You dont have javascript enabled! Please enable it! 1974.01.20 | বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক কাউন্সিলের সমাপনী অধিবেশনে তাজউদ্দীন আহমদ যে ভাষণ দেন তার বিবরণ - সংগ্রামের নোটবুক

২০ জানুয়ারি ১৯৭৪ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক কাউন্সিলের সমাপনী অধিবেশনে তাজউদ্দীন আহমদ যে ভাষণ দেন তার বিবরণ

দেশ স্বাধীন হবার পর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নবগঠিত সর্বোচ্চ পরিষদের সভায় এই সর্বপ্রথম আমরা সমবেত হয়েছি। আগে আমরা যে সম্মেলন করতাম তখনকার পটভূমিতে তার কার্যক্রম ছিল ভিন্ন ধরনের। স্বাধীনতার পর আমাদের দলীয় সংগঠনের এই সর্বোচ্চ পরিষদ কার্যক্রম ভিন্নরূপে হবে এটাই স্বাভাবিক। বঙ্গবন্ধু আজকে এই সম্মেলনে শ্রদ্ধেয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেবকে আমাদের দলের দৃষ্টিভঙ্গিতে এবং সরকারের পক্ষ থেকে আমরা যে অভিজ্ঞতা পেয়েছি তার আলােকে একটি রাজনৈতিক বিশ্লেষণ করতে বলেছেন। যার ফলে দলের নেতা ও কর্মী ভাইয়েরা আমাদের কাছ থেকে রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে মােটামুটি একটা ধারণা নিতে পারেন। যদিও আপনাদের নিজেদেরও প্রত্যেকের একটি ধারণা রয়েছে এবং আপনারা অনেকগুলাে প্রশ্ন নিয়ে এই সম্মেলনে এসেছেন। যে সব প্রশ্নের সম্মুখীন আপনারা হয়েছেন আপনাদের দৈনন্দিন কাজে—গ্রামে-গঞ্জে, পথে-প্রান্তরে। তেমনিভাবে বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেও আপনাদের মনে অনেকগুলাে প্রশ্ন রয়েছে। আগামী দিনে যারা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা হবেন তাদের কাছে আমার অনুরােধ ভবিষ্যতে যখন কাউন্সিল মিটিং হবে, তখন যেন ‘মারও দীর্ঘসময় দিয়ে সমস্ত নেতা-কর্মীর সুস্পষ্ট ধারণা সৃষ্টির জন্য তাদের সমস্ত প্রশ্নে নিয়ে আলােচনার সুযােগ কাউন্সিলে থাকে। আপনারা অবশ্যই সেই ব্যবস্থা করবেন। আগামীর যারা কর্মকর্তা হবেন, যাদের কাঁধে এই দলের গুরু দায়িত্ব ন্যস্ত হবে তাদের কাছে একজন আওয়ামী লীগ কাউন্সিলার হিসেবে আমার অনুরােধ কমপক্ষে পাঁচ দিন যাতে আমাদের বিভিন্ন অঞ্চলের নেতারা আলােচনার সুযােগ পান তার ব্যবস্থা করতে হবে ।

আগে সুযােগ কিছু কম ছিল, কিন্তু স্বাধীনতার পর আমাদের অনেক নেতার সুযােগ এবং সৌভাগ্য হয়েছে বিদেশে বিভিন্ন সমাজ ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে জাতীয় রাজনৈতিক দল কি ভাবে কাজ পরিচালনা করেন, কি ভাবে তাদের বার্ষিক সম্মেলনগুলাে হয় তা দেখবার। আমরা সেই সমস্ত কার্যক্রম থেকে আমাদের জন্য প্রয়ােজনীয় বা উপযােগী কিছু ভাল ভাল বিষয় গ্রহণ করতে পারি যা থেকে আমাদের দল এবং এর নেতা কর্মীরা উপকৃত হতে পারেন। আপনাদের মনে যে সব কথা ছিল, তা হয়ত পরিষ্কারভাবে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করার সুযােগ আজকে এই অল্প সময়ে নাও হতে পারে। তবে আমি একজন আওয়ামী লীগের ক্ষুদ্র কর্মী হিসেবে, একটি ব্যাপার এই দলের জন্মলগ্ন হতে আজ পর্যন্ত দেখে এসেছি যে, উপরের নেতৃত্ব থেকে শুরু করে গ্রাম পর্যায়ের কর্মী পর্যন্ত সবার মধ্যে মতামতের একটা মােটামুটি ঐক্য থাকে। তাই আমরা আশা করব আলােচনা পর্যাপ্ত না হলেও আমাদের যারা যারা আলােচনা করেছেন বা করবেন তারা অনেক পরিমাণে আমাদের আপামর নেতৃত্বের এবং কর্মীবৃন্দের মনােভাব ব্যক্ত করতে পারবেন। অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু আমাকে কিছু বলতে বলেছেন। সত্যিকারভাবে বলতে গেলে রাষ্ট্র পরিচালনায় দলের ভূমিকা দেশের অর্থনৈতিক উত্থান-পতন, অবনতি-উন্নতি, উৎকর্ষ-অপকর্ষের উপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ দেশের রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের জনপ্রিয়তা ও স্থিতিশীলতা এবং যে দলের তারা প্রতিনিধি অর্থাৎ শাসক, সে দলের উত্থান, পতন, অপ্রিয়তা, উৎকর্ষ-অপকর্ষ নির্ভর করে সেই দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর। আজকে বাংলাদেশের প্রত্যেকটি আওয়ামী লীগ কর্মী এবং নেতা; যে সেখানেই রয়েছেন তাদের কাছে গােপন করার বিষয় এটা নয় যে, আমরা একটি অর্থনৈতিক দুর্গতির মধ্যে রয়েছি। দুর্গতি যে আজকেই সৃষ্টি হয়েছে এ কথা বললে যেমন ভুল হবে, আবার স্বাধীনতার পর এই দু’বছরের মধ্যে যেখানে যেখানে আপনাদের দৃষ্টিতে, দেশের মানুষের দৃষ্টিতে, অবনতি হওয়া উচিত ছিল।

অথচ হয়েছে, সেগুলােও যদি আপনাদের কাছ থেকে আমরা গােপন করে যাই তাও সঠিক হবে না, এই কথাটা আমি বলে রাখতে চাই। আমরা মাঝে মাঝে যখন ঢাকার বাইরে যাই তখন বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখীন হই। এই অতি সম্প্রতি আমি নিজে নেত্রকোনায় গিয়েছিলাম। রাত দেড়টা পর্যন্ত স্থানীয় কর্মী এবং নেতা ভাইদের সাথে কথা বলেছি। তারা যে প্রশ্নগুলাে আমাকে করেছিলেন, আমার মনে হয় বাংলাদেশের যারা এখানে উপস্থিত তারাও একই ধরনের প্রশ্নই করবেন। তারা আমার কাছ থেকে মােটামুটি একটি কথাই জানতে চেয়েছিলেন, তাদের সামনে যে প্রশ্নগুলাে আসছে তার সঠিক জবাব কি হবে ? একজন যদি একরকম জবাব দেয় দ্বিতীয়জন দেয় অন্যরকম, তাহলে প্রশ্নের সমাধান না হয়ে বিভ্রান্তির পরিমাণ আরও বাড়ে। তাই আমি আজকে আবেদন করব যারা ভবিষ্যৎ কর্মকর্তা হবেন, এই কাউন্সিল যাদেরকে নির্বাচিত করবেন, তারা দলের যে কার্যক্রম তাকে স্বচ্ছ রাখবেন। সেই কার্যক্রম কি? দলের কার্যক্রম ৩ ধরনের থাকে, প্রথমটি স্বল্পমেয়াদি অর্থাৎ Short. Term, দ্বিতীয়টি মধ্যমেয়াদি অর্থাৎ Middle Term, এবং তৃতীয়টি হল দীর্ঘমেয়াদি opefte Long Term. এই Short Term প্রােগ্রাম নিয়েই অসুবিধা। Long Term প্রােগ্রামটা একটা মােটামুটি ব্যাখ্যা দিয়ে ছেড়ে দিলে বেশ কিছুদিন এমনকি বছরের পর বছর চালিয়ে নেয়া যায়। কিন্তু Short Term প্রােগ্রামের পরিবর্তন হয় অবস্থার পরিবর্তনের সাথে সাথে । আর তখনি প্রয়ােজন হয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের। এই নেতৃত্বের কাজ তখন এই যে গতি পরিবর্তন হওয়ার ফলে নতুন যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে তার সঠিক ব্যাখ্যা দেওয়া এবং সেই পরিস্থিতির মােকাবেলার।

পন্থাটি পরিষ্কারভাবে কর্মী সাধারণকে জানিয়ে দেওয়া, সংগঠনকে জানিয়ে দেওয়া। যাতে করে কেন্দ্র থেকে শুরু করে আমাদের গ্রাম পর্যন্ত একইভাবে দলের সমস্ত কর্মীদের সাথে আমাদের সবার চিন্তা ভাবনার সমন্বয় থাকে। অর্থাৎ দল হিসেবে বলতে গেলে আওয়ামী লীগের নেতা কিংবা নেতৃত্ব যা ভাবছেন, যে সমাধান চিন্তা করছেন, সমস্যাকে যে আলােকে দেখছেন, সেটা যেন গ্রাম পর্যন্ত কমী ভাইয়েরা সেই আলােকে দেখেন, সেইভাবে ভাবেন, সেইভাবে ব্যাখ্যা করেন এবং সেইভাবে সমাধানের কথা চিন্তা করেন। কাজেই সেই। ব্যবস্থাটাই অনাগত যে নেতৃত্ব তারা যেন করেন, তাঁদের কাছে আমার এই বক্তব্যটি রেখে গেলাম। সরকার হিসেবে আমরা যে কাজ করি সেই কাজের ভাল এবং মন্দের ফল প্রত্যক্ষভাবে ভােগ করতে হয় আমাদের দলকেই আর দলকে অবহিত রাখতে। হয় সেই জন্যে। সরকার কি করতে যাচ্ছে, সরকারের কাজ এবং কাজের পথে সবসময় যে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়গুলাে থাকে তার সাথে দলীয় যে নীতি এর একটা পরিষ্কার যােগাযােগ থাকা দরকার। কারণ দলীয় নীতি সাধারণত সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম থাকে না—broad principle থাকে সেখানে। আবার সরকারে যে ব্যাপারগুলাে থাকে সেগুলাে কার্যকর করতে গেলে, সাময়িকভাবে হয়ত দলীয় কর্মী বা নেতৃত্বের কাছে মনে হবে যে, এটা বােধহয় বিচ্যুতি । কিন্তু সেই বিচ্যুতিটা কেন করা প্রয়ােজন, সেটাও দলের কাছে সুস্পষ্ট হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। বর্তমানে আমাদের বিভিন্ন স্তরের নেতৃত্ব এবং কর্মীদের মধ্যে একটা ধারণা রয়েছে যে সরকারের সাথে সংগঠনের যেন খুব একটা বেশি সংযােগ নেই। এই ধারণাটার কারণ কি? তা আমি বিশ্লেষণ করতে যাচ্ছি না। কিন্তু ধারণাটা যে রয়েছে এটা আমি অন্তত ব্যক্তিগতভাবে, আওয়ামী লীগের একজন কর্মী এবং এই দলের প্রতিনিধি হিসেবে, সরকারের একজন মন্ত্রী হিসেবে বুঝেছি। সেখানেই গিয়েছি এই ধারণাটাই যেন অনুভব করেছি।

কাজেই আমি আবার নিবেদন করব ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের কাছে—সংগঠন এবং সরকারের মধ্যে একটা নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের যে নির্বাহী কমিটি হবে (বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটি) সেই ওয়ার্কিং কমিটিও গতানুগতিক নিয়মে না বসে ভবিষ্যতে কিছু সময় বেশি নিয়ে বসবেন। বিভাগীয় মন্ত্রীদের বক্তব্য, তাদের বিরুদ্ধে বা তাদের সম্পর্কে দলীয় নেতা-কর্মীরা বলবেন, সবসময় বিরুদ্ধে বলবেন এটা আমি চিন্তা করব । আপনারা যখন আমাদের বিরােধিতা করেন তখন আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি এবং আমার সমস্ত সহকর্মীবৃন্দরা ব্যক্তিগতভাবে এটাই ভাবেন যে, এটা কারাে বিরুদ্ধে নয়। বিরুদ্ধ মনােভাবের লােকেরা যে কথাগুলাে ভাবে তাই আপনারা প্রকাশ করেন। সে ক্ষেত্রে আমাদের কর্তব্য হবে আপনাদের বক্তব্যগুলাে পরিষ্কাভাবে শােনা এবং সময় নিয়ে শােনা। সময় এত অপর্যাপ্ত হওয়া উচিত হবে না। দেশে সমস্যা থাকবেই। আমরা যদি মনে করি যে সমস্যা আছে অতএব বেশি লম্বা মিটিং করা যাবে না, এটা ঠিক নয় বলে আমি মনে করি। সমস্যা থাকবেই, প্রতিদিন সমস্যার প্রবলতা যে বাড়বে না তার নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না। ঘাত-সংঘাতের মধ্য দিয়েই মানুষের জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবন, সমাজের জীবন। ঘাত-সংঘাত না থাকলে মানুষের সমাজের ক্রমবিকাশ হতে পারে না, কাজেই সংঘাত থাকবেই। সেই সংঘাত যে রূপ ধারণ করুক কেন তার মধ্য দিয়েই আমাদের যেতে হবে। আমরা ভবিষ্যতে বঙ্গবন্ধুর কাছে জাতির পিতা হিসেবে, মন্ত্রিসভার নেতা হিসেবে আবেদন করব এবং ভবিষ্যতে যে ওয়ার্কিং কমিটি হতে যাচ্ছে তাদের কাছেও আমার আবেদন থাকল, যারাই সদস্য হবেন তারা একটু দীর্ঘসময় বসে মন্ত্রীদের কার্যকলাপ সম্পর্কে যে সব কথা বিভিন্ন নেতা-কর্মীরা শােনেন তাদের নিজের মনে যে প্রশ্ন তা পরিষ্কারভাবে, বিশদভাবে বিশ্লেষণ ও আলােচনা করবেন।

সেখানে মন্ত্রীদের বক্তব্য, সর্বোপরি আমাদের সর্বময় নেতা বঙ্গবন্ধুর কি বক্তব্য সেটাও শােনা প্রয়ােজন হবে। সে জন্য যে সময়টুকু দরকার সেটুকু দেবার জন্য তৈরি থাকতে হবে । আর মাঝে মাঝে জেলা কমিটির সম্পাদক, সভাপতি মাসে হােক ছয় মাসে হােক একত্রে বসলে জেলা পর্যায়ের প্রতিনিধিরা যারা ওয়ার্কিং কমিটির মেম্বার নন, তাঁরাও সরাসরি তাদের প্রয়ােজনীয় বক্তব্য শুনে যেটা তাদের জন্য গ্রহণযােগ্য হয় সেটা গ্রহণ করবেন। যেটা গ্রহণযােগ্য নয় সেটাও আলাপ আলােচনার মাধ্যমে আমরা একটা সুষ্ঠু মতামতের ভিত্তিতে একমত হবার চেষ্টা। করব। এবং সেই মতটাকেও আমরা দলের সর্বনিম্ন পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছে দেব। বর্তমানে আমি যে জিনিসটা লক্ষ্য করেছি—খােলাখুলি বলছি, আমাকে একটু মাফ করবেন। চার বছর হয়ত পুলিশ টুলিশ দিয়ে আমরা ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা করতে পারব। গত মার্চ মাসে ইলেকশন হয়েছে। বর্তমানে যাদেরকে নিয়ে আমরা বিব্রত বােধ করছি, নাম বেশি বলতে চাই না। এক সময় ওরা আমাদের মধ্যেই ছিল । খুব বেশি দিনের কথা নয়, ওরা তখন আমাদের চাইতে ভাল কথা বলত এবং তখন সাময়িকভাবে অনেকে মনে করত ওরাই বােধহয় আসল কথা । বলছে। ওরা একসময় বলেছিল যে, বঙ্গবন্ধুকে আরাে বেশি ক্ষমতা দেওয়া দরকার। এই মন্ত্রীটন্ত্রিরা খুব বেশি সুবিধার নয়। তাদের আসল মতলব ছিল বঙ্গবন্ধুকে আস্তে আস্তে একা করে ফেলা—যেটা আমাদের শ্রদ্ধেয় সৈয়দ নজরুল সাহেব বললেন, একা করে একটু বিচ্ছিন্ন করে দেয়া—একা লােককে ধাক্কা দিয়ে ফেলে।

দেয়া খুব সহজ। তাঁদের মতলব কি ছিল ? এ রকমই একটা কিছু ছিল বােধহয়। তবে বঙ্গবন্ধু তার জীবনে অনেক দেখেছেন। সৈয়দ সাহেব যে নামগুলাে। বলেছেন তাদের এবং বাড়ির কাছের অন্যদেরও তিনি দেখেছেন। এক আল্লাহ, এক কোরআন ছিল মুসলমানদের মধ্যে মুসলিম লীগের একটা প্রচারণা। এর বিরুদ্ধে কোন চিন্তা বা কথা বলা যেত না, এমন কি মনে মনে চিন্তা করাও যেত না, সেটাও দেখেছি, বঙ্গবন্ধুও দেখেছেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর লিয়াকত আলি খানকে দেখেছি, তারপর গােলাম মুহম্মদ। গােলাম মুহম্মদকে আমাদের ছােট ভাই-বােনেরা দেখেন নাই। লােকটি একটা কথা । পর্যন্ত বলতে পারত না। কিছু বােঝা যেত না। একটা অপদার্থ, অথর্ব লােক, সেই লােকটারও কি ক্ষমতা আপনারা না দেখলে বুঝতে পারবেন না, সেটাও দেখলাম। ইসকেন্দার মির্জার কি ধরনের ক্ষমতা সেটাও দেখলাম। তারপর। আইয়ুব খাঁ এল। এই সময়ে রীতিমত আমাদেরও সংশয় দেখা দিয়েছিল যে । একজন লােক দশ বছর ক্ষমতায় কাটিয়ে গেছে, একটা মানুষের জীবনে আর । চাই-ই বা কি? যদি আরও পাঁচ-সাত বছর থেকে যেতে পারে তবে কাজ হয়ে । গেল। সেও দেখলাম। তারপর ইয়াহিয়া খান এলেন, তাকেও দেখলাম। ফলে বঙ্গবন্ধু এসব দেখে তাদের মতলবটা বুঝে গেছেন। ওই যে একা করবার একটা বুদ্ধি। সেই বুদ্ধি উনি নেননি। বঙ্গবন্ধুকে একা করে সব ধাক্কা তখন বঙ্গবন্ধুর । দিকে—তখন তাে সৈয়দ সাহেবকেও মারা লাগে না, মােশতাক সাহেবকেও মারা লাগে না। বঙ্গবন্ধুকে একটা ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলেই হয়। এই রকম। একটা অবস্থা সৃষ্টি করতে চেয়েছিল। যাই হােক আজকে সেই সমস্ত ধকল ।

কাটিয়ে আমরা এখনও টিকে রয়েছি। এখন কতকগুলাে বিতর্ক আসে। বিতর্ক যে আসে সে কথাটা আপনারা অনেকই । বলেছেন এবং আমি নিজেও কিছু কানাঘুষা শুনেছি বিভিন্ন জায়গায় যে, গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র না সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র। অথবা গণতন্ত্রের জন্য। সমাজতন্ত্র না সমাজতন্ত্রের জন্য গণতন্ত্র। এই সমস্ত প্রশ্ন কিন্তু এখন শুধু মনে। মনে না, কাগজপত্রেও বেশ প্রচার হয়েছে। আলােচনা হচ্ছে নির্ভেজাল সংসদীয় গণতন্ত্রকে রক্ষা করার জন্য, প্রয়ােজন হলে আমরা সমাজতন্ত্র ছাটাই করব। কিনা। অথবা সমাজতন্ত্রকে নির্ভেজাল সমাজতন্ত্র করবার জন্য গণতন্ত্রকে প্রয়ােজনবােধে ছাটাই করব কিনা, এই প্রশ্নটাও কিন্তু রয়েছে। তবে আমাদের অবস্থার প্রেক্ষিতে লক্ষ্য অনুসারে গণতন্ত্র সংসদীয় থাকবে। কাজেই আমরা যে সমাজ ব্যবস্থায় যাচ্ছি, মূল কথা হল সেই সমাজের রাজনৈতিক স্বাধীনতা কেন চাই ? রাজনৈতিক স্বাধীনতা চাই এই জন্য যে আমরা বাইরের হস্তক্ষেপ বা বাইরের প্রভাব মুক্ত আমাদের নিজেদের অর্থনীতি গড়ে তুলব এবং একটা সুখী, সুন্দর সমাজ আমাদের পরিকল্পনা অনুসারে গড়ে তুলব। সেই সমাজ গড়ার কাজে কোন কিছু যেন আমাদের অন্তরায় সৃষ্টি করতে না পারে সেই জন্য আগে রাষ্ট্রীয় যন্ত্রটা হাতে নিতে হয়—সেটার নামই রাজনৈতিক স্বাধীনতা। সেই রাজনৈতিক স্বাধীনতা আমরা বাঙালিরা পেয়েছি তার পেছনে রয়েছে একটা বিরাট ইতিহাস। আপনারা জানেন, সে সব শুনেছেন। আমাদের জেনারেল সেক্রেটারি তার রিপাের্টেও বলেছেন, এর আগেও বলা হয়েছে। আওয়ামী লীগের কোন নেতা বা কর্মী আওয়ামী লীগের ইতিহাস জানেন না এই কথাটা আমার জন্য চিন্তা করাটাও অন্যায়। কাজেই সেই যে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন থেকে আওয়ামী লীগ যে অধিকার আদায়ের আন্দোলন করেছে সেই আন্দোলনই ধাপে ধাপে প্রকটতর হয়ে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের মধ্যরাতে স্বাধীনতার আকার ধারণ করেছে।

এই রাজনৈতিক স্বাধীনতার যুদ্ধ কেন করলাম? কেন বাঙালি উদ্ভুদ্ধ হল। স্বাধীনতা যুদ্ধ অনেক দেশেই হয় এবং দেখা যায় স্বাধীনতা যুদ্ধে জনসাধারণের মধ্যে একটা ঐক্য আনা যায়। যেটাকে National Liberation বলা হয়। National Liberation Struggle এ মানুষ সাধারণত ঐক্যবদ্ধ হয়। একটা অর্থনৈতিক লক্ষ্য নির্দিষ্ট না থাকলেও মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়। যেমন ধরুন পাকিস্তানের সময় হয়েছিল এবং অন্যান্য দেশে হয়। কেন হয় ? National Liberationটা হয় সাধারণত বিদেশীর প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে অথবা বিদেশী প্রভাবের বিরুদ্ধে অথবা উভয়ের বিরুদ্ধে। দেশে বিভিন্ন শ্রেণীর যে সমস্ত লােক থাকে সেই প্রত্যেক শ্রেণী মনে করে বিদেশীরা থাকলে, বিদেশী শাসন থাকলে আমার ক্ষেত্রে আমি বড় হতে পারি , আরও বিকাশ সাধন করতে পারি না। তাই যে উঠতি পুঁজিপতি সে ভাবে পাকিস্তানি, ইস্পাহানি, আদমজি, বাওয়ানি, করিম এদের জন্য আমি আর উপরে উঠতে পারছি না। তাদের একটা প্রতিযােগিতা থাকে। আবার ধরুন শ্রমিক এবং মালিকদের মধ্যে থাকে যে, এই মালিক বেটাদের শােষণের জন্য আমি শ্রমিক আমার মেহনতের দাম পাচ্ছি না। আমি খেয়ে বাঁচতে পারছি না। এমনিভাবে প্রত্যেকে তার সমস্যাকে নিজের নিজের মত ভাবে দেখে। কেউ ভাবে যে, আমি  একজন ভাল শিক্ষক। অন্য দেশে শিক্ষকের যে মর্যাদা আমার দেশে তা নেই। ওই বিদেশীটার কারণে বােধহয় নেই। এই বিদেশীটা চলে গেলে হয়ত আমার মর্যাদা বাড়বে। ছাত্র মনে করে আমার লেখাপড়ার পরিবেশ সৃষ্টি হবে, আমি যদি স্বাধীন হই অর্থাৎ এই বিদেশীটা যদি চলে যায়। সাথে সাথে অবচেতন মনে পকেটমারও মনে করে যে, এই বিদেশীগুলাে থাকার জন্যই আমি পকেট মেরে মাত্র পাই এক টাকা, পাঁচ আনা। ধরা পড়ে যাই, কিলগুতাে খাই, তারপরও তিনবার জেল খাটতে হয়, নাম বদলাইয়া কামে নামতে হয়। বােধহয় জাতীয়। স্বাধীনতা হলে আমার ভাগ্য ভাল হবে।

কিন্তু কি ভাল হবে এটা কিন্তু সে । পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারে না, তবে এইটুকু বােঝে যে, জাতীয় স্বাধীনতা হলে। আমার উন্নতি হবে। পকেটমারের উন্নতি কি ? পকেটমারের উন্নতি তখনই হবে। যদি পকেট মারা ছেড়ে দিয়ে অন্য কোন কাজের সংস্থান তার হয়। কিন্তু। অবচেতন মনে সেটা থাকে না। মনে করে আমারও ভাল হবে। ভাল যে কি। হবে সেটার সুস্পষ্ট ধারণা কারাে থাকে না। তারা মনে করে স্বাধীনতা হবার। সাথে সাথে পকেটে হাত দিলে আমি অনেক পয়সা পাব। অথবা পকেটে হাত দিয়ে ধরা পড়লে আমার জেল-টেল হবে না। এই রকম এক একটা চিন্তাধারা থাকে National Struggle-এর সময়। National Liberation শেষ হয়ে গেলে তখন প্রত্যেকে যার যার চিন্তা অনুসারে সেই স্বাধীনতাটা ভােগ করতে চায়। আজকে আমাদের সমাজে সেই ধরনের অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে কিনা আমি বলতে চাই না, তবে আপনারা একটু চিন্তা করে দেখবেন। কারণ আপনাদের একটা। কথা বলি, আমাদের প্রগতিশীল নেতাদের দুই একজনকে আমি দেখেছি, তাদের সামনে বক্তৃতা করেও বলেছি, মনে মনে তারা রাগ করেছে, কিন্তু কিছু বলতে পারে নাই। আমিও বলেছি, দেখি, মারধাের কর কি হয়! এটা দেখেছি ১৯৭১এর নয় মাসে। আমি কবুতরের বাচ্চা জবাই করে কেমন করে সেটা দেখতে পারতাম না। তারপর মানুষ মারার জন্য ১৯৭১ সালে নিজে সংগঠন করেছি। কাজেই এখন আমার ভয়-ডর নাই, মেরে ফেলে গেলাম। কিন্তু মারবার আগে। একবার দেখে যাব এটাও ঠিক। সামনেই বলেছি, এই যে গাড়িটা চালাও এটা। কি তােমার বাপের ছিল ? তােমার কিনবার মত কি পয়সা হয়েছে ? বু বুকটা তাে ঠিক করে নিয়েছ!

বু বুক কিন্তু বদলে ঠিক করে নিয়েছে। বহু গাড়িওয়ালা। আছে—এই অবস্থা। আরও উদাহারণ আছে, যেমন বাড়ি। দেখবেন, একটা বাড়িতে একজন থাকে। যেটা সরকারের কাছ থেকে বরাদ্দ করে নেয়নি, দিব্যি দখল করে আছে। দুই একজন সম্পর্কে এরকম জানা যায়, তারা কোন দলের কি ? অন্তত তারা যে। কোন ভাল দলের নয় তা আমি জোর দিয়ে বলতে পারি। দুই/তিনটা বাড়ি দখল করে রেখেছে। নিজে একটায় থাকে আর তিনটা ভাড়া দেয়। ছাড়ে না কেউ, এমনও আছে। এটা কেন হল ? এটা আমার মনে হয়, এই যে স্বাধীনতার আগে মনে মনে তাদের ধারণা ছিল যে স্বাধীনতা হলে পরে, আমি সব করতে পারব। এইরকম একটা ধারণা তাদের মধ্যে হয়ে গেছে। মাফ করবেন আমাকে, আমি খােলাখুলিই বলব। আমার শ্রমিক ভাইয়েরা, স্বাধীনতার আগে তাদেরকে সুস্পষ্ট ধারণা বােধহয় আমরা দিতে পারি নাই।। বঙ্গবন্ধুকে বলছি না। আমরা যারা তার সহযােগী ছিলাম তারা এর দায়িত্ব নিচ্ছি। বােধহয় তাদেরকে সুস্পষ্ট ধারণা দিতে পারি নাই যে, সমাজতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ কি? কলকারখানার জাতীয়করণের অর্থ কি ? আমি সকলের কথা বলছি , ভাল মন্দ সব জায়গায় আছে। আমার শ্রমিক নেতা ভাইয়েরা বােধহয় কথাটা ভুল বুঝেছিল যে স্বাধীনতা পেলে সমাজতন্ত্র হবে। সেই সমাজতন্ত্রে কল-কারখানার মালিকানাটা ঐ দশ টাকার শেয়ারারদের কাছ থেকে শ্রমিকদের দিয়ে দেয়া হবে এবং শ্রমিকদের দিয়ে দিলে তারা তাে আর ম্যানেজ করতে পারবে না, তখন শ্রমিক নেতা হিসেবে আমি ম্যানেজ করব। এই রকম বােধহয় একটা ধারণা ছিল। কিন্তু এটা সমাজতন্ত্রের গুণ নয়। এটা সমাজতন্ত্রের ধারণা নয়।

সমাজতন্ত্রে জাতীয়করণ যেটা করা হয় সেটা সমাজের নিয়ন্ত্রণে আসে। সমাজের মালিকানায় আসে। কোন গােষ্ঠী বিশেষের বা শ্রেণী বিশেষের হাতে আসে না। যাই হােক এই ধারণা থেকেই স্বাধীনতার পর অপকর্মটি হয়েছে, আমাদের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে। স্বাধীনতার পর কিছুদিন বেশ ভালই ছিল, বিশ্বাস করুন, একাত্তরে নিলাম করে করে পাকিস্তানিরা আমার যে সব জিনিস বিক্রি করেছিল তারও কিছু আমি ব্যক্তিগতভাবে ফেরৎ পেয়েছিলাম, স্বাধীনতার দশ পনের দিনের মধ্যে। তারপরে দশ, পনের, বিশদিন একমাস পরে এমন একটা অবস্থা হয়ে গেল যে ফেরৎ দেওয়া দূরের কথা, পারলে আপনার ঘড়িটা খুলে নিয়ে যায় । এইরকম একটা অবস্থা হয়ে গেল, এটা কেন হল ? সেই সম্পর্কে ভবিষ্যৎ নেতৃত্বে যারা আসছেন তাদের কাছে আমার আবেদন, সামনে নেতৃত্ব আমাদেরকে দিতে হবে। তাই এই তরুণদেরকে দুষ্কৃতকারী বলে দোষ দিলে চলবে না। ভাল মানুষও দুষ্কৃতকারী হয়ে যায়। যদি ভাল ছেলেদেরকে বিশেষ করে তরুণ সমাজকে কাজ দিতে না পারেন। বঙ্গবন্ধু ডাক দিয়েছিলেন। ৯ মাসের স্বাধীনতা সংগ্রামে আপনারা দেখেছেন এই তরুণরা কি ভাবে সংগ্রাম করেছে। তাদের পাশের ভাইটি প্রাণ দিয়েছে, সামনের ভাইটি পঙ্গু হয়ে শেরে বাংলা নগরে পড়ে আছে, একটা গুলি এদিক সেদিক হলে আজ যারা সশরীরে ভাল আছেন তারাও মারা যেতেন। মৃত্যুর জন্য তারা তৈরি ছিলেন। নয় মাসে যুদ্ধ শেষ না হয়ে যদি নয় বছর লাগত এই তরুণরা সংগ্রাম করত, তাতে কোন সন্দেহ নাই। আজকে তারা যদি বিপথে গিয়ে থাকে তবে কেন গেল, আমাদের তা চিন্তা করে দেখতে হবে। আমার ভাইয়েরা দুই একটি কথা। বলে পারছি না।

তরুণ সমাজ অদম্য শক্তির অধিকারী, এই শক্তিকে যদি সুষ্ঠু পথে পরিচালনা করা না যায়, তা হলে সেই শক্তিটা যদি বিপথে যায় বা উদ্দেশ্যবিহীন, লক্ষ্যবিহীন হয়ে যায় তবে অবস্থা মারাত্মক হয়ে দাড়ায়। একটা গল্প বলি, এক লােকের খায়েশ হয়েছে, যা খুশি তাই সে করতে পারবে এরকম একটা শক্তি তার দরকার। তখন সে বহু খুঁজে টুজে এক পীরের কাছে গিয়েছে। পীরকে বলছে আমি এমন একটা ক্ষমতা চাই যার ফলে আমার ” ইচ্ছা হবে তাই যেন আমি করতে পারি । পীর বলছে জিনিসটা কিন্তু বেশি ভাল হবে না। লােকটা বলে, না তবুও শেখান। তারপর পীর একটা মন্ত্র শিখিয়ে দিয়ে বলেছে পরিষ্কার ঘরে খালি মাটিতে বসে ৪০ দিন এই মন্ত্র জপ করতে হবে। জপ করার পর এক দৈত্য আসবে। সেই দৈত্যকে তুমি যা বলবে মুহূর্তে সে তা করে দেবে। অবশেষে সেই মন্ত্র জপ করার পর ঐ দৈত্য এসে হাজির হয়েছে। এদিকে পীর কিন্তু বলেছিল দৈত্যের শর্ত হল, যদি তাকে কাজ দিতে পার তবে সে তােমার ঘাড় মটকাবে। অতঃপর দৈত্য যখন এসে হাজির হয়েছে তখন সে কি বলবে! তাড়াতাড়ি সে বলে যে, আমার জন্য একটা সাততলা বাড়ি বানিয়ে দাও। সাথে সাথে দৈত্য বাড়ি বানিয়ে দিয়েছে। তখন বলে যে, একটা পুকুর কেটে দাও, সে তাই কেটে দিয়েছে। বলে যে, একটা শহর বানিয়ে দাও, তাই দিয়েছে। কোন পরিকল্পনা টরিকল্পনা নাই, উপস্থিত বুদ্ধিমত যা মনে এসেছে, যা মুখে এসেছে তাই বলেছে, তারপর এক সময় আর কিছু মনেও আসে না। তখন দৈত্য হাজির হয়েছে তার ঘাড় মটকাবে, ভয়ে সে দৌড়, দৌড়, দৌড়, দৈত্য ধরে ধরে অবস্থা। এমন সময় পীর ধ্যানে বসে দেখতে পেল শিষ্য মহাবিপদে।

তাড়াতাড়ি পীর শিষ্যকে উপদেশ দিয়ে বললেন, তােমার বাড়িতে যে কুকুরটা আছে দৈত্যকে সেখানে নিয়ে যাও এবং দৈত্যকে বল তােমাকে কিছু ঘি যােগাড় করে দিতে। উপদেশ মত লােকটি দৈত্যকে সেই নির্দেশ দিল। দৈত্য কুকুরের কাছে গেল এবং ঘি যােগাড় করে দিল। এবার পীর তার শিষ্যকে চূড়ান্ত নির্দেশ প্রদান করে বললেন, শিষ্য এবার দৈত্যকে ঘি দিয়ে তােমার কুকুরের লেজ সােজা করতে বল। অতঃপর দৈত্য। কুকুরের লেজ সােজা করতে লেগে গেল। সে যতবার লেজ সােজা করে ততবার তা বাঁকা হয়ে যায়। অতএব কাজটি অনন্ত। এ কাজ শেষ হবার নয়। এদিকে দৈত্যকে কাজ দেওয়া গেল শিষ্যের মাথা বেঁচে গেল । পীর নিশ্চিন্ত হলেন। তেমনিভাবে আমাদের যুব শক্তিকে কাজ দিতে হবে। অন্যথায় তারা আমাদের ঘাড় মটকাবে। এটাতাে খুবই স্বাভাবিক। অন্যদিকে সমাজতন্ত্রের নামে আমাদের দেশে ব্যবসা চলছে। সমাজতন্ত্র সম্পর্কে সুষ্ঠু ধারণা না থাকার ফলে এটা হচ্ছে। আজকে সমাজতন্ত্রের যারা ঘাের বিরােধী, ধরে নিন তারা বিদেশী রাষ্ট্রের চর, ধনতন্ত্রের চর, তার পক্ষে সমাজতন্ত্রের বিরােধিতা করে সামনে আসা সম্ভব না। কাজেই সমাজতন্ত্রের নামেই আসতে হয়। আবার এই সমস্ত লােকেরা দেখেছে বাংলার মানুষের মনােভাব এমন যে এর বিরুদ্ধে বললে মানুষ পছন্দ করবে না। কাজেই পছন্দ করা সত্ত্বেও তার মুখেও সমাজতন্ত্রের স্লোগান। শুধু সমাজতন্ত্রের শ্লোগান না,। বঙ্গবন্ধুর থেকেও বেশি স্লোগান দিয়ে দেয় তারা। মায়ের চাইতে মাসীর দরদ বেশি হয়েছে। বলবেন এটা কি রকম? যেমন, ধরুন আমাদের সদরঘাটে কোন পকেটমার ধরা পড়লে সে কোনরকমে মাথা ফসকে বের হয়ে দৌড় দেয় আর বলে, পকেটমার! পকেটমার! কারণ যেন অন্য লােক বুঝতে না পারে সে যে  পকেট মার। আজকে CIA এর দালাল যারা তারাও বলে CIA, CIA, CIAতখন আপনারা বুঝতে পারেন না কোনটা আসল CIA. এই অবস্থা যে আজকে কিছু কিছু চলছে না এ কথা বলা চলে না। কাজেই এ থেকে আমাদের সতর্ক এখন অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কথা বলতে গেলে বলবেন যে, ধান বানুতে শিবের গীত কেন গাইলেন ? কোন সুষ্ঠু অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কথা কল্পনাও করা যায় , যদি সামাজিক পরিস্থিতির একটা মােটামুটি স্থিতিশীলতা না থাকে এবং সামাজিক পরিস্থিতি যদি অর্থনৈতিক কার্যকলাপ করার উপযােগী না হয়। আজকে স্বাধীনতার সাথে সাথে আমাদের অর্থনৈতিক কাজেরও উপযােগিতা বিনষ্ট হয়েছে।

আগে যা ছিল তা থেকেও বেশি বিনষ্ট হয়েছে। কেন হল তা আমি এই স্বল্পপরিসর সময়ে আলােচনা করতে চাই না। ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব নিশ্চয়ই সেই সুযােগ আপনাদেরকে দেবেন। আমি একজন সাধারণ কর্মী হিসেবে এই সুযােগে দাবি করব। শুধু কেন্দ্রে বসে নয় জেলায় জেলায় আমরা যাব, সেই কর্মসূচি নিতে হবে, এই কর্মসূচি না নিলে চলবে না। আমরা মন্ত্রী নামক যে জীবগুলাে আছি তাদের দুর্ভাগ্যের কথা শােনেন। আমাদেরকে মনে করা হয় যে মন্ত্রী হওয়া মানে ফাইল করা। মন্ত্রী হওয়া মানে কিছু তদবির টদবিরের ব্যবস্থা করা। কিন্তু এটা যে মােটেও একটা স্বাধীন, উন্নয়নকামী প্রগতিশীল রাষ্ট্রের কর্তব্য নয় সেই কথাটি সকলকে বােঝাতে হবে। আজকে আমাদেরকে যারা বুঝতে না পারবে তাদেরকে বােঝাবার দায়িত্ব আপনাদের, আমাদের, সকলের। আজকে মন্ত্রীদের কাছে তাঁরা যে সমস্ত কাজ নিয়ে যায় সেই কাজটি কিন্তু থানা পর্যায়েই হয়ে যেতে পারে। বঙ্গবন্ধু মাঝে মধ্যে বলেন যে, আমাকে তাে তােমরা দারােগা বানাইয়া ছাড়ছ!’ কোন থানায় কি হবে সেটাও বঙ্গবন্ধুর কাছে। যদি হােম মিনিস্টার বলেন যে, আমি একটু শুনি, জবাব আসে, না, না, আপনার সাথে কি কথা বলব, আমরা বঙ্গবন্ধুর কাছে যাব। একেবারে সরাসরি। সংগঠনের ব্যাপারেও দেখেছি। ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যে সমস্যা জেলার করা উচিত, থানার করা উচিত সেখানে না যেয়ে, সােজা কেন্দ্রে। তাও জেনারেল সেক্রেটারি না, অর্গানাইজিং সেক্রেটারি না সােজা গণভবনে! তারা হয়ত বঙ্গবন্ধুর দর্শন লাভের আশায় সেখানে যায়, কিন্তু তাতে দেশের বড় ভয়ানক ক্ষতি হয়ে যায়। কাজেই এই জিনিসগুলাে আমাদের একটু চিন্তা করা দরকার।

এগুলাে চিন্তা করতে হলে সাথে সাথে আবার একটা প্রশ্ন এসে যায়— স্থানীয় যে সমস্যা, সেই স্থানীয় সমস্যাগুলাের বিবেচনা কি ভাবে করা যাবে ? তারও তাে একটা সুরাহা হওয়া দরকার। কোন জায়গায় গেলে এই সমস্যার কথাটা বলা যাবে, এর প্রতিকারের একটা নির্দেশ পাওয়া যাবে, সেটাও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের কাছে আমার দাবি ভবিষ্যতে তারা যেন সেই ব্যবস্থা। করেন। আমাদের কর্মীদের, আমাদের স্থানীয় নেতাদের যে স্থানীয় অসুবিধাগুলাে রয়েছে সেই অসুবিধা বলার মত ফোরামের দরকার। সেই ফোরাম আমাদের সৃষ্টি করতে হবে। সেই ফোরামের মাধ্যমে প্রয়ােজন হলে সরকারের সাথে যােগাযােগ করতে হবে। তা না হলে শুধু যদি কমেিদর  উপদেশ দেই যে, আপনারা আমাদের কাছে আসবেন না তাতেই সমস্যার সমাধান হবে না। এবার আমি অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে আসছি। কলকারখানার কি অবস্থা হয়েছে। তা খুলনা, নারায়ণগঞ্জ, চিটাগাং এবং সেখানে যে অল্পবিস্তর শিল্প আছে সে সব যারা দেখেছেন তাদেরকে কি বুঝিয়ে বলবার দরকার আছে? মােটেই না, কারণ অবস্থা এমন হয়ে গেছে যে প্রত্যেকে আমরা স্বাধীন। কারাে কাজ করার দরকার নাই। ব্যবসা বাণিজ্যের কথা বলতে গেলে একটা কথা এসে যায়। গতকালেও এই কথাটি হয়েছে এবং আগে পরে সবসময় এই কথাটি হয়, সেটা হল পারমিট লাইসেন্সের কথা। সংমিশ্রিত অর্থনীতির কারণে কিছু পারমিট-লাইসেন্সের ব্যবস্থা যখন এখনও আছে তখন একজনকে না একজনকে এটা করতে হবে, যতদিন পর্যন্ত পারমিট প্রথা উঠিয়ে দেওয়া না যায়। এই ক্ষেত্রে এটা কমিয়ে আনার জন্যে টিসিবি নামক যন্ত্রটির হাতে কিছু ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। এখন টিসিবি জিনিসটা কি? সেখানে আমাদের যে কর্মচারিরা রয়েছে এই প্রসঙ্গে বলি। ভাইয়েরা একটা কথা নির্লিপ্তভাবে মনে করতে হবে দোষত্রুটি যদি কারাে থাকে সমষ্টিগতভাবে যদি দোষী হয়, সমষ্টিগতভাবে নিশ্চয়ই তাদেরকে আমাদের ধরতে হবে।

প্রতিকার করতে হবে। প্রয়ােজনবােধে তাদেরকে বিতাড়িত করতে হবে কিন্তু ঢালাওভাবে যদি আমরা বলি, ঢালাওভাবে বললে কাজের অসুবিধা হয়। আর সরকারী কর্মচারি কারা ? এখানে যারা আছেন, জিজ্ঞাসা করে দেখুন নিজেদের মনকে, কোন না কোন সরকারী কর্মচারি হয় আপনার ছেলে, না হয় আপনার বড় ভাই, না হয় ছােট ভাই, না হয় মামা, না হয় ভাগিনা, না হয় চাচা, না হয় ফুপা, না হয় খালু। আজকে বাংলাদেশ ছােট দেশ, জনসংখ্যা অনেক বেশি। আজকে আমি আপনাদেরকে নাম উল্লেখ না করেই বলছি, একজন দারােগাকে আমি জানি স্বাধীনতার সময় মানুষ হত্যা করিয়েছে। কিন্তু সেই দারােগার চাকরি ডিসমিস করা গেল না। কেন গেল না ? সেই দারােগার পক্ষে আমাদের অনেকেই ছিলেন। মাফ করবেন, আমি মন্ত্রী বলে যে, মন্ত্রীদের বাঁচাচ্ছি, তাও না। মন্ত্রিত্বের বাইরে যারা উচ্চপদস্থ নেতৃত্বে আছে তারা protection দিয়ে রেখেছেন। একটা নয়, এরকম বহু ঘটনা আপনাদেরকে দেখাতে পারি। কিন্তু এখানে আমরা অনেক লােক বসে আছি, সময়ও নাই, তবুও আপনাদেরকে কয়েকটি ঘটনা একটা একটা করে দেখাই যে, এই এই অফিসার এই এই কাজ করেছিল। হাকিম হুকুম দিয়েছিল, খবর দাও, কান ধরে নিয়ে এসেছিল। সেই অফিসার আমাদের কারাে না কারাে আত্মীয় স্বজন। একজন সাজা দিতে চাইলে, পাঁচজন তার বিরােধিতা করে। আমি নিজে দুই একজায়গায় গিয়ে দেখেছি।

তার মধ্যে একজায়গার কথা বলি, আমাদের এক অফিসারের বিরুদ্ধে অভিযােগ এল। তিনি এসডিও না ডিসি তা আর পরিষ্কার করে বলছি না, কারণ যারা তা জানেন তারা বুঝে যাবেন অভিযােগের জন্য যখনই পাঁচজন নেতাকে নিয়ে হুকুম দিলাম এই পদক্ষেপ গ্রহণ করেন, ঠিক দুই ঘন্টা পরেই আর দশজন এসে বলছে যার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছেন তাঁর মত ভাল মানুষ হয় না। ও আওয়ামী লীগের সাংঘাতিক উপকার করে এখন বলুন কি করবেন ? আমি যখন গত বছর একসময় রাজশাহী জেলার নবাবগঞ্জ গিয়েছিলাম। সেখানে আমাকে কয়েকজন বলেছিলেন, একজন আমাদেরই কর্মী ছিল, সে লাইসেন্স টাইসেন্স নিয়ে দু’পয়সা বানিয়ে এখন অন্য রাজনৈতিক দলে আশ্রয় নিয়েছে। নামটা আমি বললাম না। তাদের কথা অত প্রচার করতে চাই না। আর এমন অনেক জায়গায় আছে, দিনে আওয়ামী লীগ করে রাতে অন্য দলের সাথে যােগ রাখে। এই বর্ণ চোরদেরকে আপনাদের ঠিক করতে হবে। এটা যদি করা না যায় তবে অসম্ভব, কিছু করা যাবে না। মনে রাখবেন একটা দেশ চালাতে হলে তার সরকার কোনদিনই effective হবে না যদি না, তার পেছনে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান থাকে। আপনার নিজের দলের ভেতরে স্থানীয়ভাবে যদি কোন্দল থাকে, তবে বিপর্যয় আপনারা নিজেরা ভােগ করেন, কিন্তু আমরাও সেই সাথে কম শাস্তি ভােগ করি না। আমার আওয়ামী লীগ যদি দুর্বল হয়ে যায় আমি মন্ত্রী, এই যে পতাকাটি উড়িয়ে যাই, বিভিন্ন ঘটনায় আমি লজ্জাবােধ করলে এই পতাকাটি হয়ত একটা টিটকারি হয়ে যাবে।

টিটকারি হবে তখন যখন আমার আওয়ামী লীগ দুর্বল হবে। যখন আওয়ামী লীগ দুর্বল হবে না তখন কেউ টিটকারি দিতে সাহস পাবে না। যদি কোন ব্যক্তিবিশেষকে, কোন মন্ত্রীকে আপনাদের অপছন্দ থাকে, আপনারা বঙ্গবন্ধুর কাছে আসুন, আপনাদের সংগঠনের কাছে আসুন, এসে বলুন তার সম্বন্ধে। সে মন্ত্রী কোন উত্তরাধিকার সুত্রে পৌত্র-পৌত্রাদির ওয়ারিশানক্রমে ভােগ দখলের জন্য মন্ত্রিত্বে আসেনি। তাকে সরিয়ে দেবার অধিকার আপনাদের আছে। কিন্তু প্রকাশ্যে তাকে মন্ত্রিত্বেও রাখবেন আবার গালিগালাজও দিবেন তাহলে পরিণামে আওয়ামী লীগ দুর্বল হয়। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে লিফলেট বের হয়। যে অমুক তাে চোর ? আওয়ামী লীগের লােকেরাই বলছে। ওমুক permit hunter, আওয়ামী লীগাররাই বলেছে। আর রিলিফ কমিটি! এই রিলিফ কমিটির চেয়ারম্যান হয়ে আমার খুব ভাল ভাল কর্মী দোষের ভাগী হয়েছে, কিন্তু সবাই দোষী ছিল না। কিছু কিছু দোষী ছিল হয়ত, সব দোষী ছিল না। আমি জানি বিভিন্ন গ্রামে আমার কর্মী যারা আছেন আপনারা যদি দলের জন্য টাকা দিয়ে থাকেন, এক টাকার সাথে আরও চার আনা তার নিজ পকেট থেকে খরচ হয়েছে। আমাদেরকে বাংলার একটা চরিত্রের কথাও চিন্তা করতে হবে। বাংলা সমস্যাসংকুল দেশ এবং সমালােচনামুখর দেশ। এখানে আমি হলফ করে বলতে পারি পরীক্ষা করে দেখতে পারেন।

আমি বাংলাদেশের যে কোন জায়গায় একটি জনসভা থেকে বঙ্গবন্ধুর অনুমতি নিয়ে ঘােষণা করব যে, পাঁচ হাজার টাকা এক গ্রামের লােকজনের মধ্যে বিতরণ করা হবে। সেই টাকা সবচাইতে ভাল কমাটির হাতে দিবেন। সেই কর্মী এর সাথে আরও পাঁচ হাজার টাকা যােগ দিয়ে মােট দশ হাজার টাকা যদি খরচ করে তারপরও কিছু কিছু লােক বলবে যে, টাকা পয়সা বাটা হলদি’, এটা হাতের মধ্যে পড়লে কি কিছু লাগে নাই ? এই হল বাংলাদেশের চরিত্র। আপনি নিজের পয়সা খরচ করে দশটা গরু জবাই করে অথবা ৫০টা খাসি জবাই করে একটা মেজবানি (দাওয়াত) খাওয়ান, লােকজন মেজবানি খাওয়ার পরে বাড়ি যাবে আর রাস্তায় রাস্তায় গল্প করবে, একজন আর একজনকে জিজ্ঞাসা করবে, কি কেমন খেলে ?৫ জন বলবে, খুব খেলাম, ভালই হয়েছে। অন্যজন বলবে, , ওই তরকারিটায় একটু পােড়া পােড়া গন্ধ লেগেছে। আর একজন বলবে আরে শালার নিয়তই ভাল ছিল না। যিনি খাওয়ালেন, হাজার হাজার টাকা পয়সা খরচা করলেন, তিনি রাধেনও নাই, বাবুর্চিও তিনি না, সব দিয়ে দিলেন, তারপরেও কিছু লােক বলবে ওর নিয়ত ভাল ছিল না তাই একটু পােড়া লেগে গেছে, তরকারিটা একটু গন্ধ হয়ে গেছে ইত্যাদি। কাজেই এই স্বভাব আমাদের আছে, এই স্বভাবটা ভুললে চলবে না। এই স্বভাব পরিবর্তনের | দায়িত্ব আপনাদের সকলের। সেই সাথে আমাদেরও একইভাবে।

আজকে যারা রিলিফ কমিটির বিরুদ্ধে কথা বলছেন, কি ছিল আপনার গ্রাম পর্যন্ত ? গ্রাম পর্যন্ত সংগঠনটা কোথায় ছিল স্বাধীনতার পরে, একটু ভেবে দেখুন। তাে! এই এমসিএ আর রিলিফ কমিটি ছাড়া অন্য কোন সরকারী সংগঠন তখন | ছিল না। তারাই কাজ করেছেন, সাধ্যানুযায়ী কাজ করেছেন। আমি মনে করি এমনিভাবে দলের জন্য উৎসর্গীকৃত মনােভাবাপন্ন আমাদের অনেক কর্মীকে তৈরি হতে হবে। যেটা সত্যি সেটা করতে হবে। তাতে যদি অপ্রিয়তা আসে পাঁচ বৎসর যদি নির্বাচনে জয়লাভ করতে না পারি, তাতে কিছু আসে যায় না। আমরা মুসলিম লীগ নই যে, ইলেকশনে হেরে গেলে বিরােধী দলে না বসে ঐ দল ছেড়ে দিয়ে নতুন দল বানাব। একদল ভেঙ্গে পাঁচ দল বানাব। গণতন্ত্রের মূল কথা হল আমি যদি জনগণকে সাথে নিতে না পারি, আমার দোষের জন্যই হােক বা জনগণের ভুল বােঝার জন্যই হােক, যে জন্যই হােক, জনগণ যদি আমাকে না চায় তবে আমি নির্দ্বিধায় বিরােধী দলে বসব। অর্থাৎ বা হাতের দিকে বসে যাওয়া এবং জনসমর্থন যারা পাবে তাদেরকে ডান হাতের দিকে বসতে দেওয়া। এটা হল গণতন্ত্রের একটি মূল কথা, যে গণতন্ত্রকে আমরা সংবিধানে রেখেছি। কাজেই আজকে আমাদের এই নীতিগুলােকে মনে রাখতে হবে । যেটা আজ কোনভাবেই আমরা মনে রাখতে চাই না। অর্থনীতির কথা যদি বলেন, আমাদের অনেক দুর্যোগ ছিল। অনেক অভাব আছে। বাংলাদেশে খাদ্যের অভাব চিরকালই ছিল। সবসময় আমদানি হত। বাংলাদেশে কাপড়ের অভাব চিরকাল ছিল। আপনারা বলবেন, কাপড়ের অভাব। ছিল এটা আপনি কি বলেন, এতদিন তাে আমরা অভাব বােধ করিনি। আমি দৃষ্টান্ত দিয়ে দেখাচ্ছি। দু’একটা কথার বেশি বলতে পারব না। পরে দরকার হয়। সেমিনার করেন। এই সেমিনারে প্রসঙ্গে আমি আওয়ামী লীগকে পরামর্শ দেব, কালচারাল সেক্রেটারি যিনি হবেন তিনি দেশের অর্থনৈতিক ইস্যুর উপর সপ্তাহে না হলে পনর দিনে একটা সেমিনার করবেন। বিভিন্ন burning problem এর ওপর সেমিনার করবেন। যে সমস্যা নিয়ে আলােচনা হবে সেখানে সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় মন্ত্রী উপস্থিত থাকবেন। মাঝে মাঝে একাধিক মন্ত্রীও থাকবেন, এটা করতে হবে।

এবার আমি উদাহরণ দিচ্ছি। প্রথমেই ধরুন ঔপনিবেশ কাকে বলে, ঔপনিবেশ জিনিসটা কি? ঔপনিবেশের সােজা কথা হল, একটা বিদেশী শাসন, যে শাসন শুধু সাম্রাজ্যবাদী কায়দায় শাসন করেই ক্ষান্ত নয়, যারা নিজের দেশে finished products তৈরি করার জন্য ঔপনিবেশের কাঁচামাল নিয়ে যাবে। ঔপনিবেশে সংগৃহীত মূলধন নিয়ে যাবে। এই হল ঔপনিবেশের মূল চরিত্র। বাংলাদেশ আর পাকিস্তান যখন একত্রে ছিল তখন বাংলাদেশকে তারা বাজার হিসেবে ব্যবহার করেছে। এই বক্তৃতা শুধু বঙ্গবন্ধু না আপনারা সকলেই করেছেন। দু’বৎসরের মধ্যে সেটা যদি কেউ ভুলে গিয়ে থাকেন তবে নিশ্চয়ই আপনাদের দায়িত্ব তাকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া। ১৪ আগস্ট ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান যখন হয়েছিল সেদিন। পূর্ব-বাংলায় আজকের বাংলাদেশে কাপড় ও সুতাকলের সংখ্যা ছিল আট । পাকিস্তানের ২৪ বছরের মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তান শুধু কাপড় ও সুতায় স্বয়ংসম্পূর্ণই হয় নাই, তাদের সুতার বাজার বাবুর হাট, মাধবদি, শাহজাদপুর বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল। ঐ মমিন নগর থেকে শুরু করে সারা বাংলাদেশে আমার তাতি ভাইদের সুতা আসত পাকিস্তান থেকে, তারা এখানে বাজার। করেছিল, সুতার কল এখানে হয় নাই। ১৯৪৭-এ পশ্চিম পাকিস্তানে ছিল মাত্র দু’টো সুতা এবং কাপড়ের কল—ভাওয়ালপুরে একটা আর একটা করাচী এলাকায়। দু’টোই ছিল ওদের আর আমাদের ছিল আটটি কিন্তু তারা নিজেরা স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে আপনার জায়গায় বাজার বানিয়েছে। বাজার বানাবার ফলে পাকিস্তানের যে কাপড় আপনার জন্য এখানে আসত, আপনার যা চাহিদা, সে জন্য তারা আপনাকে কিছু কিছু সুতা দিত, স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে দেয় নাই আজকে আমরা পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ করে স্বাধীনতা লাভ করেছি, বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি। ইংরেজের সাথে ভারতবর্ষ এবং পাকিস্তান আপােসে যে ভাবে বিচ্ছিন্ন হয়েছে আমরা সেইভাবে বিচ্ছিন্ন হই নি।

আপােসে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভারতবর্ষ ও পাকিস্তান। যেমন করেছিল সেই সময়ে বিলাতের জিনিসপত্র কিছু কিছু আনত যতদিন পর্যন্ত তারা স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে পারেনি । আর পাকিস্তানের সাথে আমাদের স্বাধীনতাটা হয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশে, যুদ্ধের মাধ্যমে। পাকিস্তানের সঙ্গে আজও আমাদের কোন রকম সম্পর্ক নেই। কাজেই পাকিস্তান থেকে হঠাৎ করে। যদি কাপড়ের সাপ্লাইটা বন্ধ হয়ে যায় আপনার কি অবস্থা হতে পারে ? আর। একটা কথা চিন্তা করে দেখুন, লুঙ্গি এবং শাড়ি এই উপমহাদেশের কিছু লােক ছাড়া এমন কি ভারতেরও সকলে পরে না। পশ্চিম বাংলা এবং সীমান্তবর্তী এলাকাগুলােতে পরে, পাকিস্তানের কেউ পরে না, তারা আপনাদের জন্য বানাত। বাজারের জন্য বানাত। এখন যদি জাপান থেকে আপনি শাড়ি কিনতে চান, পাবেন না। আমেরিকা থেকে যদি শাড়ি কিনতে চান, পাবেন না, পাবেন স্কার্ট-শার্ট-গাউন। এখন এই পরিস্থিতিতে এই যে বিরাট gap এই gap পূরণ করতে ভারত থেকে কাপড় আনা হয়েছে। তাতে ভারতের বিরুদ্ধে সেই কি সমালােচনা! ভারত থেকে ৯ হাত শাড়ি এনেছে, সাড়ে নয় হাত শাড়ি এনেছে, এটা ভারতের দোষ। আমি বলি ভারত কি আপনাকে এই শাড়িটা জোর করে দিয়েছে ? না আপনি দেখে শুনে পছন্দ করে এনেছেন? আপনারা পছন্দ করে এনেছেন। আর ৯ হাত শাড়ি যদি আসে, বাংলার গ্রামের মেয়েরা ফ্রক পরে না। শাড়িই পরে। ঐ ছােট মেয়েদের কি ৯ হাত শাড়ি লাগে না। আমি জোর দিয়ে বলতে পারি, বাংলার তাতে যে কাপড়-শাড়িগুলাে তৈরি হয় তা শহরের মহিলাদের জন্য না। ভদ্র মহিলাদের শাড়ি ১১ হাত বা ১২ হাত হয়। আরাে এক দেড় হাত দিয়ে ব্লাউজ হয়। আজকে ভারত থেকে আমদানি করা সাড়ে ৯ হাত শাড়ি—যেটা গরীবের জন্য, সেটা যদি আপনারা কিনতে যান, কিংবা কেউ কিনলে বা ভদ্রমহিলা কিনলে তার কাছে তাে খাটোই হবে। খাটো হলে তিনি যেহেতু vocal শহরে থাকেন উন্নতমনের মহিলা আর খবরের কাগজের লােকেরা আশেপাশেই আছে বলে দিলেন যে, শাড়ি ছােট। কত ছােট, কি বিধান, কি শানে নজুল কিছুই বললেন না। এই নিয়ে আরম্ভ হয়ে গেল একটা রব যে, সমস্ত দোষ ভারতবর্ষের। এখন বলি আমরা সুতা বিতরণের জন্য সুতা বিতরণ কমিটি করেছি। তারপর সমবায় করেছি। কতরকম experiment যে করেছি।

আচ্ছা এই কমিটিগুলিতে কারা কারা ছিল বলুন ত দেখি, ওতে কি কোন ফেরেস্তা টেরেস্তা ছিল, না ভারতের লােক ছিল, নাকি আমেরিকার লােক ছিল, না রাশিয়ার লােক ছিল, না কি আমাদের লােকজনই ছিল ? সকলেই বলে চোর, চোর, চোর। তবে চুরি করে কে, কে তারা ? আমি তাে এই পর্যন্ত শুনলাম না বিগত দু’বছরে যে, কোন কর্মী এসে খাস করে বলেছে যে আমার চাচা ঐ রিলিফের চাল চুরি করেছে। এমনতাে কেউ বলেনি। ঐ পল্টন ময়দানে বক্তৃতা করে দুর্নীতি ধরে ফেলতে হবে আর ধরা পড়লে বাড়িতে এসে বলে তাজউদ্দীন ভাই আমার খালু ধরা পড়েছে, ওরে ছেড়ে দেন। আমি বলি যে, তুমি না বক্তৃতা করে এলে ? উত্তর দেয় বক্তৃতা করেছি সংগঠনের জন্য, আমার খালুরে বাঁচান, এই হল বাংলাদেশের অবস্থা। সামাজিক বয়কটই না। কোথায় ? দুনীতি যারা করে তাদের বিরুদ্ধে সামাজিক বয়কট করতে হবে সরকারের ব্যর্থতা আপনারা একশতবার বলেন, সরকারের দায়িত্ব যখন নিয়েছি, বঙ্গবন্ধু যখন নিয়েছেন, জাতির পিতা যখন হয়েছেন তখন ভালমন্দ সব ছেলের কথাই শুনতে হবে। খারাপ ছেলে, ভাল ছেলে সব ছেলের আবদারই শুনতে। হবে। ওই দুবৃত্তদের কথাও শুনতে হবে। আমরা এড়ালেও বঙ্গবন্ধু এড়াতে পারবেন না। যা বলছিলাম, যারা সমালােচনা করে, তাদেরকে মেহেরবাণী করে আমার ভাই-বােনেরা আপনারা জিজ্ঞাসা করবেন, সরকার না হয় জেল দেয় না, কিন্তু একজন ধরিয়ে দেয় তাে আর একজন টেলিফোন করে বের করে নেয়। কেন ? এটার কি করা? এই হচ্ছে এক জ্বালা। কাজেই সরকার না হয় করে, অন্যায় করে, দুনীতি করে। করলেও দোষ আসবে, করলে তাে কথাই নেই।

সামাজিক প্রতিবিধানটা তাে দেশের মানুষ করতে পারে। আপনারা জিজ্ঞাসা করেন তাে সমালােচকদেরকে যে, তাদের গ্রামে রিলিফ কমিটির মাল কে চুরি করে ? এটা কি বঙ্গবন্ধুর পক্ষে জানা সম্ভব, নাকি যারা শহরে থাকে তাদের পক্ষে জানা সম্ভব ? এটা গ্রামে আমার যে কর্মী আছে তাদের পক্ষে জানা সম্ভব। ঐ গ্রামের দুনীতিবাজটি কে তাে জানিয়েও তাে দিতে পারে ? অন্তত পক্ষে খালু যদি হয় খালাকে, মামা যদি হয় তবে মামীকে বলে দিতে পারি যে, যারা দুর্নীতি করবে তার বউয়েরা কেউ ভাত দেবে না। অন্তত এইটুকু তাে করতে পারি। এমন ধরনের কিছু কি কেউ করেছি ? আমাদের পক্ষ থেকে আমরা কি ধরনের সামাজিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে যাচ্ছি তা আমাদের মনকে জিজ্ঞাসা করতে হবে। পার্টি ভবিষ্যতে যাতে সুস্পষ্ট নির্দেশ দেন, তার আবেদন আজ আমরা সকলে রাখছি। দুর্নীতি বন্ধ করতে হলে ভবিষ্যতে এই ধরনের নির্দেশ দিতে হবে পার্টিকেই। পার্টি শুধু theoretically সরকারের উর্ধে হলে চলবে না, বাস্তবে হতে হবে। এখন আসুন, মিল কলকারখানার ব্যাপারে । মিল কারখানায় যারা শ্রমিক নেতা। তারা কারা? আমি আপনাদেরকে বলছি কারাে বিরুদ্ধে আমার কোন ইর্ষা নেই। আমাকে মাফ করবেন। মাফ করতে পারলে ভাল। না পারলে আমার বিরুদ্ধে অভিসম্পাত দিন আমার কোন আপত্তি নাই। মিল, কল-কারখানার শ্রমিক নেতা কারা ? বিশ্বাস করুন অনেক সময় মনে মনে অনেক চিন্তা করেছি যে, আজকে গিয়ে আমাদের বিরােধী দলের কোন নেতাকে ধরব জব্দ করবার জন্য। কিন্তু যখন ধরতে গেছি, ধরে দেখি আমাদের চেনাশােনা মানুষ। এই যে জিনিসটা আরম্ভ হয়েছে এটা বন্ধ করতে আমিও আপনাদের পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগের কাছে দাবি করব, বঙ্গবন্ধুর কাছে দাবি করব। বিনা দাবিতে তিনি সবসময় করেন, তারপরেও আমাদের যে শ্রমিক নেতৃত্ব, এই নেতৃত্বকে যদি সুষ্ঠু করা না যায় তবে বাংলার অর্থনীতি চলবে না। চলতে পারে না। আমি একটা নমূনা দেই আপনাদেরকে। বন্দরে জাহাজ ভিড়েছে, খাদ্য নামাতে হবে, ৭২ সালের প্রথম দিকের কথা বলছি। UNROD প্রধান আমার কাছে।

গেছেন। নিশ্চয় বঙ্গবন্ধুর কাছেও গেছেন। তিনি আমাকে বলেছেন, মি. মিনিস্টার, তােমার দেশে ব্যাপারটা কি? খাদ্য বােঝাই জাহাজ এসেছে, তােমার মানুষ না খেয়ে কষ্ট পাচ্ছে অথচ শ্রমিকরা কাজ করে না। হাজিরা দেখিয়ে চলে যায়! এখানে আমাদের শ্রমিক নেতাদের চিন্তা ভাবনা করতে হবে। আমি শ্রমিক নেতৃত্বে মানুষের পরিবর্তনের কথা বলছি না, আজ দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে। যদি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে না পারেন তবে এদেশের অর্থনীতি চলবে না। আমাদেরকে দেশের অবস্থা ভাবতে হবে, আমি যদি ভেবে থাকি আমার দেশের অবস্থা সবচেয়ে ভাল এটা ঠিক কথা নয়। আমাদের মত দেশের অবস্থা ঔপনিবেশিক শাসন শােষণে যা হয়, সেই নিম্ন পর্যায়েই রয়েছে। রেলওয়ে ওয়াগনের অভাব, বার্জ, ফ্লাটের অভাব, চালনায় জেটি নাই। যারা জানেন তাদের জন্য বলছি না। যারা না জানেন তাদের জন্য বলছি anchorage জাহাজ থাকে পানিতে বার্জ দিয়ে মাল উঠাতে নামাতে হয়, আর রেলে নিয়ে গেলেও ক্রেন দিয়ে সরাসরি জাহাজে ওঠানাে যায় না। আপনাকে আবার বার্জে বহন করে নিয়ে গিয়ে জাহাজে ওঠাতে হয়। ভরবার বেলায়ও তাই। খালাস করবার বেলায়ও তাই। চিটাগাং বন্দরের capacity কত ? আপনার প্রয়ােজন কত ? মাল আসছে। মাল যাচ্ছে। বন্দরের ক্যাপাসিটি নেই, আজকে ইচ্ছা করলেই রাতারাতি capacity বাড়াতে পারেন না। আমাদের সরিয়ে যাকেই বসান অবস্থা একই থাকবে। তার অর্থ এই নয় যে, আমাদেরকেই রাখতে হবে। পছন্দ না হয় সরিয়ে দিন। আমাদের বদলাবার অধিকার আপনাদের আছে। বঙ্গবন্ধুকে বলেন এই ২০ জন মন্ত্রী যাদের আপনি রেখেছেন এদেরকে বরখাস্ত করুন। বরখাস্তের পরও এরা দেশে থাকলে যদি অসুবিধা হয়, তবে নির্বাসনে দিন। দিয়ে আর এক সেট লােক নিন। দেখবেন একই সমস্যা। এই ক্ষেত্রে সমস্যা সমাধানের জন্য সুষ্ঠু পরিকল্পনা, সুস্পষ্ট নির্দেশনা এবং ভূমিকার কথা ভাবতে হবে। আজকে ট্রাকের ভাড়া কত ? ট্রাক কি বঙ্গবন্ধু চালায় না সৈয়দ নজরুল ইসলাম চালায় ?

ট্রাকের মালিক কে? চিটাগাং থেকে ৭ টনের যে ট্রাক স্বাধীনতার পরেও ৪৫০-৫০০ টাকায় ঢাকায় আসত এখন সেটার ভাড়া ৩০০০, ৩২০০, ৩৫০০ পর্যন্ত ওঠে। ৭ টন মাল থাকে এক ট্রাকে। দামটা কত পরে একবার চিন্তা করুন। এখন আসুন তেল সঙ্কটে। তবে এই সঙ্কট দীর্ঘস্থায়ী হবে। তেলের অভাব নেই তবে দামের সঙ্কট চলবে। দাম বেড়ে গেছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অনুন্নত দেশের পক্ষে আমরা তেল রপ্তানিকারক দেশের সাথে কথা বলে এসেছি। তবে। তারা যে তেলের দাম বাড়িয়েছে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি না যে তারা খুব অন্যায় করেছে। কেন তেলের দাম বাড়বে না ? গমের দাম কত? স্বাধীনতার পর যে গম প্রতি টন কিনেছি ৭৭ ডলারে সেই গম জুলাই-আগস্টে ৮১ ডলার আর আজ সেখানে ২৪২ ডলার। স্বাধীনতার পর পর প্রতি মনে subsidy দিতে আবুল মাল আব্দুল মুহিত। অর্থনীতিবিদ, সরকারি কর্মকর্তা, মন্ত্রী ও লেখক হয়েছে ২২ টাকা ২৫ টাকা। অর্থাৎ ৫০ টাকায় কিনে ২৫ টাকায় খাই। এই ২৫ টাকা দেয় কে ? বাকি টাকা দেবেন আপনারা জনসাধারণ, আজকে ব্যাংক থেকে ধার নিয়ে আমরা এই সব করেছি। ৭৭.ডলার থেকে শুরু হয়ে আজকের কোটেশন হল ২৪২ ডলার, কেমন করে আপনি সস্তায় খাওয়াবেন ? কোথা থেকে খাওয়াবেন ? মনে রাখবেন শুধু আপনার দেশের সমস্যা এটা নয় এটা। সারা দুনিয়ার সমস্যা। শিল্পসমৃদ্ধ দেশগুলাে খাদ্য বেশি উৎপাদন করে না। finished goods উৎপাদন করে বিনিময়ে খাদ্য ক্রয় করে থাকে। তবে তাদের ক্রয়ক্ষমতা বেশি।

সাধারণ মানুষের আয় রুজি বেশি। আমাদের মত অবস্থা তাদের নয়। আমাদের অবস্থা একবার ভেবে দেখুন। আজকে ২৭২ ডলার এক টন গমের দাম। যেটা ৭৭/৮১ ডলারে কিনেছি। আর এক সমস্যা শুনবেন ? তেলের দাম বাড়ার ফলে আজ পর্যন্ত আমরা জাহাজই ঠিক করতে পারিনি। তেলের দাম বাড়ার আগের কিছু কথা বলি। গত জুলাই মাসে (১৯৭৩) ২৮০০০০ টন গম আমেরিকা থেকে কিনেছি। তার সবগুলাে এখনাে এসে পৌছেনি। মাত্র ১৯ হাজার টন এসেছে। এই অসুবিধায় বঙ্গবন্ধু সােভিয়েট ইউনিয়নের কাছে অনুরােধ করায় সেখান থেকে আমাদেরকে ২ লক্ষ টন গম ধার দিয়েছিল। এই প্রকাশ্য সভায় গােপনে বলতে পারি এটা বােধ হয় আর ফেরৎ নাও দিতে হতে পারে। এদিকে মুহিতের সঙ্গে পরশুও আলােচনা করেছি। গত অক্টোবরের কিছুদিন আগেও যেখানে পার টন জাহাজ ভাড়া ছিল ৩৯ ডলার ৩৫ সেন্ট, খাজনা থেকে বাজনা কত দেখেন, নভেম্বরে সেই ভাড়া ৪৯ ডলার ৪২ সেন্ট এবং ডিসেম্বরে ৭৪ ডলার দাম চেয়েছে। আমি বলেছি ঠিক আছে ৭৪ ডলারে নিয়ে নাও। বর্তমানে ৭৪ ডলারেও কেউ আসে , ফলে ৭৪ ডলারেও জাহাজ ব্যবস্থা করতে পারি নাই। জাহাজ কোম্পানিরা তেলের বাড়তি দামের জন্যে জাহাজ কমিয়ে দিয়েছে। কোম্পানিগুলাে হচ্ছে ধনতান্ত্রিক দেশের প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশের জন্য তাদের তেমন আসে যায় না। তারা তেল খরচ কমাবার জন্য ৫০টা জাহাজ না চালিয়ে যদি ২৫টা চালায়। আর ভাড়াটা দ্বিগুণ করে দেয় তবে তাতেই তাদের লাভ। এই কাজটি তারা করছে। আজকে আসুন দেখি তেলের দাম বাড়ার পরে কি অবস্থা দাঁড়িয়েছে। ৭২ সালে অপরিশােধিত তেল কিনেছি ১ ডলার ৭২ সেন্ট পার ব্যারেল ।

১ ব্যারেল তেল আনার জন্য জাহাজ ভাড়া ছিল ২ ডলার ৭৫ সেন্ট। বর্তমানে ১ ব্যারেলের দাম কমপক্ষে ১১ ডলার, আপনাদের অবগতির জন্য আমি জানাচ্ছি, পরশু আমি যে আলােচনা করে এসেছি, সেখানে জানা গেল ১৬ ডলারের কম কোন রিফাইনকারী থেকে অপরিশােধিত তেল পাওয়া যাচ্ছে না। আমি বলেছি এই ১৬ ডলারই যেন কিনে ফেলে, না হলে তাও পাওয়া যাবে না। কারণ এই তেল দিয়ে পাওয়ার পাম্প চালাতে হবে। সেই crude এর কেরােসিন দিয়ে গ্রামবাংলার কুপি বাতি জ্বালাতে হবে। সেই ডিজেল দিয়ে কলকারখানা চালাতে হবে। বিভিন্ন এলাকার ১৬/১৭টি পাট কল, অন্যান্য শিল্প, বিদ্যুৎ সরবরাহ সব চালাতে হবে। এবার তাকাই আমাদের মানব সম্পদের দিকে। আমাদের সবচাইতে বড় সৌভাগ্য আমাদের প্রচুর মানব সম্পদ রয়েছে। এই মানব সম্পদকে কাজে লাগিয়ে সত্যিকার সম্পদে রূপান্তরিত করতে প্রচুর পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। আমি আবার বলছি আমাদেরকে সেমিনার করতে হবে, সেখানে একটা একটা করে প্রশ্ন করে যে যেই বিষয়ে বুঝি সেই বিষয়ে আলােচনা করে সমাধান খুঁজতে হবে। এই সেদিন ইংল্যান্ডের Black Pool-এ Labour Party-র সম্মেলন হল। সৌভাগ্যবশত আমি যেখানে ছিলাম। ৭ দিনব্যাপী সম্মেলন, Space Pollution-এর ওপর আলােচনা হল। বিরাট বিরাট Physicist, PHD. রা বক্তৃতা করেছেন। আমি মনে মনে ভাবলাম যদি আমার দেশে এই আলােচনা হত তবে আমিও দু’কথা বলবার জন্য যেতাম। অথচ ঐ Space Pollution-এর ব্যাপারটাই আমি বুঝি না।

তাই যে যেটা বুঝি সে। সেই বিষয়ে পারদর্শিতা অর্জন করলে ভাল হয় বেশি। একজনের পক্ষে সব জানা সম্ভব না। এখন আইন শৃংখলাজনিত পরিস্থিতিটার যদি উন্নতি না হয় তবে কি ভাবে কাজ করবেন ? আওয়ামী লীগ নেতৃত্বে যারা আছেন এ ব্যাপারে কি ভাবে সরকার এবং দলের সমন্বয় করবেন তারা তা ভেবে দেখবেন। এই ভেবে দেখাটাকে আমি অত্যন্ত জরুরী বলে মনে করি। এটি আমার ব্যক্তিগত অভিমত, এটা দলের বা সরকারের নয়, অস্ত্রের খেলা বন্ধ করা দরকার। আমি সামান্য যেটুকু লেখাপড়া করেছি তা থেকে বলতে পারি Establishment-এর বাইরে অর্থাৎ সরকার যন্ত্রের বাইরে যদি অস্ত্র থাকে তবে অস্ত্রের প্রতিযােগিতা বন্ধ করা সম্ভব নয়। পুলিশ হল মৌলিক প্রতিষ্ঠান। সব তন্ত্রে পুলিশ হল মুখ্য ব্যবস্থা। মিলিটারিকে কথায় কথায় Civilian-এ আনা ঠিক হবে না। যেখানে আইন ভঙ্গ হলে মানুষ পুলিশের কাছে যায়। সেই পুলিশের প্রতি আস্থা জন্মাতে হবে। আস্থা জন্মাবার দু’টো উপায়, এক, পুলিশ প্রতিষ্ঠানকে সুন্দরভাবে ঢেলে সাজান। এই কাজটি এক দিনে সম্ভব হবে এ কথা বলছি না। কিছুটা সময়সাপেক্ষ। কিন্তু কাজটি শুরু করতে হবে। দ্বিতীয়ত প্রত্যেকটা কর্মীকে কি আপনারা ব্যক্তিগতভাবে সবাই চেনেন? বাংলার আপামর সাড়ে সাত কোটি লােকের মাঝে সবগুলাে কমীকে ব্যক্তিগতভাবে চেনা সম্ভব নয়। স্থানীয় কর্মীটিকে স্থানীয় নেতা বা নেতৃত্ব চেনেন। আজকে যদি সরকারের মন্ত্রী মালেক উকিল নিজে উপস্থিত থেকে ঘেরাও দিয়ে ৫ জনকে বিনা লাইসেন্সে অস্ত্রসহ ধরেন আর পরক্ষণেই আমি তাজউদ্দীন একজন আওয়ামী লীগ নেতা ‘য়ে যদি মালেক সাহেবকে বলি যে, মালেক সাহেব, মি, এক্স অত্যন্ত ভাল মাওয়ামী লীগ কর্মী আমি জানি, আমি তার দায়িত্ব নিচ্ছি, তখন তাঁর অবস্থাটা কি দাঁড়ায় ? আজকে যদি কারাে হাতে বিনা লাইসেন্সে অস্ত্র না থাকত আর বঙ্গবন্ধু যদি হুকুম দিয়ে দিতেন পুলিশকে যে, ধর অস্ত্রজমা দাও, পুলিশের কাছে।

বিনা লাইসেন্সে অস্ত্র যদি আমার দলের লােকের কাছেও থাকে, রেহাই নেই, তবে পরিস্থিতি ভিন্ন হত। অনেক বর্ণচোরা লােক আওয়ামী লীগে বিভিন্ন কৌশলে আসছে আওয়ামী লীগ কর্মী নাম দিয়ে। আপনাদেরকে এটা বন্ধ করতে হবে। পরিবেশ সৃষ্টি না হলে কাজ করবেন কি ভাবে ? অর্থনীতির কথা বললামই না, Economic activity মানে কি ? ব্যবসা বাণিজ্য চলবে, Commerce Trade চলবে, হাট বাজার চলবে। ব্যবসা বাণিজ্য করলে এক জায়গা থেকে অন্য যায়গায় যাতায়াত করবে মানুষ সদাই। করবে, মাথায় করে জিনিসপত্র নিয়ে যাবে। আর খরিদ্দার টাকা নিয়ে যাবে হাটে-বাজারে। ৯ লক্ষ টাকা দিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মালেক সাহেবের কাছ থেকে আনসার ভাড়া করেছি পাট ক্রয় কেন্দ্রগুলাে পাহারা দেবার জন্য। যাতে টাকা। লুট করে নিয়ে না যায়। ৫ মাসের জন্যে এরা পাহারা দেবে। একটা রাইফেল নিয়ে দাড়িয়ে থাকবে। আজকাল রাইফেল কিছু না। অটোমেটিক অস্ত্রের কাছে রাইফেল কিছু না। ফড়িয়ারা যায় না পাট কিনতে। ২০ মন পাট কিনতে ১০০০ টাকা লাগে, কে তাকে নিশ্চয়তা দিবে যে তার পয়সা নিয়ে যাবে না! দুষ্কৃতকারীর একমাত্র পরিচয় সে দুষ্কৃতকারী। সে যে দলেরই হােক। আমরা অনেক সময় বিরােধী দলের উপর চাপিয়ে দেই। এতে দু’টো সর্বনাশ হয়। সে রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়ে যায়। রাজনৈতিক স্লোগান তার পক্ষে যাবার একটা সম্ভাবনা দেখা দেয়। সে যতটা শক্তিশালী নয় কিন্তু জনগণের সামনে শক্তিশালী। প্রমাণ হয়। ইংরেজ আমলেও দেখেছি পােস্ট মাস্টার হত্যা মামলায়, এটা রাজনৈতিক ডাকাতি ছিল। ফণীদারা তখন এই কাজ করতেন, বর্তমানে তিনি খাদ্য মন্ত্রী। সেই মামলায় ইংরেজরা অনুশীলন পার্টির নামই উচ্চারণ করে নাই। অনুশীলন পার্টির নাম উচ্চারণ করলে সে রাজনৈতিক protection পেয়ে যেত। এতে জনগণের সহানুভূতি পেয়ে যেত। তবে তারা কি করল ? ঐ ডাকাতির সাথে খুন, ৩৯৬ ধারা দিয়ে ফাঁসি দিয়ে দিল।

যা বলছিলাম, যদি একজন পকেটমার হয় তবে সেই জন্য তাকে পকেট মারের আইনে সােপর্দ করেন। সে যদি শ্রদ্ধেয় নেতা হয়, নেতা হিসেবে তার ব্যবস্থা নিন। নাম উচ্চারণের দরকার হয় না। তেমনিভাবে ভাল মা যারা তার দুই সন্তান যদি ঝগড়া করে তবে নিজের সন্তানের বিচার তিনি করেন। তেমনি আমি আশা করি এবং বঙ্গবন্ধুও আশা করেন যে, আমাদের মধ্যেও যদি কেউ অন্যায় করে তবে তার শাস্তি হওয়া উচিত সবচেয়ে বেশি। কারণ তা না হলে পার্টির মুখে কালিমা লেপন করা হয়, তাতে ক্ষতি হয়। বঙ্গবন্ধুর যে ভাবমূর্তি তার ক্ষতি হয়। কাজেই সেই দিকে দৃষ্টি রেখে গােপনে বা প্রকাশ্যে আইন-শৃঙ্খলা উন্নতি করতে হবে। আইন শৃঙ্খলার পরিস্থিতির যদি উন্নতি না হয় তবে অর্থনৈতিক activity হতে পারে না।

আজকে আমার তরুণ ভাইয়েরা আপনাদের কাছে আমার একটা আবেদন। আপনারা যে বিপুল শক্তির অধিকারী সেই শক্তিকে সুসংহত করুন। যুদ্ধের সময় যে লক্ষ্য নিয়ে কাজ করেছিলেন আজকে সেই রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। অতএব আর কোন লক্ষ্য নেই এই ধারণা থাকার কোন কারণ নেই। আপনাদের পরিষ্কার লক্ষ্য রয়েছে। আপনারা সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্যে উত্তরণ করবেন। উত্তরণ করবেন বলছি এই জন্যে যে, আজকেই সমাজতন্ত্র করার মত অবস্থা, পরিবেশ, কর্মী বাহিনী, মনােভাব, সবচেয়ে বড় কথা হল সম্পূর্ণ জাতির মনােভাব নেই। শুধু কর্মী থাকলে চলবে না, যদি সমস্ত জাতির প্রচেষ্টা না থাকে। সেখানে বিভিন্ন মতের লােক তলে তলে অন্য কথা বলে না তা নয়। আমরা যখন আওয়ামী লীগ সংগঠন করেছি, তখন মােনায়েম খাকে যারা পাঁচ হাজার টাকা চাঁদা দিয়েছে তারাও চুপি চুপি বঙ্গবন্ধুকে ৫০ টাকা চাঁদা দিয়ে গেছে। এই জন্য যে, যখন সরকারের পরিবর্তন হবে তখন তারা ঐ সুযােগের সদ্ব্যবহার করবে। সব মানুষের সমান অধিকার বা সমাজতন্ত্র কায়েম করবার জন্য এই যােগাযােগ নয়, নিজের সুবিধা আদায়ের জন্য তারা এটা করেছে। আজকে তারা বসে নাই। বর্তমানে সােনালি আঁশ পাট কেন্দ্রীয় সংস্থার মাধ্যমে রপ্তানি হয়।

এখন যারা পাট ব্যবসায়ে আছেন, তারা বাঙালি, আমি চিনি। তাদের। বঙ্গবন্ধুও অনেককেই চিনেন। তারা গােপনে পাকিস্তানিদের চেয়ে বেশি শত্রুতা করছে। তারা টাকা পাউন্ডে, ইয়েনে, ডয়েস মার্কে পরিবর্তন করে টোকিওতে, বৈরুতে সহ বিভিন্ন জায়গায় রাখে। তারা বর্তমানে সুইজারল্যান্ডে টাকা রাখে না, কারণ সেখানে টাকা রাখলে উল্টো শতকরা ৩/- হারে সুদ দিতে হয়। আমাদের অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করার পেছনে এই এরা কাজ করছে। যুবকদের সম্বন্ধে বঙ্গবন্ধুকে কিছু বলে যাই, কলেজে যারা প্রবেশ করে তারাই তাে যুবক হয়ে যায়। কৈশাের ছেড়ে যৌবনে পা দেয়, তার জন্য কি ব্যবস্থা ? ঢাকা শহরের কথা ধরুন। বর্তমানে ঢাকা শহরের লােকসংখ্যা কত ? বঙ্গবন্ধুর। মতে ২০ লক্ষ, তা হলে আরও ভাল। আগের লােকসংখ্যার জন্য ঢাকায় যে স্কুল কলেজ ছিল, যে ব্যায়ামাগার ছিল। বর্তমানে তা কি বাড়ছে, না কমছে ? মতিঝিল, দিলকুশা এলাকায় G.P.0 হয়েছে। ঐ পুরাে এলাকাতাে খালি ছিল। ছােট বেলায় আমরা ওখানে খেলাধূলা করেছি। এক একটা স্কুলের জন্য এক একটা খেলার মাঠ ছিল। কলেজগুলােরও নিজস্ব মাঠ ছিল। আর বর্তমানে লােক বেড়েছে সন্তান সন্ততি বেড়েছে। খালি জায়গায় ইমারত হয়েছে বাড়িঘর হয়েছে। মানুষের তুলনায় যেখানে মাঠ-ঘাট বাড়ার কথা সেখানে কমে গেছে। বাড়ির জায়গাটা নিয়েই রাস্তার কিনার ঘেষে দেওয়াল দিয়ে দেন, রাস্তাটা সংকীর্ণ হয়ে যায়। দু’টা গাড়ি চলাচল করতে পারে । যে বেশি প্রভাবশালী তার গাড়ি আগে যায়। আর যে কম প্রভাবশালী তার গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে। এই অবস্থা। এটা এক বছরে হয়নি। গত ২৫ বছরেহয়েছে। আগে কলেজগুলােতে যে বিল্ডিং, রুম ছিল যেখানে ৫০জন বসার স্থান। ছিল এখনও ঐ ৫০ জনেরই স্থান আছে। অথচ ছাত্র সংখ্যা পঞ্চাশ এর জায়গায় এক হাজার হয়েছে। যুবকদের পড়াশােনার সাথে সাথে মন ও মননশীলতার বিকাশের সুযােগ করে দিতে হবে। পাঠাগারের সংখ্যা ও আয়তন বাড়াতে হবে।

খেলাধূলার ব্যবস্থা করতে হবে। আমি ঢাকা শহরের কথা বলছি, সাথে সাথে সমস্ত জেলা ও মহকুমা সদর দপ্তর এবং অন্যান্য ঘনবসতি এলাকায় পাঠাগার ও খেলার মাঠ গড়ে তুলতে হবে। বঙ্গবন্ধু আপনি হুকুম দিয়ে দিন, ঢাকায় ১ মাইল লম্বা আধ। মাইল প্রশস্ত একটা জায়গা নিয়ে ছেলেদের খেলাধূলার ব্যবস্থা করে দিন। নিষ্কলুষ আনন্দ লাভের সুযােগ করে দিন। তা না হলে এরা ফুটপাতে ঘুরে বেড়াবে। ঘুরে বেড়ালে সাধারণত কি হতে পারে? চিন্তা করে দেখুন। হাত শুধু পকেটেই যাবে না। নানান দিকে যাবে। কাজেই যুবকদেরকে এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে—যেন ভবিষ্যৎ সােনার বাংলার যুবক হিসেবে তারা গড়ে ওঠে। এখানে আমি রিকশাওয়ালা ও হুমায়ূন খালেদের সােনার বাংলার গল্পটা বলি। একদিন শাসনতন্ত্র প্রণয়ন কমিটির সভায় যােগদানের জন্য জনাব হুমায়ুন খালেদ সংসদ ভবনে যাচ্ছিলেন।

তিনি রিকশা দিয়ে যাচ্ছিলেন। পথে এক কথা দু’কথায় রিকশাওয়ালার সঙ্গে তাঁর আলাপ জমে ওঠে। একসময় জনাব খালেদ নিজের পরিচয় প্রকাশ করেন। ফলে রিকশাওয়ালা কথা বলতে সংকোচ করছিল। কিন্তু খালেদ সহজভাবে কথা বলতে অনুরােধ করায় সে মন খুলে কথা বলতে শুরু করে এবং এক পর্যায়ে বলে, সাব, খাইটা-খুইটা কি করবেন ? সােনার বাংলা তাে হইয়া গেছে। জনাব খালেদ প্রশ্ন রাখলেন, কি করে সােনার বাংলা হল ভাই ? আমরা তাে চেষ্টা করছি। কিন্তু হল কোথায় ? উত্তরে রিকশাচালক জবাব দেয়, ক্যান ছার, দেশে জিনিসপত্র তাে সােনার দামে বিক্রি হইতাছে ! জনাব খালেদ এখানে উপস্থিত আছেন (জনাব খালেদ নিজেও এই বক্তব্যের প্রতি সম্মতি জানিয়ে নিজের উপস্থিতি ঘােষণা করেন)। সত্যিকারের সােনার বাংলা হতে হলে এই যুবক, কিশাের ও শিশুদের সম্পূর্ণ সুযােগ দিতে হবে। আমার বয়সে ৩টা পতাকায় সালাম করলাম—Union Jack, অর্ধ চন্দ্র তারকা, এখন বাংলাদেশের সূর্য। কাজেই আমাকে দিয়ে আপনি কতটুকু আশা করতে পারেন। আমার মজ্জায় ঢুকে গেছে অনেক জিনিস। বের করা সম্ভব নাও হতে পারে। মধ্যবিত্তকে শিক্ষা, সংস্কৃতি, মস্তিষ্ক, দেহ, মনের বিকাশের সুযােগ দিতে হবে। আমি বিশ্বাস করি এবং আপনারাও বিশ্বাস করেন, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা একটুও কম নয়। নিরাশ হবার কোন কারণ। নাই। আপাতত আমরা যেটা দেখছি সেটা বিভ্রান্তি। এই বিভ্রান্তি কাটিয়ে উঠতেই হবে। এই বিভ্রান্তি কাটিয়ে ওঠার দায়িত্ব আজকে যে আওয়ামী লীগের পরিষদ গঠিত হবে তাকে নিতে হবে। আমাদেরকে মূলনীতি অনুসরণ করে কাজ করে যেতে হবে। বর্তমানে সাম্প্রদায়িকতাসহ কিছু কিছু ব্যাপারে বিভ্রান্তমূলক প্রচার হচ্ছে। যেমন গত এপ্রিল মাসে খাদ্য বােঝাই জাহাজ গ্রহণ করতে চট্টগ্রাম গিয়েছিলাম। যেখানে শুনে এলাম সভিয়েট ইউনিয়ন আমাদের দেশে নৌ ঘাটি করেছে। এই যে প্রচার—এর উদ্দেশ্য কি ? বাংলাদেশে কারাে ঘাটি হবে না। এমন কি যুদ্ধের দিনে ১৯৭১-এ সবচেয়ে বিপর্যয়ের সময়ে, ভারতীয় বাহিনীকে বলেছি, শ্রীমতী গান্ধীকে বলেছি, বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবে তুমি আমাদের দেশে যাবে। বন্ধু তখনি হবে, যখন তুমি আমাদের স্বীকৃতি দেবে। তার আগে সার্বভৌমত্বের বন্ধুত্ব হয় না। ৬ ডিসেম্বর স্বীকৃতি দিয়ে ভারতীয় বাহিনী আমাদের সাথে এসেছিল। সেই দিন, শুনে রাখুন আমার বন্ধুরা, কোন গােপন চুক্তি ভারতের সাথে হয় নাই। একটাই চুক্তি হয়েছে, সেই চুক্তি প্রকাশ্য এবং কিছুটা লিখিত, কিছুটা অলিখিত। সেই নয় মাসে, সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং আমি যুক্তভাবে সই করেছিলাম।

সেখানে লেখা ছিল আমাদের স্বীকৃতি দিয়ে সহায়ক বাহিনী বা Supporting Force হিসেবে তােমরা বাংলাদেশে প্রবেশ করবে। এবং যে দিন আমরা মনে করব আমাদের দেশে আর তােমাদের থাকার দরকার নাই সেই দিন তােমরা চলে যাবে। সেই চুক্তি অনুসারে যে দিন বঙ্গবন্ধু শ্ৰীমতী ইন্দিরা গান্ধীকে বললেন যে, ৩০ মার্চের মধ্যে তােমাদের বাহিনী উঠিয়ে নিয়ে যাবে তখনই মিসেস গান্ধী ১৯৭২-এর ১৫ মার্চের মধ্যে সহায়ক বাহিনী উঠিয়ে নিয়ে গেলেন। আজকে বিভ্রান্তির জন্য বলা হয় যে, রক্ষী বাহিনীও নাকি ভারতীয় সৈন্যের পােশাকের ন্যায় তৈরি করা হয়েছে। আমার ভাইয়েরা আপনাদের কাছে একটা কথা বলা দরকার। বঙ্গবন্ধু, সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেব এবং আমরা cabinet calleague যারা ছিলাম সকলে এবং বাইরেও যারা নেতৃত্বে ছিলেন। তারাও রক্ষী বাহিনীর পােশাক নিয়ে চিন্তিত ছিলাম। যা বলছিলাম রক্ষী বাহিনীর পােশাকের একটা ইতিহাস আছে। আমাদের তখন কোথায় কাপড় ছিল ? লুঙ্গি পরে তাে আর ডিউটি করা যায় না। একাত্তরে লুঙ্গি পরে আমার যােদ্ধারা যুদ্ধ করেছে। নিজে দেখেছি যশােরে নবগ্রাম যেদিন মুক্ত হয় আমি সেদিন রণাঙ্গনে উপস্থিত ছিলাম। চোখের সামনে দেখেছি আমাদের ছেলেদের এক হাতে পােটলা আর এক হাতে রাইফেল। লুঙ্গি পরে, খালি গায়ে, গেঞ্জিও গায়ে নেই, অর্থাৎ জামাও অনেকের গায়ে ছিল না। আমাদের সেই সমস্ত মুক্তিযােদ্ধা ভাইদের পােশাক দেয়ার জন্য, এক লক্ষ uniform দিতে ভারত সরকারকে আমাদের তখনকার মন্ত্রিপরিষদ অনুরােধ করেছিল।

এদিকে মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়েছে অনেক আগেই। আর সেই পােশাকের চালান আমাদের কাছে এসে পৌছেছে দেশ স্বাধীন হবার অনেক পরে। মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য তৈরি পােশাকগুলােই রক্ষী বাহিনীকে দেয়া হয়েছে। মােল্লা জালাল উদ্দিন সাহেব বিহারে গিয়ে সেই এক লক্ষ বুট আর কাপড় জামা নিয়ে এসেছেন। এখন এদিকে বলা হচ্ছে ঐ পােশাকে বঙ্গবন্ধু ভারতীয় বাহিনী আনবেন। বঙ্গবন্ধুকে আঘাত দেওয়া হয় এই জন্যে যে তাকে এক জায়গায় কাত করতে পারলে বাকিগুলাে তাে কিছুই না, এমনিতেই কাত হয়ে যাবে। আর একটা কথা আপনাদের কাছে বলে রাখি। আমি এবং সৈয়দ নজরুল সাহেব ইন্দিরা গান্ধীর কাছে যে চিঠিপত্র লিখেছিলাম সেই চিঠিপত্রের কপি আমি ড. কামাল হােসেনের কাছে দিয়েছি। একে চুক্তি বলেন, চিঠি বলেন, দেশ বিক্রি করা বলেন যাই বলেন এটা প্রকাশ্যে হয়েছে, গােপনে না। পরবর্তীতে যে চুক্তি হয়েছে সেটাও প্রকাশ্য চুক্তি। ১২টি ধারা আছে তার মধ্যে। যেটা বঙ্গবন্ধু ও ইন্দিরা গান্ধী সই করেছেন ১৭ মার্চ ১৯৭২ সালে। এটা গােপন টোপন না। পার্লামেন্টে ড. কামাল হােসেন সালাউদ্দিন সাহেবের প্রশ্নের উত্তরে এই চুক্তির এক লাইন এক লাইন করে পড়ে শুনিয়েছেন। দুভাগ্যের বিষয় অনেক কথাই আমরা বলি কিন্তু সেগুলাে যদি জাতীয় খবরের কাগজে পুরােপুরি উঠত তবে বিভ্রান্তি অনেক কম হত। খবরের কাগজগুলাে বিরােধী দলের যত কথা প্রকাশ করেন আমাদের কথাও একটু যদি সেইভাবে প্রকাশ করেন তবে ভাল হয়। আমি এই কথাটি এই জন্য বলছি যে, সেদিন পার্লামেন্টে এই চুক্তির ওপর যে বক্তব্য ছিল তা বেশি ভাল করে প্রকাশ হয়নি। আরাে একটি নমূনা দেই, আমি আপনাদের পার্লামেন্টে অর্থমন্ত্রী হিসেবে বাজেট আলােচনার শেষ দিনে তিন ঘন্টা সমাপনী বক্তৃতা করলাম। জাতীয় খবরের কাগজ তা থেকে এক লাইনও দেয়নি।. (অসমাপ্ত) এর পরের অংশ ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বরের পর পাওয়া যায়নি।

সূত্র : আমার ছোটবেলা ১৯৭১ এবং বাবা তাজউদ্দীন আহমেদ – সিমিন হোসেন রিমি