You dont have javascript enabled! Please enable it! 1973 | স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা - সংগ্রামের নোটবুক

স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা

একথা অনস্বীয়কার্য যে, সাবেক পাকিস্তান আমলে বঙ্গবন্ধু তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ভিত্তি গড়ে তুলতে যে ৬-দফা দাবি তুলেছিলেন তা যথার্থ এবং সঙ্গত ছিল। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু পূর্ণ মাত্রায় তার ধ্যানধারণা বাস্তবায়নে পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। বলা চলে, মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পরই বঙ্গবন্ধুর চিন্তার প্রতিফলন প্রথম বাংলাদেশ সরকার ঘটাতে শুরু করে। যুদ্ধজয়ের আগেই সরকারের অর্থনৈতিক পদক্ষেপ মুক্তিযুদ্ধকালে গঠিত মন্ত্রণালয়গুলাের মধ্যে বাংলাদেশ সরকারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় ছিল অর্থ মন্ত্রণালয়। প্রথম বাংলাদেশ সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব লাভ করেন ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ন্যস্ত হয় (ক) অর্থ ও জাতীয় রাজস্ব দপ্তর (খ) বাণিজ্য ও শিল্প দপ্তর এবং (গ) পরিবহণ দপ্তর। সরকারের পরিকল্পনা সেল, বাের্ড ও কমিশনের কাজকর্ম অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে সম্পন্ন হলেও বাস্তব ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ নিজেই পরিকল্পনা বিষয়ক সব কাজ তত্ত্বাবধান করতেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ সরকারের সর্বপ্রধান কাজ ছিল প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও সাধারণ প্রশাসন বিভাগকে পূর্ণোদ্যমে সক্রিয় ও সচল করে তােলা । তাই বলে, যুদ্ধকালীন সময়ে বাংলাদেশ সরকারের অর্থনৈতিক কাজকর্ম স্থবির হয়ে পড়েনি কিংবা গতিহীনও হয়নি। বঙ্গবন্ধু পূর্ববঙ্গের অর্থনৈতিক চিত্র তুলে ধরে ১৯৬৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে। ঐতিহাসিক ৬-দফা দাবি তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকবৃন্দের কাছে পেশ করেছিলেন। এই ৬-দফার ৩-সংখ্যক দফায় তল্কালীন পাকিস্তানের দুই অংশের মুদ্রাব্যবস্থা সম্পর্কে যুক্তিসঙ্গত প্রস্তাব ছিল। মুদ্রাব্যবস্থা সম্পর্কে যে দুটি প্রস্তাব ৬-দফা দাবির মাধ্যমে দেশবাসী এবং সরকারের কাছে উপস্থাপন করা হয়েছিল তার মধ্যে অর্থনৈতিক প্রগাঢ় প্রজ্ঞার ছাপ লক্ষণীয়। মুদ্রা সম্পর্কে প্রস্তাব দুটি ছিল নিম্নরূপ :

ক) পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য দুইটি পৃথক অথচ সহজে বিনিময়যােগ্য মুদ্রার প্রচলন করিতে হইবে। এই ব্যবস্থানুসারে কারেন্সি কেন্দ্রের হাতে থাকিবে না, আঞ্চলিক সরকারের থাকিবে। দুই অঞ্চলের জন্য দুইটি স্বতন্ত্র “স্টেট ব্যাংক” থাকিবে। খ) দুই অঞ্চলের জন্য একই কারেন্সি থাকিবে। এ ব্যবস্থায় মুদ্রা কেন্দ্রের হাতে থাকিবে। কিন্তু এ অবস্থায় শাসনতন্ত্রে এমন সুনির্দিষ্ট বিধান থাকিতে হইবে যাতে পূর্ব পাকিস্তানের মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হইতে না পারে। এই বিধানে পাকিস্তানের একটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থাকিবে; দুই অঞ্চলে দুইটি পৃথক রিজার্ভ ব্যাংক থাকিবে।  জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৬-দফা প্রস্তাবে মুদ্রাব্যবস্থা সম্বন্ধে যেসব যুক্তি তুলে ধরা হয়েছিল তা রাষ্ট্রীয় অর্থবিজ্ঞানে স্বীকৃত বিষয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি  ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেমের মাধ্যমে পৃথক পৃথক স্টেট ব্যাংকের দ্বারা পরিচালিত হয়,  এমন যুক্তিও বঙ্গবন্ধু তকালে তার ৬-দফায় ব্যাখ্যা করেছিলেন। এ ছাড়া তিনি সােভিয়েত ইউনিয়ন, দক্ষিণ আফ্রিকার দেশগুলাের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ সম্বন্ধে বিস্তারিত তুলে ধরে সাবেক পূর্ব পাকিস্তানকে নিশ্চিত অর্থনৈতিক মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করার জন্য ৬-দফার মধ্যে মুদ্রাব্যবস্থা সম্পর্কিত দাবি অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। দেশ মুক্ত হবার পর বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশে ফিরে এসে অর্থ মন্ত্রণালয়কে আরাে সুসংহত করেছিলেন। তিনি তার ধ্যানধারণা দিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির বুনিয়াদ শক্তিশালী করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধুর এ কাজে তার সহকর্মীগণ নিরলস শ্রম দিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি সংহত করার পথে এগিয়ে যান। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৬-দফাভুক্ত অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত প্রস্তাব তার রাজনৈতিক সহকর্মী সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, এ. এইচ. এম কামারুজ্জামান প্রমুখের মনে ও মননে এবং কাজকর্মে সুদৃঢ়ভাবে প্রােথিত হয়ে গিয়েছিল। তাই ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর বঙ্গবন্ধু তার সহকর্মীদের নিয়ে বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রবর্তনে প্রয়াসী হন। স্বাধীন দেশের উপযােগী অর্থনীতি গড়ে তুলতে বঙ্গবন্ধুর ধ্যানধারণার বাস্তবায়নে দেশপ্রেমিক সহকর্মীবৃন্দও এগিয়ে আসেন। তাঁদের সম্মিলিত প্রয়াসেই বাংলাদেশের অর্থনীতির ভিত তৈরি হয়েছিল। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে মুক্তিযুদ্ধকালেই বাংলাদেশের তৎকালীন চাহিদা এবং ভবিষ্যৎ চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে যাবতীয় পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য বাংলাদেশ সরকার একটি পরিকল্পনা সেল গঠন করে। কিন্তু চাহিদার ব্যাপ্তি ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকায় এই সেলকে বাের্ডে রূপান্তরিত করা হয়। কিছু কাল পর এই বাের্ডকে কমিশনে উন্নীত করা হয়েছিল। এভাবে বাংলাদেশ সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিকল্পনা সেলকে একটি পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা কমিশনে সংগঠিত করা হয়েছিল। ড. মােজাফফর আহমদ চৌধুরীকে এই কমিশনের চেয়ারম্যান নিযুক্ত করা হয়েছিল। প্ল্যানিং কমিশনের অন্যান্য সদস্য ছিলেন ড. খান সরওয়ার মুর্শিদ, ড. মােশাররফ হােসেন, ড, এস, আর, বসু এবং ড. আনিসুজ্জামান।

সরকার প্ল্যানিং কমিশনের ওপর যেসব কাজের দায়িত্বভার অর্পণ করে তা ড. মােজাফফর আহমদ চৌধুরীর নেতৃত্বে সুসম্পন্ন হয় এবং কমিশন তা দীর্ঘ প্রতিবেদন আকারে সরকারের কাছে উপস্থাপন করে। বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার পর কীভাবে দেশের পুনর্গঠন, উন্নয়নমূলক কাজকর্ম এবং সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দপ্তর পরিচালিত হবে তার পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা এই প্রতিবেদনে উপস্থাপন করা হয়। বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টিভঙ্গি এবং আদর্শের ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশ সরকার মুজিবনগরে দেশ পরিচালনার যাবতীয় দায়িত্ব পালনসহ শত্রুমুক্ত বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা তৈরি করেছিল। তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনায় বঙ্গবন্ধুর সােনার বাংলা গঠনের স্বপ্নের প্রতিফলনই ছিল। আগেই উল্লেখ করেছি, বঙ্গবন্ধুর ৬-দফার ধ্যানধারণা মুজিবনগরে গঠিত মন্ত্রিসভার সদস্যগণও আত্মস্থ করেন। পূর্বাপর ধারাবাহিকতায় শত্রুমুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাজকর্ম। সুসংগঠিত হতে থাকে এবং কৃষি, শিল্প, ভূমি ব্যবস্থাপনা, বৈদেশিক বাণিজ্য, রাজস্ব আদায়পদ্ধতি, সরকারি ব্যয় ইত্যাদি বিষয়ে সরকারের অবস্থান দৃঢ়তর হতে থাকে। পরিকল্পিত উপায়ে দেশ গঠনে এবং জনগণের ভাগ্যোন্নয়নে বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (১৯৭৩-৭৮) প্রণীত হয়। তকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অভিপ্রায় অনুযায়ী স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে পুনর্গঠিত প্ল্যানিং কমিশন প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়ন করে। তিনি পুনর্গঠিত প্ল্যানিং কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিজের হাতে রাখেন। বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানি শক্রশক্তিকে বিতাড়িত করার মাত্র দেড় বছরের মধ্যে প্রণীত প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা সম্বন্ধে কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, প্রস্তুতির সময় যেভাবে চিন্তাভাবনা করা হয়েছিল তা থেকে বাংলাদেশ সরকারের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাকে ব্যতিক্রমধর্মী করতে হয়েছে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের বিদ্যমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে।

পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মুখবন্ধে তিনি বলেন যে, কোনাে পরিকল্পনাই, এমনকি সবচেয়ে সুন্দরভাবে গ্রথিত পরিকল্পনাও কোনাে ভালাে ফল অর্জন করতে পারে – যদি না তাতে জনসাধারণের সার্বিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়, যদি না তারা কঠোর পরিশ্রম ও আত্মত্যাগে উদ্বুদ্ধ হয়। জাতি গঠনে বঙ্গবন্ধু জনসাধারণের প্রতি আত্মনিয়ােগের আহ্বান জানিয়েছিলেন। বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশন পুনর্গঠন। ১৯৭২ সালের ৩১ জানুয়ারি বাংলাদেশ প্ল্যানিং কমিশন গঠন সম্পর্কিত প্রধানমন্ত্রীর অধীন। মন্ত্রিপরিষদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে জারিকৃত আদেশে (পরিশিষ্ট-৫১) বলা হয় যে, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে পরিকল্পনা এবং অর্থনৈতিক কর্মপদ্ধতি নির্ধারণে সাংগঠনিক কাঠামাে নিম্নলিখিতভাবে হবে : ১। মন্ত্রিসভা (Cabinet) অর্থনৈতিক কর্মপ্রণালী ও পরিকল্পনা প্রণয়নের অধিকারসহ সব কর্মপ্রণালী প্রণয়নের সর্বময় ও চূড়ান্তক্ষমতার অধিকারী হবে। মন্ত্রিসভা। ২। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে একটি পরিকল্পনা কমিশন থাকবে। তবে কমিশনের কাজ মন্ত্রিসভার ইচ্ছায় কখনাে সংক্ষিপ্ত বা বিস্তৃত হতে পারে ।

প্ল্যানিং কমিশনের দায়িত্ব নিম্নরূপ হবে

(১) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের আর্থ-সামাজিক উদ্দেশ্যাবলির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের জন্য বার্ষিক, পঞ্চ বার্ষিক ও পটভূমি তৈরিতে জাতীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন করবে।

(২) জাতীয় পরিকল্পনার রূপরেখার মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি তৈরি করবে, পরিকল্পনা বাস্তবায়নের নীতিমালাও নির্ধারণ করবে।

(৩) সম্পাদিত পরিকল্পনার মূল্যায়ন করবে এবং পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অগ্রগতির দিকে নিরবচ্ছিন্নভাবে লক্ষ রাখবে। জাতীয় পরিকল্পনার মূল্যায়ন প্রস্তুত করতে এসব করতে হবে।

(৪) অর্থনৈতিক বিষয়গুলাে নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাবে এবং অর্থনৈতিক নীতি এবং ব্যবস্থাদি প্রকাশ করবে।

(৫) বহিঃসাহায্যের পরিমাণ নির্ধারণ করে বিদেশ থেকে প্রয়ােজনীয় সাহায্যের মােট পরিমাণ এবং প্রকৃতি নিয়ে দেনদরবার করবে। (৬) জাতীয় পরিকল্পনার মূল্যায়নের সঙ্গে বহিঃঋণ বিষয় পরীক্ষা করে তৎসম্পর্কে প্রতিবেদন উপস্থাপন করবে। (৭) কার্যকরী পরিকল্পনা এবং উন্নয়নের সমর্থনে অর্থনৈতিক গবেষণার ব্যবস্থা গ্রহণ করে তা এগিয়ে নিতে এবং জরিপ ও প্রয়ােজনীয় অনুসন্ধানের কাজ চালিয়ে যেতে হবে। (৮) জাতীয় পরিকল্পনার বার্ষিক কর্মসূচি এবং অর্থনৈতিক নীতিমালা কার্যকরীভাবে বাস্তবায়নের জন্য প্রাপ্তব্য প্রক্রিয়ার প্রকৃতির বিষয়ে পরামর্শ প্রদান করবে। (৯) পরিকল্পনা প্রণয়নে উদ্বুদ্ধ করতে এবং প্রয়ােজনে তা সূচনা করতে হবে; জাতীয় উদ্দেশ্যের সঙ্গে পরিকল্পনাগুলি সঙ্গতিপূর্ণ কিনা তা নির্ণয় করতে কর্মসূচি গ্রহণ এবং পরিকল্পনা সম্বন্ধে পরীক্ষা এবং পরামর্শ প্রদান করতে হবে। (১০) অনুমােদিত পরিকল্পনাগুলাে বিশেষ করে সাহায্য প্রাপ্ত পরিকল্পনাগুলাের বাস্তবায়নের অগ্রগতি সম্বন্ধে পর্যালােচনা করতে হবে; এসব বাস্তবায়নে বিলম্বের কারণসমূহ এবং অসুবিধাসমূহকে চিহ্নিত করতে হবে ও তা দূর করার উপায় বের করতে হবে ৩। পরিকল্পনা মন্ত্রী প্ল্যানিং কমিশনের প্রধান হবেন। মন্ত্রীর মর্যাদায় একজন ডেপুটি চেয়ারম্যান এবং প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় তিনজন সদস্য থাকবেন। পুনর্গঠিত প্ল্যানিং কমিশনে ছিলেন ডেপুটি চেয়ারম্যান হিসেবে প্রফেসর নূরুল ইসলাম সদস্যবর্গের মধ্যে ছিলেন প্রফেসর মােশাররফ হােসেন, প্রফেসর রেহমান সােবহান ও প্রফেসর আনিসুর রহমান। পরিকল্পনা কমিশনের গুরুত্ব অনুধাবন করে বঙ্গবন্ধু ডেপুটি চেয়ারম্যানকে মন্ত্রী এবং সদস্যদের প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা দেন। সরকারের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রণয়নের গুরুদায়িত্ব এই প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদবৃন্দ নিয়েছিলেন। অর্থনীতিবিদগণের পরামর্শ অনুযায়ী প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, জাতীয়করণ বিষয়ে নীতি নির্ধারিত হয়েছিল।

প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (১৯৭৩-৭৮) বঙ্গবন্ধুর আমলে প্রণীত হলেও তিনি এর মেয়াদ-সমাপ্তি দেখে যেতে পারেননি। তার আগেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট দেশের নির্বাচিত রাষ্ট্রপতিকে নির্মমভাবে হত্যা করে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীরা। তবু বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর আমলে প্রণীত প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার গুরুত্ব অপরিসীম এবং ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৫ সালের বাংলাদেশ সরকারের কার্যক্রমে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা এবং অবদানের বিভিন্ন দিক তুলে ধরার প্রয়াসও এই ঐতিহাসিক পরিকল্পনায় লক্ষণীয় হয়ে থাকবে। বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতি, ভৌগােলিক অবস্থান, অনুন্নত অবকাঠামাে, স্থবির কৃষিপদ্ধতি, একমুখী অর্থনীতি, উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত দারিদ্র্য, দ্রুত বর্ধমান জনসংখ্যা, মুক্তিযুদ্ধের প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের ভৌত অবকাঠামাে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ইত্যাদি পরিকল্পনার দলিলের বিষয়ও ভূমিকায় তুলে ধরা হয়েছিল। ভেঙে পড়া সাংগঠনিক ও ব্যবস্থাপনাপদ্ধতি এবং অবলুপ্ত বৈদেশিক বাণিজ্যিক সম্পর্কের মধ্যে পরিকল্পনাটি প্রণয়ন করতে হওয়ায় কমিশনকে বিভিন্ন দিকও বিবেচনায় রাখতে হয়েছিল বলে ভূমিকায় উল্লেখ করা হয়। পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়নে আশাবাদ যুদ্ধবিধ্বস্ত অবস্থা থেকে দেড় বছর সময় পার না হতেই দেশটির পুনর্গঠন এবং অর্থনৈতিক আবহ পুনরুদ্ধারের জন্য প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হওয়ায় সর্বোচ্চ গুরুত্বসহকারে পুনর্গঠন কাজকে দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু তার দূরদৃষ্টি দিয়ে দেখেছিলেন যে, জাতির জন্য ওই মুহূর্তে একটি দৃষ্টিভঙ্গির যেমন প্রয়ােজন তেমনি একটি কর্মপরিকল্পনারও প্রয়ােজন। এই দৃষ্টিভঙ্গি এবং কর্মপরিকল্পনার মধ্যে দিকনির্দেশনা এবং অগ্রাধিকারভিত্তিক বিষয়াদির প্রতিফলনও তিনি আশা করেছিলেন। বহুবিধ সীমাবদ্ধতা থাকায় বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়নকালে বাস্তবতার নিরিখে। আনুষঙ্গিক তথ্যাদি পর্যালােচনা ও মূল্যায়নপূর্বক সেগুলাে পরিকল্পনায় সন্নিবেশিত হবে এমন আশা নিয়ে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা তৈরি করা হয়। এই পরিকল্পনার দ্বিতীয় অধ্যায়ে এর উদ্দেশ্যগুলাে বর্ণিত হয়েছে নিমরূপে :

১. দারিদ্র্য দূরীকরণ বেকারদের কর্মের সুযােগ সৃষ্টি, কম মজুরিতে নিযুক্তদের মজুরি বৃদ্ধি, জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধি এবং সমতাভিত্তিক আইনব্যবস্থা। ২. পুনর্নির্মাণ কাজ অব্যাহত রাখা : কৃষি ও শিল্প খাতসহ অর্থনীতির প্রধান প্রধান ক্ষেত্রে উৎপাদন সামর্থ্যও সময়ােপযােগী মাত্রায় বৃদ্ধি করা। ৩. বাৎসরিক জিডিপি অন্তত ৫.৫ শতাংশ বৃদ্ধি (বর্তমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির ৩.৩ শতাংশ হারকে অতিক্রম করা) সার্বক্ষণিক চাকরির সংখ্যা ৪১ লাখে উন্নীতকরণ, অসংগঠিত খাতের শ্রমশক্তিকে সংগঠিত করা, সম্পাদনযােগ্য, উন্নয়নমুখী স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করা। ৪. খাদ্য, বস্ত্র, ভােজ্যতেল, কেরােসিন এবং চিনির মতাে অপরিহার্য দ্রব্যসামগ্রীর  প্রাপ্তি ও স্বল্প মূল্য নিশ্চিত করা। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি রােধ করা এবং অপরিহার্য দ্রব্যসামগ্রীর ক্ষেত্রে মূল্য কমানাে। মাথাপ্রতি বাৎসরিক আয় অন্তত: ২.৫ শতাংশ বৃদ্ধি করা। এমনভাবে গতিনির্ধারণ করা যাতে দরিদ্র জনগােষ্ঠী সম্পদের তুলনায় অধিক হারে বাত্সরিক আয় ভােগ করতে পারে। আয় এবং সম্পদের ওপর সিলিং ধার্য করে এবং আদায়কৃত রাজস্বের পুনর্বণ্টন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এটা করা হবে। সমাজতন্ত্রে রূপান্তর প্রচেষ্টায় অর্জিত সাফল্যকে সমন্বিত করা, প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামােকে সমাজতন্ত্রমুখী করা এবং এতদুদ্দেশ্যে সামাজিক-রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন সাধন করা। ৮. দেশীয় সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার এবং আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধির মাধ্যমে পরনির্ভরতা কমিয়ে আনা। রপ্তানি বৃদ্ধি ও বহুমুখীকরণ এবং দক্ষতার সাথে আমদানি-বিকল্প খুঁজে বের করার মাধ্যমে বৈদেশিক বিনিময়ের ভারসাম্যহীনতা রােধ করা ।। খাদ্যশস্য উৎপাদনে আত্মনির্ভরতা অর্জন, কৃষি ক্ষেত্রে কর্মের সুযােগ সম্প্রসারণ এবং শহরমুখী শ্রমিক স্রোত ঠেকানাের উদ্দেশ্যে প্রাতিষ্ঠানিক ও কারিগরিভিত্তিক কৃষিভিত্তি গড়ে তােলা। ১০. জনসংখ্যা পরিকল্পনা ও নিয়ন্ত্রণের একটি উচ্চাভিলাষী বুনিয়াদ (মৰ্ডহফ ড়িৎশ) সম্পাদন করা, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাজনৈতিক নেতৃত্বের অঙ্গীকার ও সামাজিক সচেতনতা নিশ্চিত করা, জনসংখ্যা পরিকল্পনার জন্য একটি যথে পিযুক্ত প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামাে সৃষ্টি অনবরত ও নিবিড় মূল্যায়ন ও গবেষণার ব্যবস্থাসম্পন্ন পরিবার-পরিকল্পনার বিভিন্ন পদ্ধতি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা, বাৎসরিক জনবৃদ্ধির হার ৩ শতাংশ থেকে ২.৮ শতাংশে নামিয়ে আনা। ১১. শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গ্রামীণ গৃহায়ন এবং জল সরবরাহব্যবস্থা ইত্যাদির মাধ্যমে চিরাচরিতভাবে অবহেলিত সামাজিক ও মানবসম্পদের উন্নয়নসাধন। সমগ্র দেশে, ভৌগােলিক অঞ্চল নির্বিশেষে সমহারে আয় ও কর্মের সুযােগ সম্প্রসারিত করা, অর্থনৈতিক সুযােগ সম্প্রসারিত অঞ্চলে শ্রমিকের গমনাগমন উৎসাহিত করা। ১৯৭৩ সালে প্রণীত পঞ্চমবার্ষিকী পরিকল্পনায় দেশের উন্নয়নের রূপরেখার মধ্যে ১৯৭২ সালে জাতীয় সংসদে গৃহীত সংবিধানের মূলনীতিসমূহের উপস্থিতি লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সামাজিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রের বিভিন্ন দিকের সঙ্গে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার প্রত্যক্ষ এবং পরােক্ষ প্রভাব পরিকল্পনাবিদগণ এমনভাবেই যুক্ত করে দিয়েছিলেন, তাতে বঙ্গবন্ধুর সারা জীবনের সংগ্রামী আদর্শই একাকার হয়ে গিয়েছিল। শােষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে শােষক-শক্তির কবল থেকে সুযােগ-সুবিধা বঞ্চিত মানুষকে মুক্ত করার পরিস্থিতি সৃষ্টি করার কৌশল পরিকল্পনায় ছিল। অর্থনৈতিক দুর্দশামুক্ত সমতাভিত্তিক সমাজ গঠনে প্রত্যেক নাগরিকের জন্য কাজের সুযােগ সৃষ্টির প্রয়াস নেওয়া হয়  প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায়। অনর্জিত আয়ের ভােগ নিরুৎসাহিত এবং আইনসিদ্ধ উপায়ে  উৎপাদনব্যবস্থায় ব্যক্তিমালিকানার সীমানা নির্ধারণ করার প্রতিশ্রুতিও ওই পরিকল্পনায় ছিল  যার মাধ্যমে মূলত একটি কল্যাণমুখী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যই প্রতিফলিত হয়েছে। বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রসঙ্গে একটি কথা উল্লেখ না করলেই নয় যে, এই পরিকল্পনায় জনসাধারণকে বিশেষ করে রাজনৈতিক নেতা এবং কর্মীদের সমাজতান্ত্রিক আদর্শের ধ্যানধারণায় উদ্বুদ্ধ হওয়ার বিষয়ে জোর দেওয়া হয়। আমলাতান্ত্রিকতাকে যথাসম্ভব ঢেলে সাজিয়ে ও সরকারি কর্মচারীদের উদ্বুদ্ধকরণের মাধ্যমে  ওপনিবেশিক শাসনামলের মনােবৃত্তি পরিহার করে সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন করে গড়ে তােলার ওপর পরিকল্পনায় জোর দেওয়া হয়েছিল। প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (১৯৭৩-৭৮) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা কমিশন কর্তৃক ১৯৭৩ সালের নভেম্বর মাসে | প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (১৯৭৩-৭৮) পুস্তকাকারে সরকারের প্ল্যানিং কমিশন থেকে প্রকাশিত প্রথম দলিলগ্রন্থ। পরিকল্পনা কমিশনের চেয়ারম্যান তকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই দলিলগ্রন্থে একটি মূল্যবান ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ভূমিকা দিয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধু ভূমিকায় লিখেছিলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র দেড় বছরের মধ্যে এই (পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণীত হয়েছে। যে কোন দেশের পক্ষে এত অল্প সময়ে পঞ্চবার্ষিকীর মতাে একটি উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন এক অসাধারণ কাজ। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ কথা বিশেষভাবে প্রযােজ্য, কারণ স্বাধীনতালাভের সময় বাংলাদেশে পরিকল্পনা তৈরি করার কোনাে কাঠামাে কিংবা অর্থনীতিবিষয়ক নির্ভরযােগ্য এবং ব্যাপক (comprehensive) তথ্য-উপাত্ত সহজলভ্য ছিল না। কাজেই এই পরিকল্পনায় কিছু অসঙ্গতি (gap) থেকে যেতে পারে। তার পরও আগেভাগে এই পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। কারণ দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে দিকনির্দেশনার অনুভূতি গড়ে তুলতে জরুরি প্রয়ােজনীয়তার কথা এবং উন্নয়নকাজের অগ্রাধিকারভিত্তিক ক্রম নির্ধারণপূর্বক সমন্বিত ধারাবাহিক নীতি ও কার্যক্রম গ্রহণের বিষয়গুলাের প্রতি সরকার গুরুত্ব প্রদান করেছে। বঙ্গবন্ধু আরাে বলেছিলেন যে, দেশের উন্নয়ন পরিকল্পনা যতই সুসমঞ্জস্য করে প্রণয়ন করা হােক না কেন, জনগণ কঠোর পরিশ্রম এবং ত্যাগ স্বীকারে সর্বাত্মকভাবে সহযােগিতা দান না। করলে সেগুলাে বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। সুতরাং জাতি গঠনে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে এবং মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস জাতি যে সাহস ও শক্তি প্রদর্শন করেছিলেন দ্রুপ মনােভাব ও উদ্দীপনা নিয়ে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আত্মনিয়ােগ করতে তিনি সকলের প্রতি আহ্বান জানান।

প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়নে বহু প্রতিকূলতার বিবরণ প্ল্যানিং কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান প্রফেসর নূরুল ইসলামও বর্ণনা করেছেন। প্রফেসর ইসলামের উল্লেখযােগ্য স্বীকারােক্তি হলাে, শত চেষ্টা এবং গভীর আন্তরিকতা সত্ত্বেও কমিশনের ইচ্ছানুযায়ী বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হয়নি। পরিকল্পনা প্রণয়নে সহায়তা করতে বেশ কয়েকটি পর্যবেক্ষণ দল (study group), কারিগরী পরিষদ (Technical committee) গঠিত হয়েছিল। এসব গ্রুপ এবং কমিটি ছাড়াও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, এজেন্সি এবং বেসরকারিপর্যায়ের সংগঠনগুলােও প্ল্যানিং কমিশনকে দিকনির্দেশনা ও পরামর্শ দেয়। পরিকল্পনার বিশেষত্ব তুলে ধরে প্রফেসর নূরুল ইসলাম বলেছিলেন। যে, এতে এমন কিছু উচ্চাশামূলক বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে যেগুলাে বাস্তবায়ন করা সম্ভব। পরিকল্পনার বিশেষত্ব হচ্ছে, এতে সমগ্র বিষয়বস্তুকে দুটি প্রধান অংশে বিভক্ত করা হয়েছে। এর প্রথম অংশে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে পরিকল্পনাকাঠামাে (Framework of the plan) এবং দ্বিতীয় অংশে আছে খাতওয়ারি কর্মসূচি (Scctoral Programme)। প্রথম অংশের মধ্যে রয়েছে (১) পরিকল্পিত উন্নয়নের সামাজিক ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি (Social & Political Perspective of Planned Development); (3) পরিকল্পনার উদ্দেশ্য, আকার এবং লক্ষ্য (Objective, Size & Strategy of the Plan); (৩) পরিকল্পনার রূপরেখা (Structure of the Plan); (৪) পরিকল্পনার জন্য নিজস্ব সম্পদ (Domestic Resources for the Plan); (৫) দায় পরিশােধ সাম্যতা ও বৈদেশিক সাহায্য-সহযােগিতা (Balance (of Payments & External Resources); (৬) উন্নয়নের জন্য শ্রম পরিচালনা (Mobilisation of Labour for Development); (৭) পরিকল্পনা বাস্তবায়ন (Implementation of the Plan) এবং দ্বিতীয় অংশে যেসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে তা হচ্ছে, (৮) কৃষি, পানিসম্পদ ও গ্রামীণ সংগঠনসমূহ (Agriculture, Water Resources & Rural Institutions); (৯) শিল্প (Industry); (১০) পরিবহণ (Transport); (১১) জ্বালানি, প্রাকৃতিক সম্পদ এবং বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি গবেষণা (Power, Natural Resources and Scientific & Technological Research); (১২) ভৌত পরিকল্পনা ও গৃহায়ন (Physical Planning & Housing); (১৩) যােগাযােগ (Communication); (১৪) শিক্ষা ও জনশাক্ত (Education & Manpower); (১৫) স্বাস্থ্য ও সমাজকল্যাণ (Plealth & Social Welfare); (১৬) জনসংখ্যা পরিকল্পনা কর্মসূচি (Population Planning)।  পরিকল্পনার সূচিপত্রভুক্ত বিভিন্ন বিষয় দেখলেই বােঝা যাবে যে, সরকারের দূরদৃষ্টি, আগ্রহ, উদ্যম, নিষ্ঠা, অভিজ্ঞতা, আত্মত্যাগ দেশপ্রেমের নিদর্শন এগুলােতে কত স্পষ্ট ছিল। মুক্তিযুদ্ধে লাখ লাখ মা বােন-ভাইয়ের পবিত্র রক্তের মূল্য ও মর্যাদা দিতেই যেন প্রণীত হয়েছে এই প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা। পুনর্গঠন এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পুনরুদ্ধারের জন্য বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা যত দ্রুত প্রণয়ন করা হয়, তাতে বাংলাদেশ সরকারের দেশপ্রেমের নিদর্শনই | ফুটে উঠেছে। পুনর্গঠন কাজকে দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনাভুক্ত করার যুক্তি পরিকল্পনা প্রণয়নের সময় অক্ষরে অক্ষরে মানা হয়। জাতির জন্য তৎকালে অর্থাৎ যুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় প্রয়ােজন ছিল এমন সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং পরিকল্পনা যার মধ্যে দিক-নির্দেশনা ও অগ্রাধিকারের বিষয়গুলাে সুস্পষ্টভাবে উল্লিখিত থাকবে। পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়নকালে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিশনকে পরিসংখ্যানগত তথ্যাবলি প্রাপ্তি সম্বন্ধে বহুবিধ সীমাবদ্ধতার কথা মনে রাখতে হয়েছিল। এজন্য কমিশন পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়নকালে উল্লেখ করে যে, পরিসংখ্যানগত তথ্যাবলি বার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়নের সময় পরিকল্পনায় সন্নিবেশ করা হবে। 

বাস্তবতাবর্জিত কিংবা অতি উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা প্রণয়নের কোনাে ইচ্ছা অথবা অভিলাষ পরিকল্পনা কমিশনের ছিল না। কমিশন অসম্পাদনযােগ্য কোনাে কর্মসূচি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় ঠাই দেয়নি। বাংলাদেশের যে জনগণকে কমিশন সামনে রেখে পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজে হাত দেয় সে জনগণের বেশির ভাগই অতি নিম্ন আয়ের এবং সর্বক্ষেত্রে তারা বঞ্চনার শিকার ছিল। জনগণের এ অবস্থা ক্রমাগত দ্রুত হারেই বেড়ে যাচ্ছিল। এমন জনগােষ্ঠীর উপযােগী বাস্তবসম্মত উন্নয়ন-পরিকল্পনা প্রণয়নই কমিশনের লক্ষ্য ছিল এবং কমিশন সে পথেই এগিয়ে যায় এবং পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়নে ব্রতী হয়। পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়নকালে কমিশন খুব ভালাে করেই জানতাে যে, দশকের পর দশক অবহেলায় বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ববঙ্গের) অর্থনীতি, ভৌত অবকাঠামাে, বাঙালি জনগণের সামাজিক অবস্থান ইত্যাদি অত্যন্ত নাজুক হয়ে পড়েছিল। সেসব অবস্থা থেকে উত্তরণ এবং জাতীয় পুনর্গঠন ও উন্নয়নের কাজ এত বিপুল প্রয়ােজন হয় যে, তাতে পরিকল্পনাধীন পাঁচ বছর সময় সূচনাপর্ব মাত্র হয়ে দেখা দেয়। অর্থাৎ পুনর্গঠন ও উন্নয়নের ধারার যাত্রা শুরু হবে মাত্র। তবে, কমিশন আশাবাদী ছিল যে, পঞ্চবার্ষিকী। পরিকল্পনার কর্মসূচিকে সঠিকভাবে এগিয়ে নেওয়া হলে উন্নয়নের ও পুনর্গঠনের ভিত সুদৃঢ় হবে। কমিশন যথার্থই অনুধাবন করে যে, বাংলাদেশের মূল সম্পদই হচ্ছে জনবল। সে জন্যই কমিশন সীমাবদ্ধ ও অপ্রতুল কারিগরি এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানকে সামনে রেখে বাংলাদেশের বৃহৎ জনশক্তিকে কাজে লাগানাের সর্বাত্মক কর্মপ্রচেষ্টা গ্রহণ করে। পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় এসব বিষয় তুলে ধরে জাতির সামনে দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। কমিশন বিদেশি সাহায্য-সহযােগিতায় দেশের অর্থনীতি গড়ে তােলার কথা বললেও জনগণকে আত্মনির্ভরশীল করে তুলতে প্রয়ােজনীয় কর্মসূচি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করেছিল। কমিশন এমনভাবে কর্মসূচি প্রণয়ন করে যে, তাতে বৈদেশিক সাহায্যনির্ভরতা ক্রমেই কমিয়ে আনার ব্যবস্থা ছিল।

পরিকল্পনা কমিশনের প্রণীত প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় উন্নয়নপ্রক্রিয়াকে ধীরগতিসম্পন্ন উল্লেখ করে কমিশন কৃচ্ছ্বসাধনের ওপর গুরুত্ব আরােপ করে। বাংলাদেশের নিম জীবনযাত্রায় উন্নয়ন কীভাবে আসবে তা নিয়ে কমিশনের ভাবনার অন্ত ছিল না। কমিশন প্রণীত পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় সব সীমাবদ্ধতাকে সবাই সমানভাবে ভাগ করে নিয়ে এবং আত্মত্যাগের মনােভাবে উদ্বুদ্ধ হয়ে কাজ করার ওপর জোর দেওয়া হয়েছিল। পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রম এবং নীতিমালার বিভিন্ন দিক সুস্পষ্ট করে ব্যক্ত করে সতর্ক করা হয় যে, কারাে ভুল করার বা অপচয় করার অবকাশ নেই। পরিকল্পনায় রাষ্ট্রীয় মূলনীতির প্রতিফলন বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করে। কিন্তু এই স্বাধীনতার জন্য জাতিকে বহু বছর সংগ্রাম করতে হয়েছিল। জাতির এই সংগ্রামের ফসল হচ্ছে বাংলাদেশের সংবিধান। সংবিধানের মূল নীতিগুলির আলােকে কমিশন বাংলাদেশের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়ন করে। বাংলাদেশের রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতিতে যেমন সংবিধানের মূলনীতির প্রতিফলন ঘটে তেমনি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় এসব নীতির আলােকে কর্মসূচি নির্ধারিত হতে দেখা যায়। বঙ্গবন্ধু নিজে কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে পরিকল্পনা প্রণয়নে রাষ্ট্রীয় মূলনীতির প্রতিফলন ঘটানাের পরামর্শ ও নির্দেশ দিয়েছিলেন। উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে, ১৯৭৩ সালে প্রণীত বাংলাদেশের প্রথম পাঁচসালা পরিকল্পনায় সামাজিক ও রাজনৈতিক উন্নয়নের প্রেক্ষাপট বর্ণনাকালে ‘গণতন্ত্র সম্পর্কে ব্যাখ্যায় বাক স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, সভা-সংগঠন-সমাবেশের স্বাধীনতা, জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের কথা বলা হয়েছে। জাতীয়তাবাদ প্রসঙ্গে পরিকল্পনায় বলা হয়েছে যে, বাঙালি জাতির চিন্তা পৃথিবীর অন্য দেশের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের পরিপন্থী হবে না। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে যে, বাঙালি জাতি ধর্ম-বর্ণ-গােত্রের উর্ধ্বে উঠতে জানে, ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার করতে দেওয়া না হলে বাংলাদেশের মাটিতে সাম্প্রদায়িকতার উত্থান কখনাে হবে না। সংবিধানের মূলনীতির অন্যতম নীতি সমাজতন্ত্র প্রসঙ্গে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র একটি লক্ষ্য এবং এই লক্ষ্যে পৌঁছানাের স্বপ্ন বাংলাদেশের জনগণের মনে সাংবিধানিকভাবে যেমন থাকবে, তেমনি দেশের উন্নয়ন-পরিকল্পনায় সমাজতন্ত্রের মূল নীতিমালা অনুসৃত হবে। সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে পৌঁছানাের কণ্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দেওয়া সহজ কাজ নয়। সমাজতান্ত্রিক আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য পৃথিবীর ইতিহাসে অনেক বেদনাদায়ক দৃষ্টান্ত রয়েছে। তা এড়াতে বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের মতাে আরাে কঠোর সংগ্রামের মুখােমুখি হওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। বাঙালি জাতিকে সার্বিকভাবে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে আরাে ত্যাগ স্বীকারের অঙ্গীকার থাকতে হবে। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক দেশ যেসব কৌশল অবলম্বন করে এগিয়ে গেছে বাংলাদেশকেও সে রকম কৌশলই অবলম্বন করতে হবে। দেশের উন্নয়ন পরিকল্পনাও | সেই কৌশলের পটভূমিতে প্রণীত বলে কমিশন স্বীকার করে।

পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়নকালে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশের তকালীন সব  ধরনের পরিস্থিতি বিবেচনায় নেওয়া হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকারের দায়িত্বভার গ্রহণ করে মাত্র এগারাে মাসের মধ্যে বাঙালি জাতির জন্য একটি শ্রেষ্ঠ সংবিধান উপহার দিয়েছিলেন। পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় এই সংবিধানের শােষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার ধারাগুলাে প্রভাব লক্ষণীয় ছিল। সংবিধান অনুসারে ক) শােষক শ্রেণীর কবল থেকে সুযােগ-সুবিধা বঞ্চিত জনমানুষকে মুক্ত করার পরিস্থিতি সৃষ্টি, খ) প্রত্যেক নাগরিকের কাজের সুযােগ প্রদান, গ) সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সকল নাগরিকের সমান অধিকারপ্রাপ্তির সুযােগ, (ঘ) অনর্জিত আয়ের ব্যবহার নিরুৎসাহকরণ এবং ঙ) আইনগতভাবে উৎপাদনব্যবস্থায় ব্যক্তিমালিকানার সীমানা নির্ধারণ ইত্যাদি বিষয়ের প্রতিফলন প্রণীত পরিকল্পনায় থাকবে এমন প্রত্যয় নিয়ে পরিকল্পনার কাজটি সম্পন্ন হয়েছিল। পরিকল্পনা প্রণয়নে মূল লক্ষ্যই ছিল, শােষণমুক্ত কল্যাণমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠন। | পরিকল্পনা অনুযায়ী সমাজতান্ত্রিক সমাজে উত্তরণে যেসব প্রতিবন্ধকতা দেখা দিতে পারে, সেগুলাে দূর করে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শ্রমিক এবং ব্যবস্থাপনার মধ্যে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার ওপর এবং পরিশ্রমের বিষয়ে গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছিল। পরিকল্পনা প্রণয়নকালে এমন গুরুত্ব প্রদানের একটি মাত্র কারণ ছিল, তা হলাে সমাজতান্ত্রিক সমাজে সব পেশাজীবী সামাজিক-অর্থনৈতিক কর্মী তাদের ন্যায্য অংশ পাওয়ার বিষয়ে নিশ্চিত হবে। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রবর্তনের এবং বাস্তবায়নের কাজ সহজ নয়, কঠোর পরিশ্রম, ত্যাগ এবং কৃচ্ছসাধনের মধ্য দিয়ে এমন নীতি প্রতিষ্ঠা করতে হয়। পৃথিবীর সব সমাজতান্ত্রিক দেশের অর্থনীতি গড়ে তুলতে এই নীতির আশ্রয় নিতে হয়েছিল। তাই, বঙ্গবন্ধু প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়নকালে এসব বিষয়ে কমিশনকে যেমন সজাগ ও সতর্ক রেখেছিলেন, তেমনি জনগণের প্রতিও তাঁর এই মনােভাবের কথা ব্যক্ত হয়েছিল প্রণীত পরিকল্পনায়।

পরিকল্পনায় মানুষের চিরাচরিত অভ্যাস ও মূল্যবােধ পরিবর্তনের ওপর গুরুত্ব  আরােপ করা হয়েছিল। সমাজের এই পরিবর্তনসাধনে সরকারের কর্মসূচিই যথেষ্ট নয়, এ জন্য রাজনৈতিক ক্যাডারবাহিনী গড়ে তােলার বিষয়ে পরিকল্পনায় উল্লেখ করা হয়। এই ক্যাডারবাহিনী সাধারণ মানুষের সঙ্গে থেকে সমাজতন্ত্রের মনমানসিকতা তৈরিতে উৎসাহ দিয়ে যাবে। শুধু সরকারি চাকরেদের দিয়ে সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠন প্রচেষ্টা সুফল বয়ে আনবে না, তাই রাজনৈতিক ক্যাডারদের ভূমিকাকেও প্রধান করে তােলার বিষয় পরিকল্পনায় মুখ্য হয়ে ওঠে। ক্যাডারদের পাশাপাশি মন্ত্রী ও নেতৃবৃন্দের আত্মত্যাগ এবং নির্বাহী কর্মকর্তাসহ সবার কাজের সমন্বয়সাধনে সম্পৃক্ত হওয়ার বিষয়ে পরিকল্পনায় জোর দিয়ে বলা হয়েছিল। সমাজতান্ত্রিক ধ্যানধারণা প্রতিষ্ঠায় আমলাতন্ত্রকে উপযুক্তভাবে প্রশিক্ষণ দান, উদ্বুদ্ধকরণও সহায়ক হবে বলে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় উল্লেখ করা হয়। প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় এ কথা স্বীকার করা হয় যে, বাংলাদেশের ভূমির মালিকানা পৃথিবীর অনেক উন্নত সমাজের চেয়ে বেশি সমতাভিত্তিক। গ্রামের হতদরিদ্র মানুষ তাদের শক্তি-সামর্থ সম্পর্কে সচেতন। পরিকল্পনায় আরও উল্লেখ ছিল যে, সরকারি চাকরিতে, আমলাতন্ত্রে এবং উৎপাদনশীল খাতে যে দক্ষ, সমর্থ লােক রয়েছে তাদের উদ্বুদ্ধকরণ ও | প্রশিক্ষণ দিয়ে দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা সম্পাদন করতে দেওয়া হলে তা কার্যকরভাবে সম্পন্ন হবে বলে উন্নয়ন পরিকল্পনায় আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছিল।

প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় এক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ মন্তব্য করে বলা হয়েছিল, মুক্তিযুদ্ধ। যুবসমাজকে সমাজ পরিবর্তনে প্রেরণা জুগিয়েছে। এদের প্রতিভা এবং সামর্থ্যকে উৎপাদনশীল কাজে লাগানাের তাগিদ দিয়ে প্রণীত পরিকল্পনায় বলা হয়েছে যে, এই যুবসমাজ সংঘবদ্ধ এবং এদের ভাষা-ধর্ম-উপজাতীয়তা-বর্ণপ্রথায় ভিন্নতা থাকলেও বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় তা বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। বাংলাদেশের পাঁচসালা পরিকল্পনায় সুস্পষ্টভাবেই ভবিষ্যৎ বাণী করা হয়েছিল যে, পরিকল্পিত পাঁচ বছরের মধ্যে পরিপূর্ণ সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উত্তরণ ঘটানাে অসম্ভব ব্যাপার। তবে মানুষের প্রত্যাশাই লক্ষ্যে পৌছানাের সুকঠিন পথকেও বাধাহীন করতে পারে। দেশের বিদ্যমান সম্পদের সাহায্যে এই প্রত্যাশা মেটানাে অসাধ্য হলেও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সব শক্তি নিয়ােজিত করতে হবে। প্রত্যাশা পূরণে পরিকল্পনায় শ্রমঘন বিনিয়ােগ কৌশল নিয়ােগ করে কর্মের সুযোেগ সম্প্রসারণের এবং অপ্রচলিত ক্ষেত্রে শ্রমশক্তি বিনিয়ােগের তাগিদ দেওয়া হয়েছিল। পরনির্ভরতা হ্রাস করার জন্য পরিকল্পনায় জাতীয়করণ নীতিমালার প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছিল কমিশন।  শোষণ কমিয়ে আনতেও প্রথম পাঁচসালা পরিকল্পনার বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল ক্ষুদ্র চাষী | ও ভূমিহীন মজুরদের সমবায় সমিতি সম্প্রসারণের লক্ষ্যে পরিকল্পিত ব্যবস্থা। পরিকল্পনায় | কমিশন প্রস্তাব করে যে, সরকারি অংশে (Public sector-G) শিল্প খাতে সম্প্রসারণ  এবং ব্যক্তি খাতে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প ছেড়ে দেওয়া সঙ্গত হবে। দেশি-বিদেশি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র এবং সমবায় প্রতিষ্ঠানগুলােকে ক্রমেই শক্তিশালী করে তােলার ওপর পরিকল্পনা। কমিশন গুরুত্ব দিয়ে উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রস্তুত করেছিল। ক্রেতা সাধারণের স্বার্থ সংরক্ষণের দিকনির্দেশনা পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়। বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে গৃহায়ন ক্ষেত্রে রাষ্ট্র এবং সমবায় প্রতিষ্ঠানগুলাের ভূমিকা ব্যাপকতরকরণ, শহুরে সম্পত্তির সর্বোচ্চ পরিমাণ নির্ধারণ এবং ভূমিমালিকদের লাভের সীমারেখা নির্ণীতকরণ। দুর্নীতি প্রসঙ্গ ও সামাজিক চাহিদা পরিকল্পনায় দুর্নীতি প্রসঙ্গে মন্তব্য করা হয় যে, সমাজের প্রতি শ্রদ্ধাবােধের অভাবই মানুষকে দুর্নীতিপরায়ণ করে তােলে। এজন্য দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়ার কথা পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় উল্লেখ করা হয়। একই সঙ্গে দুর্নীতিবাজের সামাজিক বা রাজনৈতিক যে পরিচয়ই হােক না কেন তাকে চিহ্রিত করে শাস্তির ব্যবস্থার কথাও ওই পরিকল্পনায় বলা হয়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা এবং সমাজকল্যাণের ক্ষেত্রে সামাজিক চাহিদার কথা পরিকল্পনায় উল্লেখ করে বলা হয় যে, প্রাতিষ্ঠানিক এবং সাংগঠনিক কাঠামাের আয়তন বিবেচনায় নিয়েই উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়নে কমিশন সজাগ ছিল। বন্যা নিয়ন্ত্রণের বিষয়কে পরিকল্পনায় কৃষি কর্মসূচিভুক্ত করা হয়েছিল। পরিকল্পনায় জনসাধারণের মাথা পিছু আয়ের  বিষয়ে বিশেষ চিন্তা করা হয়। ১৯৭৩ সালে প্রণীত পাঁচসালা পরিকল্পনার শেষে অর্থাৎ ১৯৭৭-৭৮ অর্থবছরের জন্য মাথাপিছু আয় ১৯৬৯-৭০ অর্থবছরের (পাকিস্তান আমলের) মাথাপিছু আয় অপেক্ষা সামান্য বৃদ্ধির পরিকল্পনা করা হয়। এ ছাড়া বাংলাদেশের বাড়তি জনসংখ্যার নিরীখে এবং পাঞ্জাবি সামরিক শাসকদের শােষণ-বঞ্চনার কথা মনে রেখে উন্নয়ন বিনিয়ােগের ক্ষেত্রে কোনাে সুযােগ ছিল না বললেই চলে। এ জন্য, সতর্কতার সঙ্গে কৃষি এবং কৃষিবহির্ভূত ক্ষেত্রে বিনিয়ােগ বৃদ্ধির উপায়গুলি সম্বন্ধে পরিকল্পনায় গুরুত্ব আরােপ করা হয়েছিল। প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় দেশের বহু সংখ্যক বেকার ও অর্ধ। বেকার জনশক্তিকে উৎপাদনশীল কাজে নিয়ােগ করতে পরামর্শ দেওয়া হয়।

বিদেশি ঋণ গ্রহণের চিরাচরিত প্রথা নিরুৎসাহিত করে পরিকল্পনায় মন্তব্য করা হয় যে, সহজ শর্তে পর্যাপ্ত ঋণ পাওয়া যায় না, তবে কঠিন শর্তে যেসব ঋণ পাওয়া যায় তা অতি দ্রুত জনগণের কাধে বােঝা হয়ে দাঁড়ায়। কঠিন শর্তের বেড়াজালে আবদ্ধ ঋণ পরিশােধে সম্পদের ওপর শুধু চাপই সৃষ্টি করে, এতে অর্থনীতিক ক্ষেত্রে সাময়িক উপশম হলেও তা বাংলাদেশের জন্য স্বস্তিকর নয় বলে কমিশন প্রণীত পরিকল্পনায় উল্লেখ করা হয়েছিল। দীর্ঘমেয়াদি ঋণ লাভের দুপ্রাপ্যতা হেতু অধিক মাত্রায় ঋণনির্ভরতা নিরুৎসাহিত করা হয় পরিকল্পনায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও স্বকীয়তার পরিপন্থী ঋণ গ্রহণ না করার সুপারিশ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় করা হয়।

বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা যা বঙ্গবন্ধু সরকারের প্ল্যানিং কমিশন প্রণয়ন করে তা সুবিবেচনাপ্রসূতই ছিল। এই পরিকল্পনা দেশের অর্থনীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল। শ্রমঘন উৎপাদন ক্ষেত্রে খাদ্যশস্য আমদানি হ্রাস এবং রপ্তানি বৃদ্ধির মাধ্যমে আমদানিরফতানি বাণিজ্যে ভারসাম্য আনতে প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থার কথা পরিকল্পনায় উল্লেখ করা হয়। বঙ্গবন্ধুর নিজস্ব চিন্তাচেতনায় অর্থনীতির এই বিষয়টি প্রবলভাবেই ছিল। এ জন্যই সরকারের প্ল্যানিং কমিশন বঙ্গবন্ধুর চিন্তার প্রতিফলন ঘটানাের চেষ্টায় পরিকল্পনায় বিষয়টির গুরুত্ব দিয়েছিল। কৃষি সম্প্রসারণ ও অর্থনীতি পুনরুদ্ধার পরিকল্পনায় কৃষিই প্রধানতম উৎস হিসেবে পরিগণিত হয় এবং পরিকল্পিত বছরগুলিতে আয় ও কর্মসৃষ্টির পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন ও সঞ্চয়ের দিকে লক্ষ রাখতে বলা হয়। এ কথা সত্য যে, কৃষি সম্প্রসারণ ঘটলে খাদ্য আমদানির পরিমাণ ও নির্ভরতা কমবে। আর তাতে, অর্থনীতির অন্যান্য খাতে কাঁচামাল সরবরাহে এবং কর্মের সুযােগ সৃষ্টিতে সহায়ক ও কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে পরিকল্পনায় আশা করা হয়।  প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় উল্লেখযােগ্য সম্ভাবনার দিক প্রকৃতপক্ষে কৃষি উন্নয়নব্যবস্থাকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছিল। পরিকল্পনার মূল বিষয়ই হচ্ছে সম্ভাবনার সাফল্য কীভাবে আসবে তা দেখা। কমিশন সেই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সমগ্র পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার ছক তৈরি করেছিল। তার মধ্যে কৃষিক্ষেত্রকে কমিশন অগ্রাধিকার দেয়। কারণ, কৃষিক্ষেত্রের জোগান (input) যেমন সার, কীটনাশক, বীজসহ মজুরি ও মুনাফার দ্রুত বৃদ্ধি ঘটার সম্ভাবনা থাকায় কৃষি থেকে প্রাপ্ত ফলও দ্রুত হবে। এতে নির্মাণ খাত অধিক পরিমাণ প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে। পরিকল্পনায় নির্মাণনির্ভর খাতে দুই-তৃতীয়াংশের বেশি ব্যয় প্রাক্কলনের বিষয় চিন্তাপ্রসূত ছিল। আরাে কিছু খাতের তীব্র প্রয়ােজনীয়তার কথা ভেবে বিদ্যুৎ এবং গ্যাস খাতে বেশি পরিমাণ পুঁজি দিয়ে এসব খাতের উন্নয়নের প্রয়ােজনীয়তা কমিশন খুবই গুরুত্বের সাথে দেখে এবং এগুলাের যথেষ্ট সম্প্রসারণ হওয়া উচিত বলে মনে করে। পরিকল্পনা প্রণয়নকালে কমিশন লক্ষ করেছিল যে, ২৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে গৃহনির্মাণের প্রবৃদ্ধি বার্ষিক মাত্র ১ শতাংশে স্থির রয়েছে। এই প্রবৃদ্ধিকে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় ৪ গুণ বৃদ্ধি করার প্রস্তাব করা হয়েছিল।

যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের ঐকান্তিক চেষ্টা ছিল বঙ্গবন্ধু সরকারের প্ল্যানিং কমিশনের। তাই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানাের জন্য কমিশন তাদের প্রণীত পরিকল্পনায় যে ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন তার চিত্র দেওয়া যায় এভাবে। অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রশ্নে ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরের বাস্তব অর্থনৈতিক অবস্থার রূপ বিবেচনায় রেখে কমিশন সামগ্রিকভাবে বিষয়গুলাে পর্যালােচনা করে। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরের জিডিপি হ্রাসের কিছু কারণ ছিল। ১৯৭০ সালের সাইক্লোন এবং এবং যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশে ১৯৭২ সালের ভয়াবহ খরা এই কারণের অন্যতম। এসব কারণের কথা উল্লেখ করে পরিকল্পনায় বিশেষ ব্যবস্থার নির্দেশনা দেওয়া হয়। | নির্মাণশিল্পের উৎপাদন কমে যাওয়ায় এই খাত পুনরুদ্ধারের জন্য পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় বিশেষ জোর দেওয়া হয়। এ জন্য যেসব পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়ােজনীয়তার কথা পরিকল্পনায় উল্লেখ করা হয় সেগুলাে হচ্ছে (ক) ব্যবস্থাপনা এবং প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামাের উন্নয়ন (খ) দেশীয় ও বৈদেশিক বাণিজ্য সম্পর্কের সঙ্গে মূল্য এবং বিনিময়। হারের সামঞ্জস্যবিধান (গ) কাঁচামালের সরবরাহ নিয়মিতকরণ এবং পরিমাণ চাহিদানুপাতে নিশ্চিতকরণ (ঘ) ব্যবস্থাপনা এবং শ্রমিকের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা এবং (ঙ) কর্মচারী ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে উৎসাহজনক সুযােগ-সুবিধা বৃদ্ধি। বেকারত্ব দূরীকরণ, নিম মজুরির কর্মক্ষেত্রকে উন্নতকরণের নিমিত্ত নতুন নতুন কর্মক্ষেত্র সৃষ্টির প্রয়াসের কথা পরিকল্পনায় ছিল। সমগ্র পরিকল্পনায় শ্রমঘন এবং চিরন্তন পদ্ধতির ক্ষুদ্র খাতের উপর গুরুত্ব আরােপ করা হয়। হস্তচালিত তাঁতের প্রসার ঘটানাের প্রস্তাবও পরিকল্পনায় নেওয়া হয়। ধাতব পণ্য, চামড়া পণ্যের ক্ষুদ্র শিল্পকেও উৎসাহ ও সহযােগিতা দানের বিষয়টিও পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত ছিল । বিদ্যুৎ ও পরিবহণ খাতের উপর সার্বিক প্রবৃদ্ধি নির্ভরশীল উল্লেখ করে পরিকল্পনায় বলা হয় যে, এ দুটি খাত পুঁজিঘন বিনিয়ােগ হলেও এই খাত দুটিকে অর্থনৈতিক ভারসাম্য অবস্থায় বৃদ্ধির সুযােগ দেওয়া উচিত হবে। | বাংলাদেশের গ্রামীণ এলাকায় অতীতে যেসব উন্নয়ন কর্মসূচি পরিচালিত হয়েছিল তাতে গরিবদের তুলনায় ধনী কৃষক শ্রেণীকেই লাভবান করেছিল।

সামাজিক এই বৈষম্য দূরীকরণে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় প্রস্তাব রেখে বলা হয় যে, সরকারকেই অর্থনৈতিক ও সামাজিক নীতি প্রণয়ন করে ধনী-দরিদ্রের এই বৈষম্য দূর করতে হবে। পরিকল্পনার এই প্রস্তাব অনুযায়ী প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছিল। অনুপার্জিত আয় এবং উচ্চ আয়ের ওপর রাজস্ব নির্ধারণ করার তাগিদ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় দেওয়া হয় এবং সরকারকে তা অবিলম্বে কার্যকর করার পরামর্শ দেওয়া হয়। দরিদ্র মানুষদের ন্যূনতম মূল্যে অপরিহার্য দ্রব্য, যেমন গৃহনির্মাণ সামগ্রী, কম দামের কাপড় ইত্যাদি দেওয়ার ওপর পরিকল্পনায় গুরুত্ব দেওয়া হয়। ভােগ্যপণ্য আমদানির বিকল্প দ্রব্যসামগ্রী এবং নির্ধারিত কয়েকটি রপ্তানি দ্রব্য উৎপাদনের ওপরও পরিকল্পনায় জোর দেওয়া হয়। পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় জনসংখ্যা বৃদ্ধি অপেক্ষা দ্রুত সময়ে গৃহায়ন পরিকল্পনা গ্রহণের পক্ষে অভিমত দেওয়া হয় । সামাজিক ভােগের (Social consumption-Gi) আওতায় স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ক্ষেত্রে দ্রুত উন্নয়নের ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রস্তাব করে হাসপাতালের বেডের সংখ্যা ৮০% বৃদ্ধি করার কথা পরিকল্পনায় বলা হয়। বঙ্গবন্ধুর সরকার কর্তৃক প্রণীত প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় যে বিষয়টি স্পষ্টভাবে বলা হয় তা হলাে, পরিকল্পিত পাঁচ বছরে মানুষের সকল প্রত্যশা বিদ্যমান। সম্পদের সাহায্যে মিটানাে কোনােভাবেই সম্ভব হবে না। তাই এই পরিকল্পনায় এ বিষয়ে বলা হয় যে, পরিকল্পনাকাল শেষে অর্থাৎ ১৯৭৭-৭৮ সালেও গড় ভােগ দেশের দারিদ্র অবস্থার বিশেষ পরিবর্তন করতে পারবে না। তবে, যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে পরিকল্পিত কর্মসূচি গুণগত পরিবর্তনের সূচনাই করবে। ধীরে ধীরে এই অবস্থা বাংলাদেশের সামাজিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের বুনিয়াদ গড়ে তুলবে। দেশের অভ্যন্তরীণ সম্পদের সীমাবদ্ধতার কারণে উচ্চতর ভােগ অর্জনের জন্য পরিকল্পনার মেয়াদের শেষ দিকে বৈদেশিক ঋণের ওপর নির্ভরশীলতা সামান্য বৃদ্ধি করার ব্যবস্থা পরিকল্পনায় রাখা হয়।

বঙ্গবন্ধুর সরকার প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় কয়েক ক্ষেত্রে রফতানির মাত্রা বৃদ্ধি করে প্রবৃদ্ধি উন্নততর করার চেষ্টা করেছিল। যেসব ক্ষেত্রে এই প্রস্তাব প্রয়ােগের জন্য নির্ধারণ করা হয় সেগুলাে হলাে- কাঁচা পাট, চামড়াজাত দ্রব্যসামগ্রী, চা, কাঁচা তুলা ইত্যাদি। গম, তুলা প্রতি বছর কম উৎপন্ন হয় বলে এ দুই ক্ষেত্রে উচ্চ প্রবৃদ্ধির হার পরিকল্পনায় প্রাক্কলিত হয়। অবকাঠামােগত ক্ষেত্র, যেমন ডাক ও টেলিফোন, এবং সড়ক পরিবহণ খাতে জিডিপির চেয়ে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে এবং রেলওয়ে খাতে কমবে এমন ধারণা পরিকল্পনায় প্রকাশ করা হয়েছিল। তবে পরিবহণ খাতে বৈপ্লবিক উন্নয়নের সম্ভাবনার বিশ্বাস থেকে পরিকল্পনা কমিশন এই খাতের উল্লেখযােগ্য উন্নয়নের ব্যবস্থা নিতে পরামর্শ দেয়। পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাকালে অতীতের কিছু তথ্য, যেমন ১৯৬৯-৭০ সালের সঙ্গে ১৯৭২-৭৩ সালের ধান উৎপাদনের মাত্রা এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির মাত্রার তুলনামূলক চিত্র বিবেচনায় নেয় কমিশন। জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং ধান উৎপাদনের মাত্রায় পার্থক্যহেতু দেশে বিপুল খাদ্য ঘাটতি ছিল। খাদ্যশস্য আমদানি করেও এই ঘাটতি মেটানাে সম্ভব হয়নি। দেখতে পায় কমিশন। একই সময়কালের প্রেক্ষাপটে পাটশিল্পের সুতা উৎপাদন, কাপড় উৎপাদন, চিনি উৎপাদন ইত্যাদি ক্ষেত্রে উন্নয়ন হ্রাস পায়। তবে, ওই সময়ে ইস্পাত, সার এবং জাহাজ নির্মাণ খাতের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। ক্ষতিগ্রস্ত সেতু ও যােগাযােগব্যবস্থার কারণে দ্রব্য পরিবহণ ব্যাপকভাবে কমে গিয়েছিল। এসব বিষয় প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়নকালে কমিশন বিবেচনায় নিয়েছিল। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত টাকার সরবরাহ ৮৩ শতাংশ বৃদ্ধি করা এবং ১৯৭৭-৭৮ সালে টাকার মূল্যমান। ১৯৭৩ সালের মূল্যমানের চেয়ে কিছু নিচে রাখতে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় রেশনসপ এবং ন্যায্যমূল্যের দোকানগুলােয় পর্যাপ্ত পণ্য সরবরাহের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল এবং সরকার কর্তৃক কৃষকের কাছে থেকে তাদের উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্য ক্রয় এবং ঘাটতি এলাকায় তা বিতরণের ব্যবস্থা করার বিষয়েও বলা হয়েছিল। মেহনী মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে গ্রাম সমবায় আন্দোলন গ্রামে বসবাসকারী মানুষের বিশেষ করে মেহনতী মানুষের ভাগ্যের উন্নয়নের চিন্তা বঙ্গবন্ধুর মধ্যে প্রবলভাবে ছিল। এ জন্য তিনি পরিকল্পনা কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে কমিশনের সব সদস্যকে তার সেই চিন্তার আলােকে পরিকল্পনা প্রণয়নের পরামর্শ দেন। ফলে দেখা যায়, পরিকল্পনায় ভূমি সংস্কার ও গ্রামে সমবায় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে কৃষক-জনতার স্বার্থে গ্রাম-সমবায় এবং কৃষি উন্নয়নের বিষয় স্থান পেয়েছিল। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান ভিত্তিই হচ্ছে কৃষি। এ দেশের রাজনীতি, সমাজনীতিতেও কৃষির অবদান যুগ যুগ ধরে বিদ্যমান। কৃষির ব্যাপক ভূমিকা যাতে অক্ষুন্ন থাকে, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পরিকল্পনা কমিশনের সতর্ক দৃষ্টি সেদিকে ছিল। যৌথ চাষাবাদের ব্যবস্থায় গ্রাম সমবায় প্রকল্পের বিষয়টি পরিকল্পনায় গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল।  গ্রামীণ উন্নয়ন চিন্তার বিভিন্ন দিক, যেমন গ্রাম সমবায়ের লক্ষ্য, সাংগঠনিক তৎপরতা, চাষাবাদের ব্যবস্থাপনা, ফসলের বণ্টনব্যবস্থা ইত্যাদি নিয়ে পরিকল্পনার সংশ্লিষ্ট অংশে  বিকৃতভাবে বলা হয়। আবার এই প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নেতৃবৃন্দ, কর্মকর্তা, ব্যবস্থাপক, কর্মী প্রমুখের প্রশিক্ষণ ও আদর্শে উদ্বুদ্ধকরণ ইত্যাদির বিষয়ও পরিকল্পনার এই অংশে বিধৃত হয়েছে। দেশের অর্থনীতি, সমাজনীতি, রাজনীতিতে এই বিশেষ গ্রাম-প্রকল্পের কী কী প্রভাব পড়বে তার প্রতিচিত্রও পরিকল্পনার ব্যাখ্যায় দেওয়া হয়েছিল। উৎপাদন বৃদ্ধি, সুষম বণ্টন, কর্মসংস্থান ও গ্রামের উন্নয়নকে সামনে রেখে গ্রাম-উন্নয়নের প্রকল্প। পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। গ্রামের মানুষজনকে স্বাবলম্বী ও স্বয়ম্ভর করে। গ্রাম উন্নয়নমুখী শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ এবং গ্রামের ভৌত ও সামাজিক অবকাঠামাে গড়াই এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্য ছিল। সমবায়পদ্ধতিকে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় বিশেষ গ্রাম-প্রকল্পের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে ধরা হয়। একটি গ্রাম-সমবায় সমিতি গঠনের জন্য পরিকল্পনায় ২৯৯ একর থেকে ৫০০ একর পর্যন্ত ভূমি নেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছিল। প্রত্যেক সমিতির ব্যবস্থাপনা পর্ষদে আবাদী জমির মালিকদের ১২ জন প্রতিনিধি, ভূমিহীন খেতমজুরদের ৬ জন এবং ৩ জন মনােনীত কিংবা নিযুক্ত সদস্য অন্তর্ভুক্ত করার ব্যবস্থার কথা পরিকল্পনায় বলা হয়েছিল। প্রত্যেক ব্যবস্থাপনা পর্ষদের অধীনে উপপর্ষদ রাখার সিদ্ধান্ত হয় চারটি। গ্রামে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা, জমি সংক্রান্ত বিরোেধ মীমাংসার জন্য উপপর্ষদকে দায়িত্ব প্রদান করা হবে বলা হয়। ব্যবস্থাপনা পর্ষদের অধীনে কর্মক্ষেত্রভিত্তিক কিছু কর্মীসংঘও গড়ে তােলার বিষয়ে সার্বিক পরিকল্পনার এই অংশে বিবৃত ছিল।

পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় একটি চমক্কার বিষয় উল্লিখিত হয়েছিল। ফসল কাটার সময় মাঠেই কিংবা তার অব্যবহিত পরে উৎপাদিত ফসলের শতকরা ৩৩ ভাগ জমির মালিকগণকে এবং শতকরা ৬৭ ভাগ সমিতির অংশ হিসেবে গণ্য হবে। সমিতির অংশ থেকে আবার ৭০% চাষাবাদ, উপকরণ সরবরাহ এবং অন্য খরচাদির জন্য, ৭% সমিতির  পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় রেশনসপ এবং ন্যায্যমূল্যের দোকানগুলােয় পর্যাপ্ত পণ্য সরবরাহের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল এবং সরকার কর্তৃক কৃষকের কাছে থেকে তাদের উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্য ক্রয় এবং ঘাটতি এলাকায় তা বিতরণের ব্যবস্থা করার বিষয়েও বলা হয়েছিল। মেহনী মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে গ্রাম সমবায় আন্দোলন গ্রামে বসবাসকারী মানুষের বিশেষ করে মেহনতী মানুষের ভাগ্যের উন্নয়নের চিন্তা বঙ্গবন্ধুর মধ্যে প্রবলভাবে ছিল। এ জন্য তিনি পরিকল্পনা কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে কমিশনের সব সদস্যকে তার সেই চিন্তার আলােকে পরিকল্পনা প্রণয়নের পরামর্শ দেন। ফলে দেখা যায়, পরিকল্পনায় ভূমি সংস্কার ও গ্রামে সমবায় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে কৃষক-জনতার স্বার্থে গ্রাম-সমবায় এবং কৃষি উন্নয়নের বিষয় স্থান পেয়েছিল। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান ভিত্তিই হচ্ছে কৃষি। এ দেশের রাজনীতি, সমাজনীতিতেও কৃষির অবদান যুগ যুগ ধরে বিদ্যমান। কৃষির ব্যাপক ভূমিকা যাতে অক্ষুন্ন থাকে, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পরিকল্পনা কমিশনের সতর্ক দৃষ্টি সেদিকে ছিল। যৌথ চাষাবাদের ব্যবস্থায় গ্রাম সমবায় প্রকল্পের বিষয়টি পরিকল্পনায় গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। গ্রামীণ উন্নয়ন চিন্তার বিভিন্ন দিক, যেমন গ্রাম সমবায়ের লক্ষ্য, সাংগঠনিক তৎপরতা, চাষাবাদের ব্যবস্থাপনা, ফসলের বণ্টনব্যবস্থা ইত্যাদি নিয়ে পরিকল্পনার সংশ্লিষ্ট অংশে | বিকৃতভাবে বলা হয়। আবার এই প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নেতৃবৃন্দ, কর্মকর্তা, ব্যবস্থাপক, কর্মী প্রমুখের প্রশিক্ষণ ও আদর্শে উদ্বুদ্ধকরণ ইত্যাদির বিষয়ও পরিকল্পনার এই অংশে বিধৃত হয়েছে।

দেশের অর্থনীতি, সমাজনীতি, রাজনীতিতে এই বিশেষ গ্রাম-প্রকল্পের কী কী প্রভাব পড়বে তার প্রতিচিত্রও পরিকল্পনার ব্যাখ্যায় দেওয়া হয়েছিল। উৎপাদন বৃদ্ধি, সুষম বণ্টন, কর্মসংস্থান ও গ্রামের উন্নয়নকে সামনে রেখে গ্রাম-উন্নয়নের প্রকল্প। পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। গ্রামের মানুষজনকে স্বাবলম্বী ও স্বয়ম্ভর করে। গ্রাম উন্নয়নমুখী শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ এবং গ্রামের ভৌত ও সামাজিক অবকাঠামাে গড়াই এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্য ছিল। সমবায়পদ্ধতিকে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় বিশেষ গ্রাম-প্রকল্পের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে ধরা হয়। একটি গ্রাম-সমবায় সমিতি গঠনের জন্য পরিকল্পনায় ২৯৯ একর থেকে ৫০০ একর পর্যন্ত ভূমি নেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছিল। প্রত্যেক সমিতির ব্যবস্থাপনা পর্ষদে আবাদী জমির মালিকদের ১২ জন প্রতিনিধি, ভূমিহীন খেতমজুরদের ৬ জন এবং ৩ জন মনােনীত কিংবা নিযুক্ত সদস্য অন্তর্ভুক্ত করার ব্যবস্থার কথা পরিকল্পনায় বলা হয়েছিল। প্রত্যেক ব্যবস্থাপনা পর্ষদের অধীনে উপপর্ষদ রাখার সিদ্ধান্ত হয় চারটি। গ্রামে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা, জমি সংক্রান্ত বিরোেধ মীমাংসার জন্য উপপর্ষদকে দায়িত্ব প্রদান করা হবে বলা হয়। ব্যবস্থাপনা পর্ষদের অধীনে কর্মক্ষেত্রভিত্তিক কিছু কর্মীসংঘও গড়ে তােলার বিষয়ে সার্বিক পরিকল্পনার এই অংশে বিবৃত ছিল।

পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় একটি চমক্কার বিষয় উল্লিখিত হয়েছিল। ফসল কাটার সময় মাঠেই কিংবা তার অব্যবহিত পরে উৎপাদিত ফসলের শতকরা ৩৩ ভাগ জমির মালিকগণকে এবং শতকরা ৬৭ ভাগ সমিতির অংশ হিসেবে গণ্য হবে। সমিতির অংশ থেকে আবার ৭০% চাষাবাদ, উপকরণ সরবরাহ এবং অন্য খরচাদির জন্য, ৭% সমিতির ব্যবস্থাপনা ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যয় মেটানাের জন্য, ১০% সমিতির মূলধন তহবিলের জন্য, ১% কর ও খাজনা বাবদ সরকারকে দেওয়ার জন্য, ৫% সমিতির কল্যাণ তহবিলের জন্য বিভক্ত করে দেওয়া হবে এবং যথাযথ ব্যবস্থায় তা বণ্টিত হবে কিংবা এগুলাের হিসাব সংরক্ষিত হবে। মূলধন তহবিলের অর্থ গ্রামে স্থায়ী উন্নয়নমূলক কাজ, সদস্যদের। লভ্যাংশ প্রদান এবং ব্যবস্থাপনায় নিয়ােজিত কর্মচারী কর্মকর্তাগণকে পারিশ্রমিক বাবদ দেয়া হবে। এই বরাদ্দ বা বণ্টনব্যবস্থারও শতকরা অংশে একটি হিসাব করে দেওয়া হয়েছিল। পরিকল্পনায় উল্লেখিত বণ্টন-ব্যবস্থায় প্রত্যেকের বিশেষত দুর্বল শ্রেণীর স্বার্থ। সংরক্ষণের নিশ্চয়তা ছিল। এই ব্যবস্থায় মেধা পুরস্কারের বিধান রেখে কর্মীদের উৎসাহিত করার সুযােগ ছিল এবং কল্যাণ তহবিলের মাধ্যমে দুস্থ অক্ষম, জীবিকাহীন ব্যক্তিদের প্রতিপালনের ব্যবস্থা সংরক্ষিত থাকবে এমন নিশ্চয়তা এতে ছিল। বিশেষ গ্রাম-প্রকল্প সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প ছিল। পরিকল্পনা প্রণয়নকালে এই প্রকল্পকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। এই কাঠামােকে গণমুখী করার কথা পরিকল্পনায় উল্লেখ করা হয়। বিশেষ গ্রাম সমবায় ব্যুরাে” নামে একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করে তার একজন প্রধান পরিচালক, তার অধীনে ৪ জন পরিচালক, ৪ জন উপপরিচালক এবং ১৪ জন সহপরিচালক থাকবেন। গ্রাম সমবায় প্রকল্প প্রকৃতপক্ষে একটি আন্দোলন। গােষ্ঠী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে এই আন্দোলনকে সফল করার কথা বঙ্গবন্ধুর চিন্তা বলে পরিকল্পনায় উল্লেখ করা হয়। বিশেষ গ্রাম সমবায় প্রকল্পের জন্য প্রাথমিক অর্থায়নের ব্যবস্থা হয়েছিল। সমবায় সম্পর্কিত প্রশিক্ষণ প্রচার, পরীক্ষা ইত্যাদির জন্য ৭৫ লাখ, জাতীয় সমবায় ব্যুরাের জন্য ৩০ লাখ এবং গ্রাম সমিতির সংরক্ষিত তহবিলে ১ কোটি টাকা রাখার বিধান রাখার জন্য পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় বলা হয়েছিল।

পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় কমিশন যে রূপরেখা দেয় তাতে বাংলাদেশে উৎপাদনমুখী রাজনৈতিক তৎপরতা এবং সৃষ্টিশীল রাজনৈতিক সমন্বয় ও সংহতি তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা নিহিত ছিল। সারা দেশে গণমুখী ও উৎপাদনমুখী রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি এবং ক্রমেই দেশের গ্রাম-সমবায়ে লাখ লাখ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, সুশৃঙ্খল ও আত্মনির্ভরশীল কর্মী তৈরি হবে এমন প্রত্যাশা ছিল পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার অন্তর্গত এই প্রকল্পে। সমাজজীবনে সমবায়ব্যবস্থা যুগান্তকারী পরিবর্তনের ধারা সৃষ্টি করলে সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসের পার্থক্য কমে আসবে, দুর্বলের ওপর সবলের নির্যাতনের সুযােগ হ্রাস পাবে এবং পশ্চাৎপদ গগাষ্ঠীদের কল্যাণ নিশ্চিত হবে এমন আশার কথা পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় প্রতিফলিত হয়। দেশের চাহিদা মিটিয়েও প্রায় ১০০ লাখ টন চালের উদ্বৃত্ত ধরা হয় পরিকল্পনাভুক্ত ফসল উৎপাদন ক্ষেত্রে। এতে জাতীয় আয় সমানুপাতে বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনার কথা পরিকল্পনায় উল্লেখ করে বলা হয়েছিল যে, বৈদেশিক মুদ্রায় সঞ্চয়ের পরিমাণ যা দাঁড়াত তাতে এবং বাড়তি ফসল উৎপাদনের ফলে দেশের খাদ্য ঘাটতি মিটে গেলে দেশে বিদ্যমান। বিভিন্ন অসুবিধা দূর হতাে। যে রূপরেখার ভিত্তিতে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণীত হয়েছিল তাতে বাংলাদেশে উৎপাদনমুখী রাজনৈতিক তৎপরতা সৃষ্টির আশা করা হয়। গ্রামসমবায় ব্যবস্থায় রাজনৈতিক নেতাকর্মী এবং জনগণের মধ্যে একাত্মতা সৃষ্টির মধ্য দিয়ে ৫ গােষ্ঠীচেতনাও জাগ্রত হবে। এই চেতনায় উদ্বুদ্ধ হওয়ার ফলে সারা বাংলাদেশে গণমুখী ও উৎপাদনমুখী রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি হওয়া ছাড়াও ক্রমেই দেশের গ্রাম-সমবায়ে তৈরি হবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, সুশৃঙ্খল, আত্মনির্ভরশীল কর্মীদল। প্রশাসনের গণমুখিতাও বৃদ্ধি পাওয়ার সুযােগ এতে ছিল, জটিলতাও কমত। এমন প্রত্যাশাই ব্যক্ত হয়েছিল বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় । গ্রামীণ অবকাঠামাে তথা কৃষকসমাজের উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর চিন্তাচেতনার প্রতিফলন ছিল পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায়। এরই সঙ্গে শ্রমিকশ্রেণীর ভূমিকা নিয়েও বঙ্গবন্ধুর চিন্তা ছিল পরিষ্কার। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি গড়ে তুলতে শ্রমিকদের ভূমিকাকে তিনি গুরুত্ব দিতেন। তাই তিনি পুঁজিপতি প্রভুদের ভােগের জন্য সম্পদ উৎপাদন না করার দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে শ্রমিকদের পরামর্শ দিয়েছিলেন। কারণ, তিনি মনে করতেন, “যা উৎপাদন হয় তা শ্রমিক-কৃষক এবং বাংলাদেশের সকল মানুষের কল্যাণের জন্য।” এ বিশ্বাস থেকে বঙ্গবন্ধু সরকারের সঙ্গে শ্রমজীবীদের নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলতে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় সমাজতান্ত্রিক শৃঙ্খলা এবং সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার পরিবেশ সৃষ্টির উপযােগী ব্যবস্থার বিধান রাখতে কমিশনকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। এর ফলে রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পরিচালনায় শ্রমিকদের অংশগ্রহণের বিষয়ে একটি স্কিম প্রণয়নের প্রয়ােজনীয়তার কথা পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় স্থান পেয়েছিল ।

বাংলাদেশের মতাে একটি ঘনবসতিপূর্ণ এবং সম্পদ অপ্রতুল দেশে সর্বস্তরের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি ও সাম্য নিশ্চিত করার জন্য বৃহত্তর উৎপাদন উপাদানের সামাজিকীকরণ ছাড়া কোনাে পথ নেই, এমন চিন্তা বঙ্গবন্ধুর মনে দৃঢ়মূল ছিল। তার পরিপ্রেক্ষিতে কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে বঙ্গবন্ধু প্ল্যানিং কমিশনকে পরিকল্পনা প্রণয়নের ধারণা দিয়েছিলেন বলে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা বাংলাদেশের জন্য সম্ভাবনাময় পরিকল্পনা হিসেবে পরিগণিত। যেহেতু এই পরিকল্পনার বৈশিষ্ট্য মধ্যমেয়াদি দিকদর্শনের প্রেক্ষিতে করার কথা ছিল, সেহেতু এই প্ল্যানিং কমিশনে দেশের বরেণ্য অর্থনীতিবিদ, বিশেষজ্ঞবৃন্দ এবং মেধাবী কর্মকর্তা-কর্মী দল সেভাবেই একে প্রণয়ন করেছিলেন। বাংলাদেশের প্রথম অর্থনৈতিক দলিল বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন যেমন ছিল এক ঐতিহাসিক ঘটনা, তেমনি প্রথম পঞ্চবার্ষিকী। প্রণয়নও হয়ে ওঠে আপন মহিমায় উজ্জ্বল। এটিই বাংলাদেশের প্রথম অর্থনৈতিক দলিল।  এ দলিলে শুধু অর্থনীতির বিষয়বস্তুই তুলে ধরা হয়নি, এতে নিঃস্বার্থ রাজনৈতিক অঙ্গীকার,  প্রক্রিয়া এবং প্রয়ােজনীয় প্রশাসনযন্ত্রের বিশদ ধারণা সরকারকে দেওয়া হয়। পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সরকার যাতে কোনাে অস্বস্তিতে না পড়ে সে জন্যই পরিকল্পনায় যাবতীয়। বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু, বঙ্গবন্ধুর সরকারকে এই ঐতিহাসিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পূর্ণ সুযােগ দেওয়া হয়নি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট দেশীয় স্বার্থবাদী গােষ্ঠীর চক্রান্ত, আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র এবং প্রশাসনযন্ত্রের দুর্নীতিবাজেরা পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজে হাত দেয়ার একপর্যায়ে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে অগণতান্ত্রিক অবৈধ সরকার প্রতিষ্ঠা করে এদেশকে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য এবং আদর্শ থেকে বিচ্যুত করা হয়।

সূত্র : বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১-৭৫ এইচ টি ইমাম