিলাম, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলুন। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। আপনারা বাংলাদেশের মানুষ সেই স্বাধীনতা এনেছেন। আজ আবার বলছি, আপনারা সবাই একতা বজায় রাখুন। ষড়যন্ত্র এখনও শেষ হয়নি।” ষড়যন্ত্র সম্পর্কে হুশিয়ারির পটভূমি দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ শেষে পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আন্তর্জাতিক প্রবল চাপের মুখে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছিল পাকিস্তান সরকার। মুক্তিলাভের পর লন্ডন-দিল্লি হয়ে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় এসেই সংবর্ধনা সভায় বঙ্গবন্ধু জনগণের উদ্দেশে ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন। তিনি তাঁর রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতার আলােকে বাঙালি জাতিকে ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ার থাকতে আহ্বান জানিয়েছিলেন। এই হুঁশিয়ারি উচ্চারণের মূলে ছিল তাঁর শৈশবকৈশাের যৌবনকালে দেখা বাঙালি জাতির দুঃখদুর্দশা। জন্মভূমির সাধারণ মানুষজনের দৈন্য-ব্যথা-বেদনা দূর করতে, লাঞ্ছনা-বঞ্চনা-অত্যাচার-শােষণক্লিষ্ট জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন। তাঁর আত্মােৎসর্গের এই মহান গুণের ধারাবাহিক ইতিহাস আছে। পারিপার্শ্বিক পরিবেশ-পরিস্থিতি, সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা, সাধারণ মানুষের জীবনধারণপদ্ধতি, সমাজের স্বার্থান্বেষী গােষ্ঠীর আচরণ, শাসক শ্রেণীর অন্যায়-অত্যাচার-নিপীড়ন-নিগ্রহ  ইত্যাদি বিদ্রোহী করে তুলেছিল ইংরেজ শাসনামলের ১৯২০ সালের ১৭ মার্চে তৎকালীন ফরিদপুর জেলার গােপালগঞ্জ মহকুমার (বর্তমানে জেলার) টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণকারী | শেখ মুজিবুর রহমানকে তার শৈশবকাল থেকেই। তার পূর্বপুরুষেরা ইংরেজদের কখনাে  সহ্য করতে পারত না। এ জন্য তারা প্রথম দিকে ইংরেজি চর্চা করেননি। পরে তার দাদার।

———–

১. শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, ঢাকা, ইউপিএল, ২০১২, পৃ. ৭

——–

আমল থেকে শেখ বংশের মানুষজন ইংরেজি লেখাপড়া শুরু করলে শেখ মুজিবও ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করেন। কিন্তু ইংরেজবিরােধী মনােভাব তার অন্তরেও গড়ে উঠেছিল। সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র থাকাকালে বেরিবেরি ও চোখের রােগে আক্রান্ত হন। এজন্য তার লেখাপড়া প্রায় দুই বছর বন্ধ ছিল। সময়টাও ছিল স্বদেশী আন্দোলনের। লেখাপড়া, খেলাধুলা বন্ধ থাকায় বিকেলে সভাসমিতিতে যাওয়ার নেশা তাকে পেয়ে বসে। এরই মধ্যে (১৯৩৭ সালে) শেখ মুজিব আবার লেখাপড়া শুরু করেন এবং সমাজ সেবামূলক সংগঠন “মুসলিম সেবা সমিতির সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। শেখ মুজিবের জীবনে এ সময়ের (১৯৩৮ সালে) আরেকটি উল্লেখযােগ্য ঘটনা তার রাজনৈতিক জীবনে পরবর্তীকালে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। তকালীন বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরেবাংলা এবং শ্রমমন্ত্রী হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর গােপালগঞ্জ আগমনকে কেন্দ্র করে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দের রাজনৈতিক বৈরী আচরণ শেখ মুজিবের মনকে আলােড়িত করে। এই সময় গােপালগঞ্জের অন্য একটি ঘটনায় শেখ মুজিবকে সাত দিন জেলে কাটাতে হয়েছিল। এটাই ছিল শেখ মুজিবের জীবনে প্রথম জেল। এরপর ১৯৩৯ সালে শেখ মুজিব কোলকাতায় বেড়াতে গিয়ে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীকে গােপালগঞ্জে মুসলিম ছাত্রলীগ এবং মুসলিম লীগ গঠনের কথা বলেন। দুটি সংগঠনই গঠিত হয়েছিল। শেখ মুজিব মুসলিম ছাত্রলীগ সংগঠনের সম্পাদক হয়েছিলেন। ষড়যন্ত্র উৎখাতে রাজনীতিতে সক্রিয় বঙ্গবন্ধু রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে শেখ মুজিব ইংরেজ আমলের অন্যায়-অবিচার-অত্যাচারের কথা মনে রেখে সব ধরনের রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে পড়েছিলেন। পাকিস্তান সৃষ্টির আন্দোলনের সঙ্গেও তার সক্রিয় ভূমিকা ছিল। বহুজাতি অধ্যুষিত ভারতীয় উপমহাদেশ ১৯৪৭ সালে বিভক্ত হয়ে দুটি রাষ্ট্র ভারত ইউনিয়ন এবং পাকিস্তানের জন্ম হয় । বিভক্ত হওয়ার আগে ১৯৪৬ সালে মুসলিম লীগের দিল্লি কনভেনশনে মি. জিন্নাহ। চাতুরির আশ্রয় নিয়ে লাহাের প্রস্তাবের (১৯৪০ সালের) “স্টেটস” শব্দটির পরিবর্তন করে শুধু “স্টেট” করে নেন। এভাবে পাকিস্তানে জাতি-শাসন এবং শােষণের ষড়যন্ত্র শুরু হয়। পাকিস্তানের দূরবর্তী পূর্বাংশ যাকে ১৯৪৭ সালে পূর্ব পাকিস্তান নামে অভিহিত করা হয় সেই পূর্ববঙ্গ তথা বাংলাদেশকে উপনিবেশে পরিণত করে রাখার অপচেষ্টা চালানােরও ষড়যন্ত্র করা হয়। শুধু তা-ই নয়, পাকিস্তান সৃষ্টির মাত্র সাত মাসের মাথায় ১৯৪৮ সালে (মার্চ মাসে) পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে তা নিয়েও চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র হয়। পাকিস্তানের পূর্বাংশের বাঙালি জনগণ রাষ্ট্রভাষা নিয়ে ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে। প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ১১ মার্চ গঠিত হয়। প্রতিবাদ দমাতে পাঞ্জাবি শাসক গােষ্ঠী বাঙালি জাতির উপর মধ্যযুগীয় অত্যাচার, নিপীড়ন, গুলিবর্ষণ, হত্যা, গ্রেপ্তার শুরু হয়। এ সময় নিরীহ বাঙালি পুলিশ কিছু দাবিদাওয়া নিয়ে ধর্মঘট করে। আইয়ুব খানের নেতৃত্বে বাঙালি পুলিশদের

——————-

২. শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, ঢাকা, ইউপিএল, ২০১২, পৃ. ৮-৯ ৩. প্রাগুপ্ত, পৃ. ১৩ ৪, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪

————-

উপর নির্বিচার গুলি চালিয়ে বহু পুলিশের রক্তে রঞ্জিত করা হলাে ঢাকা লালবাগ কেল্লার সবুজ মাটি। পূর্ববাংলার তরুণ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এই ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাতে সমবেত হয়েছিল ঢাকার আরমানিটোলার ময়দানে। মি. জিন্নাহ ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করলে উর্দুভাষী বাঙালি খাজা নাজিমুদ্দিন পাকিস্তানের গভর্নর। জেনারেল হন। প্রধানমন্ত্রী নবাবজাদা লিয়াকত আলী খান এবং গভর্নর জেনারেল খাজা। নাজিমুদ্দিন মিলে ষড়যন্ত্র শুরু করলেন শুধু বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে নয়, সমগ্র বাঙালি জাতির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে। জনগণের লাখ লাখ টাকা ব্যয় করে বাংলা ভাষা থেকে বাংলা শব্দ ছাঁটাই করা শুরু হয় এবং উর্দু হরফে বাংলা লেখা প্রচলনের ষড়যন্ত্র করা হয়। এতে বাঙালি জনগণ উর্দু শব্দের অর্থ বুঝতে পদে পদে বাধাগ্রস্ত হতে থাকে। বাঙালি তরুণ বুদ্ধিজীবী-রাজনীতিকগণ এই অপতৎপরতার প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে গ্রেপ্তার হন। বাংলা সংস্কৃতিকে উচ্ছেদে পরবর্তীতে আইয়ুব আমলে বাংলা বর্ণমালা এবং রবীন্দ্রসঙ্গীতবিরােধী। সরকারি অভিযানও ছিল গভীর ষড়যন্ত্র। বাঙালির সাংস্কৃতিক জাগরণ, পুলিশ-বিদ্রোহ এবং ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে ১৯৪৯ সালে ঢাকায় গঠিত হয় আওয়ামী মুসলিম লীগ যা পরবর্তীকালে হয় আওয়ামী লীগ। | লিয়াকত-মন্ত্রিসভা ১৯৫০ সালের শেষ দিকে পাকিস্তানের সংবিধানের রূপরেখা হিসেবে বেসিক প্রিন্সিপলস কমিটির (বিপিসি-র) প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এই প্রতিবেদনে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার কথা বলা হয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, এতে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পরিষদে সংখ্যাগুরু পূর্ববঙ্গকে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে) সংখ্যালঘুতে পরিণত করার কৌশলও ছিল। পূর্ববাংলায় নবজাত আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে শুরু হয় বিপিসি-বিরােধী আন্দোলন। আন্দোলন চলাকালে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান আততায়ীর গুলিতে নিহত হলে খাজা নাজিমুদ্দিন তাঁর গভর্নর জেনারেল পদ থেকে অব্যাহতি না নিয়েই রাতারাতি প্রধানমন্ত্রী পদে নিযুক্ত হন। নাজিমুদ্দিন ঢাকায় এসে মি. জিন্নাহর অনুকরণে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। করার ঘােষণা দিয়ে ষড়যন্ত্র উসকে দেন। বাঙালি জনগণ আবার প্রতিবাদমুখর হয়। প্রাদেশিক পরিষদে বাংলা ভাষাকে সরকারি ভাষা করার মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিনের প্রস্তাব গৃহীত হয়। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকেরা দেশকে নিয়ে ষড়যন্ত্র অব্যাহত রাখে, তারা পাকিস্তানকে সামরিক চুক্তি জোটে ভেড়ায়। এর বিরুদ্ধেও পূর্ব পাকিস্তানে প্রবল আন্দোলন গড়ে ওঠে। পাকিস্তানের পাঞ্জাবি সামরিক বুর্জোয়া জোট কিছুতেই পূর্ববঙ্গকে প্রশাসন ব্যবস্থায় অংশীদার করতে চায়নি। তারা গণপরিষদ ভেঙে দিয়ে সংবিধান প্রণয়ন বাধাগ্রস্ত করার পাঁয়তারা করে। এ সময় (১৯৫৪ সালে) পূর্ব পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগ শােচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। যুক্তফ্রন্ট একুশ দফার ভিত্তিতে বিজয়ী হলে পাঞ্জাবি সামরিক শাসকচক্র শঙ্কিত হয়ে পড়ে। তারা মিথ্যা অজুহাতে যুক্তফ্রন্ট সরকারকে গদিচ্যুত করে। মুখ্যমন্ত্রী ফজলুল হককে গৃহবন্ধী করা হয়। শেখ মুজিবসহ হাজার হাজার রাজনৈতিক নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হন। ১৯৫৫ সালে গণপরিষদ ভেঙে দিয়ে

—————-

৫, আবদুল গাফফার চৌধুরী, স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস (বাংলাদেশের প্রথম বিজয় দিবস বার্ষিকী

উপলক্ষে স্মারক গ্রন্থ ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭২ দ্রষ্টব্য)

—————-

একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা হয়। পাকিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বার্থে পূর্ববঙ্গ তার সংখ্যাগরিষ্ঠতার দাবি থেকে সরে আসে। এর আগে পূর্ববঙ্গের জনগণ চরম স্বার্থ ত্যাগ করে সংখ্যালঘু অঞ্চল পশ্চিম পাকিস্তানে কেন্দ্রীয় রাজধানী এবং সামরিক হেডকোয়ার্টার্স স্থাপনের সম্মতি দিয়েছিল। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হলাে, পাকিস্তানের পূর্ব ও পশ্চিম অঞ্চলে সমানাধিকারের ভিত্তিতে চাকরি-বাকরি, ব্যবসাবাণিজ্য, জাতীয় পরিষদে উভয় অঞ্চলের সমানসংখ্যক সদস্য হবে। সংখ্যাসাম্য নীতির ভিত্তিতে ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণয়ন ও গৃহীত হয়। পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয় গৃহীত হলাে বটে, কিন্তু ষড়যন্ত্র অব্যাহত ছিল। ফলে, ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা তুচ্ছ অজুহাতে সংবিধান, মন্ত্রিসভা বাতিল করে সামরিক আইন জারি করেছিলেন। কিন্তু আইয়ুব খানের ক্ষমতা দখলের ভিতর দিয়ে তিনি ২৭ অক্টোবরে বিতাড়িত হলে পাকিস্তান থেকে গণতন্ত্র সম্পূর্ণরূপে নির্বাসিত হয় এবং জাতীয় অধিকার হরণ করে পূর্ব বাংলাকে শ্মশানে পরিণত করা হয়। পরবর্তীতে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীকে গ্রেফতারের প্রতিবাদে ১৯৬২ সালে পূর্ববঙ্গে তুমুল আন্দোলন শুরু হয়। স্বাধিকারের বজ্রকণ্ঠ উচ্চারিত হলাে শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য নেতার নামে প্রচারিত ইশতেহারে। ঐতিহাসিক ইশতেহারের ভাষা ছিল পূর্ব বাংলা রুখে দাঁড়াও। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলনকে স্তব্ধ করতে ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ১৯৬৪ সালে ৮০ হাজার মৌলিক গণতন্ত্রী সৃষ্টি করলেন। বেসিক ডেমােক্রেসির নির্বাচনে আইয়ুব জিতলেন। পূর্ববঙ্গে পাকিস্তানি শাসকবৃন্দের শােষণের মাত্রা আরাে প্রকট হয়ে দেখা দিলাে ১৯৬৫ সালে মাত্র ১৭ দিন স্থায়ী পাক-ভারত যুদ্ধের পর। পূর্ববঙ্গে বন্যা-নিয়ন্ত্রণে যেখানে কোনাে উদ্যোগই নেওয়া হয় না, সেখানে পূর্ববঙ্গের টাকায় পশ্চিম পাকিস্তানে পঁচিশ বছরে তিনটি রাজধানী শহর (করাচি, রাওয়ালপিন্ডি, ইসলামাবাদ) তৈরি হয়ে যায়। তক্কালে জাতিসংঘের পিয়ারসন রিপাের্টে পূর্ববঙ্গের (পূর্ব পাকিস্তানের) প্রতি বৈষম্যের কথা স্বীকৃত হয়। মােট কথা পাকিস্তান আমলের পঁচিশ বছরই পাকিস্তানি সামরিক শাসকবৃন্দ পূর্ববঙ্গের বিরুদ্ধে শুধু ষড়যন্ত্র-চক্রান্তই করেছে। ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের পটভূমিতে ১৯৭০ সালের নির্বাচন এমন ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের পটভূমিতে ১৯৬৫ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব গ্রহণকারী শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালে বাঙালি জাতির মুক্তি সনদ (ম্যাগনাকার্টা) ৬-দফা ঘােষণা করেন। পাকিস্তানি সামরিক শাসকবৃন্দ নিষ্ক্রিয় থাকেনি, ষড়যন্ত্র অব্যাহত রাখে। আইয়ুবপ্রশাসন আগরতলা মামলায় শেখ মুজিবের প্রহসনমূলক বিচার শুরু করে, কিন্তু পূর্ববঙ্গে ১৯৬৯ সালের আন্দোলন রূপান্তরিত হয় প্রবল গণ-আন্দোলনে। শেখ মুজিবের সঙ্গে ৬-দফা নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক শাসক এবং নেতৃবৃন্দের কোনাে মতৈক্য হলাে না।  জেনারেল ইয়াহিয়ার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে আইয়ুব সরে দাঁড়ান। ইয়াহিয়া লিগাল ফ্রেমওয়ার্কের অধীনে সাধারণ নির্বাচনের ঘােষণা দিলেন। ঘােষণা অনুযায়ী ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে সাধারণ নির্বাচনও হলাে। আওয়ামী লীগ সারা পূর্ববঙ্গে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়ী হয়ে সমগ্র পাকিস্তানের প্রতিনিধি রূপে আবির্ভূত হলাে। ওদিকে পশ্চিম পাকিস্তানে শুধু সিন্ধু ও পাঞ্জাবে জয়ী হয়ে জুলফিকার আলী ভুট্টো সারা পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব দাবি করলেন এবং শেখ মুজিবের ৬-দফা মেনে নেবেন না বলে ঘােষণা দিয়ে আর এক ষড়যন্ত্রের সূচনা করলেন। 

কিন্তু, আসনসংখ্যার নিরিখে সমগ্র পাকিস্তানে পিপলস পার্টির নেতা ভুট্টো সংখ্যালগিষ্ট দলের নেতা ছিলেন। তবু তিনি সামরিক শাসকদের দিয়ে ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করলেন। তিনিও ক্ষমতার অংশীদারিত্ব দাবি করলেন। এতে ইয়াহিয়া পাঞ্জাবি শাসকচক্রের ক্রীড়নকে পরিণত হন এবং পূর্ববঙ্গের সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী দল আওয়ামী লীগের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ক্ষমতায় বসতে না দেওয়ার ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ষড়যন্ত্র ফাস হয় বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে ১৯৭১ সালের ৭ জানুয়ারি ধৃত ছােরা হাতে গােলাম মােস্তফা নামে এক যুবকের স্বীকারােক্তিতে। চট্টগ্রামে গাড়ি-দুর্ঘটনায় বঙ্গবন্ধুকে হত্যার চেষ্টাও ব্যর্থ হয়। অন্য দিকে ৩০ জানুয়ারি একটি ভারতীয় বিমান লাহােরে হাইজ্যাক করে নামায় পাকিস্তানি গুপ্তচর। ভুট্টো হাইজ্যাকারদের অভিনন্দন জানিয়ে ভারত পাকিস্তান সম্পর্কে উত্তেজনা সৃষ্টিতে উসকানি দেন। অপরপক্ষে বঙ্গবন্ধু হাইজ্যাকের ঘটনাকে চক্রান্ত আখ্যায়িত করে তীব্র নিন্দা জানান। পূর্ববঙ্গের জনগণের বিরুদ্ধে অব্যাহত ষড়যন্ত্রের একপর্যায়ে ২৬ ফেব্রুয়ারি ইয়াহিয়া-ভুট্টো গােপন বৈঠক করলেন । ঢাকার কয়েকটি আধা সরকারি অফিসে গােপনে বােমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা হলাে যে, পাকিস্তানে বিশেষ করে ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অনুষ্ঠান করার মতাে পরিবেশ নেই। ভুট্টো ২৮ ফেব্রুয়ারি ঘােষণা করলেন : জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখতে হবে। তার দলের সদস্য ছাড়া পরিষদের বৈঠক বসলে তিনি করাচি থেকে খাইবার পর্যন্ত আগুন জ্বালাবেন। ভুট্টোর হুমকিতে ষড়যন্ত্রের অংশীদার ইয়াহিয়া নাটকীয়ভাবে পরিষদের অধিবেশন ১ মার্চ (১৯৭১) অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘােষণা করেন। ইয়াহিয়ার এই অভাবিত ঘােষণায় পূর্ববঙ্গ গর্জে উঠল। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ রমনা রেসকোর্স ময়দানে (সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে) ভাষণে বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানিয়ে বললেন  এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা সংগ্রামের আহ্বানের সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক শাসকবৃন্দ ষড়যন্ত্রের নতুন অধ্যায় শুরু করেন। তাদের সঙ্গে যুক্ত হন ভুট্টো এবং পাকিস্তান মুসলিম লীগসহ পশ্চিম পাকিস্তানের আরাে কিছু ধর্মাশ্রয়ী রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলােচনার নামে গােপনে পূর্ববাংলায় সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। আলােচনার শেষপর্যায়ে ২৩ মার্চ ইয়াহিয়া বেতার ঘােষণায় বলেন জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের একসঙ্গে কাজ করার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে এবং একত্রে থাকার পারস্পরিক স্বেচ্ছাসম্মতির ওপরই রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। ইয়াহিয়া খান

———————————

৬. আবদুল গাফফার চৌধুরী, স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস (বাংলাদেশে প্রথম বিজয় দিবস উপলক্ষে

 স্মারক গ্রন্থ, ১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৭২ দ্রষ্টব্য)

———————-

২৫ মার্চ বিকেলে গােপনে ঢাকা ত্যাগ করেন এবং সন্ধ্যা থেকে শুরু হয় ঢাকায় গণহত্যা। অভিযান। বঙ্গবন্ধু তার সহকর্মীদের প্রয়ােজনীয় নির্দেশ দান করে ২৬ মার্চ রাতের প্রথম প্রহরে চট্টগ্রাম বেতার থেকে স্বাধীনতার ঘােষণা প্রচার করার ব্যবস্থা করেন। স্বাধীনতার ঘোষণায় শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আস্থা স্থাপন এবং তাঁর নির্দেশ মেনে চলার জন্য বাঙালি সৈন্য, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও জনগণের প্রতি আহ্বান জানানাে হয়।  ষড়যন্ত্রমূলক গণহত্যা প্রতিরােধে ১০ এপ্রিল মুক্ত অঞ্চলের তত্ত্বালীন কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় আশ্রয় গ্রহণকারী উল্লেখযােগ্যসংখ্যক আওয়ামী লীগের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি (এমএনএ এবং এমপিএ) তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে এক সমাবেশে মিলিত হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘােষণাপত্র প্রচারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তাঁরা তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি এবং সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপতি করা হয়। তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী এবং ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, খন্দকার মােশতাক আহমদ ও এ. এইচ, এম, কামারুজ্জামানকে মন্ত্রীর দায়িত্ব দিয়ে সরকারের মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। এই সমাবেশে মতৈক্য হয় যে, রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের অবর্তমানে উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। এভাবে গঠিত বাংলাদেশ সরকারের সদস্যগণ ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে শতাধিক দেশি-বিদেশি সাংবাদিকের উপস্থিতিতে শপথ গ্রহণ করেন। ষড়যন্ত্রমূলক বাঙালি জাতির ওপর চাপিয়ে দেওয়া মুক্তিযুদ্ধ এদের নেতৃত্বে গঠিত সরকারের নিয়ন্ত্রণ ও নির্দেশনায় নয় মাস চলেছিল। পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিকে যুদ্ধ ঘােষণা করলে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় বাহিনীর কাছে অবরুদ্ধ নব্বই হাজার পাকিস্তানি সৈন্য ঢাকায় আত্মসমর্পণ করে। এভাবে বাঙালি জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিণত হয়।

কিন্তু পরাজিত পাকিস্তান পাঞ্জাবি শাসকচক্রের ষড়যন্ত্র শেষ হয় না। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানসহ মুক্তিযুদ্ধের বিরােধিতাকারী দেশগুলাে এবং তাদের বাংলাদেশীয় দোসরদের ষড়যন্ত্র সম্বন্ধে আগেই টের পেয়েছিলেন। তাই তিনি ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে প্রথমে লন্ডন, পরে দিল্লি হয়ে ১০ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় পৌছে তাঁর ভাষণে বলেন : বাংলাদেশ এবং বাঙালি জাতির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র এখনাে শেষ হয়নি। স্বাধীন বাংলাদেশে ষড়যন্ত্রের জাল পাকিস্তান সৃষ্টির পর বাঙালি জাতির বিরুদ্ধে যে যড়যন্ত্র জোরেশােরে শুরু হয় বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের শাসনভার নিজ হাতে গ্রহণ করার পর তা ভিন্ন মাত্রায় প্রকাশ পেতে শুরু করে। ষড়যন্ত্রের এই খেলায় যুক্ত হয় এদেশীয় বিশ্বাসঘাতকের দল। এরা মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর দোসর হিসেবে তৎপর ছিল। এই দোসরদের অন্তর্ভুক্ত ধর্মাশ্রয়ী রাজনৈতিক দলগুলাে ছাড়াও এ দেশীয় স্বাধীনতাবিরােধী শক্তি বিশেষ করে পাকিস্তান। সমর্থনপুষ্ট মাওবাদীরা আওয়ামী লীগ সরকারবিরােধী অপপ্রচার এবং নাশকতামূলক কার্যকলাপ শুরু করেছিল। সামরিক বাহিনীর উচ্চাভিলাষী কিছু ব্যক্তি এই সুযােগ গ্রহণ করে। সাম্রাজ্যবাদী এবং ইসলামি কিছু রাষ্ট্রেরও বাংলাদেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিতে ইন্ধন যে ছিল না তা বলা যাবে না। পাকিস্তানই তার পরাজয়ের প্রতিশােধ নিতে এসব দেশিবিদেশি দোসরদের সমর্থন নিতে প্রয়াসী হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু কিন্তু বাংলাদেশে নাশকতামূলক কার্যকলাপ সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। তিনি ১৯৭৫ সালে ২৫ জানুয়ারি এবং ২৬ মার্চ দুটি ভিন্ন ভিন্ন ভাষণে বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরােধীদের তৎপরতা সম্পর্কে দেশবাসীকে সজাগ থাকতে আহ্বান জানান। তিনি বলেন, এক দল লােক পাকিস্তান থেকে পাওয়া অস্ত্র দিয়ে নিরপরাধ লােককে হত্যা করছে। এমনকি তারা পাঁচজন সংসদ সদস্যকেও হত্যা করেছে। তিন-চার হাজার রাজনৈতিক কর্মীকেও তারা হত্যা করেছে। এদের মধ্যে মুক্তিযােদ্ধাও ছিলেন।… কেউ কেউ বিদেশিদের কাছ থেকে পয়সা এনে বাংলার স্বাধীনতার বিরুদ্ধে। ষড়যন্ত্র করছে। প্রতি বিপ্লবের মাধ্যমে যারা ক্ষমতা দখলের স্বপ্ন দেখছিল, তাদের মধ্যে ছিল সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টি, আবদুল হকের পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি, তােয়াহার সাম্যবাদী দল এবং জলিল-রবের জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীও প্রতিবিপ্লবের হুমকি দেন। নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের কারণে বাংলাদেশের আর্থিক কাঠামাে ভেঙে পড়ায় নিত্যপ্রয়ােজনীয় দ্রব্যমূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায়। এতে জনগণের মধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। মওলানা ভাসানী এই অস্বাভাবিক অবস্থা এবং জনগণের মধ্যে সৃষ্ট অস্থিরতার সুযােগ নিয়ে বিপ্লবের হুমকি। দেন। মাওপন্থী, ধর্মান্ধ ব্যক্তি এবং পাকিস্তানপন্থীদের উসকে দিয়ে তিনি বাংলাদেশে প্রতিবিপ্লবের আয়ােজন করেন। মওলানা ভাসানী এক জনসভায় ১৯৭২ সালের ৩ সেপ্টেম্বর বলেন, জনগণের ইচ্ছায় সরকার পরিচালিত হবে। জনগণকে বাদ দিয়ে সরকার চলতে পারে না। তিনি দাবি করেন, “সর্বদলীয় সরকার চাই; অন্নবস্ত্র দাও, না হলে গদি ছাড়।” তিনি আরাে বলেন যে, গণপরিষদ ও মন্ত্রিসভা ভেঙে দিয়ে জাতীয় কনভেনশন ডেকে জাতীয় সরকার গঠন করতে হবে। সভা শেষে তিনি এক ভুখা-মিছিল নিয়ে গণভবনে গিয়ে ১৮-দফা স্মারকলিপি পেশ করেন। বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে মওলানা ভাসানীর অবস্থান গ্রহণও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের দৃষ্টিতে চক্রান্তেরই নামান্তর হিসেবে বিবেচিত। বিশ্লেষকদের এই ধারণার সপক্ষে বলা যায় যে, ১৯৭১ সালে মুজিবনগরে মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগের বৈধতা স্বীকার করে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনকারী দল এবং সংগঠনগুলাের প্রতিনিধিদের বলেছিলেন, ১৯৭০

——————–

৭. জাতীয় সংসদে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি দ্বিতীয় বিপ্লব, জাতীয় ঐক্য গঠন ও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা

এবং সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে ২৬ মার্চ দ্বিতীয় বিপ্লব সম্পর্কে প্রদত্ত ভাষণ । (বঙ্গবন্ধু পরিষদ, বাংলাদেশের সমাজবিপ্লবে বঙ্গবন্ধুর দর্শন, ১৯৭৯, পৃ-২০৪-২২৫)। Joyti Sen Gupta, I listory of the lreedom Movement in Bangladesh, 1947-1973, Max Prakash, Calcutta, 1974, p. 475 গণকণ্ঠ, ঢাকা, ৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৭২


সালের নির্বাচনে পরাজিত প্রতিনিধিদের নিয়ে সর্বদলীয় মন্ত্রিসভা গঠন করা সম্ভব নয়।১০ অথচ সেই মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগ সরকারের বৈধতা থাকা সত্ত্বেও ১৯৭২ সালে সর্বদলীয় সরকার গঠনের দাবি উত্থাপন করেন। মুজিববিরােধী তৎপরতা চালানাে সম্পর্কিত অসংখ্য তথ্য ইতােমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলজে তাঁর “বাংলাদেশ দি আনফিনিসড রেভলিউশন” নামক গ্রন্থে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে খন্দকার মােশতাক এবং মুজিব হত্যাকারী সামরিক অফিসারদের যােগাযােগ সম্পর্কে বহু তথ্য সন্নিবেশিত হয়েছে। এ ছাড়াও জুলফিকার আলী ভুট্টোর জীবনী-লেখক স্ট্যানলি উলপার্ট তাঁর “জুলফি ভুট্টো অব পাকিস্তান হিজ লাইফ অ্যান্ড টাইমস” বইতে এমন কিছু তথ্য উল্লেখ করেছেন যা থেকে মুজিববিরােধী ষড়যন্ত্রের প্রমাণ পাওয়া যায়। উপার্ট উল্লেখ করেছেন যে, ভুট্টো মুজিববিরােধী কয়েকটি দলকে তার গােপন স্বেচ্ছাধীন তহবিল (discretionary funds) থেকে অর্থসাহায্য অব্যাহত রেখেছিলেন। আগস্ট মাস (১৯৭৫) শেষ হওয়ার আগেই ভুট্টো তার বিনিয়ােগের ফল লাভ করেন। ঐ বইতে আরাে কিছু তথ্য আছে যেগুলাে থেকে স্পষ্টতই বােঝা যায় যে, শেখ মুজিবের সরকারকে উৎখাতই শুধু নয় সংবিধান পরিবর্তন। করে “ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশ” নাম গ্রহণে বাধ্য করতে মওলানা নিয়াজি নামে এক ব্যক্তিকে ভুট্টো সৌদি আরব ও আমিরাত-এ পাঠিয়েছিলেন।১২ বাংলাদেশ এবং সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের বহু দৃষ্টান্তের মধ্যে তােয়াহা এবং তার দলের ভূমিকা ছােট করে দেখার উপায় নেই। স্বাধীনতা লাভের পরও তােয়াহা তার পার্টির নামের সঙ্গে বাংলাদেশ’ লিখতে অস্বীকার করেছিলেন। তাঁর পার্টি নামের আগে পূর্ব বাংলা’ বাদ দিয়ে শুধু সাম্যবাদী (মার্কিস্ট-লেনিনিস্ট) নামে পরিচিত হয়। তােয়াহার বৃহত্তর বাংলা’ পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করে বেইজিংয় ১৯৭২ সালে এক কূটনৈতিক সান্ধ্য-অনুষ্ঠানে জনৈক উচ্চপদস্থ চীনা কর্মকর্তা বলেছিলেন, চীন বৃহত্তর বাংলা পরিকল্পনা সমর্থন করবে।১৩

সাম্যবাদী দলের ১৯৮৫ সালের ৭ নভেম্বর প্রচারিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে দলের সভাপতি তােয়াহা ৭ নভেম্বরের তাৎপর্য সম্পর্কে বলেছিলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ও ৭ নভেম্বর আমাদের জাতীয় জীবনে দুটি সুদূরপ্রসারী তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। ১৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আমাদের মাতৃভূমি সম্প্রসারণবাদীদের কবলমুক্ত হওয়ার সম্ভাবনার মুখে এসে দাড়িয়েছিল।১৪

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে ১৯৭১ সালে ১৩ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধের সময় পূর্ববঙ্গে পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের হত্যাযজ্ঞে সাহায্যদানের জন্য গঠিত ‘শান্তি কমিটি’র সক্রিয়।

————-

১০. আজকের কাগজ, ঢাকা, ২১ এপ্রিল, ১৯৯২ > Stanley Wolpert, Zulfi Bhutto of Pakistan: Hisi Life and Times, Oxford University Pre

Tonsion, 1993 248 ১২. প্রাগুক্ত, পৃ. ২৪৮ 30. A. L. Khatib, Who Killed Mujibs, Vikash Publishing House, New Delli, 1981 p. 169 ১৪, অনিরুদ্ধ, দৈনিক সংবাদ, ২৩ ডিসেম্বর, ১৯৯৪

————

সদস্য সিলেটের মাহমুদ আলী (পূর্ব পাকিস্তান গণতান্ত্রিক দলের সেক্রেটারি জেনারেল) এবং ঢাকার ‘পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকার মালিক হামিদুল হক চৌধুরী জোহর নামাজের পর বায়তুল মােকাররম থেকে মিছিল বের করেছিলেন। এই মিছিল মুক্তিযুদ্ধ তথা বাংলাদেশবিরােধী ছিল। মিছিলের পুরােভাগে ছিলেন খাজা খয়েরউদ্দিন, গােলাম আযম, শফিকুল ইসলাম, পীর মােহসিনউদ্দিন (দুদু মিয়া), সৈয়দ আজিজুল হক (নান্না মিয়া), মাহমুদ আলী, আবদুল জব্বার খদ্দর এবং এ. টি সাদী প্রমুখ।১৫ বাংলাদেশ এবং মুজিব সরকারের বিরুদ্ধে এরা ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছিলেন। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের শেষ ছিল না। মুজিব-হত্যার পর ১৯৭৫ সালেই ভুট্টোর বিশেষ পরামর্শদাতা মাহমুদ আলীকে ইসলামাবাদ থেকে লন্ডনে পাঠানাে হয়েছিল। ষড়যন্ত্রের উদ্দেশ্য ছিল বিদেশে সমর্থন পাওয়া গেলে বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের মধ্যে একটি কনফেডারেশন’ গঠন করার। তাদের চক্রান্ত সফল হয়নি। কিন্তু তারা হাল ছেড়ে দেয়নি। পরবর্তী সময়ে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান পুনরায় একত্রীকরণ আন্দোলন নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলেছিল মাহমুদ আলী এবং তার সাঙ্গোপাঙ্গরা। উঁইফোড় আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের কার্যকলাপ থেকে প্রমাণ হয় যে, তারা মাওপন্থী ও ভারত বিদ্বেষী ছিল। এরা ১৯৮৮ সালের আগস্ট মাসে প্রেস বিজ্ঞপ্তি প্রচার করে ভারতকে ‘আগ্রাসনবাদী ও সম্প্রসারণবাদী’ হিসেবে চিহ্নিত করে। এ থেকে প্রমাণ হয়, মুজিব-হত্যার পরও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র অব্যাহত আছে। এর আগে আওয়ামী লীগের একটি অতি বিপ্লবী দল বঙ্গবন্ধুকে সমর্থন দানের নামে সঙ্কট তৈরি করে। তঙ্কালীন ছাত্রলীগের নেতা আ, স, ম, আবদুর রব গণপরিষদ ভেঙে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশপ্রেমিক পার্টির সদস্যদের নিয়ে সরকার গঠনের অসাংবিধানিক দাবি তুলেছিলেন। সমাজতন্ত্রের বুলি উচ্চারণ করে সংবিধানে পূর্ণ সমাজতন্ত্রের গ্যারান্টিও দাবি করেছিলেন তিনি। কিন্তু, এই রবই বঙ্গবন্ধুকে হুমকি দিয়ে বলেছিলেন, “মুজিব, আপনি অস্ত্রের কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু আপনি অস্ত্র ধরতে জানেন? আমরা অস্ত্র ব্যবহারের শিক্ষা পেয়েছি ।১৭ তাঁর বিশেষ ভূমিকায় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) গঠিত হয় ১৯৭২ সালের ৩০ অক্টোবর। পাটির সভাপতি হন মেজর এম, এ. জলিল। তাঁরা মওলানা ভাসানীকে মুজিবসরকারবিরােধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দানের জন্য গােপনে অনুরােধ জানিয়েছিলেন। জাসদের উদ্যোগে সারা দেশ এবং ঢাকায় মুজিব-সরকারবিরােধী বিক্ষোভ, জনসভা অনুষ্ঠিত হতে থাকে। এর মধ্যে ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ১৭ মার্চে পল্টন ময়দানে জাসদ জনসভার আয়ােজন করে গরম গরম বক্তব্য দেয়। এতে উত্তেজিত জনতা সভা শেষে মিন্টো রােডে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীর সরকারি বাসভবন আক্রমণ করে। পাহারাদার

————

১৫. মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশ কেন্দ্র, ঢাকা, একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায়, দ্বিতীয় সংস্করণ,

১৯৮৭, পৃ. ৩১-৩২, ৩৪, ৪৭-৪৯ 39. Stanley Wolpert, Zulfi Bhutto ot Pakistan His Life and Times, Oxford University Press,

Tondon, 1993, p. 256, ১৭. AL. Khatih, Who Killed Mujib, Vikash Publishing House, New Delli, 1981, p. 156-57 ১৮, সাপ্তাহিক দেশবার্তা, লন্ডন, ২৫ নভেম্বর-২ ডিসেম্বর, ১৯৮৮


জাতীয় রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক-আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের ইতিহাসে জাতীয় রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক-আওয়ামী লীগ (বাকশাল) গঠন এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। পৃথিবীর রাজনৈতিক ইতিহাসে কোনাে রাষ্ট্রে একটিমাত্র রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব বিরল নয়। বাংলাদেশে একটি মাত্র রাজনৈতিক দল গঠনের প্রেক্ষিত কিভাবে তৈরি হয়েছিল তার ঈষৎ বিবরণ তুলে ধরা প্রয়ােজন। পরাজিত দেশি বিদেশি ষড়যন্ত্র-চক্রান্তকারীদের বেআইনী নাশকতামূলক কাজ ও অপতৎপরতা এবং বন্যার জন্য খাদ্য সঙ্কটের কারণে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে অস্থিতিশীলতা ঘটায় দেশের জনগণের মধ্যে এবং সর্বত্র একধরনের অস্থিরতা দেখা দেয়। মাওবাদী সিরাজ সিকদারের সর্বহারা দল, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের গণবাহিনী, কমরেড আবদুল হকের ইপিসি এমএল, কমরেড তােয়াহার কমিউনিস্ট পার্টি এবং অন্যান্য উগ্রপন্থী দল দেশের থানা, পুলিশ ক্যাম্প, ব্যাংক লুটের মতাে সর্বনাশা কর্মকাণ্ড শুরু করে। নির্বিচারে আওয়ামী লীগের কর্মী হত্যা চলতে থাকে, এমনকি ঈদের জামাতে নামাজ-পড়া অবস্থায় আওয়ামী লীগ নেতাকে হত্যা করা হয়। দেশে নাশকতামূলক কার্যকলাপ, গুপ্তহত্যা, পাটের গুদামে আগুন, অন্তর্ঘাত, চোরাকারবারি বেড়ে যায়। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য সরকারের আন্তরিক পদক্ষেপ ও ব্যবস্থাবলি পদে পদে বিঘ্নিত হতে থাকে। সরকারের জরুরি অবস্থা ঘােষণা দেশের স্থিতিশীলতার কর্মসূচি হুমকির মুখে পড়ে, জামলের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়। দেশের সার্বিক অবস্থা এমন আকার ধারণ করে যে, তখন সরকারের জরুরি অবস্থা ঘােষণার কথা চিন্তা না করে আর উপায় ছিল না। মাওপন্থীদের নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড সম্বন্ধে বঙ্গবন্ধু সজাগ ছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরােধীদের কার্যকলাপ সম্বন্ধে বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি এবং ২৬ মার্চ দুটি পৃথক ভাষণে দেশপ্রেমিক জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। সরকারের পক্ষ থেকে তখন বলা হয়েছিল যে, অবাধ গণতন্ত্রসম্মত সুযােগের যেভাবে অপব্যবহার হয়েছে, শান্তিপূর্ণভাবে নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক তৎপরতার পরিবর্তে যেভাবে সরকারের পুনর্গঠনমূলক কর্মসূচি বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে, দেশের অর্থনীতিকে দুর্বল ও ধ্বংস করে জাতীয় বিপর্যয় ডেকে আনতে সমাজবিরােধীরা যেভাবে অশুভ তৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে, নাশকতা, অন্তর্ঘাত ও সন্ত্রাসমূলক কার্যকলাপ এবং নির্বিচার গুপ্তহত্যা চালিয়ে যেভাবে জনজীবনে নিরাপত্তাহীনতা সঞ্চার করা হয়েছে, জনগণের নির্বাচিত ও আস্থাভাজন কোনাে সরকারই তার মােকাবিলায় নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করতে পারে না। পরিকল্পিত এই নৈরাজ্য, অরাজকতা ও সঙ্কট থেকে জাতিকে রক্ষা করার জন্য এই কঠোরতম ব্যবস্থাগ্রহণ। করা ছাড়া সরকারের সামনে আর কোনাে বিকল্প পথ খােলা ছিল না।

বাংলাদেশের মাওপন্থীদের সঙ্গে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর প্রত্যক্ষ যােগাযােগ এবং মুজিববিরােধী কর্মকাণ্ড চালানাের জন্য অর্থ, অস্ত্র ইত্যাদি সম্পর্কে প্রমাণ মার্কিন অধ্যাপক স্ট্যানলি উলপার্ট রচিত “জুলফি ভুট্টো অব পাকিস্তান। হিজ লাইফ অ্যান্ড টাইমস” নামক গ্রন্থে রয়েছে। উলপার্ট তার বইতে উল্লেখ করেন যে, ভুট্টো তার গােপন তহবিল থেকে বাংলাদেশের মুজিববিরােধী কয়েকটি দলকে অর্থসাহায্য দিয়েছিলেন। এসব দল প্রতিবিপ্লবের স্বপ্ন দেখছিল। এ দলগুলাের মধ্যে সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টি, আবদুল হকের পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি, মােহাম্মদ তােয়াহার সাম্যবাদী দল (এম-এল) এবং জলিল-রবের জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের নাম উল্লেখযােগ্য। নিচের উদ্ধৃতি থেকে তা পাঠকের কাছে স্বচ্ছ হবে : Bhutto had been funding secret discretionary’ funds to several anti-Mujib parties during the past two years, and before the end of August, 1975 that investment would pay off handsomely. Orthodox Islamic as well as Marxist Communist Bangalis on both wings of the cluttered spectrum of Bangladeshi politics now combined in an opposition chorus to Mujib’s inept, tottering regime. Abdul Huq, General Secretary of Bangladesh’s MarxistLeninist Communist Party, had written on 16 December, 1974 to My dear Prime Minister Bhotto with much pain and anguish to appeal for funds, arms and wireless instruments to use against the ‘puppet Mujib clique…today totally divorced from the people.’ That TOP SECRET/MOST IMMEDIATE letter reached Zulfi on 16 January, 1975, when he minuted on its margin Important, authorising help for this honest man, whom Bhutto rated as fairly effective.  পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির (এম-এল) জেনারেল সেক্রেটারি আবদুল হক। ভুট্টোকে পত্র লিখে মুজিব সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য তহবিল, অস্ত্রশস্ত্র এবং বেতারযন্ত্র সরবরাহের জন্য বলেছিলেন। আবদুল হকের এই চিঠি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ভুট্টোর বিশেষ উপদেষ্টা মাহমুদ আলীর মাধ্যমে প্রেরিত হয়েছিল বলে উলপার্টের Zulfi Bhutto of Pakistan His Life and Times (২৪৮) নামক গ্রন্থে উল্লেখ আছে।’ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মাহমুদ আলী নিজের জন্মভূমিতে ফিরে আসার সাহস পাননি। তিনি স্থায়ীভাবে পাকিস্তানে বসবাসের সিদ্ধান্ত নেন। রব, মেজর জলিল, মওলানা ভাসানী, সিরাজ সিকদার প্রমুখ স্বাধীনতার পর থেকেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের প্রতি বৈরী হয়ে উঠেছিলেন এবং দেশবিরােধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়েছিলেন। আ, স, ম, রব ১৯৭৪ সালের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে পল্টন ময়দানে গরম। বক্তৃতা দিয়ে উত্তেজিত জনতাকে নিয়ে মিন্টো রােডের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর সরকারি বাসভবন আক্রমণ করে ৬ জন প্রহরী পুলিশ হত্যা করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নষ্ট করার অপচেষ্টা চালান। 

ওপরে বর্ণিত বাংলাদেশের তকালীন পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরামর্শে বাংলাদেশের তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি মােহাম্মদউল্লাহ দেশে। জরুরি অবস্থা ঘােষণা করেন। এই নির্দেশ জারির ফলে দেশের নাগরিকদের স্বাধীনতা ও অধিকার সম্পর্কিত সংবিধানের সংশ্লিষ্ট সব ধারা স্থগিত হয়ে যায়। রাষ্ট্রপতির জরুরি অবস্থা জারির ফলে একটা বিষয় সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, দেশের রাষ্ট্রীয় এবং রাজনৈতিক কাঠামােয় গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আসন্ন। দেশের রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক কাঠামাের পরিবর্তন আনার বহু। আগে থেকেই বঙ্গবন্ধু শােষিত বঞ্চিত দুঃখী বাঙালি জাতির স্বাধীনতা ও অর্থনৈতিক মুক্তির। চিন্তায় আন্দোলন-সংগ্রাম করেছিলেন। তাঁর এই সংগ্রাম পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই শুরু হয়েছিল। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থান্বেষী গােষ্ঠী বঙ্গবন্ধুর এই আন্দোলন-সংগ্রামের বিরােধিতা করে আসছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পরও তাদের অপতৎপরতা অব্যাহত ছিল। দেশের অভ্যন্তরে পরিস্থিতি এমন রূপ ধারণ করে যে, বঙ্গবন্ধু তঙ্কালীন রাষ্ট্রপতিকে জরুরি আইন জারি করার পরামর্শ দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। কারণ দেশপ্রেমিক বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল দেশকে এবং দেশের মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে বাংলাদেশকে সত্যিকার অর্থে সােনার বাংলায় রূপায়িত করার। বাংলাদেশ-কৃষক-শ্রমিক-আওয়ামী লীগ (বাকশাল) কোন্ পরিস্থিতিতে গঠন করতে হয়েছিল তার আলােচনা সাধারণভাবে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে নেই বললেই চলে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ১৯৭৫ সালের ৭ জুন প্রকাশিত বাংলাদেশ গেজেটের অতিরিক্ত সংখ্যার ১৯৮৯-৯০ পৃষ্ঠায় জাতীয় রাজনৈতিক দল গঠন সম্পর্কিত একটি বিজ্ঞপ্তি রয়েছে। এ ছাড়া, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একই বছরের ২৫ জানুয়ারি বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে দেশে রাষ্ট্রপতিশাসিত পদ্ধতির সরকার গঠন সম্পর্কে দীর্ঘ ভাষণে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি বর্ণনা করেন। বঙ্গবন্ধুর প্রস্তাব অনুযায়ী জাতীয় সংসদে দেশে রাষ্ট্রপতিশাসিত পদ্ধতির শাসনব্যবস্থা চালু করার আইন গৃহীত হয়। এই আইন অনুযায়ী দেশের নির্বাহী ও আইন প্রণয়নকারীর ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয় রাষ্ট্রপতির হাতে। সরকারের সমস্ত কাজকর্ম রাষ্ট্রপতির পক্ষ থেকে পরিচালনার ব্যবস্থা করা হয়। বাকশাল গঠন, এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে বিক্ষিপ্তভাবে অতি সামান্য আলােচনা হলেও এই দল গঠনের বিপক্ষে বঙ্গবন্ধুর ট্র্যাজিক হত্যাকাণ্ডের পর ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চলেছে সুদীর্ঘ তিন দশক ধরে।

———-

১. এ.এল, আতিব, হু কিলড মুজিব, পৃ-১৫৬-৫৭

———–

এসব প্রচার-প্রচারণায় বাকশাল গঠনকে মূলত নেতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকেই ব্যাখ্যা করা হয়েছে। বাকশাল গঠনকে গণতন্ত্র হত্যা বলে অপপ্রচার চালানাে হয়েছে। এসব প্রচারপ্রচারণা ছিল কিছু দেশি-বিদেশি উগ্র প্রতিক্রিয়াশীল সাম্রাজ্যবাদী চক্রের কারসাজি। জাতীয় রাজনৈতিক দল গঠনের প্রয়ােজনীয়তা। একটিমাত্র জাতীয় রাজনৈতিক দল গঠনের প্রয়ােজনীয়তা কেন দেখা দিয়েছিল তা বঙ্গবন্ধু বাকশাল গঠন সম্পর্কিত ভাষণে সবিস্তারে বর্ণনা করেছিলেন। কিন্তু, তাঁর গৃহীত ব্যবস্থা কায়েমি স্বার্থবাদী দেশি-বিদেশি গােষ্ঠী বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে প্রচারণার একটি হাতিয়ার হিসেবে পেয়ে যায়। কারণ, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু পৃথিবীর ইতিহাসে এক উজ্জ্বল রাষ্ট্রনেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু তার নেতৃত্বের সর্বোচ্চ শিখরে পৌছে যাওয়ায় কায়েমি স্বার্থবাদী গােষ্ঠীর অন্তর্জালা সৃষ্টি হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু যাতে তাঁর নতুন রাষ্ট্রকে আদর্শ ও কল্যাণের পথে চালিত করতে না পারে সে জন্য ঘরে বাইরে তার বিরুদ্ধে চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র শুরু হয়ে যায়। এসব ষড়যন্ত্র-চক্রান্তে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগেরই কিছু উচ্চাভিলাষী নেতাকর্মীর সঙ্গে অন্য রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী যেমন জড়িত ছিল তেমনি মুক্তিযুদ্ধের বিরােধিতাকারী বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে এদেশীয় পাকিস্তানপন্থী ব্যক্তিবর্গ জড়িত ছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এসব ষড়যন্ত্রকে কখনাে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছিলেন বলে তাঁর বাহ্যিক আচার-আচরণে প্রকাশ পায়নি। তিনি দেশের সব মানুষকেই গভীরভাবে ভালােবাসতেন। বাঙালি কোনাে মানুষ তার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করতে পারে এমন ভাবনা তাকে কখনাে বিচলিত করেনি। বঙ্গবন্ধু যে আদর্শ ও নীতির অনুসারী ছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি বাংলাদেশের সংবিধান যে চারটি নীতির (জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা) ওপর ভিত্তি করে প্রণয়ন করলেন তা সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের পুঁজিবাদী গােষ্ঠীকে এবং ধর্মতন্ত্রে বিশ্বাসী রাষ্ট্রগুলির শাসকদের মনঃপূত ছিল না। ফলে, মুক্তিযুদ্ধের বিরােধিতাকারী এদেশীয় লােকজনকে এবং নেতৃত্বকামী উচ্চাভিলাষী রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গকে বঙ্গবন্ধু এবং তার সরকারের বিরুদ্ধে নানান প্রক্রিয়ায় উসকে দিতে থাকে।

বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে তৎপরতা মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই দানা বাঁধতে শুরু করেছিল। যে নেতা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অবিচল আস্থা প্রকাশ করেছিলেন, সেই নেতাই স্বাধীনতার পর ভিন্ন সুরে কথা বলেছিলেন। উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলােতে মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগ সরকারের বৈধতা মেনে নিয়ে বলেছিলেন, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পরাজিত দলের নেতাদের নিয়ে সর্বদলীয় মন্ত্রিসভা গঠন করা সম্ভব নয়, সেই মওলানা ভাসানীই ১৯৭২ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ঢাকার পুরানা পল্টনে জনসভায় আওয়ামী লীগ সরকারের বৈধতা থাকা সত্ত্বেও সর্বদলীয়  সরকার গঠনের দাবি করেছিলেন। ওই সভা শেষে তিনি এক ভুখামিছিল নিয়ে গণভবনে গিয়ে ১৮ দফা স্মারকলিপি পেশ করেছিলেন।  ষড়যন্ত্র, ঈর্ষার পটভূমি তৈরি হয় শেখ মুজিবুর রহমান যখন (১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দ) আওয়ামী লীগের সভাপতির পদে এবং তাজউদ্দীন আহমদ সাধারণ সম্পাদকের পদে অধিষ্ঠিত হন।

———–

২. , ঢাকা ৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৭২।

———-

তখন। তৎকালে দলের প্রভাবশালী নেতা খােন্দকার মােশতাক আহমদ নিজেকে অধিকতর যােগ্য বলে মনে করতেন। মােশতাকের এই মনােভাব মুক্তিযুদ্ধকালেও প্রকটভাবে দেখা গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রথম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হলে মন্ত্রিসভায় খােন্দকার মােশতাককে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। এতে তিনি অসন্তুষ্ট ছিলেন। কারণ, তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদটি আশা করেছিলেন এবং তাজউদ্দীন আহমদের প্রধানমন্ত্রীর পদে অধিষ্ঠিত হওয়াকে মােশতাক স্বঘােষিত প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন বলে মনে করতেন। কিন্তু ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি কর্তৃক তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী মনােনীত হয়ে শতাধিক দেশি-বিদেশি সাংবাদিক ও বিদেশি অতিথিবৃন্দের সামনে যখন শপথ নিয়ে বৈধতা পেলেন তখন খন্দকার মােশতাকের আর বলার কিছু থাকল না। তা সত্ত্বেও সমগ্র মুক্তিযুদ্ধকালে খন্দকার মােশতাক নানা উপায়ে মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতি এবং জয়যাত্রা ব্যাহত করতে উদ্যোগী হন। এজন্য প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে তার বিরুদ্ধে বাধ্য হয়ে ব্যবস্থাও নিতে হয়েছিল । মােশতাককে মুক্তিযুদ্ধের একপর্যায়ে গৃহে অন্তরীণ করে রাখতে বাধ্য হয়েছিল তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার। বাকশাল গঠনের পটভূমিতে এসব ঘটনার প্রভাব ছিল না বলা যাবেনা। মুক্তিযুদ্ধের সময় খন্দকার মােশতাক চেয়েছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা নিতে। এ ভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিলেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী। তাজউদ্দীনের মন্ত্রিসভায় একটি প্রতিনিধিদল নিয়ে ওয়াশিংটন গমনের প্রস্তাব দিলে তা প্রত্যাখ্যাত হয়। দেশ স্বাধীন হলে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এজন্যই মােশতাককে পররাষ্ট্র মন্ত্রীর পদ থেকে এবং তার বাধ্যানুগত মাহবুব আলম চাষীকে পররাষ্ট্রসচিব পদ থেকে অপসারিত করেছিলেন। খােন্দকার মােশতাক যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় মুক্তিযুদ্ধের মীমাংশা করার প্রস্তাব মন্ত্রিসভায় দিয়েছিলেন। খােন্দকার মােশতাকের এসব অপতৎপরতার মূলে ছিল তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি। মােশতাক ছিলেন দিল্লি-মস্কোর বিরােধী, ওয়াশিংটনপন্থী ।

মুক্তিযুদ্ধকালে মােশতাক আহমদের কর্মকাণ্ড স্বাধীন বাংলাদেশের অনুকূল ছিল না বলেই প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনকে নানাভাবে ওয়াশিংটনের প্রতি প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছিলেন। দক্ষিণ এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র তার আধিপত্য দৃঢ় করতে মােশতাককে বেছে নিয়েছিল এমন কিছু আলামত মুজিবনগরের বাংলাদেশ সরকারের নজরে আসে। মােশতাক মুক্তিযুদ্ধকালেও দু’বার বাংলাদেশ সরকারের বিপক্ষে অনাস্থা প্রস্তাব এনেছিলেন। এ সময় তাহেরউদ্দিন ঠাকুর, শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিলেন এমন তথ্য বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের গােয়েন্দা সংস্থার কাছ থেকে বাংলাদেশ সরকার পেয়েছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরিপন্থী ছিল তার এসব তৎপরতা। অপরপক্ষে তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিতন্ত্রবিরােধী। তাজউদ্দীন তৎকালীন জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন। একথা সবার জানা যে, মস্কোর পৃষ্ঠপােষকতায় তৎকালে এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন যুগােস্লাভিয়ার টিটো, ভারতের নেহরু, ইন্দোনেশিয়ার শুকর্ণ, চীনের চৌ এন লাই, কিউবার। ক্যাস্ট্রো, মিসরের নাসের প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। এসব নেতা ওয়াশিংটনবিরােধী ছিলেন।

খােন্দকার মােশতাক, জহিরুল কাইয়ুম, মিজানুর রহমান চৌধুরী প্রমুখের অসহযােগিতা মােকাবিলা করে তাজউদ্দীন আহমদ শত্রু কবলিত বাংলাদেশে থেকে মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতি অব্যাহত রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। প্রসঙ্গত বলা প্রয়ােজন পাকিস্তানের পক্ষে শাহ আবদুল আজিজ শত্রু কবলিত বাংলাদেশে থেকে পাকিস্তানের সাথে সমঝােতা করে মুক্তিযুদ্ধকে বাধাগ্রস্ত করতে একটি মৈত্রী সংঘ (Confederation) গঠনের নিস্ফল চেষ্টা করেছিলেন। এসব অপতৎপরতা পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ স্বাধীন বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল। দেশ পরিচালনায় সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি শত্রুমুক্ত বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেশ পরিচালনা শুরু করেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে যারা প্রকশ্যে-অপ্রকাশ্যে নানা ধরনের চক্রান্ত করেছিল তারা মুক্তিযুদ্ধে জয়লাভের পরও দেশের স্বার্থবিরােধী তৎপরতার হাল ছেড়ে দেননি। এ কথা আগেই বলা হয়েছে মাওপন্থী আবদুল হক তােয়াহা প্রসঙ্গে অধ্যাপক উলপার্টের লেখা উদ্ধৃত করে। বঙ্গবন্ধু সােভিয়েত ইউনিয়নের অনুকরণে বাংলাদেশে এক দলীয় শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে প্রয়াসী হন বটে, তবে মুক্তিযুদ্ধকালে প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের প্রতি বিদ্বেষ পােষণকারীরাই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রতিও অকুণ্ঠ হতে পারেনি। দেশের অভ্যন্তরেও উচ্চাভিলাষী এসব ব্যক্তি স্বার্থান্বেষী হয়ে ওঠেন। এমনকি এসব ব্যক্তির মধ্যে কোনাে কোনাে রাজনৈতিক নেতাকর্মী এবং কিছু ছাত্র ও তরুণ সমাজতন্ত্রের প্রতি মােহাচ্ছন্ন হয়েছিল। তাদের এই মােহাবিষ্ট হওয়ার বিষয়টি আন্তরিকতাপূর্ণ ছিল কি না পরে তা নিয়ে সন্দেহসংশয় দেখা দেয়। বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীন আহমদের মতাে নেতা যখন আন্তরিকতাপূর্ণ হৃদয় নিয়ে বাংলাদেশের সংবিধানে চারটি মূল নীতি অকৃত্রিম বিশ্বাসে গ্রহণ করার পক্ষে দৃঢ় অবস্থানে ছিলেন, তখন আবেগপ্রবণ ওইসব তরুণ ও ছাত্রদের সঙ্গে রাজনীতিক সিরাজুল আলম খান ও তার সহযােগীদের জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল গঠনের প্রয়াস সঙ্গত ছিল কি না সে সম্বন্ধে ওই দলের কর্ণধারগণকে পরে মত পাল্টে জাতীয় ঐকমত্যের বিষয়ে গুরুত্ব আরােপ করতে হয়েছে। সিরাজুল আলম খান জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল গঠন করে দেশপ্রেমিক তাজউদ্দীন আহমদকে সেই দলের সভাপতির পদ গ্রহণের অনুরােধ জানিয়ে ব্যর্থ হয়েছিলেন। তাজউদ্দীন আহমদের সুদূরপ্রসারী এই দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রমাণ হয় তিনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও নেতৃত্বের প্রতি গভীরভাবে আস্থাবান ছিলেন।

বঙ্গবন্ধুও মুক্তিযুদ্ধের পর তার সমাজতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক ও জাতীয়তাবাদী মনােভাবকে সুস্পষ্ট করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে এলে তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৭২ সালের প্রথম দিকেই খন্দকার মােশতাককে সরকারে কিংবা দলে স্থান না দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন এমন কথা শােনা যায়। কিন্তু মােশতাককে বঙ্গবন্ধু সেচ ও পানিসম্পদমন্ত্রী করেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের গতিধারা যে বিষয়টি প্রমাণ করে, তা হলাে মােশতাক বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ হন তার দুরভিসন্ধি সফল করতে। জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে রাষ্ট্রপতিশাসিতপদ্ধতির শাসকব্যবস্থা প্রবর্তনের উদ্দেশ্যে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে প্রস্তাব উপস্থাপন করলে তা আইন হিসেবে গৃহীত হয়। এই আইন অনুসারে বাংলাদেশের সব। নির্বাহী ও আইনপ্রণয়নের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত হয়। সংবিধানে এই সংশােধনী সংযুক্ত হওয়ার ফলে যা নির্ধারিত হয়ে যায় তা হলাে, রাষ্ট্রপতি প্রত্যক্ষ ভােটে পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হবেন। জাতীয় সংসদ অনুমােদিত সংবিধানের সংশােধনী বলে রাষ্ট্রপতি তাঁর ইচ্ছানুযায়ী উপরাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, মন্ত্রিসভা এবং সরকারি সব বিভাগের কর্মকর্তা নিয়ােগ ও অপসারণের ক্ষমতাপ্রাপ্ত হন। সরকারের সব কর্মকাণ্ড রাষ্ট্রপতির পক্ষ থেকে পরিচালনার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। জাতীয় সংসদে পেশকৃত নিজের প্রস্তাব প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু যে ভাষণ দিয়েছিলেন তাতে তিনি দ্বিতীয় বিপ্লব, জাতীয় ঐক্য গঠন ও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ঘােষণা দেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে যে ভাষণ দেন তার অংশবিশেষ নিম্নরূপ : জনাব স্পিকার, আজ (২৫ জানুয়ারি, ১৯৭৫ সাল) আমাদের শাসনতন্ত্রের কিছু অংশ সংশােধন করতে হলাে। আপনার মনে আছে যখন শাসনতন্ত্র পাস করা হয়, তখন আমি বলেছিলাম, এই হাউজের পক্ষ থেকে এ দেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য, শােষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য যদি দরকার হয় তবে এই সংবিধানেরও পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করা হবে।

স্পিকার সাহেব, আমরা যে আওয়ামী লীগ পার্টি এত ত্যাগ স্বীকার করে সগ্রাম করেছি- কোন দিন আমরা আমাদের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হই নাই। ক্ষমতার লােভে আমরা রাজনীতি করলে আমিও প্রধানমন্ত্রী হতে পারতাম। আর এই নেতৃবৃন্দ অনেক বার মন্ত্রী- অনেক পদ পেতে পারত। কিন্তু আমরা চেয়েছি একটি শােষণমুক্ত সমাজ, আমরা চেয়েছিলাম বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র, আমরা চেয়েছিলাম এ দেশের দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাবার জন্য। সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে আমরা ক্ষমতায় এসেছি, বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছি। আমি যখন কারাগারে বন্দী ছিলাম, আমার সহকর্মীরা এবং লক্ষ লক্ষ লােক দেশত্যাগ করে সশস্ত্র সন্ত্রামে লিপ্ত হয়। পরাজিত করি আমরা দুশমন বাহিনীকে।…আমরা চেষ্টা করেছিলাম দেশে যারা রাজনীতি করতে চান, দেশকে ভালােবাসতে চান নিশ্চয়ই তারা কাজ করবেন এবং তাদের একটা কর্তব্য রয়েছে। কোন দেশে কোন যুগে বিপ্লবের পরে বা সশস্ত্র বিপ্লবে ক্ষমতা দখল করে কোন দিন এইভাবে অবাধ অধিকার এবং অন্যান্য দলকে সুযােগ-সুবিধা দেয় নাই। আমরা দিয়েছিলাম। তার প্রমাণ আমাদের শাসনতন্ত্র । আপনি জানেন স্পীকার সাহেব, কি দেখেছি আমরা। তিন বছর হলাে স্বাধীনতা পেয়েছি। আপনারা জানেন আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থার কথা। যারা দেশত্যাগ করে গেল তারা দেশে ফিরে আসল। …তাদের ব্যাক করার মতাে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা ছিল না, আমাদের গােল্ড রিজার্ভ ছিল না; পাকিস্তানিরা সর্বস্ব এখান থেকে নিয়ে যায়। সেই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যে কত কষ্টকর সে কথা যারা করেছে তারাই বুঝতে পারে- অন্যরা বুঝতে পারে না। …আমরা চেষ্টা করেছি বন্ধুরাষ্ট্রের সাহায্য নিয়ে তাদের পুনর্বাসন করার জন্য।…. দুঃখের সাথে বলতে হয় যে, আজ আপনার এই এসেম্বলী বা সংসদের চারজন সদস্যকে হত্যা করা হয়েছে। তাদের আগে হত্যা করা হয়েছে, যারা এই কনস্টিটিউয়েন্ট এসেম্বলীর মেম্বার ছিলেন। হত্যা করা হয়েছে গাজী ফজলুর রহমানকে হত্যা করা হয়েছে নুরুল হককে হত্যা করা হয়েছে মােতাহের মাস্টারকে;… হাজার হাজার কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। তাদের হত্যা করা হয়েছে যারা স্বাধীনতার মুক্তিযােদ্ধা ছিলেন। তাদের হত্যা করা হয়েছে, যারা স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। তাদের হত্যা করা হয়েছিল, যারা ২৫ বছর পর্যন্ত এই বাংলাদেশে পাকিস্তানি শােষকদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে কারা নির্যাতন ভােগ করেছেন, অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করেছেন। কোন একটি রাজনৈতিক দল যাদের আমরা অধিকার দিয়েছিলামতারা কোন দিন এদের কনডেম… করে নাই। তারা মুখে বলেছেন যে, তারা অধিকার চান। তাঁরা মিটিং করেছেন, সভা করেছেন, পার্টি করতে দেয়া হয়েছে। কিন্তু তারা।

কি করেছেন?… তারা বলেছিল এই সরকারকে অস্ত্র দিয়ে উৎখাত করতে হবে । আজকে আপনারা জানেন বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে এটা একটা হট বেড অফ ইন্টারন্যাশনাল ক্লিক। এখানে অর্থ আসে, এখানে মানুষকে পয়সা দেয়া হয়। এখানে তারা বিদেশিদের দালাল হয়। আজকে একটা কথা এখানে আমাদের ভুললে চলবে না, যে রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা এনেছি, সেই রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা দরকার হলে রক্ষা করা হবে। স্বাধীনতা নস্যাৎ হতে দেয়া হবে না। এবং তাদের মনে রাখা দরকার আমরা যারা দীর্ঘ দিন, ২৫ বছর মাথা নত না করে বাংলার স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বের জন্য এ দেশের মানুষের জন্য সংগ্রাম করেছি, আমাদের রক্ত থাকতে এ দেশের স্বাধীনতাকে নস্যাৎ করার ক্ষমতা কারাের নাই।… ২৫ বছর সমস্ত সম্পদ পাকিস্তানে নিয়ে গেছে। এখানে কেন্দ্রীয় সরকার ছিল না, এখানে রেলওয়ে লাইন নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, এখানে পাের্ট ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, এখানে ব্যাংকে আমাদের গােল্ড রিজার্ভ নাই, এখানে ফরেন এক্সচেঞ্জ নাই, এখানে কমিউনিকেশান নাই, এখানে প্লেন নাই, এখানে গুদামে খাবার নাই- তাই নিয়ে আমাদের সরকার শুরু করতে হয়েছিল। কষ্ট। মানুষের আছে, কষ্ট মানুষের অনেক দিন পর্যন্ত করতে হবে- যে পর্যন্ত দেশকে গঠন করা না যাবে।… আমরা যখন স্বাধীনতা পেলাম; তারপর থেকে বাংলাদেশে আসল drought, তারপরে হলাে দুনিয়া জোড়া ইনফ্লেশান। যে জিনিস কিনতাম এক টাকা। দিয়ে সে জিনিস কিনতে হয় আমাদের দুই টাকা দিয়ে। যে জিনিস কিনতাম একশাে টাকা দিয়ে সে জিনিস করতে হয় দুশাে টাকা দিয়ে। আমাদের দেশের জিনিস, যা বিদেশে বিক্রি করতাম তার ন্যায্য মূল্য আমরা পেলাম না। …আমরা শােষিতের গণতন্ত্র চাই। যারা রাতের অন্ধকারে পয়সা লুট করে, যারা বড় বড় অর্থশালী লােক, যারা বিদেশ থেকে ভােট কেনার জন্য পয়সা পায় তাদের গণতন্ত্র নয়-শােষিতের গণতন্ত্র । এটা আজকের কথা নয়, বহু দিনের কথা আমাদের। এবং সে। জন্যই আজকে আমাদের শাসনতন্ত্র পরিবর্তন করতে হয়েছে।… আজ যে শাসনতন্ত্র, আজকে আমার দুঃখ হয়, আজ আপনারা আমাকে এই কনস্টিটিউশান এমেন্ডমেন্টএর সাথে আমাকে প্রেসিডেন্ট করে দিয়েছেন। আমার তাে ক্ষমতা কম ছিল না। প্রাইম মিনিস্টার হিসেবে সমস্ত ক্ষমতা আপনারা আমাকে দিয়েছিলেন। আমরা টু-থার্ড মেজরিটি; তবু আপনারা এমেন্ডমেন্ট করে আমাকে প্রেসিডেন্ট করেছেন। এই সীটে আমি আর বসবাে না। এটা কম দুঃখ আমার স্পীকার সাহেব, তবু আজকে আমূল পরিবর্তন করেছি শাসনতন্ত্রকে। কারণ সুষ্ঠু শাসন কায়েম করতে হবে। যেখানে মানুষ।

শান্তিতে ঘুমাতে পারে। যেখানে মানুষ অনাচার অত্যাচার থেকে বাঁচতে পারে। চেষ্টা নতুন, আজ আমি বলতে চাই-This is our second revolution, second revolution আমাদের। এই revolution-এর অর্থ দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানাে। এর অর্থ অত্যাচার-অবিচার-নির্যাতন বন্ধ করতে হবে। আমি চাই এই হাউজ থেকে স্পিকার সাহেব, আপনার মাধ্যমে দেশবাসী দলমত নির্বিশেষে সকলকে বলবাে, দেশকে ভালােবাস, জাতির চারটি প্রিন্সিপ্লসকে (নীতিকে) ভালােবাস। …বিপ্লবের পরে বিপ্লবকে বাধা দিয়েছে যারা, শত্রুর সাথে সহযােগিতা করেছে, যারা এ দেশের মানুষকে হত্যা করেছে তাদের কোন দেশে কোন যুগে ক্ষমা করে নাই । কিন্তু আমরা করেছিলাম। সবাইকে ক্ষমা করেছিলাম। বলেছিলাম দেশকে ভালােবাস, দেশের জন্য কাজ করাে, স্বাধীনতাকে গ্রহণ করে নাও, থাকো। কিন্তু অনেকের পরিবর্তন হয় নাই। তারা এখনাে গােপনে বিদেশিদের কাছ থেকে পয়সা এনে বাংলার স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। আজকে amended constitution-এ (অ্যামেন্ডেড কনস্টিটিউশানে) যে নতুন সিস্টেমে আমরা যাচ্ছি এটাও গণতন্ত্র। শােষিতের গণতন্ত্র। এখানে জনগণের ভােটাধিকার থাকবে। এখানে আমরা সমাজতন্ত্র করতে চাই। আমাদের শােষিতের গণতন্ত্র রাখতে চাই। সাম্প্রদায়িকতার বীজ বাংলার মাটিতে কোনাে দিন আসতে পারবে না, আমরা allow (অ্যালাউ) করবাে না।… …বাংলার মানুষের মতাে মানুষ কোথাও নাই। বাংলার গরিব, বাংলার কৃষক ভাললা । বাংলার শ্রমিক ভালাে। যদি খারাপ হয়, তবে আমরা তথাকথিত শিক্ষিত সমাজ । যতাে গােলমালের মূলে এই তারাই । যত অঘটনের মূলে তারাই। কারণ তারাই হলেন ভােকাল শ্রেণী। তারা বক্তৃতা করেন, তারা কাগজে লেখেন। তারা এখানে করেন, ওখানে করেন। তারা আছেন বেশ, এ অবস্থায় দেশ চলতে পারে না। সেই জন্যই। শাসনতন্ত্র আমাদের পরিবর্তন (এমেন্ড) করতে হবে। এখন আমাদের সামনে কাজ কী? এক, দেশকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে হবে, উৎপাদন বাড়াতে হবে। কলে-কারখানায় সব জায়গায়। পপুলেশান প্লানিং আমাদের করতে হবে এবং পপুলেশান কন্ট্রোল আমাদের করতে হবে ।…সিস্টেম পরিবর্তন করেই আমরা সাকসেসফুল হতে পারবাে না। যদি আপনারা চেষ্টা না করেন এবং আপনারা যদি নিঃস্বার্থভাবে যেভাবে স্বাধীনতা সগ্রাম করেছিলেন, নিঃস্বার্থভাবে ২৫ বছর সংগ্রাম করেছিলেন, সেই সংগ্রাম আপনারা না করেন, অন্যায় অবিচার দুর্নীতির বিরুদ্ধে গঠনমূলক কাজে, দেশ গড়ার কাজে উৎপাদন বৃদ্ধির দিকে, তাহলে খুবই ক্ষতি হয়ে যাবে। আমি এ অনুরােধ করবাে, চলুন আমরা অগ্রসর হই।… তবে কথা হলাে এই যে, সবচেয়ে বড় কাজ আমাদের We have to work sincerely and honestly for the cmancipation of the poor people of the country. আমি আপনাদের আবার ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় নিচ্ছি।

“বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক জীবন থেকে ঔপনিবেশিক অবশেষসমূহ নিমূল করার লক্ষ্যে সংশােধনীর মাধ্যমে ব্যবস্থাগুলাে গৃহীত হয়েছে বলে বঙ্গবন্ধু সংসদে তাঁর। ভাষণে উল্লেখ করেন। বঙ্গবন্ধু দেশের রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক কাঠামাের প্রয়ােজনীয়তা উপলব্ধি করেছিলেন। স্বাধীনতাত্তোর দেশের অভ্যন্তরীণ সামাজিক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ভেঙে পড়া অবকাঠামােগত এবং আইনশৃঙ্খলাজনিত বিভিন্ন বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার লক্ষ্যে সংবিধানে জাতীয় রাজনৈতিক দল গঠন অনিবার্য হয়ে পড়েছিল। দেশের অভ্যন্তরে দেশি-বিদেশি পরাজিত শক্তির ধ্বংসাত্মক, অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপ সরকারের সব ধরনের গঠনমূলক কর্মসূচিতে বাধা হয়ে দেখা দিয়েছিল। আগেই এ সম্বন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে, অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খল ও অরাজক পরিস্থিতি ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত এ দেশীয় শত্রু এবং বৈরীমনােভাবাপন্ন ইসলামী দেশসহ গণচীনের নির্লিপ্ততা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কিছু রাজনৈতিক নেতা-কর্মীকে সরকারের বিরুদ্ধে উৎসাহ জুগিয়েছিল। সরকারবিরােধী এসব রাজনৈতিক দল, আত্মগােপনে থাকা নিষিদ্ধ দলের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডও নতুন একটি দেশের সরকারকে বেসামাল করে তুলেছিল। তারা সরকারের পুনর্গঠন, পুনর্বাসন কার্যক্রমে, খাদ্যদ্রব্য সংগ্রহ, আহত মুক্তিযােদ্ধাদের চিকিৎসাব্যবস্থাসংক্রান্ত কাজকর্মে দারুণভাবে বিঘ্ন সৃষ্টি করেছিল। রাষ্ট্রের সব কিছু সুনিয়ন্ত্রণে আনতে বঙ্গবন্ধু “সংবিধানে নির্ধারিত লক্ষ্য শােষিত শ্রমজীবী মানুষের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে দেশে আমূল পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছিলেন। রাষ্ট্রের প্রধান চারটি মূলনীতি “জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী সব দেশপ্রেমিক শক্তিকে জাতীয় রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক-আওয়ামী লীগে (বাকশাল) যােগদান করে ওইসব নীতি বাস্তবায়নে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে বঙ্গবন্ধু আহ্বান জানিয়েছিলেন। উল্লেখ্য, জাতীয় সংসদের সিদ্ধান্তানুসারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার সাবেক শিল্পমন্ত্রী সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপরাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হন এবং প্রাক্তন স্বরাষ্ট্র ও যােগাযােগ মন্ত্রী ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়ােগ দেওয়া হয়। সংবিধান সংশােধনের পর গঠিত এই মন্ত্রিসভায় ১৭ জন মন্ত্রী এবং ৯ জন প্রতিমন্ত্রী অন্তর্ভুক্ত হন। পূর্বতন মন্ত্রিসভার সদস্য ছাড়াও সাবেক রাষ্ট্রপতি মােহাম্মদউল্লাহ এবং আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি এ, এইচ, এম, কামারুজ্জামানকেও মন্ত্রী নিয়ােগ করা হয়েছিল । ব্যাপকভিত্তিক জাতীয় দল জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর ১৯৭৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপতির এক ডিক্রি জারি হয়।

এই ডিক্রির মাধ্যমে দেশের সমস্ত বৈধ রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত করে “বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ” নামে একটি নতুন জাতীয় রাজনৈতিক দল গঠন করা হয়েছিল। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, স্বাধীনতাবিরােধী দেশি-বিদেশি প্রতিক্রিয়াশীল, সাম্প্রদায়িক ও সাম্রাজ্যবাদী চক্র বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং দেশের অর্থনীতি বিকাশে অন্তরায় ও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে শুরু করেছিল। মানবতাবিরােধী কার্যকলাপে লিপ্ত হতে দেখা যায় দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের। তারা ১৯৭৪ সালে কৃত্রিম খাদ্যসঙ্কট সৃষ্টি করে বাংলাদেশকে দুর্ভিক্ষাবস্তার মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। ব্যাপকভিত্তিক জাতীয় রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্দেশ্য ছিল বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য সৃষ্টির। এ জন্য তিনি শােষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘােষণা করেন। নতুন জাতীয় রাজনৈতিক দল ‘বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ সৃষ্টির পিছনে ক্ষমতা লিপ্সার অথবা স্বৈরাচারের কোনাে দুরভিসন্ধি থাকার প্রশ্নই ছিল । এই দলে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, কমিউনিস্ট পার্টি, জাতীয় গণতান্ত্রিক লীগ, জাতীয় গণতান্ত্রিক মুক্তিফ্রন্ট এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ যােগদান করেন। বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালে নতুন জাতীয় দল গঠন কালে জাতীয় সংসদের ৩১৫ জন। সংসদ সদস্যের মধ্যে ৩০৭ জনই ছিলেন আওয়ামী লীগের । তৎকালে আওয়ামী লীগই ছিল বাংলাদেশের সরকারি দল এবং আওয়ামী লীগের সভাপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধান। নতুন জাতীয় দল গঠিত হলে বঙ্গবন্ধুই জাতীয় সংসদে রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হন। বঙ্গবন্ধুর জনসমর্থন ছিল আকাশচুম্বী। তিনি বাঙালি জাতির যেমন অবিসংবাদী নেতারূপে আবির্ভূত হন, তেমনি তিনি বিশ্ববরেণ্য নেতা হিসেবেও প্রসিদ্ধ হন। বঙ্গবন্ধুকে সারা পৃথিবীর জনগণ এবং নেতৃবৃন্দ সমাদরে গ্রহণ করেন।  আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক শক্তি ব্যাপক থাকলেও বঙ্গবন্ধু তার দলকেও বিলুপ্ত করেন। রাষ্ট্রীয় চার নীতিতে বিশ্বাসী ও আস্থা স্থাপনকারী সমাজের বিভিন্নপর্যায়ের শ্রেণিপেশার প্রতিনিধি, সরকারি চাকরিজীবী, রাজনৈতিক দলগুলাের নেতৃবৃন্দ সমন্বয়ে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ সংক্ষেপে বাকশাল’ গঠিত হয়েছিল। বাকশালের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল নিম্নরূপ

লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য (১) রাষ্ট্রপতি কর্তৃক গঠিত একক জাতীয় দল বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক-আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে বর্ণিত জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, বাঙালি জাতির ঐক্য ও সংহতি বিধান, নর-নারী ও ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায় নির্বিশেষে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা বিধান এবং মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের স্বীকৃতি মানুষের স্বাভাবিক জীবন বিকাশের পরিপূর্ণ সুযােগ সৃষ্টি ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতার বিলােপসাধন, কৃষক ও শ্রমিকসহ মেহনতী ও অনগ্রসর জনগণের ওপর শােষণ অবসানের জন্য পূর্ণ অর্থনৈতিক মুক্তি ও সামাজিক স্বাধীনতা এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শােষণমুক্ত ও সুষম সাম্যভিত্তিক এক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা, সর্বাঙ্গীণ গ্রামীণ উন্নয়ন ও কৃষিব্যবস্থার আমূল সংস্কার ও ভূমির যান্ত্রিকীকরণ এবং সমবায় ভিত্তিতে চাষাবাদ পদ্ধতির প্রচলন, কৃষি ও শিল্পের প্রসার এবং উৎপাদন বৃদ্ধি, উৎপাদন ও বণ্টন নিয়ন্ত্রণে কৃষক-শ্রমিকের অংশগ্রহণের সুযােগ প্রদান, মানুষের সাধারণ জীবনযাত্রার মানােন্নয়ন, বেকারত্ব দূরীকরণ ও অধিকতর কর্মসংস্থান, বিপ্লবােত্তর সমাজের প্রয়ােজনের সহিত সামঞ্জস্যপূর্ণ গণমুখী সার্বজনীনসুলভ গঠনাত্মক শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন, অন্ন-বস্ত্র-আশ্রয়-স্বাস্থ্যরক্ষাসহ মানুষের দৈনন্দিন জীবনধারণের মৌলিক সম্পত্তির সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ, বিচারব্যবস্থার কালােপযােগী জনকল্যাণকর পরিবর্তন সাধন এবং গণজীবনের সর্বস্তর হইতে দুর্নীতির মূলােচ্ছেদ করা- এই নীতিসমূহ ও উদ্দেশ্যাবলি সমগ্র জনগণের ঐক্যবদ্ধ ও সুসংহত উদ্যম সৃষ্টির মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক পন্থায় বাস্তবে রূপায়িত করিতে অবিচল নিষ্ঠা, সততা, শৃঙ্খলা ও দৃঢ়তার সহিত সর্বতােভাবে আত্মনিয়ােগ করিবে। (২) বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক-আওয়ামী লীগ বিশ্বভ্রাতৃত্ব ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার সব।

প্রচেষ্টায় সাহায্য ও সহযােগিতা করিবে এবং সাম্রাজ্যবাদ, ওপনিবেশবাদ বা। বর্ণবৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বের সর্বত্র নিপীড়িত জনগণের ন্যায়সঙ্গত মুক্তির

সংগ্রামকে সমর্থন করিবে। রাষ্ট্রপতি-মননানীত ব্যক্তি সমন্বয়ে ১৯৭৫ সালের ৭ জুন প্রকাশিত বাংলাদেশ গেজেটের অতিরিক্ত সংখ্যায় বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক-আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্যসংখ্যা ছিল ১৫ জন এবং কেন্দ্রীয় কমিটিতে ১১৫ জন সদস্য অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন। গেজেটে প্রকাশিত কমিটির সদস্য, অঙ্গসংগঠনের সদস্য ও বঙ্গবন্ধু কর্তৃক নিযুক্ত জেলা গভর্নরদের নামের তালিকা নিম্নরূপ : বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক-আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটি

(১) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, চেয়ারম্যান।

(২) জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম জনাব এম. মনসুর আলী, সেক্রেটারি জেনারেল

(৪)। জনাব খন্দকার মােশতাক আহমদ জনাব আবুল হাসানাত মােহাম্মদ কামারুজ্জামান জনাব আবদুল মালেক উকিল

(৭) অধ্যাপক মােহাম্মদ ইউসুফ আলী (৮) শ্রী মনােরঞ্জন ধর। (৯) ড. মােজাফফর আহমদ চৌধুরী (১০) জনাব শেখ আবদুল আজিজ (১১) জনাব মহীউদ্দিন আহমদ

(১২) জনাব গাজী গােলাম মােস্তফা (১৩) জনাব জিল্লুর রহমান, সেক্রেটারি (১৪) জনাব শেখ ফজলুল হক মনি, সেক্রেটারি

(১৫) জনাব আবদুর রাজ্জাক, সেক্রেটারি। বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক-আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটি

(১) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, রাষ্ট্রপতি, চেয়ারম্যান (২) জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম, উপ-রাষ্ট্রপতি (৩) জনাব এম, মনসুর আলী, প্রধানমন্ত্রী, সেক্রেটারি জেনারেল (৪) জনাব আবদুল মালেক উকিল, স্পিকার

জনাব খােন্দকার মােশতাক আহমদ, বাণিজ্য ও বহিবাণিজ্য মন্ত্রী (৬) জনাব আবুল হাসানাত মােহাম্মদ কামারুজ্জামান, শিল্পমন্ত্রী (৭)। জনাব মােহাম্মদ উল্লাহ, ভূমি রাজস্ব ও ভূমি সংস্কার মন্ত্রী (৮)। জনাব আবদুস সামাদ আজাদ, কৃষিমন্ত্রী। (৯) অধ্যাপক মােহাম্মদ ইউসুফ আলী, শ্রম, সমাজকল্যাণ ও ক্রীড়ামন্ত্রী (১০) শ্রী ফণী ভূষণ মজুমদার, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী (১১) ড. কামাল হােসেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী

জনাব মােহাম্মদ সােহরাব হােসেন, গণপূর্ত ও নগর উন্নয়নমন্ত্রী

জনাব আবদুল মান্নান, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনামন্ত্রী (১৪) জনাব আবদুর রব সেরনিয়াবাত, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, পানিসম্পদ, বিদ্যুৎ ও বন,

মৎস্য ও পশুপালনমন্ত্রী (১৫) শ্ৰী মনােরঞ্জন ধর, আইন, সংসদ বিষয়াবলি ও বিচারমন্ত্রী (১৬) জনাব আবদুল মমিন, খাদ্য, বেসামরিক সরবরাহ এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী। (১৭) জনাব আসাদুজ্জামান খান, পাটমন্ত্রী। (১৮) জনাব এম. কোরবান আলী, তথ্য ও বেতারমন্ত্রী (১৯) ড. আজিজুর রহমান মল্লিক, অর্থমন্ত্রী (২০) ড. মোজাফফর আহমদ চৌধুরী, শিক্ষামন্ত্রী (২১) জনাব তােফায়েল আহমদ, রাষ্ট্রপতির বিশেষ সহকারী (২২) জনাব শাহ মােয়াজ্জম হােসেন, চিফ হুইপ। (২৩) জনাব আবদুল মমিন তালুকদার, সমবায় প্রতিমন্ত্রী (২৪) জনাব দেওয়ান ফরিদ গাজী, বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী (২৫) অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরী, প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী (২৬) জনাব তাহেরউদ্দিন ঠাকুর, তথ্য ও বেতার প্রতিমন্ত্রী (২৭) জনাব মােসলেমউদ্দিন খান, পাট প্রতিমন্ত্রী

(২৮) জনাব মােহাম্মদ নূরুল ইসলাম মঞ্জুর, যােগাযােগ প্রতিমন্ত্রী। (২৯) জনাব কে. এম. ওবায়দুর রহমান, ডাক, তার ও টেলিফোন প্রতিমন্ত্রী (৩০) ডা. ক্ষিতীশচন্দ্র মণ্ডল, ত্রাণ ও পুনর্বাসন প্রতিমন্ত্রী (৩১) জনাব রেয়াজউদ্দিন আহমেদ, বন, মৎস্য ও পশুপালন প্রতিমন্ত্রী (৩২) জনাব এম, বায়তুল্লাহ, ডেপুটি স্পিকার (৩৩) জনাব রুহুল কুদুস, রাষ্ট্রপতির প্রধান সচিব (৩৪) জনাব জিল্লুর রহমান এমপি, সেক্রেটারি (৩৫) জনাব মহীউদ্দিন আহমদ, এমপি (৩৬) জনাব শেখ ফজলুল হক মনি, সেক্রেটারি (৩৭) জনাব আবদুর রাজ্জাক এমপি, সেক্রেটারি (৩৮) জনাব শেখ শহীদুল ইসলাম। (৩৯) জনাব আনােয়ার চৌধুরী (৪০) বেগম সাজেদা চৌধুরী এমপি (৪১) বেগম তসলিমা আবেদ এমপি (৪২) জনাব আবদুর রহীম, দিনাজপুর (৪৩) জনাব আবদুল আউয়াল এমপি, রংপুর (৪৪) জনাব লুৎফর রহমান এমপি, রংপুর (৪৫) জনাব এ.কে. মুজিবুর রহমান এমপি, বগুড়া (৪৬) ড. মফিজ চৌধুরী এমপি, বগুড়া (৪৭) ড. আলাউদ্দিন এমপি, রাজশাহী (৪৮) ডা. আসহাবুল হক এমপি, কুষ্টিয়া (৪৯) জনাব আজিজুর রহমান আক্কাস এমপি, কুষ্টিয়া (৫০) জনাব রওশন আলী এমপি, যশাের। (৫১) জনাব শেখ আবদুল আজিজ এমপি, খুলনা (৫২) জনাব সালাহউদ্দিন ইউসুফ এমপি, খুলনা (৫৩) মি. মাইকেল সুশীল অধিকারী, খুলনা । (৫৪) জনাব কাজী আবুল কাশেম এমপি, পটুয়াখালী (৫৫) জনাব মােল্লা জালালউদ্দিন আহমেদ এমপি ফরিদপুর (৫৬) জনাব শামসুদ্দিন মােল্লা এমপি, ফরিদপুর (৫৭) শ্রী গৌরচন্দ্র বালা, ফরিদপুর (৫৮) জনাব গাজী গােলাম মােস্তফা এমপি, ঢাকা নগর (৫৯) জনাব শামসুল হক এমপি, ঢাকা (৬০) জনাব সামসুজ্জোহা এমপি, ঢাকা

(৬১) জনাব রফিকউদ্দিন ভূইয়া এমপি, ময়মনসিংহ (৬২) জনাব সৈয়দ আহমদ ময়মনসিংহ (৬৩) জনাব শামসুর রহমান খান এমপি, টাংগাইল (৬৪) জনাব নুরুল হক এমপি, নােয়াখালী (৬৫) জনাব কাজী জহিরুল কাইউম এমপি, কুমিল্লা (৬৬) ক্যাপটেন সুজাত আলী এমপি, কুমিল্লা (৬৭) জনাব এম, আর, সিদ্দিকী এমপি, চট্টগ্রাম (৬৮) জনাব এম. এ. ওয়াহাব এমপি, চট্টগ্রাম (৬৯) শ্রী চিত্তরঞ্জন সূতার, এমপি (৭০) সৈয়দ রাজিয়া বানু, এমপি (৭১) জনাব আতাউর রহমান খান, এমপি (৭২) জনাব খােন্দকার মােহাম্মদ ইলিয়াস (৭৩) শ্রী মং প্রু সাইন, মানিকছড়ির রাজা, পার্বত্য চট্টগ্রাম (৭৪) অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ (৭৫) জনাব আতাউর রহমান (৭৬) জনাব পীর হাবিবুর রহমান (৭৭) সৈয়দ আলতাফ হােসেন (৭৮) জনাব মােহাম্মদ ফরহাদ (৭৯) বেগম মতিয়া চৌধুরী (৮০) হাজী মােহাম্মদ দানেশ (৮১) জনাব হােসেন তওফিক ইমাম, সচিব, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ (৮২) জনাব নুরুল ইসলাম, সচিব, বহিবাণিজ্য মন্ত্রণালয় (৮৩) জনাব ফয়েজউদ্দিন আহমদ, সচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় (৮৪) জনাব মাহবুবুর রহমান, সচিব, সংস্থাপন বিভাগ (৮৫) জনাব আবদুল খালেক, উপরাষ্ট্রপতির সচিব (৮৬) জনাব মুজিবুল হক, সচিব, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় (৮৭) জনাব আবদুর রহীম, রাষ্ট্রপতির সচিব (৮৮) জনাব মইনুল ইসলাম, সচিব, পূর্ত, গৃহনির্মাণ ও শহর উন্নয়ন মন্ত্রণালয় (৮৯) জনাব এম. সাইদুজ্জামান, সচিব, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় (৯০) জনাব আনিসুজ্জামান, সচিব, কৃষি মন্ত্রণালয় (৯১) ড. এ. সাত্তার, রাষ্ট্রপতির সচিব (৯২) জনাব এম, এ. সামাদ, সচিব, যােগাযােগ মন্ত্রণালয় (৯৩) জনাব আবু তাহের, সচিব, ভূমি প্রশাসন ও ভূমি সংস্কার মন্ত্রণালয়

(৯৪) জনাব আল হােসায়নী, সচিব, বিদ্যুৎ শক্তি মন্ত্রণালয় (৯৫) ডা. তাজুল হােসেন, সচিব, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় (৯৬) জনাব মতিউর রহমান, চেয়ারম্যান, টি.সি,বি, (৯৭) মেজর জেনারেল কে, এম, সফিউল্লাহ্, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান (৯৮) এয়ার ভাইস মার্শাল এ. কে. খােন্দকার, বাংলাদেশ বিমান বাহিনী প্রধান (৯৯) কমােডর এম, এইচ. খান, বাংলাদেশ নৌবাহিনী প্রধান। (১০০) মেজর জেনারেল খলিলুর রহমান, মহাপরিচালক, বি.ডি.আর. (১০১) জনাব এ. কে. নাজিরউদ্দিন আহমদ, গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক (১০২) ড. আবদুল মতিন চৌধুরী, উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (১০৩) ড. মাযহারুল ইসলাম, উপাচার্য, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (১০৪) ড. মুহম্মদ এনামুল হক, উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (১০৫) জনাব এ. টি, এম, সৈয়দ হােসেন, অতিরিক্ত সচিব, সংস্থাপন বিভাগ (১০৬) জনাব নুরুল ইসলাম, আইজি, পুলিশ (১০৭) ড. নীলিমা ইব্রাহিম। (১০৮) ডা. নুরুল ইসলাম, পরিচালক, পি.জি. হাসপাতাল (১০৯) জনাব ওবায়দুল হক, সম্পাদক, বাংলাদেশ অবজার্ভার (১১০) জনাব আনােয়ার হােসেন মঞ্জু, সম্পাদক, ইত্তেফাক (১১১) জনাব মিজানুর রহমান, প্রাক্তন প্রধান সম্পাদক, বি.পি.আই (১১২) জনাব মনােয়ারুল ইসলাম, যুগ্মসচিব, রাষ্ট্রপতির সচিবালয় (১১৩) ব্রিগেডিয়ার এ. এস. এম. নুরুজ্জামান, পরিচালক, জাতীয় রক্ষী বাহিনী (১১৪) জনাব কামারুজ্জামান, সভাপতি, বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি (১১৫) ডা. মাজহার আলী কাদরী, বাংলাদেশ চিকিৎসক সমিতির সভাপতি

শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি

বিচারপতি এম, এইচ. রহমান

সচিব

বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক-আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন

| (ক) জাতীয় কৃষক লীগ।

১. শ্রী ফণীভূষণ মজুমদার সাধারণ সম্পাদক

২. জনাব আবদুস সামাদ আজাদ ৩. জনাব আবদুর রব সেরনিয়াবাত ৪. জনাব আবদুল মমিন তালুকদার ৫. জনাব আবদুর রউফ (হুইপ) ৬. শ্রী মণি সিংহ ৭. হাজী মােহাম্মদ দানেশ ৮. পীর হাবিবুর রহমান। ৯. জনাব বাদল রশিদ, এমপি ১০. জনাব এম. এ. হানিফ, এমপি (নােয়াখালী) ১১. জনাব দেলােয়ার হােসেন, এমপি ১২. জনাব আলী আশরাফ, এমপি (কুমিল্লা) ১৩. জনাব এম, আনিসুজ্জামান ১৪. জনাব মনজুর মাের্শেদ ১৫. জনাব রহমত আলী। ১৬. জনাব আবদুল আউয়াল ১৭. জনাব আবদুর রউফ চৌধুরী ১৮. জনাব হেদায়েতুল ইসলাম খান। ১৯. ডা. মােখলেছুর রহমান, এমবিবিএস ২০. জনাব আবদুল হাকিম ২১. শেখ হারুনুর রশীদ ২২. জনাব হাবিব উল্লাহ বিশ্বাস ২৩. জনাব আবু আল সাঈদ ২৪. জনাব আমজাদ হােসেন। ২৫. জনাব নূরুর রহমান। ২৬. শ্রী জীতেন ঘােষ ২৭. জনাব বজলুর রহমান। ২৮. জনাব আবদুল করিম ২৯. জনাব নূরুল ইসলাম

(খ) জাতীয় শ্রমিক লীগ

১. অধ্যাপক মােহাম্মদ ইউসুফ আলী সাধারণ সম্পাদক।

২. জনাব আবদুর রহমান, এমপি

৩. জনাব কাজী মােজাম্মেল হক, এমপি ৪. জনাব মাহমুদুর রহমান বেলায়েত, এমপি ৫. জনাব আবদুল আলিম, এমপি। ৬. চৌধুরী হারুন-অর-রশিদ ৭. বাবু দীনেশ সেন ৮. জনাব হাসানুজ্জামান ৯. জনাব সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক ১০. বাবু সুশীল কুমার পাল ১১. জনাব তাহেরুদ্দিন খান ১২. জনাব জামশেদ আহমেদ চৌধুরী ১৩. জনাব এ. বি. এম. মহিউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী ১৪, জনাব আবদুর রউফ ১৫. জনাব মােহাম্মদ মহসীন ১৬. জনাব মােহাম্মদ এমদাদ হােসেন ১৭. জনাব মাহবুবুল আলম ১৮. জনাব এস, এম, রুমী ১৯. জনাব দেলােয়ার হােসেন খান নয়ন ২০. অধ্যাপক আবদুর রশিদ লেবু ২১. জনাব মােহাম্মদ আবদুল আজিজ ২২. জনাব মনজুরুল আহসান খান ২৩. জনাব আবদুল মান্নান ২৪. জনাব হাবিবুর রহমান ২৫. জনাব জাহিদুর রহমান জাহিদ ২৬. ব্যারিস্টার নূরুল আফসার ২৭. জনাব হাসানুদ্দিন সরকার ২৮. জনাব জামালুদ্দিন ২৯. জনাব মােহাম্মদ আহাদ। ৩০. জনাব আবদুস সালাম খান

৩১. জনাব রহমত উল্লাহ চৌধুরী

৩২. জনাব হাবিবুর রহমান

(গ) জাতীয় মহিলা লীগ ১. বেগম সাজেদা চৌধুরী, এমপি সাধারণ সম্পাদক

২. ড. নীলিমা ইব্রাহিম, প্রভােস্ট, রােকেয়া হল। ৩. অধ্যাপিকা বেগম মেহেরুন্নেসা চৌধুরী, প্রভােস্ট, শামসুন্নাহার হল ৪. সৈয়দা রাজিয়া বানু, এমপি ৫. জনাবা মমতাজ বেগম, এমপি ৬. জনাবা রাফিয়া আক্তার ডলি, এমপি ৭. অধ্যাপিকা আজরা আলী, এমপি ৮. শ্রীমতি কণিকা বিশ্বাস, এমপি ৯. শ্রীমতি সুদীপ্তা দেওয়ান, এমপি ১০. বেগম নাজমা শামীম লাইজু, এমপি ১১. বেগম আইভি রহমান। ১২. মিস সাহারা খাতুন। ১৩. মিস মাহমুদা চৌধুরী ১৪. জনাবা রওশন আরা মুস্তাজির ১৫. জনাবা নূরেশ মকসুদ ১৬. জনাবা মালেকা বেগম ১৭. জনাবা লুফুন্নেছা বকুল ১৮. জনাবা ফিরােজা বেগম। ১৯. জনাবা আয়েশা খানম ২০. জনাবা নূরজাহান বেগম, সম্পাদিকা, বেগম পত্রিকা ২১. জনাবা ফরিদা মহিউদ্দিন ২২. জনাবা ফেরদৌস আরা ডলি ২৩. জনাবা মেভিজ জেসমিন

(ঘ) জাতীয় যুবলীগ

১. জনাব তােফায়েল আহমেদ, এমপি সাধারণ সম্পাদক

২. জনাব আবদুল জলিল, এমপি ৩. জনাব সরদার আমজাদ হােসেন, এমপি ৪. জনাব সুলতান মাহমুদ শরীফ ৫. জনাব রাজিউদ্দিন আহমেদ, প্রাক্তন এমসিএ

৬. জনাব আমজাদ হােসেন, এমপি। ৭. সৈয়দ রেজাউর রহমান ৮. জনাব মােহাম্মদ নাসিম ৯, জনাব নূরুল ইসলাম। ১০. জনাব মােজাফফর হােসেন, এমপি ১১. জনাব শ. ম. বাবর আলী, এমপি ১২. জনাব নিজামউদ্দিন আহমেদ, এমপি ১৩. জনাব মােহাম্মদ ইব্রাহিম ১৪. জনাব এস, এম, ইউসুফ ১৫. ডা. আলি হাফিজ সেলিম ১৬. জনাব ফকির আবদুর রাজ্জাক ১৭. জনাব শফিকুল আজিজ মুকুল ১৮. জনাব মনিরুল হক চৌধুরী ১৯. জনাব এম. এ. রশীদ। ২০. জনাব মতিউর রহমান ২১. জনাব আবদুল মােনায়েম ২২. জনাব খায়রুল আনাম। ২৩, অধ্যাপক নিমচন্দ্র ভৌমিক ২৪, জনাব আবদুল কাদের সিদ্দিকী ২৫. জনাব মেজবাহউদ্দিন আহমেদ ২৬. জনাব ফখরুল কামাল ২৭. জনাব আবদুর রাজ্জাক

(ঙ) জাতীয় ছাত্রলীগ

১. জনাব শেখ শহীদুল ইসলাম সাধারণ সম্পাদক

২. জনাব মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ৩. জনাব এ, এম, ইসমত কাদির গামা ৪. জনাব রাশেদুল হাসান খান ৫. জনাব নূরুল ইসলাম মিলন ৬. জনাব নূহউল-আলম-লেনিন ৭. জনাব শেখ কামাল। ৮, জনাব মাহবুব জামান ৯. জনাব মােস্তফা জালাল মহিউদ্দিন

বৈঠক বসবে। একদিন দু’দিনের নয়, দরকার হলে পাঁচ সাত দিনের জন্য বসবে। এবং সেই সেন্ট্রাল কমিটির মিটিংয়ে বিভিন্ন অ্যাজেন্ডা দেয়া হবে। সেই অ্যাজেন্ডা অনুযায়ী কনফারেন্সকে ভাগ করে কতকগুলাে সাব-কমিটি বা কমিশন করে দেয়া হবে। বিভিন্ন ডিপার্টমেন্ট এবং বাইরের কাউকে যদি দরকার হয় তাদের নিয়ে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলােচনা করে একটি প্রপােজাল সাবমিট হবে কনফারেন্সের কাছে। যেমন, ফুড, এগ্রিকালচার, ইন্ডাস্ট্রি, ফ্লাড কন্ট্রোল, এডুকেশন ইত্যাদি। বিভিন্ন সাবজেক্টের সাবকমিটি করে তাদের কাছে ভার দেয়া হবে। রেসপেক্টিভ মিনিস্টার সেখানে থাকবেন। সরকারি কর্মচারীরা থাকবেন। যদি দরকার হয়, বাহির থেকে- যারা আমাদের কমিটি মেম্বার নন, কিন্তু যারা কন্ট্রিবিউট করতে পারেন, তাঁদের আমরা ইনভাইট করতে পারবাে। সেখানে বসে কতটুকু কি করা হয়েছে, কতটা ভুল হয়েছে, কি ত্রুটি হয়েছে বা কি করলে আমরা দেশের ইমপ্রুভমেন্ট করতে পারবাে, সে সম্পর্কে সাজেশন দিলে তখন সেন্ট্রাল কমিটি থেকে এটা প্রস্তাব করে গভর্নমেন্ট সেই অনুযায়ী তাদের কাজকর্ম করবেন। এই আমাদের ইচ্ছে। আগস্ট মাসে একটা ফুল অ্যাজেন্ডা নিয়ে কাজ শুরু করা। আপনাদের কাছে বক্তৃতা করে বােঝানাের দরকার নাই। তবে, এটুকু বলতে পারি, কেন আমরা এ নতুন পদ্ধতি সৃষ্টি করলাম আর কেনই বা আমরা একে বিপ্লব বললাম।… আমি যা চিন্তা করতাম বা ইতিহাসে যা পড়েছি, তা তার কথা পড়ে আমি কনফার্ম করলাম। আজকে স্বাধীনতার পরে বিনা কারণে এইভাবে সিস্টেম চেঞ্জ করি নাই। বাংলাদেশে নির্বাচন দিয়েই ৯৭ পারসেন্ট ভােট আউট অব থ্রি হানড্রেড ফিফটিন, থ্রি হানড্রেড সেভেন সীটস আমাদের পার্টি আওয়ামী লীগের ছিল। যদি তার পরেও ইলেকশন দিতাম, এখনাে বিশ্বাস করি, দুই এক পারসেন্ট বাদ যেতেও পারে, কিন্তু নব্বই পারসেন্টের কম পাবে না আমাদের পাটি।

সেজন্য এই সিস্টেমে ক্ষমতাচ্যুত হবার সম্ভাবনা আমাদের অনেক দিন ছিল না, যদি ক্ষমতায় থাকতে চাইতাম। আর। ক্ষমতার জন্য রাজনীতি যদি করতাম, তাহলে আমরা অনেকবারই ক্ষমতায় আসতে পারতাম। যদি নিগােশিয়েসন বা আপােসে আমরা ক্ষমতা চাইতাম, তাহলে কেন। আমরা এই পরিবর্তন করলাম?… ..সমস্ত কিছু ধ্বংস । আমরা কিন্তু চেষ্টা করলাম যে, ঠিক আছে। আমরা একদম যাকে বলে ফ্রি হ্যান্ড দিয়ে দিলাম। আচ্ছা বলাে, আচ্ছা করাে, আচ্ছা দল গড়াে, আচ্ছা লেখাে, আচ্ছা বক্তৃতা করাে। বাধা নাই, ফ্রি হ্যান্ড …. কিন্তু দেখতে পেলাম। কি? আমরা যখন এই পন্থায় এগুতে শুরু করলাম, বিদেশি চক্র এ দেশে মাথা চাড়া। দিয়ে উঠল। তারা এ দেশের স্বাধীনতা বানচাল করার জন্য ষড়যন্ত্র শুরু করল এবং ফ্রি স্টাইল শুরু হয়ে গেল। হুড়হুড় করে বাংলাদেশে অর্থ আসতে আরম্ভ করল। দেশের মধ্যে শুরু হলাে ধ্বংস, একটা ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ।… যাদের আমরা এ সমস্ত ভােগ করতে দিলাম, তারা রাতের অন্ধকারে মানুষ হত্যা করতে আরম্ভ করল। আমরা বলেছি যে, বাবা, ঠিক আছে, পাঁচ বছর পরে ইলেকশন হবে, ইলেকশন করাে, ইলেকশনে যদি ডিফিট খাই, আর একজন এসে বসবে।… ফ্রি ফেয়ার ইলেকশন হবে। তার পরও যারা ইলেকটেড মেম্বার তারা পার্লামেন্টে, রাতের অন্ধকারে তাদের হত্যা করা হলাে। যারা স্বাধীনতা সংগ্রামে যুদ্ধ করেছেন, দেশত্যাগ করেছেন, ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে যাদের সম্পত্তি, তাদের রাতের অন্ধকারে হত্যা করা হলাে। মােট কয়েক হাজার কর্মীকে হত্যা করা হলাে, যারা নিঃস্বার্থভাবে যুদ্ধ করেছে, মুক্তিবাহিনীর ছেলে, তাদের হত্যা করা হলাে। চরম ষড়যন্ত্র। এত অস্ত্র উদ্ধার করি, তবু অস্ত্র শেষ হয় না। এই রাজনীতির নামে হাইজ্যাক, এই রাজনীতির নামে ডাকাতি, টেলিফোন করে মানুষের কাছ থেকে টাকা আদায় করে বা মানুষের বাড়িতে গিয়ে গহনা কেড়ে নেয় রাজনীতির নামে, একটা ফ্রি স্টাইল শুরু হয়ে গেল ।

দেশের মধ্যে এজেন্সি শুরু হয়ে গেল। বহু দিন রাজনীতি করেছি। ১৮ বছর বয়স থেকে। তখন বােধহয় ১৯৩৮ সাল। তারপর চোঙ্গা মুখে দিয়ে রাজনীতি করেছি, রাস্তায় হেঁটেছি, পায়ে হেঁটেছি, ফুটপাতে ঘুমিয়েছি। সেই রাজনীতি থেকে আজ এ পর্যন্ত এসেছি।…আমি দেশে একটা পার্টি গড়ে তুলেছি এবং চালিয়েছি, যেটা নাম্বার ওয়ান পলিটিক্যাল পার্টি অব বাংলাদেশ, কিন্তু আমি একটি ডেইলি কাগজ চালাতে পারি না।…অথচ এই তিন বছরের মধ্যে দেখা গেল, এমন কাগজও চলল, যে কাগজ বছরে এক ইঞ্চি অ্যাডভারটাইজমেন্ট পায় নাই। কিন্তু একটা কাগজ করতে মাসে কমপক্ষে এক লাখ সােয়া লাখ দেড় লাখ টাকা খরচ হয়। আজকে এই টাকা তারা কোথায় থেকে পায়? কে দেয় তাদের এই টাকা, কোথা থেকে আসে? তারপর ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট বলতে যে পদার্থ বাংলাদেশে আছে, তাদের এত টাকা আছে বলে আমার জানা নাই । ছিল কিনা, তাও জানি না। এখন কিছু লােক নতুন টাকার মানুষ হয়েছে। কিন্তু ইন্ডাস্ট্রি তাে আমরা নিয়ে নিলাম। দেখা গেল যে, বিদেশের কিছু কিছু জায়গা থেকে পয়সা পেয়ে তারা দেশের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে, গােলমাল সৃষ্টি করে।…আমরা এই সিস্টেম ইন্ট্রোডিউস করলাম কেন? এই যে আমাদের সমাজ এখানে দেখতে পাই- আমি অনেক চিন্তা করেছি, বহুদিন কারাগারে একলা বসে বসে চিন্তা করতে আমি সময় পেয়েছি, এই সব বিষয়ে যে, আমার দেশের ২০% লােক শিক্ষিত। তার মধ্যে আমরা ১০% বা ৫% লােক লেখাপড়া কিছুটা জানি। এর মধ্যে এক গ্রুপ আমরা পলিটিশিয়ান হয়ে গেলাম। এক গ্রুপ আমরা বুদ্ধিজীবী। এক গ্রুপ স্কুল টিচার, যারা এই ঘােরপ্যাচের মধ্যে আসতে চায় না। এক গ্রুপ সরকারী কর্মচারী হয়ে গেলাম ।…সেজন্য আমরা চিন্তা করলাম, সমাজের যেখানে যিনি আছে, তিনি বুদ্ধিজীবী হন, ডাক্তার হন, ইঞ্জিনিয়ার হন, সরকারি কর্মচারী হন, রাজনীতিবিদ হন, ল-ইয়ার হন, আর যাই হন- কারণ, আমার সমাজে তাে শতকরা ২০ জনের বেশি শিক্ষিত নন-এদের মধ্যে সমস্ত লােককে একতাবদ্ধ করে দেশের মঙ্গলের জন্য যদি এগিয়ে যেতে না পারি, তবে দেশের মঙ্গল করা কষ্টকর হবে। সেজন্য নতুন সিস্টেমের কথা বহুদিন পর্যন্ত চিন্তা করেছি। আমার মনে হয়, বাংলাদেশবাসী এটাকে গ্রহণ করেছে। এবং ভালােভাবে গ্রহণ করেছে।… পয়সাকড়ি খরচ করে অন্য ধরনের রাজনীতি করা যায় । কিন্তু আমি যেটা বলেছি শােষিতের গণতন্ত্র, কেন বলেছি? শােষিতের গণতন্ত্র এ জন্য বলেছি যে, আজকে বঙ্গবন্ধুকে ভালােবাসে মানুষ। বঙ্গবন্ধু বলে দিয়েছে, অল রাইট, যাও তুমি; যেয়ে কনটেস্ট করাে। আমি যেয়ে কিছু বক্তৃতা করে দিয়ে এলাম, যাও। পছন্দ হয় না, কিন্তু বঙ্গবন্ধু বলেছেন, আর করবাে কি, ভােটটা দিয়েই দিলাম। এ-ও হয়েছে অনেক জায়গায়, হয়। কাজেই সেজন্য সিস্টেম চেঞ্জ করে বলেছি যে, কনস্টিটিউয়েন্সিতে চারজন কি তিনজন কি দুইজন লােক আছে, তাদের সম্বন্ধে সকলকে বলে দেয়া হলাে, এই তিনজন চারজন পার্টির লােক আছে তাদের মধ্যে যাকে আপনারা পছন্দ করেন, ছােট দিন। ফলে জনগণ সুযােগ পেলাে অ্যাকর্ডিং টু দেয়ার ওন চয়েস ভালাে লােককে পাঠাবার জন্যে। না হলে আমরা অনেক সময় জিন্দাবাদ’ ‘মুর্দাবাদ’ দিয়ে পাস করে নিয়ে আসি। তাতে দেখা গেছে যে, সত্যিকারের ভালাে লােক অনেক সময় নাও আসতে পারে। কিন্তু এতে সত্যিকারের ভালাে লােক আসবে বলে আমি বিশ্বাস করি। সেজন্য এই সিস্টেম করা হয়েছে।…জাতীয় ঐক্য, যেটা বলেছি আমি, জাতীয় ঐক্য আমরা করতে পারবাে।…শাসনব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ করা হবে। জেলা গভর্নরের কাছে যাবে আমার ওয়ার্কস প্রােগ্রামের টাকা। তার কাছে যাবে আমার খাদ্যসামগ্রী। তাঁর কাছে যাবে আমার টেস্ট রিলিফ, লােন, বিল ও সেচ প্রকল্পের টাকা।

কেন্দ্রীয় প্রশাসনের ডাইরেক্ট কন্ট্রোলে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিল ডিস্ট্রিক্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন পরিচালনা করবে।…ব্রিটিশ আমলে সেই ঘুণে ধরা অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সিস্টেম দিয়ে বাংলার মানুষের মঙ্গল হতে পারে না। ইট মাস্ট গাে। সেই জন্য আমূল পরিবর্তন দরকার হয়ে পড়েছে। দ্যাট ইজ অলসাে এ রেভল্যুশন।…এই যে পলিটিক্যাল পার্টিএটা খুব ইমপরট্যান্ট জিনিস। এর মেম্বারশীপ ইচ্ছা করলেই পাওয়া যায় না।… এখানে যে শােষণহীন সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কথা আমরা বলেছি, সে অর্থনীতি আমাদের, সে ব্যবস্থা আমাদের। কোন জায়গা থেকে হায়ার করে এনে, ইমপাের্ট করে এনে কোন ‘ইজম’ চলে না।…আজকে আপনারা মনে রাখবেন যে, নতুন আর্মি, নেভি, এয়ারফোর্স, সরকারি কর্মচারী, বেসরকারি কর্মচারী, পলিটিশিয়ান, শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী, ডক্টরস, ইঞ্জিনিয়ারস যদুর সম্ভবপর এদের রাখার চেষ্টা করেছি। পলিটিশিয়ানদের মধ্যে অনেক এক্সপিরিয়েন্সড়- আমার পুরােনাে বন্ধুরা আছেন যারা আগে আমাদের সাথে ছিলেন। কিছুদিন ডিফারেন্ট পার্টি করেছেন। আগে আমরা এক জায়গায়ই ছিলাম। মধ্যে ভাগ হয়ে গেলাম, এটা সব জায়গায় হয়। আবার আমরা এক হয়েছি। সেকেন্ড রেভলুশন ইজ নট দি এন্ড। সেকেন্ড রেভলুশন যে করেছি আমি, চারটা প্রােগ্রাম দিয়েছি, এটাই শেষ নয়। করাপশন ন্যাশনাল ইউনিটি অ্যান্ড ফ্যামিলি প্ল্যানিং। এগুলাে করলেই আমরা একটা শশাষণহীন সমাজ ব্যবস্থা গড়তে পিরবাে- যেখানে মানুষ সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে বাস করতে পারবে। এটাই হলাে আমার সেকেন্ড রেভলুশনের মূল কথা, এজন্যই আমি সেকেন্ড রেভল্যুশনের ডাক দিয়েছি ।…

বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য গৃহীত কর্মসূচির শুরুতেই দেশের তক্কালে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসতে থাকে। দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে সরকারবিরােধী দলের বিলুপ্তি ঘটে এবং গােপন চরমপন্থী দলগুলাের সন্ত্রাসী তৎপরতাও ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসছিল। দেশের উৎপাদনব্যবস্থায় উন্নতি পরিলক্ষিত হতে থাকে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রবণতা হ্রাস পায়, খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি থমকে যায়। বাকশাল গঠনের মাত্র পাঁচ-ছয় মাসের মধ্যে এই বৈপ্লবিক পরিবর্তন শুরু হয়েছিল। স্বল্পতম যে সময়ে বাকশালের কর্মসূচি চালু ছিল তাতেই দেশের পরিস্থিতির উল্লেখযােগ্য উন্নতি হয়েছিল। প্রায় সব কিছুই নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আসতে শুরু করেছিল। অর্থনীতির ক্ষেত্রে স্থিতিশীলতা ফিরে আসার লক্ষণ দেখা দিয়েছিল। চালের দাম তকালীন ওজনের মাপে সের প্রতি আট টাকা থেকে নেমে সাড়ে পাঁচ টাকা হয়েছিল। মধ্যবিত্তের জীবনযাত্রার সূচক খাদ্যমূল্য হ্রাস পেয়েছিল। অন্যান্য জিনিসপত্রের দামও কমতে শুরু করেছিল। জনমনে স্বস্তি দেখা দিতে শুরু করে। বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র সম্পর্কে দুই-একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করা প্রয়ােজন। গঠনতন্ত্রে উল্লেখ করা হয় যে, জাতীয় রাজনৈতিক দল বাকশালের লক্ষ্য হলাে শাসনতন্ত্রে ঘােষিত চার মূলনীতির বাস্তবায়ন এবং পূর্ণ অর্থনৈতিক মুক্তির মাধ্যমে শােষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা। এ ছাড়া গঠনতন্ত্রে জাতীয় রাজনৈতিক দল বাকশালের আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অবস্থান সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছিল যে, সারা পৃথিবীতে সৌভ্রাতৃত্ব ও সুদূরপ্রসারী শান্তি প্রতিষ্ঠার সমস্ত চেষ্টায় সহযােগিতা ও অংশগ্রহণ থাকবে এই দলের । সাম্রাজ্যবাদ, বর্ণবাদ ও উপনিবেশবাদের বিপক্ষে পরিচালিত ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনসংগ্রামকেও সমর্থন জানাবে এই দল।  সাংগঠনিক বিষয়াদি সম্পর্কেও গঠনতন্ত্রে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। জাতীয় পরিষদই ছিল দলের সর্বোচ্চ সংস্থা। প্রতি দুই বছর অন্তর এই পরিষদের বৈঠক অনুষ্ঠানের নিয়ম করা হয়েছিল। জাতীয় পরিষদের দুটি বৈঠকের মধ্যবর্তী সময়ে দলের প্রধান সংস্থা  হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে কেন্দ্রীয় কমিটি। দলের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হবে গঠনতন্ত্রের রীতি ও নিয়মের মাধ্যমে এবং কর্মকাণ্ডের নিয়ন্ত্রক হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে কেন্দ্রীয় কমিটি। সরকারি এবং সামাজিক সংগঠনগুলাের নিয়ন্ত্রণও কেন্দ্রীয় কমিটির হাতে রাখা হয়েছিল। দল পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের সর্বময় ক্ষমতা দেওয়া হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠনসমূহকে (কৃষক, শ্রমিক, যুবক, ছাত্র, মহিলা) দলের নীতিমালা মেনে চলার বিষয়ে গঠনতন্ত্রে উল্লেখ করা হয়েছিল। নতুন জাতীয় রাজনৈতিক দল (বাকশাল) প্রাথমিক সাংগঠনিক কাঠামাে তৈরির কাজে নিয়ােজিত থাকায় এর বাইরে অন্য কোনাে তৎপরতায় অবতীর্ণ হতেই পারেনি। অতি অল্প সময়ের অস্তিত্বকালে বাকশাল তার কর্মক্ষমতার কোনাে নিদর্শন প্রদর্শনের সুযােগই পায়নি। তাই,  এর সফলতা-বিফলতা বা সম্ভাব্যতা সম্বন্ধে কোনাে অভিমতই দেওয়া সম্ভব নয়, সঙ্গতও হবে না। যারা এই জাতীয় দল (বাকশাল) গঠনের বিপক্ষে প্রচার-প্রচারণা করেন বা করেছিলেন তা তারা উদ্দেশ্য প্রণােদিত হয়ে করেছিলেন বা এখনও করেন এমন মন্তব্য

সূত্র : বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১-৭৫ এইচ টি ইমাম

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!