৬৯ থেকে রাজনীতিতে নতুন মােড়
১৯৭০ সালে তৎকালীন পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের পর পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি শুরু করে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবকে দেশের ভাবী প্রধানমন্ত্রী ঘােষণার পরও পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুটোর পরামর্শে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘােষণা করেন। এতে অতি সাধারণ বাঙালিরাও বুঝে নেন যে, পাকিস্তানিদের সঙ্গে একই পতাকাতলে আর বসবাস করা সম্ভব হবে না। বঙ্গবন্ধুর পরামর্শক্রমে স্বাধীনতাকামী রাজনৈতিক ও ছাত্রনেতৃবৃন্দ জনগণকে সাথে নিয়ে ছয়দফা ও ১১ দফার ভিত্তিতে রাজপথে নেমে স্বাধীনতার প্রতি প্রকাশ্য ইঙ্গিতসহ নানা স্লোগান নিয়ে মাঠে নামেন। চারদিকে রব উঠতে থাকে ‘পিন্ডি না ঢাকা-ঢাকা ঢাকা’ ‘তােমার আমার ঠিকানা- পদ্মা মেঘনা যমুনা, তােমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব শেখ মুজিব।’
যতই দিন যাচ্ছিল ততই বঙ্গবন্ধুর একচ্ছত্র নেতৃত্বের প্রতি স্বাধীনতার জন্য আগ্রহী অন্য প্রায় সব দলের নেতৃবৃন্দ এমনকি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির প্রধান মজলুম জননেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীও সমর্থন জানান। অন্যদিকে কেউ পূর্ব বাংলা স্বাধীন করাে’, কেউ পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন করাে, আর কেউ ‘স্বাধীন সার্বভৌম গণবাংলা কায়েম করাে’ ইত্যাদি ভাসা ভাসা স্লোগান উপস্থাপন করতে থাকে বিভিন্ন প্রচার পত্রের মাধ্যমে। তবে ওই সব রাজনৈতিক দল বা সংগঠন ৭১ এর মার্চের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত বাংলাদেশ’ বা ‘স্বাধীন বাংলাদেশ, শব্দ উচ্চারণ করেননি। এক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু ছিলেন এগিয়ে। তার প্রমাণ মেলে ১৯৬৯ সালের ডিসেম্বরে তাঁর পূর্ব পাকিস্তানের নাম বাংলাদেশ’ ঘােষণার মধ্য দিয়ে। ১৯৬৯ এর ৫ ডিসেম্বর হােসেন শহীদ। সােহরাওয়ার্দীর মৃত্যু দিবসের এক আলােচনা সভায় শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, “এক সময় এদেশের বুক হইতে মানচিত্রের পৃষ্ঠা হইতে ‘বাংলা’ কথাটির শেষ চিহ্নটুকুও মুছিয়া ফেলার চেষ্টা করা হইয়াছে,… একমাত্র বঙ্গোপসাগর ছাড়া আর কোন কিছুর নামের সঙ্গে ‘বাংলা’ কথাটির অস্তিত্ব খুঁজিয়া পাওয়া যায় নাই। আমি ঘােষণা করিতেছি আজ হইতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম হইবে পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে শুধুমাত্র বাংলাদেশ’। সে সময় থেকে স্বাধীনতাপন্থীদের স্লোগান ছিল ‘জয় বাংলা’, ‘আমার দেশ তােমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ’।
মাওলানা ভাসানী প্রথম থেকে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্বশাসনের পক্ষে মাঝে মধ্যে কথা বললেও পূর্ণ স্বাধীনতার ব্যাপারে ছিলেন দোদুল্যমান। ১৯৬৩ সালে তিনি আইউব খান সরকারের প্রতিনিধি হয়ে চীন সফর করে আসার পর থেকে চীনের পরামর্শে পাকিস্তান সরকারকে “ডিস্টার্ব’ না করার নীতি গ্রহণ করেন। তাঁর দল ন্যাপ ছয় দফাকে সিআইএ-এর দলিল হিসেবে আখ্যায়িত করে। ১৯৬৮ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলে পিকিংপন্থি বা কাউন্সিলপন্থি ন্যাপের দু’দিনব্যাপী দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে মাওলানা ভাসানী পুনরায় সভাপতি নির্বাচিত হন। সেখানে তিনি স্বাধীন বাংলা’ আন্দোলনের বিরুদ্ধে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন। ওই সময়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার ষড়যন্ত্রের অভিযােগে শেখ মুজিবসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ এবং সামরিক বাহিনীর অনেকে জেলে আটক ছিলেন। অবশ্য ‘৬৯ এর প্রথমদিকে জেলখানা থেকে বঙ্গবন্ধুর অনুরােধক্রমে মাওলানা ভাসানী শেখ মুজিবসহ রাজবন্দীদের মুক্তির দাবিতে সভা-সমাবেশ শুরু করেন। একাত্তরের ৭ মার্চের পর থেকে তিনি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতার ব্যাপারে আশাব্যঞ্জক কথাবার্তা বলতে থাকেন, যদিও বাংলাদেশ’ শব্দটি ব্যবহার তার অজ্ঞাত কারণে আপত্তি ছিল। ৯ মার্চ তিনি পল্টন ময়দানে এক জনসভায় খােলামেলা ঘােষণা করেন সাত কোটি বাঙালির মুক্তি ও স্বাধীনতা সংগ্রামকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না।
তিনি ঘােষণা করেন সাত কোটি বাঙালিকে ২৫ মার্চের মধ্যে স্বাধীনতা দানের দাবি মেনে না নিলে তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে এক হয়ে বাঙালির স্বাধীনতার জন্য সর্বাত্মক সংগ্রাম শুরু করবেন। তিনি ইয়াহিয়া খানের প্রতি আহ্বান জানান পাকিস্তানকে ভাগ করে দুটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠনের জন্য। তিনি বলেন, ‘আমার তিনটি ছেলে, তার মধ্যে শেখ মুজিব একটি।’ তিনি আশা করেন শিগগিরই পূর্ব পাকিস্তান’ বা ‘পূর্ব বাংলা স্বাধীন হবে। ওই জনসভায়ই মাওলানা ভাসানী ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে শেখ মুজিবের আপসের আশঙ্কা নাকচ করে দিয়ে তার ওপর (শেখ মুজিবের ওপর) আস্থা রাখার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, আপনারা তাকে অবিশ্বাস করবেন না। আমি তাকে ভালাে করে চিনি। ইতিহাস প্রমাণ করে তৎকালীন বামপন্থী রাজনৈতিক দল এবং প্রগতিশীল বলে দাবিদার কতিপয় সংগঠন বাঙালির স্বাধিকার ও তাদের আশা আকাঙ্ক্ষার ব্যাপারে গুঞ্জরিত বাসনার কথা বুঝতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে ৭০-এর দশকের শুরু থেকে তাদের রাজনৈতিক গুরুত্ব ক্রমেই লােপ পেতে থাকে। এক্ষেত্রে জনগণের কাছে বঙ্গবন্ধুই হয়ে ওঠেন বাঙালির আকাক্সক্ষা পূরণের একমাত্র যােগ্যতম প্রতিনিধি, সে সাথে তার দল আওয়ামী লীগ। সে সময়কার আন্দোলনে নিজেদের ভূমিকা যে ভুল ছিল সে সম্পর্কে তৎকালীন ভাসানী। ন্যাপের অন্যতম নেতা (পরবর্তীতে বিএনপি মহাসচিব ও মন্ত্রী) প্রয়াত আবদুল মান্নান ভূঁইয়া লিখেছেন, ‘ষাটের দশকের বিভিন আন্দোলনের মধ্যদিয়ে কৃষক-শ্রমিক মধ্যবিত্ত নতুন শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণের মধ্যদিয়ে ৬৯-এ গণঅভ্যুত্থান ঘটে। এসব আন্দোলনে প্রগতিশীলদের ভূমিকা কাজ করেছে নিয়ামক হিসেবে। তাদের ভূমিকা ছিল ব্যাপক। কিন্তু বামপন্থীদের কোনাে কোনাে অংশের ভুলের কারণে পরিস্থিতি ভিন্নখাতে মােড় নেয়। রাজনৈতিকভাবে স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রবক্তা হয়েও বামপন্থীরা ছয় দফার প্রতি নেতিবাচক। মনােভাব পােষণ করায় এবং সত্তরের নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকায় রাজনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়ে।
জনগণের সমকালীন দাবির প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে কেউ কেউ শ্রেণী সংগ্রামের রাজনীতি অব্যাহত রাখে। ফলে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এগিয়ে যায় আওয়ামী লীগ এবং ৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা। লাভ করে। প্রতিষ্ঠিত হয় তাদের একক নেতৃত্ব। এরপর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কাছে। ক্ষমতা হস্তান্তরে পাকিস্তানিদের অনীহা ও চক্রান্ত একাত্তরের সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধকে অনিবার্য করে তােলে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রতি বিভিন্ন রাজনৈতিক ও পেশাজীবী সংগঠনের নেতৃবৃন্দও আস্থাশীল। হয়ে ওঠেন সম্ভাব্য বিকল্প নেতৃত্বের কোনাে সন্ধান না পেয়ে। ৯ মার্চ পল্টনের জনসভায় জাতীয় লীগ প্রধান (যুক্তফ্রন্ট সরকারের আমলে মুখ্যমন্ত্রী ‘৫৬-৫৮, এবং এরশাদ সরকারের প্রধানমন্ত্রী, ৮৫-৮৬) খান আতাউর রহমান কাল বিলম্ব না করে বাংলার জাতীয় সরকার গঠনের জন্য আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবর রহমানের প্রতি আহ্বান জানান। ১১ মার্চ সিএসপি ও ইপিসিএস সমিতির পদস্থ বাঙালি সরকারি কর্মচারীরা শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে অসহযােগ আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানান এবং আওয়ামী লীগের তহবিলে একদিনের বেতন দান করেন। ১৫ মার্চ বায়তুল মােকাররমে স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে আয়ােজিত এক জনসভায় আসম আবদুর রব (পরবর্তীতে জাসদ নেতা) ঘােষণা করেন বাংলাদেশ আজ স্বাধীন, আমাদের ওপর সামরিক বিধি জারি করার ক্ষমতা কারাে নেই। বাংলাদেশের জনগণ একমাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নির্দেশই মেনে চলবে।’
আবদুল কুদুস মাখন বলেন, ‘বাংলাদেশে যদি কোনাে আইন জারি করতে হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানই তা করবেন।’৩ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় শিক্ষক সমিতির উদ্যোগে ড. মােজাফফর আহমদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে এক প্রতিবাদ সভায় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রতি পূর্ণ আস্থা জানিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে জনতার সঙ্গে একাত্মতা ঘােষণা করা হয়। ‘৭১ এর মার্চে সারাদেশে (বাংলাদেশে) প্রশাসন, ব্যাংক, বীমা, ডাক, তার বিভাগ, কোর্ট কাচারি, রেডিও টেলিভিশন সবকিছুই কেবলমাত্র বঙ্গবন্ধুর নির্দেশক্রমে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে এবং তার অগ্রগামী সংগঠন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের প্রত্যক্ষ সহযােগিতায় চলতে থাকে। এ অবস্থায় ভুট্টো-ইয়াহিয়া-সামরিক চক্রের মাথা ঘুরে যায়। দেশব্যাপী স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের প্রশিক্ষণসহ বিন্নি কৌশলে যুদ্ধ প্রস্তুতির কথাও কারাে জানতে বাকি রইল না। এরই মধ্যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ও বঙ্গবন্ধুর মধ্যকার আলােচনায় ইতিবাচক ফলাফল না দেখে দেশের ছাত্র ও অন্যান্য রাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধুর প্রতি সরাসরি স্বাধীনতা ঘােষণার জন্য আহ্বান জানাতে থাকেন।
২১ মার্চ চট্টগ্রামে এক জনসভায় মাওলানা ভাসানী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার প্রতি আহ্বান জানান শেখ মুজিবের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের জন্যে। মাওলানা ভাসানী বলেন, শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করলে বিশ্বের স্বাধীনতাপ্রিয় জাতি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে। লক্ষণীয়, মাওলানা ভাসানী এই প্রথম বাংলাদেশের স্বাধীনতা’ কথাটি বললেন। ২৩ মার্চ ছিল পাকিস্তান দিবস। ওইদিন পাকিস্তানের জাতীয় পতাকার বদলে সারা বাংলায় ওড়ানাে হয় স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ নির্ধারিত বাংলাদেশের নতুন জাতীয় পতাকা। ওইদিন পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত জয়বাংলা বাহিনীর কুচকাওয়াজে অভিবাদন গ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধুর চার-খলিফা খ্যাত নূরে আলম সিদ্দিকী, শাহজাহান সিরাজ, আসম আবদুর রব ও আবদুল কুদুস মাখন। সেই কুচকাওয়াজে জাতীয় সংগীত হিসেবে বাজানাে হয় “আমার সােনার বাংলা আমি তােমায় ভালবাসি।’ কুচকাওয়াজ শেষে মার্চপাটি করে জয়বাংলা বাহিনীর সদস্যরা বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে গেলে তিনি রক্ত দিয়ে বাঙালিদের অধিকার আদায়ে তার দৃঢ় সংকল্পের কথা ঘােষণা করেন। তার বাসভবনেও সেদিন টাঙিয়ে দেওয়া হয় নতুন জাতীয় পতাকা। এভাবে ইতিহাস পর্যালােচনায় দেখা যায়, ষাটের দশকের আগে থেকেই পাকিস্তানি শাসক গােষ্ঠীর শােষণ-বঞ্চনা ও বৈষম্যের অবসানের জন্য শেখ মুজিব স্বাধীনতাকে লক্ষ্য করে তার সমস্ত কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছেন। আর এ লক্ষ্য পূরণে সামরিক-বেসামরিক সব পর্যায়ে জেগে ওঠা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ও বিচ্ছিন্ন শক্তি ও সংগঠনগুলােকে একই কাতারে সামিল করতে পেরেছিলেন। আর সংগ্রামে অবিচল থাকার অঙ্গীকার বজায় রাখার মধ্য দিয়ে তৎকালীন নবীন প্রবীণ সব নেতাকে ডিঙিয়ে একচ্ছত্র অধিপতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত তার অনুপস্থিতিতেও তার নামে পরিচালিত হয় ‘৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধ।
সূত্র : আগরতলা মামলার অপ্রকাশিত জবানবন্দী – মুহাম্মদ শামসুল হক