আর কালক্ষেপ নয়
সীমান্তের ওপার থেকে উদ্বেগজনক সব খবর পাওয়া যাচ্ছে। বাংলাদেশ কার্যত পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক চক্রের হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় এখন তারা মরিয়া হয়ে নির্মম প্রতিশােধ নিতে শুরু করেছে। ঢাকা থেকে প্রত্যক্ষদর্শীর যেসব বিবরণ সংগ্রহ করা যাচ্ছে তাতে দেখা যায় সেখানে এখন শ্মশানের শান্তি বিরাজ করছে। শহর একটি ধ্বংসভূপে পরিণত হয়েছে। রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও অন্যান্য শহরের ওপর নির্বিচারে বােমাবর্ষণ করা হচ্ছে। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে। নিরীহ নাগরিকদের ওপর চালানাে হচ্ছে অকথ্য অত্যাচার-নারী, শিশু এবং বৃদ্ধ ও পাক সৈন্যদের জিঘাংসার শিকার হচ্ছে। এক কথায় বাঙলাদেশে। যা চলছে তাকে গণহত্যা ছাড়া আর কোনাে আখ্যায় অভিহিত করা যায় না।
অত্যন্ত প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও বাঙরাদেশের দেশপ্রেমিক জনসাধারণ সর্বপ্রকার আধুনিক মারণাস্ত্রে সুসজ্জিত শক্তিশালী পশ্চিম পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে দাঁতে দাঁত দিয়ে প্রতিরােধ চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের এই বীরত্বপূর্ণ প্রতিরােধ সীমান্তের এপারের মানুষদের সপ্রশংস সমর্থন লাভ করেছে। দলমত নির্বিশেষে সকলেই গণতন্ত্রের জন্য, স্বাধীকারের জন্য বাঙলাদেশের মানুষের এই মরণপণ সংগ্রামের প্রতি আকুষ্ঠ সমর্থন জানিয়েছেন। কিন্তু সমর্থন ও সহানুভূতির এই অভিব্যক্তি যথেষ্ট নয়। প্রয়ােজন আরাে সক্রিয় সাহায্যের।
কি ধরণের সাহায্য তারা চান? বাঙলাদেশের মুক্তিযােদ্ধারা তা স্পস্ট করেই বলেছেন। তাঁরা চান অস্ত্রশস্ত্র, গুলি-গােলা, কামান-বন্দুক। ই পি আর এবং ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের হাতে যে সব অস্ত্র শস্ত্র আছে তা প্রথমত পর্যাপ্ত নয়, দ্বিতীয়ত তা সেকেলে ধরণের। তা দিয়ে ইয়াহিয়া বাহিনীর সঙ্গে মােকাবিলা করা সম্ভব নয়।
আর ঘটনার পতি থেকে এটা স্পষ্ট ইয়াহিয়া সামরিক চক্র কোন রাজনৈতিক সমাধান চান না। রক্তপাত বন্ধ করার জন্য সােভিয়েত প্রেসিডেন্ট পদগাের্নির আবেদনের যে জবাব তারা দিয়েছেন তা থেকে এটা দিনের আলাের মতাে পরিষ্কার। অস্ত্রের ভাষা ছাড়া আর কোন ভাষা সামরিক একনায়কেরা বােঝে না। অতএব অস্ত্রের জবাব বাঙলাদেশের মানুষকে অস্ত্রের মুখেই দিতে হবে।
শুধু মুখের সহানুভূতি জানানাে বা কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টি অতএব যথেষ্ট নয়। বাঙলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম কে রক্তের বন্যায় ডুবিয়ে দেওয়া হবে আর আমরা দূর থেকে শুধু সহানুভূতি জানাব এ কখনােই।
অতএব বাঙলাদেশের সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রশ্নটি নিয়ে আর কালক্ষেপ করা চলে না। মুজিবুর অনুগামীদের এই সরকারই যে বাঙলাদেশের বৈধ সরকার তাতে কোনােরূপ সন্দেহ তাকতে পারে না। বিগত নির্বাচনে মুজিবের দল বাঙলাদেশে শুধু নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতাই লাভ করেছে তা নয়, প্রায় সব কটি আসনই তারা পেয়েছেন। তাঁদের সরকার বৈধ নাতাে কোনাে সরকার বৈধ?
দলমত নির্বিশেষে ভারতের আপামর জনসাধারণের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে আমরাও তাই দাবি করিবাঙলাদেশের সরকারকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দেওয়া হােক। শুধু স্বীকৃতিই নয় পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশবাদীদের বিরুদ্ধে তাদের দেওয়া হােক প্রয়ােজনীয় সর্বপ্রকারের সাহায্য। প্রয়ােজন হলে তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ানাে-ভারতের জাতীয় আন্দোলনের ঐতিহ্য। সেই ঐতিহ্যকে আমাদের এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে-নাহলে ইতিহাস কখনই আমাদের ক্ষমা করবে না।
সূত্র: সপ্তাহ, ১৬ এপ্রিল ১৯৭১