সব পরিকল্পনার লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতা- কাজী আরেফ আহমেদ
স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য, ৬০। এর দশকের প্রভাবশালী ছাত্র ও যুবনেতা, স্বাধীনতা পরবর্তী। সময়ের জাসদ নেতা কাজী আরেফ আহমেদ বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত ছাত্র-যুব কর্মীদের মধ্যে ছিলেন অন্যতম। তাঁর সাথে আমি যােগাযোেগ করি ১৯৯৮ সালের ডিসেম্বরের প্রথম দিকে। ৯। ডিসেম্বর তিনি চট্টগ্রাম এলে ওইদিন সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম। পূর্বাঞ্চলীয় রেলওয়ে রেস্টহাউজে তার সঙ্গে দেখা করি। আগরতলা মামলা ও স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ গঠন। তথা সশস্ত্র সগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের। লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর চিন্তা-পরিকল্পনার কথা জানতে চাই তার কাছে। এ সময় বিশিষ্ট সাংবাদিক। আবেদ খানও উপস্থিত ছিলেন সেখানে। কাজী আরেফ প্রথমে ইতস্তত করছিলেন এই বলে যে, প্রকৃত সত্য ওই মুহূর্তে প্রকাশ করা উচিৎ হবে কি না। আমি বিধান সেনের কাছ থেকে নেওয়া সাক্ষাৎকারের প্রসঙ্গ তুললে আবেদ খানও সায় দিয়ে বললেন, ‘এখন তাে আর লুকিয়ে রাখার কিছু নেই। ও তাে (এ লেখক) চট্টগ্রামে বসে বেশ কাজ করছে।’ এরপর কথা বলতে রাজি হন কাজী আরেফ। জানান কিছু ঐতিহাসিক সত্য তথ্য। স্নি সময় স্নি কৌশল। কাজী আরেফ বলেন, ‘পাকিস্তানি শাসন-শােষণ থেকে বাঙালি জাতিকে মুক্তি দেওয়ার। লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু শুরু থেকে নানান পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। সব পরিকল্পনার লক্ষ্য ছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন। এ জন্য তিনি ভিন্ন ভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন কৌশল অবলম্বন । করেন। ১৯৬১ সালেই তিনি ভারতের সাথে যােগাযােগ করেন। আগরতলা যাবার পথে। একবার সীমান্তে ধরাও পড়েন তিনি। পূর্ব বাংলা মুক্তিফ্রন্ট নামে একটি গােপন সংগঠন। ও গড়ে তুলেছিলেন তিনি (আবদুর রাজ্জাক ও বিধান সেনের বক্তব্য দ্রষ্টব্য) যাতে চিত্তরঞ্জন সূতার ও আবদুর রব সেরনিয়াবত যুক্ত ছিলেন। পাকিস্তানের করাচিতে অবস্থিত বিক্ষুব্ধ। বাঙালি কিছু সেনা কর্মকর্তা ও সাধারণ সৈনিকের সঙ্গে তার যােগাযােগের বিষয়টিও সত্য। ছিল। কিন্তু ৬৮ সালে আগরতলা মামলার পরিপ্রেক্ষিতে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এসব বিষয় সরাসরি স্বীকার করা সম্ভব ছিল না। বাধ্য হয়ে বঙ্গবন্ধুসহ সবাই সবকিছু চেপে যান। এভাবে বিষয়টি ইতিহাসের পাতায় যথাযথ গুরুত্ব পায়নি।
তবে এখন সেই সব দিনের সগ্রামের নানান দিকগুলাে জনগণের জানা প্রয়ােজন বলে কাজী আরেফ স্বীকার করেন। কেননা এসবে কলঙ্কের কিছুই নেই, বরং এটি বাঙালি জাতির জন্য গর্বের ইতিহাস। ওইদিন সন্ধ্যায় চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলার স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠানে তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর কর্মপরিকল্পনার আরাে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করেন। এ বিষয়ে ঢাকায় গিয়ে আরাে বিস্তারিত লিখে আমার কাছে (লেখকের কাছে) পাঠানাের কথা বলেন। কিন্তু এর কিছুদিন পর তিনি আততায়ীর গুলিতে নিহত হলে তার সঙ্গে আর যােগাযােগ করা সম্ভব হয়নি। তবে ১৯৯৯ সালের ১৫ জানুয়ারি সাপ্তাহিক বিচিত্রা’ ঈদ সংখ্যায় ‘আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস অন্বেষনে’ শিরােনামে এক নিবন্ধ প্রকাশিত হয় কাজী আরেফ আহমেদের। এতে ষাটের দশকে স্বাধীনতা সংগ্রামের অংশ হিসেবে বঙ্গবন্ধুর গােপন পরিকল্পনা সম্পর্কে তিনি যা লিখেন তার সার সংক্ষেপ হচ্ছে-৬১ সালেই শেখ মুজিব চিত্তরঞ্জন সুতার ও আবদুর রব সেয়নিয়াবতসহ কয়েকজন রাজনীতিককে নিয়ে পূর্ব বাংলা মুক্তিফ্রন্ট’ নামে একটি গােপন সংগঠন গড়ে তােলেন। এই সংগঠনের লক্ষ্য ছিল পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। এঁদের সিদ্ধান্ত ছিল প্রয়ােজনে সশস্ত্র মুক্তি আন্দোলনের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করতে হবে। একইভাবে স্বাধীনতায় বিশ্বাসী কর্মী সৃষ্টি, বাংলা ভাষা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং অন্যান্য ন্যায় সংগত দাবি দাওয়ার আন্দোলনকে ধাপে ধাপে স্বাধীনতা আন্দোলনে উন্নীত করতে হবে। এই সুদূরপ্রসারী লক্ষ্যে সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও তাকে (কাজী আরেফ আহমেদকে) দিয়ে ছাত্রলীগের মধ্যে গড়ে তােলা হয় একটি গােপন ধারা যা ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ নামে পরিচিত হয়। সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা, কর্মীদের রাজনৈতিক ও সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়াসহ সার্বিকভাবে তৈরি করার লক্ষ্যে ওই তিন ছাত্রনেতাকে।
নিয়ে ৬৪ সালে গঠন করা হয় কেন্দ্রীয় নিউক্লিয়াস’। সহযােগিতার জন্য ভারত-লন্ডনে বঙ্গবন্ধু কাজী আরেফ আহমদের প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়, ৬৬ সালের ৮ মে থেকে ৬৮ সালের ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত কারাগারে আটক থাকা অবস্থায় মি. চিত্তরঞ্জন সুতারের সাথে শেখ। মুজিব (আগরতলা মামলার আসামি হিসেবে সেনা ছাউনিতে নিয়ে যাবার আগে) বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় স্বাধিকার আন্দোলনকে স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপান্তরের কৌশল নিয়ে বিশদ আলােচনা করেন। এরই মধ্যে সরকার পক্ষ শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে অভিযোেগ এনে ক্যামেরা ট্রায়ালের ব্যবস্থা করে। এতে তিনি (মুজিব) ৬২ সালে ভারতের আগরতলা গিয়ে ভারতের সাথে যােগসাজশে পাকিস্তানকে বিভক্ত করে তথাকথিত বাংলাদেশ সৃষ্টি করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত’ বলে উল্লেখ করা হয়। পরে তাকে আগরতলা মামলার এক নম্বর অভিযুক্ত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ক্যামেরা ট্রায়ালের সমস্ত বক্তব্য শুনে শেখ মুজিব চিত্তরঞ্জন সুতারকে জানান, ‘ওরা (পাকিস্তানিরা) আমার সব কিছু জেনে গেছে, তাই এ পথে আর নয়, অন্য পথে এগুতে হবে। পাকিস্তানি শাসন, শােষণ, নির্যাতন ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির আন্দোলনকে স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপান্তর করা এবং ওদের মুখােশ উম্মােচন করে বিশ্বের সকল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও জাতির সমর্থন আদায়ের চেষ্টা ও পরিকল্পনা নিয়ে এগুতে হবে। এই আলাপ-আলােচনা ও সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শেখ মুজিব ৬৯ সালে জেল থেকে মুক্তির পর চিত্তরঞ্জন সুতারকে ভারত পাঠান ইন্দিরা গান্ধী ও ভারত সরকারের সহযােগিতা-সহানুভূতি আদায়ের জন্য। বঙ্গবন্ধুর বিশেষ দূত হিসেবে কোলকাতা গিয়ে ভবানীপুরে একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে অবস্থান করেন চিত্ত রঞ্জন। অপরদিকে বঙ্গবন্ধু নিজে চিকিৎসার নামে লন্ডন যান আন্তর্জাতিক সমর্থন লাভের উদ্দেশ্যে। যাবার আগে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের নিউক্লিয়াসের সাথে বৈঠকে তিনি বলেন, ‘আমার ওপর তােমরা আস্থা রেখ। পাকিস্তানি সম্ভাব্য হামলা ও বাঙালি জনগণের ওপর শক্তি প্রয়ােগের সম্ভাব্য প্রস্তুতির বিরুদ্ধে বিশ্বজনমত সৃষ্টি করা, তােমাদের প্রশিক্ষণ, অস্ত্রশস্ত্র ও সমর্থন আদায় করাই আমার এ যাত্রার প্রধান লক্ষ্য।
লন্ডন থেকে ফিরে আসার পর ৭১ এর ফেব্রুয়ারি মাসে বিপ্লবী পরিষদের ৬০ জনকে ভারতে প্রশিক্ষণে পাঠানাের প্রস্তুতি নিতে বঙ্গবন্ধু নির্দেশ দেন। কিন্তু সে সময় দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তনের কারণে সেই প্রশিক্ষণের সময় পিছিয়ে যায়। এর আগে ২১ জানুয়ারি চার যুবনেতাকে কোলকাতায় ভবানীপুরের চিত্ত রঞ্জন সুতারের ঠিকানা দিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, এই ঠিকানায় গেলেই তােমরা প্রবাসী সরকার, সশস্ত্র বাহিনী গঠন, প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্রশস্ত্রের সহযােগিতা পাবে।’ তিনি ওই ঠিকানা চার যুবনেতা। ছাড়াও তাজউদ্দিন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও কামরুজ্জামানকেও দেন এবং সেখানে যাবার নির্দেশ দেন। পরবর্তীতে আমরা দেখি সেই চার নেতা যারা চার জাতীয় নেতার মর্যাদায় আসীন হয়েছিলেন, তাদের নেতৃত্ব ও তত্ত্বাবধানে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয় এবং সেই সরকারকেই ভারত সরকার প্রয়ােজনীয় সাহায্য-সহযােগিতা দিয়েছিল।
সূত্র : আগরতলা মামলার অপ্রকাশিত জবানবন্দী – মুহাম্মদ শামসুল হক