You dont have javascript enabled! Please enable it! মাগুরার যুদ্ধ - সংগ্রামের নোটবুক

মাগুরার যুদ্ধ

পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে মাগুরা জেলার প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মাগুরার সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ২ মার্চ শহরের চৌরঙ্গী মোড়ে তৎকালীন কোর্ট চত্ত্বরের সামনে বটতলায় (বর্তমানে পুলিশ সুপারের কার্যালয়) তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক ওয়ালিউল ইসলাম আগুনঝরা বিপ্লবী বক্তব্য রাখেন। তার বক্তব্যে মাগুরার মানুষের মাঝে ব্যাপক উদ্দিপনার সৃষ্টি হয়। এ সময় তাৎক্ষণিকভাবেই ছাত্রলীগ সভাপতি মুন্সী রেজাউল হককে সভাপতি করে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এবং অ্যাড. আসাদুজ্জামানকে আহ্বায়ক এবং ওয়ালিউল ইসলামকে সদস্য সচিব করে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। পরবর্তীতে এ দুটি পরিষদ গঠনের পর থেকেই তারা ঢাকার ঘোষণা অনুযায়ী মাগুরাতেও অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে এবং ৩ মার্চ মাগুরায় সফল হরতাল পালন করে। সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক আসাদুজ্জামান অন্যতম দুই উপদেষ্টা আতর আলী এবং অ্যাড. সোহরাব হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে ২৫ মার্চ পর্যন্ত এ অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহত রাখেন।

অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন গেরিলা তৎপরতা চালাতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন অ্যাড. আবুল খায়ের, আলতাফ হোসেন, নবুয়ত মোল্যা, রোস্তম আলী, আবু নাসের বাবলু, নন্দ দুলাল বংশী প্রমুখ।

এদিকে শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণার পর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সারাদেশে হত্যাযজ্ঞ শুরু করলেও সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ ২৬ মার্চ মাগুরার প্রবেশ পথগুলোতে নানারকম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির মাধ্যমে এক কঠিন প্রতিরোধ ব্যুহ তৈরি করতে সক্ষম হয়। পাশাপাশি তারা স্থানীয়ভাবে প্রয়োজনীয় অর্থ, অস্ত্র ও সদস্য সংগ্রহ করতে থাকে। ১২ মার্চ তারা ঝিনাইদহ এসডিপিও মাহবুব এর সহযোগিতায় মাগুরা থানা লুট করে বেশ কয়েকটি অস্ত্র সংগ্রহ করে। ২৬ মার্চ চুয়াডাঙ্গা ইপিআর এর ৪ নং উইং কমান্ডার মেজর ওসমান বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং ১ প্লাটুন সদস্যকে অস্ত্রসহ মাগুরার সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে যোগ দিতে প্রেরণ করেন যা পরবর্তীতে ব্যাপক সহায়ক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়। সংগ্রাম পরিষদ মাগুরা নোমানী ময়দানস্থ আনসার ক্যাম্পের টিনের ঘরটিকে তাদের প্রধান কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করতে থাকেন। সেই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণেচ্ছু ছাত্র জনতাকে সংগঠিত করে নোমানী ময়দান, পারনান্দুয়ালী শেখপাড়া আমবাগান, ওয়াপদা, সদর উপজেলার কাটাখালী ব্রিজের পাশে ও বিভিন্ন স্থানে তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। এ সময় হাবিলদার সাজাহান, কামরুজ্জামান (শৈলকুপা), হারেসার, জাহিদুল ইসলাম মিটুল, আকবর হোসেন, জাহিদুল ইসলাম (বেলনগর), আঃ ওয়াহেদ মিয়া (পারনান্দুয়ালী), আবদুল মান্নান প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। ৪ এপ্রিল তাজুদ্দিন আহম্মেদ এবং ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম মাগুরা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে এক গোপন বৈঠকে মিলিত হয় এবং ওইদিন রাতে সংগ্রাম পরিষদ তাদেরকে মাগুরা থেকে ভারতের পথে এগিয়ে দিয়ে আসে। এ দিনেই মাগুরা-যশোর সড়কের লেবু তলায় পাকবাহিনীর সাথে সুবেদার আ. মুকিতের নেতৃত্বে মাগুরা সংগ্রাম পরিষদের ব্যাপক সম্মুখ যুদ্ধের সৃষ্টি হয় যা ৭ এপ্রিল পর্যন্ত দফায় দফায় চলতে থাকে। এ যুদ্ধে শহরের পারনান্দুয়ালী গ্রামের শরিফুল ইসলাম ফুলসহ ১৫ জন নিহত হন। সম্ভবত শরিফুল ইসলামই মাগুরার প্রথম শহীদ মুক্তিযোদ্ধা।

এদিকে ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে শপথ গ্রহণের পর অ্যাড. আসাদুজ্জামান এমপি রানাঘাটে ক্যাম্প ইনচার্জ হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য ভারত গমণ করেন। মাগুরা সংগ্রাম পরিষদ বিশাল প্রতিরোধ ব্যবস্থা অব্যাহত রাখলেও ২২ এপ্রিল সোমবার দুপুরে পাকসেনাবাহিনী বিশাল ট্যাঙ্ক বহর নিয়ে ঝিনাইদহ ও যশোর সড়ক দিয়ে মাগুরা সীমানায় প্রবেশ করতে সক্ষম হয়। এদিন মাগুরার আলমখালী বাজার এলাকায় সুরেন বিশ্বাস নামে এক ব্যক্তিকে পাকসেনারা গুলিতে নিহত করে এবং পরদিন ২৩ এপ্রিল মঙ্গলবার জয় বাংলা শ্লোগান দেওয়ায় পাক সেনাবাহিনী বাগবাড়িয়া গ্রামের লালু নামে এক পাগলকে গুলি করে হত্যা করে। পরবর্তী সময়ে হানাদাররা শহরের পিটিআই, ভিটিআই, সিও অফিস (বর্তমান উপজেলা পরিষদ) চত্ত্বর, মাগুরা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, নিউকোর্ট বিল্ডিং, মাইক্রোওয়েভ স্টেশন ও মাগুরা সরকারি কলেজে তাদের ক্যাম্প স্থাপন করে। শহরের মধুমতি ডাক বাংলোটিকে তারা হেডকোয়ার্টার হিসেবে ব্যবহার করে কার্যক্রম পরিচালনা করে। পাক বাহিনী স্থানীয় স্বাধীনতা বিরোধীদের চিহ্নিত করে শান্তি কমিটি, রাজাকার ও আলবদর বাহিনী গঠন করে তাদের যোগসাজশে নারকীয় হত্যাযজ্ঞসহ বর্বর হামলা চালিয়ে যেতে থাকে। মেজর হায়াত এবং মাগুরার রিজু, কবির, পীর ওবায়দুল্লাহ, বাশি চেয়ারম্যান ও আয়ুব চৌধুরীদের সেই সময়কার পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞ ও বিভীষিকার কথা মাগুরার মানুষের মনে এখনো জ্বলজ্বল করে।

যুদ্ধকালীন সময়ে শ্রীপুরের আকবর বাহিনী, মহম্মদপুরের ইয়াকুব বাহিনী, মোহাম্মদপুর-ফরিদপুর অঞ্চলের মাশরুরুল হক সিদ্দিকীর কমল বাহিনী, মাগুরা শহরের খোন্দকার মাজেদ বাহিনী এবং মুজিব বিশেষ সাহসী ভূমিকা নিয়ে পাকসেনাদের ও স্থানীয় রাজাকার-আল বদর বাহিনীর সঙ্গে প্রাণপণ যুদ্ধ করে। এ সময় কমল বাহিনীর প্রধান মাশরুরুল হক সিদ্দিকী কমল ভাটিয়াপাড়ার এক সম্মুখ যুদ্ধে গুলিতে তার একটি চোখ হারান।

আকবর হোসেন মিঞার শ্রীপুর বাহিনী রণাঙ্গণে একের পর এক বিরোচিত অভিযানে পাক হানাদার বাহিনীকে তটস্থ করে তোলে। শ্রীপুরের শ্রীকোল ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আলহাজ্ব আকবর হোসেন মিয়ার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা এ বাহিনী মূলত মাগুরা, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী, ফরিদপুর এলাকাজুড়ে তৎপরতা চালায়। এ বাহিনীর অব্যাহত অভিযান ও স্থানীয় গেরিলা বাহিনীর তৎপরতায় পাক বাহিনী পিছু হটতে শুরু করে। এ দুই বাহিনী ৬ ডিসেম্বর মাগুরাকে হানাদারমুক্ত করতে নিজনান্দুয়ালি গ্রামে ও বিভিন্ন পাকিস্তানি ক্যাম্পে একই সময়ে আক্রমণ চালায়। একই সঙ্গে মিত্র বাহিনীর আগ্রাসনের ভয়ে পাকিস্তানি সেনারা রাতারাতি মাগুরা শহর ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। পরদিন ৭ ডিসেম্বর মাগুরা হয় শত্রুমুক্ত। মুক্তির আনন্দে সারা শহরে নামে হাজারো মানুষের ঢল।