You dont have javascript enabled! Please enable it!

মেজর আবু ওসমান চৌধুরী চুয়াডাঙ্গা ৩ এপ্রিল ১৯৭১
স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিল পত্র পঞ্চদশ খণ্ড
এদিকে পূর্বনির্দেশ অনুযায়ী ক্যাপ্টেন আজম চৌধুরী কুষ্টিয়ায় অধিকৃত সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ ও গাড়ী ৩রা এপ্রিল অতি প্রত্যুষে হেডকোয়ার্টার চুয়াডাঙ্গা অভিমুখে পাঠিয়ে দেয়। সেদিন আমি ও ডাঃ আসহাবুল হক সাহেব যখন আমাদের পরবর্তী পরিকল্পনার খসড়া তৈরি করেছি, এমন সময় সেখানে এসে উপস্থিত হলো ফরাসী টেলিভিশন কর্পোরেশনের ভ্রাম্যমাণ দল। তারা আমার কাছে বিশ্বময় টেলিভিশন পাবলিসিটির জন্য আমার সাক্ষাৎকার চাইলেন। আমি চিন্তা করে দেখলাম, যে পর্যন্ত একমাত্র বিবিসি ও আকাশবাণী ছাড়া আর কোথাও আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সঠিক রূপ প্রকাশ পায়নি। এমনকি বিবিসি থেকেও ২/৪টা খুচরো সংবাদ ছাড়া বিশেষ কিছু প্রকাশ পেত না। অতচ বিশ্ববাসী আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সঠিক রূপ এবং যুদ্ধ চালিয়ে যাবার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞার বিষয়ে জানতে না পারলে তাদের সমর্থন পাওয়া অসম্ভব। বিশ্বের সমর্থন ছাড়া যে কোন মুক্তিযুদ্ধ লোকালাইজড হতে হতে শেষ পর্যন্ত নিঃশেষ হয়ে যেতে বাধ্য হয়। তাই এ সুযোগ আমি হেলায় ফেলতে পারলাম না। দীর্ঘ ১৫ মিনিট পর্যন্ত আমার সাক্ষাৎকার নেয়া হল। আমার ৬ বছরের ছোট মেয়ে, দাকনাম তার কলি, তখন কাগজের উপর বাংলাদেশের পতাকা বানিয়ে সেটাকে ছোট একটা কঞ্চিতে লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। এত কচি শিশুর এত উদ্দিপনা ও মনোবল তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। সেই মুহূর্তেই তারা কলির সেই ভঙ্গিমার মুভি শট নিলেন, আরও নিলেন আমার স্ত্রী, বড় মেয়ে চম্পা এবং অন্যান্য আরও দু’চার-জনের সংক্ষিপ্ত কথা ও ছবি। আমাদের সৈনিকদের মনোবল দেখানো হলো নানাস্থানে ভারী অস্ত্রে সজ্জিত অবস্থান। বেলা তখন প্রায় সকাল ১০টা। এসে গেল কুষ্টিয়া হতে প্রেরিত অধিকৃত অস্ত্রশস্ত্র ও যানবাহনের কনভয়। কুষ্টিয়ার যুদ্ধে আমাদের অভাবনীয় জয়ের সেগুলি ছিল জীবন্ত নিদর্শন। টেলিভিশন কর্পোরেশনের সদস্যরা বেশ উৎসাহিত হলেন। সাথে সাথে সমস্ত ‘কনভয়’কে হেডকোয়ার্টারের সম্মুখে অবস্থিত রাস্তার উপর সার বাঁধিয়ে বড় বড় কামান ও মেশিনগুলির ভাল করে ডিসপ্লে করে রাখা হল। একের পর এক সুষ্ঠুভাবে তারা নিলেন এগুলোর জীবন্ত ছায়াছবি। আমাদের হাতে বন্দী লেঃ আতাউল্লাহ শাহ্‌কেও আনিয়ে মাথার ব্যান্ডেজ বাধা অবস্থায় সেই লাইনের অধিকৃত একটি জীপের পাশে বসিয়ে দেয়া হল। দীর্ঘ ১৫ মিনিট পর্যন্ত ধরা পড়ল তার জীবন্ত সাক্ষাৎকার।

আল্লাহ্‌র কি ইচ্ছা, শুটিং শেষ করে কর্পোরেশনের সদস্যরা তাদের টেপরেকর্ডার ও মুভি ক্যামেরা গুটাতে যাবে, ঠিক এমনি সময় আসল চুয়াডাঙ্গার উপরে পাকিস্তান বিমান বাহিনীর বিমান হামলা। চলল বিমানে-জমিনে লড়াই। কর্ণবিদারী আওয়াজে মুখরিত হয় চুয়াডাঙ্গা। এই সুযোগের অপচয় করেননি ফরাসী টেলিভিশন কর্পোরেশনের নির্ভীক সদস্যরা। অসম সাহসের সাধে তারা নিতে লাগলেন বিমানের উড্ডয়ন, বোমা ও রকেট নিক্ষেপ, জমিনমুখী গুলি ও এন্টি-এয়ারক্রাফট ফায়ার-এর ছবি ও আওয়াজ। ধরা পড়ল তাতে সৈন্যদের ব্যস্তসমস্ত অ্যাকশন ও রিঅ্যাকশনের জীবন্ত ছবি। বাংলার মাটিতে নিক্ষিপ্ত হল প্রথম নাপাম বোমা চুয়াডাঙ্গার ইপিআর উইং-এর প্রাক্তন হেডকোয়ার্টার ভবনে। ধরে গেল আগুন। কর্পোরেশনের সদস্যরা ভাগ্যবশত ঠিক সেখানটায় উপস্থিত ছিলেন। নাপাম বোমার নিক্ষেপ থেকে শুরু করে টার্গেট হিট, আগুন ধরা সবকিছুর জীবন্ত ছবি উঠে গেলো তাদের ক্যামেরায়। ওরা এত নির্ভীক যে ত্রস্ত গতিতে গাছের উপর উঠেও তারা এই আকাশ ও জমিনের যুদ্ধের ছবি তোলা পরিচালনা করেন।

এই যুদ্ধে আমাদের বিশেষ কিছু ক্ষতি হয় নি, শুধু একজন স্বেচ্ছাসেবকের গায়ে বোমার সামান্য একটা টুকরা লেগে সামান্য আহত হয়। তবে চুয়াডাঙ্গা শহরের ঠিক দক্ষিণ ভাগে একটা বাড়ীর কুঁড়েঘরে নাপাম বোমা নিক্ষিপ্ত হলে সে ঘরটা পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এত সুষ্ঠুভাবে এত সাহসের সহিত টিভির সদস্যরা এই জীবন্ত ছবি তোলার কাজ সমাপন করেন যে তাদেরকে আমি সালাম না জানিয়ে পারিনি।

আমার মনে আছে, এই মুভি রীলের মধ্যে আমি জোর দিয়ে একটা কথা পরিষ্কারভাবে বিশ্বকে জানিয়ে দিতে চেয়েছি যে, আমরা পৃথিবীর স্বাধীন দেশগুলোর শুধু নৈতিক সমর্থন চাই, বস্তুগত সমর্থনের দরকার আমাদের নেই, কারণ আমার হাতের চীনা এসএমজি’টা দেখিয়ে ওদেরকে শত্রুর অস্ত্র দিয়েই আমরা শত্রুকে হনন করবো।

পরিশেষে এই টিভি সদস্যদল আমাদের কাছে বিদায় গ্রহণ করে কলিকাতা যান। বলে গেলেন যে, তারা প্যারিসে সেদিনই চলে যাবেন এই অ্যাকশন ফিল্মের পাবলিসিটি দেবার জন্য।

পরবর্তীকালে এই সদস্যদলের দ্বিতীয়বার আগমন জানাতে পারলাম, তাঁরা নাকি এই ফিল্মের কপি আরও ৫১টি বিদেশী রাষ্ট্রের কাছে বিক্রি করেছে। আরো জানতে ও শুনতে পেলাম নামকরা চলচ্চিত্র পরিচালকের মাস্টার পিস ফিল্ম প্রোডাকশনের মত এই যুদ্ধের ফিল্মটিও সারা বিশ্বে সুপারহিট করেছিল, কারণ এটাই সে পর্যন্ত বহির্বিশ্বে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা ও প্রতিজ্ঞা সাফল্যজনকভাবে বিশ্বের স্বাধীনচেতা লোকদের মনোযোগ ও সমর্থন আকর্ষণ করতে পেরেছেন। লণ্ডন, ওয়াশিংটন ও অন্যান্য জায়গা থেকে সামরিক ও বেসামরিক অফিসাররাও এই সত্যের স্বীকৃতি দিয়েছিলেন।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!