১৪ আশ্বিন ১৩৭৮ শুক্রবার ১ অক্টোবর ১৯৭১
[জাতিসংঘের সোভিয়েত ইউনিয়ন, কানাডা ও ফ্রান্স কর্তৃক বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান দাবি করা, ভারত-সোভিয়েত ইউনিয়নের যুক্ত ইস্তেহার’ রাজনৈতিক সমাধান’ কথাটা ব্যবহৃত হওয়ায় কোন কোন মহলে (মুজিবনগ্রে) নৈরাশ দেখা দেয়। বাংলাদেশ সরকার ও আওয়া মীল থেকে এই ধরনের নৈরাশ্য সৃষ্টি ও আপোষ আলোচনা সম্ভাবনা সম্পূর্ণ উড়ো খবর বলে জানানো হয়। উল্লেখ্য এই দিনে আওয়ামী লীগ ও সরকারের একান্ত কোন মহল থেকে এই ধরনের নৈরাশ্য সৃষ্টির চেষ্টা হয়েছিল। পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোস্তাক আহমেদের জাতিসংঘ সফর বাতিল হওয়ার এ ধরনের গুজব ছড়ানোর কারণ হতে পারে বলে নির্ভরযোগ্য মহলের ধারনা।]- (লেখক)
-The USA wanted India to use its considerable influence to urge restraint and reconciliation over the Bangladesh problem, US officials said. They said the secretary of state Mr William Rogers gave this view to Mr Saran Sing when he met the former.
পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলে গেরিলা তৎপরতা বৃদ্ধিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রী স্যার আলেক ডগলাস হিউম বলেন, নিঃসন্দেহে পাক ভারত পরিস্থিতি গুরুত্ব লাভ করেছে এবং কালক্রমে এই পরিস্থিতি নিরসন ঘটবে তা আমি মনে করি না।
-পশ্চিম জার্মানীর পররাষ্ট্র মন্ত্রী মিঃ ওয়াল্টার শীল নিউইয়র্কে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, তাঁর সরকার মনে করে যে, পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীন ব্যাপার।
-সামুদ্রিক জাহাজ ও নৌযানের উপর ফ্রগম্যান-মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতা বৃদ্ধি করা হয়। অবরুদ্ধ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে তাদের কর্মসূচী মোতাবেক অপারেশন শুরু হয়।
-প্রাদেশিক শিক্ষামন্ত্রীও জামাতী নেতা আব্বাস আলী খান বলেন, বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থাই আমাদের সকল ক্ষতির কারণ। বর্তমানে ধর্ম নিরপেক্ষ ও অর্থহীন শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন সাধন করা না হলে আমরা কিছুতেই আমাদের ধ্বংস রোধ করতে পারবো না। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা এমন হবে যাতে আমরা গড়ে তুলতে পারবো খাঁটি পাকিস্তানী ও খাঁটি মুসলমান। আমাদের রাজনীতি, শিল্প, সাহিত্য প্রভৃতি সব অবশ্যই ইসলামের ভিত্তিতে হতে হবে। (৭ খঃ পৃঃ৫৮৫)
-The soviet press published its first detailed report on the plight f East Bengal refugees. This is interpreted as an apparent sign of stronger Kremlin support for India. (সংবাদপত্র)
-ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি কর্তৃক আয়োজিত ভোজসভায় সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বোচ্চ সোভিয়েতের সভাপতি মন্ডলীর সভাপতি এন ডি পদগোর্নি তাঁর ভাষণে বলেন, “সোভিয়েত জনগণ ভারত উপমহাদেশে কঠিন ও বিপজ্জনক পরিস্থিতিকে ঘনিষ্ট ভাবে লক্ষ্য করছেন। আমরা মনে করি যে, সামরিক সংঘর্ষের দিকে পরিস্থিতি আরও গড়িয়ে যাওয়াকে অবশ্যই ঠেকাতে হবে এবং সে অঞ্চলের জনসাধারনের ন্যায় সঙ্গত অধিকার ও স্বার্থকে যথোপযুক্ত বিবেচনার মধ্যে রেখে একটি ন্যায় সঙ্গত রাজনৈতিক মীমাংসার মাধ্যমে সেখানে উত্তেজনাকে অপসারিত করতে হবে। সোভিয়েত উনিয়ন তার দিকে থেকে ভারতের সঙ্গে বিদ্যমান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের চেতনায় এরূপ একটি মীমাংসায় উপনীয় হবার ব্যাপারে সম্ভাব্য সর্ব প্রকার সহায়তা দান করতে চায়।”
-“ডেইলি টেলিগ্রাফ” পত্রিকায় এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, চীন গোপন পথে মুক্তিবাহিনী অস্ত্র সরবরাহ করছে এবং অন্য দিকে কূটনীতিকভাবে পাকিস্তানের সমর্থন দিচ্ছে। শিলিগুড়ি থেকে প্রতিবেদক লিখেছেন, নেপালের গোপন পথে চৈনিক অস্ত্র বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌছাতে শুরু করেছে।
-চীনের জাতীয় দিবস উপলক্ষে চীন পাকিস্তান মৈত্রী সমিতির সভার চৈনিক কনস্যুল-জেনারেল ঢাকায় পুনরুল্লেখ করেন যে, চীন পাকিস্তানের সর্বক্ষেত্রে সাহায্য করবে। (দৈঃ পাঃ)
-নিউইয়র্কস্থ বাংলাদেশ লীগ অব আমেরিকার মুখপাত্র শিখায় জাতিসংঘের বাংলাদেশ দলের নেতা বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর এক দীর্ঘ প্রেস বিবৃতি প্রকাশ করে। বিবৃতিতে বলা হয়ঃ
“We appeal to the United Nations in pursuant to its charter to prevent genocide, gross violations of human rights, colonialism and racial discrimination in Bangladesh and also to help the people of Bangladesh in their struggle for liberation.” তিনি আরও বলেন, “We do fervently hope that the day is not far off when the governments of the world will come forward to accept the reality and recognize the people’s republic of Bangladesh which my delegations feels sue will also be a member of the United nations.” উল্লেখ্য ‘শিখা’ পত্রিকায় চেয়ারম্যান হলে ফরিদপুরের কৃতি ছাত্র বামন দাশ বসু ও সদস্য ছিলেন মনোয়ার আলী। প্রতিমাসে ২৬৬৭ ব্রডওয়ে, নিউইয়র্ক, এনওয়াই ১০০২৫ থেকে প্রকাশিত হত।
-নিউইয়র্কে জাতিসংঘ ভবনের বিপরীত দিকে অবস্থিত চার্চ সেন্টারের এক হলের ঘরের বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী সহযাত্রীরা এক সাংবাদিক সম্মেলনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের উদ্দেশ্য ও আদর্শ ব্যাখ্যা করেন। সাংবাদিকদের সম্ভোধন করে বাংলাদেশে প্রতিনিধি দলনেতা বিচারপতি চৌধুরী বলেন, পূর্ববঙ্গের ১৬৯ আসনের মধ্যে ১৬৭ শেখ মুজিবুরের আওয়ামী লীগ বিজয়ের ফলে পাকিস্তানের সামরিক চক্র ষড়যন্ত্র শুরু করে। ২ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বাতিল করা হয়। ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবকে আলোচনায় ব্যস্ত রেখে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য আমদানী করার ব্যবস্থা করে। শেষ পর্যন্ত আলোচনার অবসান ঘোষণা না করেই ২৫ মার্চ পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্য বাহিনীকে নির্বিচারে হত্যা, লুণ্ঠন,ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের কাজে নিয়োজিত করা হয়।
এই পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ১৭ এপ্রিল আনুষ্ঠানিক ভাবে বাংলাদেশ সরকার মুজিব নগরে গঠিত হয়। তিনি আরও বলেন, গণহত্যার ফলে প্রায় এক কোটি লোক অবরুদ্ধ বাংলাদেশ থেকে প্রতিবেশী দেশ ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য হয় তাদের অবর্ণীয় দুঃখ দুর্দশার কথা সর্বজন বিদিত। বাঙালীদের প্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে অবৈধভাবে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তান কারাগারে আটক রাখা হয়েছে। রণাংগণের বিবরণ দিতে দিতে তিনি বলেন, বাঙালীদের জয়যাত্রা চলেছে প্রতিটি রণক্ষেত্রে। চলাচলের রাস্তা হয়েছে বন্ধ। জাহাজ হয়েছে নিমজ্জিত। ইয়াহিতা খানের প্রশাসন আজ ভগ্নপ্রায়। আমাদের যুদ্ধরত সংগ্রামী ভাইদের জানাই সশ্রদ্ধ সালাম। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান তিনটি পূর্বে শর্তের উপর নির্ভরশীল। (এক) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃত (দুই) অবিলম্বে এবং বিনাশর্তে গণতান্ত্রিক প্রন্থায় নির্বাচিত বাংলাদেশের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি দান এবং (তিন) ইয়াহিয়া খানের হানাদার বাহিনীকে বাংলার মাটি থেকে অবিলম্বে অপসারণ। উপসংহারে তিনি আশা প্রকাশ করেন, অদূর ভবিষ্যতে বিশ্বের রাষ্ট্রসমূহ আমাদের স্বীকৃতি দেবে এবং জাতিসংঘের সদস্য হিসাবে আমরা বিশ্ব সংস্থায় যোগদান করবো। (প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি পৃঃ ১৭৮-৮০)
Reference:
একাত্তরের দশ মাস – রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী