You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04.03 | সব ঝুটা হ্যায়! | যুগান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

সব ঝুটা হ্যায়!

রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত গল্পের মেহের আলিকে নিশ্চই সকলের মনে আছে। সে পাষাণ অট্টালিকার মধ্যে ঘুরে বেড়াত আর তার মুখের বুলি ছির একটাই: সব ঝুটা হ্যায়! পাকিস্তানের জববস্ত জঙ্গীশাহীর আজ্ঞাবহ পাকিস্তান বেতারও দেখি অবিকল যেন মেহের আলির সুরেই কথা বলছে। বাঙলাদেশে জঙ্গীশাহীর বর্বরতার মুখে বাঙালী মুক্তিযােদ্ধাদের জীবনপণ সংগ্রামের যেসব খবর সারা পৃথিবীর খবরের কাগজের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে পড়েছে সেসবই নাকি মিথ্যে, কারণ পাকিস্তান বেতার বলছে ঢাকায় শান্তি অব্যাহত। শুধু ঢাকায় কেন, চট্টগ্রামেও। আর শুধু কি বড় শহরে? সারা গ্রাম বাংলাই শান্ত। কোনাে অপ্রীতিকর ঘটনারই নাকি কোনাে খবর ইসলামাবাদে পৌছায় নি কি করেই বা পৌছাবে? কম করেও বারাে শ’মাইলের ব্যবধান যে। ইসলামাবাদের অতি শক্তিশালী দূরবীণে এও নাকি দেখা যাচ্ছে যে, ঢাকায় দোকান-পাট সব ভােলা, কেনাকাটায় ললাকে ব্যস্ত, বাড়িতে পাকিস্তানি পতাকা পর্যন্ত উড়ছে। এর পরেও কি লােকে বলবে না যে বাঙলাদেশে সব কিছু স্বাভাবিক এবং ওখানে গণহত্যার যে মর্মান্তিক খবর অনেক চেষ্টা করেও ঢেকে রাখা যাচ্ছে না তা নিতান্তই পাকিস্তান বিরােধীদের হীন চক্রান্ত?
ইয়াহিয়া খান বাঙলা দেশের স্বাধীনতা আন্দোলন দমনে শুধু যে নাৎসী রাস্তা গ্রহণ করেছেন তাই নয়, তিনি যে ইতিমধ্যেই তার অধিকতর খ্যাতিমান পূর্বসূরী অ্যাডলফ হিটলারকে বর্বরতার পাল্লায় ছাড়িয়ে গেছেন। নাৎসী কায়দা যখন তিনি ধরেছেন তখন যে তিনে হিটলারের খ্যাতকীর্তি অনুচর ডঃ জোসেফ গেয়েবলসের প্রচারের পথ বেয়ে নেবেন তাতেই বা আর আমাদের অবাক হওয়ার কী আছে? দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় গােয়েবলস সাহেব এই খ্যাতি কুড়িয়েছিলেন যে প্রচারের জোরে তিনি দিনকে অনায়াসে রাত করতে পারেন, রাতকে দিন। তার সেই বিখ্যাত উক্তিটাও হয়ত অনেকের স্মরণে আছে যে, একটা মিথ্যে কথাও লজ্জার মাথা থেকে বারবার বলে যেতে পারলে লােকে শেষ পর্যন্ত সেটাকেই সত্যি বলে ভাবতে শুরু করে। যুদ্ধের সময় রােজ সকালে তিনি তাঁর অফিসে নাৎসী সাঙ্গোপাঙ্গোদের নিয়ে বৈঠকে বসেতেন, সেখানেই ঠিক হতন দিনের কর্মসূচী। বৈঠক অবশ্য নামেই। কথা বলতেন, অর্থাৎ হুকুম দিতেন গােয়েবলস, আর অন্যান্যরা শুধু। শুনতেন এবং পরে তা তামিল করতেন। কেউ মুখ খুলতে সাহস পেতেন না। ফলে কর্তা যদি নিতান্ত অবাস্ত ব প্রচার জানাবার হুকুম দিতেন তাও তামিল করা হত। একবার গােয়েবলস হুকুম দিলেন রয়্যাল নামে শত্রুপক্ষের একটি জাহাজ জার্মানী ডুবিয়ে দিয়েছে, এই কথাটা রটিয়ে দাও। তাই দেওয়া হল। কিন্তু যে জাহাজ সত্যি ডােবে নি, তাকে ডুবিয়ে দেওয়া কি অতই সহজ? গােয়েবলসের এই চাল নিয়ে যখন গােলযােগ শুরু হল তখন একদিন বৈঠকে তিনি নৌ-বাহিনীর প্রতিনিধিকে জিজ্ঞেস করলেন, তাহলে এখন কী করা যায়? নৌ দপ্তরের প্রতিনিধিটি সেদিন যথেষ্ট সাহস সঞ্চয় করে উত্তর দিয়েছিল, আমায় মাপ করবেন, আমি এ ব্যাপারে কিছুই বলতে পারব না, কারণ আর্ক রয়্যাল তাে নৌ দপ্তর ডােবাই নি। ডুবিয়েছে প্রচার দপ্তর।
ইয়াহিয়া খানের অনুচররাও ভেবেছেন, বারবার যদি বলা যায় যে, বাঙলা দেশে শান্তি বিরাজ করছে তবে জগৎসুদ্ধ লােক তাই মেনে নেবে। সত্যিই যদি বাঙলা দেশে শান্তি বিরাজ করে থাকে তবে বিদেশী সাংবাদিকদের সেখানে থাকতে দিতে পাক সরকারের এত ভয় কেন? কেনই বা রেডক্রশের মতাে একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের বিমানকে পর্যন্ত সেখানে যেতে দেওয়া হল না? ইসলামাবাদের দূরবীণে যা দেখা যাচ্ছে তাই যদি সত্যি হয় তবে ইয়াহিয়া খান আমন্ত্রণ জানান না, বিদেশী সাংবাদিকদের নিজের চোখে সব কিছু দেখে আসতে? অবশ্য তিনি তা পারেন না, কারণ সেখানে গেলে সাংবাদিকরা দেখতে পাবেন হাজার হাজার মৃতদেহের স্তুপ, বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি এবং সেই সঙ্গে দেখে আসবেন সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর দুর্জয় সংগ্রামের আসল রূপ। ইয়াহিয়া খান তা হতে দিতে পারেন না, তাই পাক বেতার কেবলই বলে চলেছে, সব ঝুটা হ্যায়! কিন্তু ডঃ গােয়েবলসকে শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করত হয়েছিল কারণ লক্ষ মিথ্যা দিয়েও পরাজয়ের সত্যকে তিনি ঢাকতে পারেন নি।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৩ এপ্রিল ১৯৭১