You dont have javascript enabled! Please enable it! 1973.12.24 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | বেসরকারি পুঁজি বিনিয়োগ | জাতির মুক্তির জন্যে চাই ন্যায়াদৰ্শ ও দেশপ্রেম | কাপড় থেকেও নেই | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকা: ২৪শে ডিসেম্বর, সোমবার, ৮ই পৌষ, ১৩৮০

বেসরকারি পুঁজি বিনিয়োগ

বাংলাদেশের বাতাসে নাকি টাকা উড়ছে। স্বাধীনতার পর যারা রাতারাতি টাকার পাহাড় গড়ে তুলেছেন, তাদের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ হলো, তারা পুঁজি বিনিয়োগের সুযোগ না পেয়ে পুঁজি পাচারে নিয়ত নিয়োজিত। দেশের শিল্প সম্ভাবনাকে সমৃদ্ধ করতে হলে তাই বেসরকারি বিনিয়োগের একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা চাই। বেসরকারি পুঁজির ক্ষেত্রে যদি অগ্রাধিকার না থাকে তাহলে পুঁজি পাচার বন্ধ না হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু পুঁজি যদি নানা ধরনের শিল্প প্রতিষ্ঠান গঠনের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজে লাগে কিংবা পুরনো শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর কাঁচামাল ও খুচরা যন্ত্রাংশের প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণে ব্যবহৃত হয়, তাহলে তা সার্বিকভাবে দেশের কল্যাণ সাধনে সক্ষম হবে বলেই আমাদের বিশ্বাস। শিল্প কারখানার সচল হলে উৎপাদন বাড়বে। বিপুল জনশক্তিকেও যথাযথভাবে কাজে লাগানো যাবে। কাজেই বেসরকারি পুঁজি বিনিয়োগ বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের দিনে আশীর্বাদ ছাড়া অভিশাপ বয়ে আনবে না- এ আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।
জানা গেল, গত পরশু শিল্প মন্ত্রণালয়ের এক উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ বৈঠকে বেসরকারি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অগ্রগতির পর্যালোচনা ছাড়াও কেমন করে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ ত্বরান্বিত করা যায়- আলাপ আলোচনা করে সে সম্পর্কে কতিপয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। শিল্পমন্ত্রী সৈয়দ নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে সচিবালয়ে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে যে, অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সব এলাকার জন্য সুষমভিত্তিতে অর্থ বরাদ্দ নিশ্চিত করবে এবং সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের সাহায্য করার জন্য বিস্তারিত নির্দেশাবলী প্রণয়ন করবে। ক্ষুদ্র ও গ্রামীণ শিল্পের বিকাশে কি কি সমস্যা রয়েছে, তা নির্ধারণ এবং এইসব শিল্পের সম্ভাবনাকে বাস্তবায়িত করার জন্য নাকি নিকট ভবিষ্যতে বৈঠক এবং সেমিনারের আয়োজন করা হবে। আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে বেসরকারি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কতটুকু অগ্রগতি সাধিত হলো, সে সম্পর্কেও নাকি অনেক পর্যালোচনা করে দেখা হবে। সিদ্ধান্তগুলো যে খুবই অভিনন্দনযোগ্য তাতে আমাদের দ্বিমত প্রকাশের অবকাশ নেই। আমরা বেসরকারি বিনিয়োগের ক্ষেত্রটি দিন দিন প্রশস্ত হোক, এটাই চাই। কারণ আমরা জানি বেসরকারি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অগ্রগতি সাধিত না হলে এদেশে নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে না, উৎপাদন বাড়বে না এবং দেশের ভয়াবহ বেকারত্বের দুঃসহ গ্লানিও অপনোদন হবে না। সে জন্যেই আমরা অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের তহবিল যাতে দ্রুত কাজে লাগানোর জন্য তৎপর হয়, সে জন্য দৃষ্টিপাত করার আহ্বান জানাচ্ছি। অনুন্নত এলাকাগুলোতে শিল্প সম্প্রসারণের সরকারি নীতি কতটুকু বাস্তবায়িত হলো আর কতটুকু হলো না, সেটাই সমস্যা সমাধানের পথ নয়। শিল্প সম্প্রসারণের বাস্তব এবং সক্রিয় উদ্যোগের প্রতি আমাদের সর্বাধিক আগ্রহ।
বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ বাড়ানোর কার্যকর ব্যবস্থার প্রতি আমরা মুখ ফিরিয়ে রাখতে পারি না। আগামী ফেব্রুয়ারিতে বেসরকারি খাতে পুঁজি লগ্নি অগ্রগতি সম্পর্কে আরো নতুন তথ্য পাবো। শিল্পে ব্যাপক পুঁজি বিনিয়োগের জন্য অগ্রাধিকার প্রাপ্ত শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে যদি ঋণদান সংস্থাগুলো যথাযথভাবে পুঁজি বিতরণে সক্ষম হয়, তাহলে দেশের সব অনুন্নত এলাকার শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো চাঙ্গা হয়ে উঠবে। কাঁচামাল এবং খুচরা যন্ত্রাংশের অভাবে যে সব শিল্প প্রতিষ্ঠানে অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে, পুঁজি বিনিয়োগের ফলে সেগুলোতেও উৎপাদনক্ষমতা স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে যাবে। এবং এমনি করেই, বেসরকারি পুঁজি বিনিয়োগ সাফল্যমন্ডিত হবে বলে আমরা মনে করি।

জাতির মুক্তির জন্যে চাই ন্যায়াদৰ্শ ও দেশপ্রেম

আমাদের রাষ্ট্রপতি জনাব আবু সাঈদ চৌধুরী গত পরশুদিন খুলনায় ইনস্টিটিউশন অব ইঞ্জিনিয়ার্স এর বার্ষিক সম্মেলনের উদ্বোধন করেছেন। রাষ্ট্রপতি তার মূল্যবান ভাষণের একাংশে উল্লেখ করেছেন যে, ক্ষুধা, নির্মম দারিদ্র্য, বেকারত্ব প্রভৃতির মূলোচ্ছেদের জন্য সবাইকে নৈতিক মূল্যবোধ ও কঠোর পরিশ্রমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। বিশেষ করে দেশের প্রকৌশলীদের প্রতি তিনি এ ব্যাপারে গভীর আস্থা প্রদর্শন করেছেন। শতাব্দীর অবহেলার ফলে আমাদের অনুন্নত এবং কৃষি নির্ভর অর্থনীতিতে সীমিত আবাদি জমির উপর দ্রুত বর্ধনশীল জনসংখ্যার যে চাপ ইতিমধ্যে নির্মম দারিদ্র্য ও বেকারত্ব সৃষ্টি করেছে রাষ্ট্রপতি সে কথাও উল্লেখ করেছেন। প্রথম পাঁচশালা পরিকল্পনায় কৃষি উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধিকে একদিকে যেমন অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে তেমনি অন্যদিকে বহু সমস্যা প্রপীড়িত জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তর করার উদ্দেশ্যে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সমাজকল্যাণকে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
এ কথা অনুধাবন করার আহ্বান জানিয়ে রাষ্ট্রপতি বলেছেন- আমাদের জনশক্তিকে তাই উৎপাদনশীল কর্মে নিয়োজিত করার জন্যে প্রয়োজনীয় কর্মপন্থার উদ্ভাবন করতে হবে। দেশের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্যে ন্যায়াদর্শ ও দেশপ্রেম নিয়ে কাজ করে যেতে হবে। দেশের প্রকৌশলীদেরকে এ ক্ষেত্রে অধিক প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। রাষ্ট্রপতি জনাব আবু সাঈদ চৌধুরী খুলনায় ইনস্টিটিউশন অব ইঞ্জিনিয়ার্স এর আঠারোতম সম্মেলনের উদ্বোধন করেছেন এবং খুলনায় একটি শাখারও তিনি ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেছেন। ভারতের দু’জন প্রতিনিধিসহ প্রায় চার’শ প্রতিনিধি এ সম্মেলনে যোগদান করেছিলেন।
আমাদের মাননীয় রাষ্ট্রপতি দেশের পুনর্গঠন ও অর্থনৈতিক মুক্তির আন্দোলনের সর্বাত্মক অংশ গ্রহণের জন্য সকল জনশক্তির বিশেষতঃ প্রকৌশলীদের নিয়োজিত হবার যে আহ্বান জানিয়েছেন তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ন্যায়াদর্শ ও দেশপ্রেম নিয়ে সবাইকে কাজ করে যাওয়ার তিনি যে ডাক দিয়েছেন তা সবিশেষ অর্থবহ। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে নানা সমস্যার পাহাড় জমে উঠেছে। দেশের প্রত্যেকটি খাতে ঘাটতি পূরণের সংগ্রাম। প্রতিটি বিধ্বস্ত বিষয়ে আজ নতুন করে গড়ে তোলার মহান দায়িত্ব তাদের উপর অর্পিত। এ কারণে দেশের সকল শ্রেণীর মানুষকে সততা, ন্যায় ও দেশপ্রেম নিয়ে দেশ গঠনের কাজে আত্মোৎসর্গ করতে হবে। এখানে মনে রাখা আমাদের প্রয়োজন যে, শুধু সরকারি যন্ত্রের উপর ভরসা করে জাতি দ্রুত অগ্রসর হতে পারেনা। দেশের গোটা জনশক্তিকে এ জন্যে কাজে লাগাতে হয়।
আমাদের প্রত্যেকটি দেশপ্রেমিক সংগঠনকে এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে প্রথম পাঁচশালা পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য সর্বাত্মক সহযোগিতার। গতিশীল পরিকল্পনায় দেশের প্রগতির যে ইঙ্গিত বহন করছে তাকে আরো দ্রুত বাস্তবায়নের মহান দায়িত্ব দেশপ্রমিক ছাত্র-যুবক শ্রমিক ও রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর। দেশের অগ্রসরতাকে যদি আমরা আমাদের নিষ্ঠা ও ত্যাগ দিয়ে দ্রুত বাস্তবায়নের দিকে ধাবিত করতে ব্যর্থ হই। তাহলে দেশের গোটা সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হয়ে নৈরাজ্যের সৃষ্টি হবে। একারণে দেশের সকল শ্রেণীর মানুষের দায়িত্ব আজ নির্ধারণ করা আবশ্যক- দেশের কল্যাণে সবাইকে ব্রতী হওয়া রাজনৈতিক কর্তব্য।

কাপড় থেকেও নেই

গত পরশুই বাংলার বাণীতে প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়েছে যে, অর্থ বরাদ্দের ব্যাপারে গড়িমসি করার দরুণ আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের আগে টিসিবির পক্ষে শীত বস্ত্র আমদানি করা সম্ভব হচ্ছেনা। এমন একটি আতঙ্কজনক সংবাদ প্রকাশিত হতে না হতেই গতকাল স্থানীয় আরেকটি দৈনিক পত্রিকায় যে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে তার মোদ্দা কথা হলো কাপড় গুদামে থেকেও নেই। গুদামের কাপড় ঈদের আগে জনসাধারণের হাতে পৌঁছার কোন সম্ভাবনা নেই। সংবাদে বলা হয়েছে, ভোগ্যপণ্য সরবরাহ সংস্থার অব্যবস্থা, একশ্রেণীর কর্মচারীর গাফিলতি ও কোন কোন ক্ষেত্রে দুর্নীতির ফলে আসন্ন ঈদুল আযহার আগে কাপড় না পাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সংবাদে আরো প্রকাশ, গত ২৬শে নভেম্বরের বিজ্ঞপ্তির পর শহরের ২শত ৪ জন ডিলার তাদের স্ব-স্ব কোটার জন্য ৪৬ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা জমা দিলেও অদ্যাবধি ভোগ্যপণ্য সরবরাহ সংস্থা তাদের কোটরে সম্পূর্ণ কাপড় প্রদান করেন নাই। কাপড় না দেবার কারণ কাপড় নাকি নেই। কাপড় নাই বলা হচ্ছে বটে অন্য দিকে সংশ্লিষ্ট মহল থেকে প্রশ্ন উঠেছে, বিভিন্ন সিলে তৈরী কাপড়গুলো যাচ্ছে কোথায়? এমনও অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে যে, ভোগ্যপণ্য সরবরাহ সংস্থা আমদানীকৃত বিদেশী শার্টিং কাপড় নাকি ডিলারদের মধ্যে বিতরণ না করে এক শ্রেণীর ‘রেডিমেড গার্মেন্টস’ কোম্পানিকে অদৃশ্য পথে দান করেছেন। অভিযোগ কতটুকু সত্য তা যাচাই করার অবকাশ এখানে নেই। তেমন রিপোর্ট বা তথ্য কোথাও প্রকাশিত হয়নি। তবু যে সব প্রশ্ন উঠেছে সেগুলো কি একেবারে উড়িয়ে দেয়ার মত? প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, এ ধরনের রিপোর্ট প্রকাশিত হলেই সংশ্লিষ্ট মহল থেকে প্রতিবাদ আসে। তারা একটা না একটা খোঁড়া যুক্তি খাড়া করেন। গত পরশু টিসিবির সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিবাদ এসেছে। কিন্তু গতকালই বাংলার বাণীতে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে যে, টিসিবির খামখেয়ালীতে খুলনায় বিদেশ থেকে আমদানি করা ১১ লক্ষ টাকার কাপড় পচে গেছে।
এর পর সংশ্লিষ্ট টিসিবি কি জবাব দেবেন তা আমরা জানিনা। গতকাল ভোগ্যপণ্য সরবরাহ সংস্থার গাফিলতি ও দুর্নীতি সংক্রান্ত সংবাদের জবাব কি হবে তাও আমরা জানি না। তবে আমরা বলবো বাংলাদেশের বুকে শত সহস্র সমস্যা ও সংকটের মধ্যে সরকারি আমলারা যদি গোদের উপর বিষ ফোঁড়ার সৃষ্টি করে জনসাধারণের জীবনকে বিষিয়ে তোলেন তাহলে তার পরিণতি খুব একটা শুভ হবে না। তাই সময় থাকতে যথাযথ ব্যবস্থা অবলম্বন করাটাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন