যশোর জেলার মহেশপুর থানার অধীন মহেশপুর হাসপাতালে পাকিস্তানী সেনাদের কার্যাবলী
মহেশপুর থানা থেকে মহেশপুর হাসপাতালের দূরত্ব প্রায় কোয়ার্টার মাইল হবে। খালিশপুর হতে একটা সরকারী কাঁচা রাস্তা মহেশপুর থানার পশ্চিম পার্শ্ব নিয়ে মহেশপুর গ্রামের মধ্য দিয়ে বর্ডার পর্যন্ত গিয়েছে। মহেশপুর হাসপাতালটা পূর্ব পশ্চিম লম্বা। হাসপাতালের সামনে একটা মাঠ, পূর্বে ১০/১২ খানা মুচি বাড়ী, পশ্চিমে মহেশপুর বাজার আর উত্তরে হাসপাতালের সঙ্গেই লাগানো সরকারী রাস্তা। ঐ রাস্তার নীচেই একটা মরা নদী এবং নদীর উপরে হাসপাতাল থেকে প্রায় ১০০ গজ দুরে উত্তর দক্ষিন দিক লম্বা একটা ব্রীজ।
১৯৭১ সালের ১৫ ই এপ্রিল খান সেনারা যশোর থেকে কালীগঞ্জ, কোটচাঁদপুর, খালিশপুর হয়ে মহেশপুর চলে আসে। মহেশপুর এসেই তারা মহেশপুর হাসপাতালে ঘাঁটি স্থাপন করে। তাদের মধ্য থেকে প্রায় ১৫০ জন মহেশপুর থানায় সব সময়ের জন্য রেখে দেয়। পাঞ্জাবী খান সেনারা মহেশপুর পৌছেই হিন্দু, আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ কর্মীদের বাড়ী-ঘর লুটপাট করায় এবং মুসলিম লীগ এবং জামায়াতে ইসলামের কর্মীদের ছাড়া যাদের সম্মুখে পায় তাদেরকেই গুলি করে মারে। খান সেনাদের মহেশপুর আসার পূর্বেই কিছু লোক ভারতে চলে যায় আর যারা ভারতে যায় নাই এখানেই আশেপাশে পালিয়ে বেড়াচ্ছিল তাদেরকে ধরে নিয়ে সোজাসুজি হাসপাতলে নিয়ে যেত এবং সেখানে নিয়ে একটি রুমে বন্দী করে রাখত। মেজর আনিছ ছিলেন প্লাটুন ক্যাপ্টেন। খান সেনারা এইভাবে মহেশপুর, কোটচাঁদপুর, কালীগঞ্জ, খালিশপুর ইত্যাদি স্থান হতে লোকজনকে ধরে কাউকে সেখানেই গুলি করে মারত আর যাদের মারত না তাদের মহেশপুর হাসপাতালে নিয়ে এসে একটা বদ্ধ ঘরে বন্দী করে রেখে দিত। তারা প্রতিদিন সন্ধ্যায় ১০/১২ জনকে বের করে নিয়ে হাসপাতালের এরিয়ার মধ্যেই হাসপাতাল থেকে প্রায় ৫০ গজ দূরে ৫০/৬০ টা গর্ত করা আছে সেখানে নিয়ে কাউকে জবাই করত, কাউকে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে মারত, আবার কাউকে লাইন করে গুলি করে মারত। প্রতিদিন সন্ধ্যায় নাকি ২/৩ রাউন্ড গুলির শব্দ মহেশপুর বাজারের লোকজন পেত। প্রতিদিন সন্ধ্যায় গুলি করে লোক মারার খবর মহেশপুরের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে গেল। তখন থেকে খান সেনারা শুধু গর্তের ধারে নিয়ে জবাই করত আর বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে মারত এবং অনেককে ভালায়পুর ব্রিজের উপর নিয়ে জ্যান্ত অবস্থায় একটি বস্তায় ভর্তি করে বস্তার মুখ বেঁধে ব্রীজের উপর হতে ফেলে দিত। এ ভাবেই তারা জনসাধারনকে মেরেছে। আবার বিভিন্ন এলাকা থেকে সুন্দরী মেয়েদের ধরে এনে ৪/৫ দিন পাশবিক অত্যাচার করার পর তাদেরকেও ঐ সব গর্তে মেরে পুঁতে রাখত। এইভাবে প্রায় ৩/৪ শত লোককে একমাত্র হাসপাতালে মারা হয়েছে। কেননা বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরপরই মহেশপুরের স্থানীয় জনসাধারণ সেখানে গিয়ে নাকি দেখতে পায় হাসপাতালের পূর্ব দিকে মানুষের গন্ধে যাওয়া যায় না। অনেক কষ্টে নাকে কাপড় দিয়ে তারা গিয়ে দেখতে পায়, প্রায় ৬০ টির মত গর্ত করা প্রতি গর্তে ৫/৭ টি করে কারও মাথা, কারও ডানা, কারও পা, কারও শরীরের অংশটাই পড়ে আছে। যদিও দীর্ঘ এক বছর পার হয়ে গেছে এবং সেখানে কোন নিদর্শন থাকার কথা নয়। আমি নিজে সেখানে গিয়ে দীর্ঘ একটা বছর পরও একটা মানুষের মাথা, প্রায় ২০/২৫ টা গর্ত ও মানুষের অনেক হাড় পাই।
স্বাক্ষর/-
দেবাসীষ দাস