You dont have javascript enabled! Please enable it!

পাবনায় কেমন করে বাংলাদেশ সরকার কার্যক্রম চালু হল?

আমার নাম মােহাম্মদ নূরুল কাদের খান। নিজেকে নূরুল কাদের বলে ১৯৭১ থেকে পরিচয় দিয়ে আসছি, ‘খান’টা এখন আর ব্যবহার করি না। তাজউদ্দীন সাহেবের সাথে আমার প্রথম পরিচয় টেলিফোনের মাধ্যমে। ৯ এপ্রিল ১৯৭১ সালে চুয়াডাঙ্গা রেস্ট হাউস থেকে তাঁর সাথে আমার ফোনে কথা হয়। দীর্ঘ সময়, প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট। আমি সেই সময় পাবনায় ডিসি ছিলাম। পাবনাই প্রথম স্বাধীন হয় ভূখণ্ড হিসেবে। এপ্রিলের তিন তারিখে পাবনায় আমরা স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তুলি। এখানে পাক বাহিনী সংখ্যায় ছিল প্রায় দুই কোম্পানি। আমরা পাবনায় ১৭টি খণ্ডযুদ্ধ করেছিলাম। এতে পাক বাহিনীর দুই কোম্পানিই প্রায় সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত হয়ে যায়। শেষ যুদ্ধটা হয়েছিল মুলাডুলিতে ২ এপ্রিল। মুলাডুলি থেকে পাবনার দূরত্ব প্রায় ৮/১০ মাইল। আমরা যুদ্ধে জয়ী হয়ে রাতে মার্চ করে ফিরেছিলাম। সর্বস্তরের মানুষ এসে একসাথে হয়েছিল, স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত চারদিক, সে দিন যেন ছিল চূড়ান্ত বিজয় বাঙালি, বাংলাদেশের আর মুক্তিযােদ্ধাদের। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা দরকার যে, জিয়াউর রহমান সাহেব চট্টগ্রাম থেকে যে ঘােষণা দিয়েছিলেন আমরা এই এলাকাতে সেই সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। পাবনায় ইপিআর ছিল না। আনসার ও পুলিশ ছিল। পুলিশ সুপার ছিলেন চৌধুরী আব্দুল গাফফার, যিনি পরিষ্কারভাবে বলে দিয়েছিলেন, “আমি সাঁজোয়া বাহিনীর লােক, আমি ইউনিফর্মধারী এবং চাকরি করি।’ তাঁর নেতিবাচক মনােভাব সত্ত্বেও দেশের পরিস্থিতি দেখে আমি কিন্তু ফেব্রুয়ারি মাস থেকে একটা প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম এবং ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করছিলাম ভেতরে ভেতরে। অন্যান্য জায়গায় যেখানে আর্মি এবং ইপিআর-এর সদস্যরা নেতৃত্ব দিয়েছিল, পাবনায় এর বিপরীত হল । এখানে সিভিলিয়ানদের নেতৃত্বে প্রতিরােধ গড়ে উঠল। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। এখানে সাধারণ মানুষ, গ্রামের মানুষ প্রতিরােধ গড়েছে। যুদ্ধে জয়ী হয়ে মুলাডুলি থেকে আমরা পাবনায় ফিরে এলাম। মুখে জয় বাংলা স্লোগান, মনে প্রচণ্ড উল্লাস। রাত তখন প্রায় ১১টা, আমার সাথে আব্দুর রব (বগা মিয়া) সাহেব ছিলেন। আমরা সবাই একসাথে বসে সিদ্ধান্ত নিলাম, পরদিন আমরা এখান থেকে বাংলাদেশ সরকারের আদেশ জারি করে এই সরকারের কর্মকাণ্ড আরম্ভ করব এবং আনুষ্ঠানিকভাবে পতাকা উত্তোলন করা হবে। এই সিদ্ধান্তমত রাত ১২টার দিকে একটি লােক খুঁজে বের করা হল, যে রাবার স্ট্যাম্প তৈরি করে। অনেক প্রস্তাব এসেছিল, তার মধ্য থেকে গােল করে বাংলাদেশ সরকার লেখা স্ট্যাম্প তৈরি হল। পরদিন এই রাবার স্ট্যাম্প দিয়ে ট্রেজারি ব্যাংক খােলার আদেশ দিয়ে প্রশাসন চালু হল। এটা ৩ এপ্রিল হবে। শেখ মুজিব সাহেবের পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে অসহযােগ ঘােষণার ফলে ব্যাংক এবং সমস্ত সরকারি কার্যক্রম বন্ধ ছিল। আমাদের আলােচনায় সিদ্ধান্ত হল যে, যেহেতু আর এখানে পাকিস্তানিরা নেই, এলাকাটা মুক্ত, অতএব এখানে তাে অসহযােগের আর প্রয়ােজন নেই। আমরা তখন শেখ মুজিবের নামে বাংলাদেশ সরকারের কর্মকাণ্ড এবং বাংলাদেশ সরকারের নামে প্রচারণা শুরু করলাম। ২১ বার রাইফেলের গুলি ফুটিয়ে সরকারের পতাকা উত্তোলন করা হল। বগা ভাই পতাকা উত্তোলন করলেন। আমজাদ সাহেব পাবনা আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। কিন্তু তিনি কোন চর এলাকায় থাকায় সেদিন শহরে ছিলেন না। বগা ভাই। সবসময় আমাদের সাথে ছিলেন। পতাকা উত্তোলনের সময় আমরা সব পাশে দাঁড়িয়ে রইলাম—পুলিশ, আনসার এবং মুক্তিবাহিনীতে যারা যােগ দিয়েছিল সবাই। বকুল, ইকবাল, কাদরী, ওয়াজউদ্দিন, আমজাদ এরা সবাই বীর মুক্তিযােদ্ধা ছিল এবং আওয়ামী লীগের জন্য অত্যন্ত নিবেদিতপ্রাণ ছিল। আমরা অফিস, কাচারি সব খুললাম। কাজ চলতে শুরু করল। পাক বাহিনী নগরবাড়ি দিয়ে যাতে না আসতে পারে সেজন্য আমরা রাস্তায় ট্রেঞ্চ করে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করলাম। কিন্তু ওরা আরাে উজানে গিয়ে, গ্রাম ধরে হেঁটে হেঁটে ক্রল করে আসতে শুরু করেছে। তারপর আট তারিখে পাবনার পতন হল।

(২৯.০৯.১৯৯৬) মােহাম্মদ নূরুল কাদের খান। বাংলাদেশ সরকারের সাবেক সচিব, পরে ব্যবসায়ী। ১৯৯৮ সালে মৃত্যুবরণ করেন। 

Reference: তাজউদ্দীন আহমদ – আলোকের অনন্তধারা

 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!