You dont have javascript enabled! Please enable it! 1974.03.06 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | আবার পাটের গুদামে আগুন | রেল যাত্রায় নিরাপত্তাহীনতা দিন দিন বাড়ছে | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকা : ৬ই মার্চ, বুধবার, ১৯৭৪, ২২শে ফাল্গুন, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

আবার পাটের গুদামে আগুন

একই সঙ্গে তেইশটি পাটের গুদামে আগুন। আড়াই কোটি টাকা মূল্যের রপ্তানীযোগ্য পাট সহ প্রায় ৪ কোটি টাকার সম্পদ ভস্মীভূত। গত মঙ্গলবার বেলা ৩টার দিকে রহস্যজনকভাবে খুলনার দৌলতপুরের পাটের গুদামে আগুন লাগে।
সংবাদে প্রকাশ, একই সঙ্গে তিন জায়গায় অর্থাৎ একটি জুটি প্রেসে ও পাশাপাশি দুইটি আলাদা গুদামে আগুন জ্বলে ওঠে। গুদামে রক্ষিত অগ্নিনির্বাপক ‘এক্সটিংগুইসার’ গুলোতে কে বা কারা স্ক্রু এঁটে দিয়েছিলো। যে কারণে আগুন জ্বলে ওঠার পর যন্ত্রগুলো ব্যবহার করা সম্ভব হয়নি। ফলে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং এক ঘন্টার মধ্যেই জ.পি.এস.সি র‌্যালী, বাংলাদেশ ও গ্রীনল্যান্ড মার্কেন্টাইল করপোরেশনের ২৩টি গুদামে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। আগুন লাগার সময় গুদামে ও জুট প্রেসে পুরোদমে কাজ চলছিল। দুইটি জুটপ্রেসে ৬০ লক্ষ টাকার সমুদয় যন্ত্রপাতি আগুনের লেলিহান শিখায় বিনষ্ট হয়ে যায়।
খুলনার দৌলতপুর পাট গুদামের অগ্নিকান্ড নতুন কোনো ঘটনা নয়। চৌদ্দ মাস আগে ১৯৭২ সালের ১৫ই নভেম্বর এই দৌলতপুরে ২৯টি গুদামে আগুন লেগে প্রায় ৬ কোটি টাকার পাট ভস্মীভূত হয়।
নরসিংদী আলীজান জুট মিলের ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের পর মাত্র ৬দিন যেতে না যেতেই দৌলতপুরের পাট গুদামে আগুন লাগলো।
পাটের গুদামে আগুন লাগাটা যেন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনাতে দাঁড়িয়েছে। এই তো গত ২৫শে জানুয়ারী নারায়ণগঞ্জের কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট প্রাঙ্গণে অবস্থিত দু’টি সরকারী ও একটি প্রাইভেট কোম্পানীর ৩টি পাট গুদামে এক ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে প্রায় সোয়া ২ কোটি টাকার পাট সম্পূর্ণরূপে ভস্মীভূত হয়। সরকারী গুদামগুলোর মধ্যে জে.এম.সি’র একটি ও জেটিসি’র একটি। নারায়ণগঞ্জের অগ্নিকান্ডের সূত্রপাতও হয় বেলা ১টা নাগাদ। মধ্যাহ্ন বিরতির সময় কর্মচারীরা গুদাম থেকে বেরিয়ে আসার পরই এ অগ্নিকান্ড সংঘটিত হয়। জানুয়ারীতে নারায়ণগঞ্জ পাট গুদামে আগুন লাগার আগেও গত বছরের অক্টোবর মাস থেকে আরম্ভ করে জানুয়ারী পর্যন্ত সর্বমোট ৭টি অগ্নিকান্ড সংঘটিত হয়।
শীতকালীন মৌসুমে আবহাওয়া শুকনো থাকার দরুণ যেকোনো স্থানেই আগুন লাগার সম্ভাবনা থাকে। সেজন্যে শহরাঞ্চলের দমকল বাহিনীও সদাসতর্ক থাকেন। সুতরাং আগুন লাগাটা এ সময়ে স্বাভাবিক কিন্তু কথা এটা নয়। কথা হলো যখন দেখা যায় যে, একই ধরনের এবং একই সময়ে পর পর অনেকগুলো ঘটনার জন্ম হয় তখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে এ আগুন কি স্বাভাবিক না অস্বাভাবিক? ঘটনা না দুর্ঘটনা?
জানুয়ারীতে নারায়ণগঞ্জের অগ্নিকান্ড সংঘটিত হয়েছিল প্রকাশ্য দিবালোকে। দুপুর বেলা কর্মবিরতির পর অকস্মাৎ একটা শব্দ হয় জেটিসি গুদামের পাশে। তারপরই আগুন ছড়িয়ে পড়ে। দৌলতপুর পাটগুদামেও তাই হয়েছে। বেলা ৩টায় আগুন লাগে। আগুন যাতে না নেভানো যায় সেজন্য অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রগুলোর স্ক্রু এঁটে বন্ধ করে দেয়া হয়।
স্পষ্টতঃই বোঝা যাচ্ছে বাংলার ভাগ্য সোনালী আঁশ যাতে বিদেশে পাঠানো না যায় তার বিরুদ্ধে একশ্রেণীর দেশদ্রোহীরা তৎপর হয়ে উঠেছে। ওদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেয়া। আর তা করার প্রধান উপায় ও অবলম্বন হলো সোনালী আঁশকে বিনষ্ট করা। ভস্মীভূত করা।
দৌলতপুর, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী ও যশোহরের পাটগুদাম এবং কার্পেট গুদামে আগুন লাগার ঘটনা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। একই সূতোয় বাধা। যারা গ্রাম-গঞ্জ, শহর-বন্দরের নিরীহ মানুষদের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে, যারা হত্যা, লুঠতরাজ আর রাহাজানির রাজনীতি নিয়ে মঞ্চে অবতীর্ণ হয়েছে তারাই ‘জ্বালাও পোড়াও’ এর পথটি বেছে নিয়েছে। যেকোনো উপায়ে জনজীবনে বিপর্যয়, অর্থনীতিতে বিপর্যয় সৃষ্টিই তাদের লক্ষ্য।
এই ‘জ্বালাও পোড়াও’ রাজনীতিতে বিশ্বাসীদের সময় থাকতে যদি সরকার দৃঢ় হস্তে দম করতে এগিয়ে না আসেন তাহলে ভবিষ্যতে আরো অঘটন ঘটতে পারে। সরকারের উচিত যেকোনো উপায়ে এদের মূল উৎপাটন করা। এদের উচ্ছেদ করা। প্রসঙ্গতঃ এ কথাও আমরা বলবো যে, একা সরকারের পক্ষে এই দেশদ্রোহীদের দমন করা সম্ভব নয়। এজন্যে সর্বাগ্রে প্রয়োজন জনসাধারণের সক্রিয় সাহায্য ও সহযোগিতা। শুধু তাই নয় দেশের সকল দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে সম্মিলিতভাবে। আর তা যদি না হয় তাহলে আজ পাটের গুদামে পরশু কল-কারখানায় আগুন, তরশু চালের গুদামে আগুন ইত্যাকার ঘটনা ঘটতেই থাকবে।

রেল যাত্রায় নিরাপত্তাহীনতা দিন দিন বাড়ছে

গত পরশুদিন আবার এক ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। সংবাদে, প্রকাশ লাইনের দু’দিক থেকে দু’টো ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষের ফলে এ ঘটনা ঘটেছে। দু’টো ট্রেনের একটি ছিল যাত্রীবাহী অন্যটি মালবাহী ট্রেন। সংঘর্ষের ফলে আট ব্যক্তি নিহত এবং তেরো জন আহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে একজন মহিলাযাত্রী ও দু’জন রেল কর্মচারীও রয়েছেন। নিহতদের ছয়জন ঘটনাস্থলেই মারা গেছেন। কর্তৃপক্ষীয় সূত্রে জানা গেছে যে, কর্তৃপক্ষ নাকি পাঁচ জনের মৃত্যু সংবাদ এ পর্যন্ত পেয়েছেন। ড্রাইভারকে সরকারী নির্দেশে আটক করা হয়েছে এবং ক্ষতির পরিমাণ তদন্ত সংস্থাকে দেখবার নির্দেশও প্রদান করা হয়েছে। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গেছেন। এ দুর্ঘটনা অত্যন্ত ভয়াবহ এবং মারাত্মক। দেশের যোগাযোগ বিভাগের এই দিকটি অর্থাৎ রেল যোগাযোগ ব্যবস্থায় প্রথম থেকে দুর্ঘটনা লেগে রয়েছে। বছর খানেকের বেশী হলো দেশের বিভিন্নাঞ্চলে রেল দুর্ঘটনা প্রায়ই লেগে রয়েছে। এর কারণ খুঁজে বের করা হয়েছে কিনা তা আমরা আজো জানি না। কর্তৃপক্ষ শুধু দুর্ঘটনা বলে সমস্ত ব্যাপারটাকে উড়িয়ে দিতে পারেন না। এর পেছনে নিশ্চয়ই কোনো কারণ সক্রিয় রয়েছে। কর্তব্যে গাফিলতি অথবা অদক্ষ কর্মকর্তাদের দ্বারা পরিচালিত বলে এই দুর্ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। সাধারণ মানুষের এটাই ধারণা। আমাদের কর্তৃপক্ষও নিশ্চয়ই এটা অনুধাবন করেন। তবু সমস্যার গভীরে কেন অনুপ্রবেশ করেন না—এটাই আজ জনগণের প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। গত বছরের নভেম্বর মাসে নয়টি রেল দুর্ঘটনা ঘটেছে। রেল দুর্ঘটনার যেন হিড়িক পড়েছিলো নভেম্বর মাসে। আমরা তখনই কর্তৃপক্ষকে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছিলাম। রেল বিভাগের যে সকল সমস্যা রয়েছে তার গভীরে প্রবেশ করে প্রতিটি সমস্যার মোকাবেল করার আবশ্যকতা সম্পর্কে কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছিলাম। কিন্তু তা হয়নি বরং পরের মাসগুলোতে আবারও কয়েকবার রেল দুর্ঘটনা ঘটেছে। যাত্রীরা আজ তাদের নিরাপত্তার প্রশ্ন তুলেছে। আজ আর রেলপথে যাত্রার কোনো নিশ্চয়তা নেই। যেকোনো মুহূর্তে যেকোনো দুর্ঘটনায় পতিত হওয়া মোটেই অস্বাভাবিক নয়। গত পরশু দিনের ভেড়ামারার অদূরের রেল দুর্ঘটনা রেলযাত্রীদেরকে আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলেছে। এবং সেটাই স্বাভাবিক। ইতিপূর্বে নভেম্বর মাসে যে কয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটেছে তাতেও বহুপ্রাণ বিনষ্ট হয়েছে। সম্পদের ক্ষতি সাধিত হয়েছে। তখন আমরা রেল বিভাগের বেশ কয়েকটি অব্যবস্থার কথা বলেছিলাম। আজকেও আমরা মনে করি—স্বাধীনতা লাভ করার পর থেকে রেল সার্ভিসে বেশ শূন্যতা দেখা দিয়েছে। প্রয়োজনের তুলনায় ইঞ্জিন, ইঞ্জিন ড্রাইভার, দক্ষ কর্মকর্তা, স্টেশন মাস্টার ও গার্ডের অভাব রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে দক্ষতা বা কারিগরি যোগ্যতা ছাড়িয়ে তদবীর অগ্রাধিকার পেয়েছে—ফলে অনিবার্য অব্যবস্থা এবং তার থেকে দুর্ঘটনার উদ্ভব হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে নাকি, ক্লিনার্স হয়েছে ড্রাইভার, পয়েন্টসম্যান হয়েছেন স্টেশন মাস্টার। ফলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে একটা অব্যবস্থা রেল বিভাগে আজ প্রকট হয়ে উঠেছে। এবং তার থেকে দুর্ঘটনার উদ্ভব হচ্ছে। আমাদের কর্তৃপক্ষ এ বিষয়গুলোর যদি পুঙ্ক্ষানুপুঙ্ক্ষ বিশ্লেষণ করেন তাহলে আমরা মনে করি রেল বিভাগের দুর্ঘটনার কারণগুলো খুঁজে বের করতে সক্ষম হবেন। স্বাধীনতার পর প্রথম পর্যায়ে আমাদের দেশের সার্বিক যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ অচল ছিল। রেল বিভাগও ছিল তদ্রুপ। সরকার অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থার সচলতা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছেন। এবার প্রয়োজন এই যোগাযোগ ব্যবস্থায় যথার্থ পুনর্গঠন করা। রেল বিভাগের সমস্ত প্রতিকূলতা কাটিয়ে উঠে—এটাকে যেমন অন্যতম যোগাযোগের মাধ্যম তেমনি রাষ্ট্রীয় আয়ের একটি উল্লেখযোগ্য বিভাগ হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করা আজ আমাদের অন্যতম লক্ষ্য হওয়া উচিত। অথচ আমরা লক্ষ্য করছি পূর্বাপর রেল যাত্রাকে একটি আতঙ্কগ্রস্ত ব্যাপার বলে প্রতিপন্ন করা হচ্ছে। এবং দুর্ঘটনার মূলে হস্তক্ষেপ না করে চিরাচরিত বদলি বা বরখাস্তের পথ অবলম্বন করা হচ্ছে। আমরা পুনরায় বলবো-রেল কর্তৃপক্ষ যেন জনগণের আস্থা অবিলম্বে ফিরিয়ে আনেন রেলযানের ও রেল যাত্রার প্রতি।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন