সরকারের পররাষ্ট্রনীতি (১৯৭১-৭৫)
মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশের বৈদেশিক সম্পর্ক বিভিন্নভাবে গড়ে ওঠে। বহু প্রতিকূলতা, বিরােধিতা ও বাধা-বিঘ্ন পেরিয়ে প্রথম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্যবৃন্দ বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি অবিচল আস্থা স্থাপন করে বিদেশি অসংখ্য প্রতিনিধির সঙ্গে ফলপ্রসূ যােগাযােগ করেন। ওই সব বন্ধুপ্রতিম বিদেশি প্রতিনিধিরা বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিগণ, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি এবং বাস্তুচ্যুত ক্ষতিগ্রস্ত বাঙালি জনগণের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। পৃথিবীর বহু রাষ্ট্রের প্রতিনিধির সঙ্গে প্রথমে এভাবেই বাংলাদেশ সরকার ও জনগণের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ভারত ও সােভিয়েত ইউনিয়নসহ পূর্ব ইউরােপের দেশগুলাের সরকার ও জনগণ সর্বতােভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নেয়। আমেরিকান কংগ্রেসের তৎকালীন স্বনামখ্যাত এডওয়ার্ড কেনেডি, ফ্রাঙ্ক চার্চ প্রমুখ, যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্ট সদস্য পিটার শাের, জন স্টোন হাউস, রেজিনাল প্রেনিটি, নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পােস্ট, নিউজউইক, টাইম ম্যাগাজিন প্রভৃতির সাংবাদিক-প্রতিনিধিবৃন্দ, সানডে টাইমস, লন্ডন টাইমস, গার্ডিয়ান, লা মনদে প্রভৃতির বার্তা প্রতিনিধি মুক্তিযুদ্ধকালে ভারতীয় সীমান্তে আশ্রয়গ্রহণকারী শরণার্থীদের প্রকৃত অবস্থা এবং বাংলাদেশের পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখতে ছুটে আসেন। এসব বিদেশি ব্যক্তি রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং বাংলাদেশ সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সাথে সাক্ষাৎ করে তাদের নিজ নিজ দেশের সরকারকে বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করেন। শুধু অবহিত করাই নয়, ক্ষতিগ্রস্ত বাঙালি জাতির পাশে দাড়িয়ে কীভাবে সাহায্য-সহযােগিতা করা যায় সে-সম্বন্ধেও কূটনৈতিক দূতের মতােই কাজ করেন।
অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিদেশি প্রতিনিধিগণের সাক্ষাৎকারের বিষয় পররাষ্ট্র সম্পর্কিত কার্যাবলির পর্যায়ে ও মর্যাদায় উন্নীত হয়ে উঠতে দেখে আমি অভিভূত হতাম। কোনাে কোনাে সময় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকেও পররাষ্ট্রবিষয়ক এসব কাজ সমন্বয় করা হতাে। বলাই বাহুল্য, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকার সুবাদে আমি ওইসব কাজকর্মের প্রত্যক্ষ সাক্ষী। বিদেশে যে প্রতিনিধিদল পাঠানাে হতাে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচারণা এবং বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য যুক্তি তুলে ধরতে, তাদের সমন্বয় প্রধানমন্ত্রী নিজেই করতেন। ঐতিহাসিক কোনাে সৌভাগ্য কিংবা দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা বিস্মৃত হওয়ার যেমন উপায় নেই, তেমনি মুজিবনগরে ১৯৭১ সালে ১৭ এপ্রিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্যবৃন্দের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের পরদিন (১৮ এপ্রিল) আনুষ্ঠানিকভাবে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব বণ্টনের বিষয়টিও ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার নয়। মন্ত্রিসভার বিশেষ বৈঠকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আইন ও সংসদবিষয়ক কার্যাবলি দেখাশােনার দায়িত্ব খন্দকার মােশতাক আহমদকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তাঁর নাম এখন বাংলাদেশের ইতিহাসে এক কালিমালিপ্ত অধ্যায়ের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্রের তিনি ছিলেন অন্যতম নায়ক। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতি ১৮ এপ্রিল আনুগত্য ঘােষণা করে তালে কোলকাতাস্থ পাকিস্তান হাইকমিশনের বেশির ভাগ বাঙালি কর্মকর্তা এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। ওই দিনই তারা ডেপুটি হাইকমিশনারের কার্যালয় দখল করে নেন। উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে, ওই দখলিকৃত ভবনে প্রথম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম শুরু হয়। ভবনটি আগে থেকেই সুসজ্জিত ও সুনিয়ন্ত্রিত হওয়ায় পররাষ্ট্রবিষয়ক কার্যাবলি সুষ্ঠুভাবে করার সুযােগ পাওয়া গিয়েছিল। উল্লেখ্য, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী এবং বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির সরাসরি হস্তক্ষেপে মন্ত্রিসভার বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্তের আলােকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে কাজ করতে হতাে।
মুক্তিযুদ্ধকালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আকার-আকৃতি তেমন উল্লেখযােগ্য না হলেও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী এবং বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির নির্দেশ ও মন্ত্রণালয় সমগ্র দেশের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতাে এবং একই সঙ্গে ভয়াবহ মুক্তিযুদ্ধের সব কিছু সামাল দিতে হতাে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সংখ্যা ছিল মাত্র ১৫ জন। এঁরা ছাড়াও বিদেশে বাংলাদেশের পক্ষে আনুগত্য ঘােষণা করে অনেকেই প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এবং মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের (Cabinet Division-এর) সঙ্গে সরাসরি যােগাযােগ রক্ষা করতেন। কুচক্রী খােন্দকার মােশতাক গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার বিশেষত প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের বিরুদ্ধে প্রথম থেকেই তৎপর ছিলেন। কয়েকজন সহযােগীসহ মােশতাক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের সঙ্গে সমঝােতার অপচেষ্টা করেন। মাহবুব আলম চাষী, তাহের ঠাকুর গংয়ের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পরিপন্থী কার্যকলাপে লিপ্ত থাকার বিষয় প্রথম থেকেই আঁচ করা গিয়েছিল। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত থেকে প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ সাহচর্যে দায়িত্ব পালনকালে মুক্তিযুদ্ধের প্রতিকূলে ওইসব ব্যক্তির ষড়যন্ত্রের বিষয় আমার দৃষ্টিতে পড়ত। এ জন্য, ওইসব ব্যক্তিকে প্রধানমন্ত্রী কখনাে আস্থার মধ্যে রাখতেন না। দেশ মুক্ত হওয়ার পর বাংলাদেশ সরকার খন্দকার মােশতাক আহমদ এবং মাহবুব আলম চাষীকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়।
বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর মতাে উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি বিদেশে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে দূতিয়ালি করার নির্দেশনা-পরামর্শ সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকেই পেতেন। এমন আরাে উচ্চ মর্যাদার ব্যক্তিবর্গ ওইভাবেই বাংলাদেশের পররাষ্ট্রবিষয়ক দায়িত্ব পালন করতেন। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরােপের বিভিন্ন দেশে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বহু বাঙালি রাজনৈতিক নেতা, সামাজিক মর্যাদাবান ব্যক্তি বাংলাদেশের স্বাধীনতার দাবির যৌক্তিকতা, পাকিস্তানের সামরিক সরকারের নৃশংসতার বিবরণ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রচলিত রীতিনীতি অনুযায়ী না করতে পারলেও তা বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী এবং বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির নির্দেশেই করতেন। এসব নির্দেশপত্র টেলিগ্রাম মারফত ছাড়াও টেলিফোনেও দেওয়া হতাে। সব ধরনের বৈদেশিক নীতি প্রধানমন্ত্রী নিজেই নির্ধারণ করে দিতেন। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সরকারের সবগুলাে মন্ত্রণালয় প্রয়ােজন অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর নির্ধারিত ও নির্দেশিত কার্যাবলি বাস্তবায়নে কাজ করত। মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশ সরকার বঙ্গবন্ধু কর্তৃক নির্দেশিত রূপরেখা অনুযায়ী পররাষ্ট্রবিষয়ক যেনীতিমালা প্রণয়ন করেছিল তার বৈশিষ্ট্য ছিল নিম্নরূপ : ১. সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারাে প্রতি বিদ্বেষ নয়। বৈদেশিক নীতির ব্যাপক বৈশিষ্ট্য হলাে সকল বাস্তব প্রয়ােজনে মৌলিক ধারণার ব্যাখ্যা। ২. রাজনৈতিক অবদমন, অর্থনৈতিক শােষণ ও বঞ্চনা এবং সাংস্কৃতিক আগ্রাস অবসানে বিশ্বাসী। ৩. জোটনিরপেক্ষ, সাম্রাজ্যবাদবিরােধী এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান—এই তিনটি আমাদের বৈদেশিক নীতির গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তিপ্রস্তর (corner stone)। ৪. পৃথিবীত্রাসী ও আঞ্চলিক শান্তিবিনষ্টকারী সকলপ্রকার সামরিক চুক্তির আমরা বিরােধিতা করি। আমরা সেনটো (CENTO) এবং সিয়াটো (SEATO)কে নিন্দা করি। অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি অস্থিতিশীলকারী অথবা কোনাে দেশের নিজেদের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলন দমনকারী সকল প্রকার সামরিক চুক্তির বিরুদ্ধে সার্বক্ষণিকভাবে আমরা বিরােধিতা করব। ৫. বাংলাদেশ নিন্দা জানায় সাম্রাজ্যবাদ এবং নব্য সাম্রাজ্যবাদ উপনিবেশবাদ এবং ছােট দেশগুলাের ওপর অন্যান্য সর্বপ্রকার বহিঃশক্তির অশুভ প্রভাব বিস্তার। বাংলাদেশ পারস্পরিক সমঝােতার ভিত্তিতে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে এবং সংলাপপ্রক্রিয়ার ভিত্তিতে বিভিন্ন দেশ বা জাতির মধ্যে বিরাজমান জটিলতার। সমস্যা সমাধানে বিশ্বাসী। আমরা মনে করি ক্ষমতাধর পরাশক্তিগুলি নিমরূপে বিন্যস্ত : ক. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র খ. সমাজতান্ত্রিক সােভিয়েত রাশিয়া গ. চীন ৮. আমরা সকল পরাশক্তির সমর্থন এবং তদনুযায়ী সার্বক্ষণিক সহযােগিতা প্রত্যাশা করি। আমরা এশিয়ার পুনঃজোটবদ্ধতার প্রভাবের বিরােধিতা করি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের প্রতি সম্মান জানিয়ে বলি, ইসলামাবাদের সামরিক বাহিনীকে অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ এবং ভারত-বাংলাদেশের সীমান্তজুড়ে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক নিয়ােগসংক্রান্ত বিষয়ে চাপ সৃষ্টির কারণে আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনের ভূমিকার নিন্দা জ্ঞাপন করি। বাংলাদেশ ইস্যুর প্রতি সহযােগিতা ও সহানুভূতির জন্য আমেরিকার বৃহত্তর জনগােষ্ঠীর প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ। আমরা অবশ্যই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অন্যান্য সংগঠন, যেমন কংগ্রেস ও সিনেটের প্রতিও কৃতজ্ঞ।
সমাজতান্ত্রিক সােভিয়েত রাশিয়া প্রাথমিক পর্যায়েই আমাদের সংগ্রামের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল। পরবর্তী পর্যায়ে ভিন্নতর কৌশলের কারণে আমাদের সংগ্রামের প্রতি নিরপেক্ষতার নীতি অবলম্বন করে। ভারত-সােভিয়েতের সাম্প্রতিক ইশতেহারও বাংলাদেশের জন্য ফলদায়ক নয়। কিন্তু সােভিয়েত রাশিয়ার সমর্থনের ব্যাপারে আমরা আশাবাদী। আমাদের অনুকূলে সােভিয়েত রাশিয়ার সক্রিয়মদদ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে খুবই সতর্কতার সাথে প্রয়াস চালাতে হবে। ১০. চীনের ব্যাপারে আমরা ইচ্ছাকৃতভাবে নীরবতা রক্ষা করছি এবং তা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। কারণসমূহ খুবই স্পষ্টভাবে বলা যায়। ১১. সমগ্র আফ্রো-এশীয় সংহতির প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখব। আফ্রো-এশীয় সকল দেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ লালন করব। ১২. খুবই বেদনার সাথে উল্লেখ করতে হয় যে, আরবদেশসমূহ আমাদের স্বার্থের বিপক্ষে কাজ করেছে, কিন্তু আমরা এ ব্যাপারে অনানুষ্ঠানিকভাবে নিরপেক্ষতা বজায় রাখব এবং রাখতে হবে। আমরা মনে করি ইসলামি ভ্রাতৃত্বের ব্যাপক প্রচারকারী সরকারসমূহের এটি একটি ভয়ংকর ব্যর্থতা। আমরা বাস্তব সত্যের প্রতি তাদের আকৃষ্ট করার প্রয়াস চালিয়ে যাব এবং সেইসঙ্গে তারা যে ভুল বােঝাবুঝিতে ভুগছে তা দূর করার চেষ্টা করব। ১৩. আরব-ইসরায়েল সম্পর্কের সূত্রে আমাদেরকে কোনাে পক্ষেই রাখিনি এবং তা অব্যাহত রাখব যত দিন-না আমাদের নীতিমালা পরিবর্তিত হয়। ১৪. শুধুমাত্র লন্ডন ছাড়া সমগ্র ‘স্বাধীন’ ইউরােপ কমবেশি নীরব। অতএব পাকিস্তান প্রায় ওয়াকওভার পেয়ে যাচ্ছে।
১৫. ইউরােপের সকল সমাজতান্ত্রিক দেশ আমাদের সংগ্রামের প্রতি সুস্পষ্ট সমর্থন। জ্ঞাপন করেছে এবং আমরা সেইসব দেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের ক্রমাগত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। ১৬. উপযুক্ত নীতিমালা চলতি সময়ের জন্য। বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতিমালা আরাে সংক্ষেপ করা হবে। বৈদেশিক নীতিমালা ধারাবাহিকভাবে পুনঃনিরীক্ষা করা হচ্ছে এবং যখনই যেখানে যেকোনাে ধরনের গুরুত্বপূর্ণ উন্নতি বা প্রয়ােজনীয়তা পরিলক্ষিত হচ্ছে তা বিবেচনার জন্য গ্রহণ করা হচ্ছে, যথাযথভাবে সমন্বিত করা হচ্ছে। বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক বিষয়সমূহ ওপরের নীতিমালা অনুযায়ী সরকারের তদানীন্তন সব অঙ্গসংগঠন পালন করেছিল। উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধকালে বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলােতে এই নীতিমালা অনুসরণে কাজ করে যাওয়ার জন্য মুজিবনগরস্থ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র দফতর থেকে একটি প্রজ্ঞাপন তকালীন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ((OSD) আনােয়ারুল করিম চৌধুরীর স্বাক্ষরে জারি করা হয়েছিল (পরিশিষ্ট.. ৫৫ দ্রষ্টব্য)। তকালে কোলকাতায় ম. হােসেন আলীকে, নতুন দিল্লিতে এইচ আর চৌধুরীকে, লন্ডনে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে, স্টকহােমে আ. রাজ্জাককে, নিউইয়র্কে এস এ করিমকে, ওয়াশিংটনে এম, আর, সিদ্দিকীকে, হংকং-এ মহিউদ্দিন আহমেদকে, ম্যানিলায় কে. কে, পন্নীকে, কাঠমান্ডুতে এ.এম, মুস্তাফিজুর রহমানকে, বার্নে ওয়ালিউর রহমানকে, টোকিওতে এস, এম, মাসুদকে বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃত প্রতিনিধি হিসেবে উক্ত প্রজ্ঞাপনের সঙ্গে প্রেরিত তালিকায় উল্লেখ করা হয়েছিল। এভাবে বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার প্রজ্ঞাপন জারির দৃষ্টান্ত থেকে তকালীন বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাজকর্ম সম্বন্ধে ধারণা লাভ করা যায়।
এই চিঠি/প্রজ্ঞাপনের যে-বৈশিষ্ট্য তাতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অনুসৃত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রীতিনীতিরই অনুরূপ। তৎকালীন সরকারের কাজকর্ম স্বাধীন সার্বভৌম যেকোনাে দেশের সরকারের পররাষ্ট্রবিষয়ক কাজকর্মের মতােই ছিল। পৃথিবীময় ছড়িয়ে থাকা মাতৃভূমির প্রতি অবিচল আনুগত্য পােষণকারী বাঙালি কর্মকর্তা কর্মচারী, বুদ্ধিজীবী, প্রশিক্ষণার্থী এমনকি অধ্যয়নরত ছাত্র-শিক্ষকগণও বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে এমনভাবে কাজ করেছেন যা পররাষ্ট্রবিষয়ক কাজকর্মের সঙ্গে সমার্থক ছিল। মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখতে সমর্থ হয়েছিল। তক্কালে বৈদেশিক ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিকভাবে যা যা প্রয়ােজন হয়েছিল তা-ই করা হয়েছিল। এসব কাজের মধ্যে কিছু কিছু উল্লেখ করা প্রয়ােজন এজন্য যে, স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের জানুয়ারি থেকে ১৯৭৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কীভাবে গঠিত হয়েছিল । তার তুলনামূলক ব্যাপকতা ও বিস্তৃতি বুঝতে সুবিধা হবে। বাংলাদেশের সংবিধানে পররাষ্ট্র নীতি বিষয়ক আদর্শ স্বাধীন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতর মৌলিক আদর্শ সম্বন্ধে ১৯৭২ সালে প্রণীত ও অনুমােদিত বাংলাদেশের সংবিধানে স্পষ্টভাবে ঘােষিত হয়েছিল। বাংলাদেশ সরকারের ১৯৭২-৭৫ সাল পর্যন্ত পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক এই অধ্যায়ে বাংলাদেশ সংবিধানের ১৫ সংখ্যক অনুচ্ছেদের বয়ান নিচে তুলে ধরা হলাে : জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও সমতার প্রতি শ্রদ্ধা, অন্যান্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা, আন্তর্জাতিক বিরােধের শান্তিপূর্ণ সমাধান এবং আন্তর্জাতিক আইনের ও জাতিসংঘের এবং যখনই যেখানে যেকোনাে ধরনের গুরুত্বপূর্ণ উন্নতি বা প্রয়ােজনীয়তা পরিলক্ষিত হচ্ছে তা বিবেচনার জন্য গ্রহণ করা হচ্ছে, যথাযথভাবে সমন্বিত করা হচ্ছে। বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক বিষয়সমূহ ওপরের নীতিমালা অনুযায়ী সরকারের তদানীন্তন সব অঙ্গসংগঠন পালন করেছিল। উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধকালে বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলােতে এই নীতিমালা অনুসরণে কাজ করে যাওয়ার জন্য মুজিবনগরস্থ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র দফতর থেকে একটি প্রজ্ঞাপন তৎকালীন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ((OSD) আনােয়ারুল করিম চৌধুরীর স্বাক্ষরে জারি করা হয়েছিল (পরিশিষ্ট.. ৫৫ দ্রষ্টব্য)। তকালে কোলকাতায় ম. হােসেন আলীকে, নতুন দিল্লিতে এইচ আর চৌধুরীকে, লন্ডনে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে, স্টকহােমে আ. রাজ্জাককে, নিউইয়র্কে এস এ করিমকে, ওয়াশিংটনে এম, আর, সিদ্দিকীকে, হংকং-এ মহিউদ্দিন আহমেদকে, ম্যানিলায় কে. কে, পন্নীকে, কাঠমান্ডুতে এ.এম, মুস্তাফিজুর রহমানকে, বার্নে ওয়ালিউর রহমানকে, টোকিওতে এস, এম, মাসুদকে বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃত প্রতিনিধি হিসেবে উক্ত প্রজ্ঞাপনের সঙ্গে প্রেরিত তালিকায় উল্লেখ করা হয়েছিল। এভাবে বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার প্রজ্ঞাপন জারির দৃষ্টান্ত থেকে তকালীন বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাজকর্ম সম্বন্ধে ধারণা লাভ করা যায়।
এই চিঠি/প্রজ্ঞাপনের যে-বৈশিষ্ট্য তাতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অনুসৃত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রীতিনীতিরই অনুরূপ। তৎকালীন সরকারের কাজকর্ম স্বাধীন সার্বভৌম যেকোনাে দেশের সরকারের পররাষ্ট্রবিষয়ক কাজকর্মের মতােই ছিল। পৃথিবীময় ছড়িয়ে থাকা মাতৃভূমির প্রতি অবিচল আনুগত্য পােষণকারী বাঙালি কর্মকর্তা কর্মচারী, বুদ্ধিজীবী, প্রশিক্ষণার্থী এমনকি অধ্যয়নরত ছাত্র-শিক্ষকগণও বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে এমনভাবে কাজ করেছেন যা পররাষ্ট্রবিষয়ক কাজকর্মের সঙ্গে সমার্থক ছিল। মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখতে সমর্থ হয়েছিল। তক্কালে বৈদেশিক ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিকভাবে যা যা প্রয়ােজন হয়েছিল তা-ই করা হয়েছিল। এসব কাজের মধ্যে কিছু কিছু উল্লেখ করা প্রয়ােজন এজন্য যে, স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের জানুয়ারি থেকে ১৯৭৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কীভাবে গঠিত হয়েছিল । তার তুলনামূলক ব্যাপকতা ও বিস্তৃতি বুঝতে সুবিধা হবে। বাংলাদেশের সংবিধানে পররাষ্ট্র নীতি বিষয়ক আদর্শ স্বাধীন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতর মৌলিক আদর্শ সম্বন্ধে ১৯৭২ সালে প্রণীত ও অনুমােদিত বাংলাদেশের সংবিধানে স্পষ্টভাবে ঘােষিত হয়েছিল। বাংলাদেশ সরকারের ১৯৭২-৭৫ সাল পর্যন্ত পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক এই অধ্যায়ে বাংলাদেশ সংবিধানের ১৫ সংখ্যক অনুচ্ছেদের বয়ান নিচে তুলে ধরা হলাে : জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও সমতার প্রতি শ্রদ্ধা, অন্যান্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা, আন্তর্জাতিক বিরােধের শান্তিপূর্ণ সমাধান এবং আন্তর্জাতিক আইনের ও জাতিসংঘের “চিরশত্রু বলে যেমন কিছু নেই, তেমনি চির বন্ধু বলেও কিছু নেই” । জাতীয় স্বার্থই স্থায়ী বিষয়। পৃথিবীর মানচিত্রে ভৌগােলিক অবস্থান পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে গুরুত্ববহ বিষয় হতে পারে। এসব বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার প্রথম থেকেই সজাগ ও সতর্ক ছিল। নতুন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নে সচেতনতার প্রয়ােজন ছিল। প্রথম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রনীতি সামনে রেখেই পরবর্তীকালে (১৯৭২-৭৫ কালে) বাংলাদেশ সরকারের যে পররাষ্ট্রনীতি প্রণীত হয়েছিল, তাকেই মূল ভিত্তি ধরে এখনাে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে তৃতীয় বিশ্বের প্রতি ঝুঁকে পড়ার প্রবণতা বেশি ছিল। আমাদের পররাষ্ট্রনীতিতে সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল।
স্বাধীনতা লাভের আগে সাবেক পাকিস্তানে পূর্ব বাংলার গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল দলের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন জোটনিরপেক্ষ প্রগতিশীল পররাষ্ট্রনীতির কথা জোর দিয়ে বলতেন। পররাষ্ট্রনীতির মতাে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য ছিল, “আজ বিশ্বজুড়ে যে ক্ষমতার লড়াই চলছে, সে ক্ষমতার লড়াইয়ে আমরা কোনােমতেই জড়িয়ে পড়তে পারি না। এ জন্য আমাদের অবশ্যই সত্যিকারের স্বাধীন ও জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করতে হবে।” পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশের পৃথক হওয়ার লক্ষ্যেই শুধু ১৯৭১ সালে আন্দোলন-সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং বাঙালি জাতির আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধ একটি আদর্শ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে চালিত হয়েছিল। বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতির মধ্যে সেই আদর্শের প্রতিফলন পরিলক্ষিত হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রনীতিও প্রণীত হয়েছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আন্দোলন-সংগ্রামে প্রদত্ত বক্তৃতা-বিবৃতিতে ফুটে-ওঠা নীতির আলােকে। এই অধ্যায়ের সূচনায় প্রথম বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রনীতির বিষয়ে উল্লেখযােগ্য দিকগুলাে নিয়ে আলােচনা করা হয়েছে। তবে প্রাসঙ্গিকভাবে প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের তকালীন একটি সংবাদ-বিবৃতির কথা বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক এই অধ্যায়ে উল্লেখ করা প্রয়ােজন। তাজউদ্দীন আহমদ বলেছিলেন, We do not aspire to join any bloc or pact but will seek assistance from those who give it in a spirit of goodwill free from any desire to control our destinics. We have struggled far too long for our self determination not to permit ourselves to become any one’s satellite. প্রত্যক্ষভাবে বঙ্গবন্ধু সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী, তার সরকার ও জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। সােভিয়েত ইউনিয়ন, বুলগেরিয়া, পােলান্ড এবং ইউরােপীয় কিছু দেশ এবং ফ্রান্স, ব্রিটেনের সরকার ও জনগণের প্রতিও তিনি তার কৃতজ্ঞতা জানান। ১. বঙ্গবন্ধুর বেতার ভাষণ, ২৮ অক্টোবর ১৯৭০ ২, হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ দলিলপত্র, ৩য় খণ্ড, পৃঃ ৩২
বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ায় তিনি ভুটান, ভারত, সােভিয়েত ইউনিয়ন, বুলগেরিয়া, পােলান্ড, বার্মা, মঙ্গোলিয়া, পূর্ব জার্মানিকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেছিলেন। এ ছাড়া বাংলাদেশের জনগণের সংগ্রামকে সমর্থন করায় সমগ্র পৃথিবীর স্বাধীনতাকামী মানুষসহ। যুক্তরাষ্ট্রের জনগণকেও তিনি ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন। চীনের প্রতি আবেদন জানিয়ে বঙ্গবন্ধু আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন এই বলে যে, আমি আশা করি গণপ্রজাতন্ত্রী চীন আমাদের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামকে স্বীকৃতি দেবে। কারণ, চীনও যুদ্ধবাজ শােষকের বিরুদ্ধে সগ্রাম করে স্বাধীনতা অর্জন করেছে।
বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ওপরে ব্যক্ত কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদের মধ্যে যে বিষয় স্পষ্ট তা হচ্ছে তিনি পৃথিবীর সব রাষ্ট্রের সাথে বন্ধুত্ব কামনা করেছিলেন।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সহচর ড. কামাল হােসেনের অভিমত প্রণিধানযােগ্য। তিনি এক সাক্ষাঙ্কারে বলেন, “আওয়ামী লীগের দীর্ঘ দিনের দাবি ছিল জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি গড়ে তোেলা। রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধুর সরকার তাই অনুসরণ করেছে স্বাধীনতা পরবর্তীকালে । স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর তিনি বাংলাদেশকে প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড বলে ঘােষণা করেন। অর্থাৎ সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়।”
মুক্তিযুদ্ধকালে সােভিয়েত ইউনিয়ন এবং ভারত যেভাবে সাহায্য-সহযােগিতা করেছিল তাতে প্রধানত এই দুটি রাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের আন্তরিকতা ও ঘনিষ্ঠতা। গভীরভাবে গড়ে উঠেছিল। বঙ্গবন্ধু ও সঙ্গত কারণে বাংলাদেশ সরকারের প্রধান হিসেবে এ দুই দেশে সফর করেন।
মুক্তিযুদ্ধে ভারত সরকার ও জনগণের বিশেষ সহযােগিতা ও সাহায্যের বিষয়গুলাে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক দৃঢ় করতে প্রবল ভূমিকা রাখে। মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সহায়তার জন্য বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু ভারতকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের গভীরতা বঙ্গবন্ধুর এক ঘােষণায় আরাে স্পষ্টভাবে প্রকাশ পায়। লন্ডন থেকে দিল্লি বিমানবন্দরে পৌছে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি ঘােষণা দিয়ে বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের ভ্রাতৃত্ববন্ধন চিরকাল অটুট থাকবে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী। ইন্দিরা গান্দীর সঙ্গে তার নীতির মিলের প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু বলেন, এটা হচ্ছে আদর্শ, দৃষ্টিভঙ্গি। ও মূল্যবােধের মিল।
সরকারের পররাষ্ট্রনীতি কত স্বাধীন ও দৃঢ় ছিল তা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যখন ১৯৭২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কোলকাতায় সরকারি সফরে গিয়েছিলেন তখন তার পরিচয় পাওয়া যায়। এই সফরের একপর্যায়ে বঙ্গবন্ধু ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে সুস্পষ্ট ভাষায় প্রশ্ন করে জানতে চান যে, মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতীয় যেসব সৈন্য বাংলাদেশের প্রয়ােজনে প্রবেশ করেছিল তারা কবে বাংলাদেশ থেকে প্রত্যাহৃত হবে। বঙ্গবন্ধুর সরকার স্বাধীনতার পরমুহূর্ত থেকে রাজনৈতিক বিরােধীদের কঠোর সমালােচনার
———-
৩. দৈনিক বাংলা, ১৫ জানুয়ারি ১৯৭২ ৪. , কমাল হােসেনের সাক্ষাৎকার, ১৫ জানুয়ারি ১৯৯৯
——-
মুখােমুখি হয়েছিল। বিদেশি কোনাে কোনাে মহলও সে সময় বাংলাদেশ সরকারের | নতজানু নীতির কথা বলে উসকানিমূলক প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছিল। এসব বিরােধিতার মুখে বঙ্গবন্ধুর সরকার কখনাে দুর্বল মনােভাব কিংবা দুশ্চিন্তা প্রকাশ করেনি। বরং প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে সমান-সমান মর্যাদায় তার দেশের পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জ্ঞাপন করা হয়েছিল। এমনকি ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের বিষয়টিও বঙ্গবন্ধু তাঁর সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি হিসেবে বিবেচনা করেই ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে এ প্রসঙ্গে প্রশ্নের জবাব চেয়েছিলেন। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীও যথাযােগ্য মর্যাদায় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে ইতিবাচক উত্তরই দিয়েছিলেন। সে কথা সবার জানা। ভারতীয় সৈন্য বাংলাদেশের মাটি থেকে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চের আগেই প্রত্যাহৃত হয়েছিল। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির প্রথম সােপানে পা রেখে সরকার উন্নত শিরে এগিয়ে চলার প্রেরণা পেয়েছিল। ভারত সরকারের আমন্ত্রণে বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সরকারপ্রধান হিসেবে কোলকাতা গিয়েছিলেন এ কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। এটিই ছিল বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে বঙ্গবন্ধুর প্রথম বিদেশ সফর। এই সফরের মধ্য দিয়ে সরকারের পররাষ্ট্রনীতি স্বাধীন বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছিল। ওই সফরের | ফলে বাংলাদেশ থেকে মিত্রবাহিনী প্রত্যাহারের ঘােষণা বিশেষ কূটনৈতিক সাফল্য হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার মাত্র ৫০ দিনের মধ্যে এই সাফল্য বাংলাদেশের সমতা ও পারস্পরিক কল্যাণের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পররাষ্ট্রনীতির জন্যই সম্ভব হয়। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রনীতির আরাে একটি জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত বাংলাদেশের
ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশ সফর করেছিলেন ১৯৭২ সালের | ১৭ থেকে ১৯ মার্চ। তার সফরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ভিত দৃঢ় হয়। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় অবস্থিত ঐতিহাসিক সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে বৃহত্তম জনসমাবেশে উভয় দেশের নেতা ঘােষণা করেন চির অটুট বাংলাদেশ-ভারতের মৈত্রী ও বন্ধুত্বের কথা। বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীদ্বয় ১৯ মার্চ প্রকাশিত যৌথ ইশতেহারে | এই মনােভাবের কথা ঘােষণা করেন। দুই দেশের পররাষ্ট্রনীতির আলােকে উভয় প্রধানমন্ত্রী। বন্ধুত্ব, শান্তি ও সহযােগিতার জন্য একটি চুক্তি সম্পাদনের সিদ্ধান্ত নেন এবং এই সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে ২৫ বছর মেয়াদি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। চুক্তিটি ছিল নিম্নরূপ
TREATY OF FRIENDSHIP, CO-OPERATION AND
PEACE BETWEEN THE PEOPLE’S REPUBLIC OF BANGLADESH AND THE REPUBLIC OF INDIA
Inspired by common ideals of peace, secularism, democracy, socialism and nationalism. Having struggled together for the realisation of these ideals and cemented ties of friendship through blood and sacrifices which led to the triumphant emergence of a free, sovereign and independent Bangladesh,
Determined to maintain fraternal and good neighbourly relations and transform their border into a border of eternal peace and friendship,
Adhering firmly to the basic tenets of non-alignment, peaceful co-existence, mutual cooperation, non interference in internal affairs and respect for territorial integrity and sovereignty,
Determined to safeguard peace, stability and security and to promote progress of their respective countries through all possible avenues of mutual cooperation.
Determined further to expand and strengthen the existing relations of friendship between them,
Convinced that the further development of friendship and cooperation meets the national interests of both states as well as the interests of lasting peace in Asia and the world,
Resolved to contribute to strengthening world peace and security and to make efforts to bring about a relaxation of international tension and the final elimination of vestiges of colonialism and imperialism,
Convinced that in the present-day world international problems can be solved only through cooperation and not through conflict or confrontation,
The People’s Republic of Bangladesh, on the one hand and the Republic of India, on the other, have decided to conclude the present Treaty.
ARTICLE 1: The High Contracting Parties inspired by the ideals for which their respective peoples struggled and made sacrifices together, solemnly declare that there shall be lasting peace and friendship between their two countries and their peoples. Each side shall respect the independence, sovereignty and territorial integrity of the other and refrain from interfering in the internal affairs of the other side.
The High Contracting Parties shall further develop and strengthen the relations of friendship, good neighbourliness and
allround cooperation existing between them, on the basis of the above mentioned principle as well as the principles of equality and mutual benefit.
ARTICLE 2 Being guided by their devotion to the principles of equality of all people and states, irrespective of race or creed, the High Contracting Parties condemn colonialism and racialism in all their form and manifestations and reaffirm their detimination to strive for their final and complete elimination.
The Contracting Parties shall cooperate with other states in achieving these aims and support the just aspirations of peoples in their struggle against colonialism and racial discrimination and for their national liberation.
ARTICLE 3: The High Contracting Parties reaffirm their faith in the policy of non-alignment and peaceful co-existince, as important factors for easing tension in the world, maintaining international peace and security and strengthening national sovereignty and independence.
ARTICLE 4: The High Contracting Parties shall maintain regular contacts with each other on major international problems affecting the interests of both states, through mectings and exchanges of views at all levels.
ARTICLE 5 The High Contracting Parties shall continue to strengthen and widen their mutually advantageous and all round cooperation in the economic, scientific and technical fields. The two countries shall develop mutual cooperation in the fields of trade, transport and communications between them on the basis of the principles of equality, mutual benefit and the most favored nation principle.
ARTICLE 6 The High Contracting Parties further agree to make joint studies and take joint action in the fields of flood control, river basin development and the development of hydroelectric power and irrigation.
ARTICLE 7: The High Contracting Parties shall promote relations in the fields of art, literature, education, culture, sports and health.
ARTICLE 8: In accordance with the ties of friendship existing between the two contries each of the High Contracting Parities solemnly declares that it shall not enter into or participate in any military alliance derected against the other Party.
Each of the High Contracting Parties shall refrain from any
aggression against the other party and shall not allow the use of its territory for committing any act that may cause military damage to or constitute a threat to the security of the other High Contracting Party.
ARTICLE 9 Each of the High Contracting Parties shall refrain from giving any assistance to any third party taking part in an armed conflict against the other party. In case either Party is attacked, threatened with attack, the High Contracting Parties shall immediately enter into mutual consultation in order to take appropriate effective measures to climinate that threat and thus ensure the peace and security of their countries.
ARTICLE 10: Each of the High Contracting Parties solemnly declares that it shall not undertake any commitment, secret or open, toward one or more states which may be incompatible with the present Treaty
ARTICLE 11 : The Present Treaty is signed for a term of twenty five years and shall be subject to renewal by mutual agreement on the High Contracting Parties.
The Treaty shall come into force with immediate effect from the date of its signature.
ARTICLE 12 Any differences in interpreting any article or articles of the present Treaty that may arise between the High Contracting Parties shall be settled on a bilateral basis by peaceful means in a spirit of mutual respect and understanding.
Done in Dacca on the Nineteenth Day of March, Nineteen Hundred and Seventy two.
SHEIKH MUJIBUR RAHMAN Prime Minister For the People’s Republic of Bangladesh
INDIRA GANDHI
Prime Minister For the Republic of India
উল্লেখ্য, ভারত-সােভিয়েত মৈত্রী চুক্তি আগে থেকেই ছিল। সেই চুক্তির ধারাগুলাের সাথে বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী চুক্তির ধারাগুলাের মিল ছিল। একটা কথা স্মরণ করা প্রয়ােজন যে, সে সময় আমেরিকা ও রাশিয়ার মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ চলছিল। চুক্তিপত্রের ধারা অনুযায়ী এক দেশ আর এক দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতাকে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করবে। বাংলাদেশ এবং ভারত তাদের দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে পরস্পর হস্তক্ষেপ হতে বিরত থাকবে। এক দেশ আরেক দেশের বিরুদ্ধে কোনােরূপ আক্রমণ পরিচালনা করবে না। অপর দেশের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়তে পারে কিংবা অপর দেশের জন্য কোনাে সামরিক হস্তক্ষেপের আশঙ্কা দেখা দিতে পারে এমন কোনাে কার্যকলাপে নিজ দেশের এলাকা ব্যবহৃত হতে দেবে না। চুক্তিভুক্ত কোনাে দেশ আক্রান্ত হলে কিংবা আক্রমণের আশঙ্কা দেখা দিলে তা নিরসনের চেষ্টায় উভয় দেশ ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্দেশ্যে পরামর্শ করবে এবং পারস্পরিক সমঝােতার মাধ্যমে শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। পঁচিশ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী চুক্তি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বিরােধী দল বঙ্গবন্ধুর সরকারের সময় স্বাক্ষরিত এই চুক্তির বিরুদ্ধে অযৌক্তিক অপপ্রচার চালিয়েছে দীর্ঘকাল। এ চুক্তির বিরুদ্ধে বিপুল সমালােচনা হলেও, তা বিরােধিতাকারী রাজনৈতিক দল যখন ক্ষমতায় আসীন হয়েছে তখন সে সরকার ওই চুক্তি বাতিল করেনি। পররাষ্ট্রনীতির ফসল এই শান্তিচুক্তি ভারত-বাংলাদেশের পথনির্দেশক ছিল। উভয় দেশের জনগণের কল্যাণসাধন, সৎ প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক সৃষ্টি এবং শান্তির অন্বেষায় ভারত ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির এক সফল পদক্ষেপ। এই চুক্তির প্রভাবে গােটা উপমহাদেশের শান্তি ও সহযােগিতার নবদিগন্ত উন্মােচিত হয়েছিল।
উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে, বঙ্গবন্ধু নিজেই শান্তির পক্ষে সােচ্চার ছিলেন স্বাধীনতার অনেক আগে থেকেই। তিনি ১৯৫২ এবং ১৯৫৬ সালে বিশ্বশান্তি সম্মেলনে অংশ নিতে গণচীনে গিয়েছিলেন। তাঁর অন্তরে গাঁথা শান্তির মন্ত্র তাঁকে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও একইভাবে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। তাই তাঁর সরকার শান্তির সপক্ষে এই চুক্তিতে অংশীদার হয়েছিল। সােভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক সেভিয়েত ইউনিয়ন এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক সুদৃঢ় করতে বাংলাদেশ সরকার ১৯৭২ সালের ২ থেকে ৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন প্রতিনিধিদল সােভিয়েত ইউনিয়ন সফর করেছিল। ওই সময়ে সােভিয়েত ইউনিয়ন পৃথিবীর অন্যতম পরাশক্তি। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের এই সফর বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক বিষয়াদির ওপর এক কার্যকর প্রভাব ফেলে। এই সফরকে শুভেচ্ছা সফর হিসেবে অভিহিত করা হয়। বঙ্গবন্ধু মস্কোর উদ্দেশে বিমানে আরােহণের আগে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, “সােভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ ও জনগণের জন্য বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের শুভেচ্ছা নিয়ে যাচ্ছি।” রাজনৈতিক ও পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে এই সফরের প্রভাব ছিল অপরিসীম। এই সফরে বন্ধুরাষ্ট্র সেভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পর্ক আরাে দৃঢ় হয়েছিল। সরকারের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে এ ছিল এক সফল সফর।
——–
৫.দৈনিক বাংলা, ২০ মার্চ ১৯৭২
—–
প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এই সফরে প্রতিনিধিদলের সঙ্গে যারা অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিলেন তৎকালীন ক্যাবিনেট সেক্রেটারি হিসেবে আমি, প্রধানমন্ত্রীর সচিব রফিকুল্লাহ চৌধুরী, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন মহাপরিচালক (রাজনৈতিক) শাহ এ এম এস কিবরিয়া, ফারুক আহমেদ চৌধুরী, বৈদেশিক প্রচার দফতরের মহাপরিচালক আরশাদুজ্জামান, বাংলাদেশ বেতারের মহাপরিচালক এনামুল হক, প্রধানমন্ত্রীর জনসংযােগ অফিসার আবুল হাশেম, সচিব মাহবুবুল আলম, সহকারী প্রেস সচিব আমিনুল হক বাদশা, বঙ্গবন্ধু-তনয় শেখ কামাল প্রমুখ। এই দলের সঙ্গে ৯ জন সাংবাদিকও গিয়েছিলেন। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে প্রতিনিধিদলের সােভিয়েত ইউনিয়ন সফর উপলক্ষে ওই দেশের দুটি প্রধান সংবাদপত্র “প্রাভদা” ও “ইজভেস্তিয়া” বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ঘটনার বিবরণ দিয়ে | উল্লেখ করেছিল যে, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূল লক্ষ্য হচ্ছে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, জোট নিরপেক্ষতা, সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, জাতি বৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে সগ্রাম, পৃথিবীর সব দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের উন্নয়ন এবং আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা সুদৃঢ় করা। বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের নেতা মস্কোর ভানকোভা বিমানবন্দরে অবতরণের সময় এক অভূতপূর্ব এবং অনন্য দৃশ্যের অবতারণা হয়। পৃথিবীর ইতিহাসে এ দৃশ্য এক বিরল ঘটনা। বঙ্গবন্ধুকে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ কতখানি শ্রদ্ধা করতেন তার প্রমাণ মস্কো বিমানবন্দরে সােভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী এবং প্রেসিডেন্ট উভয়ে বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানাতে উপস্থিত ছিলেন যা তারা ইতঃপূর্বে কখনাে করেননি। বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিদলের নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান এবং সােভিয়েত প্রধানমন্ত্রী অ্যালেক্সি কোসিগিনের মধ্যে দু’দফা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এ ছাড়া বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সােভিয়েতের বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন করেছিলেন। দুই মহান দেশের প্রধানমন্ত্রীদ্বয়ের বাংলাদেশ-সােভিয়েত যুক্ত ঘােষণায় বলা হয়েছিল যে, সােভিয়েত ইউনিয়নে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সফর ফলপ্রসূ হয়েছে। সফরের শেষ দিনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাসখন্দ পরিদর্শনে গেলে সেখানে এক অভূতপূর্ণ দৃশ্যের অবতারণা হয়।। প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসেবে আমার স্মৃতিতে এখনাে সেই দৃশ্য অমলিন হয়ে আছে। রাস্তার দু’ পাশে দাড়ানাে হাজার হাজার ছেলে-বুড়াে, নারী-পুরুষ, তরুণ-তরুণীর উচ্ছাসআনন্দ ভাষায় বর্ণনা করা যাবে না। আকাশ-বাতাস মুখরিত করে তারা স্লোগান দিয়েছিল, ‘বাংলাদেশ’, ‘মুজিবুর রকমান। রুশ ভাষায় রহমানকে ‘রকমান’ বলে উচ্চারণ করা হয় যেমন আরবি ভাষায় পাকিস্তানকে ‘বাকিস্তান’ উচ্চারণ করা হয়। লেনিনগ্রাদ সফরকালে সেখানকার স্মৃতিসৌধগুলাে বঙ্গবন্ধুকে বিমােহিত করে। অপূর্ব এসব দৃশ্য দেখে বঙ্গবন্ধুর মনেও বাংলাদেশে শহীদদের স্মৃতি চিরস্মরণীয় করে রাখার প্রেরণা জোগায়। তার সেই ইচ্ছার প্রতিচ্ছবি বাংলাদেশের জাতীয় স্মৃতিসৌধে প্রতিফলিত হয়েছে।
পৃথিবীর শতাধিক রাষ্ট্রের স্বীকৃতি আদায় স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থবহ পররাষ্ট্রনীতির কারণে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি লাভে বাংলাদেশকে তেমন বেগ পেতে হয়নি। তবে দুর্ভাগ্যজনক যে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নৃশংসভাবে নিহত হবার আগে চীন ও সৌদি আরব বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার আগে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক কোনাে সম্পর্ক স্থাপন করেনি এ দুটি দেশ। স্বীকৃতি আদায়ের কূটনীতি-পর্বকে দুটো পর্যায়ে বিভক্ত করা যেতে পারে। এর একটি মুক্তিযুদ্ধকালের এবং অপরটি মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালের। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানী মুজিবনগরে অবস্থিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের জোর প্রচেষ্টা। সত্ত্বেও শুধু ভুটান ও ভারত ছাড়া অন্য কোনাে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি আদায় করা সম্ভব হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ৬ ডিসেম্বর এবং ১৭ ডিসেম্বর (১৯৭১) ঐ দুটি দেশের স্বীকৃতি পাওয়া গিয়েছিল। বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১ সালের ২৪ এপ্রিল বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতির জন্য ভারত সরকারকে অনুরােধ জানিয়েছিল। ভারত ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের বিষয়ে তাদের সিদ্ধান্তের কথা জানায় এবং ভুটান ১৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। যেকোনাে স্বাধীন, সার্বভৌম দেশের মূল শক্তি অর্জিত হয় বিশ্বের অন্যান্য দেশের স্বীকৃতিতে। স্বীকৃতি লাভের অর্থ হচ্ছে, পৃথিবীর বুকে সংশ্লিষ্ট দেশের জনগণের স্বাধীন সত্তা ও অস্তিত্বের বিষয় সমতার ভিত্তিতে মান্য করা। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারের পররাষ্ট্রনীতির বড় সাফল্য হচ্ছে, অতি দ্রুততম সময়ের মধ্যে শতাধিক দেশের স্বীকৃতি আদায়ে সক্ষম হওয়া। পাকিস্তানে আটক সামরিক-বেসামরিক মানুষজনকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা, জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ, কমনওয়েলথভুক্ত দেশ হওয়ার সম্মান অর্জন, আন্তর্জাতিক কয়েকটি সংস্থার সদস্যপদ লাভ ইত্যাদিও বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রনীতির সাফল্য। স্বাধীন জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতির সাথে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলাের সঙ্গেও বিশেষ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল বাংলাদেশ সরকারের। সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহের সঙ্গে সম্পর্ক মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে সমর্থন দেওয়ায় সােভিয়েত ইউনিয়ন অথবা অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশ থেকে ঋণ ও সাহায্য নেওয়ার চেষ্টা বাংলাদেশ সরকার করেছিল। কিন্তু বাংলাদেশের প্রয়ােজন সন্তোষজনকভাবে মেটানাের মতাে সম্পদ সেসব দেশে তখন ছিল না। তবু, বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে যখন সােভিয়েত ইউনিয়ন সফরে গিয়েছিলেন তখন তিনি বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে সম্ভাব্য সাহায্যপ্রাপ্তির একটি তালিকা সঙ্গে নিয়েছিলেন। এই তালিকায় যুদ্ধাহত মুক্তিযােদ্ধাদের চিকিৎসা, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপন, ঔষধ ইত্যাদি ছিল। কিন্তু এই সফরের সময় বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে বার্ষিক ৪৩৫ মিলিয়ন ডলারের বাণিজ্যচুক্তি হয়েছিল। সরকারি খাতের কিছু প্রকল্পে আর্থিক সাহায্য মস্কো থেকে পাওয়া গিয়েছিল । পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ সাহায্যপ্রাপ্তি এই কূটনৈতিক সফরের সময় নিশ্চিত হয় এবং ১২ মিলিয়ন ডলারের একটি বাণিজ্যচুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়েছিল।
সােভিয়েত ইউনিয়ন ছাড়াও পূর্ব জার্মানি, হাঙ্গেরি ইত্যাদি সমাজতান্ত্রিক দেশগুলােতে বাংলাদেশ সরকার আহত মুক্তিযােদ্ধাদের চিকিৎসা, প্রশিক্ষণ, শিক্ষার জন্য প্রেরণের ব্যবস্থা করেছিল । বাংলাদেশে ১৯৭৩ সালে খাদ্য সঙ্কটের সময় সােভিয়েত নিজের জন্য অন্য দেশ থেকে সংগৃহীত খাদ্যসামগ্রীর ২০০,০০০ টন বাংলাদেশে প্রেরণ করেছিল। উল্লেখ্য, ১৯৭২ সালের শেষের দিকে বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশন সােভিয়েত ইউনিয়ন থেকে সংগ্রহের জন্য সাহায্যসামগ্রীর একটি তালিকা করেছিল। এ তালিকা অনুযায়ী কিছু সাহায্যসামগ্রী সংগ্রহের চেষ্টা অব্যাহত থাকাকালে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলাের কাছ থেকে বাংলাদেশ সরকার পরিকল্পনা কমিশন প্রণীত তালিকায় উল্লিখিত সাহায্যসামগ্রীর উল্লেখযােগ্য দ্রব্য লাভ করেছিল। মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশ সরকার সেসব দেশের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের কারণে এটা সম্ভব হয়েছিল। সমাজতান্ত্রিক সােভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক সাহায্যসহযােগিতা প্রদানের সামর্থ্য তেমন জোরদার না হলেও তারা অন্যভাবে বাংলাদেশ সরকারকে রাষ্ট্রীয় ও নৈতিক সহায়তা দিয়েছিল। রাষ্ট্রের সামরিক ব্যবস্থাকে কিছুটা বলীয়ান করতে মস্কো ১৯৭৩ সালের জুন মাসে ১০টি মিগ-২১ জঙ্গি বিমান বাংলাদেশকে সরবরাহ করে। সােভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশকে কয়েকটি পরিবহন বিমান ও হেলিকপ্টারও দেয় । সমাজতান্ত্রিক দেশগুলাে থেকে বাংলাদেশের প্রয়ােজনমতাে সাহায্য-সহযােগিতা লাভ সুবিধাজনক হবে না মনে করেই বাংলাদেশ সরকার অন্যভাবে ঋণ বা সাহায্য পাওয়ার পথ খুঁজতে থাকে। এমন পরিস্থিতিতে সরকার তার পররাষ্ট্রনীতিতে ভারসাম্য রক্ষায় তৎপর হয়। মুক্তিযুদ্ধকালে ক্ষতিগ্রস্ত চালনা ও চট্টগ্রাম বন্দরকে মাইনমুক্ত করার প্রস্তাব সােভিয়েত ইউনিয়নই দেয়। কিন্তু সরকার শুধুমাত্র চট্টগ্রাম বন্দরকে মাইনমুক্ত করার দায়িত্ব সােভিয়েত নৌবাহিনীকে দেয় এবং চালনা বন্দরের দায়িত্ব জাতিসংঘকে প্রদান করে। বাংলাদেশের জলসীমায় সােভিয়েত নৌবাহিনীর উপস্থিতির কারণে সম্ভাব্য বিশ্ব-প্রতিক্রিয়া এড়াতে বাংলাদেশ সরকার এমন পদক্ষেপ গ্রহণ করে। বাংলাদেশ সরকার চীনের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন এবং স্বীকৃতিলাভের আশা করলেও বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় তা হয়নি। তবে স্বাধীনতার পর সরকার পরিস্থিতি এমনভাবে এগিয়ে নিয়ে যায় যে, তাতে মনে হচ্ছিল চীনের স্বীকৃতি ছিল শুধু সময়ের ব্যাপার। কিছু ঘটনা থেকে বাংলাদেশ সরকারের বিশ্বাস জন্মেছিল যে, বাংলাদেশের প্রতি চীনের দৃষ্টিভঙ্গি নমনীয় হয়েছে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ১৯৭৪ সালের জুন মাসে বাংলাদেশের সদস্যপদ অনুমােদিত হলে চীন কোনাে বিরােধিতা না করে শুধু ভােট দানে বিরত ছিল। এ ছাড়া একই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে চীনা রেড ক্রসের একটি দল শুভেচ্ছা সফরে বাংলাদেশে এসে বন্যার্তদের জন্য এক মিলিয়ন ডলার সাহায্য দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার আগে ১৯৭৫ সালের মে মাসে চীন-বাংলাদেশ বাণিজ্যচুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল। চীনের সঙ্গে এই সমঝােতা বাংলাদেশ সরকারের সফল পররাষ্ট্রনীতির একটি উল্লেখযােগ্য দৃষ্টান্ত।
বহির্বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন
স্বাধীনতালাডের এক-দেড় বছর সময়ে ১৯৭৩ সালেই বাংলাদেশ সরকার অনুধাবন করতে সমর্থ হয় যে, সমাজতান্ত্রিক দেশগুলাে থেকে আশানুরূপ সাহায্য-সহযােগিতা পাওয়া সম্ভব নয়। সকলের সাথে বন্ধুত্ব কারাে সাথে শত্রুতা নয় বঙ্গবন্ধু ঘােষিত পররাষ্ট্র নীতির আলােকে বাংলাদেশ সরকার প্রথম থেকেই জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ইউরােপীয় দেশগুলাে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে প্রয়াসী হয়। উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে, মুক্তিযুদ্ধকালে বাঙালি জাতির প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের মনােভাব ইতিবাচক ছিল না, তবে সে দেশের জনগণের মধ্যে অসংখ্য মানবদরদি ব্যক্তি বাংলাদেশের জনগণের দুঃখদুর্দশার সময় পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। এতে যে আবহ মার্কিন সরকারকে আচ্ছন্ন করে তাতে তারা স্বাধীনতার পরপরই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দিলেও বাংলাদেশে ত্রাণসামগ্রীসহ অন্যান্য মানবিক সাহায্য-সহযােগিতা নিয়ে এগিয়ে এসেছিল। তবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ১৯৭৪ সালের বন্যা ও দুর্ভিক্ষকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ঝুঁকে না পড়ার কোন বিকল্প ছিল না। আদর্শিক সমালােচনা সত্ত্বেও মার্কিন সাহায্য পাওয়ার সুযােগ বাংলাদেশ গ্রহণ করে। এর আগে দুর্ভিক্ষের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্য মঞ্জুর করা খাদ্য সামগ্রীর জাহাজ যা মাঝপথে ছিল তা বাতিল করে । দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতার কারণে মার্কিন সাহায্য গ্রহণের জন্য বাংলাদেশ সরকার পররাষ্ট্র নীতিতে এই পরিবর্তন আনে। বাংলাদেশের জন্য জাপান সাহায্য-সহযােগিতাকারী দেশ হিসেবে খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালের অক্টোবর মাসে জাপান সফর করেছিলেন। বাংলাদেশের যমুনা সেতু প্রকল্পে আর্থিক সাহায্যের বিষয়ে প্রাথমিক আলােচনা এই সফরের সময়ই হয়েছিল। পররাষ্ট্রনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ চিন্তাভাবনা এবং তদনুযায়ী দেশের উন্নয়নপ্রক্রিয়াকে অব্যাহত রাখার স্বার্থে যেসব পদক্ষেপ বাংলাদেশ সরকার গ্রহণ করেছিল তাতে স্বাধীনতা-উত্তরকালে প্রারম্ভিক লগ্নেই পশ্চিম জার্মানি, ফ্রান্স, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক তহবিল বাংলাদেশকে সাহায্য দিতে শুরু করেছিল। জুলিও কুরি শাস্তি পদক প্রদান বিশ্বশান্তি ও জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের অগ্রদূত বঙ্গবন্ধুকে বিশ্বশান্তি পরিষদের জুলিও কুরি শান্তি পদক প্রদান এক বিরল ঘটনা। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে উপমহাদেশে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের ভেতর সম্পর্ক স্থাপন ও শান্তির সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়। বাংলাদেশভারত শান্তি, মৈত্রী ও সহযােগিতা চুক্তি (১৯৭১), ভারত-সােভিয়েত ও সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার মৈত্রী সম্পর্ক (১৯৭২) এবং বাংলাদেশের সঙ্গে সােভিয়েত ও সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার মৈত্রী সম্পর্ক উপমহাদেশের উত্তেজনা প্রশমন ও শান্তি স্থাপনের ভিত্তি হয় ।
বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক জোট নিরপেক্ষ নীতি অনুসরণ এবং শান্তি ও ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান গ্রহণের ফলে বাংলাদেশ বিশ্বসভায় মর্যাদা লাভ করে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭২ সালের অক্টোবর মাসে চিলির রাজধানী সান্তিয়াগােতে বিশ্ব পরিষদের প্রেসিডেনসিয়াল কমিটির সভায় বাঙালি জাতির মুক্তি আন্দোলন এবং বিশ্বশান্তির সপক্ষে বঙ্গবন্ধুর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ জুলিও কুরি শান্তি পদক প্রদানের প্রস্তাব উপস্থাপিত হয় এবং পৃথিবীর ১৪০টি দেশের শান্তি পরিষদের প্রতিনিধির উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুকে জুলিও করি শান্তি পদক প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। । ওই সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৩ সালের মে মাসে বিশ্ব শান্তি পরিষদ ঢাকায় দু’দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন ২৩ মে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের উত্তর প্লাজায় উন্মুক্ত চত্বরে সুসজ্জিত প্যান্ডেলে আন্তর্জাতিক কূটনীতিকদের বিশাল সমাবেশে বিশ্ব শান্তি পরিষদের তৎকালীন মহাসচিব রমেশ চন্দ বঙ্গবন্ধুকে জুলিও কুরি শান্তি পদক পরিয়ে দিয়ে বলেন, শেখ মুজিব শুধু বঙ্গবন্ধু নন, আজ থেকে তিনি বিশ্ববন্ধুও বটে।’ বঙ্গবন্ধুও শান্তির সৈনিকদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে বলেছিলেন : “লাখাে শহীদের রক্তে সিক্ত স্বাধীন বাংলার পবিত্র মাটিতে প্রথম এশীয় শান্তি সম্মেলনে যােগদানের জন্য আগত শান্তির সেনানীদের জানাই স্বাগতম। উপনিবেশবাদী শাসন আর শশাষণের নগ্নহামলাকে প্রতিরােধ করে ত্রিশ লক্ষ শহীদের প্রাণের বিনিময়ে আমরা ছিনিয়ে এনেছি আমাদের জাতীয় স্বাধীনতা, তাই বাংলাদেশের মানুষের কাছে। শান্তি আর স্বাধীনতা একাকার হয়ে মিশে গেছে। আমরা মর্মে মর্মে অনুধাবন করি বিশ্বশান্তি তথা আঞ্চলিক শান্তিও অপরিহার্যতা। এই পটভূমিতে আপনারা-বিশ্বশান্তি আন্দোলনের সহকর্মী প্রতিনিধিরা আমাকে ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদকে ভূষিত করেছেন। এই সম্মান কোনাে ব্যক্তিবিশেষের জন্য নয়। এ সম্মান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মদানকারী শহীদদের, স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর সেনানীদের, ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদক সমগ্র বাঙালি জাতির। এটা আমার দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের। বাংলাদেশের চরম দুঃসময়ে বিশ্বশান্তি পরিষদ যেমন আমাদের সাথে একাত্মতা ঘােষণা করেছিলেন, এদেশের মানুষও ঠিক একইভাবে বিশ্বশান্তি আন্দোলনে সহমর্মিতা জানিয়ে এসেছেন। আমি নিজে ১৯৫২ সালে পিকিং-এ অনুষ্ঠিত প্রথম এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলীয় শান্তি সম্মেলনের একজন প্রতিনিধি ছিলাম। বিশ্বশান্তি পরিষদের ১৯৫৬ সালের স্টকহােম সম্মেলনেও আমি যােগ দিয়েছিলাম। একই সাথে এটাও আমি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে চাই, বিশ্বশান্তি আমার জীবনদর্শনের মূলনীতি। নিপীড়িত, নির্যাতিত, শােষিত, শান্তি ও স্বাধীনতাকামী সংগ্রামী মানুষ, যে কোন স্থানেই হােক না কেন, তাঁদের সাথে আমি রয়েছি। আমরা চাই বিশ্বের সর্বত্র শান্তি বজায় থাকুক, তাকে সুসংহত করা হােক। বৃহৎ শক্তিবর্গ, বিশেষভাবে আগ্রাসী নীতির অনুসারী কতিপয় মহাশক্তির অস্ত্রসজ্জা তথা অস্ত্র প্রতিযােগিতার ফলে আজ এক সঙ্কটজনক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। আমরা
চাই, অস্ত্র প্রতিযােগিতায় ব্যয়িত অর্থ দুনিয়ার দুঃখী মানুষের কল্যাণের জন্য নিয়ােগ করা হােক। তাহলে পৃথিবী থেকে দারিদ্র্যের অভিশাপ মুছে ফেলার কাজ অনেক সহজসাধ্য হবে। আমরা সর্বপ্রকার অস্ত্র প্রতিযােগিতার পরিবর্তে দুনিয়ার সকল শশাষিত ও নিপীড়িত। মানুষের কল্যাণে বিশ্ববাসী বলেই বিশ্বের সব দেশ ও জাতির বন্ধুত্ব কামনা করি। সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারাে প্রতি বিদ্বেষ নয়, শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থানের এই নীতিতে আমরা আস্থাশীল। তাই সামরিক জোটগুলাের বাইরে থেকে সক্রিয় নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি আমরা অনুসরণ করে চলেছি। শুধু সরকারের নীতিই নয়, আন্তর্জাতিক শান্তি ও সংহতি সুদৃঢ় করা আমাদেও সংবিধানের অন্যতম অনুশাসন। আপনারা নিশ্চয়ই অবগত আছেন যে, আমাদের সংবিধান জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা এই চারটি স্তম্ভের উপরই রচিত। এই আদর্শের ভিত্তিতেই আমরা একটি শােষণমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করতে চাই। আমাদের মুক্তিসংগ্রামের আলােকেই জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের মূল্য আমরা অনুধাবন করেছি। আমরা জানি, মুক্তিকামী মানুষের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রাম অস্ত্রের জোরে স্তব্ধ করা যায় না। সেজন্য ভিয়েতনাম, কম্বােডিয়া, লাওস, এ্যাঙ্গোলা, মােজাম্বিক, গিনিবিসাউসহ দুনিয়ার সকল উপনিবেশ-বিরােধী সংগ্রামের প্রতি আমরা জানিয়েছি অকুণ্ঠ সমর্থন। আমরা ক্ষোভ প্রকাশ করি অন্যায়ভাবে আরব এলাকা ইসরাইল। কর্তৃক জোরপূর্বক দখলে রাখার বিরুদ্ধে। আমরা দ্বিধাহীন চিত্তে নিন্দা করি দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বিশ্বের সকল স্থানের বর্ণভেদবাদী নীতির। আমরা সমর্থন জানাই, বিশ্বশান্তি, নিরস্ত্রীকরণ ও মানব কল্যাণের যে কোন মহৎ প্রচেষ্টাকে। বিশ্বশান্তি ও মানবকল্যাণ আমাদের অন্যতম মূলনীতি হওয়ার জন্যই শুরু থেকে আমরা এই উপমহাদেশের স্থায়ী শান্তির জন্য চেষ্টা করে আসছি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, পাকিস্তানের বৈরী মনােভাবের দরুন আমাদের প্রচেষ্টা ফলবতী হয়নি। পাকিস্তান বার বার উপমহাদেশের নতুন বাস্তবতাকে মেনে নিতে অস্বীকার করে এসেছে। স্থায়ী শান্তি ও মানব কল্যাণে আমাদের উদ্যোগের সর্বশেষ প্রমাণ ১৭ই এপ্রিলে ভারতবাংলাদেশ যুক্ত ঘােষণা। এই ঘােষণায় স্থায়ী প্রতিষ্ঠার সূত্র খুঁজে বের করার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে মানবিক সমস্যা সমাধানের জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে। এই প্রস্তাবে অনুকূল সাড়া দেওয়ার পরিবর্তে পাকিস্তান প্রতিহিংসামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে বেআইনীভাবে আটক নিরাপরাধ বাঙালিদের বন্দীনিবাসে অবরুদ্ধ করে রেখেছে। এইভাবে পাকিস্তানের একগুঁয়ে নীতি উপমহাদেশে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। শুধু তাই নয়, কেউ কেউ আবার নতুন করে পাকিস্তানকে সজ্জিত করে চলেছেন নতুন নতুন সমরাস্ত্রে । নিঃসন্দেহে এটা স্থায়ী শান্তির যে কোন শুভ উদ্যোগের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করতে পারে। আমি এর প্রতি বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। জয় বাংলা। জয় বিশ্বশাস্তি। এশীয় শান্তি সম্মেলনের পক্ষ থেকে প্রচারিত পুস্তিকা, ৯ই জ্যৈষ্ঠ, ১৩৮০, ঢাকা।
জনশ্রুতি আছে, আলজিয়ার্স সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুকে ফিদেল ক্যাস্ট্রো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। সি.আই.এ.-র তৎপরতা সম্বন্ধে উল্লেখ করে সাবধান থাকতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। (ড, ওয়াজেদ মিয়া, বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ, ইউপিএল, ঢাকা, ১৯৯৭)। জাতিসংঘে বাংলা ভাষায় পররাষ্ট্রনীতির রূপরেখা জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভের পর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির রূপরেখা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ অধিবেশনে ১৯৭৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধুই তুলে ধরেছিলেন। ঐতিহাসিক ওই মুহূর্তে জাতিসংঘে প্রথম বাংলায় ভাষণ দিয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (পরিশিষ্ট ৫৬ দ্রষ্টব্য)। পররাষ্ট্রনীতির রূপরেখা তার ওই ভাষণে প্রতিফলিত হয়। তার ভাষণের অংশবিশেষ ছিল নিম্নরূপ : আজ এই মহামহিমান্বিত সমাবেশে দাঁড়াইয়া আপনাদের সাথে আমি এই জন্য পরিপূর্ণ সন্তুষ্টির ভাগীদার যে, বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি মানুষ আজ এই পরিষদের প্রতিনিধিত্ব করিতেছেন। আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে পূর্ণতা চিহ্নিত করিয়া বাঙালি জাতির জন্য ইহা একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। স্বাধীনভাবে বাঁচার অধিকার অর্জনের জন্য এবং একটি স্বাধীন দেশে মুক্ত নাগরিকের মর্যাদা নিয়ে বাঁচার জন্য বাঙালি জনগণ শতাব্দীর পর শতাব্দী ব্যাপী সংগ্রাম করিয়াছেন, তাঁহারা বিশ্বের সকল জাতির সাথে শান্তি ও সৌহার্দ্য নিয়া বাস করিবার জন্য আকাক্ষিত ছিলেন। যে মহান আদর্শ জাতিসংঘ সনদে রক্ষিত আছে, আমাদের লক্ষ লক্ষ মানুষ সেই আদর্শের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করিয়াছেন। …ইহা বিশেষ আনন্দের ব্যাপার যে, স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন সক্রিয় যােদ্ধা সভাপতি থাকাকালেই বাংলাদেশকে এই পরিষদের অন্তর্ভুক্ত করিয়া নেওয়া হইয়াছে। জনাব সভাপতি, গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ দেশগুলির শীর্ষ সম্মেলনের সাফল্য ব্যাপারে। আপনার মূল্যবান অবদানের কথা আমি স্মরণ করিতেছি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংহতকরণ, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠন ও ভয়াবহ চ্যালেঞ্জ মােকাবিলায় বাংলাদেশকে যাহারা মূল্যবান সাহায্য দিতেছেন, তাদেরকেও আমরা। ধন্যবাদ জানাই। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম হইতেছে সার্বিক অর্থে শান্তি এবং ন্যায়ের সংগ্রাম । …জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার পর ২৫ বৎসরের অভিজ্ঞতা হইতে দেখা যায় যে, এই সব নীতিমালার বাস্তবায়নে অব্যাহতভাবে কি তীব্র সংগ্রাম চালাইয়া যাইতে হইয়াছে। এশিয়া, আফ্রিকা এবং ল্যাটিন আমেরিকার লক্ষ লক্ষ বীরযােদ্ধার চরম আত্মদানের মাধ্যমে শুধুমাত্র জাতিসংঘ সনদ স্বীকৃত আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার পুনরুদ্ধার সম্ভব। আগ্রাসনের মাধ্যমে বেআইনিভাবে ভূখণ্ড দখল, জনগণের অধিকার হরণের জন্য সেনাবাহিনী ব্যবহার এবং জাতিগত বৈষম্য ও বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম এখনাে অব্যাহত রহিয়াছে। আলজিরিয়া, ভিয়েতনাম, বাংলাদেশ এবং গিনিবিসাউ সংগ্রামে বিরাট বিজয় অর্জন করিয়াছে।
চূড়ান্ত বিজয়ে ইতিহাস ও জনগণ ন্যায়ের পক্ষেই যায়, এই সব বিজয় এই কথাই প্রমাণ করিয়াছে। কিন্তু বিশ্বের বহু অংশে এখনাে অবিচার ও নিপীড়ন চলিতেছে। অবৈধ দখলকৃত ভূখণ্ড পুরাপুরি মুক্ত করার জন্য আমাদের আরব ভাইদের সগ্রাম অব্যাহত রহিয়াছে এবং প্যালেস্টাইনী জনগণের বৈধ জাতীয় অধিকার এখনাে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয় নাই। …জিম্বাবুয়ের (দক্ষিণ রােডেশিয়া) এবং নামিবিয়ার জনগণ জাতীয় মুক্তি ও স্বাধীনতার জন্য দৃঢ়তার সাথে লড়াই করিয়া যাইতেছে। বর্ণবৈষম্যবাদ, যাহাকে মানবতার বিরােধী বলিয়া বার বার আখ্যায়িত করা হইয়াছে, তাহা এখনাে আমাদের বিবেককে দংশন করা অব্যাহত রাখিয়াছে। অতীতের অন্যায় অবিচারের অবসান ঘটাইয়া একটি ন্যায়সঙ্গত আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়িয়া তুলিয়া জরুরিভাবে মােকাবিলা করিতে হইবে।…বর্তমানে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বাংলাদেশকে মারাত্মকভাবে আঘাত হানিয়াছে। যুদ্ধের ধ্বংসলীলার উপর সৃষ্ট বাংলাদেশ পর পর কতিপয় প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হইয়াছে। সর্বশেষে যে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হইয়াছি তাহা হইতেছে, এই বৎসরের নজিরবিহীন বন্যা।
এই পরিস্থিতি মােকাবিলায় বাংলাদেশকে সাহায্য করার ব্যাপারে সক্রিয় উৎসাহ প্রদর্শন করায় আমরা জাতিসংঘ, তার বিভিন্ন সংস্থা ও মহাসচিবের কাছে কৃতজ্ঞ ।… প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এই ভাষণের মধ্যে তৃতীয় বিশ্বের চিত্র তুলে ধরেন। জাতিসংঘের সদস্যদেশগুলাের প্রতিনিধিবৃন্দকে পৃথিবীর দরিদ্র জনগণের দুঃখদুর্দশার কথা জানিয়ে তা মােকাবিলার জন্য পৃথিবীর জাতিসমূহকে ঐক্যবদ্ধভাবে কার্যক্রম গ্রহণের অনুরােধ করেছিল বাংলাদেশ সরকার। আন্তর্জাতিক দায়িত্বের কথা সকলকে স্মরণ করতে আহ্বান জানিয়ে বঙ্গবন্ধু স্বীকৃত অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক সুবিধা ভােগের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করার কথা উল্লেখ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘে প্রদত্ত ভাষণে বলেছিলেন, “বাংলাদেশ প্রথম হইতেই শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান ও সকলের প্রতি বন্ধুত্ব—এই নীতিমালার উপর ভিত্তি করিয়া জোট নিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ করিয়াছে। …আমরা দক্ষিণপূর্ব এশিয়াকে শান্তি, স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতার এলাকারূপে ঘােষণার অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছি।…” জাতিসংঘ অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বান ইতিবাচক ফল বয়ে এনেছিল। আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট বুমেদিন এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী বুতেফ্লিকা বাংলাদেশের সাহায্যে এগিয়ে আসতে জোট নিরপেক্ষ দেশগুলাের প্রতি আহ্বান জানান । মিত্রদেশ এবং বিশ্বের মানবিক সংস্থাসমূহ এ ব্যাপারে ইতিবাচক সাড়া দেয় । স্বাধীনতালাভের পর ১৯৭৪ সালের ১৮-২০ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সম্মেলনে দলের সাধারণ সম্পাদকের প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে বিশদ উল্লেখ করা হয়েছিল। প্রতিবেদনের অংশবিশেষ নিচে উদ্ধৃত হলাে :
“…আমাদের মুক্তিসংগ্রাম চলাকালে মহান ভারতবর্ষ ও সােভিয়েত ইউনিয়নসহ বন্ধুরাষ্ট্রসমূহ আমাদের কোটি কোটি মুক্তিকামী সংগ্রামী জনতার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। তারা শুধু মৌখিক সমর্থন দিয়েই বিরত থাকেননি তারা অর্থনৈতিক এবং উপকরণগত সাহায্য দিয়ে আমাদের নবলব্ধ স্বাধীন জাতিকে বিশ্ব মানবগােষ্ঠীতে প্রতিষ্ঠিত করার ক্রমাগত চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। এ সকল বন্ধু রাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশ সরকারের সমন্বয় সাধন করে আমরা প্রতিনিয়ত দলীয় ভিত্তিতে ভাবের আদান-প্রদানের মধ্য দিয়ে সম্পর্ক মজবুত ও দৃঢ় করার প্রচেষ্টা চালিয়েছি। আজ এই কাউন্সিল সভায়ও মহান ভারতবর্ষ, সােভিয়েত ইউনিয়নসহ পৃথিবীর সমস্ত বন্ধুরাষ্ট্রের আন্তরিক সাহায্য কৃতজ্ঞতাভরে স্মরণ করি। আমাদের সেই বন্ধুরাষ্ট্রসমূহকে যারা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তাদের অকৃত্রিম সাহায্য ও সহানুভূতি দিয়ে পৃথিবীর বর্বরতম পশুশক্তির নিষ্ঠুরতম আঘাত প্রতিহত করে এবং সেই পশুশক্তিকে পরাস্ত করে আমাদের কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেছে। স্মরণ করি মিত্রবাহিনীর সেই সকল ভাইকে যারা এ দেশের স্বাধীনতার জন্য মুক্তিবাহিনীর ভাইদের সাথে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছেন।… ১৯৭২ সালের এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহে দায়িত্ব গ্রহণের পর হতে ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ দিন পর্যন্ত মােট ১৩টি বিদেশি প্রতিনিধি দলকে আমরা দলীয় অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করেছি এবং দলের পক্ষ থেকে দশটি প্রতিনিধিদল বিদেশে প্রেরণ করেছি। এছাড়া বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত এবং কূটনীতিবিদরা আমাদের দলীয় কার্যালয়ে একাধিকবার বৈঠকে মিলিত হয়ে পরস্পর স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলাপ-আলােচনা ও মত বিনিময় করেছেন। দায়িত্ব গ্রহণের মাত্র কিছুদিন পর ৫ মে, ১৯৭২ সালে তিন সদস্যবিশিষ্ট ভারতীয় রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের একটি প্রতিনিধিদলকে আমরা অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করি । এ দলের সদস্য ছিলেন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ড. শঙ্কর দয়াল শর্মা ও শ্রী চন্দ্রজিৎ যাদব এবং পশ্চিম বাংলা কংগ্রেস কমিটির সভাপতি জনাব আবদুস সাত্তার । ঐ মাসের ১৯ তারিখে আসেন বিপ্লবী শ্রী সুরেন্দ্র মােহন ঘােষ। ২২ ডিসেম্বর, ১৯৭২ তারিখে পরম সম্মানীয় ভারতীয় আইনমন্ত্রী শ্রী এইচ, আর, গােখলে এবং ৭-৯-৭৩ তারিখে আসেন পশ্চিমবঙ্গের বাণিজ্যমন্ত্রী শ্রী তরুণকান্তি ঘােষ । আমরা বন্ধুরাষ্ট্রের প্রত্যেক প্রতিনিধিকে সাদর অভ্যর্থনা জানিয়েছি। বন্ধুরাষ্ট্র সােভিয়েত ইউনিয়ন হতে প্রথম প্রতিনিধি আমাদের কার্যালয়ে আসেন ১-১২৭২ তারিখে লুমুম্বা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেক্টর এবং বাংলাদেশ-সােভিয়েত মৈত্রী সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ভি. স্তানিস।… ১৪-৪-৭৩ তারিখে আমাদের কার্যালয়ে আসেন চেকোশ্লাভ প্রতিনিধিদল । ফেডারেল রিপাবলিক অব জার্মানী হতে আমাদের কার্যালয়ে আসেন জার্মান গণপ্রজাতন্ত্রের বিশিষ্ট পার্লামেন্ট সদস্য মি. কার্ল হফম্যান ও মি, অভিলি ফিটার গত নভেম্বর মাসের ১০ তারিখে। এ ছাড়া আমাদের কার্যকালের শেষ পর্যায়ে একটি বিশেষ প্রতিনিধি দল
আসেন বন্ধুরাষ্ট্র যুগােশ্লাভিয়া হতে সংগঠনের বিশেষ আমন্ত্রণক্রমে। …তাঁদের সাথে বর্তমান অবস্থার আলােকে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সমস্যার বিস্তারিত আলােচনার পর দলের পক্ষ থেকে আমি এবং তাদের দলের নেতা একটি যুক্ত ইস্তেহারে ১৪-২৭৩ তারিখে স্বাক্ষর প্রদান করি ।… ঢাকায় অনুষ্ঠিত এশীয় শান্তি সম্মেলন এবং বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির জাতীয় কংগ্রেস অধিবেশনে যে সকল সমাজতান্ত্রিক দেশের প্রতিনিধিরা যােগদান করেন। তাদের আমরা আমাদের কার্যালয়ে অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করি। এ সমস্ত প্রতিনিধিদলে ছিলেন সােভিয়েত ইউনিয়ন, জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র, হাংগেরী, বুলগেরিয়া, চেকোশ্লাভাকিয়া, যুগােশ্লাভিয়া, নেপাল, দক্ষিণ ভিয়েতনাম, পােল্যান্ড, ভারত প্রভৃতি দেশের রাজনৈতিক এবং যুব সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। অনুরূপভাবে আমরা প্রতিনিধিদল প্রেরণ করেছি সােভিয়েত ইউনিয়ন, ভারতবর্ষ, জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র, বুলগেরিয়া, যুক্তরাজ্য, পশ্চিম জার্মানি প্রভৃতি দেশে। …পূর্ব জার্মান সরকারের আমন্ত্রণক্রমে কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের একটি প্রতিনিধিদল ১৯৭৩ সালের জুলাই মাসে জিডিআর, সােভিয়েত ইউনিয়ন, বুলগেরিয়া এবং যুক্তরাজ্য সফর করেন। উত্তর ভিয়েতনামে সেপ্টেম্বর মাসে এবং অক্টোবর মাসে হাঙ্গেরীতে দুইটি প্রতিনিধিদল প্রেরিত হয়। ১৯৭৩ সালে জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের রাজধানী বার্লিনে অনুষ্ঠিত বিশ্ব যুবসমাবেশে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে প্রতিনিধি দল যােগদান করে ।
বাংলাদেশে অবস্থিত বিভিন্ন কূটনীতিক মিশনের যে সকল প্রতিনিধির সঙ্গে পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে বিভিন্ন সময় আলােচনা হয়েছে তারা হলেন সােভিয়েত ইউনিয়নের পূর্বতন রাষ্ট্রদূত ভ্যালেন্টিন এফ. পােপভ ও রাষ্ট্রদূত সি.এ. আঁন্দ্রে ফোমিন, ভারতীয় হাই কমিশনার সুবিমল দত্ত, জি.ডি.আর-এর রাষ্ট্রদূত লােথার ওয়েনজেল, যুগােশ্লাভিয়ার রাষ্ট্রদূত ড, ডিজেন কসটিক, হাঙ্গেরীর কাউন্সেলর ফ্রিগেস ভাদাস এবং এল, জিকরা, ব্রিটিশ হাইকমিশনার এ.এ. গােল্ডেস, নেপাল হাইকমিশন থেকে ওমেশ পি, অধিকারী, মালয়েশিয়ান হাই কমিশনার আলী বিন আবদুল্লাহ, মিশরীয় রাষ্ট্রদূত এইচ, ই, ওয়াফা হিজাজী, বুলগেরিয়ান রাষ্ট্রদূত নিকোলে বয়েজিভ, ইরাকের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স হাসান আল-আনবারি, যুক্তরাষ্ট্রের ফাস্ট সেক্রেটারি ফ্রাঙ্ক জর্জ উইলসন। এছাড়া দূতাবাসগুলাের ভিন্ন ভিন্ন দায়িত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিরা সকল সময়েই আমাদের সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষা করেছেন।….. বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে শত বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও স্বাধীনতা লাভের মাত্র দু’বছর সময়ের মধ্যে আওয়ামী লীগ ও তার সরকার অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে যেমন সাফল্য অর্জন করেছে, তেমনি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও অসাধারণ কৃতিত্ব অর্জনে সক্ষম হয়েছে। এই কৃতিত্ব ও সাফল্যের মূলে রয়েছে আওয়ামী লীগের জনগণের কাছে প্রদত্ত সকল প্রতিশ্রুতি পালনে বদ্ধ পরিকর হওয়ার নীতি। তাই, বৈদেশিক নীতির প্রশ্নে আমরা।
সব সময়ই সরকারকে প্রয়ােজনীয় উপদেশ, নির্দেশ বা পরামর্শ দিয়েছি। এই উদ্দেশ্যে সাংগঠনিক কমিটিতে ২৯-৭-৭২ তারিখের সভায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ভিত্তিতে আলাপ-আলােচনার মাধ্যমে এবং সার্বভৌমত্ব ও সমতার ভিত্তিতে বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের সাথে সদ্ভাব বৃদ্ধির চেষ্টাতেও আমরা সরকারকে সব সময়ই পরামর্শ দিয়েছি। দলীয় অনুপ্রেরণা ও উৎসাহে বঙ্গবন্ধুর সরকার এ বিষয়ে সার্থক ভূমিকা পালন করেছে। আওয়ামী লীগ সংগঠনের নির্দেশিত বৈদেশিক নীতি বাস্তবায়নের মাধ্যমে বিদেশে আমাদের বন্ধুত্বের দিগন্ত সম্প্রসারিত হয়েছে। …১১৬টি রাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। ফলে, ব্যবসা-বাণিজ্য ও অন্যান্য পারস্পরিক সহযােগিতার ক্ষেত্র প্রসারিত হয়েছে।… অটোয়ায় কমনওয়েলথ সম্মেলন এবং আলজিয়ার্সে জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনের কথা এখানে উল্লেখ করা প্রয়ােজন। বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে এ এক মহাবিজয় এবং পরম গৌরবােজ্জ্বল অধ্যায়।… কমনওয়েলথ সম্মেলন ও আলজিয়ার্সে জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশ সম্মানিত সদস্য হিসেবে যােগদান করতে পারায় প্রকৃতপক্ষে সে বিপুল গৌরবের অধিকারী হয়েছে। আলজিয়ার্সে জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশকে গ্রহণ করে অধিকাংশ আরব ও আফ্রিকান দেশ তার সার্বভৌমত্বের প্রতি স্বীকৃতি ও সম্মান প্রদর্শন করেছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতাে আরব ও আফ্রিকান দেশসমূহের সাথেও বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তােলার জন্য আওয়ামী লীগ নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়েছে। এরই ফলে এবং বঙ্গবন্ধুর অসাধারণ ব্যক্তিত্বে এই ধরনের কঠিন কাজে সাফল্য লাভ সম্ভব হয়েছে। আরব দেশগুলাের মধ্যে মিশর, ইরাক, মরক্কো, তিউনিশিয়া, আলজিরিয়া, কুয়েত দক্ষিণ ইয়েমেন, লেবানন, সিরিয়া, সুদান, জর্দান প্রভৃতি দেশের স্বীকৃতি লাভ বঙ্গবন্ধু এবং তার দল আওয়ামী লীগের বিঘােষিত নীতি ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফল। আমাদের গৃহীত বৈদেশিক নীতি অনুযায়ী বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে সদা সােচ্চার এবং এদের চক্রান্তে নিষ্পেষিত নিরীহ নির্যাতিত মানুষের পাশে থেকে সগ্রাম করে যাওয়ার জন্য দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ ।…
জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে আরব নেতৃবৃন্দের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতির ফলে জাতি যেসব বন্ধুরাষ্ট্রের হৃদয়ে উত্তাপের সন্ধান পেলাে, তা আমাদের জন্য অমূল্য সম্পদ বলে পরিগণিত। এই সম্পদ লাভ শান্তির দূত বিশ্ববরেণ্য নেতা বঙ্গবন্ধুর জন্য সম্ভব হয়েছে।… কমনওয়েলথ সম্মেলনে যােগদান করে বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ প্রজাতন্ত্র বাংলাদেশ যে অপূর্ব ভূমিকা পালন করে তাতে বিশ্ববাসী বিস্মিত ও মুগ্ধ হয়েছে। স্বতঃপ্রণােদিতভাবে বহুদেশ আমাদের প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশের প্রতি সাহায্য ও সহযােগিতা দানের প্রতিশ্রুতিও দেয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুই ছিলেন কমনওয়েলথ সম্মেলনের প্রধান আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব। তাঁর সুচিন্তিত রাজনৈতিক বক্তব্য কমনওয়েলথের গতানুগতিক চরিত্র পরিবর্তন করে বিশ্বের উন্নয়নকামী দেশসমূহের নির্যাতিত মানুষের বিজয় সূচিত করে। বিশ্বের নেতৃবৃন্দ সেদিন বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠনিসৃত বাণী শােনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছিলেন। আওয়ামী লীগের বিঘােষিত বৈদেশিক নীতির ফল হিসেবে বিশ্বের শান্তি ও স্বাধীনতাকামী সকল দেশের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক আরও আন্তরিকতাপূর্ণ হয়ে ওঠে। বিশ্বের সকল নিপীড়িত ও মুক্তি সংগ্রামীদের পাশে বাংলাদেশ যে সব সময়ই থেকেছে তার প্রমাণ দক্ষিণ ভিয়েতনামের অস্থায়ী বিপ্লবী সরকার ও গিনি বিসাউয়ের সরকারের প্রতি বাংলাদেশের স্বীকৃতি প্রদান। বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ছিল বলেই আওয়ামী লীগের সেপ্টেম্বর (১৯৭৩) মাসের ঘােষণাপত্রে বর্ণিত বৈদেশিক নীতির সার্থক রূপায়ণ এত দ্রুত এবং সহজে সম্ভব হয়। এজন্য আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধু ও তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্বের কাছে চির কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তখন বাংলাদেশের অভূতপূর্ব সাফল্য এক শুভ অধ্যায়ের সূচনা করে।
জাতিসংঘে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ এবং ক্ষমতাসীন বাংলাদেশ। আওয়ামী লীগের সম্পাদক দলীয় সম্মেলনে যে প্রতিবেদন পেশ করেছিলেন সেগুলােতে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির রূপরেখা ও অঙ্গীকারই ব্যক্ত হয়েছে। ইসলামি সম্মেলন সংস্থার (OIC) অধিবেশনে যােগদান বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের আগে স্বীকৃতি না দেওয়া দেশগুলাের মধ্যে বড় শক্তি চীন যেমন ছিল তেমনি মুসলিম দেশগুলাের মধ্যে ছিল সৌদি আরব, জর্দান, ইরান ইত্যাদি। মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে কিছু বিষয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল। এজন্য বিশ্ব ব্যাংকসহ মার্কিন সাহায্য গ্রহণ এবং ১৯৭৪ সালে লাহােরে অনুষ্ঠিত ইসলামি সম্মেলন সংস্থার (OIC) শীর্ষ অধিবেশনে। যােগদানের প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদের মতপার্থক্য ঘটে। তবে, সদ্যস্বাধীন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের তীব্র খাদ্য ও অর্থ সঙ্কট মােকাবিলা করে দেশের প্রিয় জনমানুষকে বাঁচানােই ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সামনে এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। মতপার্থক্য থাকলেও বঙ্গবন্ধু মতাদর্শ নির্বিশেষে সব দেশের কাছ থেকেই সাহায্য গ্রহণের প্রত্যাশী ছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে তাজউদ্দীন আহমদ প্রাণাপেক্ষা ভালােবাসতেন। তা ছাড়া, বঙ্গবন্ধুর মতাে মহপ্রাণ ব্যক্তিত্বের সঙ্গে কখনাে কোনাে সাংঘর্ষিক অবস্থান নিতে চাননি। তাজউদ্দীন আহমদ। তাই তিনি নীরবে তৎকালের সরকারের অর্থমন্ত্রীর পদ থেকে সরে গিয়েছিলেন। সাংবাদিকদের প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়েও তাজউদ্দীন আহমদ তাঁর পদত্যাগের বিষয়ে কোনাে মন্তব্য করা থেকে বিরত থেকে বঙ্গবন্ধুকে ব্ৰিত না করার পন্থা অবলম্বন করেছিলেন। অপরপক্ষে লক্ষ করলে দেখা যাবে খন্দকার মােশতাক আহমদ সুযােগ হাতছাড়া করেননি। মুসলিম রাষ্ট্রগুলাের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে অভ্যুদয় হলেও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের অপপ্রচার চলতেই থাকে। মুক্তিযুদ্ধকালেই কিছু মুসলিম দেশের বিরােধিতা ছিল। বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রীয় নীতি সম্পর্কে পাকিস্তান এবং পরাজিত দেশি-বিদেশি শত্রুরা মুসলিম দেশগুলােতে অপপ্রচার চালাতে থাকে। এতে কিছু মুসলিম দেশ এবং তকালীন বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে ভুল বােঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছিল।
তবে বাংলাদেশ সরকারের সফল পররাষ্ট্রনীতির কারণে এ অবস্থার অবসান হয়। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সঙ্কটে অর্থসাহায্য ও মুসলিম দেশগুলাের স্বীকৃতি আদায়ের লক্ষ্যে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে তখনকার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাস্তব পরিস্থিতি অনুযায়ী উদ্যোগী হয়ে কুটনৈতিক তৎপরতা চালননা হয়। বাংলাদেশ পেট্রো-ডলার উৎস। থেকে আর্থিক সহযােগিতা লাভের প্রত্যাশী ছিল। এসব কারণে পররাষ্ট্রনীতিতে ১৯৭৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে পরিবর্তনের সূচনা হতে দেখা যায়। ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসে ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠিত হয় । এই ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা সম্পর্কিত ১৯৭৫ সালের ১৭ সংখ্যক রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছিল। অধ্যাদেশে বলা হয়, “যেহেতু, দেশে মসজিদ ও ইসলামী কেন্দ্র, একাডেমী ও ইনস্টিটিউট স্থাপন, পরিচালনা সহায়তাদান, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান ও সভ্যতার ক্ষেত্রে ইসলামের অবদান সম্পর্কে গবেষণা চালানাে, ইসলামের বিশ্বভ্রাতৃত্ব পরমতসহিষ্ণুতা ও ন্যায়বিচারের মতাে মৌলিক আদর্শাবলী প্রচার, ইসলামের ইতিহাস, দর্শন, আইন, বিজ্ঞান ও বিচারব্যবস্থার উপর গবেষণার প্রসার ঘটানাে এবং ইহার সহিত সম্পর্কিত বিষয়াদির বিধান করিবার জন্য একটি ইসলামিক ফাউন্ডেশন স্থাপন করা প্রয়ােজন ও সমীচীন; সেহেতু এতদ্বারা নিমােক্ত আইন প্রণয়ন করা হইল। ১। সংক্ষিপ্ত শিরােনাম ও প্রবর্তন।
(ক) এই আইন ইসলামিক ফাউন্ডেশন আইন, ১৯৭৫ নামে অভিহিত হইবে।
(খ) এই আইন ২৮ মার্চ, ১৯৭৫ হইতে বলবৎ হইয়াছে বলিয়া গণ্য হইবে । ২। সংজ্ঞা- বিষয় বা প্রসঙ্গের পরিপন্থী কোন কিছু না থাকিলে, এই আইনে
(ক) “বাের্ড” অর্থ ফাউন্ডেশনের বাের্ড অব (গভর্নরস); (খ) “চেয়ারম্যান” অর্থ বাের্ডের চেয়ারম্যান; (খখ) “মহাপরিচালক” অর্থ ধারা ৫ক এর অধীন নিয়ােগপ্রাপ্ত মহাপরিচালক;
(গ) “ফাউন্ডেশন” অর্থ এই আইনের অধীন স্থাপিত ইসলামিক ফাউন্ডেশন; (গ) “গভর্নর” অর্থ বাের্ডের সদস্য; (ঘ) “নির্ধারিত” অর্থ বিধিমালা দ্বারা নির্ধারিত;
(ঙ) “ভাইস চেয়ারম্যান” অর্থ বাের্ডের ভাইস চেয়ারম্যান। ৩। ফাউন্ডেশন স্থাপন :(১) এই আইন বলবৎ হইবার পর যতশীঘ্র সম্ভব সরকার, সরকারি গেজেটে
প্রজ্ঞাপন দ্বারা, এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে ইসলামিক ফাউন্ডেশন নামে একটি ফাউন্ডেশন স্থাপন করিবে।। ফাউন্ডেশন একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা হইবে। ইহার একটি স্থায়ী ধারাবাহিকতা ও একটি সাধারণ সীলমােহর থাকিবে, ইহার স্থাবর ও অস্থাবর উভয় প্রকার সম্পত্তি অর্জন করিবার, অধিকারে রাখিবার ও হস্তান্তর করিবার ক্ষমতা থ কিবে, ইহা উক্ত নামে মামলা করিতে পারিবে এবং ইহার বিরুদ্ধেও মামলা
করা যাইবে। ৪। প্রধান কার্যালয় : (১) ফাউন্ডেশনের প্রধান কার্যালয় ঢাকায় থাকিবে। (২) ফাউন্ডেশন যে সকল স্থান উপযুক্ত মনে করিবে সেই সকল স্থানে প্রয়ােজনীয়।
সংখ্যক শাখা স্থাপন করিতে পারিবে। ১৯৭২ সাল থেকেই বাংলাদেশ সরকার মুসলিম দেশগুলাের স্বীকৃতি লাভের চেষ্টা করছিল। ওই সময় আফ্রো-এশীয় সংহতি সংস্থার (AAPSO) সম্মেলন থেকে বাংলাদেশের প্রতি মুসলিম দেশগুলাের পরিবর্তিত দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়। ওই সম্মেলনে বাংলাদেশে পাকিস্তান সামরিক সরকারের গণহত্যার নিন্দা জানানাে হয়েছিল । ওই অধিবেশনেই আরব রাষ্ট্রসমূহের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন পেয়ে বাংলাদেশ এই সংস্থার সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। জেদ্দায় ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত ইসলামি পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্মেলনে মুজিব-ভুট্টোর মধ্যে এক বৈঠক অনুষ্ঠানের উদ্যোগ নেওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। এই বৈঠকের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে বঙ্গবন্ধু জানতে পেরে তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। উদ্দেশ্য সম্বন্ধে যা জানা যায় তা হলাে, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে আপসের প্রচেষ্টা।
আলজিয়ার্স জোটনিরপেক্ষ শীর্ষ সম্মেলনে ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজেই দেশের নিরাপদ ভাবমূর্তিকে সুউচ্চে তুলে ধরেছিলেন। ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আরবদের অবস্থানকে বাংলাদেশ সরকার সমর্থন করায়
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি আরব বিশ্বকে আশান্বিত করেছিল। ইসলামি সম্মেলন সংস্থার | (OIC) সদস্য পদ লাভ করার মধ্যে বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রনীতি পরিণতপর্যায়ে উন্নীত হয়েছিল। স্বাধীনতা লাভের মাত্র তিন বছরে অর্থাৎ ১৯৭৪ সালের মধ্যে কয়েকটি মুসলিম দেশসহ পৃথিবীর ১১৬টি দেশের স্বীকৃতি পাওয়া বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির গৌরবময় সাফল্য ছিল। লাহােরে অনুষ্ঠিতব্য ইসলামি সম্মেলনে যাওয়ার আগে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু যে শর্ত দেন তা ছিল এক ঐতিহাসিক ঘটনা। তিনি বলেন, পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলে অথবা সম্মেলনের স্থান লাহাের থেকে সরিয়ে কুয়েতে নিলেই কেবল তিনি সম্মেলনে যােগদান করবেন। মুসলিম দেশগুলাের প্রভাবে ১৯৭৪ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে সম্মত হয়। কিন্তু পাকিস্তান ভারতে আটক ১৯৫ জন পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দীর কোনাে বিচার হবে না এমন শর্ত দেয়। এ নিয়ে জোর বিতর্ক শুরু হয়ে যায়। সােমালিয়ার মধ্যস্থতায় বিতর্কের অবসান হলে ২২ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। বঙ্গবন্ধুও বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী। হিসেবে ঘােষণা দেন যে, পাকিস্তানের স্বীকৃতির অর্থ এই নয় যে, যুদ্ধবন্দীদের বিচার না করার শর্ত মেনে নেওয়া হয়েছে। অর্থনৈতিক ভাবনাচিন্তা মাথায় রেখে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ২৩ ফেব্রুয়ারি লাহাের ইসলামি সম্মেলনে গিয়েছিলেন। আরব বিশ্বের দেশগুলাের দৃষ্টি বাংলাদেশের প্রতি ইতিবাচক রূপে আকৃষ্ট করাই ছিল সরকারের লক্ষ্য। এজন্য ১৯৭৩ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় আরবদের প্রতি শুভেচ্ছার নিদর্শন স্বরূপ বাংলাদেশ সরকার একটি মেডিক্যাল টিম পাঠিয়েছিল। প্রায় একই সময়ে যুদ্ধরত মিসরীয় সেনাবাহিনীর জন্য এক লাখ পাউন্ড চা পাঠানাে হয়েছিল। এতে আরব বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আরাে উজ্জ্বল হয়েছিল। এ কথা অবশ্যই মানতে হবে যে, বাংলাদেশের এসব কূটনৈতিক তৎপরতায় দেশের পররাষ্ট্রনীতিতে বাস্তবতারই ছাপ ছিল। সম্পদ সীমাবদ্ধতায় সাহায্য আদায়ের কূটনীতি স্বাধীনতার পরপর রাষ্ট্রীয় কোষাগারে সঞ্চিত অর্থ দিয়ে প্রশাসনিক কর্মকর্তা/কর্মচারীদের বেতন মেটানাে অসম্ভব ছিল । অধিকন্তু দেশের পুনর্গঠন-পুনর্বাসন প্রকল্পের জন্য প্রয়ােজন ছিল প্রভূত পরিমাণ অর্থ। সরকারের একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী এ ক্ষেত্রে চাহিদার পরিমাণ ছিল মাসিক ২,০০,০০০ থেকে ২,৫০,০০০ টন খাদ্য, ১,০০,০০০ টন সিমেন্ট, ৫০,০০০ টন ঢেউ টিন, ৫০,০০০ টন কাঠ। এ ছাড়া ওষুধসহ অন্য প্রয়ােজনীয় সামগ্রী ১,০০,০০০ টন। কিন্তু সম্পদের সীমাবদ্ধতার কারণে বাংলাদেশ সরকারকে বিভিন্ন উৎস। থেকে ঋণ বা সাহায্য সংগ্রহের চেষ্টা চালানাে হয়। পুঁজিবাদী দেশ এবং প্রতিষ্ঠান, ওপেক (OPEC) দেশসমূহ থেকেও ঋণ বা সাহায্য গ্রহণ করতে হয়। এইড ক্লাবের (AID Club-এর) শর্তে কৌশলী হয়ে বাংলাদেশ সরকার ব্যক্তি মালিকানাকে উৎসাহিত করে।। ১৯৭৪-৭৫ উন্নয়ন বাজেটের মােট ৫,৫২০ মিলিয়ন টাকা অর্থ বরাদ্দের মধ্যে ৪,৪২০ মিলিয়ন টাকা ছিল বিদেশি অর্থসাহায্য। এ সময় পুঁজিবাদী দেশের উত্স থেকে সাহায্যের ওপর নির্ভরশীলতার নীতি গ্রহণ করার দরুণ বাস্তবে এ পরিমাণ বেড়ে গিয়েছিল।
আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের সঙ্গে সম্পর্ক বাংলাদেশের মতাে দরিদ্র দেশের পক্ষে জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ এক অভাবনীয় সাফল্য। অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক বিবেচনায় এই সদস্যপদ খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। বাংলাদেশ সরকার ১৯৭২ সালের ৮ আগস্ট জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভের জন্য আবেদন জানিয়েছিল। নিরাপত্তা পরিষদে ১০ আগস্ট আবেদনপত্র সম্বন্ধে বিবেচনার জন্য ওঠে, কিন্তু চীনের ভেটো প্রদানে তা বাতিল হয়েছিল। আবার ১৯৭৪ সালের মে-জুন মাসে আবেদনপত্র পুনর্বিবেচনার জন্য উত্থাপিত হলে ১৭ সেপ্টেম্বর সাধারণ পরিষদে সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে ১৩৬তম সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ জাতিসংঘে যােগদান করতে সমর্থ হয়। এ বিবেচনার সময় চীন ভােট দান থেকে বিরত ছিল, ভেটো প্রয়ােগ করেনি। এ থেকে স্পষ্ট হয় যে, চীন ক্রমেই বাংলাদেশের ন্যায্য অস্তিত্বের প্রতি নমনীয় হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর তখনকার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাস্তবতায় পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে ভারসাম্যমূলক অবস্থান নিয়ে অগ্রসর হয়ে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়। সমাজতন্ত্র-ধনতন্ত্র ঠাণ্ডা যুদ্ধ যুগে আমেরিকা সহ পশ্চিমা দেশগুলাের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন করার বিষয়ে অবস্থান গ্রহণ করা ছিল দেশের অর্থনৈতিক স্বার্থের সাথে সরাসরি সংশ্লিষ্ট । আর তাই যুক্তিসংগত ও অনিবার্য পরিণতি। এই অবস্থান গ্রহণের সময় পশ্চিমা বিশ্বের অভিসন্ধি, দুরভিসন্ধি সতর্কতার সঙ্গে পর্যালােচনা না করে সিদ্ধান্ত নেয়নি বাংলাদেশ। স্বাধীন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি গড়ে তুলতে বঙ্গবন্ধু জাতীয় মূল্যবোধকে সমুন্নত রাখার প্রতি তীক্ষ দৃষ্টি রেখেছিলেন। তিনি জানতেন, “চিরশত্রু” বলে যেমন কিছু নেই, তেমনি “চিরবন্ধু” বলেও কিছু নেই। লক্ষ করলে বােঝা যাবে যে, বঙ্গবন্ধুর সরকার অনুসৃত পররাষ্ট্রনীতিতে তৃতীয় বিশ্বের প্রতি ঝোকের আধিক্য বেশি ছিল। সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশকদের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতির অবস্থান দৃঢ় ছিল। ভারত মহাসাগর শান্তির এলাকাবিষয়ক ইস্যুই এর প্রমাণ। এ কথা মানতেই হবে যে, ১৯৭১ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে তকালীন বাংলাদেশ সরকারের সাফল্য ছিল অতুলনীয়। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর বাংলাদেশকে ওই । ভারসাম্যমূলক অবস্থান থেকে সরিয়ে আনা হয়। দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ সরকার দেশের পররাষ্ট্রনীতিতে বিশ্বশান্তি অর্থনৈতিক মুক্তি, আত্মমর্যাদা ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনের প্রতিফলন ঘটাতে চেয়েছে। সমাজতান্ত্রিক দেশ ছাড়া বহির্বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলাের সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলাের প্রেক্ষাপট দৃশ্যমানভাবে তুলে ধরতে বাংলাদেশ সরকারের তৎকালীন কাণ্ডারি প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৎপর ছিলেন। তিনি এক জনসভায় ১৯৭৪ সালের ৪ মার্চ বলেছিলেন, “এ উপমহাদেশে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও শ্রীলঙ্কা আমরা শান্তিতে বসবাস করতে চাই। আমরা কারাে সঙ্গে কোনাে বিবাদে লিপ্ত হতে চাই না। আমরা আত্মমর্যাদা নিয়ে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে একে অপরের সঙ্গে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে বসবাস করতে চাই। আমাদের ব্যাপারে কেউ হস্তক্ষেপ করুক তা আমরা চাই না, আমরা অপরের ব্যাপারেও হস্তক্ষেপ। করতে চাই না।”
সার্ক নামে দক্ষিণ-এশীয় আঞ্চলিক সংগঠন গড়ে ওঠার পটভূমি বাংলাদেশ সরকারের। তল্কালীন প্রধানমন্ত্রীর ওই বক্তব্যে ফুটে উঠেছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারত বাংলাদেশের। জনগণ এবং সরকারকে যেভাবে সাহায্য সহযােগিতা করেছিল তাতে উভয় দেশের মধ্যে আন্তরিক সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু এই সম্পর্ক বিভিন্ন কারণে শীতল হতেও সময় । লাগেনি। তাই বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশ ভারতে বেশ স্পর্শকাতর ছিল। ভারতের আপত্তি সত্ত্বেও লাহােরে ইসলামি সম্মেলন সংস্থার অধিবেশনে বাংলাদেশের। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যােগদান করে পৃথিবীর সব দেশকে বােঝতে পেরেছিলেন যে, স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাধীন সরকারের তিনি প্রতিনিধি। কারাে তাঁবেদারি। তাঁর সরকারের নীতি নয়। তিনি যে ভারতের অন্ধ ভক্ত ছিলেন তা-ও নয়। এর দৃষ্টান্তস্বরূপ উল্লেখ করা যায় পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে তিনি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সময় ভারতীয় বিমানে ভ্রমণের আমন্ত্রণে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে ব্রিটিশ বিমানে ফেরাই সঙ্গত মনে করেছিলেন। এ ছাড়া, ১৯৭৪ সালে সীমানাসংক্রান্ত চুক্তির সময় বাংলাদেশ সরকার ভারতকে কিছু ভূখণ্ড ছেড়ে দিতে অনুরােধ জানিয়েছিল। চুক্তি স্বাক্ষরের সময় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, “ We must be absolutely sure that there was no prospect of gas or oil in the sectors we had agreed to demarcate i” ফারাক্কাসংক্রান্ত অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তি ১৯৭৫ সালের ১৮ এপ্রিল স্বাক্ষরের সময়ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির বলিষ্ঠ দিক সুস্পষ্ট ছিল। কাজেই বলা যায়, ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে ভারতপ্রীতি কিংবা ভারতবিরােধী কোনাে প্রশ্ন ছিল না। পাকিস্তান বাংলাদেশের দৃষ্টিতে শত্রুপক্ষ হলেও বাংলাদেশ সরকার পাকিস্তানের। সঙ্গে নিজ স্বার্থে সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল। বাংলাদেশ থেকে অবাঙালি ফেরত পাঠানাে, পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙালি প্রত্যাবাসন, সম্পদের হিসাব-নিকাশকরণ ইত্যাদি বিষয়ে বাংলাদেশের স্বার্থ ছিল। বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের এক হিসেব অনুযায়ী পাকিস্তানের। কাছে অর্থমূল্যে বাংলাদেশের পাওনা ছিল ২৫৭ কোটি ৫৭ লাখ টাকা।
————-
৬, দৈনিক বাংলা, ৫ মার্চ ১৯৭৪ ৭, প্রত্যক্ষদর্শী পররাষ্ট্র সচিব ফখরুদ্দীন আহমদের বক্তব্য থেকে ।
—————
সূত্র : বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১-৭৫ এইচ টি ইমাম