You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04.04 | সাংবাদিকের জীবন হরণ | যুগান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

সাংবাদিকের জীবন হরণ

পাকিস্তানি হানাদাররা আওয়ামী লীগের মুখপাত্র ইত্তেফাকের চিফ রিপাের্টারকে ঢাকায় গুলি করে হত্যা করে ওদের জানােয়ার-স্বভাবের আর একটি নিঃসন্দেহ পরিচয় রেখেছে। ইত্তেফাকের উপরে জঙ্গী ইয়াহিয়া খান আর তার শকুনি-পরামর্শদাতা ভুট্টোর রাগ যে কত তা তাে সবারই জানা কথা। আওয়ামী লীগের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান সাড়ে সাত কোটি বাঙালীকে পিন্ডি করাচির ভয়ানক শাসন শােষণ অত্যাচারের হাত থেকে উদ্ধার করার জন্য কত চেষ্টাই না করে এসেছেন এতকাল। ইত্তেফাকের পাতায় সেই কথাই দিনের পর দিন লেখা হয়েছে। আজ স্বাধীন বাংলা দেশের অভ্যুত্থান, সশস্ত্র পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর অপরূপ বীরত্বময় লড়াইকে যেমন করে তােক জঙ্গী পাকিস্তানি সরকার স্তব্ধ করে দিতে তার হিংস্র নখ-দ্রংষ্ট্রা-বিস্তারে সেখানে যে পাশবিকতা দেখাচ্ছে তাতে আরণ্যক পশুর পাশবিকতাও লজ্জায় মাথা হেট করবে। এতে যে কোনও অত্যুক্তি নেই, তা আজ সভ্য দুনিয়ার নানা প্রান্ত থেকে যেসব সাংবাদিক সেখানে গিয়েছিলেন তা তাদের মুখেই আজ দুনিয়াবাসী শুনছেন। স্বাধীন বাংলায় পাকিস্তানি পাশবিকতার খবর যাতে বাইরে না বােঝায় তার জন্য ঐসব সাংবাদিকদের কাছ থেকে সব কিছু কেড়ে নিয়ে উলঙ্গ করে পরীক্ষা করতেও ওদের বাধে নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতনামা বাঙালী অধ্যাপকবৃন্দ, বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী, নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের ওরা গুলি করে হত্যা করেছে। বাঙালী মেয়েদের ওপরে ওদের পশুজনােচিত রিরংসাবৃত্তির চরিতার্থ সাধনের পর তাদের মেরে ফেলে ট্রেনে গাদাগাদি করে ওরা ফেলে রেখেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের ওপরে অত্যাচারের পর তাদের ওপরের ঘরে পুরে রেখে নিচের তলায় আগুন দিয়ে হােস্টেল পুড়িয়ে দিয়েছে ওরা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপরে কামানের গােলা বর্ষণ করে তাকে বিধ্বস্ত করেছে। ছেলেকে বুকে আঁকড়ে ভয়ার্ত মা পালাচ্ছিলেন মা ও ছেলেকে বেয়নেটের খোঁচায় মেরে ফেলতে ঐ জানােয়ারদের মনে কোনও করুণার উদ্রেক হচ্ছে না। নিরস্ত্র নিরীহ মানুষের ওপরে বিমান থেকে বােমা বর্ষণে ওদের হাত একটুও কাঁপছে না। সুতরাং স্বাধীন বাংলার সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর হৃদয়-সিংহাসনে অভিষিক্ত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সংগ্রামী পার্টি আওয়মী লীগের মুখপাত্র ইত্তেফাককেই বা ওরা রেহাই দিবে কেন?
জঙ্গী ইয়াহিয়া খানের হিংস্র হানাদার বাহিনী ঢাকায় ইত্তেফাক অফিসে ঢুকে কী ভয়ঙ্কর মনুষ্যত্ববিবর্জিত অত্যাচার চালিয়েছে, তা ঢাকা থেকে বিতাড়িত বিদেশী সাংবাদিকরা এসে জানিয়েছেন। ওদের খবরে জানা গেল, ঢাকায় ইত্তেফাক এর কার্যালয়ে ২৫শে মার্চ রাত্রে যে-সমস্ত কর্মী ছিলেন এবং সেদিন রাত্রে ঢাকায় পাকিস্তানিদের তান্ডব শুরু হওয়ায় যে অনেক ভয়ার্ত মানুষ সেখানে গিয়ে সাময়িকভাবে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তাঁদের সবাইকে সুদ্ধ ইত্তেফাকের কার্যালয়ে আগুন ধরিয়ে দিয়ে ঐসব হানাদার পৈশাচিক উল্লাসে মত্ত হয়েছিল। এখন জানা গেল, ওরা ইত্তেফাকের চিফ রিপাের্টার জনাব তাহেরুদ্দিন ঠাকুরকেও খুন করেছে গুলিন মুখে। জনাব তাহেরুদ্দিন ঠাকুর একজন বিশিষ্ট সাংবাদিক। নব-নির্বাচিত জাতীয় পরিষদের সদস্য রূপেও তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন। এ-হেন ব্যক্তিকে জঙ্গী ইয়াহিয়া খানের জল্লাদরা কখনও রেহাই দিতে পারে? অতএব তাকেও গুলি করে হত্যা করে মানুষ-হত্যার হস্ত-কন্য়ন ওরা নিবৃত্ত করতে চেয়েছে। পাকিস্তানি জানােয়ারদের হিংস্র ভয়ঙ্কর থাবা আজ সবুজ বাংলাদেশকে রক্তে পঙ্কিল করে তুলেছে। কিন্তু বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষে আজ অত্যাচারীদের খতম করে ওদের রক্ত-পিপাসা চিরদিনের জন্য মিটিয়ে দিতে দুর্জয় সংকল্পে যে সুদৃঢ় ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের মধ্যে ঝাপিয়ে পড়েছে, সেই সংগ্রামই হানাদার জঙ্গী জল্লাদের কবর না দিয়ে কিছুতেই থামবে না —এই চিহ্নই আজ সর্বত্র প্রকট।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৪ এপ্রিল ১৯৭১