You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.05.14 | কলকাতায় উভয় বাঙলার রবীন্দ্র-জয়ন্তী | সপ্তাহ - সংগ্রামের নোটবুক

কলকাতায় উভয় বাঙলার রবীন্দ্র-জয়ন্তী
চন্দ্রচূড় সেন

এ বছর পঁচিশে বৈশাখ এসেছিল নতুন তাৎপর্য নিয়ে। আমাদেরই প্রতিবেশী দেশ, পূর্বতন পূর্ব পাকিস্তান অধুনা বাঙলাদেশ, এতকাল সামরিক শাসনের বিধিনিষেধের বেড়াজালে মুক্তকণ্ঠে কবিগুরুর জন্মােৎসব পালন করতে পারেনি, সমরশাহীর হুকুমনামায় রবীন্দ্রনাথকে সেখানে নির্বাসন-দণ্ড দেওয়া হয়েছিল কিন্তু আবাল-বৃদ্ধ বণিতার মন থেকে রবীন্দ্র-স্মৃতি মুছে ফেলা যায়নি, ঢাকা বেতারকেন্দ্র সমরশাহীর নির্দেশ অগ্রাহ্য করে ইতিপূর্বেও প্রচার করেছে রবীন্দ্র-সঙ্গীত। তবু এতকাল পদানত জনগণ প্রকাশ্য ভাবে রবীন্দ্রজয়ন্তী উদযাপন করতে সমর্থ হননি।…আজ বাঙলাদেশ স্বাধীন, মুক্তিকামী জনতার অভ্যুত্থানের অত্যাচারের বুনিয়াদ ধ্বংস করেছে দিকে দিকে চলছে জঙ্গী হানাদার বিতাড়নের যুদ্ধ। এমতাবস্থায় ইয়াহিয়াচক্র মরীয়া হয়ে নাদারশাহী নৃশংসতার আশ্রয় নিচ্ছে, সভ্যতার বিরুদ্ধে নখদন্ত উদ্ভাসিত করে পশুশক্তি সামগ্রিক নগ্নতা উন্মােচিত করছে।…এই পটভূমিতে এবার ১১০ তম রবীন্দ্র জন্মােৎসবে কলকাতা মহানগরীর রাজপথে খােলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে মন্ত্রোচ্চারণের মতাে ওপার বাংলার শিল্পী-সাহিত্যিকবুদ্ধিজীবীরা এপার বাঙলার সম-গােত্রীয়দের সঙ্গে একযােগে পুনঘােষিত করেছেন কবিগুরুর অমােঘ বাণী—“দানবের মূঢ় অপব্যয়, গ্রন্থিতে পারে না কভু ইতিহাসে শাশ্বত অধ্যায়।”
পঁচিশে বৈশাখ সকালে অসংখ্য রবিন্দ্র-জয়ন্তীর মধ্যে স্বকীয় বৈশিষ্ট্য প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিল পূর্বতন পাক ডেপুটি হাই কমিশন বর্তমানে বাংলাদেশ মিশনের সামনে আয়ােজিত অনুষ্ঠানটি। বর্ষীয়ান কবি বিষ্ণু দে-র যােগ দিলেন ওপারের অগণিত শিল্পী-সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী। বাঙলাদেশের খ্যাতিকীর্তি চলচ্চিত্র শিল্পী কবরী চৌধুরীর ভাষায় প্রত্যেকে বহুদিন পরে রবিন্দ্র-জয়ন্তীর অনুষ্ঠানে যােগ দিতে পেরে আনন্দ-বিহ্বল অবস্থায় কৃতজ্ঞতা জানালেন অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তা পশ্চিমবঙ্গ যুব সঙ্ঘ ও বঙ্গীয় প্রাদেশিক ছাত্র ফেডারেশনকে। আবার করবী যখন বাঙলাদেশে প্রত্যাবর্তন করে স্বাধীনভাবে মানুষের মতাে বাচার অভিলাষ ব্যক্ত করতে গিয়ে আবেগাশ্রুতে ভেঙে পড়লেন তখন অভূতপূর্ব এক পরিবেশে মূর্ত হয়ে উঠল ওপারের শিল্পীদের আন্তরিক আকাঙ্খ।
সকাল সাড়ে আটটায় সুচিত্রা মিত্রের “এই কথাটা জেনে রাখিস মুক্তি তােকে পেতেই হবে” আর “সার্থক জনম আমার” গান দুটি দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হলাে। তারপর একে একে উঠে এলেন অনেকেই। সুভাষ মুখােপাধ্যায় আবৃত্তি করলেন তার বহু পুরনাে হয়েও চিরনতুন কবিতা “আমরা যেন বাঙলাদেশের চোখের দুটি তারা।” বিষ্ণু দে, মণীন্দ্র রায়, দক্ষিণারঞ্জন বসু, তরুণ সান্যাল প্রমুখ আবৃত্তি করলেন বাঙলাদেশের উপর সাম্প্রতিক স্বরচিত কাব্য। হীরেন্দ্রনাথ মুখােপাধ্যায় আবেগপ্রবণ কণ্ঠস্বরে বলে উঠলেন, “আজ রবীন্দ্রনাথের প্রতি যথার্থ সম্মান দেখানাে যায় না বাঙলাদেশের পতাকার প্রতি অভিবাদন না জানিয়ে। সবুজ ও সােনার সমারােহে যে বাঙলাদেশ তার অপূর্ব বীর্য ও শৌর্যের পরিচয় বিশ্বব্যাপী পরিব্যাপ্ত, এমন গণমুক্তি সংগ্রামের তুলনা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। যথার্থই বাঙলাদেশে আজ ‘ভেঙেছে দুয়ার, এসেছে জ্যোতির্ময়।”
ওপারের স্বনামধন্য বুদ্ধিজীবী রণেশ দাশগুপ্ত অনবদ্য ভাষায় জানালেন, “বাঙলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা বুকের রক্ত দিয়ে সংস্কৃতি ও স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামের উৎসবে নেমেছেন।” ওপারের আর এক প্রবীণ জননেতা (উদ্যোক্তারা নামটা গােপন রেখেছেন) প্রত্যয়সিদ্ধ কণ্ঠে বললেন, “ইয়াহিয়াশাহী মানুষের মনের ভাষা রােধ করতে পারবে না।” লােক সঙ্গীত শিল্পী কসিমউদ্দীন ও তার অন্ধ দোতারা বাদক মনিরুদ্দী পরিবেশন করলেন দুটি সুললিত সঙ্গীত-“সােনার বাংলার মানুষ কোথায় তােমরা যাও” আর “ঘুমের সময় নাই জাগাে রে বীর বাঙালি ভাই, ডাক দিয়েছে দেশের মাটি ঘুমের সময় নাই”—পরিবেশন করলেন। রফিকুল আলম ও সহ-শিল্পীরা গান শােনালেন– “যানা যদি যাক প্রায় তবু দেবাে না গােলার ধান।” ২৫ মার্চের রাত্র ইয়াহিয়া বাহিনীর বর্বরতার পরিপ্রেক্ষিতে রচিত—“পচিশের সীমাহীন জিজ্ঞাসা রক্তের লালসায় উন্মুখ, বাজপাখী কৃষ্ণাত্ত আকাশে নিষ্ঠুর দৃষ্টিতে উৎসুক”–গানটি গাইলেন কালীপদ দাস। ময়মনসিংহের চারণ কবি কোরবান আলী, কুষ্টিয়ার কবিয়াল খলিলুর রহমান, কবি কল্পনা মিত্র, কবি মেসবাহ্উদ্দীন, বাঙলাদেশ মিশন কর্মী যন্ত্রসঙ্গীত শিল্পী সুলতান আয়া জামাল ও সয়েদুজ্জামান, প্রমুখ আরাে অনেকে অনুষ্ঠানে যােগ দিলেন ওপার থেকে।
অংশগ্রহণকারী এপারের শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন সবিব্রত দত্ত, নির্মলেন্দু চৌধুরী, কাজী সব্যসাচী, দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, রুমা গুহঠাকুরতা, মায়া সেন প্রমুখ।
অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘােষিত হলাে পৌনে দুটোয়। তখন রাজপথের চারপাশে অগণিত শ্রোতা। আর মঞ্চের উপর লাল পটভূমিতে জ্বলজ্বল করছে কয়েকটি সাদা অক্ষর : “বাঙলাদেশ সরকারের স্বীকৃতি চাই”, ঠিক তার নিচেই মঞ্চের একপাশে রবীন্দ্রনাথের প্রতিকৃতি নতুন পরিমণ্ডলে তখনও আবেশমগ্ন।

সূত্র: সপ্তাহ, ১৪ মে ১৯৭১