শেষ পর্যন্ত আমিই বঙ্গবন্ধুর সাথে থাকব – চাকরী হারানোর পরে তাজউদ্দীন
আমরা কিছুদিন ধরেই শুনতে পাচ্ছিলাম তাজউদ্দীন সাহেব পদত্যাগ করতে পারেন। ২৬ তারিখে (২৬ অক্টোবর ১৯৭৪) পদত্যাগের খবরটা শুনে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। লুৎফুল হক সাহেব আর আমি ঠিক করলাম আজকে আমরা তাজউদ্দীন সাহেবের বাসায় যাব। বিকেলে আমরা গেলাম। দেখলাম সেখানে কিছু লােক ঘােরাফেরা করছে। আমাদের খবর শুনেই তাজউদ্দীন সাহেব বের হয়ে এলেন এবং বেশ রাগ করে বললেন, ‘আপনারা এখানে এসেছেন কেন?’ আমরা বললাম, আপনি যখন কর্মরত অবস্থায় ছিলেন তখন তাে আমরা আসিনি, আজ আমাদের আপনার কাছে আসতেই হয়। তাজউদ্দীন সাহেব বললেন, আপনাদের চাকরি চলে যাবে। এখানে সব এনএসআই এবং এসবি-র লোক ঘােরাফেরা করছে।’ আমরা বললাম, আজ আপনার সাথে দেখা করতে এসে যদি আমাদের চাকরি যায় যাক, তাতে পরােয়া করি না।’ আমরা যখন কথাবার্তা বলছি সেই সময় অন্তত আমি একটু উত্তেজিতই ছিলাম। আমি কথায় কথায় বলেই ফেললাম, বঙ্গবন্ধুর অবদানের চেয়ে আপনার অবদান তাে কম নয়!’ আমার এই কথা শুনে তাজউদ্দীন সাহেব আমার উপর অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেন। বললেন, ‘এ কথা কখনও বলবেন না। বঙ্গবন্ধুর অবদান আমার চেয়ে অনেক বেশি। এ কথা বলতে পারি, শেষ পর্যন্ত আমিই বঙ্গবন্ধুর সাথে থাকব। বর্তমানে সাময়িক এক বিভ্রান্তি হতে পারে, কিন্তু এটা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, বঙ্গবন্ধু না হলে এ দেশটা স্বাধীন হত না। আমরা এই স্বাধীনতার কাজে সহযােগিতা করেছি। বঙ্গবন্ধুর অবদান আর আমার অবদানের তুলনা করাটা আপনার ঠিক নয়, মতিউর রহমান।’ এই দিনই কথাপ্রসঙ্গে তাজউদ্দীন সাহেব আরও একটি কথা বলেছিলেন যে, বঙ্গবন্ধু তাে ১৯৭১-এর নয় মাস দেশে ছিলেন না, তাই আমরা কীভাবে, কত রকম করে দেশটা স্বাধীন করলাম সেই বিষয়গুলাে তিনি জানতেন না। ১৯৭২এর ১০ জানুয়ারি তারিখে বিমানবন্দর থেকে ফেরার পথে আমার সাথে কথা হয়েছিল তিনি সমস্ত শুনবেন। মুজিব ভাই বলেছিলেন, ঠিক আছে, তােমরা কীভাবে দেশ স্বাধীন করলে আমি সমস্ত শুনব। কিন্তু ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সেই সমস্ত কথা শােনার জন্য সেই সময়টুকু তিনি আর দেননি বা দিতে পারেননি। এবং আর কোনদিনই তিনি জিজ্ঞাসা করেননি যে, তাজউদ্দীন, আমি যে নয় মাস ছিলাম না, দেশটা কীভাবে স্বাধীন হল ? এই যে তিনি জানতে চাইলেন না, শুনলেন না, এই দুঃখটা আমার চিরদিন থাকবে। মুজিব ভাই যদি জানতে পারতেন কীভাবে দেশটা স্বাধীন হল, এই যুদ্ধে কারা ষড়যন্ত্র করেছিল এবং অন্যান্য বিষয়গুলাে যদি তাকে অবহিত করতে পারতাম তাহলে হয়ত তাঁর অনেক ধারণা পরিবর্তন হত।’ এরপর আর আমার তাজউদ্দীন সাহেবের সাথে দেখা হয়নি। দেখা হয়েছে তার মৃতদেহের সাথে। নভেম্বরের ৩ তারিখে হত্যাকাণ্ডের পর ৪ তারিখে আমরা কানাঘুষা শুনতে পাচ্ছি যে, চার নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। ৫ তারিখে শুনলাম তাজউদ্দীন সাহেবের মরদেহ তার বাসায় নিয়ে আসা হয়েছে। আমি তখন ধানমন্ডির ২৭ নম্বর রােডে থাকতাম। তাজউদ্দীন সাহেবের সাত মসজিদ রােডের বাসাটা আমার চেনা ছিল, সেখানে গিয়ে দেখি যে বহু লােকজনের ভিড়। বাসার নিচতলাতে তাজউদ্দীন সাহেবের মরদেহ খাটিয়ায় রাখা, নিচে বরফের চাই (বরফের খণ্ড)। আমি ঘণ্টা দুয়েক সেখানে ছিলাম। আমি থাকা অবস্থায় শুনেছিলাম তাজউদ্দীন সাহেবসহ অন্যান্য নেতাদের সােহরাওয়ার্দী উদ্যানের পাশে শেরে বাংলার কবরের কাছাকাছি সমাহিত করা হবে। সেখানে কবর খোঁড়াও হয়েছিল, কিন্তু খালেদ মােশাররফ সেখানে কবর দিতে দেয়নি।
Reference:
তাজউদ্দীন আহমদ – আলোকের অনন্তধারা
সাক্ষাৎকারঃ মতিউর রহমান, বাংলাদেশ সরকারের সাবেক যুগ্মসচিব।
সংগ্রামের নোটবুক