You dont have javascript enabled! Please enable it!

দেশ পুনর্গঠনে সরকারের প্রারম্ভিক কর্মসূচি

শক্রমুক্ত বাংলাদেশের সামনে প্রধান করণীয় কাজ ছিল যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠন এবং ক্ষতিগ্রস্ত সমগ্র বাঙালি জনগণের পুনর্বাসন। কিন্তু তা ছিল এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। এই কাজ সম্পন্ন করা সহজ ছিল না। কারণ এ কাজের সঙ্গে নবােজাত বাংলাদেশের আরাে অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব ছিল। তবে পুনর্গঠনের কাজ সুচারুরূপে সম্পন্ন করার জন্য সরকার পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বঙ্গবন্ধুর সহযােগীবৃন্দ প্রতীক্ষায় ছিলেন। সর্বোপরি তারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মুক্তির জন্য তৎপরতা আরাে জোরদার করে। এ সময় পাকিস্তানের পশ্চিমাংশের রাজনীতিতেও ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে সরিয়ে পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান রাজনীতিক জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তানের প্রধান সামরিক প্রশাসক ও প্রেসিডেন্ট পদে বসেন। তিনি পাকিস্তানি জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করার চিন্তাভাবনা করেন। এ জন্য ভুট্টো ১৯৭১ সালের ২৭ ডিসেম্বর রাওয়ালপিন্ডির বাইরে এক বাংলােয় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সমঝােতামূলক আলােচনা করেন। জানা যায়, বঙ্গবন্ধু এই বাংলােয় ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত অবস্থানকাল নাটকীয়তায় ভরা ছিল। এর মধ্যে ১৯৭২ সালের ৩ জানুয়ারি পাকিস্তান টেলিভিশনের সান্ধ্যকালীন সংবাদে করাচির জনসভায় বঙ্গবন্ধুর মুক্তি সম্বন্ধে ভুট্টোর ইতিবাচক জনমত যাচাইয়ের খবর এবং দৃশ্য প্রচারিত হয়। এসব তথ্য নিউইয়র্ক থেকে ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত রবার্ট পেইনের “ম্যাসাকার” শীর্ষক গ্রন্থে বিস্তৃতভাবে বর্ণিত হয়েছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের ২১ দিন পর ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। মুক্ত বাংলায় বঙ্গবন্ধুর প্রথম ভাষণ পাকিস্তানের সামরিক সরকারের বন্দিত্ব থেকে মুক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু লন্ডন-দিল্লি হয়ে স্বদেশের মাটিতে কীভাবে পৌছেছিলেন তার বিবরণ এই গ্রন্থের দ্বিতীয় অধ্যায়ে দেওয়া হয়েছে। ঢাকা বিমানবন্দর থেকে বঙ্গবন্ধু সরাসরি তৎকালীন রমনা রেসকোর্স ময়দানে তার প্রথম জনসভায় স্পষ্টভাবে পাকিস্তানের উদ্দেশে বলেছিলেন, “…আপনারা সুখে থাকুন। আপনাদের সঙ্গে আর না। বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে। আমরা স্বাধীন, এটা মেনে নিন।  রেসকোর্সের ময়দানে বঙ্গবন্ধু আবেগাপ্লুত কণ্ঠে সমবেত লাখ লাখ মানুষকে বারবার।

একটি কথাই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিলেন। কথাটি ছিল ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের পুনর্গঠন কাজ সম্পর্কে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে সম্মিলিত উদ্যোগে সােনার বাংলা হিসেবে গড়ে তােলার আহ্বান ধ্বনিত হয়েছে তাঁর ভাষণে শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দেশ পুনর্গঠনের কাজে সবাইকে আন্তরিক হওয়ার আহ্বান জানান তিনি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাংলাদেশের সর্বত্র ধ্বংসের প্রতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, “আমার জনগণ এখন গৃহহীন ভিখারী । বাংলাদেশের পুনর্গঠনের জন্য আমি পৃথিবীর সকল দেশের সাহায্য কামনা করি।” প্রথম সাংবাদিক সম্মেলন পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক বাঙালি জাতির ওপর চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধে বাংলাদেশে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছিল, তার একটি চিত্র পাওয়া যায় স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর বঙ্গবন্ধুর প্রথম আনুষ্ঠানিক সাংবাদিক সম্মেলনের বিবরণী থেকে। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১৪ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত সাংবাদিক সম্মেলনে প্রদত্ত বিবৃতিতে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের ক্ষত কাটিয়ে ওঠার লক্ষ্যে সবার সহযােগিতা কামনা করেছিলেন। সদ্যস্বাধীন দেশে যারা বাস্তুহারা হয়েছেন তাদের পুনর্বাসন প্রসঙ্গে ১৬ জানুয়ারি জাতীয় শােক দিবসের অনুষ্ঠানে মুনাফাখখার ব্যবসায়ীদের সতর্ক করে বলেছিলেন যে, তারা এমন কিছু না করে যাতে বাস্তুচ্যুত মানুষের দুঃখ-দুর্দশা আরাে বৃদ্ধি পায়। বাস্তুহারাদের মধ্যে জমি বরাদ্দের ব্যবস্থা ঢাকা শহর ও শহরতলী এলাকায় তাঁর সরকার করেছে বলে  তিনি ওই অনুষ্ঠানে উল্লেখ করেন। টাঙ্গাইলের জনসভায় ২৪ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পুনর্বাসন ও ঘরবাড়ি, অন্যান্য অবকাঠামাে পুনর্গঠনের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিলেন। যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠন প্রসঙ্গে যুদ্ধপূর্ব এই ভূখণ্ডের চিত্র বর্তমানে এক ইতিহাস। ব্রিটিশ শাসনের নাগপাশ থেকে প্রায় দুশাে বছর পর মুক্ত হয়ে ভারতীয় উপমহাদেশ দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রে বিভক্ত হলেও পাকিস্তান নামীয় রাষ্ট্রের পূর্বাংশের বাঙালি জনগণের দুঃখদুর্দশার ভাগ্যের কোনাে পরিবর্তন হয়নি। বাঙালি জনগণকে সুদীর্ঘ ২৪ বছর স্বাধীনতা-সংগ্রামে লিপ্ত থাকতে হয়েছে।

পাকিস্তানের পশ্চিমাংশের সামরিক শাসকেরা পূর্বাংশের বাঙালি জনগণের ওপর ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত করে চাপিয়ে দেয় যুদ্ধ। বাঙালি জনগণ তাদের অবিসংবাদী নেতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যুদ্ধ মােকাবিলা করে পাকিস্তানের পূর্বাংশ তথা পূর্ববঙ্গকে শত্রুমুক্ত করে ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর। কিন্তু জাতির জীবনে নেমে আসা এই ভয়াবহ যুদ্ধ (যা জাতীয় ইতিহাসের অধ্যায়ে মুক্তিযুদ্ধ’ শিরােনামে জনপ্রিয়) সমগ্র ভূখণ্ডে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত যা ছিল, যতটুকু ছিল তা-ও চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিয়েছিল। মাত্র ৯ মাসের যুদ্ধে বাংলাদেশের জনপদে জনবসতিসহ সহায়-সম্পদের যে ক্ষতি ও ধ্বংস হয়েছিল তা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ও কোনাে দেশের শত্রুপক্ষ করেনি। দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে পরিকল্পিতভাবে পাঞ্জাবিরা ধ্বংস করে দিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বর্বর বাহিনী তাদের এদেশীয় কিছু বিশ্বাসঘাতক বাঙালি এবং দেশভাগের সময় ভারতভূমি থেকে চলে আসা অবাঙালি (বিহারি) বাংলাদেশের গ্রামের-শহরের ঘরবাড়ি, স্কুলঘর, হাটবাজার, জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেয়। তারা রাস্তাঘাট, পুল-কালভার্ট-ব্রিজের ক্ষতিসাধন করে। শুধু এসব কাজ করেই পাকিস্তানি বর্বর বাহিনীর সদস্য এবং তাদের দোসররা ক্ষান্ত থাকেনি, তারা লাখ লাখ সাধারণ মানুষকে হত্যা করে। নারী নির্যাতন করে। যুদ্ধের রীতিনীতি ভঙ্গ করে এ ধরনের ধ্বংস পৃথিবীর ইতিহাসে দেখা যায় না। ব্যাংকের টাকা পােড়ানাে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তহবিল শূন্য করে ফেলা, বুদ্ধিজীবী হত্যা করা, খাদ্যগুদাম জ্বালিয়ে দেওয়া কৃষিব্যবস্থা স্থবির করা, পণ্য সরবরাহ ও যাতায়াতব্যবস্থা ধ্বংস করে দেওয়া, অবাঙালিদের নিয়ে বাংলাদেশের সমাজ গঠনের অপচেষ্টা ইত্যাদি ছিল বাঙালি জাতিকেই নিশ্চিহ্ন করার ঘৃণ্য পরিকল্পনা। হানাদার বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞ পরিকল্পনা অনুযায়ী পাকিস্তানী বাহিনী মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে বাংলাদেশের যা কিছু জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে এবং লুট করে ধ্বংস করে তাতে একটি জাতিকে পঙ্গু করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। পাকিস্তানিরা মুক্তিযুদ্ধের সময় সরকারি খাদ্যগুদাম থেকে সমস্ত খাদ্যশস্য সেনানিবাসে স্থানান্তর করেছিল পরিকল্পিতভাবে।

এ সময় বাংলাদেশের জনগণের জন্য খাদ্য আমদানি সম্পূর্ণ বন্ধ করে রাখে তারা। ফলে যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই দেখা গেল সরকারি খাদ্যগুদামগুলাে শূন্য সবচেয়ে জঘন্যতম কাজ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী করেছিল তাদের ছাউনিতে মজুদ করা লাখ লাখ টন খাদ্যশস্য পুড়িয়ে দিয়ে। বিশ্বব্যাংকের প্রাথমিক জরিপ থেকে জানা যায় যে, শুধু খাদ্যশস্য আমদানি বন্ধ রাখা নয়, কৃষকের হাতে তিন ভাগের এক ভাগ আবাদের জন্য বীজ ধানও মজুদ ছিল না। ওই জরিপে বলা হয়েছিল যে, সার, কীটনাশক, হালের বলদ, পাওয়ার পাম্প, গভীর-অগভীর নলকূপ ইত্যাদি নতুনভাবে সংগ্রহ করতে হবে। গমবীজ, বােরাে ধানবীজ, আলুবীজের তাৎক্ষণিক প্রয়ােজনীয়তার কথা বিশ্বব্যাংক তাদের জরিপে উল্লেখ করে বলেছিল, সদ্য শত্রুমুক্ত বাংলাদেশে তিন হাজার মণ গমবীজ, বােরােধানের বীজ ২ হাজার মণ, ৩০ হাজার টন সার, আলুবীজ ১৫০০ হাজার টন, ২০ হাজার পাওয়ার পাম্পের প্রয়ােজন। তাদের জরিপে শিশুদের দুধের অভাবের আশঙ্কাও ব্যক্ত করা হয়েছিল। এ জন্য দুগ্ধবতী গাভী এবং কৃষি আবাদের জন্য হালের বলদ প্রয়ােজন বলে বিশ্বব্যাংক আভাস দেয়। তাদের জরিপে প্রকাশ পায় যে সরকারিবেসরকারি অফিস-আদালত হাসপাতাল, স্কুলঘর, গুদামঘরসহ অসংখ্য বসতবাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছিল পাকিস্তানিরা। তাদের হিসাবে শুধু গ্রামাঞ্চলেই ৪৩ লাখ ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। প্রত্যাগত শরণার্থীদের জন্য কমপক্ষে ১০ লাখ বাড়িঘর জরুরি ভিত্তিতে নির্মাণের প্রয়ােজনীতা দেখা দেয়। জরিপে ৩০ লাখ টন খাদ্য ঘাটতির কথা উল্লেখ ছিল।  পাকিস্তানিরা আরাে যেসব ক্ষতিসাধন করেছিল তার মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেওয়ার কাজ অন্যতম। এই বন্দরকে ধ্বংস করে দেওয়া ছাড়াও তারা বন্দর থেকে বহু দূর পর্যন্ত সমুদ্রপথে মাইন পেতে রেখেছিল। এতে জরুরি ভিত্তিতে খাদ্যশস্য আমদানি করে এনে জাহাজ নােঙর করানাের উপায় ছিল না। স্থলপথের রেল, সড়ক, সেতু ধ্বংস করে যােগাযােগব্যবস্থা বিপর্যস্ত করা হয়েছিল। ট্রাক ও রেলের মালবাহী বহু বগি , ধ্বংস করা হয়। ডিনামাইট দিয়ে ইঞ্জিন মেরামতের কারখানাও উড়িয়ে দেয় পাকিস্তানি হানাদাররা। বাংলাদেশ রেলওয়ের তকালে প্রণীত প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল যে, ৪৫ মাইল রেলপথ পুনরায় স্থাপন করে রেল যােগাযােগ একটি বিশেষ অবস্থায় আনা সম্ভব।

সড়ক বিভাগের ১৯৭২ সালের একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, ১৩০টি বড় ও মধ্যম আকৃতির সেতু সম্পূর্ণ নতুন করে নির্মাণ করা প্রয়ােজন, সেতু পুনর্মির্মিত না হওয়া পর্যন্ত ১৫০টি ইঞ্জিনচালিত ফেরির প্রয়ােজন, খাদ্যবাহী কার্গো কমপক্ষে ১৫০০টি প্রয়ােজন অভ্যন্তরীণ নৌপথে খাদ্যশস্য পরিবহণের জন্য। বিশ্বব্যাংক ক্ষতিগ্রস্ত শিল্পকারখানা সম্বন্ধে জরিপে মন্তব্য করেছিল যে, ২৩৭টি বিভিন্ন আকারের শিল্পকারখানার মধ্যে ১৯৫টি কারখানাই কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে; এগুলাের মধ্যে শুধুমাত্র ছােট আকৃতির ৬৩টি কারখানার সংস্কার ও নতুন যন্ত্রাংশ ক্রয়ে এবং এগুলি চালু করতে কাঁচামাল ক্রয়ে প্রায় এক কোটি ডলারাে প্রয়ােজন কল-কারখানার বেশির ভাগেরই মালিক অবাঙালি ছিল। এসব শিল্পকারখানার ম্যানেজার, ডাইরেক্টররাও ছিল অবাঙালি। বিশেষজ্ঞ ও দক্ষ শ্রমিককর্মচারীরও প্রকট অভাব দেখা দিয়েছিল। এসব সমস্যা সমাধানেও বাংলাদেশ সরকারকে ব্যবস্থা নিতে হয়।  বঙ্গবন্ধুর অনুপ্রেরণায় সরকারি-বেসরকারি সব স্তরের মানুষ ধ্বংসপ্রাপ্ত দেশের পুনর্গঠন কাজে আত্মনিয়ােগ করে। বিশ্বব্যাংকের জরিপ থেকে আরাে জানা যায় যে, কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত ৯০০ কলেজ, ৬০০০ উচ্চবিদ্যালয়ের জন্য তিন কোটি পাঠ্যপুস্তকের প্রয়ােজন। কিন্তু দেশে তখন কাগজের অভাব দেখা দেয়। খুলনা এবং চট্টগ্রামের কাগজকলের ৬৫% অবাঙালি শ্রমিক পালিয়ে যাওয়ায় কাগজ উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। এ দু’টি কাগজ কল চালু করতে কম করে হলেও ৬ মাস দরকার। এমতাবস্থায় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের চাপও বাংলাদেশ সরকারকে নিতে হয়। বাংলাদেশ সরকারের প্রাথমিক জরিপে বলা হয়েছিল যে, স্কুল-কলেজগুলােয় সেই মুহূর্তে প্রয়ােজন ছিল ১০ হাজার শিক্ষকের। যুদ্ধের কারণে দেশের বিদ্যুৎ-ব্যবস্থাও বিচ্ছিন্ন ছিল ।

যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে তাৎক্ষণিকভাবে বিদ্যুতের ১১ হাজার খুঁটির প্রয়ােজন ছিল। এমন আরাে ধ্বংসের বিবরণ ও পরিসংখ্যান বিশ্ব ব্যাংক, বাংলাদেশ সরকার এবং বিভিন্ন সংস্থা সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে তৈরি করেছিল। স্থানীয় আলবদর বাহিনী দিয়ে পাকিস্তানিরা বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী, বৈজ্ঞানিক, বিশেষজ্ঞ, শিল্পী, সাংবাদিকদের ব্যাপক হারে হত্যা করতে শুরু করে ১৬ ডিসেম্বরের কয়েক দিন আগে থেকে। তারা ১৬ ডিসেম্বর সকালে স্টেট ব্যাংকের টাকা ব্যাংকের সামনের চত্বরে, রাস্তায় এনে পুড়িয়ে ফেলে। ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্রও জ্বালিয়ে দেয় তারা। বাংলাদেশকে পঙ্গু করে ফেলার জন্য তারা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের পরিকল্পনা কমিশনের নথিগুলাে বেছে বেছে পুড়িয়ে দেয় । বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করামাত্রই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এসব কুকর্ম সম্বন্ধে অবহিত হয়েছিলেন। তবে লন্ডন-দিল্লি হয়ে ঢাকা প্রত্যাবর্তনের সময় বিমানেই বাংলাদেশে সংঘটিত ধ্বংসলীলার বিবরণ তিনি জেনেছিলেন। বঙ্গবন্ধু ঢাকায় এসে দেখলেন বাংলার নদীতে নৌকা চলে না, খাদ্যশস্য পরিবহণের বড় নৌকা নেই। তিনি অতি দ্রুতই উপলব্ধি করেছিলেন যে তাঁর সরকারকে শূন্য থেকে দেশ ও জাতিকে গড়তে হবে। পােড়ামাটি নীতি অবলম্বন করে পাকিস্তানিরা বাংলাদেশকে এক ভয়ঙ্কর অবস্থার মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব মতে, সারা দেশের মানুষজনের হাতে তখন মাত্র চার কোটি টাকার মতাে ছিল। বৈদেশিক মুদ্রার কোনাে মজুদ বাংলাদেশ ব্যাংকে ছিল না। দেশের সচিবালয়ে সব মন্ত্রণালয়ে নতুন সচিব, যুগ্মসচিব এবং সহকারী সচিবের প্রয়ােজন দেখা দেয়। মাত্র ১০ হাজারের মতাে নথি দিয়ে শুরু হয় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সচিবালয়। বঙ্গবন্ধু প্রথম যেদিন টেলিফোনে কথা বলতে শুরু করেন সেদিন ঢাকা জেলা থেকে মাত্র তিনটি জেলার সাথে যােগাযােগের ব্যবস্থা ছিল। অন্য জেলাগুলাের টেলিযােগাযােগ ছিল বিচ্ছিন্ন। বাংলাদেশ তখন এতটাই বিধ্বস্ত যে, ১৯৭২ সালের ২৩ জানুয়ারি লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় লেখা হয়, “সদ্য আবির্ভূত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে প্রয়ােজন সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া। বাংলাদেশ পুনর্গঠনের জন্য যে মেধা এবং বিশেষজ্ঞ দরকার তা তার নেই।” এমন সঙ্কটজনক এক পরিস্থিতিতে মুসলিম রাষ্ট্রগুলাে এবং চীন-আমেরিকা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অত্যাচার-নির্যাতন, জ্বালাও-পােড়াও লুটতরাজকে মানবিক বিপর্যয় হিসেবে না নেওয়ায় বাংলাদেশ আরাে কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল।

চীনা বেতার থেকে বাংলা ভাষায় যেসব অনুষ্ঠান প্রচারিত হতাে, তা বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে পাকিস্তান বেতারে প্রচারিত অনুষ্ঠানকেও হার মানাতাে। অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি অপেক্ষা বৈদেশিক বিমুখতা ও বিরােধিতা বাংলাদেশ পুনর্গঠনের বিষয়ে একটুও সহায়ক ছিল না। বঙ্গবন্ধু সরকার গঠনের পর রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নে হাত দেওয়া মাত্রই দেশের চিনপন্থী এবং বাংলাদেশবিরােধী মৌলবাদী শক্তির মধ্যে অশুভ আঁতাত গড়ে ওঠে। এই আঁতাত যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠনের কাজে প্রতিবন্ধক হয় এবং কর্মের গতি শ্লথ করে দেয়। শত শত সমস্যা জর্জরিত যুদ্ধে বিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠন ও পুনর্বাসন কাজে, বলতে গেলে, শূন্য থেকে দেশ গড়ার কাজে হাত দেন বঙ্গবন্ধু। প্রসঙ্গত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উল্লেখ করা দরকার। বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে লক্ষ করেন। যে, বাংলাদেশ সরকারের পুলিশ বাহিনী তখনাে অসংগঠিত। পঁচিশে মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকায় রাজারবাগ পুলিশ লাইনে অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে পুলিশ সংগঠনকে বিপুলভাবে লােকক্ষয়সহ অবকাঠামােগত ক্ষতিসাধন করেছিল। বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানী মুজিবনগর থেকে ফিরে তৎকালীন সরকার সব কিছু গুছিয়ে। নিতে বেশ বেগ পাচ্ছিল। সে সময় স্থানীয় প্রশাসনযন্ত্রের এমনই বিপর্যস্ত অবস্থা যে তা। দ্বারা শান্তিশৃঙ্খলা ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া এক কঠিন ব্যাপার ছিল। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছিল না বললেই চলে। সর্বহারার সিরাজ সিকদারসহ আরাে গাঢাকা দেওয়া গুপ্তঘাতক দল দেশের শান্তিশৃঙ্খলার বিঘ্ন ঘটাচ্ছিল। এদের অপতৎপরতা বন্ধে সরকারকে হিমশিম খেতে হচ্ছিল। এর মধ্যেও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মাে) এবং বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি সে-সময় ক্ষমতাসীন প্রথম বাংলাদেশ সরকারকে অতি ক্ষীণ।

সামর্থ্য-শক্তি নিয়ে সহায়তায় আগ্রহ প্রকাশ করে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে সমস্যার পাহাড় তাে ছিলই, তার ওপর পাকিস্তানি আমলের হিন্দুবিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িকতার বিষের প্রতিক্রিয়া পুনরায় শুরুর লক্ষণ স্পষ্টতর হতে থাকে। এমন সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক এবং কিছু বৈদেশিক বিরােধিতার মধ্যে বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী তাঁর সহযােগীসহ ধ্বংসস্তুপে পরিণত বাংলাদেশ গড়ে তােলার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর এই দায়িত্ব গ্রহণকে তকালে পৃথিবীর পত্রপত্রিকায় সাহসিকতাপূর্ণ কাজ বলে বিস্ময় প্রকাশ করা হয়েছিল। পুনর্গঠনের দায়িত্ব বঙ্গবন্ধুর সামনে সদ্যস্বাধীন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের যে বিশাল করণীয় দায়িত্ব ছিল তা এক কথায় বাংলাদেশের পুনর্গঠন। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধুর সরকারের গৃহীত চারটি মূলনীতি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা প্রধান প্রেরণাদায়ী স্তম্ভরূপে দেখা দেয়। এসব নীতি গ্রহণ করেও সরকারের পক্ষে জটিল হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশের পুনর্গঠন। কোনােভাবেই সরকারের পক্ষে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠন কাজ সহজ ছিল না। রাশিয়া কিংবা জাপানের পুনর্গঠনের চেয়েও বেশি কষ্টসাধ্য ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনের কাজ। যুদ্ধে বিপর্যস্ত বাংলাদেশের সামনে তথা বঙ্গবন্ধু-সরকারের সামনে যেসব সমস্যা প্রকটভাবে দেখা দেয় সেগুলাে ছিল নিম্নরূপ : ১, মুক্তিযুদ্ধকালে ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী প্রায় এক কোটি শরণার্থীর পুনর্বাসন; ২. বাংলাদেশে অবস্থানরত ভারতীয় সেনাবাহিনীর স্বদেশে ফেরত পাঠানাের ব্যবস্থা; ৩. রাজধানী ঢাকার প্রশাসনব্যবস্থায় শৃঙ্খলা আনয়ন; ৪. আইন-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় মুক্তিযােদ্ধাসহ অন্যান্য বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ ও পুনর্বাসন; ৫. জাতীয় অর্থনীতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা; ৬. সড়ক, সেতু, রেললাইন মেরামত ও পুনর্নির্মাণ; ৭. বাংলাদেশবিরােধী দালালদের বিচার; ৮, গা ঢাকা দেওয়া সন্ত্রাসী দলগুলাের (মাওপন্থী, সর্বহারা পার্টি, জাসদ, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি ইত্যাদির) সশস্ত্র তৎপরতা বন্ধ করা; ৯. বাংলাদেশের আটকেপড়া বিহারি এবং পাকিস্তানে আটকেপড়া সরকারি বেসরকারি বাঙালি জনগণের প্রত্যর্পণ; ১০. অবাঙালি মালিক ও দালালদের পরিত্যক্ত সম্পত্তি, শিল্প এবং বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে ব্যবস্থা। ওপরে চিহ্নিত সমস্যাগুলাে সমাধানে বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রয়ােজন ছিল সৎ দেশপ্রেমিক বিশেষজ্ঞ, আত্মত্যাগী সহকর্মী। পুনর্গঠনের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের কৃষক এবং কৃষিব্যবস্থাকে মূল লক্ষ্য হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। সরকারের দায়িত্বভার গ্রহণ করে বঙ্গবন্ধু ব্যাংক-বীমা এবং ভারী শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে জাতীয়করণ, পরিত্যক্ত সম্পত্তি আইন, মুক্তিযােদ্ধা পুনর্বাসনে মিলিশিয়া গঠন, ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মসূচি, রেললাইন-সড়কসেতু পুনঃনির্মাণ, টেলিযােগাযােগ ব্যবস্থা পুনঃস্থাপন প্রভৃতি কাজে হাত দিয়েছিলেন। এ ছাড়া, দ্রুততর ব্যবস্থায় বঙ্গবন্ধুর সরকার আমদানির মাধ্যমে শূন্যপ্রায় শস্যভাণ্ডার পূরণ করে। মানুষের চলাচল স্বচ্ছন্দ করার লক্ষ্যে যােগাযােগ ব্যবস্থা যথাসম্ভব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার পদক্ষেপ নেয় সরকার।

বিকল ও বিনষ্ট করে-দেওয়া কল-কারখানাগুলােকে মেরামত করে সচল করা হয়। প্রয়ােজনীয় কাঁচামাল এবং উপকরণাদি আমদানির ব্যবস্থা করে উৎপাদনে গতিসঞ্চারের চেষ্টা অব্যাহত রাখা হয়। জনসাধারণের প্রয়ােজনীয় অন্ন-বস্ত্র সমস্যার সমাধানকল্পে খাদ্যশস্য ও কাপড়চোপড় আমদানি করতে হয় সরকারকে। এ দেশের জীবনপ্রবাহ এবং সম্পদের ক্ষয়ক্ষতিতে মুক্তিযুদ্ধের পর ভয়াবহ অবস্থার কথা জেনে মানবতাবােধসম্পন্ন পৃথিবীর সব দেশই উদ্বিগ্ন হয়েছিল। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, জাতিসংঘের সাহায্যসংস্থা, আন্তর্জাতিক অন্যান্য সংস্থা মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের ক্ষয়ক্ষতির যে চিত্র তুলে ধরে তা ছিল শিউরে ওঠার মতাে। এদের একটি প্রাথমিক হিসেবে প্রকাশ পায়, একমাত্র সরকারি খাতে বস্তুগত মূলধন এবং দ্রব্যসামগ্রীর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল প্রায় ২৭৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা। কৃষি খাতে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল ৩৭৬ কোটি টাকা। অনুরূপভাবে আমদানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এবং বিতরণব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হওয়ায় ব্যবসাবাণিজ্য খাতে ক্ষতি দাঁড়িয়েছিল প্রায় ১০০ কোটি টাকায়। উৎপাদনের ক্ষেত্রে এসব ক্ষয়ক্ষতির প্রভাব মারাত্মক হয়ে দেখা দেয়। বলাই বাহুল্য, এসব ক্ষয়ক্ষতির সঙ্গে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুজনিত ক্ষতি, ব্যক্তিমালিকানাধীন ঘরবাড়ি ধ্বংস এবং মানুষের মানসিক ক্ষয়ক্ষতির হিসাব ধরা হলে ক্ষয়ক্ষতির চিত্র কল্পনারও অতীত হতাে। নিচের তালিকায় মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের ধ্বংসযজ্ঞে বস্তুগত মূলধন এবং অন্যান্য সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির চিত্র বােঝা যাবে। পরিবহণ, বিদ্যুৎ, শিল্প ইত্যাদি খাতে ক্ষয়ক্ষতির তুলনামূলক পরিমাণ এই তালিকায় উল্লেখ করা হয়েছে।

৯৬টিকে সাময়িকভাবে চলাচলের উপযােগী করে তােলা হয়েছিল। এ ছাড়া বন্দরে মালপত্র উঠানাে-নামানাের ব্যবস্থাদিও স্বাভাবিক পর্যায়ে আনতে সক্ষম হয়েছিল সরকার। তকালে বঙ্গবন্ধুর অনুরােধে সােভিয়েত ইউনিয়ন ক্ষতিগ্রস্ত বন্দরগুলােকে কার্যক্রম করে তুলতে সহায়তা করেছিল। নদীমাতৃক বাংলাদেশের নৌপথ পুনর্গঠনের কাজকেও খুব গুরুত্ব দিয়েই সম্পন্ন করা হয়। রেলসেতু নির্মাণ, সড়ক সেতু নির্মাণেও সরকার সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করে। ক্ষত্মিস্ত নৌযানসমূহ মেরামত করার উদ্যোগ গ্রহণ ছাড়াও বিদেশ থেকে বার্জ, নৌকা, ট্রলার, টাগ প্রভৃতি আমদানি, অবতরণ ক্ষেত্র ও ওয়ার্কশপ তৈরির প্রতিও দৃষ্টি দেওয়া হয়েছিল। বিদ্যুৎ : ১৯৭১ সালের যুদ্ধে নয় মাসে বিদ্যুত্ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বহু স্থানে উৎপাদন, বিতরণ ও সরবরাহব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে। সিদ্ধিরগঞ্জ উলন লাইন ৩৩ কেভির স্থলে ১৩২ কে ভিতে উন্নীত করা হয়েছিল। মেরামতের কাজকর্ম ছাড়াও ঈশ্বরদি উলন ও খিলগাঁও-এর। সাব-স্টেশনগুলাের নির্মাণ করা হয়।

প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে, বঙ্গবন্ধুর সরকার যখন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠনে আত্মনিয়ােগ করেছে, ঠিক তখনই কিছু জনবিচ্ছিন্ন রাজনৈতিক দল, সংগঠন রাজনৈতিকভাবে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেছিল। এসব দল-সংগঠনের মধ্যে ছিল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ভাসানী), বাংলা জাতীয় লীগ, জাতীয় গণমুক্তি পার্টি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (মা-লে), বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি, কংগ্রেস, বাংলাদেশ শ্রমিক ফেডারেশন, গণতন্ত্রী দল, পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টি (সিরাজ সিকদার), পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি (দেবেন সিকদার), কমিউনিস্ট সংহতি কেন্দ্র (নজরুল ইসলাম), পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি (আবদুল হক), পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি (মােহাম্মদ তােয়াহা, মা-লে), হুকুমতে রাব্বানিয়া (ভাসানী), মুসলিম বাংলা ইত্যাদি। এদের বিরােধিতা-প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও বঙ্গবন্ধুর সরকার ১৯৭৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাস শেষ হওয়ার আগেই পুনর্গঠনের অনেক কাজ সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছিল। এসবের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হলাে : ক) তেরাে মাসের মধ্যে কৃষকদের মাঝে ১০ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করা হয়েছিল; খ) সমবায় ঋণ বণ্টিত হয় ৫ কোটি টাকার; গ) সার সংগৃহীত হয়েছিল ৮৩ হাজার টন এবং বিতরিত হয়েছিল ৫০ হাজার টন; ঘ) বােরােধানের বীজ সরবরাহ করা হয় ২ হাজার ১২৫ মণ; ঙ) গমবীজ বণ্টন করা হয় ৩ হাজার টন; চ) আলুবীজ বণ্টিত হয় ১৭০০ মণ; ছ) গভীর নলকূপ বসানাে হয় ৯৪টি সেচের জন্য; জ) অগভীর নলকূপ ১০০টি (৩ ইঞ্চি ব্যাসের) বসানাে হয়; ঝ) ২০ হাজার পাওয়ার পাম্প সরবরাহ করা হয়; ঞ) সেচের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয় ৮০ লাখ একর জমিতে; ট) ট্রাক্টর ও কলের লাঙ্গল সরবরাহ করা হয় ২১টি করে; ঠ) হালচাষের ১ লাখ বলদ নামমাত্র মূল্যে দেওয়া হয়; ড) ভর্তুকি মূল্যে ৫০ হাজার গাভী দেওয়া হয়; ঢ) টেকি, চারল, আটার কলের ব্যবস্থা করা হয়।

এসব জরুরি কাজে প্রায় ৯ হাজার নতুন লােককে চাকরিতে নিয়ােগ করা হয় । জাতিসংঘের সহায়তায় টানা তিন মাস ৩০ কোটি টাকার খাদ্যসহ রিলিফ বিতরণ করা হয় এবং প্রায় ১০ লাখ ঘরবাড়ি নির্মাণ ও সংস্কার করা হয়। সরকার গ্রামপর্যায়ে ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্রণ কমিটি গঠন করে ৬৬ হাজারটি। এসব কমিটি জাতিসংঘ ও রেড ক্রসের সঙ্গে কাজ করত। সরকার ৬৩ কোটি টাকায় ৯৮টি সরকারি খাদ্যগুদাম ও থানাপর্যায়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত হাসপাতাল পুনর্নির্মাণ করেছিল। সরকারের প্রথম বছরে ৩০ লাখ টন খাদ্য ঘাটতির মধ্যে ২৬ লাখ টন সরবরাহ করে। অসংখ্য ব্রিজ, কালভাট, হাইওয়ে সংস্কারের কাজও বঙ্গবন্ধু সরকার করে। বহুবিধ কাজের মধ্যে সরকার কারখানাগুলাের উৎপাদনের জন্য ৩৪ কোটি টাকার কাঁচামাল আমদানি, শ্রমিক প্রশিক্ষণ এবং তাদের পুনর্বাসনের জন্য ২৮ কোটি টাকা ব্যয়, ৯০০ কলেজ ভবন সংস্কার, ৪০০ উচ্চবিদ্যালয় পুনর্নির্মাণ, শিক্ষকদের বকেয়া ৯ মাসের বেতন পরিশােধ করে। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলীকে বঙ্গবন্ধু সরকারীকরণের ব্যবস্থা করেছিলেন। ১৫০০ কিলােমিটার বিদ্যুৎ লাইন, ৩০০। মেগাওয়াট পাওয়ার পাম্প স্থাপন, ৯ হাজার বিদ্যুৎ শ্রমিক নিয়ােগ, ১৯৭৩ সালের মার্চ মাস নাগাদ মংলা ও চট্টগ্রাম বন্দরকে মাইনমুক্ত করার ব্যবস্থা করে বঙ্গবন্ধুর সরকার। ওই বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে বঙ্গবন্ধুর সরকার যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের গুরুতর মানবিক সমস্যা বাংলাদেশ-পাকিস্তান লােকবিনিময় শুরু করে। বিপর্যস্ত-বিধ্বস্ত ঢাকা পৌরসভাকে ১৯৭৪ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি কর্পোরেশনে পরিণত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বঙ্গবন্ধুর সরকার। শিক্ষাব্যবস্থা পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক গঠিত ড. কুদরাত-ই-খুদা কমিশন ১৯৭৪ সালের ২৪ মে প্রতিবেদন পেশ করলে তা ৩০ মে চূড়ান্ত করা হয়। এ ছাড়া যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত পাকশির হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পুনরায় চালু করা হয়েছিল।

এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে, প্রতিটি তথ্য এখনাে সহজলভ্য হওয়া সত্ত্বেও ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত সাড়ে তিন বছরে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের ঐতিহাসিক পুনর্গঠন-প্রক্রিয়া সম্বন্ধে কিংবা সাফল্য ও অগ্রগতি সম্বন্ধে আজ পর্যন্ত কোনাে গবেষণা কর্ম লক্ষ করছি না। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রহর থেকে প্রথম বাংলাদেশ। সরকারসহ বঙ্গবন্ধুর সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত থেকে এ বিষয়টি গভীর বেদনার। সঙ্গে শুধু দেখেই গেছি । মনের গভীরে সুপ্ত অভিপ্রায়ের তাগিদে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধু সরকারের খতিয়ানের সামান্য একটা দিক তুলে ধরার চেষ্টা এ অধ্যায়ে করা হলাে। বাংলাদেশের পুনর্গঠন নিয়ে গবেষণার কাজ গবেষক-অধ্যাপক-ইতিহাসবিদ-রাষ্ট্রবিজ্ঞানীসমাজবিদদের করার প্রয়ােজনীয়তা এখন খুব বেশি জরুরি কারণ, চীনপন্থী ও রাজাকার আঁতাত চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের কথা প্রচার করে এত দিন জনগণকে বিভ্রান্ত করে বঙ্গবন্ধু সরকারের দেশ পুনর্গঠনের সাফল্যের বিষয় আড়াল করতে যে অবস্থার সৃষ্টি করেছিল তা এখন আর তেমনভাবে নেই। নানা চড়াই উত্রাই পার হয়ে বঙ্গবন্ধুর শাহাদতবরণের সুদীর্ঘ কাল পর বাংলাদেশ আবার অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরে পেয়েছে। কাজেই  এখন বাংলাদেশ বিরােধী চক্রের অপপ্রচার মিথ্যাচারের জবাব দিয়ে জনগণ বিশেষত তরুণ সমাজের কাছে সত্য উদঘাটন করা দরকার। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর থেকে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হওয়ার আগ পর্যন্ত যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে বঙ্গবন্ধু সরকার কীভাবে পুনর্গঠন করে অগ্রগতির সােপানে স্থাপন করেছিল তার সব তথ্য। বাংলাদেশের সরকারি তথ্যভাণ্ডারে সংরক্ষিত আছে। আমার প্রত্যাশা, গবেষকগণ এসব তথ্য বিশ্লেষণ-পর্যালােচনা করে সমগ্র জাতিকে প্রকৃত তথ্য জানাতে এগিয়ে আসবেন।

সূত্র : বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১-৭৫ এইচ টি ইমাম

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!