দি ইকোনমিস্ট, লন্ডন, ৩১ জুলাই ১৯৭১
বাঙলায় পাকিস্তানীদের দিন শেষ হয়ে আসছে
পূর্ব পাকিস্তানে শরনার্থিদের ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে একটি ছোট্ট প্রথম পদক্ষেপটি অর্জন করা হয়েছে। পাকিস্তান জাতিসংঘ পর্যবেক্ষকদের সেখানে কাজ করার অনুমতি দিয়েছে। ভারত এই সপ্তাহে এই প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা মনে করে সীমান্তের এদিকে পর্যবেক্ষক থাকা উচিত। কিন্তু শরণার্থীদের ফিরে আসার প্রধান বাধাটি পূর্ব পাকিস্তানে গভীরভাবে বজায় রয়েছে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া থেকে প্রশংসা ছাড়া আর কিছুই পায়নি। যখন কেউ পূর্ব পাকিস্তানে ভ্রমণ করবে তখন তার কাছে সুস্পষ্ট হবে যে তারা অত্যধিক শক্তি ব্যবহার করেছে। প্রদেশ জুড়ে যে ক্ষতি করা হয়েছে তা বিশাল হয়ে উঠেছে, এবং এটির একটি অফিসিয়াল কাহিনি ছিল – সেটা হল সৈন্যদের যখন গুলি করা হয়েছে শুধুমাত্র তখনি তারা গুলি করেছে। সর্বাধিক আক্রান্ত হয়েছে বাজার এলাকা, যেখানে তারা সর্বাধিক ক্ষয়ক্ষতি ও অগ্নিকান্ড ঘটিয়েছে।
প্রদেশের প্রধান সড়কগুলির দুইপাশের কুটির পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে এবং বেশিরভাগ এলাকায় চারপাশে রাস্তা এবং ব্রিজগুলি থেকে মানব বসতি সাফ করা হয়েছে। সেনাবাহিনীর দাবি যে মাত্র আটজন সৈন্য, যাদের মধ্যে কোনও কর্মকর্তা নেই – যাদের শাস্তি দেওয়া হয়েছে বাড়াবাড়ির জন্য। রিপোর্ট আছে যে কমপক্ষে একজন ব্রিগেডিয়ার তার কমান্ড দিয়েছেন। কর্তৃপক্ষ যদি এই ধরনের শৃঙ্খলাবদ্ধ ব্যবস্থা গড়ে তোলে তাহলে এটা বিদেশী সাহায্য দাতা এবং উদ্বাস্তুদের সন্তস্ট করতে পারে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কোনও সমালোচনার ব্যাপারে ভয়ঙ্কর কথা বলছে, যারা পাকিস্তানের সৃষ্টির পর থেকে কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে।
বেশিরভাগ শরণার্থী হিন্দু – মোট প্রায় ৭ মিলিয়নের প্রায় ৬ মিলিয়ন হিন্দু। রাষ্ট্রপতি আশ্বস্ত করেছেন, নতুন সংবিধান আগের তুলনায় আরো বেশি ইসলামী হবে; এবং এটা এখনও অস্পষ্ট যে সেনাবাহিনী কিভাবে এটা থামাবে। ২১ শে জুন – রাষ্ট্রপতির বক্তব্যের দুই দিন পর – ঢাকার সবচেয়ে বিখ্যাত হিন্দু মন্দিরকে গুড়িয়ে ফেলা হয়। এবং দুর্বৃত্তরা আশেপাশের গ্রামে সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালিত করে। যেগুলোর বেশিরভাগ ছিল হিন্দুদের।
হিন্দু শরণার্থী এখনও পূর্ব পাকিস্তান থেকে চলে যাচ্ছে। যারা সীমান্তে সাক্ষাৎকার দিয়েছে তারা বলে যে তারা চলে যাচ্ছে কারণ তাদের কাছে স্পষ্ট হচ্ছে যে ভবিষ্যতে পাকিস্তানে তারা কোন স্থান পাবে না। সেনাবাহিনীর পাশাপাশি তারা যেসব অভিযোগ করে, তারা হচ্ছে জামায়াত-শিবিরের ধর্মীয় দলসমূহ জামায়াত ইসলামী ও মোসলেম লীগের বাঙ্গালী সদস্য যারা গত ডিসেম্বরে ‘নির্বাচন’এ হেরেছিল এবং বিহারি যারা যারা ভারত থেকে মোসলেম শরণার্থী হিসেবে এসেছিল।
দু’টি নতুন দল “শান্তি কমিটি” গঠন করেছে। এখন পর্যন্ত এই কমিটি সেনাবাহিনীকে আওয়ামী লীগের সদস্যদের এবং হিন্দুদের সম্পর্কে তথ্য দেয়ার কাজে নিয়োজিত রয়েছে। অনেক লোক পালিয়ে গেছে এবং বরাদ্দ কমিটি করা হয়েছে যারা এইসব পতিত জমি দেখাশোনার দায়িত্ব পালন করবে। অফিসিয়ালি এসব জমি থেকে প্রাপ্ত আয়ের অর্ধেক যাবে রিলিফ ফান্ডে এবং যার সম্পদ সে যদি ফিরে আসে তাহলে তাকে তার জমি বুঝিয়ে দেয়া হবে। যেহেতু ফিরে আসার সম্ভবনা খুব কম তাই বাস্তবে তা ঘটবে কিনা সন্দেহ আছে। ফিরে আসা শরনার্থিদের পক্ষে তাদের জমি আবার ফিরে পেতে কষ্ট হবে – কারণ এগুলোর দায়িত্বে আছে বিহারী ওঁ মুসলিমরা যারা এই মুহুর্তে বর্তমান সামরিক সরকারের লোক।
শান্তি কমিটির অধীনে রাজাকাররা কাজ করে, এরা হোম গার্ড-টাইপ স্বেচ্ছাসেবক যাদের সামান্য মজুরি দেওয়া হয় – যারা মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের ব্যাপারে গুপ্তচরবৃত্তি করে পুলিশকে সহায়তা করে। তাদের বেশিরভাগই কেবল স্থানীয় ঠগ। বলা আছে যাদের বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল কেইস আছে তারা যদি রাজাকারে নাম লেখায় তাহলে তাদের কেইস উঠিয়ে নেয়া হবে। এবং তারা সাথে অস্ত্র বহনের ন্যায্য অধিকার পাবে।
শান্তি কমিটি এবং রাজাকার, সুবিধাবাদী সহযোগীদের সমন্বয়ে একটি দল, যাদের মুক্তি ফৌজ গেরিলারা তাদের প্রধান লক্ষ্য হিসেবে বেছে নিয়েছে। তারা তাদের একটি পর্যাপ্ত সংখ্যায় হত্যা করেছে। ঢাকায় সামরিক কর্তৃপক্ষ বেসামরিক সমর্থন বাড়ানোর জন্য তাদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছে। প্রকৃতপক্ষে জেনারেল ফরমান আলী, যিনি পূর্ব পাকিস্তানের সিভিল প্রশাসনের দায়িত্বে আছেন, তিনি সর্বজনীনভাবে স্বীকার করেছেন যে শান্তি কমিটিতে কিছু খারাপ মানুষ রয়েছে।
কিন্তু সময় সামরিক সরকারের পক্ষে নেই। মুক্তি ফজকে দেখিয়ে দিয়েছে যে তারা ঢাকাতেও কাজ করতে পারে এবং ইতিমধ্যেই যেসব বাঙালি সামরিক কর্তৃপক্ষের সাথে চলবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা নেবে। এবং যতদিন মুক্তিবাহিনী কাজ চালাচ্ছে ততদিন পর্যন্ত সরকার বাঙালি কাউকে প্রশাসনে দিতে সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে। ৬০০০০ সৈন্য এবং ৫ হাজার পশ্চিম পাকিস্তানি পুলিশ ছাড়াও সরকার “সম্ভাব্য উপনিবেশিক” হিসাবে যতটা সম্ভব কম রাখার চেষ্টা করেছে বলে মনে হয়। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানি সিভিল সার্ভিসের লোকদের স্বরাষ্ট্র ও তথ্য মন্ত্রণালয়ে রাখা হয়েছে। এবং ঢাকা ও চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক হিসেবে আনা হয়েছে: পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের কিছু লোক সরানো হয়েছে – ৮৫০ টি ফ্লাইট ওঁ গ্রাউন্ড স্টাফদের মার্চের পড় থেকে ছাঁটাই করা হয়েছে। পিআইএ-তে নিরাপত্তা অপরিহার্য। কারণ এটি দেশের দুটি উইংসের মধ্যে একমাত্র লিংক।
রাষ্ট্রপতির পক্ষেও সময় নেই যদি মুক্তি ফৌজ অর্থনীতিকে তাদের টার্গেট সেট করে থাকে। ব্রিজ এবং যোগাযোগের ক্ষয়ক্ষতি করা হয় মূলত সেনাবাহিনীর চলাচল কমিয়ে দেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে। এখন তারা পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান শস্য – পাট – চায়ের বিরুদ্ধে একটি যৌথ অভিযান শুরু করেছে; এগুলো পাকিস্তানের প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনকারী শস্য – এগুলোর খুব কম পরিমাণ মিলে আসে। তারা মিলের কাছে ছোট্ট চিরকুট পাঠাচ্ছে। উৎপাদনকারী ও ডিলারদের কাছে মুক্তিফৌজ চিঠি পাঠাচ্ছে যাতে লেখা আছে এগুলোকে না সরানোর ব্যাপারে। অনেক গুলি চিঠিতে পোস্ট মার্ক আছে যার অর্থ তাদের নিজস্ব ডাক ব্যাবস্থা আছে। যা গেরিলাদের নিজেদের কাজে ব্যাবহ্রিত হচ্ছে। এবং মিলগুলি যে সামান্য পরিমাণ পাট পায় তাও বিহারী ও বাঙালি শ্রমিকের দ্বন্দ্বের ফলে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ভারতীয় সীমান্ত থেকে কিছু অঞ্চলে শেলিং হয়েছে এবং মুক্তিবাহিনী আটটি কারখানা উড়িয়ে দিয়েছে।
কিন্তু এখন পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তান থেকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার উপর সামান্য চাপ দেখা যাচ্ছে। পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কে সংবাদ ব্যাপকভাবে সেন্সর করা হয় এবং শুধুমাত্র ভারতীয় সম্প্রচার থেকে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে জানা যায়। এবং যেহেতু অর্থনৈতিক সংকোচন ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে বিজনেস লবি রাষ্ট্রপতির সাথে উপস্থাপিত হচ্ছেনা। শুধুমাত্র জনাব ভুট্টো অব্যাহত মার্শাল লঙ্ঘনের বিষয়ে মাঝে মাঝে অভিযোগ করে, এবং এটি কেবলমাত্র পশ্চিম পাকিস্তানে তার নির্বাচনী সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবার জন্য করে।