আধুনিক সার্বভৌম জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠা
ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি প্রায় কুড়ি লাখ মানুষের এক সমাবেশে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের আওয়ামী লীগ-দলীয় নবনির্বাচিত সদস্যগণ জনগণের সামনে শপথ নিয়ে সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। কারণ জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণের আগে জনগণের সামনে শপথ নেওয়ার এমন দৃষ্টান্ত আর নেই। এতে জনগণের সঙ্গে গভীর সম্পৃক্ততার প্রমাণই দিয়েছিলেন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিবৃন্দ। এই শপথ অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণও প্রণিধানযােগ্য। তিনি দেশ ও জনগণের মুক্তির লক্ষ্যে নীতিগত বক্তব্য প্রদান করে বলেছিলেন : আওয়ামী লীগ সরকার যদি গঠন করা হয় তবে দেশে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি গ্রহণ করা হবে। ধনীকে আরাে ধনী এবং গরিবকে আরাে গরিব হতে দেওয়া হবে। আমি পুনর্ব্যক্ত করছি, যে যাই বলুক না কেন, ব্যাংক, বীমা ও পাট ব্যবসা জাতীয়করণ করা হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা হবে এবং কল-কারখানার শেয়ার শ্রমিকদের মধ্যে বিতরণ করা হবে। (দৈনিক পাকিস্তান, ৪ জানুয়ারি১৯৭১) বঙ্গবন্ধুর সরকারপদ্ধতি স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘােষণায় বাংলাদেশ সরকার-পদ্ধতি সম্পর্কে একটি ধারণা সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। এই গ্রন্থের প্রশাসনিক কাঠামাে পুনর্বিন্যাস’ শীর্ষক অধ্যায়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-ঘােষণা সনদের বিবরণ দেওয়া হয়েছে। এই সনদে বলা হয়েছিল, সংবিধান প্রণীত হওয়ার সময় পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট থাকবেন এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকবেন। দুটি পদের ক্ষমতা সম্পর্কেও দিকনির্দেশনা ছিল। বাংলাদেশের সরকারপদ্ধতি কেমন হবে সে সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়টি পাকিস্তানের কারান্তরাল থেকে বঙ্গবন্ধু ফিরে এসে শত্রুমুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন পর্যন্ত অপেক্ষাধীন রাখা হয়।
পরিষদের ১১-দফাভিত্তিক শাসনতন্ত্র প্রণয়নের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। ৬-দফা এবং ১১-দফায় সংসদীয় গণতন্ত্রের দাবিই মুখ্য ছিল। এ প্রেক্ষাপটে কারােই এমনকি পাকিস্তানি শাসকবৃন্দেরও বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে, বাংলাদেশ সরকার গঠনে বঙ্গবন্ধু কোন্ পদ্ধতির সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করবেন। স্বাধীন বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের পথই অনুসৃত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর অন্যতম সহযােগী ড. কামাল হােসেনের স্মৃতিচারণ লক্ষ করলে বােঝা। যাবে যে, বাংলাদেশের সরকারপদ্ধতি নির্ধারণে বঙ্গবন্ধু কোন্ পথ বেছে নিয়েছিলেন। ড. কামাল হােসেন তার স্মৃতিকথার এক জায়গায় লিখেছেন : মধ্যেই আমার ডাক পড়লাে হেয়ার রােডে। সেখানে মন্ত্রিসভার বৈঠক হচ্ছে। শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থা হিসেবে পার্লামেন্টারি পদ্ধতি তথা মন্ত্রিসভা শাসিত। সরকার হবে তা ঠিক হয়ে গেছে ইতােমধ্যে। আবু সাঈদ চৌধুরী, আমীর-উল। ইসলাম ও আমার ওপর দায়িত্ব পড়লাে নতুন শাসনতান্ত্রিক অধ্যাদেশের একটি ড্রাফট করে দেওয়ার। তাৎক্ষণিকভাবে ১১ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতির সাময়িক সংবিধান আদেশ-১৯৭২’ জারি করা। হয়। সাময়িক সংবিধান আদেশের ভাষ্য এই গ্রন্থের ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা সুসংহতকরণ শীর্ষক অধ্যায়ে উল্লেখ করা হয়েছে। সাময়িক সংবিধান আদেশের সূচনায় বলা হয়েছিল, “যেহেতু ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিলের স্বাধীনতার ঘােষণা আদেশে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের শাসন পরিচালনার নিমিত্তে সাময়িক ব্যবস্থাবলী গ্রহণ করা হয়েছে এবং যেহেতু উক্ত ঘােষণায় রাষ্ট্রপতির উপর অর্পিত হয়েছে সকল প্রকার নির্বাহী ও আইন প্রণয়ন কর্তৃত্ব এবং একজন প্রধানমন্ত্রী নিয়ােগের ক্ষমতা এবং যেহেতু উক্ত ঘােষণায় উল্লেখিত অন্যায়। ও বিশ্বাসঘাতকতামূলক যুদ্ধ এখন সমাপ্ত হয়েছে এবং যেহেতু বাংলাদেশের জনসাধারণের অভিব্যক্ত প্রত্যাশা/আকাক্ষা এই যে, বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্র কার্যকর হবে এবং যেহেতু উক্ত প্রত্যাশা পূরণার্থে সেই লক্ষ্যে তাৎক্ষণিকভাবে কিছু কিছু পদক্ষেপব্যবস্থা গ্রহণ। আবশ্যক, সেহেতু ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিলের বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা অনুসরণে । এবং সেই লক্ষ্যে প্রদত্ত, অপর সকল ক্ষমতা বলে এখন রাষ্ট্রপতি নিমবর্ণিত আদেশ প্রস্তুত। ও জারি করছেন।” সাময়িক সংবিধান আদেশে মােট ১০টি অনুচ্ছেদ সংযােজিত হয়।
এসব আদেশের প্রধান প্রধান বিষয়গুলাের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিল যে, সাময়িক সংবিধান। আদেশ বাংলাদেশব্যাপী কার্যকর হবে, তাৎক্ষণিকভাবে এটি বলবৎ হবে, প্রধানমন্ত্রীর। নেতৃত্বে একটি মন্ত্রিপরিষদ থাকবে, প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি তাঁর সব কার্যক্রম। সম্পন্ন করবেন, প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি অপর সব মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী। নিয়ােগ করবেন, গণপরিষদ কর্তৃক সংবিধান প্রণীত ও গৃহীত হওয়ার আগে রাষ্ট্রপতির পদ। শূন্য হলে মন্ত্রিপরিষদ বাংলাদেশের কোনাে একজন নাগরিককে রাষ্ট্রপতি নিয়ােগ করবেন। যিনি গণপরিষদ প্রণীত সংবিধান অনুসারে অন্য একজন রাষ্ট্রপতি নিয়ােগপ্রাপ্ত ও দায়িত্ব। গ্রহণ করার আগ পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন, বাংলাদেশে একটি হাইকোর্ট থাকবে, যাতে একজন প্রধান বিচারপতি এবং প্রয়ােজনানুসারে সময় সময় নিযুক্ত অপর। কয়েকজন বিচারপতি থাকবেন এবং বাংলাদেশ হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতিকে এবং রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী ও অন্য মন্ত্রীবর্গ, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীবৃন্দকে শপথবাক্য পাঠ। করাবেন। সাময়িক সংবিধান আদেশে রাষ্ট্রপতি পরিবর্তন, মন্ত্রিসভার সদস্য নিয়ােগ, তাঁদের শপথবাক্য পড়ানাে, হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠা, গণপরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যগণের আস্থাভাজন, একজন সদস্যকে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রদান ইত্যাদি বিষয় অতি নিপুণতার সঙ্গে এবং আইনানুগভাবে সন্নিবেশিত হয় । কার্যপ্রণালী, কার্যবন্টন ও কার্যপরিচালনা প্রবাসে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিপরিষদ সচিব পদে লব্ধ অভিজ্ঞতা এবং ১৯৬১ থেকে ১৯৭১ সালের মার্চের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার এবং প্রাদেশিক সরকারের বিভিন্ন পদ ও দপ্তরে দায়িত্ব পালনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর সরকারকাঠামাে তৈরিতে আমার সহায়ক হয়েছিল। এ কথা অত্যুক্তি নয়, বরং বাংলাদেশের আধুনিক সার্বভৌম জাতীয় সরকার গঠনপ্রক্রিয়ার সঙ্গে প্রথম থেকে যুক্ত থাকতে পারার বিরল সৌভাগ্য আমার হয়েছে।
এ ছাড়া আরাে যেসব সহকর্মী স্বাধীন শত্রুমুক্ত বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর প্রত্যক্ষ নেতৃত্ব। এবং পরামর্শ-নির্দেশে বাংলাদেশ সরকারের সাংগঠনিক কাঠামাে নির্ণয়, বিধানাবলি প্রণয়ন ইত্যাদিতে আমার সঙ্গে আরাে যারা অবদান রেখেছিলেন, তাদের মধ্যে ছিলেন বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী সচিবালয়ে নিযুক্ত অর্থসচিব খন্দকার আসাদুজ্জামান, প্রতিরক্ষাসচিব নূরুল কাদের, প্রতিরক্ষাসচিব এম. এ. সামাদ, স্বরাষ্ট্র সচিব ও পুলিশপ্রধান আবদুল খালেক, আইনসচিব আবদুল হান্নান চৌধুরী, সেক্রেটারি জেনারেল রুহুল কুদুস প্রমুখ। এঁরা প্রত্যেকেই মুক্তিযুদ্ধকালে গঠিত প্রবাসী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার পরিচালনায় অসাধারণ অবদান রেখেছিলেন। যদিও সে সময় উল্লখিত কর্মকর্তাবৃন্দের পদ-পদবি অনুযায়ী নির্দিষ্ট কোনাে কার্যবন্টন বিধি (Rules for the Allocation of Business) ছিল না, তাতে কিন্তু সরকারের কোনাে কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়নি। তবে, পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলদেশে সরকারের কাজকর্ম পরিচালনার জন্য Rules of Business প্রণয়নে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছিলেন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জনাব কফিলউদ্দীন মাহমুদ, জনাব সফিউল ইসলাম, জনাব মাহবুবউজ্জামান, জনাব মুজিবুল হক, জনাব সৈয়দউজ্জামান। প্রমুখ। আরাে সহায়তা করেছেন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের যুগ্মসচিব আব্দুল মজিদ ও হাবিবুল হক। মন্ত্রিপরিষদে গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে নিয়মিত রিপাের্টের ব্যবস্থা প্রতি সপ্তাহে প্রচলিত হওয়ায় সরকারের কর্মের গতিশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছিল। হানাদারমুক্ত যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতির সাময়িক সংবিধানে বর্ণিত উপায় ও পন্থায় সরকারের কাজকর্ম পরিচালিত হয়।
সংবিধান প্রণয়নের প্রয়ােজনীয় নির্দেশ প্রদানের পরপরই বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়েছিল দুটি তাৎক্ষণিক সমস্যা যেমন (ক) ছিন্নমূল বিপর্যস্ত গণমানুষের পুনর্বাসন ও (খ) দেশ পুনর্গঠন-সমস্যার প্রতি। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর ১৪ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু তাঁর প্রথম আনুষ্ঠানিক সাংবাদিক সম্মেলনে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ ও জনগণের অবর্ণনীয় দুঃখদুর্দশার চিত্র তুলে ধরে সংশ্লিষ্ট সবার সাহায্য-সহযােগিতা কামনা করেন। মুক্তিযােদ্ধা পুনর্বাসন, ত্রাণকার্যক্রম, দেশে আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, রাষ্ট্রীয় চার মূল নীতি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের ভিত্তিতে দেশ গড়ার অঙ্গীকার, জাতীয়করণ নীতি ইত্যাদি বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করে তিনি অভূতপূর্ব কর্তব্যপরায়ণতা ও কর্মনিষ্ঠার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। সর্বজনবিদিত বিষয় হলাে, সংবিধানে বর্ণিত থাকে সরকার কোন্ কোন্ বিষয়ে বিধি (জঁষবং) প্রণয়ন করবে এবং সেসব অনুসরণ করে সরকার এবং সরকারের কাজকর্ম পরিচালিত হবে। সরকারের প্রশাসন যন্ত্রের কাজকর্ম পরিচালনায় প্রণীত বিধিবিধানকে প্রচলিত পরিভাষায় কার্যপ্রণালীবিধি (Rules of Business) বলা হয়ে থাকে। এই কার্যপ্রণালী বিধির দুটো অংশ থাকে, এর একটি হচ্ছে কার্যবন্টন বিধি (Rules for Allocation of Business) এবং অপরটি হলাে কার্যপরিচালনা বিধি (Rules for the Transaction of Business)। কার্যবন্টন বিধিতে কোন্ মন্ত্রণালয় বা দপ্তর-অধিদপ্তর কী কাজ করবে তার পরিষ্কার একটি রূপরেখা থাকে এবং কার্যপরিচালনা বিধিতে কে কীভাবে কাজ করবে বা করবেন, কোন্ কোন্ বিষয়ে কে বা কারা সিদ্ধান্ত-সুপারিশ দিতে পারবে কিংবা পারবেন, কোন্ বিশেষ বিষয় অথবা সমস্যা কিংবা সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে অন্যান্য মন্ত্রণালয় বা সংস্থার সঙ্গে পরামর্শ করবেন সেগুলাের দিকনির্দেশনা থাকে। উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতার ঘােষণা সংবলিত বাণী প্রচারিত হওয়ার সময় বাংলাদেশ যুদ্ধাবস্থায় ছিল।
নির্দিষ্ট বিধিবিধান মেনে চলার কোনাে অবকাশ তল্কালীন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের ছিল না। কিন্তু সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সব কাজকর্মই সঠিকভাবেই পরিচালিত হয়েছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে, পাকিস্তান সরকারের অর্থবিভাগে কাজ করার অঢেল অভিজ্ঞতা থাকায় খন্দকার আসাদুজ্জামানের পক্ষে প্রবাসী সরকারের আর্থিক বিধি, বাজেট প্রণয়ন, ব্যয়বরাদ্দ, প্রকৃত ব্যয়সংক্রান্তবিভিন্ন কাজে আত্মনিয়ােগ করা অতি সহজ ও সাবলীল হয়েছিল। আমি নিজে জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব পালনের আগে অর্থ বিভাগে কাজ করায় সরকারি ব্যয়বরাদ্দ, ব্যয় ইত্যাদি বিষয়ে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ছিলাম। ঠিক তেমনি নূরুল কাদেরের দীর্ঘকাল জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা থাকায় তা মুজিবনগরে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ সরকারের কাজকর্ম পরিচালনায় বিশেষ সহায়ক হয়। সাবেক পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারে দায়িত্ব পালনের সময় মন্ত্রিসভার কার্যপ্রণালী সম্বন্ধেও আমার জ্ঞান লাভের সুযােগ ঘটেছিল। আমার অভিজ্ঞতার সুবাদে স্বাধীন সার্বভৌম শত্রুমুক্ত বাংলাদেশের জাতীয় সরকারের কাজকর্মে আমিও ঘনিষ্ঠভাবে একীভূত হয়ে যাই। এবং মন্ত্রিসভার জন্য কীভাবে সারসংক্ষেপ তৈরি করতে হয়, কীভাবে সেগুলাে উপস্থাপন করতে হয়, মন্ত্রিসভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত ও সুপারিশমালা সংশ্লিষ্ট সবাইকে অবহিত করতে হয়, বাস্তবায়ন-নিরীক্ষণ-পর্যবেক্ষণ কীভাবে অনুসৃত হয় তা সফলভাবে সম্পন্ন করতে সমর্থ হই। মুক্তিযুদ্ধকালে খন্দকার আসাদুজ্জামান এবং আমি তকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন। আহমদকে আমাদের অভিজ্ঞতার কথা বলে যেমন সরকারের কাজকর্মে নিয়মকানুন, শৃঙ্খলা। স্থাপনে ভূমিকা রাখতে পেরেছিলাম, তেমনি ১৯৭২ সালের মধ্য জানুয়ারি থেকে বঙ্গবন্ধু পুনর্বাসন, ত্রাণকার্যক্রম, দেশে আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, রাষ্ট্রীয় চার মূল নীতি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের ভিত্তিতে দেশ গড়ার অঙ্গীকার, জাতীয়করণ নীতি ইত্যাদি বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করে তিনি অভূতপূর্ব কর্তব্যপরায়ণতা ও কর্মনিষ্ঠার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। সর্বজনবিদিত বিষয় হলাে, সংবিধানে বর্ণিত থাকে সরকার কোন্ কোন্ বিষয়ে বিধি (জঁষবং) প্রণয়ন করবে এবং সেসব অনুসরণ করে সরকার এবং সরকারের কাজকর্ম পরিচালিত হবে। সরকারের প্রশাসন যন্ত্রের কাজকর্ম পরিচালনায় প্রণীত বিধিবিধানকে প্রচলিত পরিভাষায় কার্যপ্রণালীবিধি (Rules of Business) বলা হয়ে থাকে। এই কার্যপ্রণালী বিধির দুটো অংশ থাকে, এর একটি হচ্ছে কার্যবন্টন বিধি (Rules for Allocation of Business) এবং অপরটি হলাে কার্যপরিচালনা বিধি (Rules for the Transaction of Business)। কার্যবন্টন বিধিতে কোন্ মন্ত্রণালয় বা দপ্তর-অধিদপ্তর কী কাজ করবে তার পরিষ্কার একটি রূপরেখা থাকে এবং কার্যপরিচালনা বিধিতে কে কীভাবে কাজ করবে বা করবেন, কোন্ কোন্ বিষয়ে কে বা কারা সিদ্ধান্ত-সুপারিশ দিতে পারবে কিংবা পারবেন, কোন্ বিশেষ বিষয় অথবা সমস্যা কিংবা সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে অন্যান্য মন্ত্রণালয় বা সংস্থার সঙ্গে পরামর্শ করবেন সেগুলাের দিকনির্দেশনা থাকে। উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতার ঘােষণা সংবলিত বাণী প্রচারিত হওয়ার সময় বাংলাদেশ যুদ্ধাবস্থায় ছিল।
নির্দিষ্ট বিধিবিধান মেনে চলার কোনাে অবকাশ তৎকালীন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের ছিল না। কিন্তু সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সব কাজকর্মই সঠিকভাবেই পরিচালিত হয়েছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে, পাকিস্তান সরকারের অর্থবিভাগে কাজ করার অঢেল অভিজ্ঞতা থাকায় খন্দকার আসাদুজ্জামানের পক্ষে প্রবাসী সরকারের আর্থিক বিধি, বাজেট প্রণয়ন, ব্যয়বরাদ্দ, প্রকৃত ব্যয়সংক্রান্তবিভিন্ন কাজে আত্মনিয়ােগ করা অতি সহজ ও সাবলীল হয়েছিল। আমি নিজে জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব পালনের আগে অর্থ বিভাগে কাজ করায় সরকারি ব্যয়বরাদ্দ, ব্যয় ইত্যাদি বিষয়ে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ছিলাম। ঠিক তেমনি নূরুল কাদেরের দীর্ঘকাল জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা থাকায় তা মুজিবনগরে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ সরকারের কাজকর্ম পরিচালনায় বিশেষ সহায়ক হয়। সাবেক পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারে দায়িত্ব পালনের সময় মন্ত্রিসভার কার্যপ্রণালী সম্বন্ধেও আমার জ্ঞান লাভের সুযােগ ঘটেছিল। আমার অভিজ্ঞতার সুবাদে স্বাধীন সার্বভৌম শত্রুমুক্ত বাংলাদেশের জাতীয় সরকারের কাজকর্মে আমিও ঘনিষ্ঠভাবে একীভূত হয়ে যাই। এবং মন্ত্রিসভার জন্য কীভাবে সারসংক্ষেপ তৈরি করতে হয়, কীভাবে সেগুলাে উপস্থাপন করতে হয়, মন্ত্রিসভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত ও সুপারিশমালা সংশ্লিষ্ট সবাইকে অবহিত করতে হয়, বাস্তবায়ন-নিরীক্ষণ-পর্যবেক্ষণ কীভাবে অনুসৃত হয় তা সফলভাবে সম্পন্ন করতে সমর্থ হই । মুক্তিযুদ্ধকালে খন্দকার আসাদুজ্জামান এবং আমি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে আমাদের অভিজ্ঞতার কথা বলে যেমন সরকারের কাজকর্মে নিয়মকানুন, শৃঙ্খলা। স্থাপনে ভূমিকা রাখতে পেরেছিলাম, তেমনি ১৯৭২ সালের মধ্য জানুয়ারি থেকে বঙ্গবন্ধু পুনর্বাসন, ত্রাণকার্যক্রম, দেশে আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, রাষ্ট্রীয় চার মূল নীতি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের ভিত্তিতে দেশ গড়ার অঙ্গীকার, জাতীয়করণ নীতি ইত্যাদি বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করে তিনি অভূতপূর্ব কর্তব্যপরায়ণতা ও কর্মনিষ্ঠার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। সর্বজনবিদিত বিষয় হলাে, সংবিধানে বর্ণিত থাকে সরকার কোন্ কোন্ বিষয়ে বিধি (জঁষবং) প্রণয়ন করবে এবং সেসব অনুসরণ করে সরকার এবং সরকারের কাজকর্ম পরিচালিত হবে। সরকারের প্রশাসন যন্ত্রের কাজকর্ম পরিচালনায় প্রণীত বিধিবিধানকে প্রচলিত পরিভাষায় কার্যপ্রণালীবিধি (Rules of Business) বলা হয়ে থাকে। এই কার্যপ্রণালী বিধির দুটো অংশ থাকে, এর একটি হচ্ছে কার্যবন্টন বিধি (Rules for Allocation of Business) এবং অপরটি হলাে কার্যপরিচালনা বিধি (Rules for the Transaction of Business)। কার্যবন্টন বিধিতে কোন্ মন্ত্রণালয় বা দপ্তর-অধিদপ্তর কী কাজ করবে তার পরিষ্কার একটি রূপরেখা থাকে এবং কার্যপরিচালনা বিধিতে কে কীভাবে কাজ করবে বা করবেন, কোন্ কোন্ বিষয়ে কে বা কারা সিদ্ধান্ত-সুপারিশ দিতে পারবে কিংবা পারবেন, কোন্ বিশেষ বিষয় অথবা সমস্যা কিংবা সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে অন্যান্য মন্ত্রণালয় বা সংস্থার সঙ্গে পরামর্শ করবেন সেগুলাের দিকনির্দেশনা থাকে। উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতার ঘােষণা সংবলিত বাণী প্রচারিত হওয়ার সময় বাংলাদেশ যুদ্ধাবস্থায় ছিল।
নির্দিষ্ট বিধিবিধান মেনে চলার কোনাে অবকাশ তল্কালীন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের ছিল না। কিন্তু সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সব কাজকর্মই সঠিকভাবেই পরিচালিত হয়েছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে, পাকিস্তান সরকারের অর্থবিভাগে কাজ করার অঢেল অভিজ্ঞতা থাকায় খন্দকার আসাদুজ্জামানের পক্ষে প্রবাসী সরকারের আর্থিক বিধি, বাজেট প্রণয়ন, ব্যয়বরাদ্দ, প্রকৃত ব্যয়সংক্রান্তবিভিন্ন কাজে আত্মনিয়ােগ করা অতি সহজ ও সাবলীল হয়েছিল। আমি নিজে জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব পালনের আগে অর্থ বিভাগে কাজ করায় সরকারি ব্যয়বরাদ্দ, ব্যয় ইত্যাদি বিষয়ে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ছিলাম। ঠিক তেমনি নূরুল কাদেরের দীর্ঘকাল জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা থাকায় তা মুজিবনগরে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ সরকারের কাজকর্ম পরিচালনায় বিশেষ সহায়ক হয়। সাবেক পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারে দায়িত্ব পালনের সময় মন্ত্রিসভার কার্যপ্রণালী সম্বন্ধেও আমার জ্ঞান লাভের সুযােগ ঘটেছিল। আমার অভিজ্ঞতার সুবাদে স্বাধীন সার্বভৌম শত্রুমুক্ত বাংলাদেশের জাতীয় সরকারের কাজকর্মে আমিও ঘনিষ্ঠভাবে একীভূত হয়ে যাই। এবং মন্ত্রিসভার জন্য কীভাবে সারসংক্ষেপ তৈরি করতে হয়, কীভাবে সেগুলাে উপস্থাপন করতে হয়, মন্ত্রিসভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত ও সুপারিশমালা সংশ্লিষ্ট সবাইকে অবহিত করতে হয়, বাস্তবায়ন-নিরীক্ষণ-পর্যবেক্ষণ কীভাবে অনুসৃত হয় তা সফলভাবে সম্পন্ন করতে সমর্থ হই। মুক্তিযুদ্ধকালে খন্দকার আসাদুজ্জামান এবং আমি তকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন। আহমদকে আমাদের অভিজ্ঞতার কথা বলে যেমন সরকারের কাজকর্মে নিয়মকানুন, শৃঙ্খলা। স্থাপনে ভূমিকা রাখতে পেরেছিলাম, তেমনি ১৯৭২ সালের মধ্য জানুয়ারি থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সব বিষয়ের সঙ্গেও যুক্ত হয়েছিল মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে যুক্ত আরাে অনেক সহকর্মী স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শত্রুমুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশে আধুনিক সার্বভৌম জাতীয় সরকার গঠন করতে গিয়ে প্রথমত তিনটি সরকারকাঠামাের বিষয় বিবেচনায় রেখেছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৯৭১ সালে যে সরকার বাংলাদেশের প্রশাসনিক রাজকর্মের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছিল সেই মুজিবনগরের সরকার তথা প্রথম বাংলাদেশ সরকারের সাংগঠনিক কাঠামাে, পরিচালনাপদ্ধতি, জনগণের কাছে প্রদত্ত অঙ্গীকার, স্বাধীনতার ঘােষণায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম কর্তৃক ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল জারিকৃত আইনের ধারাবাহিকতা প্রয়ােগ আদেশ-১৯৭১ (Laws Continuance (Order-1971) ইত্যাদি বিষয় অন্যতম ছিল। প্রথম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের এসব ছাড়াও সাবেক পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক সরকারকাঠামাের বিষয়গুলােও বিবেচনায় নেন তিনি। তৃতীয়ত, বঙ্গবন্ধুর বিশেষ আগ্রহ ছিল সুইজারল্যান্ডের শাসনতন্ত্র ও সরকারপদ্ধতির বিষয়ে। স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারকাঠামাে গঠনে এই তিনটি বিষয়কে বিবেচনার আওতায় রাখা হয়েছিল। তবে, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সরকারের অবকাঠামাে, বেতন কাঠামাে, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের সুযােগ-সুবিধা ইত্যাদি বিষয়েও বঙ্গবন্ধু বিশেষভাবে নজর দেন । সে কারণে সাবেক পাকিস্তান আমলে সরকারি কর্মচারীদের জন্য বিদ্যমান দুই হাজারের অধিক বেতন-স্কেলের মধ্যে অনৈক্য দূর করে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ ও পরামর্শে বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসনিক কাঠামাের জন্য মাত্র দশটি সর্বজনীন ও ভারসাম্যপূর্ণ বেতনস্কেল প্রবর্তিত হয়। এতে রাষ্ট্রীয় চার মূল নীতির সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটে। জাতীয় সরকার গঠনকালে বিবেচ্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আধুনিক জাতীয় সরকার গঠনে যেসব বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া হয়েছিল তার মধ্যে “আইনের ধারাবাহিকতা প্রয়ােগ আদেশ-১৯৭১”-এর বিষয়বস্তুও অন্তর্ভুক্ত ছিল। পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশের নিজস্বতা, স্বাতন্ত্র ও সার্বভৌমত্বের দাবি প্রতিষ্ঠিত করতে আইনগত বৈধতার প্রশ্নটি ছিল সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সারের ৭ মার্চ ঢাকার তকালীন রেসকোর্স মাঠে ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদানের পর আরাে নিবিড়ভাবে তার দলীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলাপ-আলােচনা ও পরামর্শ করেন। দূরদর্শী রাজনৈতিক নেতা বঙ্গবন্ধু দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ এমনকি সাবেক পাকিস্তানের প্রগতিশীল নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে মতবিনিময় করেন। তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রশ্নে আলােচনা চলাকালে বঙ্গবন্ধু পূর্ববাংলার ছাত্র-পেশাজীবীসহ সব স্তরের জনমানুষের সঙ্গে সার্বক্ষণিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। পূর্ববাংলার মানুষ আন্দোলন-সংগ্রামের ব্যাপ্তি ও মাত্রা দেখে ভেবে নিয়েছিল যে, বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ সরাসরি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করবেন। কিন্তু কূটনৈতিক ভাষায় সেদিন বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা দিয়ে বলেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” পাকিস্তানের সামরিক শাসকবৃন্দ সেদিন বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘােষণার বাণী সঠিকভাবেই বুঝে নিয়েছিল।
তাই জেনারেল ইয়াহিয়া খান আলােচনার নামে কালক্ষেপণ করতে থাকেন এবং বাঙালি জাতিকে দমন করতে গােপনে প্রস্তুতি নেন। বঙ্গবন্ধু তার সাথী ও সঙ্গীদের এই ষড়যন্ত্রের বিষয়ে সতর্ক থাকতে বলেছিলেন। অন্য দিকে বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ এবং তার পরবর্তী দিনগুলােতে বাঙালি। জনগণকে “যার যা আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকতে বলে হুঁশিয়ার করে দেন। বঙ্গবন্ধুর আশঙ্কা সত্য প্রমাণিত হলাে ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় যখন পাকিস্তান বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালি জাতি নিধনে অপারেশন সার্চলাইট বাস্তবায়নে ঢাকার রাজপথে নেমে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস বিশেষত সার্জেন্ট জহুরুল হক হল এবং জগন্নাথ হলে ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আক্রমণ পরিচালনা করে। বঙ্গবন্ধুও তার সঙ্গী-সাথীদের নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে। ২৬ মার্চ রাতের প্রথম প্রহরে প্রত্যক্ষভাবে স্বাধীনতার ঘােষণা সংবলিত বার্তা তকালীন ইপিআর-এর মাধ্যমে প্রচার করেন। প্রতিবেশী ভারতীয় সীমান্তসংলগ্ন মেহেরপুরের এক আমবাগানে বঙ্গবন্ধুর দলীয় এমএনএ ও এমপিএ আওয়ামী লীগ নেতা তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে সমবেত হন এবং তারা বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘােষণার আইনগত বৈধতা প্রদানের জন্য ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। স্বাধীনতা ঘােষণায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে আইনের ধারাবাহিকতা প্রয়ােগ আদেশ-১৯৭১ জারি করেন। এই আদেশ দ্বারা পৃথিবীর অন্যান্য রাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশের অস্তিত্বের গ্রহণযােগ্যতার একটি ধাপ অতিক্রান্ত হয়। প্রতিবেশী ভারত বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি শরণার্থীর দুঃখদুর্দশার কথা সারা পৃথিবীকে অবহিত করে এবং পাকিস্তানের সামরিক শাসকবৃন্দের পূর্ববাংলায় গণহত্যার বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে।
তৎকালীন পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচনে। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দলের বিজয়ী জনপ্রতিনিধিগণ মেহেরপুরের আমবাগানে একত্র হয়ে আইনের ধারাবাহিকতা প্রয়ােগ আদেশ জারির পক্ষে যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেন তাতে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব স্বীকৃত হয়েছিল। এ জন্য মুক্তিযুদ্ধের সময় পৃথিবীর বহু রাষ্ট্রের গণতন্ত্রমনা মানুষজন বাংলাদেশের জনগণের পাশে এসে দাড়িয়েছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আইনের ধারাবাহিকতা প্রয়ােগ আদেশের ভিত্তিতে দেশের সরকার এবং যাবতীয় কর্মকাণ্ড বৈধভাবে পরিচালিত হতে থাকে। বাংলাদেশের আধুনিক সার্বভৌম জাতীয় সরকার গঠনকালে বঙ্গবন্ধু আইনের ধারাবাহিকতা প্রয়ােগ আদেশ-১৯৭১সহ তাঁর দলের ঐতিহাসিক ৬-দফা এবং সর্বদলীয়। ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের ১১-দফাও বিবেচনায় রেখেছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রপতির সাময়িক সংবিধান আদেশের ৭ নম্বর ধারা অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়ােগ করা হয়েছিল এবং প্রধানমন্ত্রী সেদিনই তার ১১-সদস্যবিশিষ্ট মন্ত্রিসভা গঠন করেন। সংবিধান আদেশের ৮ নম্বর ধারা বলে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তার মন্ত্রিসভার ১১ সদস্যকে শপথবাক্য পাঠ করান। শপথের ধরন/প্রকৃতি নির্ধারণ করার দায়িত্ব মন্ত্রিপরিষদকে দেওয়া হয়েছিল। ঢাকা প্রত্যাবর্তনের পর মুজিবনগরে মন্ত্রিসভাকে সহায়তাকারী এবং অন্যান্য দাপ্তরিক কাজে অংশগ্রহণকারী কয়েক জন কর্মকর্তা ঢাকার সরকারি কাজকর্ম সচল করে তােলেন। কালবিলম্ব না করে মুজিবনগরের বেশির ভাগ সহকর্মীকে যাদের আনুগত্য প্রশ্নাতীত ছিল তাদের প্রশাসনের বিভিন্ন পদে নিয়ােগ দেওয়া হয়েছিল এ জন্য যে, এতে সরকারের কাজকর্ম যাতে সাবলীল ও নিরবচ্ছিন্ন থাকে।
বাংলাদেশ সরকারের ইতিহাসে কিছু উল্লেখযােগ্য ঘটনার কথা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে সরকার গঠন প্রসঙ্গে আবশ্যকীয়ভাবে উঠে আসে। এসব কথা বললেই নয়। কারণ আমার জীবনে বিশেষ করে সরকারি দায়িত্ব পালনকালে এই ঘটনা প্রকৃতপক্ষেই গৌরবজনক। উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে, মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকারের বেশির ভাগ গুরুত্বপূর্ণ বেসামরিক প্রশাসনিক কর্মকর্তাসহ আমিও ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করি ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর ২২ ডিসেম্বর তারিখে। ওই দিন মুজিবনগরে অবস্থানরত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম মন্ত্রিসভার অন্যান্য সদস্যসহ প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে নিয়ে ঢাকায় এসে পৌছেন। যেহেতু অন্যান্য সহকর্মীকে নিয়ে মন্ত্রিসভাকে দাপ্তরিক কাজে সহায়তা করছিলাম সেহেতু বেশির ভাগ কর্মী কর্মকর্তা অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীকে অনুসরণ করে ঢাকায় আসেন। আগেই অন্য স্থানে উল্লেখ করেছি যে, এর কয়েক দিন আগে ১৮ ডিসেম্বর অস্থায়ী রাজধানী মুজিবনগরে কর্মরত কর্মকর্তাবৃন্দের উচ্চপর্যায়ের একটি দলকে ঢাকায় বেসামরিক প্রশাসনিক কাজকর্ম প্রত্যক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার জন্য পাঠানাে হয়। এই দলে বাংলাদেশ সরকারের উচ্চপর্যায়ের আটজন কর্মকর্তা ছিলেন। তাঁরা হানাদার পাকিস্তান বাহিনীর কবলমুক্ত বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় প্রাথমিকভাবে বেসামরিক প্রশাসনিক কর্মকণ্ডের সূচনা করেন। বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীসহ আমরা ঢাকায় | এসে নতুন উদ্যম ও প্রেরণায় উদ্ভাসিত হয়ে দেশের কাজে আত্মনিয়ােগ কবি। ঢাকায় তৎকালে আইন ও শৃঙ্খলার জটিলতর পরিস্থিতি ১৭ ডিসেম্বর থেকে ক্রমেশই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পাকিস্তানের পরাজয়ের পর মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে। অবস্থানরত বহু তরুণ বিজয়ােল্লাসে মত্ত মুক্তিযােদ্ধাদের সঙ্গে যােগ দেয়। মুখ্যত এদের হাতে ছিল পাকিস্তানি সৈন্য ও সমর্থকদের পরিত্যক্ত অস্ত্র এবং অঢেল গােলা-গুলি। এদের একটি অংশ অন্যের গাড়ি, বাড়ি, সম্পদ, দোকানপাট বিনামূল্যে কিংবা নামমাত্র মূল্যে দখলের কাজে জড়িয়ে পড়ে। এদেরকেই সাধারণ জনগণ ‘সিক্সটিনথ ডিভিশন’। নামে অভিহিত করে। এই ডিভিশন সৃষ্ট ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছিল অতি নগণ্যসংখ্যক মুক্তিযােদ্ধা। এতে রাজাকার আর মুক্তিযোেদ্ধা শনাক্ত দুরূহ হয়ে ওঠে এবং এতে এক অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। অন্য দিকে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে মানুষের পুঞ্জীভূত ক্রোধ দূর করতে এক জটিল সমস্যার সৃষ্টি হয়।
মন্ত্রিসভার ঢাকায় প্রত্যাবর্তনের আগে সৃষ্ট আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা কষ্টসাধ্য ব্যাপার ছিল এই জন্য যে দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধশেষে বাংলাদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার দারুণ অবনতি ঘটে। তদুপরি, পৃথিবীব্যাপী আলােড়ন | তােলা এক কোটি শরণার্থীর বিষয়টিও বাংলাদেশ সরকারের মাথাব্যথার কারণ ছিল। এমন এক অবস্থার মধ্যে ঢাকায় প্রত্যাবর্তনের পর মন্ত্রিসভা অতি দ্রুত সুপরিকল্পিত উপায়ে আইন | ও শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নেয়। মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যেই আমরা একটি কেন্দ্রীয় সরকারের প্রয়ােজননাপযােগী কেন্দ্রীয় প্রশাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হই। ফলে, সঘাত ও বিশৃঙ্খলা হ্রাস পায় এবং সাধারণভাবে প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক জীবনধারা সচল হয়ে ওঠে। প্রসঙ্গত আরাে উল্লেখ্য যে, ওই দিনই (২২ ডিসেম্বর ১৯৭১) অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের নির্দেশে মন্ত্রিসভার বিশেষ জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার ঘটনা পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধুর সরকার গঠনে উল্লেখযােগ্য অবদান রেখেছিল। এই সভার আলােচ্যসূচি পর্যালােচনা করলে বােঝা যাবে কীভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসন অতি দ্রুততম সময়ে পরিপূর্ণতার দিকে অগ্রসর হয়ে আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশ পরিচালনায় সক্ষম হতে পেরেছিল। প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে, মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি জাতির বিজয় নিশ্চিত জেনেই তকালীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার মুজিবনগরে স্বাধীনতা-পরবর্তী বিভিন্ন সমস্যা ও তার সমাধানের উপায় নিয়ে চিন্তাভাবনা করেছিল। এই সরকার এ জন্য একটি অগ্রিম কার্যকর কর্মসূচি (Plans and Programms) গ্রহণ করে। এই অগ্রিম পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য যেসব বিষয়ে প্রাধান্য পেয়েছিল সেগুলাের সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নরূপ ক, পুলিশ প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে আইনশৃঙ্খলা পুনস্থাপন : সর্বাপেক্ষা। গুরুত্বপূর্ণ ঘােষণা ছিল আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার বিষয়ে। নভেম্বর-ডিসেম্বরে (১৯৭১) বিভিন্ন সূত্র থেকে খবর জানা যায় যে, দেশের অভ্যন্তরে মুক্তিবাহিনীর যােদ্ধারা এবং স্থানীয় জনগণ রাজাকার/শান্তি কমিটি এবং অন্যান্য দেশদ্রোহীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে আইন হাতে তুলে নিচ্ছে। গণ-আদালত বসিয়ে কোথাও কোথাও বিচারও করা হচ্ছিল। এই শত্রুদের তাদের জঘন্যতম অপরাধের জন্য নির্মম শাস্তি প্রাপ্য ছিল।
তবু সরকার মনে করেছিল যে, এ ধরনের স্থানীয় বিচার বা প্রতিশােধ গ্রহণ স্বাধীনতা ঘােষণার সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ। তাই স্বাধীন বাংলা বেতারে তৎকালে বারবার ঘােষণা করেছিল ‘আপনারা আইন নিজের হাতে তুলে নিবেন না। ভুলে যাবেন না আমাদের যুদ্ধ হলাে গণতন্ত্র আর আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য, শান্তি আর অগ্রগতির জন্য।’ বেসামরিক প্রশাসন চালু করে সরকারের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা : স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশে বেসামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠার ঘােষণায় বলা হয়েছিল, দেশ মুক্ত হবার আগেই প্রতিটি জেলার জন্য জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে পূর্ণাঙ্গ টিম গঠন করা হয়েছে। প্রশাসনে শূন্যতা রােধে এই ঘােষণা দেওয়া হয়েছিল। প্রশাসনে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বাংলাদেশ সরকারকে যেমন গােপনে সহযােগিতা করেছে, তেমনি প্রকাশ্যভাবে অসহযােগিতাও করেছে। আবার অনেকের সম্পর্কে সরকারের কাছে কোনাে তথ্য ছিল না। এ কারণে সরকারকে সম্পূর্ণ নতুন টিম গঠন করতে হয়েছিল। গ. ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা মুজিবনগরে অবস্থানকালেই শরণার্থীদের পুনর্বাসনের জন্য সরকারকে বহুমাত্রিক প্রস্তুতি নিতে হয়। ভিটেমাটি ছেড়ে প্রায় এক কোটি লােক নিঃস্ব হয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। বেশির ভাগ শরণার্থী নিঃস্ব হয়ে পড়ে। অনেকেই অসুস্থ, আবার অকেকেই পাকিস্তানি বাহিনী, রাজাকার বাহিনীর আক্রমণে আহত হয়েছিল । এসব শরণার্থী স্বগৃহে, স্বভূমে ফিরলেই আশ্রয় মিলবে না, আশ্রয় থাকতে হবে ঘর তৈরি করতে হবে। ঢেউটিন, কাঠ, খড়, গৃহনির্মাণসামগ্রী, হালের বলদ, ফসলের বীজ, সার, কয়েক মাসের খাদ্যসামগ্রী প্রভৃতি সব কিছুর জন্য বাংলাদেশ সরকার ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছিল। সরকার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ও চিন্তাভাবনা করেছিল।
বিপুল সংখ্যক শরণার্থী তথা মানবসম্পদকে সামাল দিতে যে আয়ােজন দরকার ছিল, তা আগেই পরিকল্পনা করে খুঁটিনাটি পর্যন্ত ব্যবস্থা করতে হয়েছিল। পুরাে অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে সরকার বিভিন্ন টাস্ক ফোর্স গঠন ও দায়িত্ব বণ্টন করা হয়েছিল। এ জন্য ভারতীয় প্রতিপক্ষের (counterpart) সাথেও প্রতিদিন আলােচনা করতে হয়েছিল। এসব শরণার্থীকে কীভাবে, কোন উপায়ে দেশে ফেরত আনা হবে, তাদের অন্যান্য সেবামূলক ব্যবস্থা কীভাবে হবে, তার সবই করার ব্যবস্থা সরকার নিয়েছিল। এ রকম অসংখ্য সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রয়ােজনীয় জনবল নিয়ােগ করতে হয়েছিল। স্বীকার করতেই হবে, ভারতীয় কর্তৃপক্ষের দিক থেকে সময়ােচিত সাহায্য ও সহযােগিতা না পেলে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের এত বড় সমস্যা সমাধান বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে খুবই কষ্টকর হতাে। ঘ, একই সাথে সরকারকে আরাে একটি সমস্যার অনুরূপ সমাধান করতে হয়েছে। দেশের অভ্যন্তরেই বিপুল সংখ্যক অধিবাসীকে তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র নিরাপদে আশ্রয় নিতে হয়েছিল। এদের পুনর্বাসনের দিকেও সরকারকে লক্ষ রাখতে হয়। গৃহনির্মাণ সামগ্রী সংগ্রহ, চাষাবাদের উপকরণ এবং গবাদিপশু সরবরাহ ছিল সরকারের অন্যতম দায়িত্ব। চ, সড়ক ও যােগাযােগব্যবস্থা, যার অধিকাংশ ছিল বিধ্বস্ত, সেগুলাের সংস্কার ও পুনঃস্থাপন অগ্রাধিকার পায়। নদীপথগুলােকেও নৌচলাচলের উপযােগী এবং নিরাপদ করার প্রয়ােজন ছিল। সরকার এসব বিষয় দক্ষতার সঙ্গেই মােকাবিলা করেছিল। ছ, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবার সকল প্রতিষ্ঠান নিয়মিতভাবে সচল করতে প্রয়ােজন ছিল অতি দ্রুত এগুলাের সংস্কার, শিক্ষক ও ডাক্তারদের উপস্থিতি নিশ্চিতকরণ সরকারের কাছে কোনাে তথ্য ছিল না। এ কারণে সরকারকে সম্পূর্ণ নতুন টিম গঠন করতে হয়েছিল। গ. ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা মুজিবনগরে অবস্থানকালেই শরণার্থীদের পুনর্বাসনের জন্য সরকারকে বহুমাত্রিক প্রস্তুতি নিতে হয়। ভিটেমাটি ছেড়ে প্রায় এক কোটি লােক নিঃস্ব হয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। বেশির ভাগ শরণার্থী নিঃস্ব হয়ে পড়ে। অনেকেই অসুস্থ, আবার অকেকেই পাকিস্তানি বাহিনী, রাজাকার বাহিনীর আক্রমণে আহত হয়েছিল । এসব শরণার্থী স্বগৃহে, স্বভূমে ফিরলেই আশ্রয় মিলবে না, আশ্রয় থাকতে হবে ঘর তৈরি করতে হবে। ঢেউটিন, কাঠ, খড়, গৃহনির্মাণসামগ্রী, হালের বলদ, ফসলের বীজ, সার, কয়েক মাসের খাদ্যসামগ্রী প্রভৃতি সব কিছুর জন্য বাংলাদেশ সরকার ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছিল। সরকার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ও চিন্তাভাবনা করেছিল।
বিপুল সংখ্যক শরণার্থী তথা মানবসম্পদকে সামাল দিতে যে আয়ােজন দরকার ছিল, তা আগেই পরিকল্পনা করে খুঁটিনাটি পর্যন্ত ব্যবস্থা করতে হয়েছিল। পুরাে অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে সরকার বিভিন্ন টাস্ক ফোর্স গঠন ও দায়িত্ব বণ্টন করা হয়েছিল। এ জন্য ভারতীয় প্রতিপক্ষের (counterpart) সাথেও প্রতিদিন আলােচনা করতে হয়েছিল। এসব শরণার্থীকে কীভাবে, কোন উপায়ে দেশে ফেরত আনা হবে, তাদের অন্যান্য সেবামূলক ব্যবস্থা কীভাবে হবে, তার সবই করার ব্যবস্থা সরকার নিয়েছিল। এ রকম অসংখ্য সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রয়ােজনীয় জনবল নিয়ােগ করতে হয়েছিল। স্বীকার করতেই হবে, ভারতীয় কর্তৃপক্ষের দিক থেকে সময়ােচিত সাহায্য ও সহযােগিতা না পেলে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের এত বড় সমস্যা সমাধান বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে খুবই কষ্টকর হতাে। ঘ, একই সাথে সরকারকে আরাে একটি সমস্যার অনুরূপ সমাধান করতে হয়েছে। দেশের অভ্যন্তরেই বিপুল সংখ্যক অধিবাসীকে তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র নিরাপদে আশ্রয় নিতে হয়েছিল। এদের পুনর্বাসনের দিকেও সরকারকে লক্ষ রাখতে হয়। গৃহনির্মাণ সামগ্রী সংগ্রহ, চাষাবাদের উপকরণ এবং গবাদিপশু সরবরাহ ছিল সরকারের অন্যতম দায়িত্ব। চ, সড়ক ও যােগাযােগব্যবস্থা, যার অধিকাংশ ছিল বিধ্বস্ত, সেগুলাের সংস্কার ও পুনঃস্থাপন অগ্রাধিকার পায়। নদীপথগুলােকেও নৌচলাচলের উপযােগী এবং নিরাপদ করার প্রয়ােজন ছিল। সরকার এসব বিষয় দক্ষতার সঙ্গেই মােকাবিলা করেছিল। ছ, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবার সকল প্রতিষ্ঠান নিয়মিতভাবে সচল করতে প্রয়ােজন ছিল অতি দ্রুত এগুলাের সংস্কার, শিক্ষক ও ডাক্তারদের উপস্থিতি নিশ্চিতকরণ এবং শিক্ষা ও চিকিৎসার উপকরণ সংগ্রহ ও সরবরাহ। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধোত্তর স্বাধীন দেশে সরকারের কার্যক্রম সার্বিকভাবে প্রচলন করতে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল।
শত্রুমুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশে (১) আইন ও শৃঙ্খলা এবং বেসামরিক প্রশাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা; (২) অর্থনীতি পুনর্গঠন; (৩) গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পূর্বসাফল্যের ধারাবাহিকতা অক্ষুন্ন রাখতে সহায়ক হয়েছিল। আধুনিক সার্বভৌম জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মুজিবনগরে প্রতিষ্ঠিত সরকারের ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছিলেন। তাই ওপরের এসব দৃষ্টান্ত তুলে ধরা। এসব ছাড়াও কিছু কার্যক্রমের গতিধারা অব্যাহত রাখার বিষয়ে বঙ্গবন্ধু তার তীক্ষ্ণ সচেতনতার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তনের আগে ১৯৭১ সালের ২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত সম্প্রসারিত সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্যগণের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের বিষয় আমার কাছে যেমন, তেমনি বাংলাদেশ সরকারের ইতিহাসে চিরকাল এক স্মরণীয় ঘটনা হয়ে থাকবে। এই শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান সাবেক পাকিস্তানের গভর্নমেন্ট হাউস’ যাকে রুহুল কুদুসের নেতৃত্বে প্রথম বাংলাদেশ সরকারের অগ্রবর্তী দল “বঙ্গভবন” নামে অভিহিত করার প্রস্তাব গ্রহণ করেছিলেন সেই বঙ্গভবনে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। আমি প্রথমবারের মতাে আনুষ্ঠানিকতার সাথে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করি সে দিন। বাংলাদেশের মাটিতে প্রথম যথাযােগ্য মর্যাদায় এবং আনুষ্ঠানিকতায় মন্ত্রিসভার সদস্যগণের শপথপাঠ করানাে হয়েছিল। মন্ত্রীদের নিয়ােগের ঘােষণা, এক-এক করে তাদের শপথবাক্য পাঠ করার অনুরােধ ইত্যাদি আনুষ্ঠানিকতা দেশি-বিদেশি আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ, রেডিও টেলিভিশন ও অন্যান্য গণমাধ্যমের প্রতিনিধির উপস্থিতিতে পরিচালনা করতে পেরে জনাব তাজউদ্দীন আহমদসহ আমি এবং আমার অন্যান্য সহকর্মী গর্বিত হয়েছিলাম। পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যখন আধুনিক সরকার গঠনে আত্মনিয়ােগ করেছিলেন তখন এই ধারাবাহিকতাই রক্ষিত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু সরকারের বিশেষ বিশেষ কর্মসূচি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধকালেই দেশের সব ধরনের প্রশাসনিক কাজকর্ম শুরু করেছিল।
যুদ্ধ পরিচালনার মতাে এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি মােকাবিলাও সরকারকে করতে হয়েছিল। অধিকন্তু, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশ ও জনগণের অধিকার সম্বন্ধে অবহিতকরণের দুরূহ কাজও করতে হয়েছে। মুক্তাঞ্চলে জনগণের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা প্রণালী ও ব্যবসাবাণিজ্য, শিল্পকারখানায় উৎপাদন অব্যাহত রাখা, কৃষিকাজে সহযােগিতা প্রদান, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি রােধ, হানাদার পাকিস্তান বাহিনীর জ্বালাও-পােড়াও ও লুটতরাজ-হত্যা মােকাবিলায় সরকারকে প্রতিনিয়ত ব্যতিব্যস্ত থাকতে হয়েছিল। এর মধ্যে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে পুনর্গঠনের পরিকল্পনাও যুদ্ধকালে বাংলাদেশ সরকার করে রাখে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি সরকারের দায়িত্বভার নিয়েই তাঁর অনুপস্থিতিকালে তার নামে পরিচালিত সরকারের সব কর্মসূচির ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে থাকেন এবং অসংখ্য নতুন নতুন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে থাকেন। মুজিবনগরে প্রফেসর মােজাফফর আহমদের সভাপতিতে গঠিত পরিকল্পনা কমিশনে যুদ্ধবিদ্ধস্ত বাংলাদেশের জন্য তিনটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন : (১) পুনর্বাসন (শরণার্থীসহ সকল বাস্তুচ্যুত ব্যক্তি এবং অবকাঠামাে); (২) মধ্যমেয়াদি উন্নয়ন; (৩) দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন। বঙ্গবন্ধু পরবর্তীকালে এটিকেই গ্রহণ করে পরিকল্পনা কমিশনকে দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু ১৪ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিক এক সাংবাদিক সম্মেলনে যুদ্ধের ক্ষত কাটিয়ে ওঠার লক্ষ্যে সবার সাহায্যসহযােগিতা কামনা করে বিবৃতি দিয়েছিলেন। বিবৃতিতে তিনি আশু যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন তার কিছু কিছু বিষয় তিনি উল্লেখ করেছিলেন। নিচে বিবৃতির অংশবিশেষ উল্লেখ করা হলাে :
বাংলাদেশ এখন বিশ্বে একটি স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্থান গ্রহণ করেছে । আমি প্রাণদানকারী সেই লাখ লাখ শহীদের স্মৃতিকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি এবং সালাম জানাচ্ছি সেই সমস্ত তরুণ, বৃদ্ধ বীরদের, কৃষক ও শ্রমিক, ছাত্র ও সরকারি কর্মচারী এবং বিশেষ করে বাংলাদেশের সশস্ত্রবাহিনীর বীর সন্তানদের, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, সাবেক ইপিআর, সাবেক আনসার, সাবেক মােজাহিদ, পুলিশ ও মুক্তিবাহিনীর সবাইকে, যারা অত্যাচারীকে প্রতিরােধ করার জন্য ঐক্যবদ্ধ। হয়েছিলেন। পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বর ধ্বংসযজ্ঞ আমাদের দেশকে পুরােপুরি বিধ্বস্ত করে দিয়ে গেছে। …এর ফলে অর্থনীতি এক বিধ্বস্ত অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। সব চেয়ে জরুরি কাজ হচ্ছে অর্থনীতিকে পুনর্গঠন ও পুনর্বিন্যস্ত করা। অর্থনীতিকে অবশ্যই পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে। খাদ্য, আশ্রয় এবং বস্ত্র অবশ্যই দিতে হবে মানুষকে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলােকে অবশ্যই আবার চালু করতে হবে এবং সব শ্রেণীর লােক যাতে শিক্ষার সুযােগ পায় তার ব্যবস্থা করতে হবে। জরুরি ভিত্তিতে রিলিফ ও পুনর্বাসনের কাজ চালিয়ে যেতে হবে। ইয়াহিয়ার বর্বর বাহিনী পেছনে যে ভস্ম রেখে গেছে তার মধ্যেই একেবারে গােড়া থেকে এক নয়া সমাজ গড়ে তুলতে হবে। …একটি নতুন পরিকল্পনা প্রণয়ন সংস্থা নতুন অর্থনীতির জন্য একটি ব্যাপক শ্বেতপত্র প্রণয়নের কাজ হাতে নিচ্ছে। এই সংস্থা পেশাগতভাবে অত্যন্ত যােগ্য ব্যক্তিদের নিয়ে গঠন করা হয়েছে। এই শ্বেতপত্রে কৃষি, শিল্প ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগত পরিবর্তন সাধন করবে। এসব নতুন প্রতিষ্ঠান বৈষয়িক ও জনসম্পদকে পুরােপুরি কাজে লাগাবার চেষ্টা করবে। তারা সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসমতা কমিয়ে আনার লক্ষ্য সামনে রেখে উৎপাদন আরাে বাড়ানাের চেষ্টা করবে। শ্বেতপত্র প্রণয়নের কাজ দ্রুত শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে কতকগুলাে কাজ জরুরি ভিত্তিতে হাতে নেওয়া হচ্ছে। তার প্রথমটি হলাে, সাহায্য ও পুনর্বাসন। এ কাজের।
————
১. দৈনিক বাংলা, ১৫ জানুয়ারি, ১৯৭২
————-
জন্য একটি ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।… জনগণ যাতে জাতিগঠনমূলক কাজ শুরু করতে পারে, তার জন্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার একটি কাঠামাের আবশ্যকতা সম্পর্কে আমি সম্পূর্ণ সচেতন।…আমি আমাদের জনগণকে আশ্বাস দিচ্ছি যে, নৃশংসতার জন্য দায়ী ব্যক্তি ও তাদের দালালদের শাস্তি দেওয়া হবে। সেই সঙ্গে একথা ভুলে গেলে চলবে না যে, আমাদের জাতীয় মুক্তি-সংগ্রামের অন্যতম মূল লক্ষ্য হলাে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং মৌলিক মানবিক অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া। দুষ্কৃতিকারীদের আইন মােতাবেক যথােপযুক্ত শাস্তি দেওয়া হবে। আইন তার নিজস্ব গতিধারায় চলবে। কাজেই আমি সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধৈর্য ধারণের আবেদন জানাচ্ছি। আমি হাইকোর্ট ও অধস্তন আদালতগুলাে যাতে কাজ শুরু করতে পারে, তা নিশ্চিত করার জন্য আশু পদক্ষেপ গ্রহণ করবাে।… প্রশাসন বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে পৃথককরণের নীতি সুষ্ঠুভাবে পর্যালােচনা করা হবে। আমরা সাহায্য, পুনর্বাসন ও অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের জরুরি কাজ শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের খসড়া-শাসনতন্ত্র পেশ করার জন্য গণপরিষদের অধিবেশন ডাকার ব্যাপারে প্রয়ােজনের চাইতে এক মুহূর্তও বিলম্ব করবাে না। শাসনতন্ত্রের খসড়া প্রণয়নের কাজ ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে।… প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বঙ্গবন্ধু সরকারের দায়িত্ব নিয়ে এক মুহূর্ত বসে থাকেননি। সাংবাদিক সম্মেলনের পর ১৬ জানুয়ারি জাতীয় শােকদিবসের অনুষ্ঠানে বাস্তুহারাদের যথাযথভাবে পুনর্বাসন প্রসঙ্গে তার কর্মসূচির কথা উল্লেখ করেছিলেন। বিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠন ও বাস্তুহারাদের পুনর্বাসন প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু তার দৃঢ়চিত্ততার কথা ২৪ জানুয়ারি টাঙ্গাইলে অনুষ্ঠিত এক বিশাল জনসভায়ও ব্যক্ত করেছিলেন। মুক্তিযােদ্ধাদের অস্ত্রসমর্পণ করে দেশগড়ার কাজে আহ্বান স্বাধীনতা-উত্তরকালে বীর মুক্তিযােদ্ধাদের দেশ গড়ার কাজে নিয়ােজিত করার লক্ষ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার সিদ্ধান্ত নেয়। পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর ১৮ ডিসেম্বর মন্ত্রিসভা জাতীয় মিলিশিয়া গঠনের প্রস্তাব অনুমােদন করে। আনুষ্ঠানিকভাবে ২৬ ডিসেম্বর এক সরকারি ঘােষণায় মুক্তিযােদ্ধাদের সমবায়ে একটি জাতীয় মিলিশিয়া বাহিনী। গঠনের কথা উল্লেখ করা হয় এবং এই বাহিনী যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে গড়ে তােলার জন্য বিভিন্ন পুনর্গঠন কাজ ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অংশ নেবে। বাস্তব পরিস্থিতির আলােকে ২৬ ডিসেম্বরে তালিকাভুক্ত ও তালিকা-বহির্ভূত সব মুক্তিযােদ্ধাকে নিয়ে জাতীয় মিলিশিয়া’ গঠনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার এক ঘােষণায় বলে : গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার মনে করে যে, মুক্তিবাহিনী এ দেশের মেধার বৃহত্তর | আধার, যার মধ্য থেকে এদেশের দ্রুত পুনর্গঠন এবং অবকাঠামাে পুনঃস্থাপনের জন্য উৎসর্গিত নতুন নেতৃত্বের উদ্ভব সম্ভব। বাংলাদেশ সরকারের এই উপলব্ধির পাশাপাশি অস্ত্র পুনরুদ্ধার করাও ছিল এই সিদ্ধান্ত ের অন্যতম লক্ষ্য।
অস্ত্র তখন ছিল মূলক (১) পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ কর্তৃক গঠিত বিভিন্ন আধা-সামরিক বাহিনী ও সামরিক সমর্থক, (২) মুক্তিযােদ্ধা, এবং (৩) বিজয় কালীন সইয়ে স্বঘােষিত ‘মুক্তিযােদ্ধাদের’ প্রথাৎ তথাকথিত ‘সিকস্টিনথ ডিভিশন’ -এর কাতে। দ্বিতীয় গ্রুপের কাছ থেকে অস্ত্র পুনরুদ্ধার অপেক্ষাকৃত সহজ প্রমাণিত হয়। অগণিত মুক্তিযােদ্ধা গ্রুপের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সংক্রামী চরিত্র ের বিভিন্নতা সত্ত্বেও তাদের কে ঐক্য বদ্ধ করার পরিকল্পনা প্রয়ােজনীয় চিন্তাভাবনা মাধ্যমেই সরকার সম্পন্ন করে।
কিন্তু সমস্যা ছিল স্বঘােষিত মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ে। তবু এদের জাতীয় মিলিশিয়াতে যােগদানের সুযােগ উন্মুক্ত করা হলে, তাদের সমবায় জাতীয় মিলি শিয়া গঠনের সিদ্ধান্ত ঘােষণা করে সরকার। পূর্ণ রাজনৈতিক আস্থা সৃষ্টিকল্পে সকল যােগদানেচ্ছু মুক্তিযােদ্ধা সমবায় জাতীয় মিলি শিয়া গঠন, রাজনৈতিক দলেছ প্রতিনিধিত্বের ভিত্তি তে বহু দলীয় কমান গঠন, এই কমান্ডের অধীন জাতীয় উপদেষ্টা কমিটি কর্তৃক মিলি শিয়া বাহিনী নিয়ােগ এবং তাদের পেশা গত বিকা শের সুযােগ, ইত্যাকার বিষয়ে যুবশক্তিকে এক নতুন সমাজ গঠন সক্রিয় করা এবং এই উপায় জাতির অর্থনৈতিক স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু করা সম্ভব হতে পারে বলে সরকার মনে করে। বঙ্গবন্ধুর এই কার্যক্রম ছিল দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এক বাস্তব পদক্ষেপ। ১৯৭২ সালের ২ জানুয়ারি বাংলাদেশ সরকার জাতীয় মিলিশিয়ার ১১ জন সদস্য সমবায়ে জাতীয় নিয়ন্ত্রণ বাের্ড গঠন করে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে একজন করে এবং মুজিব বাহিনীর পক্ষ থেকে দু’জন সদস্যকে এই বাের্ডের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের বঙ্গবন্ধুর সরকার কাজে লাগানাের পরিকল্পনা গ্রহণ করে । মুক্তিযুদ্ধে যেসব শিক্ষার্থী অংশ নেন তাদের মধ্যে যারা শিক্ষার পাট শেষ করতে ইচ্ছুক ছিলেন তাদের লেখাপড়ায় ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা বঙ্গবন্ধুর সরকার করে। অবশিষ্ট সব মুক্তিযােদ্ধাকে তার সরকার পুলিশ এবং মিলিশিয়া বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করার ব্যবস্থা করে। মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্র নিজেদের কাছে না রেখে তিনি সেগুলাে ১৯৭২ সালের ৩১ জানুয়ারির আগেই সরকারের কাছে জমা দিতে নির্দেশ দেন। বঙ্গবন্ধুর এই নির্দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যকর হয়। অস্ত্রসমর্পণ অনুষ্ঠানে নিজে উপস্থিত হয়ে অস্ত্র গ্রহণ করেন। পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের অব্যবহিত পর ১৭ জানুয়ারি, ১৯৭২ তারিখে মুক্তিযােদ্ধাদের অস্ত্র জমা দিয়ে সমাজ গঠনে আত্মনিয়ােগ করতে বঙ্গবন্ধুর সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে আহ্বান জানায়। এই আহ্বানের সারমর্ম ছিল নিম্নরূপ। বীরত্বের সাথে সংগ্রামকারী মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন কাজে নিয়ােগের পরিকল্পনা ঘােষণা করেছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বীর যােদ্ধাদের পুলিশবাহিনী ও জাতীয় মিলিশিয়ার অন্তর্ভুক্ত করা হবে। নিজেদের সমস্ত শক্তি ও প্রচেষ্টায় একটি নয়া সমাজ গড়ে তােলার ও দেশের স্বাধীনতা রক্ষার কাজে নিয়ােগ করার জন্যে তিনি মুক্তিযুদ্ধকালে আওয়ামী লীগ এবং বাংলাদেশ ছাত্রলীগের যুবসদস্যদের সমবায়ে গড়ে ওঠা মুজিববাহিনীর সদস্যগণ বঙ্গবন্ধুর কাছে ৩১ জানুয়ারি অস্ত্রসমর্পণ করে। চার নেতা শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও তােফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে আনুষ্ঠানিকভাবে সেই অনুষ্ঠানেও প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্যে সাড়ে সাত কোটি মানুষ গুনে গুনে প্রাণ দেবে, তবুও স্বাধীনতা বিসর্জন দেবে না ।
রক্তের মূল্যে অর্জিত স্বাধীনতাকে প্রাণের বিনিময়ে রক্ষা করবে। স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র সম্পর্কে জনগণকে সতর্ক করে দিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বাংলদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে এখনাে ষড়যন্ত্র চলছে। এই ষড়যন্ত্র মােকাবিলার জন্য জাতিকে ঐক্যবদ্ধ ও প্রস্তুত থাকতে হবে।’হানাদার পাকিস্তান বাহিনীর নৃশংস হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট, বন্দর, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কারখানা সর্ব শক্তি দিয়ে পুনর্নির্মাণ করার কর্মসূচি বঙ্গবন্ধুর সরকার হাতে নেয়। উল্লেখ্য, এসব কর্মসূচি ও পরিকল্পনা মুজিবনগরে অবস্থানকালে তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারও গ্রহণ করেছিল। ত্রাণকার্যক্রমের আওতায় সরকার দেশের বিভিন্ন এলাকায় জনসংখ্যার ভিত্তিতে মজুরি দেওয়ার ব্যবস্থা করে। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে যাতে কোনাে দুর্নীতি না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব জনগণকে সামাজিক সচেতনতা গড়ে তােলার আহ্বান জানান। দেশ পুনর্গঠনের প্রয়ােজনে সমবায়ের ভূমিকা অপরিসীম বলে বঙ্গবন্ধু মনে করতেন। এ জন্য তিনি ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রত্যেক জনসভায়, সাংবাদিক সম্মেলন ও সাক্ষাৎকারে প্রশ্ন। রেখে বলতেন, “আরাে যদি দু’মাস ছ’ মাস বা এক বছর যুদ্ধ করতে হয় তাহলে কি জনগণ যুদ্ধ করতাে না?” তিনি সকলকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে এ বলে সজাগ করতেন যে, “মনে রাখবেন, আমরা সবাই যুদ্ধ করছি, যুদ্ধ এখনও চলছে, এ জনযুদ্ধ চলছে এই লক্ষ্যে যে, কিছু নেই, নতুন করে গড়তে হবে সব কিছু।” এসব আহ্বান টাঙ্গাইলে অনুষ্ঠিত জনসভায় বলেছিলেন। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ গড়ার কাজে যথাযােগ্য মর্যাদায় মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ােজিত করার সিদ্ধান্তবঙ্গবন্ধুর নামে পরিচালিত মুজিবনগরে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ সরকার আগেই নিয়ে রেখেছিলেন। বঙ্গবন্ধু প্রত্যক্ষভাবে সরকারের কার্মকাণ্ডে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যুক্ত হয়ে ১৯৭২ সালের ১৭ জানুয়ারি মুক্তিযোেদ্ধাদের অস্ত্র জমা দিয়ে নতুন সমাজ গঠনে আত্মনিয়ােগ করতে আহ্বান জানান। ওই আহ্বানে সাড়া দিয়ে মুক্তিযােদ্ধারা দলে দলে অস্ত্র জমা দিয়ে যার যার পেশা কিংবা পড়াশােনায় আত্মনিয়ােগ করে। টাঙ্গাইলের কাদেরিয়া বাহিনীসহ কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ, ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলা বাহিনী জানুয়ারি মাস শেষ হওয়ার আগেই সরকারের কাছে অস্ত্র জমা দেয়। অস্ত্রসমর্পণ অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু ঘােষণা করেন, “চিরদিনের জন্য আমি আপনাদের কাছ থেকে অস্ত্র নিচ্ছি না। প্রয়ােজন হলে আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের মােকাবিলা করতে আমি আবার আপনাদের অস্ত্র ফেরত দেবাে।”
———-
২. দৈনিক সংবাদ, ২৫ জানুয়ারি, ১৯৭২ ৩, দৈনিক সংবাদ, ১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২
——
বঙ্গবন্ধুর সরকার মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের সংগঠিত করে দেশ গঠনের স্বপ্ন। দেখলেও বাস্তবে তার প্রতিফলন ব্যাহত হয়েছিল। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর পরাজিত দেশিবিদেশি চক্রান্তকারীরা বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে যে অপচেষ্টা চালায় তা আমি প্রত্যক্ষ করি। মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত পক্ষ কুখ্যাত রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর সদস্যরা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মানবতাবিরােধী অপরাধ যেমন খুন-হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযােগ, লুটতরাজ, বলপূর্বক ধর্মান্তরিত করাসহ গণহত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল তাদের ওইসব দণ্ডযােগ্য অপরাধের জন্য বাংলাদেশ কোলাবরেটরস (স্পেশাল ট্রাইব্যুনালস) অর্ডার-১৯৭২ জারি করা হয়েছিল এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন-১৯৭৩ প্রণীত হয়েছিল। বাংলাদেশ কোলাবরেটরস (স্পেশাল ট্রাইব্যুনালস) অর্ডার-১৯৭২ প্রয়ােগ করে মানবতাবিরােধী অপরাধ সংঘটনকারীদের ৩৭০০০ অপরাধীকে আটক করা হয়। এদের মধ্য থেকে খুন, ধর্ষণ, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোেগ ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত ১১০০০ ব্যক্তিকে অভিযুক্ত করে আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে বিচারের জন্য সােপর্দ করা হয়। এসব অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচারের জন্য সারা দেশে ৭৩টি স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছিল। ট্রাইব্যুনালে বিচারান্তে যারা অপরাধী সাব্যস্ত হয় তাদের মধ্যে ২২ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ৬৮ জনকে যাবজ্জীবন এবং ৭৫২ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধের বিরােধিতাকারী ও পাকিস্তানের এদেশীয় চর, যারা বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতি কঠিন করে তােলার হুঙ্কার দিয়েছিল, তাদের অনুসারীরাই ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারসহ জাতীয় চার নেতাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে দেশের অপূরণীয় ক্ষতি করেছে। সামরিক শাসকগােষ্ঠী বাংলাদেশ কোলাবরেটরস (স্পেশাল ট্রাইব্যুনালস) অর্ডার-১৯৭২ অনুযায়ী পরিচালিত বিচারকার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। এক সামরিক ফরমান বলে ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর বাংলাদেশ কোলাবরেটরস (স্পেশাল ট্রাইব্যুনালস) অর্ডার-১৯৭২ বাতিল করে ওই আইনের অধীনে দণ্ডিত এবং আটক সব অভিযুক্ত ব্যক্তিকে মুক্তি দিয়ে তাদেরকে সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়।
জেনারেল জিয়াউর রহমান ১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিল সংবিধানের পঞ্চম সংশােধনীর মাধ্যমে সব সামরিক ফরমানের বৈধতা দিয়ে মানবতাবিরােধী অপরাধে দণ্ডিত অপরাধীদের পুনর্বাসিত হওয়ার সুযােগ করে দেন। এসব মানবতাবিরােধী অপরাধী তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে শক্তি সঞ্চয় করে বাংলাদেশের সব কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হতে পেরেছে। এরা বিপর্যস্ত বিধ্বস্ত বাংলাদেশে তকালে বিদ্যমান বিশৃঙ্খলা ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সুযােগ নিয়ে দেশের উন্নয়ন কাজে বিঘ্ন ঘটায়। জনগণের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা যুদ্ধাপরাধী ও ষড়যন্ত্রকারীরা তাদের অপচেষ্টা অব্যাহত রাখে। এতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী দেশবাসী বিভ্রান্ত হয়। এবং মুক্তিযােদ্ধাদের সংগঠিত করে দেশপ্রেমিক সরকারের দেশ গড়ার পরিকল্পনা ব্যাহত হয়। কিন্তু বাঙালি জনগণের মন থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মুছে যায়নি। ইতিহাস বিকৃত করার অপচেষ্টায় কাজ হয়নি। একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের প্রথম ভাগেই তরুণ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ফিরে আসতে দেখা গেছে যার প্রতিফলন ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে সারা বাংলাদেশে ঘটেছে।
রাষ্ট্রীয় মূলনীতির ভিত্তিতে দেশ পরিচালনা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কবলমুক্ত হওয়ার পর স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয় ১৭ এবং ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ তারিখে। সরকারের দায়িত্বে থাকায় স্পষ্টতই তখন আওয়ামী লীগ সরকারি দল। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তাদের দলীয় ওই সভায় রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি যেমন, (১) বাঙালি জাতীয়তাবাদ (২) গণতন্ত্র (3) ধর্মনিরপেক্ষতা ও (৪) সমাজতন্ত্রের ওপর ভিত্তি। করে স্বাধীন বাংলাদেশকে গড়ে তােলার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে। শােষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেও ওই সভায় আওয়ামী লীগ কাজ করার সঙ্কল্প ব্যক্ত করে। জাতীয়করণ নীতি আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হয়ে জাতীয়করণ কর্মসূচি গ্রহণ করেন। তিনি তাঁর সরকারের এই সঙ্কল্পের কথা ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের প্রথম স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে বেতার ও টেলিভিশনের মাধ্যমে জাতির উদ্দেশে ঘােষণা করেন। জাতীয়করণ কর্মসূচিসংক্রান্ত আদেশে প্রধানমন্ত্রী স্বাক্ষরও দেন। প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে রাষ্ট্রপতিও ১৯৭২ সালের রাষ্ট্রপতির আদেশ ২৬ ও ২৭ সর্বসাধারণের অবগতির জন্য বাংলাদেশ গেজেটের অতিরিক্ত সংখ্যায় ২৮৬-প্রকা এবং ২৮৭-প্রকা সংখ্যক প্রজ্ঞাপন জারি করে (পরিশিষ্ট-২১ এবং ৫০ দ্রষ্টব্য)।
বঙ্গবন্ধু জাতির উদ্দেশে ঘােষণায় বলেন, “আমার সরকার অভ্যন্তরীণ সমাজবিপ্লবে বিশ্বাস করে। এটা কোনাে অগণতান্ত্রিক কথামাত্র নয়, আমার সরকার ও পাটি বৈজ্ঞানিক সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। একটা নূতন সমাজব্যবস্থার ভিত নির্মাণের জন্য পুরাতন সমাজব্যবস্থা উপড়ে ফেলতে হবে। আমরা শােষণমুক্ত সমাজ গড়বাে।” | সরকারের এই অভিপ্রায় বাস্তবায়নে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল। বিদেশি ব্যাংক ও বীমা কোম্পানি বাদে দেশের অন্যান্য ব্যাঙ্ক, বীমা, পাট-বস্ত্র-চিনি শিল্পসহ পরিত্যক্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ বিমান, জাহাজ করপােরেশন ইত্যাদিকে জাতীয়করণ নীতিমালার আওতায় আনয়নের জন্য চিহ্নিত করা হয়। অবাঙালি শিল্পপতিদের মালিকাধীন বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা ছাড়া গত্যন্তর ছিল না, কারণ এসব শিল্পপতি মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পশ্চিম পাকিস্তানে পাড়ি জমায়। শোষণমুক্ত নূতন সমাজ গঠন কর্মসূচির শুভসূচনা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর সরকার নিম্নলিখিত প্রতিষ্ঠান, সংস্থা ও বিষয় জাতীয়করণ করেছিল:
ক, ব্যাংকসমূহ (বিদেশি ব্যাংকের শাখা বাদে) খ. সাধারণ ও জীবন বীমা কোম্পানিসমূহ (বিদেশি বীমা কোম্পানির শাখাগুলাে বাদে) গ. সব চটকল ঘ, সব বস্ত্র ও সুতাকল ঙ. সব চিনিকল চ. অভ্যন্তরীণ ও উপকুলীয় অধিকাংশ নৌযানসমূহ ছ. পনেরাে লাখ টাকা মূল্যের এবং তদপেক্ষা বেশি মূল্যের সব পরিত্যক্ত ও অনুপস্থিত মালিকানার সম্পত্তি জ, বাংলাদেশ বিমান ও বাংলাদেশ শিপিং করপােরেশনকে সরকারি সংস্থায় পরিণত ঝ, ট্রেডিং করপােরেশন অব বাংলাদেশের অধীনে প্রধান প্রধান আমদানি-রপ্তানিব্যবস্থা অন্তর্ভুক্তি ট্রেডিং করপােরেশন অব বাংলাদেশের আওতায় দেশের প্রধান আমদানি-রপ্তানি ব্যবস্থা সাময়িকভাবে ন্যস্ত করা হলেও সব বৈদেশিক বাণিজ্য জাতীয়করণের পরিকল্পনা বাংলাদেশ সরকারের ছিল। জাতীয়করণকৃত শিল্পকারখানার মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে বিরাজমান বিরােধ অবসানের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর সরকার জাতীয়করণ নীতি গ্রহণ করে এজন্য প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থাও সরকার নেয়। শিল্পকারখানায় দক্ষ ও অভিজ্ঞ পরিচালক নিযুক্ত করে সরকার তার পরিকল্পনা সফল করার উদ্যোগ নেয়। লক্ষণীয় যে, প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাঁর সরকারের জাতীয়করণ নীতি সাফল্যমণ্ডিত করতে ছাত্রসমাজকেও উদ্বুদ্ধ করেন। মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং মুক্তিসংগ্রামে শিক্ষার্থীদের সাহসী অবদানের স্বীকৃতি দিতেই তিনি জাতীয়করণ নীতি সফল করতে তাদের সম্পৃক্তির প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করেন। জাতীয়করণ কর্মসূচির ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে ১৯৭২ সালের ২৯ মার্চ চট্টগ্রামের জেলা বার সমিতির সদস্যদের উদ্দেশে ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘ধনীদের তিনি আরও ধনী হতে দেবেন না।
বাংলাদেশ কৃষক, শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের দেশ হবে।’ জাতীয়করণ নীতিতে শিল্পপতিগণ খুশি হতে পারেননি। বঙ্গবন্ধু শিল্পপতিদের উদ্দেশে বলেছিলেন, তিনি নিজের জন্য জাতীয়করণ নীতি গ্রহণ করেননি, জনগণের জন্যই তিনি তা করেন।’ জনগণের প্রতি বঙ্গবন্ধুর দৃঢ় আস্থা ও ভালােবাসার কথা পুনর্ব্যক্ত করে তিনি বলেন, কোনাে বিশেষ শ্রেণীর নেতৃত্ব তিনি করেন না। তিনি সমগ্র জনগণের নেতা। গ্রামীণ ও নগরজীবনের বৈষম্য দূরীকরণ শুধু জাতীয়করণ নীতি ঘােষণা এবং তা বাস্তবায়ন করতে প্রয়াসী হয়েই বঙ্গবন্ধু ক্ষান্ত হননি। এসব কাজের মধ্যে গ্রামীণ ও নগরজীবনে বিদ্যমান বৈষম্য দূর করতেও তিনি স্থিরপ্রতিজ্ঞ হয়েছিলেন। তাঁর এই প্রচেষ্টার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে পাঁচ শত ডাক্তারকে গ্রামে নিয়ােগ করেন। বঙ্গবন্ধু জানতেন যে, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার প্রমুখ কৃষক-শ্রমিকের উপার্জিত অর্থে গড়ে ওঠা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বিদ্যা অর্জন করেন। কাজেই সেই সব কৃষকশ্রমিকের ঋণ পরিশােধ করতে হবে তাদের কিন্তু সরকারের এসব কল্যাণমুখী পদক্ষেপ কিছু স্বার্থান্বেষী মহলের পছন্দ হয়নি। বিদেশি ষড়যন্ত্রকারী যারা বাংলাদেশকে দাবিয়ে রাখতে চায় তাদের সঙ্গে দেশবিরােধী স্বার্থান্বেষী এদেশীয় চক্রান্তকারীর কুচক্রীমহল সরকারের কর্মসূচি বানচাল করতে অপতৎপরতা চালায়। সমাজের এই শ্রেণীর মানুষের সঙ্গে মুনাফাখাের ব্যবসায়ীরাও জোট বাঁধে। অতি লােভী ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়ে তুলতে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে বঙ্গবন্ধু তাঁর সরকারকে নির্দেশ দেন। স্বাধীনতার পর ধ্বংসস্তুপের মধ্য থেকে দেশ পুনর্গঠনকাজে ব্যবসায়ীদেরও সম্পৃক্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি ব্যবসায়ী সম্প্রদায়কে পরামর্শ দেন।
কিন্তু তার এ আহ্বানে কিছু স্বার্থান্বেষী মুনাফাখখার ব্যবসায়ী সাড়া না দিয়ে বিধ্বস্ত বাংলাদেশের তৎকালীন বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে ষড়যন্ত্রকারীদের সঙ্গে হাত মেলায়। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় যারা দালালী করেছিল তাদের বিষয়ে বঙ্গবন্ধু ঘৃণা এবং ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমাদের ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক, সাধারণ মানুষ যখন ‘যার হাতে যা ছিল’ তাই নিয়ে যুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছিল, ঠিক তখনই দ্র, শিক্ষিত ও অভিজাত কিছু বাঙালি শত্রুপক্ষের সাথে সহযােগিতা করেছে। চাপে পড়ে যারা হানাদার বাহিনীর সহযােগিতা করেছিল, তাদের অসহায়ত্বের কথা বঙ্গবন্ধু বুঝেছিলেন এবং তাদের বিষয়ে তার সরকার বিবেচনা করবে এমন আশ্বাস বঙ্গবন্ধু দেন। যুদ্ধাপরাধীদের বাংলাদেশে এনে ট্রাইব্যুনালে বিচার করার ঘােষণাও তিনি দেন। এসব দালালের যাতে উপযুক্ত শাস্তি হয় বঙ্গবন্ধু তার সরকারকে সে দিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখতে নির্দেশ দেন। উল্লেখ করা প্রয়ােজন, স্বাধীনতার দেশি-বিদেশি বিরুদ্ধপক্ষ তখন বঙ্গবন্ধুর সরকারকে উৎখাতের তৎপরতা আরাে বৃদ্ধি করে। দলীয় কাউন্সিলে বঙ্গবন্ধুর নীতিনির্ধারণী ভাষণ স্বাধীন বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের প্রথম কাউন্সিল অধিবেশন সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ১৯৭২ সালের ৭-৮ এপ্রিল অনুষ্ঠিত এই অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ ছিল নীতিনির্ধারণবিষয়ক। শশাষণমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে ওই কাউন্সিল অধিবেশনে নীতিনির্ধারণী ভাষণের আলােকে স্বাধীন বাংলাদেশের আধুনিক সার্বভৌম জাতীয় সরকারের কর্মসূচির রূপরেখা প্রণীত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর ওই | ভাষণের অংশবিশেষ নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনের কিছু অংশ ছিল এমন :…বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যুদ্ধের ধ্বংসস্তুপ থেকে সােনার বাংলা গড়ে তােলার জন্য আওয়ামী লীগ কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, এ কাজে তাদের সকল ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থ ও লােভ বিসর্জন দিতে হবে। ঢাকার কাকরাইলে অনুষ্ঠিত অধিবেশনে উপস্থিত ১ হাজার ৪শত কাউন্সিলার ও ২ হাজার ডেলিগেট বঙ্গবন্ধুর এই আবেদনে। সাড়া দিতে দেশ গড়ার সর্বাত্মক সংগ্রামে অংশগ্রহণের জন্য শপথ নেন।… তিনি বলেন, আপনারা গত কাউন্সিল সভায় যােগদান করেছিলেন। সেখানে আমরা শপথ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলাম তা কার্যকর করার জন্য আপনারা সর্বতােভাবে চেষ্টা করেছেন। বঙ্গবন্ধু বলেন, আমি ডাক দিয়েছিলাম। আপনারা সে ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন। সাড়া দিয়েছিল এদেশের সামরিক বাহিনীর ভাইয়েরা, শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র, বুদ্ধিজীবী, লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষ আর ইপিআর-এর জোয়ান ভাইয়েরা; ডাক দিয়েছিলাম এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। আপনারা তা পালন করেছেন।
—————-
৪.. দৈনিক বাংলা, ৯ এপ্রিল, ১৯৭২
———–
তিনি আরাে বলেন, স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু সেদিন হয় নাই। এ সংগ্রাম শুরু হয়েছে বহু আগে থেকেই। আওয়ামী লীগের জন্মের পর থেকেই একে উজান বেয়ে চলতে হয়েছে। মাঝে মাত্র কয়েক মাস ছাড়া। আওয়ামী লীগের সূচনা থেকেই যে স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয়েছিল আজ তার পূর্ণতা ঘটেছে। অর্থনৈতিক স্বাধীনতার প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘স্বাধীনতা অর্জন করা যেমন কষ্টকর, তা রক্ষা করা তার চাইতেও কঠিন। আজ দেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ছাড়া রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্থহীন।… তিনি আবেগময় ভাষায় বলেন, ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান হবার পরই আমার সন্দেহ হয়েছিল। কলকাতায় আমি বলেছিলাম, এ স্বাধীনতা মিথ্যা। এ স্বাধীনতা বাংলাদেশকে উপনিবেশ করেছিল। এর আগে বাংলাদেশ কখনই স্বাধীন হয়নি। দু’শ বছর ইংরেজ ও ২৪ বছর পাকিস্তান নামক গােষ্ঠী আমাদের পরাধীন করে রেখেছিল। তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতা পেয়েছি, স্বাধীনতা রক্ষা করতে হবে। …বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যত রক্ত দিয়েছে, যত বড় ধ্বংসযজ্ঞের মধ্য দিয়ে এদেশ স্বাধীন হয়েছে, পৃথিবীতে অন্য কোনাে দেশকে তা হতে হয়নি ।…’ আওয়ামী লীগ কাউন্সিল অধিবেশনে দলের এবং সরকারের প্রধান হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বলেছিলেন, ‘আমাদের নীতি পরিষ্কার। এর মধ্যে কোনাে কিন্তু নেই। আওয়ামী লীগ কাউন্সিলই সুপ্রিম বডি। আপনাদের সিদ্ধান্ত সরকারকে মানতে হবে। এটা আওয়ামী লীগের সরকার। সরকারের আওয়ামী লীগ নয় ।. ক্ষমতা দখলের জন্য আওয়ামী লীগ সংগ্রাম করেনি। তাই সবাইকে লােভের উর্ধ্বে, স্বার্থের উর্ধ্বে উঠতে হবে।’ বঙ্গবন্ধু আরাে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ যেমন লক্ষ লক্ষ শহীদের জন্ম দিয়েছে, তেমনি বেঈমানও রয়েছে। এখানে রাজাকার, আলবদরও হয়েছে। এসব পরগাছার শিকড় তুলে। তা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। তা না হলে স্বাধীনতা বিপন্ন হবে।…যারা জাতীয় স্বার্থের কারণে একত্রে কাজ করেছেন, সংগ্রাম করেছেন যেমন কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ, কংগ্রেস, ছাত্র লীগ, ছাত্র ইউনিয়ন, শ্রমিক প্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য, তাদের আমি অভিনন্দন জানাই। আদর্শের মিল যাদের সঙ্গে রয়েছে, তাদের সহযােগিতা আমাদের কাম্য।
কাউন্সিল অধিবেশনে সরকারের নীতি প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রে বিশ্বাসী, তার মানে এই নয়, যা ইচ্ছে তাই করা। এ দেশে ইসলাম বিপন্ন এমন কোনাে ধুয়া তুলতে দেওয়া হবে না।’ পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের প্রতি ইঙ্গিত করে বঙ্গবন্ধু অধিবেশনে আরও বলেছিলেন যে, যারা ইসলামের নামে গত ২৪ বছর এ দেশকে শশাষণ করেছিল তারা কি মুসলমান? আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনকে বাংলাদেশ সরকারের নীতিনির্ধারণীর দিকনির্দেশনামূলক অধিবেশন বলা চলে। এই অধিবেশন শেষ হয় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সােনার বাংলা গড়ে তােলার অঙ্গীকার ব্যক্ত করার মধ্য দিয়ে। অঙ্গীকারের সংক্ষিপ্ত বিবরণ ছিল নিম্নরূপ :…বিপ্লববাত্তর বাংলাদেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিঘােষিত চারটি মূল নীতি ও আদর্শের সার্থক বাস্তবায়নের স্বার্থে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষমতাসীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগের পূর্ণাঙ্গ কাউন্সিল অধিবেশন পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের জন্য বঙ্গবন্ধু দলীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করবেন। এই বিশেষ প্রশ্নে দলের গঠনতন্ত্রের সংশ্লিষ্ট ধারার পরিবর্তনের প্রয়ােজন নেই বলে কাউন্সিল অধিবেশন সর্বসম্মত প্রস্তাব গ্রহণ করে। জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাএই চারটি স্তম্ভের ওপর আওয়ামী লীগকে একটি বিপ্লবী রাজনৈতিক পার্টিতে রূপান্তরিত করার ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনের ভার আওয়ামী লীগ কর্মীদের ওপর বর্তায়।
এই পরিপ্রেক্ষিতে দলের গঠনতন্ত্র সংশােধনী, ঘােষণাপত্র প্রণয়ন, সরকার পদ্ধতি পরিবর্তন করা হয়। আওয়ামী লীগের নাম আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ রাখা হয়। গঠনতন্ত্রের উদ্দেশ্য নতুন করে সংযােজিত করে বিঘােষিত চারটি মূল নীতির ভিত্তিতে একটি শােষণহীন সমাজ-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি ধারা এতে সংযােজিত হয়। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নতুন পতাকা গাঢ় সবুজ ও লাল রঙে তৈরি। গাঢ় সবুজ। বাংলাদেশের মাটি, লাল রঙে সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের শহীদের ও চারটি লাল তারকা ঘােষিত মূল নীতির প্রতীক।… আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন শেষ হওয়ার পরের দিন অর্থাৎ ১৯৭২ সালের ৯ এপ্রিল বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের ত্রয়ােদশ জাতীয় সম্মেলনে বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ উপায়ে |সমাজতন্ত্রে উত্তরণের যে রূপরেখা বঙ্গবন্ধু দিয়েছিলেন তাতে বঙ্গবন্ধুর গঠিত জাতীয় |সরকারের নীতির প্রতিফলন ছিল। ছাত্র ইউনিয়নের এই সমাবেশে বঙ্গবন্ধু তার সরকার। কর্তৃক একটি শিক্ষাকমিশন গঠনের কথাও ঘােষণা করেন। কালােবাজারি, মজুতদারি, দুষ্কৃতিকারি ও সমাজবিরােধীদের উৎপাটন করতে তিনি ছাত্রসমাজকে সরকারি প্রচেষ্টায়
এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের ১ মে প্রথম মহান মে দিবস পালিত হয়। মে দিবসে বঙ্গবন্ধু শ্রমিকদের কাছে তাঁর সরকারের অনুসৃত নীতির কথা ঘােষণা করে ভাষণ। দেন। শ্রমিকশ্রেণীকে বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অগ্রণী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে সরকারকে সহযােগিতা করার আহ্বান জানান তিনি। মহান মে দিবসে মেহনতি
————
৫ . দৈনিক বাংলা, ৯ এপ্রিল ১৯৭২ .
৬.দৈনিক বাংলা, ১০ এপ্রিল ১৯৭২
————
মানুষের জন্য বঙ্গবন্ধুর সরকার যে কল্যাণমূলক নীতিমালার কথা ঘােষণা করেন তা তখন। ছিল সম্পূর্ণ নতুন এক অভিজ্ঞতা, তুলনাবিহীন এবং অপ্রত্যাশিত। দেশের নিম্ন আয়ের বিপুলসংখ্যক শ্রমিক-কর্মচারীর জন্য আর্থিক সুবিধা প্রদানের যে নীতিমালা বিনা দাবিতে ও বিনা আন্দোলনে ঘােষিত হয়েছিল তাতে সরকারের সমাজতান্ত্রিক ও জনকল্যাণমূলক দৃষ্টিভঙ্গিই ফুটে ওঠে। অসুবিধাগ্রস্ত মেহনতি, শ্রমজীবী মানুষের প্রতি বাংলাদেশের সার্বভৌম জাতীয় সরকারের যে দায়িত্বশীলতা প্রকাশ পায় তা অবিস্মরণীয়। জাতীয় সরকার গঠনে অসাম্প্রদায়িক চেতনা আধুনিক সার্বভৌম জাতীয় সরকার গঠনে পূর্ববঙ্গের প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলগুলাের পূর্বাপর অবদান বাংলাদেশের ইতিহাসে এক গৌরবােজ্জ্বল অধ্যায়। সংখ্যাগুরু মুসলিম এলাকা নিয়ে গঠিত ভারতীয় মুসলমানদের আবাসভূমি পাকিস্তানের সৃষ্টি হলেও আঞ্চলিক স্বার্থ এবং আদর্শগত বিভিন্নতার জন্য পাকিস্তানের পূর্বাংশে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি জোরদার হয়। এই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তান রাষ্ট্র থেকে বেঙ্গল। প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত তত্ত্বালীন পূর্ব পাকিস্তান এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হয়ে। যায়। দক্ষিণ এশীয় রাষ্ট্রীয় কাঠামােয় বাংলাদেশের অভ্যুদয় এক নতুন যুগের সূচনা করে। | নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশে পূর্বে গড়ে ওঠা পরস্পর বিরােধী মতের কুড়িটির মতাে। রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব ছিল। এসব দল প্রধানত সাম্প্রদায়িক মুসলিম লীগের কর্মকান্ডের বিরােধিতা করতাে। তবে সাবেক পূর্ব পাকিস্তানে মুসলিম লীগের অবক্ষয় আগেই শুরু হয়েছিল। এর আলামত ঢাকায় গণ-আজাদী লীগ (পরবর্তীকালে সিভিল লিবারটিজ লীগ)। গঠিত হওয়ার মধ্য দিয়ে ফুটে ওঠে। সােহরাওয়ার্দী-হাশিম গ্রুপের কয়েকজন বিশিষ্ট মুসলিম লীগ কর্মীগণ আজাদী লীগ গঠন করে। আহসান মঞ্জিল গ্রুপ থেকে গণ আজাদী লীগের সদস্যগণ স্বতন্ত্র ছিলেন। হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী ১৯৪৮ সালে ব্যাপকভিত্তিক ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয় রাজনীতির কথা বলে পাকিস্তান ন্যাশনাল লীগ গঠনের প্রস্তাব দেন। কিন্তু তৎকালীন প্রাদেশিক পরিষদের টাঙ্গাইল আসনের উপনির্বাচনে মূল মুসলিম লীগের প্রার্থী খুররম খান পন্নী মুসলিম লীগের অভ্যন্তরীণ বিরুদ্ধবাদী কর্মী শামসুল হকের কাছে। বিপুল ভােটের ব্যবধানে পরাজিত হয়। মুসলিম লীগের কয়েকজন এমএলএ এবং কর্মী দলীয় নেতৃবৃন্দের অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপে হতাশ হয়ে ঢাকায় সম্মেলনের আয়ােজন করে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে গণমানুষের দল গঠন করে।
প্রকৃত অর্থে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ সাম্প্রদায়িক মনােভাবাপন্ন মুসলিম। লীগেরই ভিন্ন মতের সদস্যগণ একত্র হয়েছিলেন। এসব সদস্যের সামাজিক-অর্থনৈতিক পটভূমি মুসলিম লীগ সদস্যদের মতাে অভিন্ন হলেও সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক সব কর্মকাণ্ডে আঞ্চলিক স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার মনােভাব তাদের চেতনায় দৃঢ়ভাবে প্রােথিত ছিল। তবে দলের নাম থেকে মুসলিম” শব্দটি আনুষ্ঠানিকভাবে বাদ দেওয়া হলে ১৯৫৫ সালে ঐসব নেতা পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগে যােগ দিয়েছিলেন। তৎকালীন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে কেবল প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র বিষয় ও মুদ্রাব্যবস্থা ছেড়ে দিয়ে। প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টি আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে সর্বোচ্চ গুরুত্ব। পেয়েছিল। এ ছাড়া নিরাপত্তা আইন বাতিল, বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি প্রথা বিলােপ, পাট ব্যবসায় ও প্রধান প্রধান শিল্প জাতীয়করণ, রাজবন্দীদের মুক্তি ও নির্বাচনের বিষয়ও আওয়ামী লীগের বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান তার সাংগঠনিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিলেন যে, ১৯৪৯ সালে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে দল গঠনের বিষয় ছিল নির্যাতননিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য জনগণ ও বুদ্ধিজীবীগণের এক সমন্বিত প্রচেষ্টা। এ কথা অনস্বীকার্য যে, পূর্ব পাকিস্তানের জনসমাজের রাজনীতি সচেতন স্তরগুলিতে পরিবর্তনের প্রবল আকাঙ্ক্ষা নিঃসন্দেহে ছিল। এই আকাঙ্ক্ষাকে দাবিতে পরিণত করতে প্রায় বাইশ বছরের নিরবচ্ছিন্ন আন্দোলন হয়ে ওঠে স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম। সেই স্বাধীনতা সংগ্রাম পূর্ণতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায় ১৯৭০ সালে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে দল-মত নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল এবং মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিল। স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জনে যেমন ঐতিহাসিক-অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ আওয়ামী লীগের অবদান অনস্বীকার্য, তেমনি ধর্মনিরপেক্ষ আধুনিক সার্বভৌম জাতীয় সরকার গঠনেও আওয়ামী লীগের অবদান অবিস্মরণীয়।
সূত্র : বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১-৭৫ এইচ টি ইমাম