You dont have javascript enabled! Please enable it! 1972 | ১ টাকার নোট নিয়ে তাজউদ্দীনের বিরুদ্ধে চক্রান্ত - সংগ্রামের নোটবুক

১ টাকার নোট নিয়ে তাজউদ্দীনের বিরুদ্ধে চক্রান্ত

নােট ছাপাবার ব্যাপারেও তাজউদ্দীন সাহেব কোনদিনও কোন দেশের পক্ষে সুপারিশ করেননি। আমরা টেন্ডার কল করতাম, সবচাইতে কম দর যারা দিত তাদেরকেই কাজ করতে দেয়া হত। বেশির ভাগ সময় ইংল্যান্ডের একটি কোম্পানি ছিল, ওরাই সর্বনিম্ন দরে কাজটি পেত। এদিকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের ঠিক আগে বা সেই সময় পাকিস্তান তাদের এক টাকার নােট বাজেয়াপ্ত করে উঠিয়ে নেবে শােনা যাচ্ছিল। বাংলাদেশ সরকার তখন ভারতের সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেসে এক টাকার নােটে ৬০/৭০ কোটি টাকা ছাপাতে দিয়েছিলেন। সেই টাকার নােট আমরা পেলাম বাংলাদেশ হবার কয়েক মাস পর। আমরা তখন সিদ্ধান্ত নিলাম বাংলাদেশী নােটটা আমরা আস্তে আস্তে ছাড়ব। এই নােটটিতে মুক্তিযুদ্ধকালের অর্থ সচিব খন্দকার আসাদুজ্জামানের স্বাক্ষর মুদ্রিত ছিল। আমরা দুই মাস সময় দিলাম পাকিস্তানি নােট তুলে নেবার জন্য। এর কিছুদিনের মধ্যেই বাজারে প্রচণ্ড গুজব শুরু হল, ভারতের সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেসে এক টাকার নােট ছাপানাে হয়েছে আমাদের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দেবার জন্য। ভারত ডুপ্লিকেট নােট ছাড়ছে বাজারে এবং কোটি কোটি টাকা সরিয়ে নিচ্ছে। এটা এখনই বন্ধ করতে হবে। খবরের কাগজেও এই ধরনের কথাবার্তা উঠতে শুরু করল। একদিন একটি কাগজে একই নম্বরের দুটো নােট পাশাপাশি ছাপল। তাজউদ্দিন সাহেব কাগজটি আমাকে দেখালেন। আমি বললাম, “দেখুন, একই নােটের ছবি দু’বার ছাপালে তাে নম্বর একই উঠবে।’ তিনি তখন বললেন, ‘এই বিষয়ে কী করা যায় ? আমি বললাম, আপনি দেশের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। এই বিষয়টি নিয়ে যেহেতু আপনার বিব্রতকর অবস্থা হচ্ছে তাই আমরা ভারতে। ছাপানাে এই টাকাটা উঠিয়ে নেব। ইতােমধ্যে লন্ডন থেকে এক টাকার নােট ছাপা হয়ে এসেছে, তাই আমরা অর্ডার ইস্যু করে দিলাম, নতুন নােট ছাড়া হবে এবং আগামী দু’মাস সময়ে ভারতে ছাপানাে নােট তুলে নেয়া হবে। যেইমাত্র এই অর্ডারটি ইস্যু করা হল অমনি আবার বাজারে হৈচৈ যে, এই তাে দু’মাস সময় দেয়া হল, এই দু’মাসেই ভারত থেকে কোটি কোটি টাকা চলে আসবে। ওখানে এক টাকার নােট প্রিন্ট তাে হচ্ছেই! আরাে কত কী কথাবার্তা। আমি এই গুজবে তেমন একটা গুরুত্ব দিচ্ছিলাম না, কারণ আমি তাে জানি এসব কথা সত্য নয়। কিন্তু এইসব গুজব, কথাবার্তা এমন অবস্থায় এল যে তাজউদ্দীন সাহেব একটা বিবৃতি দিলেন। তিনি বললেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের জানা আছে আমরা কত কোটি টাকার এক টাকার নােট বাজারে ছেড়েছি। আমি নিশ্চয়তা দিচ্ছি, সম্পূর্ণ টাকা বাজার থেকে তুলে নেবার পর যদি এক টাকাও বেশি আমরা পাই, তবে আমি পদত্যাগ করব। এই বিবৃতি তিনি সংসদে দিলেন, না বাইরে দিলেন সেটা আমার ঠিক খেয়াল নেই। যাই হােক, এই বিবৃতির পর সব দিক ঠাণ্ডা হল। এদিকে যখন আর মাত্র দিন দশেক বাকি আছে দু’মাসের, তখন প্রধানমন্ত্রী আমাকে ডাকলেন। বললেন, ‘বর্ডার এলাকা থেকে আমার কাছে কর্মীরা আসছে, তারা বলছে কোটি কোটি টাকার নােট নাকি ইন্ডিয়া থেকে বর্ডার দিয়ে ভেতরে আসছে। এটা তাে এখনই বন্ধ করতে হবে।’ প্রধানমন্ত্রীর সাথে আমার সম্পর্ক ছিল খুবই আন্তরিক। তাই আমি বলেই ফেললাম, স্যার, যারা আপনাকে এইসব বলছে তাদেরকে আপনি জিজ্ঞাসা করেন তারা কি তাদের জীবনে এক টাকার নােটে এক কোটি টাকা দেখেছে ? কারণ, স্যার, আমার চাকরিজীবনের এক সময়ে আমি মুন্সিগঞ্জে ট্রেজারি অফিসার ছিলাম। সেখানে আমাদের একটি স্ট্রং রুম ছিল, বাক্সভর্তি টাকা থাকত ১, ৫, ১০, ৫০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত। স্ট্রং রুমটি যে পরিমাণ বড় ছিল তাতেও কিন্তু ৪০/৫০ লক্ষ টাকার বেশি জায়গা হত না। স্ট্যাক করে টাকা রাখা হত, স্ট্যাক ধরে টাকা গুনতে হত, টাকা গুনে শেষ করা যেত না। মুন্সিগঞ্জের সাব ট্রেজারির সিলিং ছিল ৪০/৫০ লক্ষ টাকা। সেখানে সব ধরনের নােট ছিল, কিন্তু তাতেও স্ট্রং রুমে গাদাগাদি অবস্থা ছিল। আর আপনি বলছেন ওরা বলছে এক টাকার নােট আসছে কোটি কোটি টাকার ? তাই, স্যার, আমি বলছি ওরা কি জীবনে দেখেছে এক টাকার নােটে কোটি টাকা ? প্রধানমন্ত্রী বললেন, “তুমি কী বল? আমি বললাম, আমরা যা করেছি তা সঠিক। আর দশ দিন বাকি আছে, সময়কে এগিয়ে যেতে দিন।’ তারপর দশ দিন শেষ হল। বাংলাদেশ ব্যাংক জমা হওয়া টাকার হিসাব দিল । সেখানে মােট ছাপানাে টাকার চাইতে জমা পড়েছে কম টাকা। তাজউদ্দীন সাহেবের বিরুদ্ধে অভিযােগ মিথ্যা বলে প্রমাণিত হল। আমি এই ক্ষেত্রে একটি জিনিস লক্ষ্য করেছি, অন্য যে কেউ হলে হয়ত হুজুগে কান দিত বা নানা রকম প্রতিক্রিয়া দেখাত। কিন্তু তাজউদ্দীন সাহেব একদম শান্ত ছিলেন, ভীষণ শান্ত। কোন সময় কোন উচ্চবাচ্য করেননি। আমি আমার সম্পূর্ণ সমর্থন তাঁকে দিয়েছি। এদিকে এই সময়টায় ভারতের পার্লামেন্টে বাংলাদেশের এই নােট ছাপানাে নিয়ে প্রশ্ন ওঠে যে, ব্যাপারটা কী, আমরা নােট ছাপিয়ে কি অন্যায় করেছি, ইত্যাদি।ওই সময়টাতেই আমি দিল্লী গেলাম অর্থ সচিবদের একটা বৈঠকে। ভারতের অর্থ সচিব এম. জি. কাউল আমার কাছে জানতে চাইলেন এই বিষয়ের ব্যাপারে। আমি তাকে বিষয়টি জানালাম। সেইসাথে এটার যে সমাধান বা নিষ্পত্তি হয়ে গেছে তাও বললাম। এই ঘটনাগুলাে যে সম্পূর্ণই হুজুগ ছিল সে সম্পর্কে ভারতের অর্থ সচিব একই মত প্রকাশ করলেন।

(১০..১৯৯৯)

মতিউল ইসলাম : সরকারি কর্মকর্তা, বাংলাদেশ সরকারের সাবেক অর্থ সচিব।

Reference: তাজউদ্দীন আহমদ – আলোকের অনন্তধারা