তৌফিক-ই-ইলাহী/ এলাহী চৌধুরী (সিএসপি ১৯৬৮), বীরবিক্রম
মুক্তিযুদ্ধে অনন্যসাধারণ অবদান বা ভূমিকা পালনের অধিকারী জনাব মাে. তৌফিক-ই-ইলাহী/ এলাহী চৌধুরী (Md. Taufiq-e-Elahi Chaudhury) সম্বন্ধে কিছু বলতে গেলে আমরা মনে করি তা শুরুই হওয়া উচিত সা’দত হুসাইন-এর মূল্যবান স্মৃতিভাষ্য উদ্ধার করে, যাতে তিনি জানাচ্ছেন: “০১ মার্চ ১৯৭১ এ গণঅভ্যুত্থান শুরু হলে সেটেলমেন্ট ক্যাম্প বন্ধ করে আমাদেরকে নিজ নিজ কর্মস্থলে যােগ দেবার নির্দেশ দেয়া হয়। আমি যশােরে ফিরে আসি। এরপর ওয়ালি (১৯৬৭ সাল ব্যাচের সিএসপি ওয়ালিউল ইসলাম) ভাই-এর সাথে সর্বশেষ দেখা হয়েছে ২৩ মার্চ তারিখে, ঝিনাইদহে। মহকুমা পুলিশ অফিসার মাহবুব উদ্দিনের (পরবর্তীতে এসপি মাহবুব নামে খ্যাত) বাসায় মধ্যাহ্ন ভােজে স্বাধীনতা আন্দোলনে দেশ তখন উত্তাল। পুরােমাত্রায় চলছে অসহযােগ আন্দোলন। সেই অনুষ্ঠানে আরাে উপস্থিত ছিলেন মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক ড. তৌফিক ভাই (ড. তৌফিক ইলাহী চৌধুরী বীরবিক্রম, বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা) রাজবাড়ি মহকুমার প্রশাসক শাহ মােহাম্মদ ফরিদ (পরবর্তীতে প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি)। তৌফিক ভাই বলেছিলেন স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে আমি।সরাসরি যুদ্ধে যােগ দেব, অবস্থা বেগতিক দেখলে লাফ দিয়ে ওপারে গিয়ে বসে থাক, তবে কোনাে অবস্থাতেই পাকিস্তানিদের গােলামী করব না। অনুষ্ঠানে সবাই স্বাধীনতার পক্ষে সােচ্চার ছিল।”৪০
তৌফিক-ই-ইলাহী/ এলাহী চৌধুরী তার এ ধনুর্ভাঙ্গা পণ যথাসময়ে অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন। বস্তুত বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে যেসব সিএসপি- ইপিসিএস অফিসার মুক্তিযুদ্ধের একেবারে শুরুতে ও পরে নানাভাবে জড়িয়ে পড়েছিলেন এবং আগাগােড়া গৌরবদীপ্ত ভূমিকা রেখেছিলেন, তাঁদের মধ্যে এঁর অবদান অন্য সবার চেয়ে ব্যতিক্রমী, বিশিষ্ট ও অনন্য। একমাত্র পূর্বপাকিস্তানি বাঙালি সিভিল সার্ভিস অফিসার হিশেবে তিনি সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছায়, বুদ্ধিতে ও একক চেষ্টায় একটি দেশের নাগরিক ও গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদে (এসডিও) অধিষ্ঠিত থেকে অন্য আরেকটি স্বাধীন দেশের (এক্ষেত্রে ভারতের) সম ও উর্ধ্বতন পদ-পদবির কর্মকর্তাদের কাছে আসন্ন মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন-সহযােগিতা চেয়ে গোপনে পত্র যােগাযােগ করেছিলেন। স্মর্তব্য, বহুলকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুসহ অন্য যারা আসামি ছিলেন তাদের মধ্যে রাজনীতিবিদ ছাড়াও তখনকার কয়েকজন সিভিল সার্ভিস ও মিলিটারি অফিসার জড়িত বা অভিযুক্ত ছিলেন । সম্ভবত সেটাই প্রথম সরকারি পদে থেকে দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য সিভিল সার্ভিস অফিসারদের প্রথাবিরােধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখা গিয়েছিল। এরপর, আমাদের জানা মতে, তৌফিক-ই-ইলাহী/ এলাহী চৌধুরীই প্রথম পূর্বপাকিস্তানি সিভিল সার্ভিস কর্মকর্তা, যিনি স্বদেশের স্বাধীনতার জন্য ভারতের প্রত্যক্ষ সহযােগিতা চান। এজন্য তিনি এককভাবে কিছু প্রাথমিক উদ্যোগও নিয়েছিলেন; যে-প্রক্রিয়ায় পরে রাজনৈতিক নেতবৃন্দ বিশেষ করে জনাব তাজউদ্দীন আহমদ, ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম প্রমুখ জড়িত হয়েছিলেন।
বিশিষ্ট গবেষক সুকুমার বিশ্বাস জনাব চৌধুরীর ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারসূত্রে মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ভূমিকা ও তৎপরতা সম্পর্কে মুক্তিযুদ্ধে রাইফেলস্ ও অন্যান্য বাহিনী শীর্ষক গ্রন্থে যা লিখেছেন, তার কিয়দংশ এখানে তুলে ধরা হলাে: “মার্চ মাসে মেহেরপুর মহকুমা প্রশাসক ছিলেন জনাব তৌফিক-ই এলাহী চৌধুরী)। তিনি ২৫শে মার্চেই পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে বাংলাদেশ সরকারের আনুগত্য ঘােষণা করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। জনাব চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধে সাহায্যের প্রশ্নে ভারতের সঙ্গে যােগাযােগ শুরু করলেন। ২৬শে মার্চ তিনি তার সিল-স্বাক্ষর দিয়ে দুটি চিঠি লিখলেন ভারতবর্ষে। একটি চিঠি নদীয়া জেলা প্রশাসককে, যার অনুলিপি দিলেন ৭৬তম বি, এস, এফ.-এর কমান্ডিং অফিসার লেঃ কর্নেল চক্রবর্তীকে। অপর চিঠিটি লিখলেন ভারতবর্ষের জনগণের উদ্দেশ্যে। এই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ জনাব চৌধুরীকে ২৯শে মার্চ ভারতের বেতাই বি. ও. পি, (বর্ডার আউট পােস্ট) তে সাক্ষাৎ করতে বললেন।/ ২৯শে মার্চ জনাব চৌধুরী ভারতের বেতাই বি, ও, পি-তে উপস্থিত হন। নদীয়া জেলা প্রশাসক এবং লে: কর্নেল চক্রবর্তী জনাব চৌধুরীকে সাদরে গ্রহণ করলেন। এক ঘন্টা নানা বিষয় নিয়ে আলােচনা শেষ করে জনাব তৌফিক-ই-এলাহী মেহেরপুর ফিরে আসেন। পুনরায় ভারতীয় কর্তৃপক্ষ জনাব তৌফিক-ই-এলাহীকে সংবাদ পাঠালেন ৩০শে মার্চ রাতে চুয়াডাঙ্গা সীমান্তে চেংখালী চেক পােস্টের অদূরে ভারতীয় বি, ও, পি-তে একজন সামরিক অফিসারসহ দেখা করার জন্য। জনাব চৌধুরী মেজর ওসমানের সঙ্গে আলােচনার জন্যে ৩০শে মার্চ সকালে চুয়াডাঙ্গা আসেন। মেজর ওসমান ঝিনাইদহ মহকুমা পুলিশ অফিসার জনাব মাহবুব উদ্দিন আহমদকে সঙ্গে নিয়ে সীমান্তে যেতে বললেন। তৌফিক-ই- এলাহী চৌধুরী জনাব মাহবুবের সঙ্গে ভারতীয় সাহায্য এবং অন্যান্য বিষয় নিয়ে আলােচনা করলেন। এই সময় আওয়ামীলীগ নেতা জনাব তাজউদ্দিন আহমেদ এবং ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম নানা জনপদ ঘুরে ঝিনাইদহে এসে অবস্থান করছিলেন। ৩০শে মার্চ মাহবুব উদ্দিন তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে একটি জীপে করর চুয়াডাঙ্গা আসেন। ঐ দিন সিদ্ধান্ত হয়-তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী এবং মাহবুব উদ্দিন যখন ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলােচনা করতে যাবেন তখনই এই দুই নেতাকে ভারতে পাঠানাে হবে। ৩০শে মার্চ বিকালে ২টি জীপ গাড়ীতে নেতৃদ্বয়কে নিয়ে তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী এবং মাহবুব উদ্দিন আহমদ সীমান্তের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। সন্ধ্যার পর পরই সীমান্তে উভয় দেশের নেতৃবর্গের মধ্যে ব্যাপক আলােচনা হয়। ঐ সভাতে দু’টি সিদ্ধান্ত হয়: এক, আগামী ৩১ মার্চ থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্যের জন্যে কিছু কিছু অস্ত্রশস্ত্র দেওয়া হবে, দুই, ভারতীয় সামরিক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতৃবর্গের যােগাযােগ করিয়ে দিতে হবে। জনাব তাজউদ্দিন এবং ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামের উপস্থিতির কথা তখনও গােপন রাখা হয়েছিলাে। মাহবুব উদ্দিন এবং তৌফিক-ই- এলাহী চৌধুরী নিজেরা আলােচনা করে বি, এস, এফ-এর উচ্চপদস্থ অফিসার শ্রী গােলক মজুমদারকে আওয়ামী লীগ নেতৃদ্বয়ের উপস্থিতির কথা বলেন। তখনই নেতৃদ্বয়কে আনতে বলা হলাে। মজুমদার বাবু বললেন, ‘দমদম বিমান বন্দরে সামরিক জেট বিমান অপেক্ষা করছে আওয়ামী লীগ নেতৃবর্গকে নিয়ে যাবার জন্যে।”৪১
মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক লেঃ কর্ণেল (অব.) এম, এ, ওসমান চৌধুরী৪২ সূত্রে শ্রীবিশ্বাস আরও লিখেছেন: “মেহেরপুর মহকুমা প্রশাসক জনাব তৌফিক-ই- এলাহী চৌধুরী, ঝিনাইদহ মহকুমা পুলিশ অফিসার জনাব মাহবুব উদ্দিন এবং ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের অধ্যাপক জনাব শফিকউল্লাহ মেজর ওসমানের নির্দেশে যুদ্ধের ময়দানে অফিসার হিসাবে কাজ করছিলেন। দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনে তখন সামরিক অফিসারের বিশেষ প্রয়ােজন ছিলাে। মেজর ওসমান সেই পরিচালনা করার জন্যে এই ত্রয়ী অফিসারকে সরাসরি ‘ক্যাপ্টেন র্যাঙ্কে’ কমিশন দিয়ে র্যাঙ্ক’ (ব্যাজ?) পরিয়ে দেন। সেক্টর অর্ডারে বলা হলাে:/ “On behalf of the Bangladesh High command (Command?). I, hereby award commission to the following persons directly in the rank of captain to meet operational requirements./a. Mr. Towfique-E-Elahi Chowdhury./ b. Mr. Mahbubuddin Ahmed./c. Mr. Md. Shafiqueullah./ স্বাক্ষর/ (মেজর এম. এ. ওসমান চৌধুরী)।”৪৩
মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক তৎকালীন মেজর (অবঃ)রফিক- উল- ইসলাম জনাব চৌধুরী সম্বন্ধে লিখেছেন: “এদিকে ২৬শে মার্চেই দু’জন বেসামরিক অফিসার মেহেরপুরের এসডিও তৌফিক এলাহী চেীধুরী এবং ঝিনাইদহের এসডিপিও মাহবুব উদ্দিন আহম্মদ বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে স্বাধীনতা যুদ্ধে যােগ দেন। পাকসেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য সাহায্যের অনুরোধ জানিয়ে জনাব তৌফিক এলাহী ২৬শে মার্চ ভারতের নদিয়া জেলার ডি- সি’র নিকট চিঠি লেখেন। চিঠিটির একটি প্রতিলিপি ঐ এলাকার বিএসএফ কমান্ডিং অফিসারকেও দেওয়া হয়। ৩০শে মার্চ সকালে জনাব তৌফিক চুয়াডাঙ্গায় মেজর ওসমানের সঙ্গেও যোগাযােগ করেন। সেদিনই মেজর ওসমানের পরামর্শে জনাব তৌফিক এবং মাহবুব উদ্দিন প্রয়ােজনীয় সাহায্যের বিষয়ে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে যান।/ এ সময়ে আওয়ামী লীগের সেক্রেটারী জেনারেল জনাব তাজউদ্দিন (যুদ্ধকালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী) কয়েকজন দলীয় নেতাসহ ঝিনাইদহে উপস্থিত হন। জনাব তৌফিক এবং জনাব মাহবুবউদ্দিন বিএসএফ অফিসারদের কাছে আওয়ামী লীগ নেতাদের আগমন বার্তা জানিয়ে দেন। তখনই জনাব তাজউদ্দিন এবং তার সঙ্গীদের প্রথমে কলকাতা এবং সেখান থেকে বিমানযােগে দিল্লী নিয়ে যাওয়া হয়।”88
মজিবনগর সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা এবং মুক্তিযােদ্ধা চৌধুরী হাবীবুর রহমান সিদ্দিকী তৎপ্রণীত ও সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধে লক্ষ বাঙালী শহীদের রক্তস্রাত স্বাধীনতা নামক গ্রন্থে প্রায় একই কথা লিপিবদ্ধ করেছেন: “তৌফিক-ই এলাহী চৌধুরী (বর্তমানে [১৯৯২] যুগ্ম সচিব, অর্থ মন্ত্রণালয়) তখন ছিলেন মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক। ২৫শে মার্চেই তিনি পাকিস্তান সরকারের সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করেন এবং মুক্তিযুদ্ধে যােগদান করে(ন)। ২৯শে মার্চ তৌফিই-ই-এলাহী চৌধুরী নদীয়ার জেলা প্রশাসক ও ভারতীয় বিএসএফ বাহিনীর অধিনায়কের সাথে বেতাই সীমান্তে মিলিত হন। সম্ভাব্য ভারতীয় সাহায্য, অস্ত্রশস্ত্র ও গােলাবারুদ সরবরাহের বিষয়টি আলােচিত হয়। এই সময় আওয়ামী লীগ নেতা তাজউদ্দিন আহমেদ ও ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম ঝিনাইদহে এসে উপস্থিত হন। তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী ও মাহবুব উদ্দিন (ঝিনাইদহের এসডিপিও) বিএসএফ-এর কর্মকর্তার সাথে আললাচনাক্রমে নেতৃদ্বয়ের ভারতে যাবার ব্যবস্থা করেন। পরে দমদম বিমানবন্দরে সামরিক বিমানে চড়ে নেতৃদ্বয় নয়াদিল্লী চলে যান।
যাই হােক, তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী- যুগপৎ বেসামরিক ও সামরিক অফিসার হিশেবে অতঃপর মুক্তিযুদ্ধকালে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে সরাসরি বিভিন্ন খণ্ডযুদ্ধে (skirmish) অংশ নিয়েছিলেন। উল্লেখ্য, মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক কর্নেল (অব.) এম, এ. জি. ওসমানী এবং অপরাপর শীর্ষস্থানীয় অধিনায়ক ইউনিট বা চৌকি প্রভৃতি পরিদর্শনে আসতেন তখন নিজ ইউনিটের সদস্য হিসেবে তিনি সেখানে উপস্থিত থাকতেন। যেমন, সুকুমার বিশ্বাস লিখেছেনঃ’২০ শে এপ্রিল সকাল ১০টায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নবনিযুক্ত সেনাপতি এ. জি. ওসমানী বেনাপােলে মুক্তিযােদ্ধাদের সদর দফতর পরিদর্শন করেন। দফতরে মেজর এম, এ, ওসমান চৌধুরীর সঙ্গে ক্যাপ্টেন তৌফিক-ই এলাহি চৌধুরী, ক্যাপ্টেন মাহবুব, ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন, ক্যাপ্টেন মুস্তাফিজুর রহমান প্রমুখ অফিসার ছিলেন।”৪৬
বােঝাই যাচ্ছে, ততদিনে তিনি পুরােদস্তুর একজন দক্ষ ও চৌকস সামরিক কর্মকর্তা হয়ে উঠেছিলেন। অন্যদিকে আমাদের জানা মতে, সাবেক পাকিস্তান সিভিল তথা বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের তিনিই একমাত্র অফিসার যিনি সেনাবাহিনীর এজাতীয় রাঙ্ক-ব্যাজ পরিধানের বিরল ও এখনপর্যন্ত অনন্য সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। তার আগে বা পরে আর কেউ এটা পাননি। ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি গ্রন্থে লিখেছেন: “মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক (তওফিক এলাহী) মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে যােগ দিয়েছেন। চুয়াডাংগার অবাঙ্গালী মহকুমা প্রশাসককে হত্যা করা হয়েছে। কুষ্টিয়ার অবাঙ্গালী জেলা প্রশাসক মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে বন্দী।.. তওফিক একাধারে চুয়াডাংগা ও মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক। সেখানে বসে পাবনার খবর পাই। সেখানে মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে জেলা প্রশাসক নুরুল কাদের যােগ দিয়েছেন। মাগুরা, ঝিনাইদহ, ফরিদপুর আমাদের অবস্থা ভাল। যশাের সেনানিবাস বীর জনতার দ্বারা তখনাে অবরুদ্ধ।”৪৭
তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর বিরল কৃতিত্বের একটি এই যে, নবগঠিত মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিপরিষদের শপথগ্রহণ সংক্রান্ত অনুষ্ঠানসূচি প্রণয়ন এবং শপথগ্রহণ শেষে মঞ্চস্থ মাননীয় অতিথিবৃন্দকে সম্মানসূচক গার্ড অব অনার প্রদানকারী দলের নেতৃত্বপ্রদান। ব্যারিস্টার আমীর লিখেছেন: “১৭ই এপ্রিল জাতীয় ইতিহাসের একটি স্মরণীয় দিন। স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণের দিন ।.. ভােরের দিকে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, খন্দকার মােশতাক আহমদ, এম, মনসুর আলী, এ এইচ এম কামরুজ্জামান এবং ওসমানী একটি গাড়ীতে রওয়ানা হয়ে যান।/ শপথ অনুষ্ঠানের নির্ধারিত স্থান আম্রকাননে পৌছতে ১১টা বেজে গেল। অনুষ্ঠানের আয়ােজন প্রায় শেষ। মাহবুব (এসডিপিও) ও তওফিক এলাহী অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন।”৪৮
রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী পরিবেশিত তথ্যে পাই: ‘স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের বর্ণনাঃ- ১৯৭১ এর ১৭ এপ্রিল। সকাল ন’টা। অস্থায়ী বেকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল হলাম ও অন্যান্যদের নিয়ে বৈদ্যনাথ তলায় মঞ্চে এলেন। আশেপাশের গ্রাম থেকে চেয়ার আনা হয়েছে। সংগৃহীত চেয়ারগুলোর একটাও পূর্ন(র্ণা)ঙ্গ নয়। কোনটার হাতল নেই, কোনটার বা পা নেই। উ(ম) পাহ()রা দেয়ার জন্য নিয়ােজিত আনসারদের তখন রান্না হচ্ছিল। ক্যাপটেন মাহবুব আর জনাবতওফিক এলাহী চৌধুরী তখন অনুষ্ঠানসূচী প্রণয়নে ব্যস্ত। গার্ড অব অনার দেয়ার জন্য কয়েক প্লাটুন ইপিআর এবং কিছু মােজাহিদ প্রস্তুত।”৪৯
তার সামরিক তৎপরতা সম্পর্কে শ্ৰীত্রিবেদী লিখেছেন: “৬ আষাঢ় ১৩৭৮সােমবার ২১ জুন ১৯৭১/৮নং সেকটরের মুক্তিযােদ্ধারা ১৪ জুন মানিকনগর, ২০জন বৈদ্যনাথতলা, কুষ্টিয়া মুজিবনগর পুনরুদ্ধার করে। আখক্ষেত থেকেমুক্তিবাহিনীর আক্রমণে ২৮ জন পাকসেনা নিহত হয়। এ দিনের যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধানায়েব সুবেদার পাটোয়ারী বিশেষ কৃতিত্বের দাবি রাখে। উল্লেখ্য, এই সেন্টারেরস্টাফ অফিসার পদে দায়িত্ব পালন করেন প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য অবসরপ্রাপ্তফ্লাইট সার্জেন্ট জামাল চৌধুরী, আর দু’জন বেসামরিক কর্মকর্তা প্রত্যক্ষ সামরিকতৎপরতায় অংশ গ্রহণ করেন তারা হলেন মহকুমা প্রশাসক তৌফিক এলাহীচৌধুরী, সিএসপি (ডঃ বীর বিক্রম) ও মহকুমা পুলিশ কর্মকর্তা মাহবুব উদ্দিনআহমেদ (কুদরত) পিএসপি। স্থানীয় রাইফেল বাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর সাথেতরুণ কর্মীবাহিনী নিয়ে তারা প্রতিরােধ ব্যবস্থা গড়ে তােলেন। এই প্রতিরােধভাঙ্গতে পাকিস্তানী বাহিনীকে অনেক ক্ষয়ক্ষতি করতে হয়েছিল। পরবর্তীতে এইবাহিনী মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভা শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেএবং দু’টি পাকিস্তানী হামলার মুখে পিছিয়ে পড়ে মেজর ওসমান চৌধুরীরনেতৃত্বাধীন প্রধান দলটির সঙ্গে যােগদান করে। এপ্রিল মাসে পাবনার জেলাপ্রশাসক নূরুল কাদের খান, সিএসপি (প্রথম সংস্থাপন সচিব) অনুরূপপ্রতিরােধগড়েতুলেছিলেন এবং মেজর ওসমান চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন বাহিনীতে যােগ দেন। অবশ্য, ড. তৌফিক এলাহী চৌধুরী , বীর বিক্রম ও মাহবুব উদ্দিন আহমেদ বীরবিক্রম সরকারের বেসামরিক পদে যােগদান না করে দু’জনেই প্রত্যক্ষ স্বাধীনতাযুদ্ধে নিয়ােজিত থাকেন। এদিনের মুজিবনগর পুনরুদ্ধার তাদেরই নিবেদিতনেতৃত্বের সাফল্য।”৫০
নিচে অধুনালুপ্ত দৈনিক বাংলা, ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭২ তারিখের ৯ম বর্ষ ৩৮শ সংখ্যায় স্বয়ং তৌফিক-ই-ইলাহী/ এলাহী চৌধুরী লিখিত ‘যুদ্ধে যারা লড়েছে’ নামীয় রচনা থেকে কিছু অংশ উদ্ধৃত করে তার প্রসঙ্গ আলােচনা শেষ করব (সংশ্লিষ্ট পত্রিকা থেকে সরাসরি সংগৃহীত)।
‘ যাইহােক, আমি বস্তুনিষ্ঠতা বজায় রাখার, লক্ষ্য সম্পর্কে সত্যনিষ্ট থাকার চেষ্টা করব।/.. আমাদের স্বাধীনতার লড়াই-এ যে বিভিন্ন শক্তি অংশ নিয়েছে তাদের ভূমিকাকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্নভাবে দেখা একটু কঠিন ব্যাপার। এক্ষেত্রে সামগ্রিক সংগ্রামে বিভিন্ন গােষ্ঠীর অবদানের বর্ণনা করাই শ্রেয়। যুদ্দের প্রথম পর্যায় মােটামুটিভাবে ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ থেকে এ সময়টা ছিল ইয়াহিয়ার পশুশক্তির হামলার বিরুদ্ধে দেশব্যাপী গনঅভ্যুত্থান ও সামরিক বিদ্রোহ। একটি জাতির শােষিত হওয়ার তিক্ত অভিজ্ঞ তারাজনৈতিক শিক্ষা ও সংকল্প থেকে এই গণঅভ্যুত্থানের সূচনা হয়েছিল। এতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, পাক বাহিনীর বিরুদ্দে কতকগুলাে স্থানে যে যুদ্ধ হয় তার মধ্য দিয়েই প্রতিরােধ বাস্তব রূপ লাভ করে। এই যুদ্ধগুলাে প্রধানত বেঙ্গল রেজিমেন্ট, অন্যান্য সশস্ত্র বাহিনী, তদানিন্তন ইপিআর, পুলিশ, আনসার ও মুজাহিদ বাহিনীর জোয়ান ও অফিসারদের নেতিৃত্তে সংঘটিত হয়েছিল; যদিও অনেকস্থানে বেসামরিক ব্যক্তিরাই লড়াইএর নেতৃত্ত দিয়েছিল।.. মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক হওয়ার দুর্লভ সম্মানের উপযুক্ত না হলেও অত্যন্ত গৌরব ও আনন্দের সঙ্গে এই সুমহান দায়িত্বভার আমি গ্রহণ করেছিলাম। ১৯৭১ সালের ২৫শে ও ২৬শে মার্চের রাতে ইয়াহিয়ার বর্বর বাহিনী সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর বিরুদ্ধে যে ঘৃণ্য অঘােষিত যুদ্ধ শুরু করেছিলাে তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণের গৌরবােজ্জ্বল প্রতিরােধ-সংগ্রামের সুকঠিন দায়িত্বভার আমি গ্রহণ করেছিলাম। ইয়াহিয়ার বর্বর বাহিনীর আক্রমণের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে এবং বাংলাদেশের মানুষের প্রতিরােধ সংগ্রামে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বীর অফিসার ও সৈনিকেরা (বাংলার বাঘেরা), সাবেক ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস-বর্তমানে বাংলাদেশ রাইফেলসের সাহসী বীরেরা(,) দেশপ্রেমিক আনসার ও মুজাহিদেরা এবং সশস্ত্র পুলিশ বাহিনীর বঙ্গবীরেরা ঐক্যবদ্ধ হয় এবং সংগ্রাম শুরু করে। লড়াই শুরু করে তারা বর্বর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে। এ যুদ্ধ কোন বিদ্রোহ ছিল না। এ যুদ্ধ জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ-জাতীয়স্বাধীনতা অর্জনের লড়াই। ৫১
Reference: মুক্তিযুদ্ধে সিএসপি ও ইপিসিএস অফিসারদের ভূমিকা