You dont have javascript enabled! Please enable it! 1950 | ভূপতিভূষণ চৌধুরী ওরফে মানিক চৌধুরী | পঞ্চাশের দশকে বৃহত্তর চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের প্রথম সারির নেতাদের একজন আগরতলা মামলার ১২নং আসামি - সংগ্রামের নোটবুক
ওইসব তােমাদের জেনে লাভ নেই – ভূপতিভূষণ চৌধুরী
পঞ্চাশের দশকে বৃহত্তর চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের প্রথম সারির নেতাদের একজন আগরতলা মামলার ১২নং আসামি ভূপতিভূষণ চৌধুরী ওরফে মানিক চৌধুরী। ১৯৩০ সালের  ১৬ ডিসেম্বর পটিয়া উপজেলার হাবিলাসদ্বীপ গ্রামে তার জম্ম। তার বাবা ধীরেন্দ্রলাল চৌধুরী ছিলেন চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ এলাকার ব্যবসায়ী। মানিক চৌধুরী ১৯৪৬ সালে চট্টগ্রাম মিউনিসিপাল স্কুল থেকে ম্যাট্রিক ও ৪৭-৪৮ সালে কলকাতার বঙ্গবাসী কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। বঙ্গবাসী কলেজের ছাত্র থাকার সময় তিনি ব্রিটিশ বিরােধী আন্দোলনে যােগ দেন। পাকিস্তান সৃষ্টির পর তিনি দেশে এসে পারিবারিক ব্যবসা দেখাশােনার পাশাপাশি মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সংস্পর্শে এসে মুসলিম লীগ বিরােধী অসাম্প্রদায়িক আন্দোলনে অংশ নেন। পরবর্তীতে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, বাষট্টির সামরিক আইনবিরােধী আন্দোলন ও ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। আগরতলা মামলা ছাড়াও সরকারবিরােধী আন্দোলনে ভূমিকা রাখার কারণে আরও একাধিকবার তিনি কারাবরণ করেন। হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তার ছিল অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। মানিক চৌধুরী সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য ২০০৯ সালের ২০ জানুয়ারি চট্টগ্রামের আছদগঞ্জ এলাকার রামজয় মহাজন সড়কের বাসভবনে গিয়ে কথা বলি তাঁর স্ত্রী সবিতা চৌধুরী (৭২) ও বড় ছেলে দীপঙ্কর চৌধুরী কাজলের সঙ্গে। তারও আগে ২০০০ সালে।
মানিক চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ সহযােগী, আগরতলা মামলার আসামি বিধানকৃষ্ণ সেনের কাছেও মানিক চৌধুরী সম্পর্কে জানা গেছে বেশ কিছু তথ্য। তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাকালীন সময়েই এ সংগঠনের সাথে জড়িত হন মানিক চৌধুরী। প্রয়াত জনপ্রিয় আওয়ামী লীগ নেতা এমএ আজিজ ও জহুর আহমদ চৌধুরীদের সাথে দলের বিকাশে তিনিও ভূমিকা রাখেন। ১৯৫৪ সালের শুরুতে নিজেদের জায়গা সংক্রান্ত মামলার ব্যাপারে তিনি তৎকালীন আওয়ামী লীগের অন্যতম শীর্ষ নেতা ও আইনজীবী হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর সংস্পর্শে আসেন। সে সময় মানিক চৌধুরীর সঙ্গে যােগাযােগ এবং অল্পদিনের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হয় তৎকালীন যুব ও আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবের সঙ্গে। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের পর তিনি জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ নির্বাচিত হন। ষাটের দশকের শুরু থেকে একজন পরীক্ষিত ও বিশ্বস্ত কর্মী হিসেবে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক আরও গভীর হয়। বিপ্লবী সংগঠনে ভূমিকা ষাটের দশকের গােপন বিপ্লবী আন্দোলনে মানিক চৌধুরীর সম্পৃক্ততা সম্পর্কে তাঁর সুখদুঃখের সাথী বিধান সেন জানান, একজন জাতীয়তাবাদী ও নিয়মতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতা হিসেবে গােপন সশস্ত্র বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে সরাসরি সম্পৃক্ত থাকা বঙ্গবন্ধুর জন্য সে সময়কার পরিবেশ পরিস্থিতিতে বাস্তবসম্মত ছিল না। সামরিক গােয়েন্দা নজরদারি ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে চারদিক সামলে ব্যস্ত সময় কাটাতে হতাে তাকে।
এ ছাড়া আন্দোলনের নানা পর্যায়ে সামরিক সরকার বিরােধী বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে গিয়ে প্রায় কারারুদ্ধ হতেন তিনি। এ অবস্থায় বিপ্লবী প্রক্রিয়া যাতে অব্যাহত থাকে এবং বিপ্লবী সংগঠনের সদস্যদের মনােবল যাতে ভেঙে না পড়ে একই সঙ্গে তাঁর ওপর যাতে গােয়েন্দারা অতিমাত্রায় সন্দেহপরায়ণ হয়ে না ওঠে সে ব্যাপারে সচেতন ছিলেন বঙ্গবন্ধু আর তাই তিনি বিপ্লবী সংগঠনের প্রথম সারির সদস্যদের সঙ্গে যােগাযােগ, মতবিনিময়, তথ্য আদানপ্রদান, আর্থিক সহযােগিতা নিশ্চিত করা এবং রাজনৈতিকভাবেও স্বাধীনতাপন্থী স্রোত তৈরির জন্য নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এ ব্যাপারে তিনি যে কয়েকজন বেসামরিক বিশ্বস্ত দলীয় লােক নিয়ােজিত করেন তাদের মধ্যে অন্যতম ও প্রথম ছিলেন মানিক। চৌধুরী খ্যাত ভূপতিভূষণ চৌধুরী, ডা. ছৈয়দুর রহমান, বিধানকৃষ্ণ সেন এবং আবুল হােসেন। প্রথম তিনজন চট্টগ্রামের অধিবাসী। আবুল হােসেন মুন্সিগঞ্জের কামারগাঁওয়ের বাসিন্দা। এঁদের মধ্যে মানিক চৌধুরী বিপ্লবী সংগঠনের সদস্যদের সঙ্গে আলাপ আলােচনার বিষয়বস্তু সময় সময় বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে বেগম মুজিবকে অবহিত করতেন। মানিক চৌধুরীর বাসায় মুজিব ও বেগম মুজিব। মানিক চৌধুরীর স্ত্রী সবিতা চৌধুরী বলেন, “৬১-৬২ সালের দিক থেকে তাঁকে (মানিক চৌধুরীকে) প্রায় সময় ব্যস্ত-চঞ্চল দেখাতাে। ঘরে বা ব্যবসায় তেমন সময় দিতেন না। আজ চট্টগ্রাম তাে কাল ঢাকায়, কয়েকদিন পর অন্য কোথাও যাওয়া আসা করতেন। ৬৪৬৫ সালে করাচিতেও গিয়েছেন কয়েকবার।
আমাদের এখানে (আছদগঞ্জে) তখনও এই দালান উঠেনি। নিচে একতলা ঘর এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। সেই সময় শেখ সাহেব মাঝে মাঝে আসতেন এখানে। উনিও (মানিক চৌধুরী) শুনতাম ঢাকায় যেতেন, শেখ সাহেবের বাসায় যেতেন। কি করেন, কোথায় যান জানতে চাইলে বলতেন, “ওইসব তােমাদের জেনে লাভ নেই। তুমি ছেলের পড়াশােনা দেখ।’ কখনও কখনও বলতেন, ব্যবসার কাজে নানা জায়গায় যেতে হয়।’ ৬৪-৬৫ সালের দিকে বেগম মুজিব এবং তার মেয়ে শেখ হাসিনাও আমাদের খাতুনগঞ্জের বাসায় এসেছিলেন বেড়াতে। তখন বুঝেছি শেখ সাহেব ও তাঁর পরিবারের সঙ্গে ওর (মানিক চৌধুরীর) কত ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ ছিল। পরে যখন সে ৬৬ এবং ৬৭ সালে গ্রেপ্তার হয় তখন থেকে জানতে পারি শেখ সাহেবের সঙ্গে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য গােপন আন্দোলনে সে জড়িত ছিল। আর এজন্যই বিভিন্ন জায়গায় মিটিংয়ে যাতায়াত করতাে।” সবিতা চৌধুরী জানান, মানিক চৌধুরীর সঙ্গে বিধান কৃষ্ণ সেনের আন্তরিক, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। তিনিও প্রায় সময় আসতেন রামজয় মহাজন লেনের বাসায়। ডা. ছৈয়দুর রহমানও আসতেন। অন্য আরও অনেকেও দোকানে আসতেন কিন্তু নাম পরিচয় তিনি জানতেন না। তিনি জানান, ৬৭ সালের ডিসেম্বরে আগরতলা মামলায় গ্রেপ্তারের পর মানিক চৌধুরীর ওপর প্রচণ্ড রকম নির্যাতন চালানাে হয়। নির্যাতনে তার একটা কান ও একটা চোখ আংশিক নষ্ট হয়ে গিয়েছিল । ডা. ছৈয়দুর রহমান ও বিধান সেনের ওপরও একই রকম নির্যাতন করা হয়।
সরকার বিরােধী আন্দোলনে জড়িত থাকার কারণে ১৯৬৬ সালের ২০ মে মানিক চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করা হয় পাকিস্তান প্রতিরক্ষা আইনে। ওই সময় ডা. ছৈয়দুর রহমান মানিক চৌধুরীর বাসায় এসে তার স্ত্রী সন্তানদের খোঁজ-খবর নিতেন। ৬৭ সালের ২৩ জানুয়ারি মুক্তি পেয়ে মানিক চৌধুরী অবার ৯ ডিসেম্বরে গ্রেপ্তার হন চট্টগ্রামের বাসা থেকে। পরে জানা গেছে, কয়েকদিন চট্টগ্রাম কারাগারে রাখার পর ঢাকার রাজারবাগে নিয়ে গিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ৬৯ এর গণঅভুত্থানের সময় মুক্তি পাওয়ার কয়েকমাস পর আবারও তিনি গ্রেপ্তার হন এবং ৭০ এর শেষ দিকে মুক্তি পান। নিউ এজেন্সির টাকা গােপন আন্দোলনে। মানিক চৌধুরীর ছেলে দীপঙ্কর চৌধুরী ও সহযােগী বিধান সেনের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, ষাটের দশকের প্রথম দিক থেকে দ্বিতীয়ার্ধ পর্যন্ত মানিক চৌধুরী, এমএ আজিজ ও বঙ্গবন্ধুর যৌথ পরিচালনায় খাতুনগঞ্জের আছদগঞ্জ এলাকায় ‘নিউ এজেন্সি’ নামে একটি ক্লিয়ারিং ফরওয়ার্ডিং ও ইনডেনটিং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছিল । এটির দেখাশােনার মূল দায়িত্বে ছিলেন মানিক চৌধুরী। প্রতিষ্ঠানের আয়ের সিংহ ভাগই খরচ হতাে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কাজে। একটা অংশ গােপনে যেতে সশস্ত্র আন্দোলনের প্রস্তুতিমূলক কাজে জড়িতদের কাছে।
বিধান সেনের মতে, স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র প্রস্তুতির গােপন পরিকল্পনার ব্যাপারটি চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে সম্ভবত মানিক চৌধুরীকেই প্রথম জানান বঙ্গবন্ধু। আর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বিধান সেনের পরিচয় এবং ঘনিষ্ঠতাও তৈরি হয় মানিক চৌধুরীর মাধ্যমে। আগরতলা মামলার আরও একাধিক আসামি গােপন বিপ্লবী আন্দোলন প্রক্রিয়ায় মানিক চৌধুরীর সম্পৃক্ততা এবং তাঁর মাধ্যমে সংগঠনের জন্য অর্থ পাওয়ার বিষয়টি এ লেখককে জানিয়েছেন। সবিতা চৌধুরী ও ছেলে দীপঙ্কর চৌধুরী জানান, তারা জেনেছেন যে, ‘৭১ সালের মার্চে মুজিব-ভূট্টো আলােচনার সময় অন্যদের সঙ্গে মানিক চৌধুরীও কয়েকবার বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলেন। তাজউদ্দিন আহমদই তাকে তখন ফোনে ঢাকায় ডেকে পাঠান। স্বাধীনতাযুদ্ধে ভারতের সঙ্গে যােগাযােগ ও মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনের কাজে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন মানিক চৌধুরী ।

সূত্র : আগরতলা মামলার অপ্রকাশিত জবানবন্দী – মুহাম্মদ শামসুল হক