You dont have javascript enabled! Please enable it! সাগরদীঘি যুদ্ধ - সংগ্রামের নোটবুক
সাগরদীঘি যুদ্ধ
১৯৭১ সালের ৭ আগস্ট মধুপর-টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ সড়কের জলছত্ররসুলপুরের দিক থেকে সাগরদীঘির দিকে হানাদাররা এগােতে থাকে। ঐ পথে রাঙামাটিতে ঘাঁটি গেড়ে বসেছিল টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনীর ১১ নম্বর কোম্পানি। তারা সংবাদ পায়, শত্রু বাহিনীর এক কোম্পানি হানাদার ও শতাধিক রাজাকার রাস্তার আশপাশে ঘরবাড়ি জ্বালাতে জ্বালাতে এগিয়ে আসছে। শক্রর হামলার সম্ভাব্য ধরণ দেখে কোম্পানির অধিনায়ক মনির আরও মুক্তিযােদ্ধা চেয়ে পাঠান। দক্ষ অধিনায়ক আবদুল হাকিমকে তার কোম্পানি দিয়ে মনিরের সাহায্যে। এগিয়ে যেতে নির্দেশ দেন কাদের সিদ্দিকী। সিনিয়র অধিনায়ক আবদুল হাকিম মনিরের কাছ থেকে মূল নেতৃত্বভার নিয়ে শত্রুর হামলা প্রতিহত করতে সচেষ্ট হন। তিনি স্থায়ী ঘাঁটি থেকে এগিয়ে রাস্তার নানা স্থানে অ্যামবুশ লাগান। আছিমের কোম্পানি অধিনায়ক লালটুকেও নির্দেশ পাঠানাে হয়, তিনি যেন ঘাঁটির দায়িত্ব অধিনায়ক ইদ্রিসের হাতে তুলে দিয়ে কোম্পানির অর্ধেক যােদ্ধা নিয়ে হাকিমকে সাহায্য করতে রাঙামাটির দিকে এগিয়ে যায়। শত্রুরা এক কোম্পানি নিয়মিত সৈন্য ও শতাধিক রাজাকারসহ এগিয়ে আসছিল। জুলাই মাস থেকে রাজাকাররা মুক্তিবাহিনীর কাছে তাচ্ছিল্যের বস্তুতে পরিণত হয়েছিল। যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধারা রাজাকারদের খুব একটা হিসেবের মধ্যে ধরতেন। না। মনিরের নেতৃত্বে ৩০০ এবং হাকিমের নেতৃত্বে ২০০ মুক্তিযােদ্ধাসহ হাকিমের কাছে গিয়ে তার উদ্দেশ্যের কথা জানান, তখন রাঙামাটির সব। মুক্তিযােদ্ধার মধ্যে উৎসাহের বান ডেকে যায়। তাদের তখন এমন অবস্থা, মনের জোরেই তারা যেন খালি হাতে শত্রুর মােকাবিলা করতে পারবেন। অভিজ্ঞ অধিনায়ক হাকিম সহযােদ্ধাদের মনােবল দেখে আনন্দিত হন। কিন্তু তিনি জানতেন, শক্রর অস্ত্রবল মুক্তিযােদ্ধাদের চেয়ে অনেক উন্নত ও বেশি। তাই মনােবল ও কৌশলে শত্রুকে ঘায়েল করতে হবে। সে জন্য সম্মুখযুদ্ধকে প্রাধান্য।
দিয়ে নানা দিক থেকে শত্রুর উপর চোরাগুপ্তা আক্রমণ হানার পরিকল্পনা নেয়া হয়। শক্রদের উত্ত্যক্ত ও নাজেহাল করার রণকৌশল হিসেবে মুক্তিযােদ্ধাদের ছােটো ছােটো দলে ভাগ করে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দেয়া হয়। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কয়েকটি দলকে আশপাশের প্রায় ২-৩ মাইল জায়গা জুড়ে গ্রামের ভিতর রাখা হয়। পাকিস্তানি সৈন্যরা তাণ্ডব চালাতে চালাতে এগিয়ে আসছিল। রাঙামাটির ৩ মাইল উত্তরে হানাদাররা প্রথম মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের মুখে পড়লাে । আর সে আক্রমণও সামনে থেকে হয়নি, হয়েছে একেবাওে পিছন থেকে। হঠাৎ পিছন থেকে আক্রান্ত হয়ে শত্রু সেনারা খুব বিভ্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে বিভ্রান্তি কাটিয়ে উঠতে তাদের বেশি সময় লাগে না । হঠাৎ আক্রান্ত হয়ে জ্বালাওপােড়াও বন্ধ করে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র থেকে অগ্নিবৃষ্টি শুরু করে। এতে আশপাশের ১০-১২ মাইল এলাকা থরথর করে কেঁপে ওঠে। তবে হানাদারদের মেশিনগান ও অন্যান্য ভারি অস্ত্রের গর্জনে মুক্তিযােদ্ধারা যে এতটুকু ভয় পাননি তা তাদের আঘাতের পর আঘাত হানা থেকেই বোেঝা যায়। প্রথম আঘাতেই দুইজন হানাদার নিহত ও ৭-৮জন গুরুতর আহত হয়। শক্ররা যে ৪টি মহিষের গাড়িতে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আসছিল, সেই গাড়ির মহিষগুলাে গুলির সাথে সাথে আর্তচিৎকার করে উত্তের মতাে বিদ্যুৎ বেগে ছুটতে থাকলে রাস্তার পাশে গাছে লেগে গাড়িগুলাে উল্টে পড়ে যায়। পায়ে গুলি লাগা একটা মহিষ অচল হয়ে পড়ে। একটির জোয়াল, অন্য ২টির ২টি চাকা গাছে লেগে টুকরাে-টুকরাে হয়ে যায়। অন্য একটির ডলনা ভেঙে বেরিয়ে পড়ে। এমন বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে শত্রু আরও ২ মাইল এগিয়ে আসে। কিন্তু তার পরই তাদের লেজ গুটিয়ে পিছু ফেরার পালা শুরু হয়।
অধিনায়ক হাকিমের কোম্পানির অত্যন্ত সাহসী যােদ্ধা পুলিশের সাইদুর খুব কাছ থেকে হানাদারদের আঘাত হানেন। তাদের আঘাতের প্রধান লক্ষ্য, দলনেতা ও সহকারীকে বেছে-বেছে দেখে-দেখে গুলি করা। শত্রু বাহিনীর নেতা একজন ক্যাপ্টেন এবং তার সহকারী একজন সুবেদার। সাইদুর ও তাঁর সাথীরা মাত্র ৬-৭ রাউন্ড গুলি খরচ করে হানাদার নেতা ও উপনেতার ভবলীলা সাঙ্গ করে দেন। দলনেতা নিহত হওয়ায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারে শক্ররা বিপাকে পড়ে যায়। তাদের যুদ্ধ করার খায়েশ মিটে গেছে। তারা গােলাগুলির তুফান ছুটিয়ে পিছনে সরে পড়া শুরু করে। শত্রু পালানাের এক নতুন ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে। কয়েকটি ছােটো ছােটো দল রাস্তার দুই পাশে জঙ্গলের ভিতর ছড়িয়ে দেয় এবং রাস্তা আগলে রেখে আস্তে আস্তে উত্তরে পিছু হটতে থাকে। হানাদারদের পিছু হটতে দেখে মুক্তিযােদ্ধারা রাস্তার দুই পাশ থেকে তাদের উপর ঝাপিয়ে পড়েন। এতে হানাদারদের দুর্দশার অন্ত থাকে না। একে তাে অনেক অস্ত্রের বােঝা, উপরন্তু ১৬-১৭জন আহত-নিহত। সর্বোপরি তারা অধিনায়ক ও নেতৃত্ববিহীন। একেবারে লেজেগােবরে অবস্থা। এ রকম নাস্তানাবুদ অবস্থা থেকে রেহাই পেতে তারা ৪টি মৃতদেহ, ৩জন আহতসহ ১৬-১৭টি রাইফেল ও এসএমজি এবং হাজার দশেক গুলি ফেলে পালিয়ে যায় ।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – চতুর্থ খন্ড