সীমান্তে বিপদ – আমরা কি প্রস্তুত?
দেখেশুনে মনে হচ্ছে দেশ আবার একটা জরুরি অবস্থার দিকে যাচ্ছে। বাঙলাদেশের মানুষের হাতে মার খেয়ে পাগলা কুকুরের মতাে পাকিস্তানি সামরিক চক্র ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বাঁধিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের তথাকথিত ঐক্য বজায় রাখবার মতলব ভাজছে। ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রীও হুশিয়ারি দিয়ে জানিয়েছেন, আমরা প্রস্তুত। কিন্তু সত্যিই আমরা প্রস্তুত কি? অন্তত এই পশ্চিমবঙ্গে?
খাস কলকাতায় নিষ্প্রদীপ আর বিমান আক্রমণ সংকেতের মহড়া হচ্ছে, অসামরিক প্রতিরক্ষার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারাও ঘনঘন বৈঠকে বসছেন-সবই ঠিক। কিন্তু জরুরি অবস্থার মােকাবিলা তাে শুধু সেনাবাহিনী আমলাতন্ত্র করে না, করে দেশের মানুষ। সর্বস্তরের, সর্বক্ষেত্রের মানুষ। সেই মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার কোনও ব্যবস্থা হয়েছে কি? হয়নি।
কী করে হবে? বাজারে সব কিছু অগ্নিমূল্য এবং মজুতদার মুনাফাখােররা বহাল তবিয়তে সাধারণ মানুষের গলা কাটছে। একচেটিয়া পুঁজির শিরােমনি বিড়ালারা সরকারি পদাঙ্ক অনুসরণ করে কেশােরাম রেয়ানে কোন কারণ না দেখিয়ে, চার্জশিট না দিয়ে শ্রমিককে বরখাস্ত করে। সেই বেআইনী বরখাস্ত মাথা পেতে মেনে নেবার দাবিতে শ্রমিকদের বিরুদ্ধে কারখানায় লকআউট ঘােষণা করে কয়েক হাজার শ্রমিকদের কর্মহীন করেছে। এবং বরখাস্ত শ্রমিকরা এ আই টি ইউ সি ইউনিয়নের সদস্য বলে সি পি এম-এর ‘সিটু’র নেতারা সেই বে-আইনী ছাঁটাই মেনে নিয়েই বিড়ালাদের সঙ্গেই বেসরকারি পর্যায়ে তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার, এমনকি জীবিকা আক্রান্ত, আক্রান্ত তাদের শ্রেণীগত ঐক্য।
ছেন কিংবা যারা ক্ষমতার মসনদে চড়বার খােয়াব দেখছেন তাঁদের সকলের কাছেই বিনীত অনুরােধ আপনারা ভেবে দেখুন। মানুষের উপরে আক্রমণ চালিয়ে কিংবা সেই আক্রমণকে অব্যাহত ধারায় চলতে দিয়ে কি মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা সম্ভব?
এক্ষেত্রে নেতৃত্বের একটা বিশেষ দায়িত্ব এবং ভূমিকা রয়েছে। আজ যারা ভারতের এবং পশ্চিমবঙ্গের ভাগ্যবিধাতা, সেই সরকারি দলের দায়িত্ব আরাে বেশি। তেমনি দায়িত্ব রয়েছে প্রতিটি সাচ্চা দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলের। তারা কি মেহনতী মানুষের জীবনও জীবিকার উপরে আক্রমণ প্রতিরােধে সক্রিয় হবেন, সক্রিয় করে তুলবেন প্রশাসনকে? তারা কি সরকারি বা বেসরকারি ক্ষেত্রে কষ্টার্জিত গণতান্ত্রিক অধিকারের উপরে আক্রমণকে দলগত প্রতিহিংসা প্রতিহত করার জন্য ঐক্যবদ্ধ হবেন?
তা যদি করতে পারেন, তাহলেই দেশের মধ্যে একটা উদ্দীপনাময় সদর্থক ঐক্য আসবে—যেটা জরুরি অবস্থা মােকাবিলা করার অপরিহার্য শর্ত। এবং সেখানেই থাকবে দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের সার্থকতা।
আর তা যদি না হয় এবং দেশ সত্যিই একটা যুদ্ধের মধ্যে জড়িয়ে পড়ে? পশ্চিমবঙ্গের দেশপ্রেমিক মানুষ তাদের দায়িত্ব পালন করবেন ঠিকই, কিন্তু সমাজতান্ত্রিক-সমাজবাদী থেকে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লববাদী নেতারা, আপনাদের কী কৈফিয়ত থাকবে দেশের মানুষের কাছে?
এই কৈফিয়ৎ দেবার ভাবনাটাই মনে হয় দলবাজির মাতনে নেতারা ভুলে গিয়েছেন। না হলে এই ধরণের এক উদ্বেগজনক অবস্থায় কী করে ভারতের অন্য রাজ্যগুলাের ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হবার অধিকারের দাবি নিয়ে খবরের কাগজের প্রতিনিধির সঙ্গে তাত্ত্বিক আলােচনা” চালান রাজ্যের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দলের (গত বিধানসভার নির্বাচনী ফল অনুযায়ী) নেতা?
কী করে মেদিনীপুর জেলায় জমি সম্পর্কে দলের ঘােষিত নীতি লঙ্ঘন করে বিভিন্ন জায়গার স্থানীয় নবকংগ্রেস ইস্তাহার বিলি করে জোতদারের পক্ষে দাঁড়ায় এবং রাজ্যনেতারা সে বিষয়ে তুষ্ণীভাবে অবলম্বন করেন?
এখনাে সময় আছে। সীমান্তে পরিস্থিতি উদ্বেগজনক, কিন্তু এখনাে বিস্ফোরণ ঘটেনি। ঐক্যবদ্ধ মানুষকে নেতৃত্ব দেবার সুযােগ এখনাে রাজনৈতিক দলগুলাের হাতছাড়া হয়নি। কিন্তু সে সুযােগ গ্রহণ করতে হলে মানুষের অধিকার রক্ষা ও প্রতিষ্ঠায় সবাইকে সক্রিয় ও উদ্যোগী হতে হবে দলগত সংকীর্ণতার উর্ধ্বে উঠে । নেতারা যদি সেখানে ব্যর্থ হন, তাহলে মানুষ কিন্তু সকলের কাছ থেকেই কৈফিয়ৎ আদায় করবে-হয়তাে অনেক চড়া দামে।
সূত্র: সপ্তাহ, ৩ নভেম্বর ১৯৭১