You dont have javascript enabled! Please enable it!

রাজধানী ঢাকায় বাংলাদেশ সরকার

(বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানী মুজিবনগর থেকে ২২ ডিসেম্বর, ১৯৭১ বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্যগণ রাজধানী ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন।) বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় প্রথম মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণ ও দফতর পুনর্বণ্টন (২৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১)

খােন্দকার মােশতাক আহমদ : আইন ও সংসদীয় বিষয়াদি, ভূমি রাজস্ব

জনাব এম. মনসুর আলী : অর্থ, বাণিজ্য ও শিল্প

জনাব এ. এইচ, এম, কামারুজ্জামান : স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসন

শেখ আবদুল আজিজ : যােগাযোেগ

জনাব ফণীভূষণ মজুমদার : খাদ্য ও কৃষি, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন

জনাব আবদুস সামাদ আজাদ : পররাষ্ট্র।

জনাব জহুর আহমেদ চৌধুরী : স্বাস্থ্য, শ্রম, সমাজকল্যাণ

অধ্যাপক ইউসুফ আলী : শিক্ষা, পূর্ত, বিদ্যুৎ ও সেচ

২৭ ডিসেম্বর তারিখে সম্প্রসারিত মন্ত্রিসভার সদস্যদের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয় বঙ্গভবনে। এই প্রথমবার আনুষ্ঠানিকতার সাথে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করি আমি। আমন্ত্রিত ব্যক্তিবর্গ, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিবৃন্দ, বিদেশি মেহমান, সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা, সংবাদপত্র, রেডিও আর টেলিভিশনের উপস্থিতিতে মন্ত্রীদের নিয়ােগের ঘােষণা, এক-এক করে তাদের শপথবাক্য পাঠ করার অনুরােধ ইত্যাদি আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা হয়। ২৮ ডিসেম্বর তারিখে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভায় গৃহীত সিদ্ধান্তগুলাের মধ্যে অন্যতম ছিল শত্রুমুক্ত বাংলাদেশের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ার প্রস্তাব এবং ১৯৭১-৭২ অর্থবছরে আমন ধান ও চালের অভ্যন্তরীণ সংগ্রহ অভিযান-সংক্রান্ত।

৩১ ডিসেম্বর মন্ত্রিসভা ফুড করপােরেশন গঠন, পাট নীতি অনুমােদন, তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবিত তথ্যব্যবস্থাপনা অনুমােদন, জাতীয় মিলিশিয়া স্কিমের জন্য বাের্ড গঠন সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও অনুমােদন, গণহত্যা অনুসন্ধান কমিটি গঠন, সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তাদের স্ক্রিনিং পদ্ধতি ইত্যাদি সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল।

যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে কার্যক্রম শুরু করতে তখনকার ক্যাবিনেট ডিভিশন (মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ) অসাধারণ কর্মতৎপরতার স্বাক্ষর রাখে। ওই বিভাগে কর্মরত বেশ ক’জন সরকারি কর্মকর্তা তাদের দেশপ্রেম, দক্ষতা এবং পরিশ্রম দিয়ে অতি দ্রুত যেভাবে একটি সদ্য স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের জরুরি রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডগুলাে সমাধা করেন, তা তুলনাবিহীন।

মুজিবনগরে ক্যাবিনেট ডিভিশনের সচিবকে সহায়তা করতেন উপসচিব জনাব আকবর আলি খান (পরবর্তীকালে তিনিও ক্যাবিনেট সচিব হয়েছিলেন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টার পদ অলঙ্কৃত করেন)।

সৌভাগ্যক্রমে প্রাক্তন পূর্ব পাকিস্তানে কেন্দ্রীয় সরকারের ক্যাবিনেট ডিভিশনের একটি ছােট দপ্তর ছিল। সেখানে কর্মরত ছিলেন উপসচিব জনাব এম. এ. মজিদ, জনাব নাজিম উদ্দিন আহমেদ এবং জনাব শাহজাহান আমিন। নতুন ক্যাবিনেট ডিভিশনে তাঁরাও যুক্ত হয়ে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন এবং প্রতিটি কাজে স্বীয় মেধার স্বাক্ষর রাখেন। ‘৭১-এর মার্চ মাস থেকেই বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে কর্মরত ছিলেন জনাব মােঃ আসাদুজ্জামান। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সাথে সাথেই তিনি আমাদের সঙ্গে যােগ দেন। প্রথমে মুজিবনগরে এবং পরে মুক্ত বাংলার রাজধানী ঢাকায় কনফিডেনশিয়াল অফিসার হিসেবে গুরুদায়িত্ব পালন করেন। অত্যন্ত নিষ্ঠাবান এবং আস্থাভাজন কর্মকর্তা ছিলেন তিনি। ব্যক্তিগত সহকারী পদে কাজ করেছিলেন জনাব মােহাম্মদ ফোরকান। ক্যাবিনেট ডিভিশনে অন্য আর একজন অভিজ্ঞ কর্মকর্তা ছিলেন জনাব এম, এ, হাশেম। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের ক্যাবিনেটে সুপারিনটেনডেন্ট পদে নিয়ােজিত ছিলেন। পরে তাঁকে সেকশন অফিসার করা হয়।

সে সময়ে বাংলা সঁটলিপিকার (আজকের দিনের কম্পিউটার অপারেটর) পাওয়া খুব কঠিন ছিল। সৌভাগ্যক্রমে ক্যাবিনেট ডিভিশনে দু’জন অসাধারণ দক্ষ সি.এ. (কনফিডেনশিয়াল অ্যাসিসটেন্ট বা গােপনীয় সহকারী) যােগ দিয়েছিলেন একজন জনাব মােহাম্মাদ রায়হান উদ্দিন এবং অপরজন জনাব ওয়াজেদ আলী । শেষােক্তজন তার মেধা ও দক্ষতা সত্ত্বেও ১৯৭৫ পরবর্তী প্রেক্ষাপটে সচিবালয় ত্যাগ করে পুলিশ সার্জেন্ট হিসেবে যােগদান করেন। কিন্তু যত দিন তিনি ক্যাবিনেট ডিভিশনে ছিলেন, দক্ষতা ও নিষ্ঠার সাথেই দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ১৯৭২-সালের প্রথম দিকেই ক্যাবিনেটে উপসচিব পদে যােগদান করেন প্রাক্তন সিএসপি ও জেলা জজ জনাব কাজী হাবিবুল হক। মেধাবী এবং কর্মঠ ছিলেন তিনি। মন্ত্রিপরিষদ বৈঠকে সচিবকে সর্বপ্রকার সহায়তা করতেন। জনাব এম, এ, মজিদ এবং জনাব হাবিবুল হক-এই দুই প্রবীণ ও নবীন কর্মকর্তা ক্যাবিনেট ডিভিশনকে অত্যন্ত গতিশীল করতে স্থায়তা করেন। এ পর্যায়ে আমি প্রয়াত সরকারি কর্মকর্তা নাজিম উদ্দিন আহমেদের প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতে চাই। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের দ্বারা পরিচালিত সব রাষ্ট্রীয় আচার-অনুষ্ঠানে (যেমন শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান, ভিভিআইপিগণের এয়ারপাের্টে গ্রহণ ও বিদায়পর্বের আনুষ্ঠানিকতা ইত্যাদি) তিনি ছিলেন অপরিহার্য। সদা হাস্যময় এই ব্যক্তি তার অপর সহকারী শাহজাহান আমিনকে নিয়ে যেভাবে ত্বরিত কার্যসম্পাদন করতেন, তা আজকের এবং আগামী দিনের কর্মকর্তাদের জন্য আদর্শ হয়ে থাকবে।

এই সময়ে (১৯৭১ সালের ডিসেম্বর হতে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত) মন্ত্রিসভার বিভিন্ন সিদ্ধান্ত লিপিবদ্ধকরণ, বিতরণ এবং সাথে সাথেই তার বাস্তবায়নের জন্য সবাইকে প্রচণ্ড তৎপর থাকতে হতাে। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর এই তৎপরতা, কাজের উদ্যম ও গতি শতগুণ বেড়ে যায়। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের প্রথম অগ্নিপরীক্ষা হয় ২৩শে ডিসেম্বর, ১৯৭১ বাংলাদেশ সচিবালয়ের প্রাক্তন মন্ত্রিপরিষদ কক্ষে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিপরিষদ বৈঠকে। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সুদূরপ্রসারী বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এই বৈঠকে এবং সেগুলাে তাৎক্ষণিকভাবে বাস্তবায়নে ব্যর্থ হলে নতুন রাষ্ট্রের প্রভূত ক্ষতিসাধন হতে পারত। এ গ্রন্থের অন্যত্র এ বিষয়ে আলােচনা করা হয়েছে। আরেকটি অগ্নিপরীক্ষা আসে ২৭ ডিসেম্বর ১৯৭১-এ, যখন মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণ করে শেখ আব্দুল আজিজ, ফনিভূষণ মজুমদার, আবদুস সামাদ আজাদ, জহুর আহমেদ চৌধুরী এবং অধ্যাপক ইউসুফ আলীকে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি কর্তৃক মন্ত্রীদের নিয়ােগ, তাঁদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান, ঢাকায় অবস্থিত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকবৃন্দ, উচ্চপদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাবৃন্দ এবং দেশি-বিদেশি সব সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বঙ্গভবনে আমন্ত্রণ জানানাে, তাদের উপস্থিতি নিশ্চিত করা এবং শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করা বলাই বাহুল্য, সদ্য-স্বাধীন দেশে আনুষ্ঠানিকভাবে এটি ছিল এ ধরনের প্রথম কাজ। এ প্রসঙ্গে সহৃদয় পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের আগে নিয়াজী এবং গভর্নর ডা, মালেকের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য মিত্রবাহিনীর বিমান বঙ্গভবন আক্রমণ করেছিল। এতে দরবার হলসহ বঙ্গভবনের অবকাঠামােগত বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। সেই অবকাঠামাের মধ্যেই একটি অংশে এই সম্প্রসারিত মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে হয়।  নতুন দেশে রাষ্ট্রীয় আচার-অনুষ্ঠান (যাকে এক কথায় আমরা রাষ্ট্রাচার বলে জানি), তার অভিজ্ঞতা অনেকেরই ছিল না। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, প্রধান বিচারপতি, মন্ত্রী এবং প্রতিমন্ত্রীদের শপথ গ্রহণ এবং গােপনীয়তার অঙ্গীকার সংবলিত যে দলিলপত্র তখন ব্যবহার করা হয়, তাও সম্পূর্ণ নতুন। এই সময় জনাব নুরুল ইসলাম (অনু), জনাব মহীউদ্দীন খান আলমগীর, জনাব আকবর আলি খান প্রমুখ অত্যন্ত গঠনমূলক ভূমিকা রাখেন। তাদের পরামর্শ ও সহযােগিতা ব্যতীত মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এত বিশাল কর্মযজ্ঞ সমাধা করতে পারত কি না সন্দেহ। শত্রুমুক্ত স্বাধীন রাষ্ট্রে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি প্রত্যাবর্তনের পর বাংলাদেশে শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর যুগ- যা স্থায়ী হয় কিঞ্চিদাধিক সাড়ে তিন বছর, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত ।

বঙ্গবন্ধু আসার আগে নেয়া সিদ্ধান্ত

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ থেকে ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের আগে বাংলাদেশ সরকার যেসব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ও ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল তার একটি বিবরণ এই অধ্যায়ে প্রাসঙ্গিকভাবে তুলে ধরা প্রয়ােজন। কারণ, ঢাকায় বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভায় গৃহীত এসব সিদ্ধান্ত ঐতিহাসিক বিষয়। হয়ে রয়েছে। মুজিবনগরে অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং সেগুলাে বাস্তবায়ন করায় সরকারের ভূমিকা যেমন ইতিহাসের মূল্যবান উপাদান, তেমনি তার ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত বিভিন্ন বৈঠকে বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপও ঐতিহাসিক।

মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভা ঢাকায় ফিরে পরের দিন অর্থাৎ ২৩ ডিসেম্বর (১৯৭১) প্রথম বৈঠকে বসে সাবেক পূর্ব পাকিস্তান সরকারের ক্যাবিনেট রুমে। এই বৈঠকই ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সূচনা বৈঠক। এই ক্যাবিনেট রুমে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়া নিঃসন্দেহে এক তাৎপর্যময় ঘটনা। পাকিস্তানের মুসলিম লীগ সরকার এবং পরে পাকিস্তানি সামরিক সরকার বাঙালি জাতির স্বার্থবিরােধী বহু সিদ্ধান্ত ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত নিয়েছিল। এবার সেই ক্যাবিনেট রুমেই বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভা বৈঠকে বসে বাঙালি জাতির স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি নিয়ে আলােচনা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও সুপারিশমালা প্রণয়ন করে। এই কক্ষে অনুষ্ঠিত বৈঠকের প্রধান সিদ্ধান্ত ছিল বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষায় স্বীকৃতি দানজাতীয় মিলিশিয়ায় মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের অন্তর্ভুক্তকরণের সিদ্ধান্তও ওই বৈঠকে নেওয়া হয়েছিল। ঢাকার জেলা প্রশাসক নিয়ােগের বিষয়সহ বিভিন্ন বাহিনীকে ক্রম অনুযায়ী বিন্যস্তকরণ ও গেরিলা সদস্যদের ঐক্যবদ্ধ করে একক নিয়ন্ত্রণাধীনে আনয়ন সম্পর্কে আলােচনা হয়। মন্ত্রিপরিষদে গৃহীত পূর্ববর্তী সিদ্ধান্তগুলাের কথাও এই বৈঠকের আলােচনায় উঠে আসে। এসবের মধ্যে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্ক্রিনিং-এর সিদ্ধান্ত সম্বন্ধেও আলােচনা হয়। মন্ত্রিসভার পূর্ববর্তী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন প্রশ্নে বিভিন্ন খােলামেলা অভিমত ব্যক্ত হয়। এতে সরকারের মুজিবনগর অস্থায়ী কার্যালয় থেকে গৃহীত পদক্ষেপগুলাের সাফল্য এবং সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার অবদানের কথা ওই বৈঠকে ওঠে। একই সাথে বৈঠকে একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা ওঠে যে, চিহ্নিত দালাল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দ্রুত অপসারণ করা জরুরি। তা না হলে জনরােষ নিয়ন্ত্রণ করা সরকারের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়তে পারে। 

বৈঠকের বিভিন্ন কার্যবিবরণীতে পদায়ন, স্ক্রিনিং, কর্মকর্তা-কর্মচারী সম্পর্কে প্রাথমিক সন্তোষজনক ধারণা, স্বেচ্ছাপ্রণােদিত পরিচিত দালালসহ অন্য দালালদের তালিকা প্রণয়ন এবং তা মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন, তাদের নিরাপত্তা হেফাজতে রাখা, যেসব রাজনৈতিক নেতা বা ব্যক্তি হানাদার শক্রর পক্ষে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে দালালি করে অপরাধ করেছে তাদের, আলবদর, রাজাকার, আলশামসের মতাে বাহিনীর সদস্য, বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে যেসব শিক্ষক, সাংবাদিক কিংবা সামরিক বাহিনীর বাঙালি সদস্য সাক্ষী দিয়েছে তাদের গ্রেফতারের বিষয় ইত্যাদি লিপিবদ্ধ হয়। এতদ্ব্যতীত ডা. মালিক এবং তার মন্ত্রিসভার সদস্যগণকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে তাদের গ্রেফতার, যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী ক্যান্টনমেন্টে অন্তরীণ অবস্থায় রয়েছে তাদেরও গ্রেফতার করে বিচারের সম্মুখীন করার বিষয়ও সেসব বৈঠকে আলােচিত এবং সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ডা. মালিক, তার মন্ত্রিসভার সদস্যগণ এবং ক্যান্টনমেন্টে অন্তরীণ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গ্রেফতারের পর তা প্রকাশ করা হবে বলেও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। জাতীয় মিলিশিয়ায় নিয়মিত বাহিনীর সদস্যগণ ছাড়া মুক্তিবাহিনীর সদস্য নিয়ে গঠনের ঘােষণা প্রদানেরও সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। সরকার এবং দেশবাসীর কৃতজ্ঞতার নিদর্শনস্বরূপ মুক্তিবাহিনীর ছাত্র-সদস্যদের অধিকতর উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযােগ দান, জাতীয় পুনর্গঠন কাজে সর্বাধিক মাত্রায় নিয়ােগকরণ, যােগ্যতার ভিত্তিতে (প্রয়ােজনবােধে ক্ষেত্রবিশেষে যােগ্যতা শিথিল করে) সরকারি চাকরিতে নিয়ােগ, নিয়মিত বাহিনীতে অন্তর্ভুক্তির জন্য যােগ্য হলে তাতে এবং পুলিশ বাহিনীতেও মুক্তিবাহিনীর সদস্যগণকে আত্তীকরণ কিংবা নিয়ােগ দেয়ার সুপারিশ করা হয়। উল্লেখ্য, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে এ লক্ষ্যে ব্যাপকভিত্তিক কাজের জন্য একটি কোষ (cell) গঠনের সিদ্ধান্ত হয়।

সিদ্ধান্ত ও সুপারিশ অনুযায়ী এসব নিয়ােগদান ও আত্তীকরণ না হওয়া পর্যন্ত সরকার মুক্তিবাহিনীর এসব সদস্যের থাকা-খাওয়া-হাতখরচ ইত্যাদির দায়িত্ব বহন করবে বলে মন্ত্রিসভার বৈঠকে মতামত ব্যক্ত করা হয়। বৈঠকগুলােতে বিস্তারিত আলােচনার পর আরাে যেসব সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় তার একটি চিত্র নিচে তুলে ধরা হলাে :

ক) কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক বাের্ড (সদস্যসংখ্যা অনধিক ১১ জন) গঠিত হবে। এতে যৌথ কমান্ড মনােনীত দুজন উপদেষ্টা অন্তর্ভুক্ত হবেন। সরকার কর্তৃক বাের্ডের মনােনয়ন দেওয়া হবে;

খ) মহকুমাগুলােতেও অনুরূপ অনধিক ১১ সদস্যের বাের্ড গঠিত হবে। এসব বাের্ডেও উপদেষ্টা থাকবেন । এই বোর্ডগুলাের মনােনয়নও সরকার দেবে;

গ) সরকার ট্রাস্টভুক্ত পত্রিকাগুলাের জন্য একজন এবং অবজারভার গ্রুপের জন্য একজন, মােট দুজন প্রশাসক নিয়ােগ করবেন। ইতােপূর্বে গঠিত ট্রাস্ট বাতিল করা হবে।

ঘ) বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলােতে উপাচার্য নিয়ােগ করা হবে;

ঙ) ব্যুরাে অব ন্যাশনাল রিকনস্ট্রাকশন (বিএনআর), পাকিস্তান কাউন্সিল, ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর ফাইন আর্টস অ্যান্ড লিটারেচার বিলুপ্ত করা হবে;

চ) পাকিস্তান সামরিক জান্তার অতর্কিতে সশস্ত্র আক্রমণে লাখ লাখ ছাত্রছাত্রী পাশের সীমান্ত অঞ্চলে আশ্রয় গ্রহণ করে এবং অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করায় তাদের পড়ালেখা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয়। এ পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে ২৫ মার্চ থেকে অনুষ্ঠিত সব পরীক্ষা বাতিল করা হবে। সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে নতুন পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে;

) ওয়ার মেমােরিয়াল ট্রাস্ট ফান্ড চালু করা হবে;

জ) অবিলম্বে শহীদ মিনার পুর্ননির্মানের নিমিত্তে খ্যাতনামা বায়ুকলাবিদ (architect) সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠিত হবে;

ঝ) বাংলাভাষা বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা এবং অফিসীয় ভাষা হবে;

ঞ) মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরণে ঢাকায় একটি স্মৃতিসৌধ নির্মিত হবে;

ট) স্টেট ব্যাংকের নামকরণ করা হবে বাংলাদেশ ব্যাংক।

ঠ) যেসব সংস্থার নামের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তান অথবা পাকিস্তান শব্দ আছে সেসব  বাতিল হবে এবং সংস্থার নামের সঙ্গে ‘বাংলাদেশ যুক্ত হবে;

ড) সব সাইনবাের্ড, হােল্ডিং গাড়ির নম্বর ইত্যাদি বাংলায় হবে;

ঢ) সােমবার ও বৃহস্পতিবার নিয়মিত মন্ত্রিসভার বৈঠক হবে;

ন) মুজিবনগর থেকে সরকারের অস্থায়ী কার্যালয় স্থানান্তরের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে;

ত) অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির মিলিটারি সেক্রেটারি এবং এডিসি নিয়ােগ দিতে হবে। বঙ্গভবনের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে। বঙ্গভবনের জন্য অর্থসংস্থান করতে হবে। সম্মত হলে শাহ মােহাম্মদ ফরিদ কিংবা জনাব রেজাউল হায়াতকে রাষ্ট্রপতির ব্যক্তিগত সচিব পদের দায়িত্ব দেওয়া হবে;

থ) জনাব হামিদ চৌধুরী এসও এবং জনাব মহীউদ্দীন খান আলমগীরকে ডিএস করা হবে।

দ) কার্যবিধি (Rules of Business) প্রণয়ন করা হবে;

ধ) বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ প্রণয়ন, রাষ্ট্রপতিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর করার নিয়ম, বিশ্ববিদ্যালগুলােতে ভাইস চ্যান্সেলর নিয়ােগ, অন্যান্য অধ্যাদেশ এবং অফিস-সময়সূচি নির্ধারণ ইত্যাদি কাজও করতে হবে।

ওপরে বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে যেসব সিদ্ধান্ত মন্ত্রিসভার বৈঠকে গৃহীত হয়েছিল সেগুলাের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হয়েছে। এরপর বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশে ফিরে আসার আগের দিন পর্যন্তও মন্ত্রিসভার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এসব বৈঠকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ আলােচনা এবং সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম কোনাে কোনাে বৈঠকে সি-ইনসিকে বিশেষ আমন্ত্রণে উপস্থিত থাকতে বলতেন।

ডিসেম্বর (১৯৭১) মাসের ২৮ তারিখের বৈঠকে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর বিধিমালা (lorces /\ct) প্রসঙ্গে আলােচনা হয়। শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য এই আইনের প্রয়ােজনীয়তা দেখা দেয়। কমান্ডার ইন চিফ (c-in-c) মূল ধারণা সংবলিত এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন বৈঠকে পাঠ করে শােনান।

সামরিক বিধি সম্পর্কে ২৯ ডিসেম্বর (১৯৭১) রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ জারির সিদ্ধান্ত হয়। ডিসেম্বরের ২৮ তারিখে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে বাংলাদেশের মুদ্রা প্রসঙ্গে সিদ্ধান্ত হয় যে, অর্থনৈতিক লেনদেনের মাধ্যম ‘টাকা’ নামে অভিহিত হবে। ডিসেম্বর ২৯ তারিখে বাংলাদেশের পরিত্যক্ত চা-বাগান সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত হয় যে, চা-মালিকগণ তাদের শ্রমিকদের কাজে লাগিয়ে উৎপাদন শুরু করবেন। 

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্যগণ ২২ ডিসেম্বর (১৯৭১) স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় ফিরে আসেন। তারা প্রায় প্রতিদিন বৈঠক করে বিভিন্ন ধরনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত জরুরি ভিত্তিতে গ্রহণ করতে থাকেন। সেসব সিদ্ধান্ত ও সুপারিশও বাস্তবায়িত হতে থাকে দ্রুত গতিতে।

উল্লেখ্য, জাতীয় মিলিশিয়া বাহিনী গঠনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার এই বলে ঘােষণা দেয় যে, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার মনে করে যে, ‘মুক্তিবাহিনী এদেশের মেধার বৃহত্তম আধার, যার মধ্য থেকে এদেশের দ্রুত পুনর্গঠন এবং অবকাঠামাে পুনঃস্থাপনের জন্য উৎসর্গিত নতুন নেতৃত্বের উদ্ভব’ সম্ভব। জাতীয় মিলিশিয়া গঠনের মধ্য দিয়ে মুক্তিযােদ্ধা এবং অন্যান্য অস্ত্রধারীদের দেশ গঠনের কাজে নিয়ােজিত রাখা এবং অস্ত্র নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আনাই ছিল সরকারের অন্যতম উদ্দেশ্য। বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে প্রত্যাবর্তনের আগে। মুজিবনগর থেকে ঢাকায় ফিরে আসা বাংলাদেশ সরকার ১৯৭২ সালের ২ জানুয়ারি জাতীয় মিলিশিয়ার ১১ জন সদস্য নিয়ে জাতীয় নিয়ন্ত্রণ বাের্ড গঠন করেছিল। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে একজন করে এবং মুজিব বাহিনীর পক্ষ থেকে দু’জন সদস্যকে নিয়ে এই নিয়ন্ত্রণ বাের্ড গঠিত হয়। সারা দেশের জেলা ও মহকুমা প্রশাসকদের জরুরি ভিত্তিতে জাতীয় মিলিশিয়া শিবির স্থাপনের নির্দেশ দেয় সরকার। এ সময়ে শেখ মনির একটি গুরুত্বপূর্ণ বিবৃতি প্রকাশ করা হয়। বিবৃতিতে শেখ মণি মুজিববাহিনীর অস্তিত্ব বিলােপ করার ঘােষণা দিয়েছিলেন। বীরত্বের সাথে দেশমাতৃকাকে শত্রুমুক্ত করতে গণবাহিনীর সদস্যদের প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন কাজে নিয়ােগের পরিকল্পনাও ঘোষণা করেন।

যুদ্ধহি, স্বাধীনতা অর্জন ইত্যাদি ঘটনায় তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলােকে যে পরিস্থিতি মােকাবিলা করতে হয়েছে, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর বাংলাদেশকেও সেই একই পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছিল। চার দিকে ধ্বংসের নিদর্শন, মানুষজনের চোখেমুখে একদিকে উদ্দীপনা আর অপরদিকে ব্যথা-বেদনার প্রতিচ্ছবি, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, অফিস-আদালতে স্থবিরতা ইত্যাদি প্রকটভাবে লক্ষণীয় ছিল। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার তার দূরদৃষ্টি দিয়ে এসবই মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই আঁচ করেছিলেন এবং প্রতিকূল অবস্থা কিভাবে মােকাবিলা করা যায় সে সম্বন্ধেও পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। শত্রুমুক্ত বাংলাদেশের মাটিতে প্রবাসের অস্থায়ী কার্যালয় স্থানান্তরের যাবতীয় ব্যবস্থাও গ্রহণ করে বাংলাদেশ সরকার।

সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্যগণ শত্রুমুক্ত বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় পৌছার আগে সেক্রেটারি জেনারেল রুহুল কুদুসের নেতৃত্বে সরকারের অগ্রবর্তী দল রাজধানী ঢাকায় পৌছে। এরপর ২২ ডিসেম্বর মন্ত্রিসভার সদস্যগণ ঢাকায় পৌঁছেছিলেন। প্রবাস থেকে প্রত্যাবর্তন এবং স্বাধীন বাংলাদেশের পবিত্র ভূখণ্ডে বাংলাদেশ সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে ন্যূনতম সময় লেগেছিল। ঢাকা প্রত্যাবর্তনের পর মন্ত্রিসভা দ্রুতগতিতে মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যে সরকারের প্রয়ােজন অনুযায়ী সুপরিকল্পিত প্রশাসন-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় পৌছার পর প্রয়ােজনানুযায়ী সম্পন্ন কাজগুলাের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিল

১। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি কর্তৃক ১৯৭২ সালের ৩ জানুয়ারি তারিখে শিল্প এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনা গ্রহণ সংক্রান্ত অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির “বাংলাদেশ আদেশ ১৯৭২” জারি। এই আদেশ দ্বারা বাংলাদেশে পরিত্যক্ত সব শিল্প ও বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানসহ এগুলাের কর্তৃত্ব, ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণভার বাংলাদেশ সরকার গ্রহণ করে (পরিশিষ্ট-৭)।

২। “এয়ার বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল আদেশ ১৯৭২” অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির আদেশ হিসেবে ১৯৭২ সালের ৪ জানুয়ারি জারি হয়। এই আদেশ দ্বারা বাংলাদেশে। পূর্বতন পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনস করপােরেশনকে একটি স্বাধীন সংস্থায় পরিণত করে বাংলাদেশের জনগণের প্রয়ােজন পূরণ করতে পুনর্গঠিত। হয়। বাংলাদেশ রাষ্ট্রে উক্ত করপােরেশনের সব ধরনের সম্পদসহ পুনর্গঠিত বিমান চলাচলব্যবস্থাকে ‘এয়ার বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল’ নামে অভিহিত করা হয় (পরিশিষ্ট-৮)।

। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয় কর্তৃক ১৯৭২ সালের ৫ জানুয়ারি বাংলাদেশ গেজেটের অতিরিক্ত সংখ্যায় প্রকাশিত মন্ত্রণালয়ের এমএফ/ইএফ/২জিএস(৪)/৭২/৪২ সংখ্যক প্রজ্ঞাপন জারির মারফত বলা হয়। যে, বাংলাদেশে সক্রিয় কোনাে বীমা কোম্পানি বীমা-দাবি গ্রহণ কিংবা মেটাতে পারবে না (পরিশিষ্ট-৯)।

৪। বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি কর্তৃক ১৯৭২ সালের ৩ জানুয়ারি ঘােষিত “বাংলাদেশ (বিশ্ববিদ্যালয় আইন সমন্বয়করণ) অধ্যাদেশ-১, ১৯৭২”এ জানানাে হয় যে, সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের যেসব অংশে গভর্নর, পূর্ব পাকিস্তান এবং প্রাদেশিক সরকার আছে সেসবের পরিবর্তে যথাক্রমে রাষ্ট্রপতি, বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ সরকার পড়তে হবে।(পরিশিষ্ট-১০)।

৫। বাংলাদেশ গেজেটের অতিরিক্ত সংখ্যায় ১৯৭২ সালের ৬ জানুয়ারি প্রাতিষ্ঠানিক বিভাগের প্রাতি/আর১/এইচ-১/৭২/৮ সংখ্যক প্রজ্ঞাপন মারফত বাংলাদেশ সরকারের সব অফিসে রবিবারকে সাপ্তাহিক ছুটি হিসেবে পালনের কথা জানানাে হয় (পরিশিষ্ট-১১)। পরবর্তী সময়ে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার ১৯৭২ সালের ১৩ জানুয়ারির বৈঠকে সাপ্তাহিক ছুটি ও দৈনিক কর্মঘণ্টার বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফিরে প্রত্যক্ষভাবে দায়িত্ব গ্রহণের আগেই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের উপযুক্ত নির্দেশাবলি ও বিজ্ঞপ্তিসমূহ দ্বারা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের বিশাল কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন হতে শুরু করেছিল।

মুক্তিযুদ্ধের বিশাল ক্ষতচিহ্ন বুকে নিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিদ্যমান বিশৃঙ্খলা ও অরাজক পরিস্থিতি ধীরে ধীরে দূর হতে থাকে। দেশের বিপর্যস্ত যােগাযােগব্যবস্থা এবং পরিবহণের ক্ষেত্রে লক্ষণীয় মাত্রায় উন্নতি সাধিত হয়। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-প্রতিষ্ঠান চালু করতে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে। অবাঙালি এবং পাকিস্তানি মালিকাধীন কলকারখানা পরিচালনা-ব্যবস্থাপনা বাের্ড গঠন কিংবা প্রশাসক নিযুক্ত করা হয়। পর্যায়ক্রমে জনমানুষের জীবনপ্রবাহে গতি সঞ্চারিত হতে শুরু করে। সেক্রেটারি জেনারেল রুহুল কুদ্‌সের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সরকারের তথা তঙ্কালের মুজিবনগর সরকারের অগ্রবর্তী দল ঢাকার বঙ্গভবনে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে ভবনটিতে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসে, এটি তাৎক্ষণিকভাবে হয়ে ওঠে সরকারের সদর দফতর। এই বঙ্গভবন তকালে স্মৃতিময় ঘটনার সাক্ষী হয়ে থাকে। প্রবাস থেকে প্রত্যাবর্তন করে বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামও সাময়িকভাবে বঙ্গভবনে অবস্থান করেন। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের দফতরও সরকারের প্রাথমিক দিনগুলােয় বঙ্গভবনে ছিল। উৎসাহী ও উদ্দীপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সহযােগিতায় বাংলাদেশ সরকারের কর্মতৎপরতা বঙ্গভবনে ২২ ডিসেম্বরের (১৯৭১) সন্ধ্যা থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বঙ্গভবনে ঘুরে ঘুরে উপস্থিত কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সঙ্গে করমর্দন করেন। বঙ্গভবনে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে দখলমুক্ত বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এবং মুজিবনগর থেকে আগত কর্মকর্তাবৃন্দের সঙ্গে সেটাই ছিল প্রথম পরিচয়। পাকিস্তানি সামরিক সরকারের প্রতিভূদের হটিয়ে বঙ্গভবনে প্রধানমন্ত্রীর দৃপ্ত পদচারণায় বাঙালি নেতৃত্বের গৌরব দীপ্যমান হয়ে ওঠে। বাঙালি জাতির সামনে চূর্ণবিচূর্ণ হয় পাকিস্তানি সামরিক সরকারের দম্ভ। নতুন সূর্যোদয়ে আলােকিত বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয় প্রত্যক্ষ বাঙালি শাসন-কর্তৃত্ব। বিজয় দিবসের প্রথম সপ্তাহের সেই সন্ধ্যায় বঙ্গভবনে তথা শত্রুকবলমুক্ত বাংলাদেশে বাঙালি জাতির রাজনৈতিক সরকারের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দিনটিই ছিল আনন্দ-উচ্ছলতা আর উত্তেজনায় পরিপূর্ণ একটি স্মরণীয় দিন।

বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আগমনের আগে ঢাকায় বাংলাদেশ সরকারের আগমন ঘটে, এ কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। এই সরকারের আগমনের পরের দিন দিল্লি থেকে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর বিশেষ দূত মিস্টার দুর্গাপ্রসাদ ধরের (ডি. পি. ধর) ঢাকায় আগমন ছিল আরেক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। তিনি বাংলাদেশে ২৩ ডিসেম্বর থেকে ২৯ ডিসেম্বর (১৯৭১) পর্যন্ত ঢাকায় অবস্থান করেন। তার আগমন-সংক্রান্ত নােট আমার ডায়েরির পাতায় লেখা আছে। এই নােটে ২৪ ডিসেম্বর তিনি কোন্ কোন্ ব্যক্তির সঙ্গে কখন সাক্ষাৎ করবেন সে সম্বন্ধে খুব সংক্ষেপে আমি লিখে রাখি। এই নােটে লিখিত আছে মিস্টার ডি. পি. ধর ওইদিন সকাল ১০ টায় বাংলাদেশ সরকারের অর্থমন্ত্রী, অর্থসচিব, খাদ্যমন্ত্রী এবং সেক্রেটারি জেনারেলের সঙ্গে আলােচনায় বসবেন। সকাল সাড়ে ১১টায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও ত্রাণ-পুনর্বাসন মন্ত্রীর সঙ্গে তিনি বৈঠক করবেন। বিকেল ৪ টায় বাংলাদেশ সরকারের কর্মকর্তাবৃন্দের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও আলােচনা করবেন। সবশেষে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হবেন (পরিশিষ্ট-১২)। নােটে লেখা কর্মসূচি অনুযায়ী মিস্টার ধর তার সফর সম্পন্ন করেন।  মিস্টার ডি. পি. ধরের আগমনে বাংলাদেশে তৎকালে রটে যায় যে, তিনিই বাংলাদেশে নিযুক্ত প্রথম ভারতীয় রাষ্ট্রদূত। এ রটনা ছিল বিভ্রান্তিকর। প্রকৃতপক্ষেই এই রটনা বিভ্রান্তিকর ও ভিত্তিহীন ছিল। তবে, মিস্টার ধর ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণের পর নাটকীয়ভাবে বলেন যে, তিনি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে এসেছেন এক নবজাতক দেশকে সম্ভাষণ জানাতে। মিস্টার ধরের এই সফর ছিল প্রকৃতপক্ষে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কোনাে বিদেশি প্রতিনিধির মতােই। তার এই সফর ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলাদেশে ২৩ থেকে ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত অবস্থানকালে সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য এবং উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাবৃন্দের সঙ্গে অনুষ্ঠিত সব দ্বিপক্ষীয় বৈঠকই অতি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। একটি বিষয় উল্লেখ করার মতাে এই যে, এসব বৈঠকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী খােন্দকার মােশতাককে কখনােই অংশগ্রহণের সুযােগ দেওয়া হয়নি। কারণ, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে খােন্দকার মােশতাক ও তার অনুসারীরা দেশের স্বার্থবিরােধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়েছিল। এসব সংঘটিত হওয়ার সব দৃশ্যের প্রত্যক্ষ সাক্ষী আমি। তারা স্বাধীন বাংলাদেশেও বিদেশি প্রভুদের পদলেহন করে দেশকে সাম্প্রদায়িক পথে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। প্রথম বাংলাদেশ সরকারের এই সন্দেহ এবং আশঙ্কা যে অমূলক ছিল না তা ১৯৭৫ সালের আগস্টে বঙ্গবন্ধু এবং নভেম্বরে জাতীয় চার নেতাকে সাম্প্রদায়িক ধর্মান্ধ শক্তিগুলাে হত্যা করায় দিবালােকের মতাে স্পষ্ট হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি জাতির জয়লাভের প্রায় ৩৮ বছর পর মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের অবমুক্ত করা দলিল থেকে প্রকাশ পেয়েছে যে সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হেনরি কিসিঞ্জার খােন্দকার মােশতাকসহ বঙ্গবন্ধুর খুনিচক্রকে আমেরিকায় রাজনৈতিক আশ্রয় প্রদানে সমঝােতায় পৌঁছেছিলেন।

দেশি-বিদেশি এই গােষ্ঠীর অপচেষ্টা এখন থেমে গেছে এমন প্রমাণ নেই। তারা জাতির পিতাকে ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট এবং ৩ নভেম্বর জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করেও ক্ষান্ত হয়নি। এইসব হত্যাকাণ্ড এবং ২০০৪ সালে আওয়ামী লীগের জনসভায় তৎকালীন বিরােধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গ্রেনেড হামলা করে আওয়ামী নেতৃবৃন্দকে হত্যা এবং আহত করে অগণতান্ত্রিক পথে প্রতিক্রিয়াশীল ও সাম্প্রদায়িক চক্র দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল। এরা বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করে মুক্তিযুদ্ধে তাদের পরাজয়ের প্রতিশােধ নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। মিস্টার ডি. পি. ধর ঢাকা পৌছে সেদিন সন্ধ্যায় বেগম ফজিলাতুননেসা মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ধানমন্ডির ১৮ নম্বর সড়কে অবস্থিত অস্থায়ী আবাসস্থলে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বেগম মুজিব নিজেদের স্থায়ী বাসভবন ছেড়ে এই আবাসস্থলে আশ্রয় নিয়েছিলেন। বেগম মুজিবের বাসস্থানে এক আবেগঘন পরিবেশ সৃষ্টি হয় মি, ডি, পি, ধরের আগমনে। মি, ডি. পি, ধরের সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতা আবদুস সামাদ আজাদও ছিলেন। এ সময়ও বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খােন্দকার মােশতাক আহমদকে বিদেশি অতিথির সঙ্গে থাকতে দেওয়া হয়নি। দোভাষীর মাধ্যমে বেগম মুজিব তার মুক্তিযুদ্ধকালের অন্তরীণ অবস্থার বর্ণনা দেন মিস্টার ডি. পি. ধরকে। ঢাকায় অবস্থানকালে মিস্টার ধর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, এ. এইচ, এম, কামারুজ্জামান, শেখ আবদুল আজিজ, আবদুস সামাদ আজাদ প্রমুখ মন্ত্রী এবং অর্থসচিব খন্দকার আসাদুজ্জামান, সেক্রেটারি জেনারেল রুহুল কুদুসের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেন।

রাজনৈতিক অঙ্গনের একটি উল্লেখযােগ্য ঘটনা ঘটে ২৭ ডিসেম্বর (১৯৭১)। এ দিন বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার সম্প্রসারণ উপলক্ষে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান হয়। লক্ষণীয় বিষয় এই যে, অনুষ্ঠানে ভারতের প্রতিনিধি মি. ধর আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দের আসনে উপবিষ্ট ছিলেন। ঐতিহাসিক ও তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা এই যে, সেদিন মন্ত্রিসভার সদস্যগণকে শপথবাক্য পাঠ করানাে হয় বাংলায়। অনুষ্ঠানটি পরিচালনার দায়িত্ব আমি পালন করি। সম্প্রসারিত মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন ফণীভূষণ মজুমদার, আবদুস সামাদ আজাদ, জহুর আহমেদ চৌধুরী ও অধ্যাপক ইউসুফ আলী। এই সম্প্রসারিত মন্ত্রিসভার মন্ত্রীদের মধ্যে ২৯ ডিসেম্বর দফতর বণ্টন করা হয়েছিল।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার উষালগ্নে ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভা বেসামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠা এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ সম্পর্কে এক সভায় মিলিত হয়েছিলেন। সেই সভার গৃহীত সিদ্ধান্তগুলাে বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করতে আমি (তকালীন ক্যাবিনেট সেক্রেটারি) ১৫ ডিসেম্বর (১৯৭১) গােপনীয় ৪৬৯(৫)/ক্যাব সংখ্যক এক স্মারক (১) প্রতিরক্ষা সচিব, পররাষ্ট্র বিষয়ক সচিব, স্বাস্থ্যসচিব, কৃষিসচিব এবং অর্থসচিবের কাছে পাঠিয়েছিলাম (পরিশিষ্ট-১৩)। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শত্রুমুক্ত হওয়ার পরই বাংলাদেশে বেসামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে কালবিলম্ব না করে তৎকালে বিদ্যমান ১৯ জেলার জেলা প্রশাসক এবং পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট নিয়ােগ করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময়ই বিভিন্ন অঞ্চলের প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনে আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ ছাড়াও মুক্তিবাহিনীর সশস্ত্র সদস্য, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিও সম্পৃক্ত ছিলেন। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় সরকারের মন্ত্রিসভাকে দিনরাত ব্যতিব্যস্ত থাকতে হয়। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর যথেচ্ছ আক্রমণ, অগ্নিসংযােগ, লুণ্ঠন, ধ্বংসসাধন ইত্যাদিতে বাংলাদেশের অফিস-আদালত, বাজার, মাঠ-ঘাট, জনপদ, বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট সর্বত্রই এক বিশৃঙ্খল পরিবেশ, অব্যবস্থাপনা এবং ধ্বংসস্তুপ পরিলক্ষিত হয়। ধ্বংসস্তুপ থেকে বাংলাদেশের পুনর্গঠন এক দুঃসাহসিক কর্মকাণ্ড বলে মনে হতে থাকে। পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রও বাংলাদেশের এই বিপন্ন অবস্থা দেখে সহানুভূতি প্রকাশ করে। এদিকে বাংলাদেশের মুক্ত মানুষ বঙ্গবন্ধুকে তাদের মাঝে আবার দেখতে পাওয়ার আশায়। ব্যকুল হয়ে ওঠে। বাংলাদেশ সরকারও অধৈর্য হয়ে ওঠে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি-প্রতীক্ষায়। এমন উৎকণ্ঠা ও উদ্বেগের মধ্যে পাকিস্তানের কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির খবর সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে পৌছে যায় ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি সকাল সাড়ে ৬ টার পর। বঙ্গবন্ধু মুক্তি পেয়ে লন্ডন হয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করবেন এমন সংবাদ বিবিসি রেডিওতে প্রচার হওয়ার পর লন্ডনের ক্ল্যারিজেস হােটেলের আশপাশে শত শত মানুষ সমবেত হতে শুরু করে। উৎসুক জনতা এবং সমবেত বিদেশি সাংবাদিকদের সাথে বঙ্গবন্ধু কিছু কথা বলেন। পরদিন ৯ জানুয়ারি (১৯৭২) বঙ্গবন্ধু লন্ডন থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন। পথে সংক্ষিপ্ত যাত্রাবিরতি হয় ভারতের দিল্লিতে। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, দিল্লিতে যাত্রাবিরতি কালে। বঙ্গবন্ধুকে ভারতের প্রেসিডেন্ট ভি,ভি, গিরি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, ভারতীয় মন্ত্রিসভার সদস্যবৃন্দ, কূটনীতিবিদ, শত শত সাংবাদিক পালাম বিমানবন্দরে স্বাগত জানান।

বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা হিসেবে আমি যা-যা ঘটতে দেখেছিলাম তার সব বিবরণ এই গ্রন্থে উল্লেখ করে শেষ করা যাবে না। তবু আংশিক কিছু দিক এই গ্রন্থের বিভিন্ন অধ্যায়ে বর্ণনার চেষ্টা করা হয়েছে। ঢাকায় ১০ জানুয়ারি (১৯৭২) বঙ্গবন্ধুর আগমন উপলক্ষে বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষের আনন্দ-উল্লাসের যেমন শেষ ছিল না, তেমনি বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্যবৃন্দ, প্রশাসনিক কর্মকর্তা-কর্মচারীরও নিঘুম রাত কেটেছে, ব্যস্ত থাকতে হয় সারা দিনমান। মন্ত্রিসভার সদস্যগণ বঙ্গবন্ধুর মুক্তি এবং দেশে আগমন উপলক্ষে কর্মসূচি প্রণয়নে ঘর্মাক্ত কলেবর হন। বঙ্গবন্ধু মুক্তি পাচ্ছেন এমন খবর বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন সূত্র থেকে পাচ্ছিলেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও সরকারের

———

১, দিল্লিতে বঙ্গবন্ধুর সংক্ষিপ্ত অবস্থানকালের দৃশ্য ফারুক আহমদ চৌধুরীর লেখা দেশ দেশান্তর নামক গ্রন্থেও বিবৃত হয়েছে।

———–

এবং জনগণের উৎকণ্ঠা এবং উদ্বেগ কাটছিল না। এমনই শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার মধ্যে। বাংলাদেশ সরকার জানতে পারে যে, বঙ্গবন্ধু সত্যি-সত্যিই পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পাচ্ছেন। তবে সরাসরি তিনি বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় পদার্পণ করছেন না। তৃতীয় একটি দেশ হয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করছেন। এই তথ্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভা উদ্দীপ্ত ও তৎপর হয়ে ওঠে। জানুয়ারির ৮ তারিখে মন্ত্রিসভার জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সভায় উপস্থিত ছিলেন, অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী, কৃষিমন্ত্রী, সি-ইনসি, সেক্রেটারি জেনারেল, ক্যাবিনেট সচিব (গ্রন্থকার), পররাষ্ট্রসচিব এবং স্বরাষ্ট্রসচিব ।

সভায় বাংলাদেশের জনগণ, বন্ধুপ্রতীম রাষ্ট্রের সরকার ও তাদের জনগণকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধানের মুক্তির বিষয়ে প্রচেষ্টা চালানাের জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ জানানাের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বঙ্গবন্ধুর আগমন কিভাবে নিরুপদ্রব ও নিরাপদ হবে সে সম্বন্ধেও পরিকল্পনা ও বিস্তারিত কর্মসূচি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় । এই বৈঠকে গৃহীত সব সিদ্ধান্ত ও সুপারিশ অতিমাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সেসব সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনার কিছু কিছু এখানে উল্লেখ করা হলাে।

ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে লাখ লাখ মানুষ সমবেত হলে তাদের থাকা, খাওয়া, পয়ঃব্যবস্থা কিভাবে করা হবে তাও বৈঠকে আলােচিত এবং ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়। কে, কখন, কিভাবে বঙ্গবন্ধুকে প্রথমে বরণ করবেন সে-সম্পর্কে সিদ্ধান্ত হয় যে, এ বিষয়ে দল যেভাবে স্থির করবে সে ভাবেই হবে।

বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী বিমান কোথায় এসে থামবে, আকাশ থেকে পুষ্পবৃষ্টি, গার্ড অব অনার প্রদানের স্থান নির্ণয়, গার্ড অব অনার প্রদানের সময় কারা উপস্থিত থাকবেন, সাংবাদিক, আলােকচিত্র শিল্পীদের গােয়েন্দা দফতর থেকে পরিচয়পত্র প্রদান, প্রত্যেক। সংবাদপত্র কিংবা সংবাদ সংস্থার একজন প্রতিনিধিকে এবং টিভির তিনজনকে অনুমতি দেওয়ার বিষয়েও বৈঠকে আলােচনা হয়। বৈঠকে আরাে ঠিক করা হয় যে, বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুর কোনাে সাক্ষাৎকার কিংবা প্রশ্নোত্তরপূর্ব থাকবে না। মন্ত্রিসভার সদস্যবৃন্দ ছাড়াও দল কর্তৃক মনােনীত আওয়ামী লীগের প্রথম সারির নেতৃবৃন্দ বিমানের পাশে দণ্ডায়মান থেকে বঙ্গবন্ধুকে বরণ করবেন বলে স্থির করা হয়। সব কূটনীতিবিদকে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানাে হবে, সংবর্ধনা-অনুষ্ঠানে আগত কূটনীতিককে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হবে। ভারত সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে সামরিক এবং বেসামরিক যেসব কর্মকর্তা আসবেন বঙ্গবন্ধুকে তাদের সঙ্গেও পরিচয় করানাে হবে। উল্লেখ্য, চীন ও ইরানের কনসাল জেনারেলদ্বয় বঙ্গবন্ধুর সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে অনুপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি (যেমন এমএনএ, এমসিএ) অন্য রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের (যেমন প্রফেসর মুজাফফর আহমদ, মণি সিংহ প্রমুখের) একটি সারি থাকবে। এসব ব্যক্তিকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে মৌখিকভাবে আমন্ত্রণ জানানাের এবং এদের পরিচয়পত্র প্রদানের জন্য বৈঠকে বলা হয় । প্রটোকল অনুযায়ী ভারতীয় কূটনীতিকসহ অন্যান্য দেশের কূটনীতিক, বাংলাদেশের জনগণের বন্ধুজন স্টোনহাউস ও চেসওয়ার্থকে আমন্ত্রণ জানানাের বিষয়ও ঠিক হয়।

সমবেত জনতাকে সামাল দেওয়ার জন্য পুলিশ এবং দলকে নির্দেশ দেওয়া হয়। এদের সঙ্গে গণবাহিনীর অস্ত্রবিহীন সদস্য এবং মুক্তিবাহিনীর সশস্ত্র সদস্যগণকে কর্তব্য পালনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী মহামান্য রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করবেন মর্মে সিদ্ধান্ত হয়। বঙ্গবন্ধুকে লাল গালিচা সংবর্ধনা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হলেও অফিসীয় কিংবা দলীয় (আওয়ামী লীগের) কোনাে তােরণ নির্মিত হবে না বলে কর্মসূচিতে উল্লেখ করা হয় । সড়কের দু’পাশে স্বেচ্ছাসেবক এবং সেনাবাহিনীর সশস্ত্র সদস্যের লাইন থাকবে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দানে এয়ারপাের্ট রােড দিয়ে বঙ্গবন্ধুর যাওয়ার গমনপথ নির্ধারণ করা হয়। রেসকোর্স ময়দানে মহিলা ও শিশুদের জন্য ঘেরাও (enclosures) ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর জনসভা উপলক্ষে রেসকোর্স ময়দানে রােস্ট্রাম তৈরি করা হয়। বঙ্গবন্ধুর আগমনের আগের দিন (০৯ জানুয়ারি ১৯৭২) বিকেল ৪টায় নিরাপত্তাব্যবস্থা পরীক্ষা করে দেখার বিষয়েও ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধুকে রেসকোর্স ময়দান থেকে তার বাসভবন পর্যন্ত কিভাবে নিয়ে যাওয়া হবে সে বিষয়েও বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। লন্ডন থেকে দিল্লি হয়ে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত বৈঠকে এমন অসংখ্য খুঁটিনাটি বিষয়ে আলােচনা করে করণীয় স্থির করা হয় । মুজিবনগর থেকে ফিরে এসে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে এই কাজগুলাে অন্যান্য ব্যক্তির সহযােগিতায় আমি সম্পন্ন করতে পেরেছিলাম। এ ছিল এক বিস্ময়কর ঐতিহাসিক ঘটনা। এর ধারাবাহিক বর্ণনা প্রদান করা এক কঠিন কাজ।

সূত্র : বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১-৭৫ এইচ টি ইমাম

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!