You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04.09 | আন্তর্জাতিক আইনে কি বলে বাঙলাদেশে ‘গণহত্যা চলছে না’ | সপ্তাহ - সংগ্রামের নোটবুক

আন্তর্জাতিক আইনে কি বলে
বাঙলাদেশে ‘গণহত্যা চলছে না

বাঙলাদেশে নিরস্ত্র অসামরিক নরনারীকে যেভাবে ব্যাপকভাবে হত্যা করা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী তাকে কি জেনােসাইড বা গণহত্যা বলা যায়?
এ বিসয়ে এখন আর সন্দেহেরে কোন অবকাশ নেই যে পূর্ববঙ্গে গত কয়েকদিন ধরে পশ্চিম পাকিস্তানি ফৌজ যেভাবে নির্বিচারে গুলি বর্ষণ করেছে এবং ব্যাপকভাবে নরহত্যা করেছে, তার তুলনা সাম্প্রতিক ইতিহাসে মেলা ভার। এ বিষয়ে যেটুকু নির্ভরযােগ্য ও নিরপেক্ষ প্রমাণ দরকার ছিল সেটাও পাওয়া গেছে। প্রচুর পরিমাণেই, বিদেশি সংবাদদাতাদের খবর থেকে তাে বটেই, অধিকন্তু বাংলাদেশ থেকে চলে আসা পশ্চিম পাকিস্তানিদের স্বীকৃতি থেকেও। বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক বিধিবিধানের পরিপ্রেক্ষিতে যথাযথভাবে স্থাপন করার জন্য ‘গণহত্যার’ আইনগত দিকগুলাে সযত্নে বিচার করে দেখা দরকার।
‘জেনােসাইড’ বা গণহত্যা শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন ড. রাফায়েল লেমকিন নামে একজন আন্ত র্জাতিক বিষয়ে বিশেষজ্ঞ-১৯৪৪ সালে। ৯ ডিসেম্বর, ১৯৪৮ তারিখে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ সাধারণ সাধারণ পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত ‘কনভেনশন অনুযায়ী “গণহত্যা” অপরাধ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
শব্দটির অর্থ হলাে: এক মানবগােষ্ঠির জাতীয় নৃজাতীগত, বর্ণগত অথবা ধর্মীয় মানবগােষ্ঠির ধ্বংস সাধন-সেই গােষ্ঠিভুক্ত ব্যক্তিদের হত্যার দ্বারা, অথবা তাদের গুরুতর দৈহিক বা মানসিক ক্ষতিসাধনের দ্বারা, অথবা সমগ্রভাবে কিংবা আংশিকভাবে সেই গােষ্ঠির শারিরীক বিনাশ সংঘটিত করার উদ্দেশ্যে তাদের উপর তদনুরূপ জীবনের অবস্থা ইচ্ছাকৃতভাবে চাপানাের দ্বারা, অথবা সেই গােষ্ঠির শিশুদের বলপূর্বক অপর গােষ্ঠিতে স্থানান্তরের দ্বারা।”
চুক্তি অনুযায়ী, গণহত্যা শান্তির সময়ে অথবা যুদ্ধের সময়ে, যখনই সংঘটিত হােক না কেন, আন্তর্জাতিক আইনে তাে অপরাধ ; চুক্তিবদ্ধ দেশগুলাে সেই অপরাধ “রােধ করা ও তার শান্তি বিধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু চুক্তিতে আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনালের দ্বারা বিচারের কথাও আছে। তাতে বলা আছে, চুক্তিবদ্ধ যে কোন রাষ্ট্র সম্মিলিত জাতি পুঞ্জের উপযুক্ত সংস্থার সামনে গণহত্যা বা তৎসংশ্লিষ্ট যে কোন কাজের অভিযােগি উপস্থিত করতে পারেন এবং সবদ অনুযায়ী উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানাতে পারেন। ভাষ্য চুক্তি পালনের শর্ত প্রয়ােগ প্রভৃতি সম্পর্কে দুটি দেশের মধ্যে বিতর্ক দেখা দিলে, বিদ্যমান দু পক্ষের যে কোন এক পওক্ষর অনুরােধে বিতর্কের বিষয়টি আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের কাছে পেশ করতে হবে। ” অতএব, সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ নিরাপত্তা পরিষদের সামনে বিষয়টি উপস্থিত করা হলে, পাকিস্তানের সরকার পূর্ববঙ্গে গণহত্যার অপরাধ করেছে কি করেনি এ বিষয়ে বিতর্ক তােলার অধিকার পাকিস্তান সরকারের থাকবে চুক্তি অনুযায়ী। এবং তার ফলে, বিষয়টিকে ঠাতে হবে হেগ-স্থিত আন্তর্জাতিক আদালতে।
যাই হােক, গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে এই বিষয়টি যদি একবার প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে চুক্তিতে ঘােষণা করা হয়েছে যে এরজন্য যারা অপরাধি, তাদের শাস্তি দেওয়া হবে, “তারা সংবিধানগতভাবে দায়ী শাসকই হােন, বা সরকারি কর্মকর্তাই হােন অথবা ব্যক্তিবিশেষই হােন।
চুক্তির অংশ ২, ৪ নং ধারায় বলা হয়েছে; “১. আপাকালীন অবস্থায় যখন জাতীর জীবন বিপন্ন হয় এবং যে বিপদের অস্তিত্ব সরকারিভাবে ঘােষিত হয় সেই সময়ে বর্তমান চুক্তি অনুযায়ী তাদের দায় দায়িত্ব হ্রাসমূলক কিছু কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে ততদূর পর্যন্তই যতদূর পরিস্থিতির জরুরি প্রয়ােজনের জন্য একান্তভাবে দরকার, যদি অবশ্য এই ব্যবস্থাগুলাে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী তাদের অন্যান্য দায়দায়ীত্বের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ না হয়।
অতএব, সন্দেহের কোন অবকাশ নেই যে পশ্চিম পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ এবং প্রথমত সর্বময় কর্তা জেনারেল ইয়াহিয়া খা বাঙলাদেশের মানুষের বিরুদ্দে গণহত্যার জন্য সম্মিলিতভাবে এবং ব্যক্তিগতভাবে দায়ী। পূর্ববঙ্গের যে সমস্ত প্রধান প্রধান কর্মকর্তা ইয়াহিয়া খাঁর নির্দেশ পালন করেছেন তারও গণহত্যার আইন অনুযায়ী দণ্ডনীয়।
পাকিস্তান এই চুক্তিতে সম্মতি দিয়েছে। এ বিষয়ে সে নিশ্চয়ই সচেতন যে চুক্তিতে এমন কোন সময়সীমার কথা বলা হয়নি যাতে গণহত্যার অপরাধে অপরাধিদের যে কোন সময় শাস্তি দেওয়া যায়। ১৯৬৫ সালের গােড়ার দিকে, কতকগুলাে দেশের জাতীয় আইন ব্যবস্থায় যুদ্ধাপরাধ ও মারবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতার যে বিধি আছে সেটি প্রয়ােগ করার প্রশ্ন উঠেছিল। কথাটা একটু আগে বলা হচ্ছে মনে হলেও বলা দরকার যে বাংলাদেশ’ পশ্চিম পাকিস্তানের নাগপাশ থেকে নিজেকে মুক্ত করার অভিষ্ট অর্জনে সফল হলে; সেই দেশের বিধিবদ্ধ সরকারের অধিকার থাকবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার মানবাধিকার বিষয়ক সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ কমিশন এপ্রিল ১৯৬৬ তে বলেছিলেন, নাৎসি যুগের কোন যুদ্ধাপরাধী বা মানবতার জন্য দায়ী কোনাে ব্যক্তি বিচারের হাত এড়িয়ে যাবে না, সে যেখানেই থাকুক এবং যখনই ধরা পড়ুক না কেন। অন্য যে কোন ক্ষেত্রেই এ কথা প্রযােজ্য হবে, পাকিস্তানি ফৌজের ক্ষেত্রেও।
গণহত্যা সংক্রান্ত চুক্তির শেষাংশে যেখানে বলা হয়েছে যে …ব্যাপক হত্যা যে সমস্ত পরিস্থিতি গণহত্যা বলে পরিগীণত হবে, … মধ্যে “আপাকালীন অবস্থাও”… সেই অংশটিতে এই প্রশ্নটি সম্পূর্ণ সন্দেহের আর কোন অবকাশ হয়নি। কোন আন্তর্জাতিক … সংস্থা বাঙলাদেশে গণহত্যার …বলে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের বিচার করতে এগিয়ে আসার মতাে সাহস ও বলিষ্ঠতা দেখাবন কিনা লক্ষ করা যাক।
সূত্র: সপ্তাহ, ৯ এপ্রিল ১৯৭১