You dont have javascript enabled! Please enable it!

এইচ. টি. (হােসেন তওফিক) ইমাম (সিএসপি ১৯৬১)

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতপূর্ব ভাইস-চ্যান্সেলর ও ইতিহাসবিদ এ.আর. (আজিজুর রহমান) মল্লিকের স্মৃতিচারণামূলক লেখায় (এপ্রিল ১৯৮৪) তিনি (মল্লিক) উল্লেখ করেছেন: ‘.২৬শে মার্চ সন্ধ্যায় রাঙ্গামাটি থেকে জিলা প্রশাসক জনাব হাসান (হােসেন) তৌফিক ইমাম টেলিফোনে আমাকে জানান যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং উত্তর চট্টগ্রাম থেকে ই পি আর এর জওয়ানদের বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এসে জমায়েত হতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে (।) আমি যেন তাদের দায়িত্ব নিয়ে প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করি। রাতে প্রায় আড়াইশ জওয়ান ক্যাম্পাসে এসে পৌছােন। আমরা তাদের দায়িত্ব গ্রহণ করি। আলাওল হল ও এ, এফ, রহমান হলে তাদের থাকবার ও খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। রাঙ্গামাটি থেকে হাসান (হােসেন) তৌফিক ইমাম ও এস, পি, বজলুর রহমান আমাদের আগেই এখানে এসে যােগ দিয়েছিলেন।”১৭

প্রাক্তন এম. এন. এ. এবং বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের ভূতপূর্ব স্পীকার আব্দুল মালেক উকিল স্বীয় আত্মজবানিতে উল্লেখ করেছেন (১/৭/১৯৮৪); ..২রা এপ্রিল চাঁদপুর থেকে মিজান চৌধুরী রায়পুর হয়ে নােয়াখালী আসেন। আমি, মিজান চৌধুরী এবং ফেণীর এম, এন, এ মরহুম খাজা আহমেদ সহ ছােতাখােলা হয়ে ভারতীয় বি, এস, এফ এর মেজর প্রধান এর সহায়তায় প্রথম সীমান্ত অতিক্রম করি। প্রথমে রামগড় ও পরে উদয়পুর হয়ে আগরতলায় যাই। উল্লেখ্য যে, রামগড়ে আমরা মেজর  জিয়া, ক্যাপ্টেন রফিক সহ কয়েকজন সামরিক অফিসার ও তদানীন্তন  পার্বত্য চট্টগ্রামের ডি, সি জনাব তৌফিক ইমামের সঙ্গে আলােচনা করি।”১৮

জনাব আব্দুল খালেকের আত্মজবানিসূত্রে জানা যায়; মুজিব নগর সরকারের প্রশাসন সংঘটিত হওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধকে একটি কেন্দ্রীয় প্রশাসনের আওতায় আনা হয় এবং যথারীতি প্রশাসনিক বিধি নিষেধের অন্তর্ভুক্ত করা হয।  এই সকল জটিল  কাজ তারা ‘গুটি কতেক কর্মচারী সম্পন্ন করেছিলেন; যাদের মধ্যে অন্যতম হলেন , ‘মাহবুব আলম চাষী (মরহুম), হাসান (হােসেন) তৌফিক ইমা,  জহুর  আহমদ চৌধুরী (মরহুম), মােস্তাফিজুর রহমান সিদ্দিকী প্রমুখ’। এরাই আগরতলায় মুক্তিযুদ্ধের প্রশাসনিক কাঠামাে বানাবার প্রথম পর্বের সূচনা করেন’ মুক্তিযুদ্ধের প্রশাসনিক কাঠামাে বানাবার প্রথম পর্বের সূচনা করেন’ এবং ‘পরে তারা কলকাতা কেন্দ্রিক প্রশাসনের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়েন’।১৯

এইচ. টি ইমাম সম্বন্ধে তখনকার মেজর ও পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল ও সংসদ সদস্য এম, এস, এ. ভূঁইয়া লিখেছেন:  “১লা এপ্রিল আমি চট্টগ্রামের বান্দরবন থানায় যাই।../ বান্দরবন যাওয়ার পর সেখানে এক মিজো লেফটেন্যান্ট কর্নেলের সাথে আমার সাক্ষাৎ  হলাে। আমরা উভয়েই নানা ব্যাপারে আলাপ আলােচনা করলাম। এর আগে মিজোদের সম্পর্কে আমার তেমন কোনাে গভীর ধারণা ছিল না। মিজো কর্ণেল অবশ্য আমাদের লিবারেশন মুভমেন্টে সাহায্য করতে চেয়েছিল। রামঘরে (রামগড়ে) যাওয়ার পর আমি পার্বত্য চট্টগ্রামের ডেপুটি কমিশনার জনাব তৌফিক ইমামের সাথে মিজোদের এই সাহায্য সম্পর্কে আলাপ-আলােচনা করি। অনেক ভেবে-চিন্তে আমরা এই স্থির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি যে, আমাদের স্বাধীনতা-সংগ্রামে মিজোদের সাহায্যের কোন প্রয়ােজন নেই।”২০

প্রসঙ্গত জনাব ভূইয়ার বরাতে আরও জানা যায়, চট্টগ্রামের ডি.সি, বা জেলা প্রশাসকও তখন তাকে প্রয়ােজনীয় সাহায্য করেছিলেন। তাঁর ভাষায়, “অবশেষে চট্টগ্রামের পুলিশ সুপারের সাহায্য নেওয়াই অত্যাবশ্যক মনে করলাম।.. /পুলিশ সুপারের কথায় আমি হতােদ্যম হলাম না। পাশেই ছিল ডি. আই. জি-র অফিস। ডি. আই. জি-র সাথে দেখা করলাম। আমার কথা শুনে ডি, আই, জি বিস্ময় প্রকাশ করলেন।…/ কিন্তু ডি. আই. জি-র কাছ থেকে কোন উৎসাহব্যঞ্জক সাড়া পাওয়া গেল না। সাহায্যদানের ব্যাপারে তাঁকে অনিচ্ছুক মনে হলাে পুলিশ সুপার ওভি. আই. জি-র কাছ থেকে সন্তোষজনক সাড়া না পেয়ে অগত্যা আমি ডি. সি-কেই টেলিফোন করা শ্রেয় মনে করলাম। টেলিফোনে অনেকক্ষণ কথাবার্তার পরে অবশেষে তিনি সাহায্য করতে সম্মত হলেন। আমাকে সাহায্য করার জন্যে তিনি পুলিশ সুপারকে বলে দিলেন।”২১

হােসেন তওফিক ইমাম সম্বন্ধে সৈয়দ আব্দুস সামাদ লিখেছেন: ” হোসেন তওফিক ইমাম (১৯৬১ এর সি.এস,পি,).. তিনি যুগপৎ মন্ত্রিপরিষদ সচিব এবং উত্তর পূর্বাঞ্চলের আঞ্চলিক প্রশাসক। তিনি আমার ‘বস’ ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রামে। অন্যতম প্রধান আর প্রথম যােদ্ধা। তার সিদ্ধান্ত গ্রহণ ক্ষমতা সম্ভাব্য সর্বোচ্চ পর্যায়ের। অত্যন্ত গােছানাে এবং পূর্ণ অধিশ্রয়ণিত (focused) ব্যক্তি। চট্টগ্রামে এপ্রিল মাসের ২০ তারিখ পর্যন্ত যে প্রতিরােধ আর যুদ্ধ হয় ইমাম পশ্চাদভূমি থেকে তার প্রাণকেন্দ্র ছিলেন। যত সৈন্য সামন্ত, গােলাবারুদ সব তাঁর নেতৃত্ব এবং নির্দেশে সরবরাহ করা হয়, প্রচুর ঝুঁকিপূর্ণ প্রেক্ষাপটে ।.. ১৯৭১ সালে ইমামের চাকরির পূর্ণ মেয়াদ ছিলাে ১০ (দশ) বছর, কিন্তু মন্ত্রিপরিষদ সচিবের দায়িত্ব তিনি যেভাবে পালন করেন তাতে কেউ কল্পনাও করতে পারবে না যে তিনি জেলা প্রশাসক (উপসচিব) থেকে সরাসরি আমলাতন্ত্রের শিখরে আরােহণ করেছিলেন। অনন্য সাধারণ মেধা এবং দক্ষতা ছাড়া এটা কোনােক্রমেই সম্ভব না। পূর্ব পাকিস্তান সরকার একটা অপূর্ণাঙ্গ প্রাদেশিক সরকার ছিলাে। এই সরকার জাতীয় সরকারের সঙ্গে কোনােক্রমেই তুলনীয় নয়। অথচ সর্বোচ্চ সন্দীপন এবং প্রণােদনা এই সরকারেরই মুষ্টিমেয় কয়েকজন কনিষ্ঠ আমলাকে যুদ্ধকালীন একসরকার চালনা করতে উদ্বুদ্ধ করেছে। এটাও নেতৃত্বেরই কৃতিত্ব। ইমাম আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে সমগ্র মুজিবনগর সরকারের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আধিকারিক ছিলেন। তাঁর আত্মপ্রচার বিমুখতা এবং শালীনতা তাকে তার ন্যায্য পাওনা থেকে সম্ভবতঃ বঞ্চিত করেছে।”২২

সা’দত হুসাইন লিখেছেন: “জুনের কোনাে এক সময়ে অথবা জুলাই-এর প্রথম দিকে হােসেন তওফিক ইমাম আগরতলা থেকে এসে মন্ত্রিপরিষদ সচিব (বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা) হিসাবে মুজিবনগরে যােগ দিলেন। হােসেন তওফিক ইমাম রাঙামাটিতে জেলা প্রশাসক ছিলেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম (বর্তমানে রাঙামাটি, বান্দরবন এবং খাগড়াছড়ি) জেলায় মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং অবশেষে অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে তার সহযােদ্ধাদেরকে নিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে ত্রিপুরা রাজ্যে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেখানে ক্যাম্প স্থাপন করে মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করেছেন। মুজিবনগর সরকার থেকে ডাক এলে তিনি সচিবালয়ে এসে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তার অক্লান্ত চেষ্টায় এবং দক্ষতায় পরিষদের কার্যাবলি একটি সুশৃংখল কাঠামােতে পরিচালিত এবং বিন্যস্ত হতে থাকে। অর্থমন্ত্রীর একান্ত সচিব হিসাবে জনা তওফিক ইমামের কর্মদক্ষতা আমি খুব কাছ থেকে অনুধাবন করতে পেরেছি।.. মুক্তিযুদ্ধের সেই চরম ব্যস্ততা এবং প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যেও জনাব তাজউদ্দিন আহমেদ এবং জনাব ইমাম যে সুঠাম এবং কার্যকর কাঠামাের উপর মন্ত্রিপরিষদের কার্যাবলি প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তা যে কোনাে মূল্যায়নে প্রশংসিত হবে।”২৩

স্বাধীনতা সংগ্রামী ও বেতার ব্যক্তিত্ব বেগম মুশতারী শফী তাঁর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক  স্মৃতিকথা স্বাধীনতা আমার রক্ত ঝরা দিন গ্রন্থে লিখেছেন: “১৩ জুন/.. আজ সকালে কৃষ্ণনগরে বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী দপ্তরে তৌফিক ইমাম সাহেবেরর সাথে দেখা করলাম। তৌফিক ইমাম রাঙ্গামাটির ডিসি ছিলেন। শােনা যায় মুক্তিযুদ্ধ  শুরু হলে ইমাম সাহেব পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলা তহবিলের প্রায় ২ কোটি টাকা তুলে নিয়ে সােজা চলে আসেন ভারতে এবং প্রবাসী সরকারের হাতে সম্পর্ণ টাকা তুলে দেন। এই দেশপ্রেমিক লােকটির সাথে পরিচিত হয়ে তার অমায়িক ব্যবহাতে  মুগ্ধ হলাম।”২৪  তার মারফতে আরও জানা যায়, জনাব ইমামকে এ সময় কত ঠান্ডা, ধীরস্থির মস্তিস্কে কত রকমের কঠিন ও ব্রিতকর, ক্ষেত্রবিশেষে  উত্তেজক পরিস্থিতি ‘ট্যাকল করতে হতাে। অভিজ্ঞ, ঝানু আমলার মতো বিরল নৈপুণ্যে ও সুচারু দক্ষতায় তিনি সেসব সামলে প্রশাসনের কাজকর্ম এগিয়ে নিতে চেষ্টা করতেন।

প্রসঙ্গত স্বয়ং এইট. টি. ইমাম রচিত বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১ শীর্ষক গ্রন্থটি বিশেষ করে এর অন্তর্ভুক্ত ‘মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি এবং আমার ডায়েরি’ শীর্ষক অংশ পাঠ করলে জানা যায়- কখন, কীভাবে তিনি মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিলেন এবং প্রবাসী মুজিবনগর সরকারে যােগ দিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের ন্যায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদের দায়িত্ব নির্বাহ করেছিলেন।

Reference: মুক্তিযুদ্ধে সিএসপি ও ইপিসিএস অফিসারদের ভূমিকা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!