You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04.24 | ইয়াহিয়ার হুমকী | যুগান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

ইয়াহিয়ার হুমকী

জবর শসানী দিয়েছে পাকিস্তান। কলকাতার বেদখল পাক-মিশন তুলে দিতে হবে মাসুদের হাতে। যারা এখন এ ভবন দখল করে আছেন তাদের উচ্ছেদ করতে হবে নয়াদিল্লীকে। ভারত সরকা ইসলামাবাদের এ দাবী না মানেন তবে তার পরিণাম হবে সংঘাতিক। ইয়াহিয়া খান হয়ত ভাবছেন, তিনি সাম্প্রতিককালের দূর্ধর্ষ ডাকাত দলের সর্দার। তাঁর হুমকীতে নয়াদিল্লীর কর্তারা সাত হাত মাটির মাটির নীচে সেধিয়ে যাবেন। পাক-দস্যুদের হাতে আছে ঢাকা এবং ইসলামাবাদের ভারতীয় হাইকমিশন। এই দুটি মিশনের কর্মী এবং তাদের পরিবারবর্গকে তারা হােষ্টেজ হিসাবে সারণ নিয়ে পাক-টালবাহানা এ সন্দেহকে ঘনীভূত সুযােগ পাকিস্তানের কাছে চেয়েছিলেন। কিন্তু তারা কোন জবাব পান নি। ঢাকায় বিশেষ বিমান পাঠাবার অনুমতিও মিলছে না। অন্যান্য বিদেশী দূতাবাসের অনেক কর্মী এবং তাঁদের পরিবার ঢাকা ছেড়েছেন। পাকিস্তানি বিমান ওদের করাচী পৌছে দিয়েছে। করাচীর পথে ভারতীয় মিশনের কর্মী এবং তাঁদের পরিবারবর্গকে ভারতে নিয়ে আসতে নয়াদিল্লী রাজী। ইসলামাবাদের জঙ্গী শাসকেরা নিজেদের বিমানে ভারতীয় কূটনৈতিক কর্মীদের অপসারণ করবেন না। অন্য কোন বিদেশী বিমানকেও এ কাজ করতে দেবেন না। এদিকে ঢাকা মিশনের কর্মীদের অবস্থা শােচনীয়। ওদের চোখের সামনে ঘটেছে নারকীয় ঘটনা। মিশন কিম্বা বাড়ী ছেড়ে কেউ বাইরে যেতে পারছেন না। প্রতিদিন তাদের কপালে জুটছে সৈন্য এবং তাদের খয়ের খাঁদের লাঞ্ছনা। যে কোন স্বাধীন রাষ্ট্রের কূটনৈতিক-বিদদের এ অপমান অসহনীয়। অথচ এই কলকাতায় ইসলামাবাদের নরঘাতীদের প্রতিনিধি মাসুদ পাচ্ছেন সরকারি রক্ষণাবেক্ষণ।
বাংলাদেশ আজ স্বাধীন সার্বভৌমত্বের জন্য বাঙালী যে রক্তমূল্য দিয়েছেন তা তুলনাহীন। সরকারিভাবে এখন পর্যন্ত তাজউদ্দিন সরকার কূটনৈতিক স্বীকৃতি না পেলেও পঞ্চান্ন কোটি ভারতবাসী তাদের স্বীকৃতি দিয়েছেন। জনাব আলী বাংলাদেশের স্বাধীন অবাঙালী সাধারণ মানুষের অন্তরের মনিকোঠায়। প্রাক্তন পাকডেপুটি হাইকমিশন ভবন এখন বাংলাদেশের কূটনৈতিক ভবনে পরিণত। এ বাড়ীর যিনি মালিক তিনি ইতিমধ্যেই নূতন ভাড়াটিয়াদের সঙ্গে নব-পর্যায়ের চুক্তি করছেন বা করতে যাচ্ছেন বলে সংবাদ পাওয়া গেছে। পররাষ্ট্র দপ্তর দপ্তর স্পষ্টই বলে বলে দিয়েছেন, সমস্যাটা আদালতে নিষ্পত্তি হওয়া দরকার। পাক হাই-কমিশন ইচ্ছা করলে জনাব আলীর নামে মামলা দায়ের করতে পারেন। কিন্তু নাছােড়বান্দা পাক ধুরন্ধররা আদালতের ধারে কাছে যাচ্ছেন না।
তারা চাইছেন পুলিশ দিয়ে নয়াদিল্লী জনাব আলীকে সদলে বার করে দেবেন। আর মাসুদ বীরদর্পে সেখানে ঢুকবেন। এ ধরনের কল্পনা যে অবাস্তব তা বােঝার মত বুদ্ধি অবশ্যই ইয়াহিয়ার আছে। লক্ষ লক্ষ বাঙালীর রক্তে লাল হয়ে আছে ইসলামাবাদের নরপশুদের হাত। এরা ইয়াহিয়ার মত ভুইফের ডিকটেটর নন, জনপ্রতিনিধি। ইসলামাবাদের মনােরঞ্জনের জন্য তাঁরা নরপশুদের দলে নাম লেখাবেন না। মনে হয়, একটা সঙ্কট সৃষ্টি করতে চাইছেন ইয়াহিয়া। যে সাংঘাতিক পরিণামের হুমকী তিনি দিয়েছেন তার বাস্তব রূপটি কি? হয়ত ঢাকা এবং ইসলামাবাদের ভারতীয় কূটনৈতিক কর্মীরা অনির্দিষ্ট কালের জন্য থাকবেন পাক বর্বরদের হােষ্টেজ হিসাবে। অথবা কাশ্মীর সীমান্তে হানাদার পাঠিয়ে ইয়াহিয়া বাধাবেন আর একটা সংঘর্ষ। তার ধারণা, এ ধরনের একটা কান্ড করে বসলেই বাঙলাদেশের গণহত্যা এবং লড়াই পড়বে চাপা। বড় হয়ে উঠবে পাক-ভারত বিরােধ। দুনিয়াকে বিভ্রান্ত করার সহজ সুযােগ আসবে ইয়াহিয়ার হাতে। আগুন নিয়ে খেলছেন ইসলামাবাদ। নরঘাতীর পেশী সঞ্চালনে ভয় পান নি নিরস্ত্র বাঙলাদেশ। আর সশস্ত্র ভারত চলবে তাকে সমীহ করে? বেশী বাড়াবাড়ির দুঃসাহস দেখালে মায়ের চোটে বাজানের নাম ভুলে যাবেন ইয়াহিয়া খান। মােহনিদ্রা ভেঙ্গে ফেলুন নয়াদিল্লী। ইসলামাবাদের দুষমনরা মানবদ্রোহী। ওদের বন্ধুত্ব যে কোন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের গলায় ফাস। আন্তর্জাতিক বিধান যারা মানে না তাদের সঙ্গে আইনের তর্ক বৃথা। বাঙলাদেশের স্বাধীন সরকারকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দিন। মুক্তিযােদ্ধার জয়যাত্রায় সাহায্য করুন। তা হলেই ইসলামা ইসলামাবাদের লড়াই-এর সাধ মিটবে। ইয়াহিয়াকে স্পষ্ট ভাষায় জানানাে দরকার, বাঙলাদেশের কূটনৈতিক প্রতিনিধি জনাব আলী যেখানে আছেন সেখানেই থাকবেন। ঢাকা কিম্বা ইসলামাবাদের ভারতীয় কূটনৈতিকদেরও মাথা মুড়িয়ে দেওয়া হবে। ভারতীয় কূটনৈতিকদের পরিবারবর্গ নিরাপদে স্বদেশে না আসা পর্যন্ত পাক-কূটনৈতিকদের পরিবারবর্গও থাকবেন ভারতে। পাকিস্তানে ভারতীয় যে ব্যবহার পাবেন ভারতও পাকিস্তানিদের ভাগ্যে অনুরূপ ব্যবহার জুটবে। নয়াদিল্লীর অস্ত্রের ঝংকার না শুনলে এবং ব্যবহারিক কঠোরতা না পেলে ইয়াহিয়ার গােবর ভর্তি মগজে শুভ বুদ্ধির গাছ গজাবে না।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২৪ এপ্রিল ১৯৭১