You dont have javascript enabled! Please enable it! 1973.12.16 | ১৯৭৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস উপলক্ষে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে আয়ােজিত সভায় তাজউদ্দীন আহমদ - সংগ্রামের নোটবুক
১৯৭৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস উপলক্ষে বাংলা
একাডেমি প্রাঙ্গণে আয়ােজিত সভায় তাজউদ্দীন আহমদ যে বক্তৃতা প্রদান করেন তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ। দৈনিক বাংলা ও ডিসেম্বর ১৭, ১৯৭৩ সােমবার। বাংলা একাডেমির অনুষ্ঠানে তাজউদ্দীন; মানুষকে ক্ষুধার্ত রেখে গুটিকয় সুবিধাবাদীর জন্যে স্বাধীনতা নয় ঃ স্টাফ রিপাের্টার। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ও বর্তমান অর্থমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ পূর্ণ আস্থার সাথে ঘােষণা করেন যে, সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে এ দেশকে গড়ে তােলার অন্তর্নিহিত শক্তি বাঙালি জাতির রয়েছে। গত স্বাধীনতা আন্দোলনই তার। প্রমাণ। মহান জাতীয় দিবস উদ্যাপন উপলক্ষে গতকাল রােববার সন্ধ্যায় বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে আয়ােজিত মনােজ্ঞ আলােচনা সভায় জনাব তাজউদ্দীন আহমদ এই দৃঢ় প্রত্যয়ের কথা ঘােষণা করেন। তিনি বলেন, দেশকে কাঙ্খিত পথে গড়ে তােলার জন্য সমগ্র জাতিকেই কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। এক্ষেত্রে শুধু গরীব কৃষক-শ্রমিকই কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করবে কিন্তু শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী করবে না—তা আর বেশিদিন চলবে না। প্রধান অতিথির ভাষণে জনাব তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, আজ আমাদের আত্মসমালােচনারও দিবস। যে জাতি আত্ম-সমালােচনা করে না সে জাতি কখনই অগ্রগতির পথে সঠিকভাবে এগিয়ে যেতে পারে না। নিজের ঘর থেকেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। সরকারের মিথ্যা সাফাই গাওয়া নয়—বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়কে আমাদের ত্রুটি বিচ্যুতি ধরিয়ে দিয়ে দেশ গড়ার কাজে গঠনমূলক দায়িত্ব পালন করতে হবে। দেশের কোটি কোটি ভুখা-নাঙ্গা মানুষের পেটে ক্ষুধা রেখে গুটিকতক সুবিধাবাদী শ্রেণীর জন্য এই স্বাধীনতা আসেনি।
এ দেশের জনগণের জন্য ভাত-কাপড়-শিক্ষা-চিকিৎসা ও বাসস্থানের নিশ্চয়তা বিধানের জন্য শােষণহীন সমাজ গঠনের উদ্দেশ্যেই আমাদের পরিশ্রম করতে হবে। অন্যথায় জনগণের মনে বিক্ষোভের ঝড় সৃষ্টি হবে। অর্থমন্ত্রী দেশকে সমাজতন্ত্রের দিকে এগিয়ে নেয়ার জন্য স্বনির্ভর অর্থনীতির গড়ে তােলার উদ্দেশ্যে খেতখামার ও কলে-কারখানায় উৎপাদন বাড়ানাের আহ্বান জানান। তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, বাঙালি জাতি বড় বেশি তাড়াতাড়ি সব কিছু ভুলে যায়। তাই আমরা স্বাধীনতা পাওয়ার মাত্র দুই বৎসরের মধ্যেই শােকাবহ ঘটনাকে ভুলতে বসেছি। তিনি বলেন, এই মুহূর্তে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সার্বিক ইতিহাস রচনা করতে হবে। যদি সঠিক ইতিহাস রচিত না হয় তবে আগামী দিনে জাতি আমাদেরকে কিছুতেই ক্ষমা করবে না। জনাব তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, বাঙালির স্বাধীনতার ইতিহাস বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে জনগণই সৃষ্টি করেছে। একা কেউ এ ইতিহাস সৃষ্টি করেনি। এই ইতিহাসকে সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ করার জন্য তিনি বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান। জনাব তাজউদ্দীন আহমদ শহীদদের আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে বলেন, আত্মত্যাগের মাধ্যমে শহীদ ভাইয়েরা দেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছেন। এখন দেশকে গড়ে তােলার দায়িত্ব আমাদের। আমরা যদি সেই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ। হই, তবে আমাদেরকে ইতিহাসের আস্তাকুড়ে স্থান নিতে হবে।
জনাব তাজউদ্দীন আহমদ সুস্পষ্ট ভাষায় ঘােষণা করেন যে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক বুনিয়াদে বিদেশী শাসনের অনুপ্রবেশের কোন সুযােগও সম্ভাবনা নাই। তিনি বলেন, কিন্তু স্বনির্ভর অর্থনীতি কায়েম করতে না পারলে আমাদের ওপর সাম্রাজ্যবাদী চাপ থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। জনাব তাজউদ্দীন আহমদ তার দীর্ঘ-ভাষণে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। আন্দোলনের মূল্যবান তথ্যাবলী জনগণের সামনে তুলে ধরেন। দৈনিক ইত্তেফাক : জানুয়ারি ১৬, ১৯৭৪ বুধবার সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হইলে ইতিহাসের কলংকিত অধ্যায়ে আমাদের নাম লেখা হইবে ? (জাতীয় দিবস উপলক্ষে গত ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭৩ বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে আয়ােজিত আলােচনা সভায় প্রধান অতিথি অর্থমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদের ভাষণের সংক্ষিপ্ত বিবরণ)। মুক্তিযুদ্ধে যারা শহীদ হয়েছে তারা অমর, তাঁরা চিরদিন বাংলার মাটিতে বেঁচে থাকবেন। কারণ তাদের কথা রক্ত দিয়ে লেখা হয়ে গেছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অধ্যায়ে। তারা মরে প্রমাণ করে গেছেন, বিশ্বাস ও আদর্শের জন্য, ভবিষ্যৎ বাংলার মানুষের সুখ-সমৃদ্ধির জন্য, সাড়ে সাত কোটি মানুষের অন্ন, বস্ত্র, কল্যাণ, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান ও নিরাপত্তা বিধানের জন্য তাঁরা অকাতরে হাসিমুখে বুকের তাজা রক্ত বিলিয়ে প্রাণ বিসর্জন দিয়ে মুক্তি সংগ্রামের প্রয়ােজনীয় উপাদান সরবরাহ করেছেন, তাঁরা চিরঞ্জয়ী।
বাংলার মানুষের মৌলিক সমস্যা খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার সুব্যবস্থার দায়িত্ব আমাদের উপর ন্যস্ত। আমরা যদি এই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হই, তবে ইতিহাসের কলংকিত অধ্যায়ে আমাদের নাম থাকবে। দেশ গড়ার নামে জনতাকে হাতছানি দিয়ে ডেকে দেশ গড়তে উপদেশ দিলে কিছুই হবে না। কি করতে হবে তা আমাদের জানতে হবে। পরিকল্পিত উপায়ে এগিয়ে যেতে হবে এবং যে যেখানে আছেন, সেখানে তার কর্তব্য পুরােপুরি পালন করতে হবে। সবাইকে নিজ নিজ ঘর থেকে দুর্নীতি উচ্ছেদ অভিযান শুরু করতে হবে। ব্যক্তি জীবনে পুর্বাপর সংহতি বজায় রাখতে হবে। অন্যথায় দুর্নীতির উচ্ছেদ হবে না এবং বাংলাদেশ থেকে দুর্নীতি কখনাে যাবে না। উপর থেকে আদর্শ-অনুশাসন করে দেখাতে হবে। তাহলে কর্মীরা উৎসাহ ও প্রেরণা পাবে। উপরে বসে। দুর্নীতি করে আদর্শবান নাগরিক হবার উপদেশ প্রদান করা উপহাসমাত্র। এতে জাতির দুর্ভোগ বাড়বে বই কমবে না। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথে অন্তরায় সৃষ্টি হতে পারে এমন সব মৌলিক অধিকার রহিত করা প্রয়ােজন। সংবিধানে এর ব্যবস্থা রয়েছে। তবে ভবিষ্যৎ সংসদে আইন প্রণয়নকারীদের ওপর এ ব্যাপারটি নির্ভর করবে। যার পয়সা আছে, সে উচ্চ আদালতে মামলা করে মৌলিক অধিকার ক্রয় করতে পারে।
যার পয়সা নেই, তার সেই অধিকারও নেই। প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় ১৯ লক্ষ লােকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা রয়েছে। ধরুন, ৫টি পাট কল স্থাপন করতে হবে বেকার সমস্যা সমাধানের জন্য এবং পাঁচসালা সফল করার জন্য কিন্তু পাট কলের জমি সংগ্রহ করতে গিয়ে পয়সাওয়ালা এবং প্রভাবশালী লােকদের নিকট থেকে বাধা আসবে। সে বাধা সম্পত্তি রাখার মৌলিক অধিকারের প্রতিবন্ধকতা, তারা মামলা করবে। ধরুন, সরকার যদিও জিতে যাবে, পরিণামে তবুও পাঁচসালার দু’বছর অতীত হয়ে। যাবে ইতােমধ্যেই, অতএব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন অসম্ভব হয়ে যাবে। তাই ব্যক্তি মালিকানায় সম্পত্তি রাখার মৌলিক অধিকার দেশের বৃহত্তর অগ্রগতির স্বার্থে রহিত হওয়া প্রয়ােজন। সংবিধানে তাই রয়েছে। মৌলিক অধিকার নিয়ে আজকে যারা বাক-বিতন্ডা করছেন তাহাদের আসল কথা বাক স্বাধীনতা নয়, তাঁরা চান ব্যক্তিগত সম্পত্তি রাখার অধিকার। যার ফলে আপনার সম্পত্তি কিভাবে হল, কিভাবে বৃদ্ধি পেল, এটা কি হাইজ্যাক করে হল, না ডাকাতি করে হল, লুটপাট করে হল তার কোন হিসাব-নিকাশ করা বা প্রশ্ন করা যাবে না।
 
শিক্ষা প্রসঙ্গ ও গণমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা আমি চাই না। জনকল্যাণমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা চাই। যে শিক্ষা ব্যবস্থা দেশের অগ্রগতির প্রতিটি স্তরে প্রয়ােজনীয়সংখ্যক অনুশীলনপ্রাপ্ত কর্মীর যােগান দেবে সে ব্যবস্থাই আমার কাম্য। পরিকল্পিত শিক্ষা ব্যবস্থা চাই। যেখানে দেশের অগ্রগতির জন্য সর্বস্তরের সবরকম কর্মী পাওয়া যাবে। কোনও দিক শূন্য থাকবে না। সংস্কৃতি ও সংস্কৃতির আবেদন বিশ্বজনীন। এর সীমা রেখা টানা ঠিক হবে না। সংস্কৃতি চির প্রবাহমান। সত্য ও সুন্দরের সাধনাই সংস্কৃতি। সংস্কৃতি কোনকালে কোন-অবস্থায়ই বর্জনীয় নয়, সবকালেই গ্রহণীয়। প্রমাণ করতে পারলে ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুলতে প্রস্তুত ? আমি চ্যালেঞ্জ প্রদান করছি, যদি কেউ কোন দিন প্রমাণ করতে পারেন যে, আমার প্রধানমন্ত্রিত্বকালীন সময়ে ভারতের সঙ্গে কোন প্রকার গােপনীয় বা প্রকাশ্য চুক্তি করেছি তবে আমি ফাসিকাষ্ঠে ঝুলতে প্রস্তুত রয়েছি। ২৩ নভেম্বর ইয়াহিয়া খান ঘােষণা করেন যে, ১০ দিনের মধ্যে ভারত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্বে পরিচালিত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য প্রদান বন্ধ না করে তবে পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করবে। এই ঘােষণার পর শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বিশ্ববাসীর নিকট আবেদন জানান এই হামলা বন্ধ করার জন্য। কিন্তু কিছুই হয়নি এবং ঠিকই দশদিন পর ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান ভারতের পশ্চিম সীমান্তে আক্রমণ শুরু করে।
ফলে ভারতের স্বাধীনতা বিপন্ন হয় এবং আমরাও তখন স্বাধীনতা সংগ্রামে লিপ্ত। তাই উভয়ের স্বাধীনতার চরম শত্রু পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যৌথভাবে কি করে মােকাবেলা করা যায়, তাই নিয়ে আমরা আলােচনা শুরু করি এবং একদিন রাতে সবার অলক্ষে মুজিবনগর থেকে আমি এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেব উধাও হয়ে যাই। মিসেস গান্ধীর সঙ্গে রাতে দীর্ঘ আলােচনার পর আমাদের সিদ্ধান্ত ভারতকে জানিয়ে দেই যে, আমরা স্বাধীনতার সম্মিলিত শত্রুর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রাম করতে প্রস্তুত, তবে তা হবে আমাদের শর্তানুযায়ী।
শর্তগুলাে হল ঃ ভারত বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করবে, ভারতীয় সৈন্য বাহিনী বাংলাদেশের সম্মিলিত সৈন্যবাহিনীর সাথে (গণফৌজ ও ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট, তৎকালীন ই.পি.আর., আনসার, মুজাহিদ যার সম্মিলিত নাম ছিল মুক্তিবাহিনী) Supporting force বা সহায়ক বাহিনী হিসেবে আমাদের সাথে যুদ্ধ করিবে। এটাই ছিল ভারতের সাথে বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দের সেই রাতের বৈঠকের কার্যবিবরণী  এটাকে আপনারা যে কোন নামে অভিহিত করতে পারেন। আমাদের আপত্তি নেই। এই প্রস্তাবের মূলকপি এখনও বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা রয়েছে। বিপ্লবের নিম্নচাপ থেকে সময় থাকতে সাবধান হতে হবে ও জলভাগে বায়ুর গতি ও চাপ পরিবর্তনের ফলে যে নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বায়ুর গতি ও চাপ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে না এলে যে ঘূর্ণিঝড় ও গীর সৃষ্টি হয়, তাতে প্রলয়ংকারী জলােচ্ছাস এবং হারিকেন মানব ও প্রাকৃতিক জীবনে ডেকে আনে এক চরম বিপর্যয়। যার ফলে সব স্বাভাবিক অবস্থা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে রূপ নেয় এক প্রলয়ংকরি ধ্বংসলীলার। তেমনি আমরা যদি দেশের মানুষকে প্রয়ােজনীয় খাদ্য ও বস্ত্র সরবরাহ করতে ব্যর্থ হই বা তাদের প্রয়ােজন মেটাতে না পারি, তবে আমাদের দেশেও বিপ্লবের নিম্নচাপ সৃষ্টি হবে এবং যদি সময় থাকতে মানুষের কল্যাণ প্রচেষ্টায় আমরা ব্ৰতী না হই, তাহলে নিম্নচাপের ফলে অবশ্যম্ভাবী বিপ্লবের গতিধারায় আমরা শুধু ভেসেই যাব না, ইতিহাসের কলংকজনক অধ্যায়েও নিক্ষিপ্ত হব।
অতএব সময় থাকতে আমাদের সাবধান হওয়া উচিত। অতি-বিপ্লবীরা সমাজের কোন উপকারে আসে না। তারা শুধু জনসাধারণকে নির্যাতন করতেই সক্ষম। পশ্চিম বাংলায় অতি-বিপ্লবীরা বহু মানুষ হত্যা করেছে। কিন্তু সার্বিক জনগণের কোন উপকার হয়নি। বুদ্ধিজীবী প্রসঙ্গ : বুদ্ধিজীবীরা তাঁদের দায়িত্ব সম্বন্ধে সর্বদাই সচেতন এবং আমি বিশ্বাস করি, তাদেরকে নতুন করে দায়িত্ব নেয়ার কোন প্রশ্নই আসে না। কারণ জাতীয় প্রয়ােজন এবং ক্রান্তিলগ্নে বুদ্ধিজীবীরা সর্বদাই সঠিক দায়িত্ব অতীতেও পালন করে এসেছে। বর্তমানে এবং ভবিষ্যতেও করবেন, এই দৃঢ় বিশ্বাস আমার রয়েছে। আমাদের বুদ্ধিজীবীরা দেশের সত্যিকার সমস্যা তুলে ধরবেন এবং সমাধানের ইঙ্গিত প্রদর্শন করবেন, এটাই কামনা করি। অন্ধভাবে আমাদের শুধু প্রশংসা করলেই চলবে না। বঙ্গবন্ধু যেন রেলগাড়ি লাইনের ওপর স্থাপন করতে পারেন ঃ বঙ্গবন্ধুর কাছে খুব বেশি কিছু আশা করবেন না। শুধু এইটুকু দোয়া করবেন যে, বঙ্গবন্ধু যেন লাইনচ্যুত রেলগাড়িটি লাইনের ওপর সঠিকভাবে স্থাপন করে যেতে পারেন। কারণ অগ্রগতির প্রতীকস্বরূপ এই গাড়িটি লাইনে অবস্থান করলে যে কোন ইঞ্জিন বিলম্বে হলেও সেটি গন্তব্যস্থানে পৌছাতে সক্ষম হবে। অন্যথায় রেলগাড়িটি যদি লাইনচ্যুত থেকে যায়, তা হলে দ্বিগুণ শক্তিসম্পন্ন ইঞ্জিন দিয়েও তাকে এগিয়ে নেয়া যাওয়া সম্ভবপর হবে না।
সার্বভৌমত্ব ও দেশের সার্বভৌমত্ব নির্ভর করে দেশের অর্থনৈতিক স্বয়ংসম্পূর্ণতার উপর। এই জন্য আমাদের উৎপাদন বাড়াতে হবে, সম্পদ বৃদ্ধি করতে হবে এবং সবাইকে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতেই হবে। বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানি করে শতকরা ১০০ ভাগ সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা অসুবিধা হবে। কারণ বিদেশ থেকে যখন সাহায্য হিসেবে গম আসে, তখন দলিল-পত্রের কোথাও কোন শর্ত লেখা থাকে না। গমের সাথে সাথেই বিদেশী প্রভাবও দেশে প্রবেশ করে। পরনির্ভরশীল যে কোন দেশের সার্বভৌমত্ব এমনিভাবে ক্ষুন্ন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী সরকারী প্রশাসন যন্ত্র ছাড়া অন্য কোন রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তি কোনরূপ অস্ত্র রাখতে পারবেন না। সরকারী দলের কাছে অস্ত্র থাকলে আত্মরক্ষার জন্য বিরােধী দলও অস্ত্র রাখতে চাইবে। ফলে দেশে অশান্তির সৃষ্টি হবে। এমন কি ভয়াবহ পরিস্থিতিরও সৃষ্টি হতে পারে। কোন আওয়ামী লীগারের হাতে বেআইনী অস্ত্র থাকলে তাকেও গ্রেফতার করতে হবে, নতুবা বক্তৃতা-বিবৃতিতে ভাল কথা শুনিয়ে দেশে শান্তি তথা আইন-শৃংখলা ফিরিয়ে আনা সম্ভবপর হবে না। পুলিশ বাহিনীকে শক্তিশালী করতে হবে, জনগণের আস্থা অর্জনে সাহায্য করতে হবে। তাই, আসুন প্রতিজ্ঞা করি, শহীদদের স্মৃতি স্মরণ করে, আমার পঙ্গু মুক্তিযােদ্ধাদের দিকে তাকিয়ে, যারা আমাদের জলন্ত দৃষ্টান্ত, চলুন, আজ আমরা শপথ গ্রহণ করি, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সমাজবাদী বাংলাদেশ গড়ে তােলার। দেশের ৮০জন ভুখা-নাংগা মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়ন প্রচেষ্টায় আমাদের সম্পদ সৃষ্টি করতে হবে, উৎপাদন বাড়াতে হবে। তবেই আমরা সুখী। সমৃদ্ধিশালী শােষণহীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ এবং স্বনির্ভর অর্থনীতি গড়ে তুলতে পারব। আমরা দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করব এবং বিশ্বশান্তিতে অবদান রাখব, বিশ্বের সব মুক্তি সংগ্রামীদের পাশে থাকব ও বিশ্বশান্তিতে বিঘ্ন সৃষ্টিকারীদের রুখে দাঁড়াব।

সূত্র : আমার ছোটবেলা ১৯৭১ এবং বাবা তাজউদ্দীন আহমেদ – সিমিন হোসেন রিমি