শরণার্থীর খাদ্য ও অর্থ চুরি করে শাসক কংগ্রেস আগামী নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন
দুর্নীতি ও দুর্ব্যবহারে মােহনপুরের বি-ডি-ও-র তুলনা নাই
মােহনপুর: প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আসবেন। আগের দিন বি.ডি.ও শ্রীজ্ঞান সাহা বললেন, শরণার্থী শিবিরের মেয়েরা যেন কেউ বের হন না। পরদিন দেখা গেল, গ্রাম থেকে একদল কংগ্রেসী মহিলাকে বেশ পােশাক করে সামনের সারিতে আনা হলাে এবং শরণার্থী বলে প্রধানমন্ত্রীর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হলাে।
এই গল্পটি বললেন এক বৃদ্ধ শরণার্থী, বি-ডি-ও সাহেবের গুণকীর্তন করতে গিয়ে। গােপালনগর সিনিয়র বেসিক স্কুলের সামনে গ্রামবাসীরা নিজেরা ঘর তুলে একশত শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছেন, বি-ডিওর প্রতিশ্রুতি ছিল, রেশন দেয়া হবে। কিন্তু তিনি সে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেন নাই। স্কুলের ভিতরে শরণার্থী আছেন প্রায় ২ হাজার; কিন্তু রেশন পান মাত্র ১০৭১। গত ৭ মে তাও দেয়া হয়নি।
যে সব ক্যাম্পে রেশন দেয়া হচ্ছে, সেখানে চলছে লুট। গঙ্গাগতিপুর কাইলরীর গ্রাম্য শিবিরটি তার চমৎকার দৃষ্টান্ত। শরণার্থীর সংখ্যা ৩৫০। চারদিন কোনাে রেশনই দেয়া হয়নি। তারপর কিছুদিন তেল-নুন দেয়া হলাে না। তারপর তেল দেয়া হচ্ছে দু’বেলার জন্য আধালিটার, আলু সাড়ে তিন কেজি। বিকেল তিনটায় রান্না শেষ হয়। ক্ষিধায় বাচ্চাগুলাে ছটফট করে। কিছু লােকের খাওয়া হয়, পরে যারা আসেন তারা কিছুই পান না। সকলের রেশন একত্র করে রান্না করার উদ্দেশ্যই হলাে রেশন চুরি করা তা কারাে বুঝতে কষ্ট হচ্ছে না।
বি-ডি-ও ঠিক করেছেন, দৈনিক ৫ টাকা দিয়ে কিছু ভলান্টিয়ার রাখা হবে। সে ভলান্টিয়ারও আনা হচ্ছে অনেক বাছাই করে খাতিরা তােক দেখে বাইরে থেকে। এক নং শিবিরের ভলান্টিয়ার দিলিপ রায়কে আনা হয়েছে ধর্মনগর থেকে।
নিতাই দেবনাথ কাইলরী শিবিরের ভলান্টিয়ার। বি-ডি-ও সাহেবের কান্ত অনুগত। তাই শরণার্থী যদি বলেন, আমাদের রেশন পাওনা কতটুকু তা জানতে চাই, ওজন করে নিতে চাই— তবে নিতাই বাবু তাদের ধমক দিয়ে বলেন, তােমাদের পুলিশ এনে পিটাবাে। বি-ডি-ও জ্ঞানবাবু আর একটু ভদ্র ভাষায় বলেন, তােমাদের তাে আমরা নিমন্ত্রণ করে আনিনি। যা দেব তাই নিয়ে থাকতে হবে, প্রতিবাদ করলে তাও বন্ধ করে দেব। ১৯ মে দুই নং ক্যাম্পের বিনােদ মণ্ডলের রেশন তিনি বন্ধ করতেও দ্বিধা করেন নাই।
তারাপুর শিবিরের কর্তা কংগ্রেসি গাঁও প্রধান শ্রীনরেশ দাস, ভলান্টিয়ার তাঁর পুত্র রবীন্দ্র দাস। শরণার্থীরা সন্ধ্যায় একবেলা ভাত পান। প্রতিবাদ করার উপায় নাই। রান্না করা ভাত উধাও হলেও তা মেনে নিতে হয়। নতুবা সব ভাতই বন্ধ হবে।
তারানগরে ঋষিদাস শিবিরে শরণার্থীর সংখ্যা ৫০০। তাদের ডাল দেওয়া হয়, ১২.৫০ কেজি। সবজি কোথাও ওজন করে দেয়া হয় না। পানীয় জলতাে নাই বললেই চলে। দুই নং শিবিরের টিউবওয়েলের সংখ্যা ১টি, যদিও শরণার্থী সংখ্যা ১৬৫। তিন নং এবং চার নং শিবিরে তাও নাই।
বি-ডি-ও জ্ঞান সাকার ধারণা, শরণার্থী শিবির হলাে জেলখানা এবং তিনি তার দারােগা। বাংলাদেশের সংগ্রামী জনতা তার ক্রীতদাস হয়ে থাকবেন। তিনি যখন যা হুকুম করবেন, তাই তাদের মানতে হবে। বিডি-ও তার দুনীতি চক্রের সাহায্যে শরণার্থীদের সামান্য রেশন, ডাল, তেল-নুন থেকে চুরি করে খাবেন এবং তার সামান্যতম প্রতিবাদে তিনি হিটলারি মেজাজ দেখাবেন। তাদের বেগার খাটনিতে ঘর তুলে ঘর তােলার পয়সা তিনি সরকার থেকে আত্মসাৎ করবেন।
* * *
এ কথা মনে করা ভুল হবে যে, মােহনপুরের বি-ডি-ও যা করছেন, সে রকম দুর্নীতি শুধু মােহনপুরে সীমাবদ্ধ। তা নয়। বিলােনিয়া জেলােই বাড়ি যান দেখবেন, এক রাতে দু’বস্তা রেশনের চাল নেই। আজ ডাল নেই, কাল তেল নেই। মনু যান দেখবেন একদিনে রেশন দেয়া হলাে তাে আর একদিন নেই। যারা শিবির ছেড়ে চলে গেছেন তিন দিন আগে, তাদের নামেও রেশন খরচ লিখে রাখা হচ্ছে। রাইমা শর্মা সােনামুড়া জমের ঢেপা, বৈরাগী বাজার, নলছড়া যান, দেখবে চাল ছাড়া শিবির বাসীদের আর কিছুই দেয়া হচ্ছে না। সদর দুর্গাচৌধুরী পাড়ায় দেখবেন, রান্নাঘর তৈরির খরচ বাবদ শিবিরবাসীদের তিন দিনের রেশন থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।
ছাত্র ফেডারেশন ও গণতান্ত্রিক যুব ফেডারেশনের কর্মীরা কংগ্রেসী পাণ্ডা ও দুর্নীতিবাজ আমলাদের উপর যাতে নজর না রাখতে পারে তার জন্যই তাদের সযত্নে দূরে রাখা হচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী সিও নিজেও যে ‘সর্বদলীয় কমিটি গঠন করেছেন, তাতে এমনকি মার্কসবাদী কমিউনিস্ট এম.পি, এম. এল.এ-দেরও স্থান নেই। (অবশ্য বিশ্বাসঘাতক দক্ষিণ কমিউনিস্ট নেতা অঘােষ দেববর্মা এম এল এ তাতে আছেন)।
সিংহ সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে ত্রিপুরার গণতান্ত্রিক জনতাকেই অগ্রণী হয়ে সংগ্রাম শুরু করতে হবে। তার জন্য গড়ে তুলতে হবে শিবিরগুলােতে কমিটি। যারা শিবিরের বাইরে আছেন, তারা যাতে বিনা পয়সায় রেশন ও ডােল পান তার জন্য সক্রিয় আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। শিবিরবাসী শরণার্থীদের প্রত্যেক পরিবারকে যেন আলাদা করে রেশন দেওয়া হয় এবং সকলকে একসঙ্গে খিচুড়ি খেতে বাধ্য করা না হয়, তার জন্য সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে। শিবিরগুলােতে জল, ডাক্তার না থাকায় আমাশয় সংক্রামক হয়েছে; শিশুখাদ্য না থাকায় শিশু মৃত্যু দেখা দিয়েছে। ৪৩-এর মন্বন্তরে বৃটিশ ৩০ লক্ষ বাঙালির জীবন নিয়েছিল; এবার ইয়াহিয়া-ইন্দিরাকে আরাে ৩০ লক্ষ বাঙালি হত্যা করতে দেয়া হবে না এই শপথ ঘােষণা করতে হবে—সকল গণতান্ত্রিক মঞ্চ থেকে।
সূত্র: দেশের ডাক
২৮ মে, ১৯৭১
১৩ জ্যৈষ্ঠ, ১৩৭৮