অর্থ পেতাম মানিক চৌধুরীর কাছ থেকে – সুলতান উদ্দিন আহমদ
পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য প্রথম দিকে যে ক’জন নৌসেনা গােপন প্রক্রিয়া শুরু করেন তাঁদের একজন গাজিপুর জেলার কাপাশিয়া উপজেলার উত্তর খামার গ্রামের প্রয়াত শামসুদ্দিন আহমদের ষষ্ঠ ছেলে সুলতান উদ্দিন আহমদ। তিনি কথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ৪ নম্বর আসামি। ১৯৯৩ সালের ১৫ জানুয়ারি তিনি মারা যান। তাঁর সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য ২০০৭ সালের ১৩ মার্চ তাঁর ঢাকার মানিক মিয়া অ্যাভেনিউর কাছে মনিপুরি পাড়ার বাসায় গিয়ে তার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলি। কিন্তু তার (স্ত্রীর) সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, স্বামীর কর্মতৎপরতা সম্পর্কে তার তেমন কোনাে ধারণা নেই। তবে সুলতান উদ্দিনের ছােট ভাই সত্তরের দশকের ছাত্রলীগ নেতা ও স্বাধীনতা পরবর্তী জাসদের ঢাকা নগর কমিটির সদস্য কামাল উদ্দিনের কাছ থেকে জানা যায় বেশ কিছু তথ্য। তিনি জানান, আগরতলা মামলায় গ্রেপ্তার হওয়ার আগে পর্যন্ত সুলতান তার কর্মকাণ্ড সম্পর্কে পরিবারের কাউকে কোনাে কিছু বলেননি। কিন্তু চাকরি চলাকালে বিশেষ করে ষাটের দশকের গােড়ার দিক থেকে ঘন ঘন করাচি থেকে ঢাকায় আসা, ক্যাপ্টেন নূর মােহাম্মদ বাবুল, স্টুয়ার্ড মুজিব ও কামাল উদ্দিন প্রমুখের সঙ্গে একান্তে বৈঠক, তাদের নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় সন্দেহজনক ঘােরাফেরা ইত্যাদি দেখে মনে হয়েছে তিনি বা তারা এমন কিছু কাজের সঙ্গে জড়িত যা অন্যকে জানাতে চান না। আগরতলা মামলা থেকে মুক্তির পরও এ ব্যাপারে তেমন কিছু বলতে চাননি সুলতান।
তবে মৃত্যুর কিছুদিন আগে তাঁকে দেখতে আসা প্রয়াত জাসদ নেতা কাজী আরেফ আহমদ, আসম আবদুর রবের সঙ্গে স্মৃতিচারণ করার সময় কামাল উদ্দিন তাদের বিপ্লবী তৎপরতা সম্পর্কে কিছু কথা শুনেছেন। এ ছাড়া মৃত্যুর আগে ভারতের টাটা মেমােরিয়াল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সুলতান উদ্দিন চিকিৎসা খরচ নিয়ে আলাপকালে চট্টগ্রামের মানিক (চৌধুরী ভূপতিভূষণ চৌধুরী) সম্পর্কে কিছু কথা বলেছিলেন। কামাল উদ্দিন বলেন, “সুলতান ভাই নৌবাহিনীতে যােগ দিয়ে আমেরিকা যাতায়াত এবং পরে বাংলাদেশে আসা-যাওয়ার সময় তার মাঝে উন্নত জীবন-যাপনের একটা মানসিকতা দেখতে পাই। আব্বাও ভাল চাকরি করতেন। কিন্তু শেষ দিকে আমাদের আর্থিক অবস্থা ভাল যায়নি। এ অবস্থায় সুলতান ভাইকে চিকিৎসার জন্য ভারতের মুম্বাই এ টাটা মেমােরিয়াল হাসপাতালে নিয়ে যাই। কিন্তু তিনি এত টাকা খরচ করে অপারেশন করাতে রাজি হচ্ছিলেন না। অনেক অনুনয় করে রাজি করানাের পর তিনি ওই রাতেই আমাকে বললেন, “তােমাকে আমি অনেক টাকা দেব।’ মনে হলাে আমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্যই তিনি একথা বলছেন। তাই কৌতুহলী হয়ে জানতে চাই তুমি কোথেকে টাকা দেবে? বললেন, “তােমাকে একটা কথা জানিয়ে রাখি, কারণ মৃত্যুতে কালও হতে পারে। এই যে আমরা স্বাধীনতার জন্য গােপন আন্দোলনটা করেছিলাম তার জন্য যে অর্থের দরকার ছিল সেই অর্থ পেতাম মূলত চট্টগ্রামের এক আওয়ামী লীগ নেতা মানিক চৌধুরীর কাছ থেকে। চট্টগ্রামের একটি ঘরে আমাকে নিয়ে তিনি ভােল্টেজ ভর্তি টাকা দেখিয়ে তার একটা চাবি দিয়ে বলেছিলেন, “তােমাদের যত টাকা লাগবে তত টাকা এখান থেকে নিতে পারবে।’ সুলতান ভাই আরও বলেন, ‘মানিক চৌধুরীর সঙ্গে শেখ সাহেবের ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ ছিল।
তিনি এখন বেঁচে আছেন কিনা জানি না। বেঁচে থাকলে আমি তােমাকে ওনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব।’ ছােট ভাই হিসেবে নিজের পর্যবেক্ষণ এবং সংশ্লিষ্টদের উদ্ধৃত্তি দিয়ে কামাল উদ্দিনের দেওয়া তথ্যে জানা যায়, সুলতান উদ্দিন ১৯৫৪-৫৫ সালে নন কমিশন অফিসার হিসেবে পাকিস্তান নৌবাহিনীতে যােগ দেন। করাচিতে চাকরিরত অবস্থায় পাকিস্তানিদের আচারব্যবহার ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি মুক্তির পথ খোঁজেন। প্রায় একই সময়ে সুলতানের ভগ্নিপতি কামাল উদ্দিন (প্রথমে রাজসাক্ষী ও পরে বৈরী সাক্ষী) পাকিস্তান বাহিনীতে চাকরি করতেন। তিনিও ছিলেন একই রকম ভুক্তভােগী ও বিক্ষুব্ধ। এক পর্যায়ে তারা লে. কমাণ্ডার মােয়াজ্জেম হােসেনের নেতৃত্বে পাকিস্তানিদের অন্যায় অবিচার থেকে বাঁচার উপায় খুঁজতে গােপন শলাপরামর্শ করে সংগঠিত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সম্ভবত ৬২-৬৩ সালের দিকে সুলতান উদ্দিনের সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমান কামাল উদ্দিনের বাসায় যান। সেখানে লে. মােয়াজ্জেম, নূর মােহাম্মদ, স্টুয়ার্ড মুজিবুর রহমান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু, সিএসপি অফিসার খান শামসুর রহমান, আহমদ ফজলুর রহমানসহ অনেকের সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় বৈঠকে সুলতান উদ্দিন উপস্থিত ছিলেন। তিনি প্রথম দিক থেকেই প্রায় সপ্তাহে প্রতি রােববার ছুটির দিন ঢাকা আসতেন। কিন্তু ওই সময়ে ঘরে কিংবা আত্মীয় স্বজনের কাছে গিয়ে না থেকে বাইরের কিছু লােককে নিয়ে অজ্ঞাত স্থানে ঘুরে বেড়াতেন। আগরতলা মামলা সৃষ্টি হলে কামাল বুঝতে পারেন। তিনি (সুলতান) ওইসব ব্যক্তিকে নিয়ে গােপন আন্দোলনের জন্য প্রস্তুতিমূলক কাজ করছিলেন।
কামাল উদ্দিন স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘১৯৯২ সালের অক্টোবর-নভেম্বরে তৎকালীন জাসদ নেতা কাজী আরেফ আহমদ ও আসম আবদুর রব অসুস্থ সুলতান ভাইকে দেখতে আসেন। তখন আরেফ ভাই আবেগপ্রবণ হয়ে অতীতের কিছু স্মৃতিচারণ করে বলেছিলেন, তিনি সুলতান ভাই এবং নূর মােহাম্মদ বাবুলকে ৬২ সাল থেকে চিনতেন এবং তারা যে। স্বাধীনতার লক্ষ্যে কিছু একটা করতে যাচ্ছেন যে বিষয়ে জানতেন। আরেফ ভাই বলেছিলেন, স্বাধীনতার জন্য কি কি করতে হবে, কোন কোন দেশের সঙ্গে কী রকম সম্পর্ক করা যায়, কোথায় কার সহযােগিতা পাওয়া যাবে এসব কিছু প্রায় ঠিক হয়ে গিয়েছিল। এসব নিয়ে বঙ্গবন্ধু ছাত্রনেতাদের মধ্যে সিরাজুল আলম খান, আরেফ ভাই এবং রাজ্জাক ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলতেন। স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস গঠনে তারাই মূল ভূমিকা পালন করেন।
বঙ্গবন্ধুর অনুমতি নিয়ে তারা স্বাধীনতার জন্য গােপন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতেন। আমি বিদ্যালয়ে সপ্তম-অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময় থেকে নূর মােহাম্মদ, স্টুয়ার্ড মুজিবসহ। কয়েকজনকে আমাদের মনিপুরী পাড়ার বাসায় আসতে দেখেছি। মনিপুরী পাড়া তখন। ছােট একটি গ্রামের মতাে ছিল। একদিন সুলতান ভাই আমাকে নিয়ে ঢাকা থেকে জয়দেবপুর যান। সেখানে রাজবাড়িতে অবস্থিত একটি সেনা ক্যাম্পে (বেঙ্গল রেজিমেন্টের) কয়েকজন সেনা সদস্যের সঙ্গে তাকে কথা বলতে দেখেছি। তখন আমি পঞ্চম কি ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র। অতকিছু বােঝার বয়স হয়নি। ১৯৬৮ সালের প্রথম দিকে সুলতান ভাই একদিন বললেন, কিছু বিলাই চিমটি সংগ্রহ করে দেওয়ার জন্য। তার সঙ্গে নূর মােহাম্মদ ও স্টুয়ার্ড মুজিবও ছিলেন। তাদের খুবই ব্যস্ত ও বিচলিত দেখাচ্ছিল। ওই রাতে কি পরের দিন রাতে তারা চট্টগ্রাম যান এবং দু-একদিনের মধ্যে ঢাকা ফিরে আসেন। রাতে সুলতান ভাই মগবাজার অয়্যারলেস গেট এলাকায় অবস্থিত দুলাভাই কামাল উদ্দিনের বাসায় ছিলেন। সেখান থেকেই দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তখন আমি মােহাম্মদপুর উচ্চবিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছাত্র। গ্রেপ্তারের পর তাদেরকে কোথায় নেওয়া হয় জানতাম না। পরে জেনেছি তারা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাদের ওপর চরম অমানুষিক নির্যাতন করা হয়েছিল।’
সূত্র : আগরতলা মামলার অপ্রকাশিত জবানবন্দী – মুহাম্মদ শামসুল হক