You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04.30 | সাপ্তাহিক সপ্তাহ-এর সম্পাদকীয়: একটি পর্বান্ত | সপ্তাহ - সংগ্রামের নোটবুক

একটি পর্বান্ত

বাঙলাদেশের সংগ্রামের একটি পর্ব শেষ হয়েছে। আধুনিক মারণাস্ত্রে সুসজ্জিত সুশিক্ষিত পাক সৈন্যবাহিনী বাঙলাদেশের অধিকাংশ শহর দখল করে নিতে সক্ষম হয়েছে। এতে অবশ্য আশ্চর্য হবার কিছু নেই। ই পি আর এবং ই বি আরের কয়েক সহস্র সৈনিক ছাড়া মুক্তিফৌজের আর কারাের কোনাে সামরিক শিক্ষা ছিল।, অস্ত্র বলেও তারা নিতান্তই হীন। সম্মুখ সমরে তারা পাক বাহিনীর সঙ্গে এঁটে উঠতে পারবেন না, তা এক রকম জানাই ছিল। কিন্তু কেতাবী সমর বিশেষজ্ঞদের যা বিস্মিত করেছে তা প্রায় নিরস্ত্র, সামরিক শিক্ষাহীন মুক্তিফৌজের প্রতিরােধ ক্ষমতা। প্রতি ইঞ্চি জমির জন্য তারা দাঁতে দাঁত দিয়ে লড়ছেন। বহু বছর একাধিকবার হাত বদল হয়েছে। পাকিফৌজকে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করতে হয়েছে। মুক্তিফৌজ তাদের প্রায় প্রাগৈতিহাসিক হাতিয়ার নিয়েই ইয়াহিয়া খানের তৈলমসূণ সমর যন্ত্রকে মাসাধিক কাল ধরে অচল করে রেখেছেন। নিছক মনােবল, আদর্শের ন্যায্যতা সম্পর্কে দৃঢ় বিশ্বাস মানুষকে যে কত শক্তি দিতে পারে যুদ্ধের এই প্রথম পর্ব তারই জলন্ত প্রমাণ।
যুদ্ধের এই প্রথম পর্বে শহরগুলাে পাকবাহিনীর হাতে গেলেও, গ্রামাঞ্চল অর্থাৎ দেশের শতকরা ৯০ ভাগ, রয়েছে বাঙলাদেশের গণ-প্রজাতন্ত্রী সরকারের হাতেই। জঙ্গীশাহীর পরােয়ানা এখানে অচল। এইসব অঞ্চলে কোনােদিন তারা তাদের কতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারকে কিনা সন্দেহ।
পাকিবাহিনী বাঙলাদেশের জনসাধারণের উপর শুরু করেছিল অতর্কিত আক্রমণ। তদুপরি বাঙলাদেশের জনসাধারণের অবিসংবাদি নেতা মুজিবুর রহমান ও তার আওয়ামী লীগ ছিলেন সংসদীয় লড়াইয়ে অভ্যস্ত ও অভিজ্ঞ। সংসদের বাইরে গণ-আন্দোলনের কিছু অভিজ্ঞতাও তাদের নিশ্চয়ই ছিল। কিন্তু সমর্বাত্মক সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য হয়তাে সত্যিই তারা প্রস্তুত ছিলেন না। এমন প্রয়ােজর দেখা দেবে হয়তাে তারা ভাবতে পারেনি। তবু অতি অল্পকালের মধ্যেই যে তারা বিহ্বলতা কাটিয়ে উঠেছেন এবং সরকার গঠন করে মুক্তি-সংগ্রামকে সংহত করার কাজে আত্মনিয়ােগ করতে পেরেছেন এটা আওয়ামী লীগের প্রাণ শক্তিরই পরিচায়ক। আর এই কারণেই আওয়ামী লীগের এই সরকারকে ঘিরে দানা বেঁধে উঠেছে। বাঙলাদেশের জাতীয় ঐক্য। মৌলানা ভাসানির মতাে মুজিবুর রহমানাের কঠোর সমালােচক থেকে শুরু করে বাঙলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, অধ্যাপক মুজফফর আহমেদের ন্যাপ’ পর্যন্ত সকলেই এই সরকারের প্রতি প্রশ্নাতীত আনুগত্য ঘােষণা করেছেন। একটি ঐক্যবদ্ধ মাের্চায় এই সাংগঠনিক রূপ পেলে বাঙলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম সত্যি দুর্বার হয়ে উঠবে।
এই একমাসের প্রাণপণ লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে মুক্তিফৌজ অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। রড়াইয়ের মধ্য দিয়ে এসেছে সৈনিক শৃঙ্খলাও। এখন তারা মুখােমুখি লড়াই এড়িয়ে গেরিলা কায়দায় শত্রুর উপর হামলা শুরু করেছেন এবং তাতে ইতিমধ্যে সফল্যও অর্জন করেছেন জনসমুদ্রে মাছের মতাে যতক্ষণ মাছের মতাে ঘুরে বেড়াতে পারেন গেরিলারা ততক্ষণ অপরাজেয়। এখন তাদের নেতৃত্বে আছেন কর্নেল ওসমানির মতাে সুদক্ষ, অভিজ্ঞ সেনানায়ক। তাই আশা করা যায় অতঃপর মুক্তিফৌজের ক্যাম্পেনগুলােও হয়ে উঠবে আরও সুপরিকল্পিত ও তাৎপর্যময়।
বিশ্বের জনমতের সহানুভূতি বাঙলাদেশের জনসাধারণ ইতিমধ্যে অর্জন করেছেন। ভবিষ্যতে এই সহানুভূতি হয়তাে সক্রিয় সমর্থনে রূপায়ীত হবে। আর তাহলে বাঙলাদেশের জনসাধারণের স্বাধীনতা সংগ্রামের গতিবেগ হয়ে উঠবে আরাে দূর্বার। আজই হােক আর কালই হােক বাঙলাদেশের জনসাধারণের জয় হবেই- সংগ্রামের প্রথম পর্বের শেষে এই সত্যটাই আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
সূত্র: সপ্তাহ, ৩০ এপ্রিল ১৯৭১