You dont have javascript enabled! Please enable it!

প্রশাসনিক কাঠামাে পুনর্বিন্যাস

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের জন্মলগ্ন ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল। পঁচিশে মার্চের ‘ভয়াল রাতের পর আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারি তাজউদ্দীন আহমদ, ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলামকে নিয়ে ২৭ মার্চ প্রথমে ঝিনাইদহ যান। মার্চের ৩০ তারিখে পশ্চিমবাংলা সরকারের সঙ্গে যােগাযােগ করে তারা ০২ এপ্রিল দিল্লি গিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাহায্য ও সহযােগিতার প্রতিশ্রুতি পেয়ে তাজউদ্দীন আহমদ আওয়ামী লীগের এমএনএ এবং এমপিএ-দের কুষ্টিয়া জেলার সীমান্তে অধিবেশন আহ্বান করেন। ওই অধিবেশনে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে কার্যকর স্বাধীনতার ঘােষণা প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। অধিবেশনে উপস্থিত এমএনএ ও এমপিএ-গণ সর্বসম্মতিক্রমে মুক্তিযুদ্ধ ও সরকার পরিচালনার জন্য মন্ত্রিসভা গঠন করেন। অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি ও সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপতি নিযুক্ত এবং তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী, ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী, খন্দকার মােশতাক আহমেদ ও এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে মন্ত্রিসভার সদস্য নিয়ােগ করা হয়। এভাবে ওই অধিবেশনে ১০ এপ্রিল সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। প্রধানমন্ত্রী ১১ এপ্রিল বাংলাদেশ বেতারে মন্ত্রিসভা গঠনের ঘােষণা দেন। উপরাষ্ট্রপতি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে এবং মন্ত্রিসভার সদস্যগণ মন্ত্রী হিসেবে ১৭ এপ্রিল ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তসংলগ্ন মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলায় শত শত দেশি-বিদেশি সাংবাদিকের সামনে শপথ গ্রহণ করেন। এতে সারা পৃথিবীতে ব্যাপক চাঞ্চল্য ও সাড়া পড়ে যায়। স্বাধীনতার ঘােষণাপত্রই (Proclamation of Independence) বাঙালি জাতির ম্যাগনাকার্টা, স্বাধীনতার সনদ। এই ঘােষণাপত্র ছিল নিম্নরূপ :

স্বাধীনতার ঘােষণাপত্র

(১০ এপ্রিল, ১৯৭১) যেহেতু ১৯৭০ সালের ০৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালের ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত একটি শাসনতন্ত্র রচনার অভিপ্রায়ে প্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য বাংলাদেশে অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল

এবং

যেহেতু এই নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণ তাদের ১৬৯ জন প্রতিনিধির মধ্যে ১৬৭ জনই আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত করেছিলেন।

|

এবং

যেহেতু জেনারেল ইয়াহিয়া খান একটি শাসনতন্ত্র রচনার জন্য ১৯৭১ সালের ০৩ মার্চ। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অধিবেশন আহ্বান করেন।

এবং

যেহেতু আহূত এ পরিষদ স্বেচ্ছাচার ও বেআইনিভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘােষণা করা হয়।

এবং

যেহেতু পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠী তাদের প্রতিশ্রুতি পালনের পরিবর্তে বাংলাদেশের গণপ্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপ-আলােচনা চলাকালে একটি অন্যায় ও বিশ্বাসঘাতকতামূলক যুদ্ধ ঘােষণা করে।

| এবং যেহেতু উল্লেখিত বিশ্বাসঘাতকতামূলক কাজের জন্যে উদ্ভূত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতা ঘােষণা করেন এবং বাংলাদেশের অখণ্ডতা ও মর্যাদা রক্ষার জন্যে বাংলাদেশের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান।

এবং যেহেতু পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী একটি বর্বর ও নৃশংস যুদ্ধ পরিচালনাকালে বাংলাদেশের অসামরিক ও নিরস্ত্র জনসাধারণের বিরুদ্ধে অগুনতি গণহত্যা ও নজিরবিহীন নির্যাতন চালিয়েছে এবং এখনাে চালাচ্ছে।

 এবং যেহেতু পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী অন্যায় যুদ্ধ, গণহত্যা ও নানাবিধ নৃশংস অত্যাচার চালিয়ে বাংলাদেশের জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের একত্র হয়ে একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করতে ও নিজেদের সরকার গঠন করতে সুযােগ করে দিয়েছে

এবং

যেহেতু বাংলাদেশের জনগণ তাদের বীরত্ব, সাহসিকতা ও বিপ্লবী কার্যক্রমের দ্বারা বাংলাদেশের ভূ-খণ্ডের উপর তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে

সেহেতু সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের পক্ষে যে রায় দিয়েছে, সে মােতাবেক আমরা, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আমাদের সমবায়ে গণপরিষদ গঠন করে পারস্পরিক আলাপ-আলােচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের জন্যে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা আমাদের পবিত্র কর্তব্য বিবেচনা করে আমরা বাংলাদেশকে সার্বভৌম গণপ্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্ত ঘােষণা করছি এবং এতদ্বারা পূর্বাহ্নে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘােষণা অনুমােদন করছি

এবং

এতদ্বারা আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘােষণা করছি যে, শাসনতন্ত্র প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপ্রধান ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপরাষ্ট্রপ্রধান পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন।

এবং

রাষ্ট্রপ্রধান প্রজাতন্ত্রের সশস্ত্রবাহিনীসমূহের সর্বাধিনায়ক হবেন, রাষ্ট্রপ্রধানই ক্ষমা প্রদর্শনসহ সর্বপ্রকার প্রশাসনিক ও আইন প্রণয়নের ক্ষমতার অধিকারী হবেন, তিনি একজন প্রধানমন্ত্রী ও প্রয়ােজনবােধে মন্ত্রিসভার অন্যান্য সদস্য নিয়ােগ করতে পারবেন, রাষ্ট্রপ্রধানের কর ধার্য ও অর্থব্যয়ের এবং গণপরিষদের অধিবেশন আহ্বান ও মুলতুবির ক্ষমতা থাকবে এবং বাংলাদেশের জনগণের জন্যে আইনানুগ ও নিয়মতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্যে অন্যান্য সকল ক্ষমতারও তিনি অধিকারী হবেন। বাংলাদেশের জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে আমরা আরও সিদ্ধান্তঘােষণা করছি, যে-কোনাে কারণে যদি রাষ্ট্রপ্রধান না থাকেন অথবা কাজে যােগদান করতে না পারেন অথবা তার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে যদি অক্ষম হন, তবে রাষ্ট্রপ্রধানকে প্রদত্ত সকল ক্ষমতা ও দায়িত্ব উপ-রাষ্ট্রপ্রধান পালন করবেন। আমরা আরও ঘােষণা করছি যে, বিশ্বের একটি জাতি হিসেবে এবং জাতিসংঘের সনদ মােতাবেক আমাদের উপর যে দায়িত্ব ও কর্তব্য আরােপিত হয়েছে তা আমরা যথাযথভাবে পালন করব। আমরা আরও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছি যে, আমাদের স্বাধীনতার এ ঘােষণা ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে কার্যকরী বলে গণ্য হবে। আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘােষণা করছি যে, আমাদের এই সিদ্ধান্ত কার্যকরী করার জন্যে

আমরা অধ্যাপক ইউসুফ আলীকে ক্ষমতা দিলাম এবং রাষ্ট্রপ্রধান ও উপ-রাষ্ট্রপ্রধানের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করলাম। উপযুক্ত স্বাধীনতার ঘােষণাপত্রটি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত “বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (তৃতীয় খণ্ড)” শীর্ষক গ্রন্থের ৪-৬ পৃষ্ঠায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। স্বাধীনতার ঘােষণাপত্রের ভিত্তি ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘােষণার বার্তা। ঢাকায় সেনা-অভিযান শুরু হওয়ার পরপরই বঙ্গবন্ধু ২৫ মার্চ মধ্যরাতে তকালীন পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস-এর ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে বাংলাদেশের সর্বত্র প্রচারের জন্যে চট্টগ্রামে একটি বার্তা প্রেরণ করেছিলেন। স্বাধীনতার ঘােষণা সংবলিত বার্তা ছিল নিম্নরূপ : “This may be my last message, from today Bangladesh is independent. I call upon the people of Bangladesh where you might be and with whatever you have, to resist the army of occupation to the last. Your fight must go on until the last soldier of the Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh and final victory is achieved.” “(এটাই হয়তাে আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের মানুষ যে যেখানে আছেন, আপনাদের যা কিছু আছে তা দিয়ে সেনাবাহিনীর দখলদারির মােকাবিলা করার জন্য আমি আহ্বান জানাচ্ছি। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে উৎখাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আপনাদের সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।) ওপরের স্বাধীনতার ঘােষণাবার্তার ভিত্তিতে প্রচারিত স্বাধীনতার ঘােষণাপত্রে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল “আইনের ধারাবাহিকতা প্রয়ােগ আদেশ-১৯৭১ (Laws Continuance Enforcement (Order-1971)” জারি করেছিলেন। এই আদেশ ছিল নিম্নরূপ :

আইনের ধারাবাহিকতা ও প্রয়োেগ আদেশ-১৯৭১

মুজিবনগর ১০ এপ্রিল, ১৯৭১ আমি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, বাংলাদেশের উপরাষ্ট্রপতি এবং অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিলের স্বাধীনতার ঘােষণাপত্রে আমাকে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে এই মর্মে আদেশ প্রদান করছি যে, বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছার পরিপ্রেক্ষিতে গঠিত স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের সৃষ্টি হওয়ায় ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বাংলাদেশে যেসব আইন ও বিধিবিধান কার্যকর ছিল সে-সমস্তই প্রয়ােজনীয় অবস্থাগত পরিবর্তনসহ পূর্বোক্ত ঘােষণা সাপেক্ষে বলবৎ থাকবে এবং সকল সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, বেসামরিকসামরিক, বিচার-বিভাগীয়, কূটনৈতিক যারা বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্যের শপথগ্রহণ করবেন তারা সকলেই তাদের স্ব স্ব পদে চাকুরিবিধির শর্তানুযায়ী যেভাবে কর্মরত ছিলেন তারা সেভাবেই কর্মরত থাকবেন এবং বাংলাদেশ ভূখণ্ডের সকল জেলা জজ ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং অন্যত্র কর্মরত কূটনৈতিক প্রতিনিধিবৃন্দ তাদের আওতাধীন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আনুগত্যের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনার ব্যবস্থা করবেন। এই আদেশ ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে কার্যকর হয়েছে বলে গণ্য হবে। স্বা: সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি।

Laws Continuance Enforcement Order-1971 Mujibnagar Dated 10″ day of April 1971 al, Syed Nazrul Islam, the Vice President and Acting President of Bangladesh, in exercise of the powers conferred on me by the Proclamation of Independence dated tenth day of April 1971 do hereby order that all laws that were in force in Bangladesh on 25 March, shall subjcct to the Proclamation aforesaid contiune to be so in force with such consequential changes as may be necessary on account of the creation of the sovereign independent State of Bangladesh formed by the will of the people of Bangladesh and that all government officials civil, military, judicial and cliplomatic who take the oath of allegience to Bangladesh shall contiunc in their offices on terms and conditions of services so long cnjoyed by them and that all District Judges and District Magistrates, in the territory of Bangladesh and all diplomatic representatives else where shall arrange to administer the oath of allegience to all government officials within their jurisdiction. This order shall deemed to have come into effect from 26th day of March 1971.

Signed: Syed Nazrul Islam Acting President

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বহর বড় ছিল না বটে, তবে তা সুসংগঠিত ছিল এবং রাষ্ট্রের সব ধরনের কাজ সুশৃঙ্খলভাবে এগিয়ে নিতে ব্ৰতী ছিল। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রচণ্ড স্নায়ু চাপের মধ্যে থেকেও এই সরকার প্রশাসনিক সব কাজ সম্পন্ন করেছে। প্রতিকূলতার মধ্যেও সরকারের প্রশাসনিক সব কাজ যেমন সম্পন্ন হয়েছে তেমনি মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় নেতৃত্ব দানসহ ভিটেমাটি ছেড়ে যাওয়া প্রায় এক কোটি শরণার্থীর ত্রাণব্যবস্থাও করেছে। লাখ লাখ মুক্তিপাগল ছাত্র-জনতা-তরুণ-তরুণীকে যুবশিবিরে প্রশিক্ষণ দিয়ে মুক্তিবাহিনী ও গেরিলাবাহিনী গঠন করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের সমুচিত জবাব দেয়। স্বাধীন বাংলা বেতারের মাধ্যমে বাঙালি জনগণকে উদ্বুদ্ধ রাখাসহ সমগ্র পৃথি বীতে পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলে আলােড়ন সৃষ্টি করে। সমকালীন ইতিহাসে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের এসব কাজ অতুলনীয় বললে অত্যুক্তি হয় । মুক্তিযুদ্ধের মাত্র নয় মাসকালে স্বাধীন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সরকারের কার্যাবলিই শক্রমুক্ত বাংলাদেশের গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রেরণা ও ভিত্তি ছিল। বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বাঙালি জাতির প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে উৎখাত করতে এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যেতে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করে পরাজয় বরণ করতে বাধ্য হয়েছিল। বাঙালি জাতি চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে ১৬ ডিসেম্বর। | প্রাসঙ্গিকভাবে প্রথম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সদর দপ্তরে প্রতিষ্ঠিত শক্তিশালী প্রশাসনব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ চিত্র তুলে ধরা হলাে। এই সরকারের অস্থায়ী সদর দপ্তর পশ্চিমবাংলার কোলকাতায় অবস্থিত ছিল। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দপ্তরও একই সঙ্গে ছিল। প্রথম বাংলাদেশ সরকারের শক্তিশালী প্রশাসন গঠনে যাদের ঐতিহাসিক ভূমিকা ছিল তা এখানে উল্লেখ করা বিশেষভাবে প্রয়ােজন। কারণ, এঁরা যে ঐতিহ্য এবং ধারার সূত্রপাত করেছিলেন তা-১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে হত্যার পর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে ছেদ পড়ে। জননেত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৬-২০০১ সালের এবং বর্তমান শাসনামলে ঐতিহ্যের ওই ধারা পুনরায় ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার হচ্ছে। | প্রথম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসন গঠনে নিচে উল্লিখিত ব্যক্তিদের নাম ঐতিহাসিক কারণেই স্মরণীয়। এঁরা হলেন : প্রথম বাংলাদেশ সরকারের কর্মকর্তাবৃন্দ জনাব রুহুল কুদুস, প্রাক্তন সিএসপি জনাব এইচ. টি. ইমাম। (পার্বত্য চট্টগ্রামের ডিসি) খন্দকার আসাদুজ্জামান, সিএসপি (যুগ্মসচিব, অর্থ মন্ত্রণালয়)

প্রশাসনে পদবি মহাসচিব মন্ত্রিপরিষদ সচিব

অর্থসচিব

উপযুক্ত কর্মকর্তাবৃন্দ ছাড়া প্রথম বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও বেতারের ভারপ্রাপ্ত দায়িত্বে ছিলেন জনাব আবদুল মান্নান এমএনএ। মুক্তিযুদ্ধকালে গঠিত যুবশিবির বাের্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন অধ্যাপক ইউসুফ আলী এমএনএ এবং পরিচালক ছিলেন উইং কমান্ডার মির্জা। প্রথম বাংলাদেশ সরকারের কর্মকর্তাবৃন্দের মধ্যে জনাব মাহবুবুল আলম চাষী, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ পরবর্তীকালে ঐতিহ্যচ্যুত হয়েছেন।

মুক্তিযুদ্ধে জয়লাভ বাঙালি জাতির জন্য ছিল এক নিশ্চিত বিশ্বাস। তাই, যুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশ গড়ে তুলতে অগ্রিম কিছু কর্মসূচির পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এতে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর বঙ্গবন্ধুর প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে গড়া সরকারের সুবিধাই হয়েছিল। প্রথম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের আগাম পরিকল্পনার মূল্য লক্ষ্য ছিল, (ক) পুলিশ। প্রশাসন ও বিচার-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে আইনশৃঙ্খলা পুনঃস্থাপন; (খ) বেসামরিক প্রশাসন চালু করে সরকারের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা; (গ) ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসন; (ঘ) দেশের অভ্যন্তরেই বিরাট সংখ্যক অধিবাসী যারা ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র নিরাপদ আশ্রয়ে ছিল তাদের পুনর্বাসন (ঙ) এসব শরণার্থী এবং বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের পুনর্বাসনে প্রয়ােজনীয় গৃহনির্মাণ সামগ্রী সংগ্রহ, চাষাবাদের উপকরণ ও গবাদিপশু সরবরাহ; (চ) বিধ্বস্ত সড়ক ও সেতু সংস্কার এবং ভৌত অবকাঠামাে পুনর্নির্মাণ, নদীপথগুলােকে নৌচলাচলের উপযােগীকরণ এবং (ছ) শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা দ্রুত সংস্কারসাধন ইত্যাদি। দূরদর্শী প্রথম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার অগ্রিম পরিকল্পনা সেলও গঠন করেছিলেন। এটি পরবর্তকিলে পরিকল্পনা বাের্ডে রূপান্তরিত হয়।

মুক্তিযুদ্ধকালে এবং শত্রুমুক্ত হওয়ার অব্যবহিত পরের পটভূমিতে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রশাসনব্যবস্থা সুসংহত করতে সরকারকে অসম্ভব চাপের মুখে পড়তে হয়েছিল। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের পর সারা দেশে স্থিতিশীল পরিবেশ প্রতিষ্ঠা করতে ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর থেকে নবনিযুক্ত ডেপুটি কমিশনার এবং এসপিদের স্বাধীন বাংলা বেতার এবং টেলিগ্রাম মারফত সরাসরি নির্দেশ দেওয়া শুরু হয়। প্রশাসনিক কর্তৃত্ব নিতে এই পন্থা অবলম্বন করতে হয়। সরকারি কাজকর্ম নতুন করে ঢেলে সাজানাের প্রয়ােজনীয়তা। প্রবলভাবে অনুভূত হয়। বাংলাদেশের প্রতি যাদের আনুগত্য সম্বন্ধে কোনাে সংশয় ছিল। , কালবিলম্ব না করে প্রশাসনের বিভিন্ন পদে তাদের নিয়ােগ করা হয়েছিল। বেসামরিক প্রশাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠার কর্মসূচি কাগজপত্রে যত নির্ভুলভাবে ব্যক্ত হােক, প্রায় নয় মাস দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতাযুদ্ধের পর সারা দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রের মতাে প্রশাসন ক্ষেত্রেও কিছু বিপর্যস্ত অবস্থা বিদ্যমান ছিল। মানুষের মনােবল ও সংহতি প্রশাসন ব্যবস্থাকে সুসংহত ও দৃঢ় করে রেখেছিল। ঢাকায় ফিরে ১৯৭১ সালের এপ্রিলে গঠিত বাংলাদেশ সরকারের প্রথম মন্ত্রিসভা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭১ সালের ২৩ ডিসেম্বর ।  পাকিস্তানের কারাগারে অন্তরীণ বঙ্গবন্ধুর জন্য মন্ত্রিসভার সদস্যগণের উৎকণ্ঠা এবং উদ্বেগ ছিল সীমাহীন। তাদের ও বিদেশে অবস্থানরত বাঙালি কূটনীতিকগণসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের হিতৈষী রাজনৈতিক নেতা এবং সাধারণ জনগণের দাবির মুখে পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি ভােরে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনসের একটি বিশেষ বিমানে লন্ডন যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়। লন্ডন থেকে ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু ঢাকায় পৌছেই বাংলাদেশের শাসনক্ষমতা হাতে নেন। পরের দিন (১১ জানুয়ারি) মন্ত্রিসভার সঙ্গে দু’দফা বৈঠক করেন এবং বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি স্বাধীনতার ঘােষণাপত্রে (Proclamation of Independence) প্রদত্ত ক্ষমতা বলে রাষ্ট্রপতির সাময়িক সংবিধান আদেশ, ১৯৭২” জারি করেন। এই আদেশের মধ্য দিয়ে সদ্য স্বাধীন দেশ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বিধিসম্মতভাবে অগ্রসর হতে প্রয়াসী হয়। সাময়িক সংবিধান আদেশের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথমে বিচারপতি আবু সাদত মােহাম্মদ সায়েমকে প্রধান বিচারপতি নিয়ােগ করেছিলেন এবং ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি প্রধান বিচারপতির কাছে রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে পদত্যাগ ঘােষণা করেন।

আগেই জারিকৃত রাষ্ট্রপতির সাময়িক আদেশের সংশ্লিষ্ট ধারা অনুযায়ী তকালে বিদ্যমান (প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, এম. মনসুর আলী, এ. এইচ. এম কামারুজ্জামান এবং খন্দকার মােশতাক আহমদ) মন্ত্রিসভা বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিয়ােগ করলে প্রধান বিচারপতি তাকে শপথবাক্য পাঠ করান। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন। আহমেদসহ মন্ত্রিসভার সদস্যগণ রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হওয়ার পর পদত্যাগ করেন। মহামান্য রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী পূর্বোক্ত সাময়িক আদেশের ধারা অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রী নিয়ােগ করেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর ১১ সদস্য বিশিষ্ট মন্ত্রিসভা গঠনের ঘােষণা দেন। ওই সাময়িক আদেশের ধারা বলে রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী প্রধানমন্ত্রী এবং অন্যান্য মন্ত্রীদের শপথবাক্য পাঠ করান। এভাবে বিধিবদ্ধভাবে নতুন সরকার গঠিত হয়। বাংলাদেশ গেজেটের অতিরিক্ত সংখ্যায় ১৯৭২ সালের ১৩ জানুয়ারি তারিখে বঙ্গবন্ধুর শপথগ্রহণ, পদত্যাগ, রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নিয়ােগ ও দায়িত্বভার গ্রহণ, পূর্বতন মন্ত্রিসভার সদস্যগণের পদত্যাগ এবং তা নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি কর্তৃক গ্রহণ, নতুন রাষ্ট্রপতি কর্তৃক বঙ্গবন্ধুকে প্রধানমন্ত্রী নিয়ােগ এবং প্রধানমন্ত্রীর মনােনীত নতুন মন্ত্রিসভার নিয়ােগসংক্রান্ত গেজেট বিজ্ঞপ্তি এবং রাষ্ট্রপতির আদেশ সর্বসাধারণের অবগতির জন্য প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছিল। এসব প্রজ্ঞাপন ১৪ থেকে ২০ সংখ্যক পরিশিষ্টে সংযােজিত হয়েছে। ১৯৭২ সালের ১৩ জানুয়ারি প্রকাশিত ক্যাব-১২০ থেকে ক্যাব-১২৬ পর্যন্ত বিজ্ঞপ্তি।

প্রসঙ্গত একটি বিষয় এখানে উল্লেখ না করলেই নয়। ঢাকা শত্রুমুক্ত হয় ১৬ ডিসেম্বর (১৯৭১)। সেদিন ঢাকায় সরকারের অবস্থান মােটেই সুদৃঢ় ছিল না। উল্লেখ করতেই হয়, সে-সময় প্রশাসনিক শূন্যতা স্পষ্টতই দেখা দিয়েছিল। রাজধানী ঢাকা এবং দেশের সর্বত্র এই অবস্থা বিরাজমান ছিল। প্রথম বাংলাদেশ সরকার কার্যত ভারতের ভূখণ্ড কোলকাতায় অবস্থান করছিল এবং ঢাকা তথা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে তৎকালীন প্রশাসনিক কর্মকর্তাকর্মচারী ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ছিলেন পাকিস্তান সরকারের দখলাধীন কার্যালয়সমূহে কর্মরত। দেশ শত্রুমুক্ত হলেও ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকারের কোনাে প্রশাসন কার্যকরভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তবে, স্বাধীন দেশের জনগণের স্বতঃস্ফুর্ত ও আন্তরিক সহযােগিতার কারণে দেশের প্রশাসন পরিচালনায় তেমন গুরুতর কোনাে সঙ্কট দেখা দেয়নি। সরকারি অফিসে অভ্যাসবশেই কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দ হাজির হয়েছিলেন তাদের স্ব স্ব দায়িত্ব পালনের জন্য। তবে এক বিশেষ ধরনের সমস্যা দেখা যায়। স্মর্তব্য, বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের আগে এই ভূখণ্ড পূর্ব পাকিস্তান নামে অভিহিত ছিল। তক্কালে পূর্ব পাকিস্তান সমগ্র পাকিস্তানের পাঁচটি প্রদেশের মধ্যে একটি প্রদেশ হিসেবে গণ্য হতাে । উল্লেখ্য, পাকিস্তানের শাসনব্যবস্থা ছিল দুই পর্যায়ভুক্ত, কেন্দ্রীয় সরকার-ব্যবস্থা এবং প্রাদেশিক সরকারব্যবস্থা ।  ফলে, পূর্ব পাকিস্তানের তঙ্কালীন ঢাকায় সরকারব্যবস্থা তথা সরকারি দফতরগুলােও ছিল দুই ধরনের। প্রথমটি হলাে প্রাদেশিক সরকারের দফতরসমূহ এবং দ্বিতীয়টি কেন্দ্রীয় সরকারের শাখা অফিসগুলাে। প্রসঙ্গত ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দফতরকে কেন্দ্রীয় সরকারের একটি শাখা অফিসের দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করা যায় । বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পূর্ব পর্যন্ত (১০ জানুয়ারি ১৯৭২) বাংলাদেশের প্রশাসনিক কাঠামাে পুরােপুরি পুনর্বিন্যস্ত হতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী একটি দেশের আবির্ভাব আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রচুর আগ্রহ সৃষ্টি করেছিল । বিদেশি অসংখ্য সাংবাদিক ১৬ ডিসেম্বর তারিখের পর মুহূর্ত থেকেই ঢাকায় এসে উপস্থিত হতে থাকে। অধিকন্তু লক্ষ করা যায় | যে, বেশ উল্লেখযােগ্যসংখ্যক বিদেশি কনস্যুলেট জেনারেল এবং ডেপুটি হাইকমিশনারের দফতর ঢাকায় রয়েছে। এর অর্থ এই যে, ঢাকায় তখনাে ছােট আকারে হলেও একটি কূটনৈতিক গােষ্ঠীর অস্তিত্ব বিদ্যমান ছিল। এদের কাজে লাগানাের প্রয়ােজনে বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড এবং তৎপরতা প্রদর্শনের আবশ্যকতা অনুভূত হচ্ছিল।

ঢাকায় বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠা এবং সচল করার প্রয়ােজনীয় আয়ােজন সম্বন্ধে এসব বিদেশি কূটনীতিক এবং সাংবাদিকদের মধ্যেও ছিল প্রচুর ঔৎসুক্য। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের কাছেও যুদ্ধোত্তর পর্বে ঢাকা তথা সারা দেশের প্রশাসনব্যবস্থা সুসংহত করা ছিল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। | মুক্তিযুদ্ধকালে ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের তৃতীয় সপ্তাহে বেসামরিক প্রশাসনব্যবস্থা গড়ে তােলা হয়েছিল, প্রধানত যুদ্ধ-পরিচালনা ও অন্যান্য প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড চালানাের উপযােগী করে। সেদিন মন্ত্রিসভা ছােট পরিসরে গঠিত হলেও তা ছিল খুবই শক্তিশালী। | সারা পাকিস্তানে তত্ত্বালে যেসব মন্ত্রণালয়ের অস্তিত্ব ছিল তার প্রায় সবগুলােই বাংলাদেশ | সরকারেরও ছিল। প্রচলিত ধারার মন্ত্রণালয় নিয়ে বাংলাদেশ সরকার গঠিত হলেও এই সরকারকে বাঙালি জাতির ওপর অতর্কিতে চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধপরিচালনার মতাে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে হয়। তদুপরি, ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী প্রায় এক কোটি শরণার্থীর খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ইত্যাদির ব্যবস্থা করতে হয়েছিল প্রথম বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসনকে।

বাংলাদেশ সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে সরকারের যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী ব্যাপক অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়েছিলেন তাঁদের এবং যুদ্ধকালে দেশের অভ্যন্তরে থেকে যেসব বাঙালি দেশপ্রেমিক কর্মকর্তা-কর্মচারী বাংলাদেশের প্রতি অনুগত ছিলেন তাদের সবাইকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু তার নেতৃত্বাধীন সরকার পরিচালনায় আত্মনিয়ােগ করেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতি, প্রশাসনব্যবস্থা সবই বিপর্যস্ত অবস্থায় ছিল। যুদ্ধ শেষে অসংখ্য সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু তার গঠিত সরকার নিয়ে। তিনি | হিমালয় পর্বতের মতাে অটল থেকে দেশের সব সমস্যার মােকাবিলা করতে তার সরকারের প্রশাসন-ব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে আত্মনিয়ােগ করেছিলেন। সাবেক পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারব্যবস্থার বিলােপ ঘটিয়ে স্বাধীন দেশের জাতীয় কেন্দ্রীয় কাঠামাে হিসেবে দ্রুত রূপান্তরিত করার পাশাপাশি জেলা কাঠামাে পুনরুদ্ধার করার উদ্যোগ নেয় বঙ্গবন্ধুর সরকার। এই লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় নিয়ােজিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারী এমনকি পাকিস্তান প্রত্যাগত কর্মকর্তাকর্মচারীদেরও যথাযােগ্য মর্যাদায় বহাল করা হয়েছিল। তাদের চাকুরির ধারাবাহিকতাও অব্যাহত রাখা হয়। দেশের প্রশাসন-ব্যবস্থায় সামঞ্জস্য বিধানের ব্যবস্থাও বঙ্গবন্ধুর সরকার গ্রহণ করেছিল। বেসামরিক প্রশাসন পুনর্বিন্যাস কমিটি বঙ্গবন্ধুর সরকার চাকরি পুনর্বিন্যাস তথা প্রশাসন-ব্যবস্থা সুসংহত করার আগে প্রথম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংস্থাপন বিভাগ ১৯৭১ সালের ২৭ ডিসেম্বর জি.এ. ৪/৪১৭/৭১-১৫৭৩ সংখ্যক প্রজ্ঞাপন দ্বারা বেসামরিক প্রশাসন পুনর্বিন্যাস কমিটি (Civil Administration Restoration Committed) গঠন করে। এই কমিটিকে সরকারের বিভিন্ন স্তরের বেসামরিক প্রশাসনব্যবস্থা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তা পুনর্বিন্যাসকরণ এবং তৎকালীন পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/দফতরসমূহের কর্মকর্তাকর্মচারীদের আত্তীকরণ এবং সাবেক কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের মন্ত্রণালয়/দফতরের সঙ্গে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/দফতরের একত্রীকরণের উপায় ও পন্থা সম্বন্ধে সুপারিশ করার দায়িত্ব দেওয়া হয় (পরিশিষ্ট-৪৮)। এই কমিটি নিম্নলিখিতভাবে গঠিত হয়েছিল :

(১) জনাব এম.এম. জামান, চেয়ারম্যান, টি বাের্ড.. …………. চেয়ারম্যান। (২) জনাব মােহাম্মদ আলী, ও.এস.ডি., যােগাযােগ, ….সদস্য।। (৩) জনাব এম.এ. মজিদ, ডেপুটি সেক্রেটারি ও অ্যান্ড এম (সংস্থাপন বিভাগ), সাবেক পাকিস্তান সরকার, ঢাকা,

..সদস্য। (৪) জনাব নজমুল আবেদীন খান, সাবেক ডিসি, পাবনা,……………সদস্য। (৫) জনাব এম, কে, আলমগীর, ডি, এস, অর্থ মন্ত্রণালয়…….সদস্য সচিব।

উপযুক্ত কর্মকর্তা সমন্বয়ে গঠিত কমিটির নিম্নলিখিত বিষয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সুপারিশ প্রদানের দায়িত্ব ছিল : (ক) স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রাক্কালে বিদ্যমান মহকুমা, জেলা এবং বিভাগীয় পর্যায়ে।

বেসামরিক প্রশাসনব্যবস্থা পুনর্বিন্যাসের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের অপেক্ষায় ছিল তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে পুনর্বিন্যস্তের উপায় ও পন্থার বিষয়ে সুপারিশ প্রদান। (খ) যেভাবে প্রশাসনব্যবস্থা পুনর্বিন্যস্ত হবে তার অগ্রাধিকার ও পর্যায় নির্ধারণ। (গ) সাবেক পাকিস্তান সরকারের দফতরগুলােকে একত্রীকরণ এবং কর্মকর্তা কর্মচারীদের বাংলাদেশ সরকারের সদৃশ মন্ত্রণালয়সমূহের সঙ্গে আত্তীকরণের পন্থা ও উপায় সম্বন্ধে সুপারিশ। (ঘ) বেসামরিক প্রশাসনের অন্য যে কোনাে বিষয় যা কমিটি বাঞ্ছনীয় ও প্রয়ােজনীয়

মনে করে তা বিবেচনা । কমিটি প্রয়ােজন মনে করলে অন্য যেকোনাে সদস্যকে সহযােজন (Co-opt) করতে পারবে এবং তার পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশ যত দ্রুত সম্ভব উপস্থাপন করবে। তৎকালীন সরকারের সংস্থাপন সচিব এম. নূরুল কাদের এই প্রজ্ঞাপন জারি। করেছিলেন। প্রজ্ঞাপনের কপি কমিটির সব সদস্য, মন্ত্রণালয়/বিভাগগুলাের দায়িত্বপ্রাপ্ত সচিববৃন্দ, সাবেক কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক অধিদপ্তর/কার্যালয়ের প্রধানগণ, সব বিভাগীয় কমিশনার, উপকমিশনার এবং মহকুমা প্রশাসকবৃন্দের কাছে প্রেরিত হয়েছিল। সংস্থাপন বিভাগের ও অ্যান্ড এম উইং-এর গবেষণা কর্মকর্তা জনাব টি, আহমেদকে কমিটিতে সহযােজন করা হয়েছিল।  এই কমিটি ১৯৭২ সালের ০৪ জানুয়ারি বেসামরিক প্রশাসন পুনর্বিন্যাস সংক্রান্ত প্রতিবেদনের প্রথম অংশ সরকারের নিকট পেশ করেছিল। প্রতিবেদনের সঙ্গে কমিটি যে পত্র দিয়েছিল তাতে বলা হয় যে, প্রজ্ঞাপনে বর্ণিত বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে প্রতিবেদনের এই অংশ প্রস্তুত করা হয়েছে। কমিটি আরাে উল্লেখ করে যে, প্রতেবেদনটি যেভাবে প্রস্তুত করার প্রয়ােজন ছিল সেভাবে এটি না হলেও কমিটির লক্ষ্য ছিল বিদ্যমান জরুরি অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে যত দ্রুত সম্ভব প্রতিবেদন পেশ করা । কমিটি প্রতিবেদনটির প্রেরণ-পত্রে উল্লেখ করে যে, সাংগঠনিক কাঠামাে সম্পর্কে সিদ্ধান্তে পৌঁছতে এই প্রতিবেদন সরকারের জন্য সহায়ক হবে। একই চিঠিতে কমিটি আশা প্রকাশ করে বলে যে, প্রতিবেদনের দ্বিতীয় অংশ নির্দিষ্ট বিষয়াদির পরিপ্রেক্ষিতে দ্রুত পেশ করা হবে। কমিটির চেয়ারম্যান এম, এম, জামান-সহ অন্যান্য সদস্যের স্বাক্ষরে প্রতিবেদনটি সরকারের কাছে উপস্থাপিত হয়। প্রতিবেদনের সঙ্গে একটি সারসংক্ষেপ দেওয়া হয়। এতে কমিটি উল্লেখ করে যে, বাংলাদেশের সংবিধান প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত সরকারের বেসামরিক প্রশাসন যন্ত্র হওয়া উচিত গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্রের নীতির ওপর ভিত্তি করে। এই প্রতিবেদনে উল্লিখিত কিছু নীতি এবং সাবেক পাকিস্তান আমলের প্রশাসনযন্ত্রের ত্রুটিবিচ্যুতি পর্যালােচনান্তে সরকারি কর্মকাণ্ড পরিচালনায় জনগণের প্রত্যাশা পূরণে আস্থার আবহ প্রতিষ্ঠার জন্য সাধারণ পদক্ষেপের সুপারিশ করা হয়েছিল। ওইসব সুপারিশের উল্লেখযােগ্য বিষয়গুলাে ছিল নিম্নরূপ : (ক) সরকারের সব স্তরের সব কর্মক্ষেত্রে অবিলম্বে এই মর্মে নির্দেশ প্রদান করা প্রয়ােজন যে, তারা তাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে/আওতাধীনে সাধারণ বিধিবিধান এবং নির্দেশনা মােতাবেক কাজকর্ম সচল রাখবে। সবপর্যায়ে কর্মকর্তাকর্মচারীদের কাজে যােগদানের বিষয়ে লাগাতার নির্দেশ জারি অব্যাহত রাখতে হবে। জনগণের দুঃখ-দুর্দশা মােচন ও সমস্যা সমাধানের দায়িত্বে নিয়ােজিত বেসামরিক প্রশাসনের কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে তাদের প্রাপ্য মর্যাদা ও সম্মান সরকারের বৈধ সংস্থা ও মাধ্যম হিসেবে দেওয়া উচিত।

দখলদার বাহিনীর আমলে চাকরিতে মেয়াদ বৃদ্ধি এবং পুনর্নিয়ােগ, নিয়ম বহির্ভূতভাবে পদোন্নতি, অস্বাভাবিক নিয়ােগ ও পদায়নের বিষয়গুলাে একটি কমিটির মাধ্যমে পুনর্বিবেচনা করতে হবে। খাস জমির বিষয়ে মীমাংসায় প্রবীণ কর্মীদের (veterans) প্রথমে সুযােগ দিতে হবে, অক্ষম/মৃত বিশেষ অভিজ্ঞদের, তাদের পােষ্যদের ঋণের দায়ভার যা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার কার্যক্রমের কারণে ঘটেছে তা মওকুফ করতে হবে। নিয়মিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অতিরিক্ত হিসেবে সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনী গড়ে তােলা উচিত। (চ) ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ইস্যুকৃত আগ্নেয়াস্ত্রের সব লাইসেন্স বাতিল করা আবশ্যক। (ছ) দখলদারি আমলে অস্ত্রপ্রাপ্ত অপরাধীদের চিহ্নিত আস্তানাসমূহ নিশ্চিহ্ন করা প্রয়ােজন। (জ) সব আদালত এবং পরিদর্শন দফতর সচল হওয়া দরকার । দণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত ও গুরুতর অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত বিচারাধীন বন্দী যাদের জেল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে তাদের পাকড়াও করা উচিত। তবে অন্যদের মুক্তি দেওয়া উচিত। এ জন্য মহকুমাপর্যায়ে মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেট ও মহকুমা পুলিশ কর্মকর্তা নিয়ে এবং জেলাপর্যায়ে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, এসপি এবং অতিরিক্ত জেলা ও সেশন জজ নিয়ে পর্যালােচনা কমিটি গঠিত হওয়া প্রয়োজন । (ঞ) বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে রাজাকার, আলশামস, আলবদর বাহিনী এবং পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এ দেশীয় অন্যান্য দোসর ও বিশ্বাসঘাতক ব্যক্তিদের দালালি, লুটতরাজ, হত্যা, অগ্নিসংযােগ ইত্যাদি অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা খতিয়ে দেখতে এবং তাদের বিচারের জন্য বিভিন্নপর্যায়ে ট্রাইবুনাল গঠন করা দরকার। জেলাপর্যায়ের ট্রাইবুনালের নিম্নরূপ কাঠামাে সুপারিশ করা হয় : ১. জেলা জজ। ২. অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সদস্য ৩. জনসাধারণের মধ্য থেকে সরকার মনােনীত ব্যক্তি अम्मा জাতীয়পর্যায়ে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হাইকোর্টের দু’জন বিচারক সমন্বয়ে একটি অ্যাপিলেট ট্রাইবুনাল থাকার বিষয়েও সুপারিশ করা হয়েছিল। (ট) যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী দালালি করেছেন তাদের চিহ্নিত করতে বিভিন্ন স্ক্রিনিং | কমিটি গঠন করা প্রয়ােজন বলে কমিটি সুপারিশ করে । সরকারি প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা কিংবা স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার অনুরূপ বা সমমর্যাদার ব্যক্তিদের দালালি সম্পর্কিত বিষয় বিবেচনার জন্য জাতীয়পর্যায়ে নিম্নলিখিতভাবে স্ক্রিনিং কমিটি গঠিত হতে পারে বলে কমিটির সুপারিশ ছিল : ১. হাইকোর্টের একজন বিচারক চেয়ারম্যান ২. সরকারের একজন সচিব

সদস্য ৩. সরকার মনােনীত একজন বেসরকারি ব্যক্তি ………… সদস্য ৪. সরকারের একজন যুগ্মসচিব

সদস্যসচিব •••••••••

চেয়ারম্যান

(ণ) সরকারি দফতরে ৯ মাস সময়ে বাংলা ভাষায় পূর্ণোদ্যমে কাজকর্ম চালুর জন্য এবং ফরম, রিসিট, প্রতিবেদন-বিবৃতি ইত্যাদি অবিলম্বে বাংলায় প্রচলনের জন্য বাংলা শর্টহ্যান্ড এবং টাইপরাইটিং-এ (টাইপরাইটারসহ) দক্ষতা অর্জনের ব্যবস্থা করতে হবে বলে কমিটি সুপারিশ করে। অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রশাসনিক ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠায় পদক্ষেপ গ্রহণ থানাপর্যায়ে কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছিল। সেগুলাের মধ্যে ছিল : (ক) থানা ম্যাজিস্ট্রেটগণকে প্রত্যাহার করে মহকুমায় পদায়নপূর্বক সাহায্য ও পুনর্বাসন প্রকল্প সম্পন্ন করতে হবে। সমন্বয় কর্মকর্তা হিসেবে সার্কেল অফিসার (উন্নয়ন) তার সার্কেলে/থানায় তার সমপর্যায়ের অন্যান্য কর্মকর্তাকে সঙ্গে নিয়ে সাহায্য ও পুনর্বাসন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়ে ইউনিয়ন কাউন্সিলের প্রশাসনব্যবস্থার তদারকির দায়িত্বও তাকে দেওয়ার সুপারিশ করা হয়। বিভিন্ন তহসিলের ধ্বংসপ্রাপ্ত/ক্ষত্মিস্ত ভূমির দলিলপত্র পুনর্লিখন, পুনর্গঠনের প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সার্কেল অফিসার (রাজস্বকে) দায়িত্ব দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছিল। (ঘ) প্রত্যেক থানায় পুলিশের সংখ্যা নির্ধারিত সংখ্যার দ্বিগুণ করার এবং তাদের উন্নতমানের অস্ত্র এবং পরিবহণে সজ্জিত করার জন্য প্রতিবেদনে উল্লেখ ছিল। প্রাচীন চৌকিদারি-প্রথার পরিবর্তে গ্রামরক্ষী বাহিনী গড়ে তােলা, তাদের অস্ত্রে সজ্জিত করা এবং প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা উচিত বলে কমিটি সুপারিশ করেছিল। সাব-রেজিস্ট্রি কার্যালয়ে যেসব তথ্যপত্র বা রেকর্ড মুক্তিযুদ্ধকালে ক্ষতিগ্রস্ত বিনষ্ট হয়েছে সেগুলাে পুনরায় তৈরি করার সুপারিশ করা হয়। ইউনিয়ন সিড স্টোরের ক্ষতি, বীজ সংরক্ষণের সরঞ্জামের ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয়ের জন্য থানা কৃষি অফিসারকে দায়িত্ব দেওয়ার জন্য কমিটি সুপারিশ করে। তা ছাড়া থানা কৃষি সহকারীদের নিজ নিজ এলাকায় কৃষি বিষয়ে দায়িত্ব পালন অব্যাহত রাখারও পরামর্শ দেওয়া হয়। (জ) জনগণের সমর্থন ও অংশগ্রহণে স্বাস্থ্যবিষয়ক কর্মকাণ্ডে প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্যও প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস কমিটি থানায়থানায় গণপরামর্শক পরিষদ গঠনের জন্য বলেছিল। মহকুমা/জেলা/বিভাগসমূহে প্রশাসনব্যবস্থায় পদক্ষেপ। মহকুমা ভিত্তিক প্রশাসনব্যবস্থায় শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার বিষয়ে পর্যবেক্ষণ ও প্রত্যক্ষণ ছিল যে, বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার পরমুহূর্ত থেকেই বাংলাদেশ সরকারের ঘন ঘন নির্দেশ জারির পরিপ্রেক্ষিতে দেশের বেশির ভাগ মহকুমায় এসডিও, এসডিএম, এসপিও, মুনসেফ, সহকারী ইঞ্জিনিয়ার (ইমারত), সহকারী ইঞ্জিনিয়ার (সড়ক), সহকারি সার্জন/এসডিএমও, এসডিএও, এসডিসিও এবং তাদের অধীনস্থ সরকারি কর্মচারীবৃন্দ নিজ নিজ কর্মস্থলে যােগদান করে উল্লিখিত কর্মকর্তাগণের তত্ত্বাবধানে কাজ করছেন। রিলিফ অফিসারের দায়িত্ব ও কর্তব্য কী হওয়া উচিত সে সম্বন্ধে কমিটি সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা উল্লেখ করে।

একজন গেজেটেড কর্মকর্তার অধীনে মহকুমা অফিসারের (এসডিও-র) কার্যালয়ে তথ্য ও কল্যাণ সেল স্থাপনের সুপারিশ ছিল প্রণিধানযােগ্য। এই সেল গঠনের উদ্দেশ্য ছিল জনগণের বিভিন্ন অনুসন্ধিৎসার জবাব, বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের কল্যাণে ব্যবস্থা গ্রহণ ও নিখোঁজ ব্যক্তির সন্ধানে যথাযথ দায়িত্ব পালন। অনুরূপভাবে মহকুমার পুলিশ কর্মকর্তাদের বিষয়েও উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কমিটি তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিল। এ ছাড়া, এসএও, এসইও, এসসিওদের বিষয়েও কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ ছিল। জেলাপর্যায়েও কমিটি কিছু সুপারিশ দেয়। এসব সুপারিশে জেলার সব কর্মকর্তাকে মাঠপর্যায়ে ব্যাপক সফর, তদারকি এবং ব্যবস্থা গ্রহণের প্রস্তাব দেয়। জনগণের সমর্থন লাভ এবং স্বাভাবিক কার্যক্রম অক্ষুন্ন রাখার স্বার্থে এর প্রয়ােজনীয়তা ছিল। সাহায্য ও পুনর্বাসন কাজে জেলার সব শ্রেণীর কর্মকর্তাকে সক্রিয় করার প্রস্তাব করা হয়। বাস্তবে জেলার ট্রেজারিসমূহের কী অবস্থা তা দেখে প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যেও কমিটি সুপারিশ করে। ট্রেজারিতে প্রয়ােজনীয় স্ট্যাম্পের পরিমাণ নিরূপণ ছাড়াও সরকারি গুদামে খাদ্যশস্যের মজুদের পরিমাণ যাচাই এবং তা সংগ্রহের ব্যবস্থা করারও চিন্তা করা হয়। বিভাগীয় স্তরে বিভাগীয় কমিশনারকে তার সংশ্লিষ্ট দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করার পরামর্শ কমিটির প্রতিবেদনে প্রদান করা হয়।

জাতি গঠনসংক্রান্ত দফতরগুলােকেও প্রশাসনিক বিভাগের সহযােগী কেন্দ্র করার ধারণাও কমিটি তার প্রতিবেদনে দিয়েছিল। এই কমিটি সরকারের সাংগঠনিক কাঠামাে গড়ে তুলতে মােট ২০টি মন্ত্রণালয়, ৩টি সাচিবিক। দপ্তর এবং ৭টি সাংবিধানিক দফতর গঠনের সুপারিশ করেছিল। মন্ত্রণালয় গঠন। সরকারের কর্মকাণ্ডের বিভিন্ন ক্ষেত্র অনুযায়ী এই ২০টি মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবিত নামগুলাের অন্তর্ভুক্ত ছিল, ১, কৃষি মন্ত্রণালয়, ২. মন্ত্রিসভাবিষয়ক মন্ত্রণালয় (ক, মন্ত্রিসভা বিভাগ, খ, সংস্থাপন বিভাগ), ৩. যােগাযােগ ও পরিবহণ মন্ত্রণালয়, ৪, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, ৫. শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিশাস্ত্রগত গবেষণা মন্ত্রণালয়, ৬. অর্থ ও রাজস্ব। মন্ত্রণালয়, ৭ খাদ্য মন্ত্রণালয়, ৮, পররাষ্ট্রবিষয়ক মন্ত্রণালয়, ৯, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, ১০, স্বরাষ্ট্রবিষয়ক মন্ত্রণালয়, ১১. শিল্প এবং খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়, ১২. তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়, ১৩. পাট মন্ত্রণালয়, ১৪, শ্রম, সমাজকল্যাণ ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, ১৫. আইন ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়, ১৬. স্থানীয় সরকার, গ্রামীণ উন্নয়ন এবং সমবায় মন্ত্রণালয়, ১৭. পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, ১৮, সাহায্য ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়, ১৯, ব্যবসায় ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং ২০. নির্মাণ, গৃহসংস্থান, বিদ্যুৎ এবং সেচ মন্ত্রণালয়। অন্যান্য।

সাচিবিক দপ্তরের মধ্যে রাষ্ট্রপতির সচিবালয়, প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় এবং জাতীয় সংসদ সচিবালয় প্রতিষ্ঠার সুপারিশ ওই প্রতিবেদনে ছিল। এ ছাড়া সাংবিধানিক দফতর যথা, (ক) সরকারি কর্মকমিশন (খ) সরকারবিষয়ক কমিশন (ন্যায়পাল) (গ) নির্বাচন কমিশন (ঘ) কম্পট্রোলার ও মহা হিসাব নিরীক্ষক (ঙ) হাইকোর্ট (চ) সুপ্রিম কোর্ট গঠনের প্রস্তাবও কমিটির প্রতিবেদনে সন্নিবেশিত হয়। কোন মন্ত্রণালয়ের কাঠামাে ও কার্যপ্রণালী কেমন ও কী রকম হতে পারে তার বিস্তৃত বিবরণ এবং রূপরেখা উক্ত প্রতিবেদনের সঙ্গে সংযােজিত হয়েছিল। সাবেক পাকিস্তান। সরকারের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক দফতরগুলাে কোন উপায়ে কী ভাবে সমন্বিত হতে পারে তার সামগ্রিক উপায় এবং পন্থার বিষয় এই কমিটি প্রতিবেদনে দিয়েছিল। সমন্বয়ের উপায় ও পন্থার কারণগুলােরও ব্যাখ্যা প্রতিবেদনে দেওয়া হয়েছিল। উল্লিখিত সচিবালয় এবং সাংবিধানিক দফতরের প্রয়ােজনীয়তা সম্বন্ধেও কমিটি সবিস্তারে ব্যাখ্যা দিয়েছিল। সংবিধিবদ্ধ অঙ্গ সংগঠনগুলির নিরপেক্ষতা, পবিত্রতা ও কার্যকারিতা সমুন্নত রাখার স্বার্থে সেগুলাে সংবিধান অনুযায়ী গঠনের প্রয়ােজনীয়তার বিষয়ও কমিটির প্রতিবেদনে উল্লেখ ছিল।  স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসনিক কাঠামাে প্রয়ােজনানুযায়ী সুবিন্যস্ত করার উদ্দেশ্যে সুপারিশমালা প্রণয়নের জন্য ১৯৭১ সালের ২৭ ডিসেম্বর তারিখে গঠিত বেসামরিক প্রশাসন পুনর্বিন্যাস কমিটি ১৯৭২ সালের ০৪ জানুয়ারি সরকারের বিবেচনার জন্য সুপারিশসহ প্রতিবেদনের প্রথম অংশ উপস্থাপন করে। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, এই কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছিলেন তৎকালীন চা (Tea) বাের্ডের চেয়ারম্যান জনাব এম.এম, জামান। কমিটির অপর পাঁচজন সদস্যের স্বাক্ষরসহ তিনি প্রতিবেদনের প্রথম অংশ সরকারের বিবেচনার জন্য দিয়েছিলেন। প্রশাসনিক ও চাকরি পুনর্বিন্যাস কমিশন গঠন বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরেই বেসামরিক প্রশাসনিক কাঠামাে বিন্যস্তকরণের সঙ্গে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পাহাড়প্রমাণ সমস্যা সমাধানে মনােনিবেশ করেন। রাষ্ট্রীয় মূলনীতি বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের ওপর ভিত্তি করে স্বাধীন দেশকে গড়ে তােলার প্রত্যয়ে বঙ্গবন্ধু কয়েকটি মৌলিক বিষয় যেমন, জাতীয়করণ নীতি, মুক্তিযােদ্ধাদের পুনর্বাসন, ত্রাণকার্যক্রম, সংবিধান প্রণয়ন, নির্বাচন ইত্যাদির প্রতি প্রথমেই ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। পাশাপাশি দেশের বেসামরিক প্রশাসন কাঠামােয় শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর সরকার ১৯৭২ সালের ১৫ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য (Vice-Chancellor) অধ্যাপক মুজাফফর আহমদ চৌধুরীকে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দিয়ে একটি কমিটি গঠন করে । এই কমিটির মূল দায়িত্ব ছিল সরকারি চাকরিতে নিয়ােগ সম্পর্কিত নতুন নীতিমালা তৈরি করা। সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এই কমিটিতে নিম্নলিখিত সদস্যগণকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় : ১) পরিকল্পনা কমিশনের একজন প্রতিনিধি। ১) ২) মন্ত্রিপরিষদ মন্ত্রণালয়ের (সংস্থাপন বিভাগের) সচিব।

৩) প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক মনােনীত একজন রাজনৈতিক প্রতিনিধি। এই সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে, অধ্যাপক মুজাফফর আহমদ চৌধুরীর সভাপতিতে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য অধ্যাপক আনিসুর রহমান এবং প্রধানমন্ত্রীর মনােনীত তৎকালীন এমসিএ জনাব আবদুল মুন্তাকিম চৌধুরীকে কমিটির সদস্য করা হয়। মন্ত্রিপরিষদ মন্ত্রণালয়ের সংস্থাপন বিভাগের সচিব জনাব এম, এম, জামানকে (যিনি ১৯৭১ সালের ২৭ ডিসেম্বর তারিখে গঠিত এতদসম্পর্কিত প্রথম কমিটির সদস্য ছিলেন) গঠিত প্রশাসনিক ও চাকরি পুনর্বিন্যাস কমিটির পূর্ণকালীন সদস্যসচিব হিসেবে নিয়ােগ দেওয়া হয়। পুনর্গঠিত কমিটির কর্মসূচির আওতা সম্প্রসারিত করে বিদ্যমান বিভিন্ন টেকনিক্যাল এবং নন টেকনিক্যাল পদ ও চাকরির কাঠামাে সরকারের স্বাভাবিক ক্রিয়ামূলক (functional) প্রয়ােজনীয়তা এবং আবশ্যকতার নিরিখে ভবিষ্যৎ কাঠামাে সম্বন্ধে এবং প্রতিরক্ষা বাহিনীর চাকরি ব্যতীত অন্য সব ধরনের বেসামরিক চাকরিকে সমম্বিতকরণের উপায় সম্বন্ধে সুপারিশমালা প্রণয়নের দায়িত্ব অন্তর্ভুক্ত করা হয়। নতুন চাকরি-কাঠামােয় সমপর্যায়ের শিক্ষাগত যােগ্যতা এবং চাকুরি ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা ইত্যাদি বিষয় বিবেচনার দিকনির্দেশনা ও নীতিমালা নির্ধারণের দায়িত্বও কমিটির ওপর বর্তায়। সরকারের বিভিন্ন স্তরের চাকরিতে ভবিষ্যতে নিয়ােগের নীতিমালায় শিক্ষাগত ও চাকরির অন্যান্য যােগ্যতা নির্ধারণের দায়িত্ব কমিটিকে দেওয়া হয়। প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাসের বিস্তারিত পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং তা সুপারিশ আকারে উপস্থাপন করার দায়িত্ব কমিটিকে অর্পণ করা হয়েছিল। ন্যস্ত দায়িত্ব পালনকালে কমিটি অনেক সংগঠনের প্রতিনিধি, মন্ত্রী, উচ্চপদমর্যাদার কর্মকর্তার সাক্ষাৎকার গ্রহণ এবং তাদের সঙ্গে চাকরির নীতিমালা সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে আলােচনা করে। এসব ব্যক্তির মধ্যে সরকারের সচিব, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা, জাতীয় উদ্যোক্তা, ইনসিওরেন্স, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রধানগণ অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। জেলা প্রশাসন সম্বন্ধে ধারণা নিতে কমিটির সদস্যগণ চট্টগ্রাম ও রাজশাহী জেলায় গিয়ে সরকারি এবং জেলা কর্মকর্তাবৃন্দের সঙ্গেও আলােচনা করেছিলেন। এ ছাড়া, কমিটি সােভিয়েত রাশিয়ায় গিয়ে সেখানকার সরকারি প্রশাসনব্যবস্থা এবং চাকরি-কাঠামাে সম্বন্ধেও ধারণা নেয়। বঙ্গবন্ধুর সরকার কর্তৃক অধ্যাপক মুজাফফর আহমদের নেতৃত্বে গঠিত প্রশাসনিক ও চাকরি পুনর্বিন্যাস কমিটি স্বাধীনতা-পূর্ব প্রশাসনিক ব্যবস্থায় পুরনাে ধাঁচের কাঠামাে দেখতে পায়। স্বাধীন সার্বভৌম দেশের জন্য ওই ধরনের কাঠামাে কারাে কাম্য হতে পারে। কমিটি মনে করে যে, জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে ওই পদ্ধতি ছিল ঢিলেঢালা ও অসার, জটিল, বিভ্রান্তিকর এবং দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ও ভাবনায় আচ্ছন্ন করার মতাে। এ জন্য কমিটি এমন এক সরল কাঠামাের সুপারিশ করে যাতে একই সঙ্গে অধিক যুক্তিসঙ্গত কর্মবণ্টন, দায়িত্বসহ দ্রুত কর্মসম্পন্নের ব্যবস্থা এবং দেশের মানুষের অনুকূলে ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশনা ছিল। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের বেসামরিক চাকরিক্ষেত্রের বিভিন্ন দিক পর্যালােচনার সময় লক্ষ্য করে যে, বিদ্যমান চাকরি-কাঠামাে অসংখ্য নামীয় পদের অস্তিত্বে আকীর্ণ। এসব পদ আবার ভিন্ন ভিন্ন পেশাগত সম্ভাবনার বেড়াজালে পরিবেষ্টিত ছিল। এগুলােতে বৃত্তিগত উন্নয়নের অভাব ছিল। শ্রেণী ও মর্যাদাভিত্তিই ছিল এগুলাের প্রধান বৈশিষ্ট্য।

নিমমর্যাদার পদে প্রবেশ করে চাকরিতে পদোন্নতি লাভ করে উচ্চতর পদে যাওয়ার কোনাে সুযােগ প্রবেশকদের ছিল না। উপনিবেশবাদী ধনতান্ত্রিক কাঠামাের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রীয় পদ্ধতির সরকারকে পরিচালনার জন্য চাকরিকাঠামাে এমনভাবে পরিকল্পিত ছিল যে তা স্বাধীন, দেশপ্রেমিক, গণতান্ত্রিক ও গণমুখী সরকার পরিচালনার জন্য বেমানান ছিল। শুধু তাই-ই নয়, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগের ওই ধরনের সরকারব্যবস্থা দেশের দ্রুত উন্নয়ন ও সামাজিক পুনর্গঠনে অক্ষম ছিল। এরূপ পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুর চিন্তা-চেতনা সঠিকভাবে প্রতিফলনের উদ্দেশ্যে কমিটি দেশের বেসামরিক চাকরিকাঠামাে এবং প্রশাসনব্যবস্থা ঢেলে সাজানােয় প্রয়াসী হয়।  কমিটি বাংলাদেশের বেসামরিক চাকরিতে মাত্র একটি বৈষম্যহীন পদক্রমভিত্তিক চাকরিকাঠামাে প্রবর্তনের সুপারিশ করে। সুপারিশে উল্লেখ করা হয় যে, একমাত্র সুস্পষ্ট প্রযুক্তিগত (technical) কারণ ছাড়া কোনাে শ্রেণিভুক্ত পদ সংরক্ষিত থাকবে না। বেসামরিক চাকরিতে আসা এসব সদস্যকে তাদের বেছে নেওয়া চাকরিক্ষেত্রে বৃত্তিগত বুৎপত্তি অর্জন করতে হবে এবং যে কোনাে স্তরের মেধাবী ব্যক্তিগণ যাতে দ্রুত উচ্চতর পদে উঠে যেতে পারে সে জন্য তাদের অবারিত সুযােগ থাকতে হবে। বৈজ্ঞানিক, প্রযুক্তিবিষয়ক ও শিল্পীসুলভ মেধাবীগণ, শিক্ষক ও মাঠ কর্মকর্তাগণের মর্যাদা বৃদ্ধির সুপারিশ করেছিল কমিটি। জাতীয় সদর দফতরে (Fleadquarters-এ) কর্মরত জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাগণকে পুরােভাগে পুনঃস্থাপনের ব্যবস্থার কথাও কমিটি তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করে। জাতির নতুন সামাজিক দর্শনের আলােকে নতুন নতুন নিয়ােগপ্রাপ্ত কর্মচারীসহ বিদ্যমান কর্মচারীদের বুৎপত্তি অর্জন (orientation) ও প্রশিক্ষণের জন্য বিশেষ সুপারিশ করা হয়েছিল।

সুসমন্বিত ও বিজ্ঞানসম্মত পেশা ব্যবস্থাপনা এবং কর্মজীবী উন্নয়নে বিশেষ গুরুত্ব আরােপ করা হয় কমিটির সুপারিশে ।। স্মর্তব্য, ১৯৭২ সালের ৪ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী বরাবর যে প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছিল তাতে শুধু চাকরি পুনর্বিন্যাসের ক্ষেত্রে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়ে সুপারিশ ছিল। নতুন বেতন-স্কেল নির্ধারণে জাতীয় বেতন কমিশনকে চাকরি পুনর্গঠনের বিষয়টিতে প্রথমে হাত দিতে হবে বলে অধ্যাপক মুজাফফর আহমদের নেতৃত্বাধীন কমিটির সুপারিশে উল্লেখ করা হয়। এই কমিটি মূলত সচিবালয় পদ্ধতি এবং কর্মপ্রণালী, মন্ত্রণালয় ও বিভাগীয় সংগঠন এবং জেলা ও স্থানীয় সরকার প্রশাসন কেমন হবে তার রূপরেখা সংবলিত সুপারিশ প্রদান করে। প্রশাসনব্যবস্থায় সচিবালয় হচ্ছে মূল স্নায়ুকোষ এবং মূল চাবিকাঠি। এখানেই সরকারের প্রশাসনিক সব ধরনের নীতির উদ্ভব হয়, চূড়ান্তরূপ লাভ করে এবং সেগুলাে। কার্যকর করতে বিভিন্ন বিভাগের প্রধানগণের নিকট প্রেরিত হয়। এজন্য সচিবালয়ের সব পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীর পদগুলাে গুরুত্বপূর্ণ। তাই, প্রশাসনিক ও চাকরি পুনর্বিন্যাস ৭ কমিটি সচিবালয়ের সংগঠন ও সচিবালয়সহ অন্যান্য দফতরের কার্যবিধি গতিশীল করে জনগণের সমস্যার আশু প্রতিকার ও তাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রয়ােজনীয় বিষয়সমূহ দ্রুততার সাথে বিবেচনা করে যথাবিহিত ব্যবস্থা অবলম্বন সম্পর্কে বিস্তারিত বিশ্লেষণ দিয়ে সুপারিশ করে। এ ছাড়া, স্বায়ত্তশাসিত ও রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প-সংস্থাগুলাের প্রশাসন ও পদ্ধতিগত জটিলতার সহজীকরণ সম্পর্কেও সুপারিশ করেছিল এই কমিটি। বঙ্গবন্ধুর সরকার কমিটির সুপারিশ গুরুত্বের সঙ্গে বাস্তবায়নে অগ্রসর হয়েছিল।

বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসনিক কাঠামাে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে বিভক্ত। কিছু গুরুত্বপূর্ণ নীতির ভিত্তিতে মন্ত্রণালয়গুলাে গঠিত হওয়ার রীতি থাকলেও অক্ষরে অক্ষরে তা মেনে চলা যায় না। তাই সরকারের কাজ সুষ্ঠু ও সাবলীলভাবে পরিচালনার জন্য মৌলিক নীতিমালাবহির্ভূত এবং প্রয়ােজনের তাগিদে কোনাে কোনাে সময় কিছু মন্ত্রণালয় সৃষ্টি করতে হয়। প্রসঙ্গত, উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে, যেসব মৌলিক নীতির ওপর মন্ত্রণালয় সৃষ্টি করা হয় সেগুলাে হচ্ছে (ক) উদ্দেশ্য (পৃথিবীর অধিকাংশ রাষ্ট্রে মন্ত্রণালয় গঠিত হয়। উদ্দেশ্যভিত্তিক) (খ) কর্ম-প্রণালী (জনস্বাস্থ্য বিষয়ক মন্ত্রণালয়, গণপূর্ত ও নগর উন্নয়ন ইত্যাদি মন্ত্রণালয়) (গ) পােষ্যভিত্তিক (clientele) (সাহায্য ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়, শ্রম ও সমাজকল্যাণ ইত্যাদি মন্ত্রণালয়) এবং (ঘ) ভূগােল, প্রশাসনিক সুবিধা ও নিয়ন্ত্রণাধীনতা। একজন মন্ত্রীর অধীনে একটি অথবা একাধিক বিভাগ নিয়ে মন্ত্রণালয় গঠিত হয়। আরাে কিছু বিষয় থাকে যেগুলাে মন্ত্রণালয় গঠনের সময় বিবেচিত হয়। সাধারণত একটি মন্ত্রণালয় অপরপৃষ্ঠার কাঠামাে অনুসারে গঠিত হয় :

উল্লিখিত কাঠামাে অনুসরণ করে গঠিত বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের যাবতীয় খুঁটিনাটি বিষয় এবং কর্মপরিধি ও দায়িত্ব কমিটি পর্যালােচনা করে। সাবেক পাকিস্তান আমলে চাকরিকাঠামােয় বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সাংগঠনিক কাঠামাে ও পদক্রমে যেসব বিশৃঙ্খলা বিদ্যমান ছিল তা দূর করে চাকরির ক্ষেত্রে একটি সুসমন্বিত পদবিন্যাস। বিনির্মাণের জন্য কমিটি বঙ্গবন্ধুর দূরদৃষ্টি ও পরামর্শের আলােকে এই পর্যালােচনার কাজটি করে। একটি বিষয় এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে, সাবেক পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের চাকরিকাঠামােয় বিস্তর অনিয়ম, আসামঞ্জস্য ও সমন্বয়হীনতা ছিল। বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পরমুহূর্ত থেকেই এসব মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল এবং সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মনে নানারূপ দ্বিধাদ্বন্দ্ব, সন্দেহ, অসন্তোষ দেখা দিয়েছিল। ফলে, প্রশাসন-ব্যবস্থা অগােছালাে হয়ে ওঠার উপক্রম হয়। দেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থা। সুসমন্বিতভাবে পুনর্গঠনের জন্য বঙ্গবন্ধু একে ঢেলে সাজানাের ব্যবস্থা করেছিলেন। এ জন্যই তিনি জাতীয় বেতন কমিশন গঠন করেন। এই কমিশন সচিবালয়পদ্ধতি এবং তার কর্মপ্রক্রিয়া সম্বন্ধে বিশদ বর্ণনা দিয়ে বিভিন্ন সুপারিশ তুলে ধরে।

মন্ত্রী, মন্ত্রণালয় ও বিভাগীয় সংস্থার আকার-আকৃতি, মন্ত্রিপরিষদ পদ্ধতি, কমিটি গঠনে প্রধানমন্ত্রী সচিবালয়, মন্ত্রিপরিষদ সচিবালয়, জাতীয় পরিসংখ্যান সংস্থা, সাধারণ চাকুরি, প্রতিরক্ষা, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় পুনর্গঠন, ন্যায়পাল ও প্রশাসনিক আদালত, অর্থসংক্রান্তক্ষমতা। প্রদান ইত্যাদি বিষয়ে এই কমিটি পর্যালােচনা করে সরকারের বিবেচনার জন্য সুপারিশ প্রণয়ন করে । জেলা প্রশাসন সম্পর্কে পর্যবেক্ষণে কমিটি জেলার আয়তন, প্রকৃতি ও সংখ্যা, জেলা প্রশাসনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য আইন ও শৃঙ্খলা, ভূমি রাজস্ব, ভূমি প্রশাসন, কার্যনির্বাহী কর্মকাণ্ড, সাহায্য, উন্নয়ন, রাজস্ব প্রশাসন ইত্যাদি বহুবিধ বিষয় বিবেচনায় নেয় এবং সুপারিশ দেয়। স্থানীয় সরকার প্রশাসন প্রসঙ্গে কমিটির সুপারিশে বলা হয় যে, বিংশ শতাব্দীতে সরকারের কর্মকাণ্ডের পরিধি সর্বত্র ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হয়েছে। এই অভিমতের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি যেসব কর্মকাণ্ড স্থানীয়ভাবে মেটানাে প্রয়ােজন তার গুরুত্ব বর্ণনা করে সেগুলাে স্থানীয়ভাবে সম্পন্ন করার সুপারিশ করে। প্রসঙ্গত কমিশন গণতান্ত্রিক পথে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য অর্জনে সরকারি দায়িত্বের আকার-আকৃতি পরিমাণ, বিভিন্নতা, জটিলতা অনেক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে উল্লেখ করে। পৃথিবীব্যাপী সব রাষ্ট্রে এই পরিবর্তনের তরঙ্গ বাংলাদেশ সরকারকেও সচেতন করে। কমিশন মনে করে যে, সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের সরকার গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের নীতির প্রতি গভীরভাবে বিশ্বাসী এবং সেগুলাে মেনে চলতে অঙ্গীকারবদ্ধ। বাংলাদেশ সরকারের প্রধান লক্ষ্যই হচ্ছে সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে দেশে সমাজতান্ত্রিক পদ্ধতির অর্থনীতি প্রবর্তন করা এবং বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছা ও আকাক্ষার প্রতিফলন ঘটানাে। সরকার জনশক্তি, প্রাকৃতিক সম্পদ এবং দ্রুত উন্নয়নশীল প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহারের ওপর আপনা-আপনিই সামাজিক কল্যাণ এবং ব্যাপক অর্থনৈতিক ক্ষেত্র সম্প্রসারণের দায়িত্ব গ্রহণে আগুয়ান হতে বাধ্য হয়। সরকারের ওপর জনগণের দাবি ও প্রত্যাশা অনেক বেড়ে যায়।

ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অশিক্ষা, রােগবালাই ইত্যাদিতে জনগণের জীবনপ্রণালী দুঃসহ এবং এ প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের মতাে দরিদ্র দেশের সরকার সুষ্ঠু ও সাবলীলভাবে বিভিন্ন সমস্যা-সঙ্কট মােচনের জন্য প্রতিনিধিত্বমূলক প্রশাসনব্যবস্থা গড়ে তােলে। এমন পরিস্থিতিতে সরকারের দায়িত্বের পরিধি তুলনামূলক অনেক বৃদ্ধি পায়। এ জন্য যেসব কর্মকাণ্ড সরকারের কেন্দ্রীয় পর্যায়ভুক্ত নয় সেগুলাে সারা দেশে স্থানীয়ভাবে মােকাবিলার জন্য কমিশন স্থানীয় প্রশাসনব্যবস্থা প্রবর্তন ও জোরদার করার সুপারিশ বঙ্গবন্ধুর সরকারের কাছে বিবেচনার জন্য পেশ করে। ইউনিয়ন পরিষদ গঠন, পরিষদের সদস্য কিভাবে নির্বাচিত বা মনােনীত হবে তার দিকনির্দেশনা, পরিষদের চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচন, ইউনিয়ন পরিষদের কার্যাবলি, পরিষদের আয়ের উৎস, সরকারের সঙ্গে পরিষদের সম্পর্ক কেমন থাকবে, থানা পরিষদ, জেলা পরিষদ গঠন, জেলা পরিষদের ভূমিকা, স্থানীয় সরকারের চাকরির প্রকৃতি, জেলা কাউন্সিলের অর্থব্যবস্থা এবং আয়ের উৎস, মিউনিসিপ্যালিটি, স্থানীয় সংস্থাসমূহের চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান প্রমুখের অপসারণপদ্ধতি, জাতীয় সরকার এবং স্থানীয় সরকারের মধ্যে সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয়েও কমিশন রূপরেখা দেয়। এ ছাড়া কমিশন প্রস্তাবিত মন্ত্রণালয়গুলাের তালিকা প্রস্তুত করে তা সরকারের বিবেচনার জন্য দিয়েছিল। মাঠপর্যায়ের দফতরের গঠনপ্রণালী সম্পর্কেও কমিশনের প্রতিবেদনে সুপারিশ দেওয়া হয়। প্রত্যেক মন্ত্রণালয়ের জন্য পৃথক কর্মপরিকল্পনা এবং মাঠপর্যায়ের দফতরসহ জাতীয়পর্যায়ের দফতরের প্রশাসনিক কাঠামাের রূপরেখাও কমিটির সুপারিশে ছিল। দেশের জাতীয় সরকার এবং স্থানীয় সরকারের প্রশাসনিক কাঠামাের ওপরও কমিশন আলােকপাত করে। এতে বঙ্গবন্ধুর চিন্তা এবং নির্দেশের প্রতিফলন ছিল। জাতির পিতা কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। জাতীয় বেতন কমিশন গঠন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের ২১ জুলাই (১৯৭২) তারিখের এমএফ (প্রশাসন) ২২-১(৩০০)/৭২/১০৮১ সংখ্যক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জাতীয় বেতন কমিশন গঠিত হয়েছিল। এই কমিশনের গঠন-কাঠামাে ছিল নিম্নরূপ : সভাপতি

১) জনাব এ. রব, অবসরপ্রাপ্ত সচিব সদস্যবৃন্দ।

২) জনাব জহিরুল হক, সাবেক ম্যানেজিং ডাইরেক্টর, আইডিবিবি | ৩) জনাব এ. এম. এ. কবির, পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত আইজি

৪) জনাব এম. এ. রশীদ, সাবেক উপাচার্য, প্রকৌশল ও কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয় | খণ্ডকালীন সদস্যবৃন্দ

৫) প্ল্যানিং কমিশনের একজন প্রতিনিধি ৬) অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন প্রতিনিধি ৭) প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন প্রতিনিধি

>. Report of the National Pay Commission Bangladesh Vol. 1- Main Text, May 1973,p

৮) জনাব সাইফুর রহমান, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট ৯) জনাব এম. এ. মামুন, ম্যানেজিং ডাইরেক্টর, হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপােরেশন জরুরি নিয়ন্ত্রণ কক্ষের (Emergency Control Room-এর) ওএসডি জনাব এ, বি, এম, গােলাম মােস্তাফা পুনরাদেশ না দেওয়া পর্যন্ত কমিশনের সদস্যসচিব হিসেবে সার্বক্ষণিক ভিত্তিতে দায়িত্ব পালনের জন্য নিযুক্ত হন। কমিশনকে ১৯৭২ সালের ১৩ জুলাই তারিখ থেকে ছয় মাসের মধ্যে সরকারের নিকট তাদের প্রতিবেদন পেশ করতে বলা হলেও জনস্বার্থে প্রয়ােজনানুযায়ী সেই সময়সীমার আগেও কমিশন অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদন পেশ করতে পারবে। তবে, অদৃষ্টপূর্ব কিছু কারণে নির্ধারিত ছয় মাস সময়ে কমিশন প্রতিবেদন সম্পন্ন করতে অসমর্থ হওয়ায় প্রতিবেদন পেশের সময়সীমা বর্ধিত করা হয়েছিল। খণ্ডকালীন সদস্য হিসেবে কমিশনের দায়িত্ব পালনের জন্য সাধারণ অর্থনৈতিক বিভাগের (General Economic Division-এর) প্রধান ড. এ. আর. খান, যুগ্মসচিব জনাব কিউ. এ. রহিম এবং বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনীর (Bangladesh Army-র) ডেপুটি চিফ অব স্টাফ কর্নেল জিয়াউর রহমানকে যথাক্রমে অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্ল্যানিং কমিশন এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় মনােনয়ন দেয়।

উল্লেখ্য, উপযুক্তভাবে সরকার কর্তৃক জাতীয় বেতন কমিশন গঠিত হওয়ামাত্র ১৯৭২ সালের ০১ আগস্ট তারিখে কমিশনের প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সভায় এই মর্মে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, সব মন্ত্রণালয়, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা, জাতীয়করণকৃত প্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে নির্ধারিত ছকে কর্মচারীদের বেতন, ভাতা ও প্রান্তিক সুবিধাদি সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ করা হবে। এসব তথ্য ১৯৭২ সালের ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে নির্ধারিত ছক পূরণপূর্বক কমিশনে ফেরত পাঠানাের অনুরােধ জানানােরও সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। কমিশনের বর্ণিত শর্তের আলােকে চাকরির সঙ্গে সম্পৃক্ত বিভিন্ন সমিতি এমনকি জনগণের কাছে থেকেও প্রত্যেক শ্রেণীর কর্মচারীর জন্য কাক্ষিত বেতনকাঠামাে সম্পর্কে তাদের অভিমত ও পরামর্শ প্রদান করতে জাতীয় বেতন কমিশন আহ্বান জানিয়েছিল। চাকরির সঙ্গে সম্পৃক্ত কিছু সমিতি, মন্ত্রণালয় এবং সরকারের স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের অনুরােধে কমিশন তথ্য-উপাত্ত ও বিষয়সহ পূরণকৃত ছক জমা দেওয়ার শেষ তারিখ বর্ধিত করে ১৫ অক্টোবর (১৯৭২) পর্যন্ত করে। সংবিধানে বর্ণিত নীতিমালার আলােকে বাংলাদেশে সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠনে সরকারের ঘােষিত উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের প্রতি মান্যতা বজায় রেখে কমিশনকে সরকার সুনির্দিষ্ট পরামর্শ দেয়। তকালে সর্বস্তরের কর্মচারীদের জন্য বিদ্যমান বেতনস্কেল পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পর্যালােচনা করে নতুন বেতনস্কেল সম্পর্কে সুপারিশকালে জাতীয় বেতন কমিশনকে জীবনযাত্রার ব্যয়, সরকারের সম্পদ, সমাজের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন আয়ের মধ্যে বৈষম্য হ্রাসের প্রয়ােজনীয়তা, উচ্চ মেধাবী এবং কারিগরি ও পেশাগতভাবে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের সরকারি কর্মক্ষেত্রে আকৃষ্ট করে রাখার প্রয়ােজনীয়তা, কর্মক্ষেত্রে দক্ষতা, সমতা (equity), উদ্দীপনা-প্রেরণার জন্য প্রয়ােজনীয় বিষয়, বিভিন্ন পেশা ও কর্মের পরিপ্রেক্ষিতে চাহিদা ও সরবরাহ ইত্যাদিও বিবেচনা করতে বলা হয়েছিল। এ ছাড়া কমিশনের বিবেচ্য বিষয়ের আওতায় সাবেক পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের অধীনে যেসব ব্যক্তি চাকরি করতেন তাদের বেতন-হার (scale) গ্রহণীয়। (rationalise) এবং প্রমিত (standardise) করার উপায় সম্বন্ধে সুপারিশ করার ক্ষমতাও অন্তর্ভুক্ত ছিল। কমিশনের ক্ষমতার মধ্যে চাকরি-সংশ্লিষ্ট যেকোনাে সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান এবং সরকারের প্রশাসনিক ও চাকরি পুনর্বিন্যাস বিষয়ক পরিষদের (Administrative and Services Re-(organization Committee-i) সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে কাজ করার। জন্যেও কমিশনকে সরকার পরামর্শ দেয়। ওপরে বর্ণিত সরকারের প্রদত্ত পরামর্শ এবং ক্ষমতার আওতায় জাতীয় বেতন কমিশন। শতাধিক বৈঠকে মিলিত হয়। কমিশন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও উৎস থেকে প্রায় পাঁচশত সুপারিশ পেয়েছিল। কমিশন এসব সুপারিশ সতর্কতার সঙ্গে বিশ্লেষণ ও বিবেচনা করে। সরকারের সীমিত সম্পদ সম্পর্কে অর্থ মন্ত্রণালয় বিভিন্ন তথ্য জাতীয় বেতন কমিশনকে। অবহিত করে।

বিদ্যমান বাজারদর এবং জীবনযাত্রার ব্যয় সম্পর্কে পরিকল্পনা পরিষদের (Planning Commission) সঙ্গে কমিশনের মতবিনিময় হয়। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, করপােরেশন, ব্যাংক-বীমা প্রতিষ্ঠানের প্রধানগণের সঙ্গেও কমিশন আলােচনা করে। প্রতিরক্ষাবিষয়ক চাকরি বিভাগের (services) প্রধানদের অভিমত গ্রহণ করে কমিশন। যেহেতু বেতনকাঠামাে ও বেতন-হার প্রশাসনিক চাকরি এবং প্রতিরক্ষা বিভাগের চাকরি সংশ্লিষ্ট কাঠামাে সংক্রান্ত বিষয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং পরিপূরক সেহেতু কমিশন প্রশাসনিক। ও চাকরি পুনর্বিন্যাস বিষয়ক পরিষদের সঙ্গে অনেকগুলাে যৌথ বৈঠকেও বসে। কমিশন। তকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের চিন্তাভাবনার আলােকে কাজ করার সুযােগ পাওয়ায় তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানায় ।। কমিশনের বৈঠকগুলোেত বিশেষত ১৯৭২ সালের ১৬ আগস্ট অনুষ্ঠিত বৈঠকে। সদস্যগণের মনে এমন কিছু প্রশ্ন দেখা দেয় যেগুলাে কমিশনের জন্য সরকার নির্ধারিত বিবেচনার বিষয়াদির আওতাধীন ছিল না। এসব প্রশ্ন চাকরিবিষয়ক পুনর্বিন্যাস পরিষদ এবং চাকরি সংস্থাসমূহের সঙ্গে কমিশনের যৌথ বৈঠককালে উঠে আসে। এমন পরিস্থিতিতে জাতীয় বেতন কমিশন কতিপয় সুপারিশ নির্ধারিত সীমা (Terms of Reference) বহির্ভূতভাবে করেছিল। কমিশনের সুপারিশে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক চাকরিবিষয়ক পুনর্বিন্যাস পরিষদ এবং চাকরি সংস্থাগুলােকে তাদের বিদ্যমান ব্যবস্থানুযায়ী নীতিমালা তৈরির পরামর্শ দেওয়া হয়। দেশ-বিদেশের প্রশাসনিক নীতিমালা সম্পর্কে পর্যাপ্ত দলিলপত্র, তথ্য-উপাত্ত থাকায় কমিশন সীমাবদ্ধতার মাঝেও যুক্তরাজ্য, কানাডা, নাইজেরিয়া, ঘানা, বার্মা, সুইডেন হাঙ্গেরি প্রভৃতি দেশের বেতনকাঠামাে সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত পর্যালােচনা করে। ভারত ও সাবেক পাকিস্তানের প্রাসঙ্গিক তথ্যও কমিশন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখেছিল।

জাতীয় বেতন কমিশনের সভাপতি আবদুর রব এবং সদস্যবৃন্দ সর্বজনাব ডা. আজিজুর। রহমান খান, জহিরুল হক, কর্নেল জিয়াউর রহমান, আলমগীর ম. আ. কবির, মাে: ছয়ফুর রহমান, আব্দুর রশীদ, কাজী আনােয়ারুল মামুন, কিউ. এ. রহিম, এ, বি, এম, গােলাম

————–

  1. Report of the National Pay Commissien Bangladesh Vol. 1- Main Text, May 1973

——

মােস্তাফা (সদস্যসচিব) তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিকট জাতীয় বেতন কমিশনের প্রতিবেদন পেশ করেন। (পরিশিষ্ট ৪৯ দ্রষ্টব্য) প্রতিবেদনের সঙ্গে জাতীয় । বেতন কমিশনের ঢাকাস্থ ১৫৬ ধানমন্ডি আবাসিক এলাকার ১৩/৩ নম্বর সড়কে অবস্থিত। কার্যালয় থেকে ১৯৭৩ সালের ১৮ মে তারিখে এনপিসি/রিপাের্ট/৭২/৩৬৫, সংখ্যক একটি পত্রও দেওয়া হয়। পরিশিষ্টাংশে কমিটির সদস্যগণের স্বাক্ষর যুক্ত পত্রসহ প্রতিবেদন। দেওয়া হয়েছে। পত্রটি ছিল নিম্নরূপ :

“আপনার নিকট এই রিপাের্ট পেশ করতে পেরে আমরা আনন্দিত ও গর্বিত। সামন্তবাদের পর দুবার করে যে-দেশের স্বাধীনতা অর্জন করতে হয়েছে তার বেতনবিকার অনুমেয়। এই ব্যাধিগ্রস্ত ব্যবস্থার সুষম ও সুস্থ পরিবর্তনের যে দায়িত্ব সরকার। জাতীয় বেতন কমিশনের ওপর দিয়েছিলেন তা যথাযথভাবে পালন করতে পেরেছি। কিনা জানি না। তবে সেই উদ্দেশ্যে আমরা নিষ্ঠার সঙ্গে চেষ্টা করেছি। অতীত আমাদের খর্ব করতে চেয়েছে পদে পদে। ভবিষ্যতের অনুমােদন পাবাে এই আশায়। আমরা অতীতের বন্ধনের উর্ধ্বে ওঠার বলিষ্ঠ চেষ্টা করেছি। সরকারের কাছে আমরা। কৃতজ্ঞ যে তারা আমাদেরকে এই কঠিন দায়িত্বের উপযুক্ত মনে করেছেন। সাম্রাজ্যবাদী ও নব্য উপনিবেশবাদী সরকারের প্রয়ােজনীয়তা অনুসারে যে বেতন । ও আয় বৈষম্যের অবিচার পর্বতপ্রমাণ হয়ে সমাজে দাঁড়িয়ে আছে, তার মধ্য থেকে। পরিপূর্ণ সমাজবাদী বেতনব্যবস্থার উদ্ভব করা এই কমিশনের পক্ষে অসম্ভব বললেও বােধ হয় অতিশয়ােক্তি হবে না। জাতীয় বেতন কমিশন সরকারের কাছে সেই। পরিপ্রেক্ষিত সম্পর্কে সচেতনতার আবেদন করে।। এখানে বলা প্রাসঙ্গিক যে চাকরি পুনর্বিন্যাস কমিটির প্রশাসনিক প্রস্তাবের স্তর অনুযায়ী। আমরা বেতন হার সুপারিশ করেছি। জাতীয় জীবনের শান্তিপূর্ণ প্রগতি নির্ভর করে নিত্যপ্রয়ােজনীয় দ্রব্যাদির উপযুক্ত। সরবরাহ এবং ন্যায্যমূল্যের উপর, বিশেষ করে বিতরণ প্রথার উপর। এই ব্যবস্থার। সুষ্ঠতা আমাদের প্রস্তারের মৌলিক অঙ্গ। দ্রব্যাদির মূল্য হ্রাস ও বিতরণব্যবস্থার আশু। উন্নতি না হলে আমাদের প্রস্তাবসমূহ অপ্রাসঙ্গিক ও অর্থহীন প্রমাণিত হবে। আমাদের প্রস্তাব আপনার সরকারের কাছে গ্রহণযােগ্য হবে বলে আমরা আশা করি।

ধন্যবাদান্তে আরজ,

ইতি,

আপনার অনুগত, । জাতীয় বেতন কমিশনের সভাপতি ও সদস্যবৃন্দ। ”

প্রধানমন্ত্রীর কাছে জাতীয় বেতন কমিশনের প্রতিবেদন পেশকালে প্রদত্ত পত্রে সদ্য

———-

৩. Report of the Natical Pay Commission Bangladesh, Vol.1- Main Text, May 1973

———

স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনকাঠামােয় বিদ্যমান বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরা হয়। এই বৈষম্যের শিরদাঁড়া আগে থেকেই শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল পাকিস্তান সরকারের অনৈতিক কূটকৌশলে। পাকিস্তানি শাসকবৃন্দ পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ববঙ্গের বাঙালি জনগণের মঙ্গল ও কল্যাণের কথা কখনাে ভাবেনি, এমনকি তারা এই ভূখণ্ডের সার্বিক উন্নয়নেও কোনাে ভূমিকাই রাখেনি। ব্রিটিশ শাসনামলের ওপনিবেশিক মনােভাব নিয়ে তারা পাকিস্তানের বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিষয়-আশয় দেখত। ভারতীয় উপমহাদেশ বিভক্ত হলে পাকিস্তানের পূর্ব ও পশ্চিম অংশের উন্নয়ন ও কল্যাণের ক্ষেত্রে প্রথম থেকেই যে বৈষম্য শুরু হয় তা বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দৃষ্টি এড়ায়নি। বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত হয়ে শত শত সমস্যার সম্মুখীন হন। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠন, বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের পুনর্বাসন, বিশৃঙ্খল অর্থনীতিতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে গৃহীত ব্যবস্থাদির সঙ্গে রাষ্ট্রের প্রশাসনিক পর্যায়ের চাকরি কাঠামাে ও বেতনবিন্যাসেরও পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, তকালীন অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদও বঙ্গবন্ধুর সাথে একযােগে স্বাধীন বাংলাদেশকে বৈষম্যহীন রাষ্ট্রে পরিণত করতে আত্মনিয়ােগ করেছিলেন। সরকারের সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার নীতি বাস্তবায়নের অন্যতম পদক্ষেপ হিসেবে চাকরিকাঠামাে ও বেতন-হার তদনুযায়ী করতে বেতন কমিশনকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। কর্মপরিধির (Terms of Reference-এর আওতায় কমিশন পৃথিবীর কয়েকটি সমাজতান্ত্রিক দেশ যথা- যুগােস্লাভিয়া, বুলগেরিয়া, জিডিআর ইত্যাদি দেশের বেতন-পরিকল্পনা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ এবং প্রতিবেদন পেশের জন্য তিন-সদস্যবিশিষ্ট একটি গ্রুপ কমিটিকে দায়িত্ব দিয়েছিল। এই কমিটির সদস্য ছিলেন ড. এম. এ. রশীদ, জনাব এ বি এম গােলাম মােস্তাফা এবং কর্নেল জিয়াউর রহমান। ওইসব বন্ধু (host) দেশের বেতন পরিকল্পনা সম্বন্ধে এই গ্রুপ কমিটি একটি অত্যন্ত মূল্যবান প্রতিবেদন কমিশনের নিকট পেশ করেছিল। 

পাকিস্তানের কবলমুক্ত হওয়ার পর স্বাধীন বাংলাদেশে বিভিন্ন শ্রেণীর পূর্ববর্তী কয়েক শ’ কর্মচারীর জন্য প্রচলিত প্রায় দুই হাজার দুই শ’ বৈষম্যমূলক ও অরাজক বেতন-হার (pay scales) নিয়ে কমিশনকে এক জটিলতম পরিস্থিতির মুখােমুখি হতে হয়। এই পরিস্থিতি মােকাবেলা করে বাংলাদেশ সরকার বেতনহারে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধণ করেন। এই পরিবর্তনের ফলে বেতনহার আগেও প্রচলিত দুই সহস্রাধিক বেতন হারকে মাত্র ১০টি গ্রেডে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। স্বাধীনতার চার দশক পর এখন (২০১৩ সালে) ভাবতে অবাক লাগে যে, বঙ্গবন্ধুর সরকার কর্তৃক গঠিত জাতীয় বেতন কমিশন যে দূরূহ কাজটি করেছিল। তারই ধারাবাহিকতায় নতুন বেতনহার নির্ধারণের প্রক্রিয়া এখনও অব্যাহত আছে। এতে বঙ্গবন্ধুর সরকারের চিন্তাধারাবহির্ভূত নতুন উল্লেখযােগ্য কোনাে পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়নি। কাজেই এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, বঙ্গবন্ধুর সরকারই সুষ্ঠু সুশৃঙ্খলভাবে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে পথিকৃৎ হিসাবে পরিগণিত হওয়ার দাবিদার।

সূত্র : বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১-৭৫ এইচ টি ইমাম

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!