You dont have javascript enabled! Please enable it! 1969 | আওয়ামী লীগের অনেক নেতা কর্মী জানতেন না- বিধান কৃষ্ণ সেন | আগরতলা মামলার অপ্রকাশিত জবানবন্দী - সংগ্রামের নোটবুক
আওয়ামী লীগের অনেক নেতা কর্মী জানতেন না- বিধান কৃষ্ণ সেন
শ্রী বিধানকৃষ্ণ সেনের জন্ম ১৯৩০ সালে চট্টগ্রাম জেলার বােয়ালখালী উপজেলার সারােয়াতলী গ্রামে। বাবা রাজেন্দ্র নারায়ন সেন ছিলেন সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক। রাউজান উপজেলার নােয়াপাড়া উচ্চবিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক এবং চট্টগ্রাম সিটি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক ও ডিগ্রি পাস করা বিধান সেন ছাত্রাবস্থা থেকেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ৪৭ এর আগে তিনি নেতাজী সুভাষ বসুর ফরওয়ার্ড ব্লকের ছাত্র সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে মানিক চৌধুরীর ব্যবসায়িক সহযােগীও ছিলেন তিনি। অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল চিন্তাচেতনায় বিশ্বাসী রাজনৈতিক কর্মী বিধান সেনের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর পরিচয় মানিক চৌধুরীর মাধ্যমে। বঙ্গবন্ধুর দেশপ্রেম, কথাবার্তা এবং আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বে অভিভূত হয়ে শ্রী সেন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন। সেই সুবাদে ভালাে সম্পর্ক গড়ে ওঠে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। তিনি ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের সময় ভূমিকা রাখেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে অবহেলিত, বিক্ষুব্ধ বাঙালি সৈনিকদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে যােগাযােগ ও প্রয়ােজনে বেগম মুজিবের মাধ্যমে সংবাদ বিনিময়ের জন্য বিধান সেনকেও দায়িত্ব দেওয়া হয়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধেও তাঁর ছিল সক্রিয় ভূমিকা। স্বাধীনতার পর প্রথমে তিনি চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হন। পরে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) গঠিত হলে তিনি ওই দলের প্রথম সিনিয়র সহসভাপতি হন এবং ৭৭ সালে কিছু দিন ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ছিলেন। এভাবে রাজনীতি ও স্বাধীনতা সংগ্রামের গােপন বিপ্লবী তৎপরতার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত থাকার সুবাদে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আকাক্ষা ও স্বাধীনতা আন্দোলনের বিভিন্ন স্তরে নানান আয়ােজন সম্পর্কে অনেক কিছুই জানার কথা শ্ৰী বিধান সেনের। তাই তাঁর সঙ্গে কথা বলে জানতে চাই বিস্তারিত। তার কথার সার সংক্ষেপ: পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসন শােষণ থেকে মুক্ত করে বাঙালি।
 
জাতিকে একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় শেখ মুজিবের মধ্যে ৬০ এর দশকের শুরু থেকে স্পষ্ট দেখা গেছে। বাঙালিদের মধ্যে পাকিস্তানের অস্তিত্বে আস্থাশীল, রক্ষণশীল এবং স্বাধীনতাকামী প্রগতিশীল দুটো অংশেরই অস্তিত্ব তখন থেকেই ছিল। সাম্প্রদায়িক, নিপীড়নমূলক ও রক্ষণশীল শাসন থেকে মুক্তির কথা অন্য অনেকেই ভাবলেও সবার আকাঙ্ক্ষাকে নিজের মধ্যে ধারণ করে তাদের হয়ে স্পষ্ট কথা বলার ক্ষমতা ও প্রবণতা একমাত্র শেখ মুজিবেরই ছিল। স্বাধীনতার সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে অগ্রসর হবার সংকল্প, পরিকল্পনা ও কৌশল ছিল বলেই একই লক্ষ্যে বিভিন্ন স্রোতধারার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শক্তিগুলাে তার নেতৃত্বে আস্থাশীল ও একই ফ্লাটফরমে সমবেত হয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে সামিল হয়েছিল। একই সুতােয় তিন সংগঠনের বিপ্লবী কর্মকাণ্ড বিধান সেন জানান, পূর্ববাংলা মুক্তিফ্রন্ট’, স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’, ‘কেন্দ্রীয় নিউক্লিয়াস’ এবং বাঙালি সশস্ত্র বাহিনীর বিপ্লবী কর্মকাণ্ড ছিল একই সঁতােয় গাথা। শেখ মুজিব ৬১ সালেই পূর্ব বাংলা মুক্তিফ্রন্ট’ নামে একটি গােপন সংগঠনের জন্ম দেন। এর মাধ্যমে কৌশলে ছাত্রসমাজসহ বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের মধ্যে স্বাধীনতার পক্ষে প্রয়ােজনীয় জনমত সৃষ্টি ও অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বিপ্লবের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের কথা চিন্তা করছিলেন তিনি। পাশাপাশি চলে ছাত্রদের মধ্যে সশস্ত্র ক্যাডার সৃষ্টির প্রক্রিয়া। এর অংশ হিসেবে ছাত্রলীগের স্বাধীনতাপন্থী প্রগতিশীল ও বাছাই করা বিশ্বস্ত কর্মীদের নিয়ে ১৯৬২ সালে গঠন করেন স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ। ১৯৬৪ সালে গঠন করেন পরিষদের ‘কেন্দ্রীয় নিউক্লিয়াস’।
শুরুতে এসব সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে যুক্ত ছিলেন সিরাজুল আলম খান (পরবর্তীতে জাসদের তাত্ত্বিক নেতা বলে পরিচিত), আবদুর রাজ্জাক (পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী, বর্তমানে প্রয়াত) ও কাজী আরেফ আহমেদ (প্রয়াত জাসদ নেতা)। ৬৬ সাল থেকে আরাে পরে এ সংগঠনের সাথে এমএ মান্নান, আবুল কালাম আজাদ, তােফায়েল আহমদ, আসম আবদুর রবসহ অনেকেই যুক্ত হন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ ও পরামর্শে তারা ছাত্র জনতার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে ছয় দফা ও স্বায়ত্বশাসনের দাবির আড়ালে স্বাধীনতার পক্ষে প্রয়ােজনীয় কার্যক্রম চালাতে থাকেন। বিধান সেন বলেন, পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে শেখ মুজিবের গােপন তৎপরতার ব্যাপারে আওয়ামী লীগের অনেক প্রবীণ ও রক্ষণশীল নেতা-কর্মী প্রকৃতই অজ্ঞ ছিলেন। এক পর্যায়ে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ গঠনের একটি ভিন্ন প্রেক্ষাপটের চিত্র পাওয়া যায়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কিছু বাঙালি সৈনিক ও অফিসার লে. কমান্ডার মােয়াজ্জেম হােসেনের নেতৃত্বে পাকিস্তান সরকারের বাঙালি বিদ্বেষী কর্মকাণ্ড বিশেষ করে সৈনিকদের প্রতি বৈষম্যমূলক ও অপমানজনক আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে সংগঠিত হচ্ছিলেন। তারাও ভাবছিলেন কি করে বাংলাদেশকে স্বাধীন করে নিজেদের শাসন প্রতিষ্ঠা করা যায়। কিন্তু তাঁরা ছিলেন মূলত পশ্চিম পাকিস্তানে, অসংগঠিত ও সংখ্যায় অতি অল্প। তাঁরা তাঁদের মনােভাব প্রকাশের জন্য একজন দৃঢ়চিত্ত রাজনৈতিক নেতৃত্বের খোঁজ করছিলেন। তারা আগে থেকেই বঙ্গবন্ধুর অসাধারণ সাংগঠনিক ক্ষমতা ও বাঙালি জাতির স্বার্থে তার ত্যাগী ভূমিকার কথা জেনে মুজিবকে তাদের মনােভাবের কথা জানাতে উদগ্রীব ছিলেন এবং মুজিবের করাচি আগমনের অপেক্ষা করছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বিভিন্ন সময় আলাপের কথা উল্লেখ করে বিধান সেন জানান, সেনা সদস্যদের এই মনােভাবটা জানতে পেরে শেখ মুজিব তাদেরকে নিজ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সহযােগী শক্তি হিসেবে দেখছিলেন এবং এই শক্তিকে তাঁর মুক্তি আন্দোলনের সাথে সম্মিলনের চেষ্টা করছিলেন। করাচিতে শেখ মুজিবের সঙ্গে সেনা সদস্যদের গােপন বৈঠকে মুজিব তাদেরকে পূর্ব বাংলার জনগণের স্বার্থে যেকোনাে আন্দোলনে সমর্থন সহযােগিতার আশ্বাস দেন এবং এ ব্যাপারে ছাত্রদেরও দায়িত্ব দেবেন বলে জানান। বিক্ষুব্ধ এই সৈনিক গ্রুপের সঙ্গে সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে প্রয়ােজনে সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য জনগণের মধ্যে স্বাধীনতার চেতনা ও দাবি জাগিয়ে তােলার সুদূর প্রসারী লক্ষ্য নিয়েই স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস’ গঠন করা হয় বলে স্পষ্টতাই ধারণা করা যায়। ছাত্র-জনতাকে সংগঠিত করে আন্দোলনকে এগিয়ে নেওয়ার যে পরিকল্পনা বঙ্গবন্ধু গ্রহণ করেন সৈনিকদের অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে তাতে নতুন মাত্রা যােগ হয়। পরে সৈনিকদের ঢাকা ও চট্টগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বদলির পদক্ষেপ নেওয়া হয়। ৬৪’র শেষ দিক থেকে শুরু করে সৈনিক গ্রুপের একাধিক সদস্যের মতে ৬২ সাল থেকে) ৬৬ সালের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর সাথে সৈনিক গ্রুপের ঢাকা, চট্টগ্রাম ও করাচিতে একাধিকবার বৈঠক হয়। এসব বৈঠকে এক একটি পর্যায়ে রুহুল কুদ্স সিএসপি, মানিক চৌধুরীসহ কতিপয় বেসামরিক ব্যক্তি সংশ্লিষ্ট হন। এ ছাড়া তাদের (সৈনিক গ্রুপের) সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর নিযুক্ত বেসামরিক প্রতিনিধিদের অনেক বৈঠক হয় বিভিন্ন স্থানে। বিধান সেন বলেন, ‘দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বিশেষ করে স্বৈরাচারী আইউব সরকারের অব্যাহত নিপীড়নমূলক ব্যবস্থার যে কোনাে পর্যায়ে শেখ মুজিবের গ্রেপ্তার হওয়ার আশঙ্কা ছিল। তাই তিনি তাঁর অবর্তমানে অর্থাৎ জেলে থাকাকালে তিনি, সেনা সদস্য ও বেগম মুজিবের সঙ্গে পৃথকভাবে লিয়াজো রক্ষার জন্য ভূপতিভূষণ চৌধুরী (মানিক চৌধুরী), ডা. ছৈয়দুর রহমান ও আমাকে মনােনীত করেন।
তিনি মানিক চৌধুরীকে প্রথমে বিষয়টি অবহিত করেন। পরে ডা. ছৈয়দুর ও আমাকে এ পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এ ব্যাপারে কঠোর গােপনীয়তা রক্ষা করা হয় দলের ভেতরে বাইরে। সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি শেখ মুজিবের কড়া নির্দেশ ছিল যাতে কোথাও কেউ লিখিত কোনাে প্রমাণপত্র না রাখেন। যেখানে যেখানে গােপন বৈঠক অফিসারসহ সংশ্লিষ্ট বাঙালি সিপাইরা প্রথম দিকে সেনানিবাস ও নৌবাহিনী মেসসহ তাঁদের নিজস্ব গন্ডির মধ্যে সাংগঠনিক কাজগুলাে চালাতে থাকেন। পরে ঢাকা ও চট্টগ্রামে কয়েকটি বাড়ি ঠিক করা হয় যেখানে গােপন প্রক্রিয়ায় জড়িতদের কেউ কেউ বসে কাজের অগ্রগতি এবং ভবিষ্যৎ করণীয় সম্পর্কে আলােচনা-পর্যালােচনা করতেন। বিভিন্ন সময় যে সব বাড়িতে বৈঠক হয়েছে সেগুলাের মধ্যে ঢাকার বঙ্গবন্ধুর বাড়ি, তাজউদ্দিন আহমদের বাড়ি, গেন্ডারিয়ার দ্বীননাথ সেন রােডের একটি বাড়ি ও আজিমপুরের সিটি নামে একটি বাড়ির কথা এ মুহূর্তে মনে পড়ছে। চট্টগ্রামে আমার ৩১ মিরেন্ডা লেনের বাসা, এনায়েত বাজারের ডা. ছৈয়দুর রহমানের আউটার হাউস, রামজয় মহাজন লেনের মানিক চৌধুরী। বাসা/অফিস, রহমতগঞ্জস্থ বর্তমান বাংলা কলেজের কাছের শঙ্কু চৌধুরীর বাড়ি, লাভ লেইনের নেভাল এভেনিউস্থ লে. ক. মােয়াজ্জেমের বাসা, হােটেল মিসকা এবং সদরঘাটের হােটেল শাহাজাহানে বিভিন্ন সময় গ্রুপ ভিত্তিক বৈঠক হয়েছে। কয়েকটি বৈঠকে শেখ মুজিব নিজে উপস্থিত থাকলেও অধিকাংশ বৈঠকে দায়িত্বপ্রাপ্তরা যােগ দিতেন। বেগম মুজিব সব জানতেন বিধান সেন জানান, বেসামরিক ব্যক্তিদের মধ্যে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রস্তুতি সম্পর্কে বেগম মুজিবেরও অনেক কিছু জানা ছিল। বঙ্গবন্ধু একবার গ্রেপ্তার হবার পর নির্দেশ দেন, তার অনুপস্থিতিতে বিভিন্ন খবরাখবর বেগম মুজিবকে জানানাে যাবে এবং তিনি মুজিবের নির্দেশাবলী মানিক চৌধুরীদের মাধ্যমে অন্যদের জানবেন।
এ প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন সময় প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে জড়িতদের মধ্যে রুহুল কুদ্স, খান শামসুর রহমান, আহমদ ফজলুর রহমানসহ কতিপয় সরকারি আমলাও ছিলেন। অবশ্য আগরতলা মামলার সব আসামি কিংবা এ প্রক্রিয়ায় যুক্তদের সবাই পরিকল্পনার প্রকৃত বিষয়বস্তু সম্পর্কে বিস্তারিত জানতেন না। তবে বঙ্গবন্ধুর কথাবার্তা ও কার্যক্রমে সবাই বুঝতেন যে, তার (বঙ্গবন্ধুর) মূল ধ্যান ধারণা ছিল সকল প্রগতিশীল স্বাধীনচেতা শক্তিগুলাের সম্মিলন ঘটিয়ে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাধীনতার পক্ষে গণজোয়ার সৃষ্টি করা। এ পর্যায়ে সরকারের পক্ষ থেকে সশস্ত্রভাবে বাধাবিঘ্ন এলে সশস্ত্র উপায়েই তা মােকাবেলা করে দেশকে স্বাধীন করা। এসব আন্দোলনকে রাজপথে সম্প্রসারণের মূল চালিকা শক্তি ছিল স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত প্রগতিশীল ছাত্র সমাজ। স্বাধীনতার লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সম্ভাব্য সাহায্য সহযােগিতা অপরিহার্য ছিল। তাই বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন সময় ভারতের সাথে যােগাযােগ করেন ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত ও চিত্তরঞ্জন সূতার প্রমুখের মাধ্যমে। ভারতের কাছে প্রস্তাব দেওয়া হয় যে, আমাদের পূর্ব বাংলায় সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হলে তাদের আকাশপথ বন্ধ করে দিতে হবে এবং বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে অস্ত্রশস্ত্রসহ সব ধরনের সহযােগিতা দিতে হবে। কথা ছিল সব ধরনের প্রস্তুতি শেষ হবার পর একটি দিন ধার্য হবে, যেদিন বিভিন্ন সেনানিবাসের অস্ত্রভাণ্ডার দখল করে, কারাগারের সকল বন্দীকে মুক্তি দিয়ে সেখানে পাক সেনাদের বন্দী করা হবে এবং শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রপতি ঘােষণা করে বন্ধু রাষ্ট্রগুলাের সাহায্য চাওয়া হবে।
 
পুরাে বিষয়টি এগিয়ে নেওয়া ছিল সময় সাপেক্ষ। এরই মধ্যে বঙ্গবন্ধু তার নিয়মতান্ত্রিক। আন্দোলনের সবচেয়ে বড় কৌশল চালিয়ে দেন ঐতিহাসিক ছয় দফা ঘােষণার মাধ্যমে। ছয় দফা ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়তা অর্জন করছিল, পাশাপাশি স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের সাংগঠনিক কাঠামােও বিস্তৃত হচ্ছিল দেশব্যাপী। এমন অবস্থায় সেনাবাহিনীর যে অংশটি বঙ্গবন্ধুর পরিকল্পনার সাথে যুক্ত হয়ে কাজ করছিল তাদের কয়েক জনের নিজেদের মধ্যে। ভুল বােঝাবুঝি হয় আর্থিক লেনদেনের হিসেব নিকেশ নিয়ে। বিশেষ করে সাবেক করপােরাল। আমির হােসেনের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযােগ উঠে। তিনি সরকারের পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তি করছেন বলেও কারাে কারাে সন্দেহ জাগে। এ পর্যায়ে সরকারের গােয়েন্দা সংস্থার তৎপরতায় সন্ধিগ্ধ হয়ে বিপ্লবী পরিষদ খোজ নিয়ে নিশ্চিত হন যে, করপােরাল আমির ইতিমধ্যে অনেক গােপন তথ্য সরকারের গােয়েন্দা সংস্থাকে জানিয়ে দিয়েছে। দলনেতা মােয়াজ্জেম আমির হােসেনকে হত্যার নির্দেশ দিলেও দায়িত্বপ্রাপ্ত সৈনিকের সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে সে নির্দেশ কার্যকর হয়নি। ৬৭’র শেষ দিকে আমির হােসেন পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক গােয়েন্দা সংস্থার সদর দপ্তরে গিয়ে সবকিছু ফাঁস করে দেয়। এই ঘটনার পর বিপ্লবী প্রক্রিয়ায় জড়িতদের কেউ কেউ স্বাধীনতা সংগ্রামের পরিণতি। সম্পর্কে হতাশ হয়ে পড়েন। কেউ কেউ মনে করেন এসব করে আর হয়তাে তেমন লাভবান হওয়া যবে না। কেউ কেউ বিপদ থেকে বাঁচার জন্য তথ্য ফাঁস করে দিয়ে কর্তৃপক্ষের আস্থাভাজন হয়ে লাভবান হওয়াটাকে ভাল মনে করেন। ইতিমধ্যে এই গােপন প্রক্রিয়ায় জড়িতদের কেউ কেউ সরকারের গােয়েন্দা সংস্থার পক্ষে হয়ে কাজ করছেন বলে মনে করা হয়।  ফলশ্রুতিতে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝির পরিণতিতে আগরতলা মামলার উদ্ভব হয় বলে ধারণা করা হয়। এই মামলার কারণে বিপর্যয় নেমে আসে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের ওপর, সাথে সাথে সেই সব বাঙালি সেনা ও বেসামরিক সরকারি কর্মকর্তাসহ বঙ্গবন্ধুর সহযােগীদের ওপর যারা দেশের স্বাধীনতার জন্য নিজেদেরকে উৎসর্গ করার মতাে প্রচণ্ড ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছিলেন।’

সূত্র : আগরতলা মামলার অপ্রকাশিত জবানবন্দী – মুহাম্মদ শামসুল হক