নির্বিকার রাষ্ট্রসংঘ
এক সপ্তাহ কেটে গেছে বাংলাদেশে ইয়াহিয়ার নরহত্যার প্রচণ্ডতা বাড়ছে। গত দুদিন ধরে চলছে বিভিন্ন শহরে বিমান আক্রমণ। চট্টগ্রাম শহরের উপর পড়ছে যুদ্ধ জাহাজ থেকে নিক্ষিপ্ত কামানের গােলা। গ্রামের পর গ্রাম জ্বলছে। নিহতের সংখ্যা লক্ষাধিক। নারী এবং শিশু কেউ রেহাই পাচ্ছে না। মুক্তিযােদ্ধারা শহর এবং ক্যান্টনমেন্ট অঞ্চলে কোণঠাসা করে রেখেছেন দখলদার পশ্চিমা সৈন্যদের। অবরুদ্ধ হানাদাররা শিবির থেকে মাঝে মাঝে বাইরে এসে সব ছারখার করে আবার নিজেদের ব্যুহে ফিরে যাচ্ছে। সুরক্ষিত পকেট থেকে এদের উৎখাত করার মত অস্ত্রশস্ত্র মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে নেই। জনসাধারণের সম্বল লাঠি এবং সড়কি। একমাত্র মনােবল নিয়ে আর কতদিন লড়বে ওরা শত্রুবাহিনীর সঙ্গে? ঘুমিয়ে আছে বৃহৎ শক্তিগুলাে, ঘুমিয়ে আছে ইউরােপ, ঘুমিয়ে আছে এশিয়া এবং ঘুমিয়ে আছে আফ্রিকা। বাংলাদেশের মানবাত্মার কান্না তাদের ঘুম ভাঙ্গাতে পারছে না। রাষ্ট্রসংঘ বধির। সেক্রেটারী জেনারেল উ. থান্ট এক ভােলা কান দিয়ে শুনছেন তিনি আমেরিকার কথা। চীৎকার করে বলছে ভারত-দস্যু লাঞ্ছিত বাংলাদেশের আর্ত জনতার সাহায্যে এগিয়ে আসার জন্য অনুরােধ জানাও আন্তর্জাতিক রেডক্রশকে। উ. থান্টের উপদেশ- তােমরাই সরাসরি আবেদন কর এই সেবা সংস্থার কাছে। আমেরিকা হুকুম দিল- আন্তর্জাতিক রেডক্রশের মধ্যমে ভিয়েতনামে মার্কিন যুদ্ধবন্দির মুক্তির ব্যবস্থা কর। উ থান্ট গা-ঝাড়া দিয়ে উঠলেন। সরাসরি আর্জি পাঠালেন রেডক্রশের কাছে। মার্কিন কর্তৃপক্ষকে নিজের পথ নিজে দেখবার উপদেশ দেবার হিম্মত তার হল না।
বাংলাদেশের সাড় সাত কোটি মানুষের রক্তে স্নান করার রাক্ষুসী পরিকল্পনা আঁটছেন ইয়াহিয়া খান। এমন কি, রেডক্রশের ত্রান বিমানকেও তিনি যেতে দিচ্ছেন না আর্ত জনতার সেবায়। দানবীয় তান্ডবের কলঙ্ক চিহ্ন তিনি দেখাতে চান না বাইরের দুনিয়াকে। সভ্য দুনিয়ার চোখের সামনে এ ধরনের আদিম যুগের বর্বরতা কল্পনাতীত। ১৯৫৬ সালে হাঙ্গেরীর গণ-অভ্যুত্থানে যারা সােভিয়েট অত্যাচার নিরােধের জন্য রাষ্ট্যসংঘের আকাশ-বাতাস গরম করে তুলেছিলেন তারা এখন কোথায়? গতবছর সেপ্টেম্বর মাসে জর্ডানের বাদশা হুসেনের সৈন্যদল শুরু করেছিল আরব গেরিলা উচ্ছেদ অভিযান। রক্তগঙ্গা বইয়ে দিয়েছিল তারা। জনপথে। এই বর্বরদের থামানাের জন্য যেসব গণতন্ত্রী আরব রাষ্ট্র সেদিন হুমকি দিয়েছিল বাদশা হুসেনকে,আজ তারা কোথায়? হুসেন-দোস্ত ইয়াহিয়ার তান্ডব রােধের জন্য তাদের তর্জনী অন্দোলিত হচ্ছে। কেন? ঔপনিবেশিক শক্তির মরণকামড় কত সাংঘাতিক হাড়ে হাড়ে বুঝেছে তা কেনিয়া। মাও মাও বিদ্রোহ দমনের অছিলায় হাজার হাজার মুক্তিযােদ্ধাকে মেরে ফেলেছির বৃটিশরা। কেনিয়ায় যে হত্যালীলা চালিয়েছিল বৃটেন তার শতগুণ হিংস্রতা দেখাচ্ছেন ইয়াহিয়া খান। আফ্রিকার বরেণ্য নেতা জমু কেনিয়াত্তা আজ নীরব কেন? কোথায় গা-ঢাকা দিয়ে আছেন আফ্রো-এশিয়ান প্রগতিবাদী নায়করা? বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক ডিকটেটরের গণহত্যার প্রতিবাদে তাদের কণ্ঠ গর্জে উঠেছে না কেন? দুনিয়াটা সামনের দিকে এগুচ্ছে, না আদিম যুগের দিকে পিছুচ্ছে?
বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের গণতান্ত্রিক সংগ্রাম আজ রাষ্ট্রসংঘের কাছে উপেক্ষিত। খুনীর হত্যা উন্মাদনার বীভৎস দৃশ্যে এই ক্লীব সংস্থা দেখতে চায় না। বৃহৎ শক্তিগুলাের কোন একটির আশ্রিত না হলে রাষ্ট্রসংঘ কোন রাষ্ট্রের সাধারণ মানুষের জীবনের মূল্য দেয় না। বাংলাদেশ নিরস্ত্র। তার মানুষগুলাে শক্তি কামী। পশ্চিমা শোষণের প্রতিকার চেয়েছে তারা বছরের পর বছর। কিন্তু নিরাশ হয়ে বা এসেছে। গণতান্ত্রিক শাসনের বদলে তারা পেয়েছে সামরিক স্বৈরাচারী শাসন। নির্বাচনের মাধ্যমে এই অবাঞ্ছিত শাসনের অবসানের চরম মুহুর্তে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে ইয়াহিয়া খান। মানবাধিকারের শেষ চিহ্ন টুকু মুছে ফেলেছেন বাংলাদেশ থেকে। বিদ্রোহের পথে ঠেলে দিয়েছেন তিনি জনতাকে। তারপর চালাচ্ছেন পাইকারী হত্যা। রাষ্ট্রসংঘের চার্টার কি খুজে পাচ্ছেন না সেক্রেটারী জেনারেল উ. থান্ট? বার করুন একবার বিশ্বসভার সনদ। দেখতে পাবেন বাংলাদেশে পশ্চিমা জল্লাদদের মারণযজ্ঞ রাষ্ট্রসংঘের বহুঘঘাষিত আদর্শের পরিপন্থী। ইয়াহিয়া খান শুধু বাঙালীকে মারছেন না, জুতােপেটা করছেন বিশ্বসভাকে। আর খুড়ছেন গণতন্ত্রের কবর। বৃহৎ শক্তিগুলাের স্বার্থকবলিত রাষ্ট্রসংঘের মুরুদ্বিহীন বাঙালীর দাবী পৌছাবে না। নিজের শক্তিতে মুক্তিযােদ্ধারা লড়ছেন এবং লড়বেন। প্রতিবেশী ভারত বেশী দিন দর্শক থাকতে পারবে না । গণতান্ত্রিক শক্তির পক্ষ তাকে নিতেই হবে। এই ঐতিহাসিক দিনের অপেক্ষারত অধীর ভারতীয় জনতা। এদিন যখন আসবে তখন জাগ্রত বাঙালী জীবন্ত কবর দেবেন পশ্চিমা জল্লাদদের। ক্লীব রাষ্ট্রসংঘের ভূমিকা অসহনীয়। যে সংস্থা নিজের সনদের মর্যাদা রাখতে জানে না তাকে বাঁচিয়ে রেখে লাভ কি?
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৩ এপ্রিল ১৯৭১