You dont have javascript enabled! Please enable it!
বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভা এবং সরকারের কর্মসূচি
প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্ব নদেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণার পরমুহূর্ত থেকেই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ তকালীন ইপিআর-এর ওয়্যারলেসে ডিকোডেড মেসেজে পূর্ববঙ্গের সর্বত্র প্রচারের জন্য বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণার বাণী প্রেরণ করেন। গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়েই স্বাধীনতার ঘােষণা সম্বন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে এবং ৩-সংখ্যক পরিশিষ্ট হিসেবে তা সংযােজিত। এই মেসেজ তৎকালীন পাকিস্তানের সামরিক শাসকসহ পৃথিবীর আরাে কয়েকটি দেশ রেকর্ড করতে সক্ষম হয়েছিল। এসব রাষ্ট্রের মধ্যে ভারতের প্রতিরক্ষা বিভাগ এবং যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ্য। যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধসংক্রান্ত প্রকাশিত তথ্য জনসমক্ষে আসায় বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘােষণার বিষয় বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হিসেবে সংযােজিত হয়েছে। বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয় আন্দোলন-সংগ্রাম ও যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। পাকিস্তানি। চক্রান্তকারী সামরিক শাসকবৃন্দ নিরস্ত্র বাঙালি জাতিকে অতর্কিত রাতের অন্ধকারে ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আক্রমণ করলে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ করে বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত এবং স্বাধীন করে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সুপরিকল্পিত নেতৃত্বে বাঙালি জাতি পাকিস্তানি ঘাতক ও আক্রমণকারীদের বাংলাদেশের মাটি থেকে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিতাড়িত করে। বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি করে মুজিবনগরে যে মন্ত্রিসভা গঠিত হয় তার সাফল্যের ধারাবাহিকতায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের পর ১৯৭৩ সালে সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে পরবর্তী বাংলাদেশ সরকার গঠন করেন। এই সরকার গঠনের আগে বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশে মাত্র এক বছরের কম সময়ে জাতিকে একটি সংবধািন উপহার দেন। সেই সংবিধানের ভিত্তিতে ১৯৭৩ সালে জাতীয় নির্বাচনের পর সরকার গঠিত হয়েছিল। মুজিবনগর সরকার থেকে বঙ্গবন্ধুর সরকার মুজিবনগরে গঠিত প্রথম বাংলাদেশ সরকারকে সীমিত পরিসরে তার সাংগঠনিক কাঠামাে এবং কর্মকাণ্ড চালাতে হলেও দেশের সামগ্রিক প্রশাসন, অর্থনৈতিক কর্মসূচি, বাণিজ্য
 

দফতরসমূহ গড়ে তােলেন। গত ২০০৪ সালে প্রকাশিত আমার রচিত “বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১” নামক গ্রন্থে বাংলাদেশের আন্দোলন-সংগ্রাম, রাজনৈতিক অবস্থা, মুক্তিযুদ্ধ ইত্যাদি সম্পর্কে প্রাসঙ্গিক বহু বিষয় বিধৃত হয়েছে। বর্তমান অধ্যায়ে বঙ্গবন্ধুর আজন্ম লালিত সােনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নে তিনি কীভাবে তাঁর মন্ত্রিসভা গড়ে তােলেন, মন্ত্রিসভায় কোন কোন ব্যক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করেন, কতগুলাে মন্ত্রণালয় সৃষ্টি করেন, সেসব মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব কি ছিল ইত্যাদি সম্পর্কে সংক্ষেপে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।  স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পরদিন মন্ত্রিসভার সঙ্গে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দু’দফা বৈঠক শেষে শাসনতান্ত্রিক-ব্যবস্থা হিসেবে সংসদীয় পদ্ধতির চিন্তাভাবনার আলােকে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, ড. কামাল হােসেন ও ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলামকে নতুন শাসনতান্ত্রিক অধ্যাদেশের খসড়া তৈরি করার দায়িত্ব অর্পণ করেন। তাঁরা স্বাধীনতার সনদে উল্লিখিত রাষ্ট্রপতি সম্পর্কিত অনুচ্ছেদে “The President shall act on the advice of the Prime Minister (প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে রাষ্ট্রপতি কাজ করবেন) বাক্যটি জুড়ে দিয়েছিলেন এবং এরই আলােকে রাষ্ট্রপতির সাময়িক সংবিধান আদেশ১৯৭২” জারি করা হয় ১১ জানুয়ারি। এই আদেশে রাষ্ট্রপতি পরিবর্তন, মন্ত্রিসভা নিয়ােগ, শপথ গ্রহণ, হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।

মওদুদ আহমদ বিরচিত “শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনকাল” নামক গ্রন্থের সংশ্লিষ্ট অংশেও এসব বিষয় উল্লেখ রয়েছে। রাষ্ট্রপ্রতির সাময়িক সংবিধান আদেশ-১৯৭২ জারির পর বঙ্গবন্ধু তাঁর ১১ সদস্যবিশিষ্ট নতুন মন্ত্রিসভা গঠন এবং তাঁদের শপথ গ্রহণ করান। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের তৎকালীন সচিব হিসেবে আমার সব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করার সৌভাগ্য হয়।। মন্ত্রিসভার পরিমিত সদস্য সংখ্যা একটানা নয় মাস মুক্তিযুদ্ধ (১৯৭১ সালের মার্চ মাস থেকে) শেষে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক ভাবনার আলােকে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠন, বাস্তুহারাদের পুনর্বাসন, প্রশাসনিক-ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়ােজিত সব সংগঠনের মধ্যে সমন্বয়সাধন, রাষ্ট্রীয় মূলনীতি তথা বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, ও সমাজতন্ত্রের ভিত্তিতে দেশগঠন, জাতীয়করণ নীতি ঘােষণা, সারা বছর প্রত্যেক চাষিকে কৃষিঋণ দানের ব্যবস্থা, নগর ও গ্রামীণ জীবনধারার বৈষম্য দূরীকরণ, মুনাফাখােরদের বিরুদ্ধে জনপ্রতিরােধ গড়ে তােলার ঘােষণা, মুক্তিযুদ্ধ বিরােধী দালালদের শাস্তির আইন প্রণয়ন ইত্যাদি কর্মসূচি হাতে নেন। এজন্য বঙ্গবন্ধুর সরকার নিষ্ঠার সঙ্গে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে। বঙ্গবন্ধু তার আমলে গঠিত সরকারে প্রয়ােজনের অতিরিক্ত কোনাে মন্ত্রণালয় সৃষ্টি করেননি কিংবা মাত্রাতিরিক্ত মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী নিয়ােগ করেননি। উল্লেখ্য, তার মন্ত্রিসভায় কোনাে উপমন্ত্রীর পদ ছিল না। ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত সৃষ্ট মন্ত্রণালয়ের নাম মন্ত্রিসভার সদস্যসংখ্যা ও মন্ত্রী প্রতিমন্ত্রীর নাম, তাঁদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব ও দপ্তরের নাম, মন্ত্রীপ্রতিমন্ত্রীর নিয়ােগের তারিখ ও কার্যকাল ইত্যাদি দেখলে সহজেই একটি বিষয় স্বচ্ছ হবে। যে, তিনি অযথা কিংবা কাউকে তুষ্ট করতে তাঁর মন্ত্রিসভায় আন্তর্ভুক্ত করেননি (পরিশিষ্ট ৫২ দ্রষ্টব্য)। উল্লেখ্য, ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত মন্ত্রিসভায় প্রথমে মাত্র ১১ জন সদস্য অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী ড. কামাল হােসেন এই মন্ত্রিসভায় স্থান পেয়েছিলেন। এদের মধ্যে অস্থায়ী রাজধানী মুজিবনগরে গঠিত প্রথম বাংলাদেশ সরকারের চার জন মন্ত্রী (তাজউদ্দীন আহমদ, খন্দকার মােশতাক আহমেদ, এম. মনসুর আলী, এ. এইচ, এম কামারুজ্জামান) এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী ছিলেন) এবং উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামও (মুক্তিযুদ্ধকালে ভারপ্রাপ্ত। রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন) ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের আগে।

প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের মন্ত্রিসভায় ২৭ ডিসেম্বর অন্তর্ভুক্ত শেখ আবদুল আজিজ, শ্রী ফণী মজুমদার, মােহাম্মদ আবদুস সামাদ, জহুর আহমেদ চৌধুরী এবং ২৮ ডিসেম্বর অন্তর্ভুক্ত অধ্যাপক এম ইউসুফ আলীকেও বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস মন্ত্রিসভার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী তাজউদ্দীন আহমদকে অর্থ, রাজস্ব, পরিকল্পনাবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি ক) প্রতিরক্ষা খ) তথ্য, বেতার, ও যােগাযােগ গ) অর্থনৈতিক বিষয়, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন ঘ) শিক্ষা, স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন সরকার, স্বাস্থ্য, শ্রম ও ঙ) মন্ত্রিসভার অন্য কোনাে সদস্যকে দেওয়া হয়নি এমন বিষয়গুলাের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। রাজস্ব বিভাগের দায়িত্ব বাদে তিনি অর্থ ও পরিকল্পনা সম্পর্কিত বিষয়াদি ১৯৭৩ সালের ১৬ মার্চ পর্যন্ত দেখাশুনা করেছিলেন। অতঃপর প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় তিনি ১৯৭৪ সালের ৮ জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভায় পাট বিভাগের (পাট বাের্ড, পাট রপ্তানি সংস্থা, পাট বাণিজ্য সংস্থা, পাট বাজারজাতকরণ সংস্থা ও পাট মূল্য স্থিতিকরণ সংস্থাসহ) এবং ১৯৭৪ সালের ৮ জুলাই থেকে ২৬ অক্টোবর পর্যন্ত অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বন, মৎস্য ও পশুপালন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় প্রথমে ১১ জনকে ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি অন্তর্ভুক্ত করা হলেও পরে আরাে ১২ জনকে তাঁর মন্ত্রিসভায় নেওয়া হয়েছিল। এতে মন্ত্রিসভার সদস্যসংখ্যা দাঁড়িয়েছিল মাত্র ২৩ জনে। মন্ত্রিসভায় দ্বিতীয় ও তৃতীয়পর্যায়ে অন্তর্ভুক্ত সদস্যগণ ১৯৭২ সালের ১৯ জানুয়ারি এবং ১২ এপ্রিলে নিয়ােগপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। এই ২৩ জন প্রত্যেকেই পূর্ণমন্ত্রীর পদমর্যাদা পেয়েছিলেন। এই মন্ত্রিসভার কার্যকাল ১৯৭৩ সালের ১৬ মার্চ পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল। আগে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বাংলাদেশের সংবিধানের খসড়া প্রণীত হলে তা বাংলাদেশ গণপরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশনে উপস্থাপিত হয়। অধিবেশন বসেছিল ১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর। তৎকালীন আইনমন্ত্রী ড. কামাল হােসেন গণপরিষদের সামনে খসড়া শাসনতন্ত্র পেশ করেন। গণপরিষদে পূর্ণ বিতর্কের পর ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর বাংলাদেশ সংবিধান গৃহীত হয়। গণপরিষদ সদস্যগণ পাসকৃত সংবিধানে ১৯৭২ সালের ১৪ ডিসেম্বর স্বাক্ষর প্রদান করেছিলেন। ওই দিনই স্পিকার বাহাত্তরের সংবিধান। প্রমাণীকৃত করেন। সংবিধান কার্যকর হয় ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে। তবে তার আগের দিন ১৫ ডিসেম্বর গণপরিষদ বাতিল করা হয়েছিল।

সাংবিধানিক সরকার গঠন সংবিধানের বিধিমতে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিবর্গ ও সুপ্রিম কোর্টের বিচারকগণ শপথ গ্রহণ করেন এবং সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। দল পরিবর্তন করলে সদস্যপদ রহিতব্যবস্থা সংবিধানে যুক্ত হয়। সংবিধান গৃহীত হওয়ার তিন মাসের মধ্যে ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচন। নির্বাচনে ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৯২টি আসনে বিজয়ী হয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে ১৯৭৩ সালের ১৬ মার্চ ৩৭ সদস্যবিশিষ্ট নতুন মন্ত্রিসভার সদস্যদের নাম ঘােষণা করা হয়। নতুন মন্ত্রিসভায় পূর্বতন মন্ত্রিসভার সকলকেই পূর্ণমন্ত্রীর পদমর্যাদায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। নতুন মন্ত্রিসভায় জনাব আবদুল মমিনকে প্রথমে প্রতিমন্ত্রী পরে মন্ত্রীর পদমর্যাদায় নিযুক্ত করা হয়েছিল। এই মন্ত্রিসভায় ২৪ জন পূর্ণমন্ত্রী এবং ১৩ জন প্রতিমন্ত্রী ছিলেন (পরিশিষ্ট-৫৩ দ্রষ্টব্য)। | লক্ষ করার বিষয় এই যে, ১৯৭৩ সালের ১৬ মার্চ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালের ২৬ জানুয়ারি পর্যন্ত মন্ত্রিপরিষদ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও সংস্থাপন বিভাগ; প্রতিরক্ষা; পরিকল্পনা; সাহায্য ও পুনর্বাসন তথ্য। ও বেতার; জাহাজ চলাচল, অভ্যন্তরীণ নৌচলাচল ও বিমান পরিবহণ মন্ত্রণালয়; পাট মন্ত্রণালয় নিজ দায়িত্বে রাখেন। তার মন্ত্রিসভার অন্য মন্ত্রীদের অধীনে যেসব দপ্তর বণ্টন করে দিয়েছিলেন তার তালিকা দেখে বুঝে নিতে কষ্ট হয় না যে, প্রধানমন্ত্রী দেশের এবং জনগণের কল্যাণে যেসব কাজ অবশ্য করণীয় সেসব বিবেচনায় নিয়ে সামগ্রিক কর্মসূচি অনুযায়ী দপ্তর বা মন্ত্রণালয়গুলাের নামকরণ করেছিলেন। জনগণ ও দেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কর্মসূচি বাস্তবায়ন যাতে সুসমন্বিত উপায়ে সম্পন্ন হয় সে জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয় সৃষ্টি করে তার মাধ্যমে দেশের উন্নয়নের সামগ্রিক কর্মসূচি বাস্তবায়নের ব্যবস্থাও করেছিলেন এবং এজন্য বিভিন্ন দপ্তরের দায়িত্বে যােগ্য, দেশপ্রেমিক ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিবর্গ বিশেষত রাজনৈতিক সহকর্মীদের নিযুক্ত করেছিলেন। মন্ত্রীদের জন্য দায়িত্বের যেসব এলাকা নির্ধারণ করেছিলেন সেগুলিকে বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়েছিল। কর্মসূচির বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী মন্ত্রণালয়, দপ্তর, বিভাগ ইত্যাদির নামগুলাে ছিল নিম্নরূপ : | (১) মন্ত্রিসভা সংক্রান্ত বিষয়াবলি (২) ক্যাবিনেট ডিভিশন (৩) এস্টাবলিশমেন্ট ডিভিশন (৪) প্রতিরক্ষা (৫) স্বরাষ্ট্র সংক্রান্ত বিষয়াবলি (৬) তথ্য ও বেতার (৭) শিল্প (৮) ব্যবসা ও বাণিজ্য (৯) অর্থ (১০) রাজস্ব (১১) পরিকল্পনা (১২) যােগাযােগ (সড়ক, জনপথ, সড়ক পরিবহণ, রেলপথ ও বন্দর) (১৩) বিদ্যুৎ, সেচ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ (১৪) পানি সম্পদ (১৫) পররাষ্ট্র (১৬) সাহায্য ও পুনর্বাসন (১৭) ত্রাণ ও পুনর্বাসন (১৮) কৃ ষি (১৯) শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক বিষয়াবলি ও ক্রীড়া (২০) স্বাস্থ্য (২১) শ্রম, সমাজকল্যাণ ও পরিবার পরিকল্পনা (২২) খাদ্য ও বেসামরিক সরবরাহ (২৩) আইন ও পার্লামেন্টারি বিষয় (২৪) গৃহ নির্মাণ ও পূর্ত (২৫) বাণিজ্য মন্ত্রণালয় (২৬) স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় (২৭) ডাক, তার ও টেলিফোন (২৮) বন, মৎস্য ও পশুপালন (২৯) স্বরাষ্ট্র (৩০) ভূমি প্রশাসন ও ভূমি সংস্কার (৩১) জাহাজ চলাচল, অভ্যন্তরীণ নৌচলাচল ও বিমান সংস্থা (৩২) বিদ্যুৎ, প্রাকৃতিক সম্পদ ও বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি গবেষণা। প্রত্যেক মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর নিয়ােগের, অব্যাহতি/পদত্যাগের তারিখ সংবলিত তথ্যাদির একটি তালিকা। থেকেও বঙ্গবন্ধুর তকালীন সরকারের সাংগঠনিক কাঠামাের একটি চিত্র পাওয়া যায়। 

সাধারণ নির্বাচনের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালের ১৬ মার্চ পুনরায় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন এবং মন্ত্রিসভার সদস্যসংখ্যা ৩৭ জনে উন্নীত করেন। মন্ত্রিসভার মধ্যে ১৩ জন প্রতিমন্ত্রী অন্তর্ভুক্ত ছিলেন । পূর্বতন মন্ত্রিসভার মােস্তাফিজুর রহমান | সিদ্দিকী বাদে অন্য সব সদস্যকে পরবর্তী এই মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু তার পরবর্তী মন্ত্রিসভায় নতুন পূর্ণমন্ত্রী হিসেবে শ্রী মনােরঞ্জন ধরকে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। এই মন্ত্রিসভায় যে ১৩ জন প্রতিমন্ত্রীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল তারা সবাই প্রথমবারের মতাে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন। পূর্ণমন্ত্রীদের সঙ্গে এঁরাও শপথ গ্রহণ করেন। এসব প্রতিমন্ত্রীকে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছিল। এ জন্য সরকারের কোনাে কোনাে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ও কর্মপরিধি সম্প্রসারিত করা হয় কিংবা দায়িত্বের প্রকৃতি ও পরিধির পরিপ্রেক্ষিতে পৃথক বিভাগ সৃষ্টি করে সেগুলাের দায়িত্ব প্রতিমন্ত্রীগণকে বণ্টন করে দেওয়া হয়। সংসদীয় পদ্ধতির সরকার গঠন করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালের ২৫  জানুয়ারি পর্যন্ত দেশ পরিচালনা করেন। বাংলাদেশের সংবিধান অনুসারে বাংলাদেশ একটি সংসদীয় গণতান্ত্রিক দেশে পরিণত হয়। রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়ে যায় স্বাধীন বাংলাদেশে । সাম্প্রদায়িক দলগুলাে মুক্তিযুদ্ধ বিরােধী ভূমিকার কারণে তাদের রাজনৈতিক তৎপরতা আগে থেকেই প্রকাশ্যভাবে বন্ধ ছিল। স্বাধীনতা লাভের অব্যবহিত পর থেকে সাম্প্রদায়িক এবং অস্ত্রধারী চীনাপন্থী দলগুলাে গােপনে সংগঠিত হয়ে বেআইনি ও নাশকতামূলক কাজ চালায়। গণতন্ত্র কার্যকর থাকায় অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও সংগঠনগুলাের অপতৎপরতা বিশেষভাবে বৃদ্ধি পায়। এ সময় রাজনীতির মেরুকরণও লক্ষ করা যায়। স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশের রাজনীতি তিনটি মূল ধারায় দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। এর একটি ধারা ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সরকার কর্তৃক অনুসৃত নীতির অনুকূলে এবং অন্য ধারা দুটি ছিল ঠিক তার উল্টো, বিপরীতমুখী।

অনুকূল ধারার অন্তর্গত ছিল শাসক দল আওয়ামী লীগ, কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ-মােজাফফর) এবং প্রতিকূল ধারার বাহক হিসেবে দেখা যায় পাকিস্তানি দালাল দক্ষিণপন্থী আর চীনাপন্থী উগ্রবামপন্থী বা নকশালপন্থী। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে, স্বাধীনতার প্রতিকূল ধারার অন্তর্ভুক্ত ছিল ভাসানী ন্যাপ, আতাউর রহমানের জাতীয় লীগ , জাসদ, বিরােধী গােপন দল, মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম, জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম, পিডিপি ইত্যাদি সাম্প্রদায়িক দল। সাংবিধানিক সরকারের বিরুদ্ধবাদী সরকারবিরােধী রাজনৈতিক দলগুলির অন্তর্গত অতি বামপন্থী এবং মুক্তিযােদ্ধাদের একটি অংশ বঙ্গবন্ধুর আহ্বান সত্ত্বেও অস্ত্র জমাদানে বিরত থাকে। পাকিস্তান বাহিনীর সহযােগিতাকারী রাজাকার, আলবদর, আলশামসের সদস্যরাও মুক্তিযুদ্ধের সময় হস্তগত করা অস্ত্র জমাদানে বিরত থাকে। আত্মগােপন অবস্থায় এসব অপশক্তি সরকারকে অস্থিতিশীল করতে ক্রমাগতভাবে অপতৎপরতা চালিয়ে যেতে থাকে। বিশেষত মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে ১৯৭২ সালের মাঝামাঝি বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে। প্রথম রাজনৈতিক গােষ্ঠীর আবির্ভাব দেশে এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। মুসলিম জাতীয়তাবাদ ও ইসলামি সমাজতন্ত্রের সরলীকৃত ধারণা নিয়ে মওলানা ভাসানী যেভাবে বিরােধিতা শুরু করেছিলেন তাতে দেশে এক বিভ্রান্তিকর অবস্থা সৃষ্টি হওয়ার উপক্রম হয় । মওলানা ভাসানীর “বৃহত্তর বাংলা” গঠন এবং “ইসলামি সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ঘােষণাকালে। ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে পঁচিশ বছর মেয়াদি এক মৈত্রী সহযােগিতা ও শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, চুক্তির পূর্ণ বিবরণ ১১তম অধ্যায়ে প্রদত্ত হয়েছে। এই চুক্তি সম্পাদিত হওয়ায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ভারতপন্থী হিসেবে প্রচার চালানাে হতে থাকে ।

বিরুদ্ধবাদীরা এমন কথাও ছড়াতে থাকে যে, বঙ্গবন্ধু ভারতের কাছে বাংলাদেশের কোনাে কোনাে এলাকা ছেড়ে দিয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে এগুলাে সবই ছিল বঙ্গবন্ধু এবং তার সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার। কারণ, বঙ্গবন্ধুর সরকারের সময় সম্পাদিত এই চুক্তি পরবর্তীতে খন্দকার মােশতাক আহমদ, জেনারেল জিয়াউর রহমান, জেনারেল এরশাদ এবং অন্যান্য ক্ষমতাসীন বাংলাদেশ সরকার তা বাতিল করেনি। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মী ১৯৭২ সালের অক্টোবর মাসে দল ত্যাগ করে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) নামে নতুন একটি দল গড়ে তােলে। এই দলের নেতৃত্বে সিরাজুল আলম খান, আ স ম রব, এম, এ, জলিল, শাজাহান সিরাজ প্রমুখ। ছিলেন। মুজিব সরকারকে উৎখাতের ঘােষণা দিতেও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল কুষ্ঠিত হয়নি। দেশের এমন সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে অতি বাম শক্তিগুলােও অপতৎপরতায় নেমে পড়ে। ১৯৭৩ সালের পাঁচ মাসের মধ্যেই ৬০টি থানা আক্রমণ করে। সরকারবিরােধী শক্তিসমূহের ঢাকা, বরিশাল, কুষ্টিয়া, রাজশাহী, খুলনা ইত্যাদি স্থানে নাশকতামূলক কাজ সরকারকে দারুণভাবে ব্রিত করে তােলে। চরম বামপন্থী দল বাংলাদেশের স্বাধীনতাকেই অস্বীকার করার ধৃষ্টতা দেখায়। কক্সবাজার-টেকনাফ এলাকার রােসাং-ভিত্তিক “মুসলিম। বাংলা” নামের চরম ডানপন্থী প্রতিক্রিয়াশীলদের সাথে এক হয়ে চরম বামপন্থী গােষ্ঠী। হত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি অপরাধমূলক তৎপরতায় লিপ্ত হয়। বাংলাদেশ সরকার এসব অপতৎপরতা বন্ধ করতে সেনাবাহিনীর সহযােগিতা গ্রহণ করে। সার্বিকভাবে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সঙ্কটের অবসানকল্পে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ সংবিধানে সংশােধনী গ্রহণের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির হাতে দেশে জরুরি অবস্থা ঘােষণার বিধান সংবলিত ক্ষমতা অর্পণ করে। অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পরিস্থিতির দ্রুত অবনতির ফলে দেশে অস্থিরতা ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকলে ১৯৭৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশক্রমে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মােহাম্মদউল্লাহ দেশে জরুরি অবস্থা ঘােষণার নির্দেশ দেন। এই নির্দেশবলে সংবিধানের দ্বিতীয় সংশােধনীর নাগরিকদের স্বাধীনতা ও অধিকার সম্পর্কিত সংবিধানের সব ধারা স্থগিত রাখা হয়। কিন্তু মাওবাদী সিরাজ সিকদারের সর্বহারা দল, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)-এর গণবাহিনী, কমরেড আবদুল হকের ইপিসি এম-এল, কমরেড তােয়াহার কমিউনিস্ট পার্টি এবং অন্যান্য উগ্রপন্থী দল দেশের থানা, পুলিশ ক্যাম্প ও ব্যাংক লুট, আওয়ামী লীগ কর্মী হত্যা অব্যাহত রাখে। নাশকতামূলক কাজ বৃদ্ধি পায়, কালােবাজারিও অব্যাহত থাকে। দেশের রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় কাঠামােয় গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনয়নের ক্ষেত্রে জরুরি অবস্থা ঘােষণা প্রাথমিক ব্যবস্থা ছিল।

বঙ্গবন্ধুর প্রস্তাব অনুসারে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে দেশে রাষ্ট্রপতিশাসিত পদ্ধতি চালু করার আইন গৃহীত হয়। এই আইন অনুযায়ী দেশের সব নির্বাহী | ও আইন প্রণয়নের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত হয়। সংশােধিত বিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি প্রত্যক্ষ ভােটের মাধ্যমে ৫ বছরের জন্য নির্বাচিত হবেন। জাতীয় সংসদে অনুমােদিত সংবিধানের এই সংশােধিত বিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি তাঁর ইচ্ছানুসারে উপরাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার সদস্য এবং অন্য সরকারি বিভাগের কর্মকর্তা নিয়ােগ এবং অপসারণ করতে পারবেন। রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারের সব কাজকর্ম রাষ্ট্রপতির পক্ষ থেকে পরিচালনার ব্যবস্থা প্রচলনের বিধান গৃহীত হয় অর্থাৎ সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থার পরিবর্তে রাষ্ট্রপতিশাসন-পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা চালু করার আইন সংসদে অনুমােদিত হয়।  জাতীয় সংসদে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারপদ্ধতি চালু করার আইন গৃহীত হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু জাতীয় সংসদের অধিবেশনে দেশে বিরাজমান তল্কালীন চিত্র তুলে ধরে কালােবাজারি, অন্তর্ঘাত, গুপ্তহত্যা, পুলিশ ক্যাম্প-থানা লুট, নাশকতামূলক কার্যকলাপ বন্ধ করার প্রয়ােজনীয়তার ওপর সবিশেষ জোর দেন। দেশের রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক কাঠামােয়  গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনতে জাতীয় সংসদে তাঁর যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য তুলে ধরে বলেছিলেন  যে, বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জীবন থেকে ওপনিবেশিক অবশেষসমূহ নির্মূল করার  উদ্দেশ্যে সংবিধানে নির্ধারিত লক্ষ্য- শােষিত শ্রমজীবী মানুষের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য দেশে আমূল পরিবর্তন করতে বাধ্য হচ্ছি। বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রের প্রধান চার মূল নীতি যথা জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী সব দেশপ্রেমিক শক্তির প্রতি ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। জাতীয় সংসদের সিদ্ধান্ত অনুসারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। সাবেক শিল্পমন্ত্রী সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপতি এবং সাবেক স্বরাষ্ট্র ও যােগাযােগ মন্ত্রী এম মনসুর আলীকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়ােগ করা হয়। রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারের মন্ত্রিসভায় ১৭ জন মন্ত্রী এবং ৯ জন প্রতিমন্ত্রী অন্তর্ভুক্ত হন। এই মন্ত্রিসভায় প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি মােহাম্মদউল্লাহ এবং আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি এ. এইচ, এম, কামারুজ্জামান মন্ত্রী হিসেবে যােগদান করেন (পরিশিষ্ট ৫৪ দ্রষ্টব্য)। সাংবিধানিকভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়ে  ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি দেশ ও সরকারের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ওই দিন থেকে তিনি রাষ্ট্রপতির সচিবালয়ের অধীনে (ক) মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ (খ) সংস্থাপন বিভাগ (গ)

——–

১. জাতীয় পরিষদে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ।

——-

রাষ্ট্রপতির বিভাগগুলাে এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িগ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালের ২৬ জানুয়ারি থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদে সমাসীন ছিলেন। | পনেরােই আগস্ট বাংলাদেশের ইতিহাসে এক কলঙ্কময় অধ্যায় রচিত হয়। সংবিধানসম্মত উপায়ে নির্বাচিত দেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতিকে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের দোসর হিসেবে এ দেশেরই কয়েকজন কুলাঙ্গার পাকিস্তানি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে তার স্ত্রী ও তিন পুত্র এবং ভাগ্নে শেখ মনিসহ ১৫ জন পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়কে নির্মমভাবে হত্যা করে। আত্মীয়স্বজন ছাড়াও তাঁর বাসভবনে কর্তব্য পালনরত একজন ডিএসপি রাষ্ট্রপতির মিলিটারি সেক্রেটারি কর্নেল জামিল, বঙ্গবন্ধুর ভগ্নীপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাতের সরকারি বাসভবনে অবস্থানরত তিনজন অতিথিকেও দুবৃত্তরা হত্যা করেছিল। দুবৃত্তদের মধ্যে অন্যতম ছিল মেজর রশিদ, মেজর ফারুক, মেজর ডালিমসহ আরাে কয়েকজন সেনাসদস্য। হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণকারী সেনাসদস্যের মন্ত্রণাদাতা হিসেবে খােন্দকার মােশতাক আহমদ, মাহবুব আলম চাষী এবং তাহেরউদ্দিন ঠাকুরের নাম বিদেশি লেখক লরেন্স লিফশুলজের রচিত এবং লন্ডনের জেড প্রেস থেকে ১৯৭৯ সালে প্রকাশিত “বাংলাদেশ : দ্য আনফিনিশড রেভলিউশন” নামক গ্রন্থে বাংলাদেশের করুণ ইতিহাসের এই আলেখ্য বর্ণিত হয়েছে। প্রবীণ রাজনীতিবিদ মুক্তিযুদ্ধকালে মুজিবনগরে গঠিত প্রথম বাংলাদেশ সরকারের অভিভাবক হিসেবে উপ-রাষ্ট্রপতির দায়িত্বপ্রাপ্ত সৈয়দ নজরুল ইসলাম ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারিতে প্রবর্তিত সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থায় এবং পুনরায় রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থার অধীনে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত দায়িত্ব পালনরত এবং বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহযাত্রী জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং এ. এইচ, এম, কামারুজ্জামানকে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বিশ্বাসঘাতক খােন্দকার মােশতাক তার অবৈধ অসাংবিধানিক সরকারে নিতে সক্ষম হতে না পারায় বন্দী করে কারাগারে নিক্ষেপ করে। কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে মােশতাকের নির্দেশে বর্বর রিসালদার মােসলেম উদ্দিনের নেতৃত্বে এক সৈন্যদল জেলখানায় জোরপূর্বক প্রবেশ করে হত্যা করেছিল। তৎকালীন আইজি (প্রিজন) নূরুজ্জামানের লিখিত রিপাের্ট থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারের মন্ত্রিসভায় খন্দকার মােশতাক আহমদ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার পর মােশতাক নিজেই অসাংবিধানিক পন্থায় রাষ্ট্রপতি পদ দখল। করেন এবং ১৯৭৫ সালের ২০ আগস্ট থেকে ৬ নভেম্বর পর্যন্ত মাত্র ৭৮ দিন রাষ্ট্রপতির সচিবালয়সহ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিজ কজায় রেখেছিলেন।

বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি যারা মন্ত্রী এবং প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছিলেন তাদের অধিকাংশই প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থায় মন্ত্রী কিংবা প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। তবে ওই।

—————-

২, অবসরপ্রাপ্ত লেক, এম,এ, হমিদ পিএসসি রচিত এবং ঢাকার শিখা প্রকাশনী থেকে ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত তিনটি সেনা অভূত্থান ও | কিছু না বলা কথা” নামক গ্রন্থ দ্রষ্টব্য।

———-

মন্ত্রিসভার বেশ উল্লেখযােগ্যসংখ্যক সদস্য পরবর্তী রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারের মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত হননি। এঁদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য কয়েকজনের নাম হলাে তাজউদ্দীন আহমদ, শেখ আবদুল আজিজ, জহুর আহমেদ চৌধুরী (১৯৭৪ সালের ১ জুলাই মৃত্যুবরণ করেছিলেন), শামসুল হক, মতিউর রহমান, আবদুল মালেক উকিল, মােল্লা জালালউদ্দিন আহমদ, মিজানুর রহমান চৌধুরী, জেনারেল আতাউল গণি ওসমানী, ড. মফিজ চৌধুরী, আমীর-উল ইসলাম, বদরুন্নেছা আহমেদ (১৯৭৪ সালের ২৫ মে ইন্তেকাল করেন), নূরজাহান মুর্শিদ, মােঃ নূরুল ইসলাম মঞ্জুর, অধ্যাপক শাহজাদা আবদুল মালেক খান। প্রমুখ। এঁরা বিভিন্ন সময়ে মন্ত্রিসভার সদস্যপদ থেকে পদত্যাগ করেন। আওয়ামী লীগের সভাপতি পদের দায়িত্ব গ্রহণের জন্য দলীয় গঠনতন্ত্রের শর্তের কারণে এ. এইচ, এম, কামারুজ্জামান মন্ত্রিসভার সদস্যপদ থেকে পদত্যাগ করলেও তিনি পরবর্তী রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন। রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর জীবদ্দশায় সর্বশেষ যে মন্ত্রিসভা গঠন করে এই মন্ত্রিসভায় নতুন পাঁচ জন সদস্যকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। এঁরা হলেন আসাদুজ্জামান খান, এম. কোরবান আলী, ড, আজিজুর রহমান মল্লিক এবং বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতি হিসেবে সরকারের যেসব মন্ত্রণালয় কিংবা বিভাগ ও দপ্তরের দায়িত্ব নিজ হাতে রেখেছিলেন সেগুলির ওপর গুরুত্ব আরােপ করে সংশ্লিষ্ট কর্মকাণ্ড পরবর্তী অধ্যায়গুলােতে বর্ণিত হয়েছে।

সূত্র : বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১-৭৫ এইচ টি ইমাম

 
error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!