You dont have javascript enabled! Please enable it! 1975.11.03 | জেল হত্যা সম্পর্কে তৎকালীন কয়েকজন রাজবন্দি ও কারা কর্মকর্তার সাক্ষাৎকার - সংগ্রামের নোটবুক

 জেল হত্যা সম্পর্কে তৎকালীন কয়েকজন রাজবন্দি ও কারা কর্মকর্তার সাক্ষাৎকার

আব্দুস সামাদ আজাদ *

রাজনীতিক, মন্ত্রী ও বাংলাদেশ সরকার

২৩ আগস্ট ১৯৭৫ তারিখে আমাকে গ্রেফতার করে সােহরাওয়ার্দী উদ্যানের কন্ট্রোল রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান জাতীয় চার নেতাসহ ২৬ জনের মত নেতৃবৃন্দ ছিলেন। একটু পরেই ডালিম ও রশিদ সেখানে হাজির হয়। রশিদের আক্রমণাত্মক হাবভাব সকলকেই শঙ্কিত করে তােলে। প্রায় ঘণ্টাখানেক পর অর্থাৎ সাড়ে ১১টার দিকে আমাদের সবাইকে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। আমাদেরকে নিউ জেলে পাশাপাশি তিনটি রুমে রাখা হয়। প্রথম রুমটিতে তাজউদ্দীন সাহেব ও সৈয়দ নজরুল সাহেবসহ মােট আটজন। দ্বিতীয় রুমে কামরুজ্জামান সাহেব এবং অন্যান্য ১২ জন এবং তৃতীয় রুমে মনসুর আলি সাহেব এবং আমিসহ ২৫ জন। প্রতিটি রুমে লােহার শিকের দরজার ব্যবস্থাসহ রুমগুলাে একটি টানা লম্বা বারান্দার ওপর দাঁড়ান ছিল। বারান্দার শেষেও ১টি লােহার দরজা ছিল। নভেম্বর মাসের ১ তারিখের পড়ন্ত বিকেলে তাজউদ্দীন সাহেব ও আমি বাগানে। পায়চারি করছিলাম। এই বাগানটি তাজউদ্দীন ভাইয়ের হাতে গড়া। পচা নর্দমা ভরাট করে উনি এই বাগানটি তৈরি করেছিলেন। তাজউদ্দীন ভাই বললেন, জেলটা তার কাছে নিরাপদ এলাকা হিসেবে মনে হচ্ছে না। একে ‘রেডক্রস’এর অধীনে নিতে পারলে ভাল হয়। আমাকে বললেন, এই ব্যাপারে একটু চেষ্টা করে দেখতে। সেই সন্ধ্যাতে মনসুর আলি সাহেবও রেডক্রস-এর সাথে যােগাযােগ করতে অনুরােধ করলেন। কারণ দু’দিন আগেই আর্মির লােক এই নিউ জেল এলাকা পরিসংখ্যান করে গিয়েছিল। কাজটি যদিও সহজসাধ্য ছিল তবুও আমি তকালীন রেডক্রসের ভাইস চেয়ারম্যান ময়েজউদ্দিন আহমদের (তাকে ‘৮৫-তে মিছিলে হামলা চালিয়ে প্রকাশ্যে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়) কাছে খবর পাঠাতে সক্ষম হই। ২ তারিখ দিবাগত রাতে তাহাজ্জতের নামাজ পড়বার জন্য উঠেছি। সেই সময় হুইসেলের তীক্ষ্ণ আওয়াজ। বদলি হয়ে আসা সেপাই আমার পরিচিত ছিল।

সে জানাল, ডিউটিতে আসবার সময় আইজি নূরুজ্জামানকে সে গেটে দেখেছে। তার হঠাৎ জেলে আসবার কারণ সে কিছু জানে না। এর কিছুক্ষণ পরই হুইসেল এবং পাগলা ঘণ্টার আওয়াজ। আমাদের রুমের সামনের বারান্দা থেকে আওয়াজ পেলাম মনসুর আলি সাহেবকে তৈরি হয়ে ১ নম্বর রুমে যেতে বলছে। আর ১ নম্বর রুমের তাজউদ্দীন সাহেব এবং নজরুল ইসলাম ছাড়া সবাইকে আমাদের রুমে ঢােকান হল। এরই মধ্যে ব্রাশ ফায়ারের শব্দ। আমরা সবাই মাটিতে শুয়ে পড়লাম। একসময় শুনতে পেলাম, আজানের শব্দ ভেসে আসছে। আমরা সবাই তালাবন্দি, মুক্তিযােদ্ধা সহকর্মী মায়া পাশের রুম থেকে চিঙ্কার করে জিজ্ঞাসা করল আমাদের রুমের খবর কি। তারপর আবার স্তব্ধতা। আমরা নিজেরাই তখন আন্দাজ করে ফেলেছি লীডারদের শেষ করে ফেলেছে। ৩ তারিখ দিনে বিশেষ সংস্থার কর্মকর্তারা এল মৃতদেহ দেখতে এবং আমাদের রুমের সামনে এসে হুমকি দিয়ে গেল, ব্যাড ডেজ আর কামিং ফর ইউ। মনে করবেন না যে, সুবিধা করতে পারবেন। এদের একজনের নাম সম্ভবত ছিল কাদের। তকালীন শ্রমিক নেতা মােজাম্মেল তাদের চিনতে পেরেছিল।

শেখ আব্দুল আজিজ *

রাজনীতিক, সাবেক মন্ত্রী ও বাংলাদেশ সরকার

আমরা অক্টোবর মাসের শেষ দিক থেকেই জেলে নিরাপদ বােধ করছিলাম না। কারণ জেলার আমাকে, নজরুল সাহেব, তাজউদ্দীন সাহেব এবং আরাে কয়েকজনকে বলেছিলেন যে, রাতে জেলের ভেতর আর্মির লােক আসে। বিশেষ করে আপনাদের দিকটায়। আপনাদের হয়ত এখান থেকে বদলি করে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাবে যাতে আপনারা বাইরের কারাে সাথে সাক্ষাৎ করতে পারেন। এমনও হতে পারে আপনাদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে নিয়ে যেতে পারে। আমাদের প্রশ্নের জবাবে জেলার আরাে বলেছিলেন, দেখুন, জেলের ভেতর রাতে আর্মির লােক আসে, তাতে আমরা কিভাবে আপত্তি করব। দেশে এখন আর্মির শাসন, মার্শাল ল’, তাই ওরা আসে। এই কথা শুনে নজরুল সাহেব বললেন, “আর বাঁচা যাবে না।’ তাজউদ্দীন সাহেব খুব শক্ত মানুষ, খুব বেশি সাহসী মানুষ, উনি আর কোন মন্তব্য না করে নিজের মত রইলেন। জেলের ভেতর নিউ জেল বিল্ডিংয়ের প্রথম রুমটাই ছিল আমাদের ১ নম্বর রুম। তাজউদ্দীন সাহেব এবং আমার বিছানা ছিল পাশাপাশি। আর আমার দিকটা ছিল লােহার গরাদের দরজার ঠিক পাশেই।

সেই রাতে মাথার কাছে আস্তে আস্তে কথাবার্তার আওয়াজে আমার ঘুম ভেঙে যায়। তাকিয়ে দেখি তাজউদ্দীন সাহেব এবং কোরবান আলি—আমার মাথার কাছে দরজার সামনে দাড়িয়ে কথা বলছেন। আর পাগলা ঘণ্টা বেজে চলেছে। বিছানা থেকে উঠে আমিও তাদের সাথে যােগ দিলাম। চিন্তিত অবস্থায় আমরা তিনজন দাড়িয়ে নানারকম কথাবার্তা বলছি এমন সময় জেল সুবেদার মৃধা সাহেব চাবি দিয়ে আমাদের দরজার তালা খুললেন। আমরা বললাম, তালা খুলছেন কেন ? চাপা সুরে ভীত সন্ত্রস্তভাবে সুবেদার বলল, ‘মিলিটারি এসেছে।’ তালা খুলেই আমাদের বললেন, আপনারা সবাই তাড়াতাড়ি ৩ নম্বর রুমে চলে যান। আমি যখন ১ নম্বর রুম থেকে বের হয়ে আসি তখন দূরে মাঠের দিকে কিছু লােকজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। আমি ৩ নম্বর রুমের সামনে এগিয়ে যেতেই পেছন থেকে জেলারের গলার চিৎকার শুনলাম—নজরুল-তাজউদ্দীনকে আবার ঘরে ঢােকাও। এদের ৩ নম্বরে যেতে হবে না। এই কথায় বােঝা গেল ওনারা দুজনেই ঘর থেকে বের হয়ে এসেছিলেন। এমন সময় মনসুর সাহেবকেও ১ নম্বর রুমে যেতে বলা হল। এর কিছু পরেই কান ফেটে যাওয়া শব্দগুলির শব্দ। ইটের দেয়াল, টিনের চাল, গুলির শব্দে ঝনঝন করছে। তারপর পিনপতন নীরবতা। আবার একটু পরেই শুনি সেই ১ নম্বর রুম খােলার শব্দ। সকাল বেলা জেলের পাহারাদারদের কাছ থেকে শুনলাম চার নেতাকে মেরে ফেলেছে এবং দ্বিতীয়বার ওরা দরজা খুলে বেয়নেট চার্জ করতে এসেছিল। কারণ নেয়ামত আলি নামের দাড়িওয়ালা এক পাহারাদার চার নেতার মধ্যে একজন জীবিত আছে বুঝতে পেরে ঘাতকদের আবার ডেকে আনে। পরে শুনেছি, অস্ত্র নিয়ে জেলের ভেতরে ঘাতকদের ঢুকতে দিতে ডিআইজি অনুমতি দিচ্ছিলেন না। তখন তাকে মারধর করা হয়। এও শুনেছি খন্দকার মােশতাক ঘাতকদের জেলের ভেতরে ঢুকতে দেওয়ার জন্য ফোনও করেছিল।

খন্দকার আসাদুজ্জামান

* সাবেক সচিব ও বাংলাদেশ সরকার এবং সংসদ সদস্য ও সপ্তম জাতীয় সংসদ

অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি থেকে আমাদের কানে আসছিল বাইরে থেকে কিছু লােকজন জেলের ভেতরে আসা যাওয়া করে। বিশেষ করে ৪ নেতা এবং অন্যান্য নেতৃবৃন্দ যেখানে ছিলেন সেই দিকটাতে। আমার জানা মতে প্রায় তিনবার এরা এসেছিল। ১৫ আগস্ট যারা কু করেছিল এরা তাদেরই লােকজন ছিল। এদিকে কিছুটা গুঞ্জন শােনা যাচ্ছিল যে, আর্মির ভেতর ‘চেইন অফ কমান্ড’ নিয়ে অসন্তোষ চলছে। বাইরে থেকে এমন খবরও আসছিল যে, নেতাদের সাথেও আলাপ করা হবে। ২ নভেম্বর দিবাগত রাতে প্রতিদিনের মত আমি শুয়ে পড়েছি। হঠাৎ সতর্ক বাঁশি এবং পাগলা ঘণ্টার আওয়াজে ঘুম থেকে জেগে যাই। তাকিয়ে দেখি রুমের মধ্যে কামরুজ্জামান সাহেবসহ আর যারা ছিলেন সবাই জেগে গেছেন। তখন আমরা সবাই আতঙ্কিত। কিছুক্ষণ পরেই আমাদের পাশের ১ নম্বর রুমের তালা খুলবার আওয়াজ পেলাম। এর একটু পরেই আমাদের ২ নম্বর রুমের তালা খুলতে দেখলাম এবং কামরুজ্জামান সাহেবের নাম ধরে তাকে রুম থেকে বের হয়ে ১ নম্বর রুমে যেতে বলা হল। তখন ঠিক কারা দরজার বাইরে ছিল বলতে পারব না, তবে জেলের একজন কর্তৃপক্ষ এবং সাথে আরাে বেশ কয়েকজন ছিল। কামরুজ্জামান সাহেব রুম থেকে বের হয়ে যাবার সময় আমার হাত ধরলেন।

তিনি বেরিয়ে যেতেই আবার আমাদের রুমের তালা বন্ধ করে দেয়া হল। ৩ নম্বর রুমে থাকতেন মনসুর আলি সাহেব এবং আরাে অনেকে। মনসুর আলি সাহেবকেও ১ নম্বর রুমে নেয়া হল আর ১ নম্বর রুমে তাজউদ্দীন সাহেব এবং নজরুল সাহেব ছাড়া অন্য ৪/৫ জনকে ৩ নম্বর রুমে অর্থাৎ আমাদের ঠিক পাশের রুমে যেতে বলা হল। এর কিছু পরেই গুলির আওয়াজ—স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের বিকট তীব্র শব্দ। প্রায় সাথে সাথেই আজানের শব্দ ভেসে এল। পরদিন আর আমাদের লক-আপ খােলেনি। জেলে লােকজনদের ফিসফিস কথাবার্তায় বুঝেছি ওঁরা ৪ জন আর নেই। আমার যতদূর মনে আছে সেদিন কিছু আর্মি অফিসার এসেছিল। তারা আমাদের রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। পরে শুনেছি, উর্ধ্বতন মহলের নির্দেশ এবং অনুমতি সত্ত্বেও ডিআইজি প্রিজন নাকি ঘাতকদের অস্ত্রসহ জেলে ঢুকতে বাধা দিয়েছিলেন। জেল কোড অনুযায়ী সন্ধ্যার পর বাইরের কেউ কারাগারের ভেতরে ঢুকতে পারে না। এই নৃশংস ঘটনার আগে থেকে রাতে বাইরের লােকজনের যে একটা আনাগােনা চলছিল তা যেন ২ তারিখ রাতের ঘটনারই প্রস্তুতি।

হােসেন তওফিক ইমাম

* সাবেক কেবিনেট সচিব ও বাংলাদেশ সরকার

আমি সে সময় বন্দি অবস্থায় ২৬ নম্বর সেলে। আমার রুমটার ফুট দশেক পরেই একটি উঁচু দেয়াল, তারপরেই নিউ জেল বিল্ডিং, যেখানে তাজউদ্দীন সাহেবসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ ছিলেন। গভীর রাত। আমি এবং সাবেক সচিব নূরউদ্দিন আহমদ রােজ তাহাজ্জতের নামাজ পড়ি। সে রাতেও নামাজ পড়তে দাঁড়িয়েছি—তখনই পাগলা ঘণ্টা বাজল এবং চারদিকে হৈ চৈ। জেলের লােকজন দৌড়াদৌড়ি করছে, বুঝতে পারছি। আরও বুঝতে পারছিলাম, নিউ জেলের দিকেই লােকজন যাচ্ছে । জেলখানায় পাগলা ঘণ্টা মানে সাংঘাতিক ব্যাপার। ভয়ানক কিছু হয়েছে বা হতে যাচ্ছে। এর কিছুক্ষণের মধ্যে বিকট ফায়ারের শব্দ। মনে হল কান ফেটে গেল। জেলের দরজা-জানালাতে লােহার শিক, কাজেই আওয়াজ তখন খােলা। আমরা ভেবেছি এর পরেই বুঝি আমাদের পালা এল। কিন্তু না, তারপর আর কোন শব্দ নেই। ধীরে ধীরে ভাের হল। এদিকে এই ঘটনার দুই-এক দিন আগে জেল রক্ষীদের কাছ থেকে খবর পেয়েছিলাম ডালিমসহ সামরিক বাহিনীর উচ্চপদস্থ কিছু লােকজন জেলখানার ভেতরে এসে দেখে গেছে। তৎকালীন ডিআইজি প্রিজনের সাথে আমার ভাল পরিচয় ছিল। সম্ভবত ৩০ অক্টোবর আমার পরিবারের সাথে জেল গেটের অফিসে দেখা করে আমি ডিআইজির রুমে গেলে তিনি আমাকে সামরিক বাহিনীর লােকজনের জেলের ভেতরে আসা যাওয়ার খবর দেন। ৫/৬ তারিখে আমার পরিবারের সাথে সাক্ষাতের দিন ছিল। ওদের বিদায় দিয়ে আমি আবার ডিআইজির রুমে গেলাম।

আমি ওনার কাছে জানতে চাইলাম ঘটনাটা কি হয়েছিল, কিভাবে হল ? তিনি জানালেন, চ্যালেঞ্জ করার পর ওরা জীপ নিয়ে চলে যায়। সেই সময়েই কারাগারে পাগলা ঘণ্টা বাজিয়ে দেওয়া হয়। এর কিছুক্ষণ পর আবার ফিরে আসে। ওদেরকে আবার বাধা দেয়া হয়। তখন ওরা বলে ঠিক আছে, বঙ্গভবনে ফোন করেন। খন্দকার মােশতাক তখন ক্ষমতায় । খন্দকার মােশতাক ফোনে বলে, ‘ওরা গেছে, ওদেরকে সাহায্য করেন। ওরা যা করতে চায় করতে দেন। ওরা ভেতরে যাবে।’ খন্দকার মােশতাক সরাসরি এই নির্দেশ দেন। এরপর তাদেরকে নিউ জেলে ঢুকতে দেয়া হয়। এরা সরাসরি নিউ জেল বিল্ডিংয়ে চলে যায়। নির্মমভাবে হত্যা করে চার মহান নেতাকে। এই হত্যাকাণ্ডের বেশ পরে ডিআইজি-র কাছ থেকেই শুনেছিলাম যে, ৩ নভেম্বর রাতের ঘটনার অনুসন্ধান হয়েছিল। সকলের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করা হয়েছিল। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। তখন জেলের একজন ডেপুটি জেলার ছিল আমার ছাত্র, সেও আমাকে এই । সমস্ত ব্যাপারে অনেক কিছু বলেছিল। এদের সবার কথা শুনে আমার মনে হয়েছে খন্দকার মােশতাক সাক্ষাৎ এক শয়তান। আমার শুধু মনে হয়নি, আমি স্থির জানি, বিশ্বাস করি, খন্দকার মােশতাকের নির্দেশেই এই নির্মম-নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে।

মােহাম্মদ মহিউদ্দিন

* সভাপতি : মুন্সিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগ

আমি ছিলাম কামরুজ্জামান ভাইয়ের রুমে। ২ তারিখ সকালে দূর থেকে দেখলাম তাজউদ্দীন ভাই মাটি ঠিক করছেন, ওনারই হাতের লাগান ছােট ছােট চারায় নিড়ানি দিচ্ছেন। আমি ওনার কাছে এগিয়ে যেতেই বললেন ঃ এই সময় আমাদের মনের বলই সব চাইতে বড় বল। আমাদের কাজ করতে হবে। আমরা যদি মানসিকভাবে ভেঙে পড়ি তাহলে কি ভাবে চলবে! সাহস হারাবে না। বেঁচে থাকতে হবে। রাতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, সম্ভবত মায়া আমাকে ডেকে তুলল। বলল, পাগলা ঘণ্টা বাজছে। পাশের ঘরের শিকের দরজার সামনে থেকে তাজউদ্দীন ভাইয়ের কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে। অনেক অস্পষ্ট কথার মধ্যে যেটুকু শুনতে পেলাম— তিনি বলছেন, এই সংকেত খুব খারাপ। অশুভ সংকেত। কামরুজ্জামান ভাই বললেন, ভাল মনে হচ্ছে না। দেখা যাক আল্লাহ্ কি করে। পাশের রুমের তালা খােলার শব্দ হল। শুনতে পাচ্ছি সবাইকে ৩ নম্বর রুমে যেতে বলল। এমন সময় কে একজন চিৎকার করে বলল, তাজউদ্দীন, নজরুল সাহেব ভেতরেই থাকেন, যাবেন না। একটু পরেই জেল সুবেদার আমাদের ২ নম্বর রুমের তালা খুলল এবং কামরুজ্জামান ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি আসেন। এই যে রুমের তালা খােলা, ১ নম্বর রুমে চার নেতাকে একসাথে করা, সবই করেছে জেল কর্তৃপক্ষ, পরে শুনেছি ঘাতকেরা অস্ত্র হাতে তখন বাগানের পাশে দাঁড়ান ছিল। এদিকে আমরা সকলেই হয়ত ভাবছি কি হবে, কি হতে যাচ্ছে। সেই মুহূর্তে খুব । জোরে তাজউদ্দীন ভাইয়ের গলার চিৎকার শুনলাম, What are you doing ? এবং সাথে সাথেই ব্রাশ ফায়ারের শব্দ—মনে হল বােমা পড়ছে। একাধিক স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র থেকে এক সাথে গুলি বর্ষণ। পাশের ঘরে সে কি বিকট শব্দ, মনে হয়েছিল ভেঙেচুরে সব শেষ। তারপর চুপচাপ। চার তারিখ সন্ধ্যার দিকে আওয়াজে বুঝলাম নেতাদের বের করে নিয়ে যাচ্ছে।

নূরুজ্জামান * আইজি, প্রিজনস, ১৯৭৫

সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নির্দেশেই ২ নভেম্বর রাতে আমরা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে একত্রিত হই। আমাদেরকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছিল। সম্ভবত সে কারণেই পাগলা ঘণ্টা (সতর্ক ঘণ্টা) বাজিয়ে দেওয়া হয়। আমরা ধারণা। করছিলাম রাজনৈতিক কোন আলাপ-আলােচনার জন্যই বােধহয় কেউ আসবে। কিন্তু যখন দেখলাম সম্পূর্ণ মাতাল অবস্থায় রক্তবর্ণ চোখ আর স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ে সামরিক বাহিনীর তিন সেপাই আর এক সুবেদার এসেছে তখন অবস্থাটাই পাল্টে গেল। ওদের নির্দেশ মত ভেতরে চার নেতাকে অন্য সবার মাঝ থেকে। আলাদা করে এক রুমে আনা হল। ওরা যখন বলল, চার নেতাকে মেরে ফেলতেই ওরা এসেছে তখন আমরা ঐ মাতাল অস্ত্রধারীদের সামনে জমে বরফ হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু এদিকে আশ্চর্য ব্যাপার হল, পাগলা ঘণ্টা বাজান সত্ত্বেও নিয়ম মােতাবেক বিডিআর অথবা পুলিশ কেউই সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেনি। যাই হােক এই সময় সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে ফোনে নির্দেশ আসে ওই অস্ত্রধারী চারজন। যা করতে চায় তাই করতে দেওয়া হােক। ওদের বাধা দিলে যেটা হতে পারত আমরা জেল কর্তৃপক্ষ মরতে পারতাম। আমাদের চোখের সামনে জাতীয় সম্পদ চার নেতাকে ওরা গুলি করে হত্যা করল। আমাদের অবস্থা তখন বর্ণনাতীত। পরের দিন ডিআইজি প্রিজন লালবাগ থানায় বাদী হয়ে লিখিতভাবে এজাহার দেন। এরপর সেই রাতে জেলে উপস্থিত আমাদের সবার জবানবন্দি রেকর্ড করা হয় বিভিন্ন সংস্থা থেকে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্পেশাল ব্রাঞ্চ, সিআইডি, ডিজিএফআই আলাদা আলাদাভাবে সকলের জবানবন্দি রেকর্ড করে। এ ছাড়াও খালেদ মােশাররফ নিজে তার অফিসে এবং দু’জন কর্নেল আলাদাভাবে আমাদের জবানবন্দি রেকর্ড করেন। এই চারজন নেতা ছিলেন জাতীয় সম্পদ, অথচ এই মর্মান্তিক হৃদয়বিদায়ক হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়নি। আমি এই হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করছি।

কে. আব্দুল আউয়াল

* ডিআইজি, প্রিজন ঃ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার, ১৯৭৫

এই হত্যাকাণ্ডের দু-চার দিন আগে আমার সঙ্গে যােগাযােগ করে জেলখানায় কেউ এসেছিল বলে আমার মনে নেই। তবে সপ্তাহখানেক আগে একদিন আমি আইজির অফিসে আইজির দায়িত্বে ছিলাম। জেলখানায় আমার অফিসে ফিরে এসে শুনলাম, মেজর ডালিম আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। আমাকে। এখানে না পেয়ে আমার বাসাতেও গিয়েছিল। আমি ডালিমের সঙ্গে ফোনে যােগাযােগ করি। আমাকে কেন খুঁজছে জানতে চাইলে ডালিম বলে, আপনি বঙ্গভবনে আসেন, আপনার সঙ্গে কথা আছে। আমি বঙ্গভবনে গেলাম। সেখানে তাদের এডিসি জাতীয় কেউ ছিল, আমি তাকে বললাম ডালিমকে খবর দিতে। ওয়েটিং রুমে বসলাম প্রায় আধঘণ্টা। কারাে কোন খোঁজ নেই। আমি আবার সেই ক্যাপ্টেনকে বললাম। কিন্তু তারপরেও ২০/২৫ মিনিট বসে থাকার পর তাদের কারাে দেখা নেই। তখন আমি রেগে গেলাম। আমি ক্যাপ্টেনকে বললাম, ওদেরকে বলেন, আমি ওদের বাপের বয়সী একজন লােক বসে আছি, যে কিছুদিনের মধ্যে অবসরপ্রাপ্ত হতে যাচ্ছে, ওরা যেন আদব শেখে। এই কথা বলার দুই-এক মিনিটের মধ্যেই সেই ক্যাপ্টেন এসে বলল, আপনাকে ডাকে। ভেতরে গিয়ে দেখি একজন বসে আছে। আমি তাকে ডালিমই মনে করেছিলাম। তাই বললাম, আপনি কি ডালিম ? তিনি বললেন, না আমি ফারুক রহমান। আমি জানতে চাইলাম, কেন ডেকেছেন ? সে বলল, বাইরে থেকে যদি জেলখানার ওপর কোন রকম আক্রমণ হয় সেই জন্য আপনাদেরকে খুব সজাগ এবং হুশিয়ার থাকতে হবে। আমি বললাম, আমরা খুব সজাগ আছি। আমার যতদূর মনে পড়ে তাকে বলেছিলাম, আমি যদি কিছু করে তা হলে অন্য কথা। না হয় বাইরে থেকে আমাদেরকে কেউ কিছু করতে পারবে না। সেই দিন ফারুকের কথায় আমার মনে হয়েছিল জেলখানার ভেতরে যারা আছেন তাদের কাউকে বা কোন আসামীকে বের করে নিয়ে যেতে পারে।

এমন ইঙ্গিতই ছিল। এ ছাড়াও একবার আর্মি হেডকোয়ার্টার্স থেকে ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের এক ব্রিগেডিয়ার আমাকে ফোন করেছিল। বলেছিল, জেলখানায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ আসামী আছে, জেলখানায় আক্রমণ করে তাদেরকে হয়ত বাইরে নিয়ে যেতে পারে। আমি বলেছিলাম, সে সব ভয় করবেন না। যদি আর্মির কোন লােক না আসে, আমরা আমাদের জেলখানা রক্ষা করতে পারব। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে লক্ষ্য করেই এই কথাগুলাে বলা হয়েছে। আমাকে ফারুকও একই কথা বলেছে। ফোনে এই আলাপ হয়েছিল ঘটনার কয়েক দিন আগে। সেই রাতে আমাকে যখন খবর দেওয়া হয় তখন রাত প্রায় ভাের হয়ে এসেছে। আমাকে আইজি সাহেব নিজে ফোন করলেন। তিনি তখন জেলখানায় ছিলেন, সতর্ক ঘণ্টা বাজান হয়েছে। আইজি সাহেব বললেন, আমরা সবাই এখানে আছি, আপনি এখনই আসুন। আমি বললাম, আপনি কেন এখন জেলখানায় আছেন ? আমাকে উনি বললেন, আমাকে ফোন করেছিল এখানে আসবার জন্য। বলেছিল আপনি জেলে যান, সতর্ক ঘণ্টা বাজান, এলার্ট হয়ে জেল গেটে থাকেন। আইজি সাহেব আমাকে কোন এক ব্রিগেডিয়ারের কথা বলেছিলেন, তার নামটা মনে আসছে না। আইজি সাহেব বললেন, আমি, জেলার, ডেপুটি জেলার, সুবেদার, ডাক্তার সবাই জেল গেটে আছি। আমি যেন তখনই যাই । আমি তাকে আমার জন্য গার্ড পাঠাতে বললাম।

গার্ডের সঙ্গে আমি জেলখানায় গেলাম। সেখানে পৌছে জিজ্ঞেস করলাম, কি ব্যাপার? আইজি সাহেব বললেন, আমাকে বঙ্গভবন থেকে ফোন করেছিল। বলেছে। জেলে আসবার জন্য এবং এলার্ট থাকতে। আমি সেই হিসেবেই এসেছি। আপনি জেলের ডিআইজি আপনাকে ছাড়া তাে চলে না। সেই সময় কি ব্যাপার, কি ঘটনা, তিনিও কিছু জানেন বলে মনে হল না। কারণ তিনি এমনও বলেছিলেন, হয়ত রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হচ্ছে কিংবা এমন ধরনের কোন আলাপ-আলােচনা হতে পারে।  এই ধরনের ঘটনা একবার ঘটেছিল। যাদু মিয়া তখন জেলে, আইজি সাহেব তখন জেলার। জুলফিকার আলি ভুট্টো শেষ রাতে জেলে এসে মশিউর রহমান যাদু মিয়ার সঙ্গে দেখা করেছিলেন। এই সব কথাবার্তা আমরা নিজেরা আলােচনা করছিলাম। কিছু পরেই শুনলাম আর্মির কিছু লােক জেল গেটে এসেছে।

আমরা তখন আমার অফিস অর্থাৎ ডিআইজির অফিসে বসা। আমরা বললাম, ওদেরকে এই অফিসে আসতে দাও। কিন্তু জেলের লােক এসে বলল, ওরা নাম স্বাক্ষর করছে না। তখন আমি নিজে উঠে গেলাম। ওদের বললাম, জেলখানায় ঢুকতে গেলে নাম স্বাক্ষর করতে হয়, তাই নাম লিখতেই হবে। তখন ওরা চারজনই নাম লিখল। একজনের নাম আমার মনে আছে মুসলেম’। ওরা আমাদের অফিসে ঢুকল। ওদের হাতে অস্ত্র ছিল। আইজি সাহেব ওদের জিজ্ঞেস করলেন, কি ব্যাপার, কেন এসেছেন? চারজন নেতার নাম দিয়ে মুসলেম বলল, এদের আলাদা করে দেন। আইজি এবং আমি জেলারকে বললাম ঐ চার জনকে আলাদা করে দিতে। এক । রুম খালি করে শুধু ঐ চারজনকেই সেই রুমে নিয়ে আসতে। আমাদের নির্দেশ মত জেলার, সুবেদার এবং জেলের সেপাইরা ভেতরে গিয়ে রুম চেঞ্জ করে । আসল। কিন্তু তাদেরকে কেন আলাদা করা হল, তখনাে আমরা জানি না ওঁদেরকে খুন । করবে। ঐ যে জুলফিকার আলি ভুট্টো এসে যাদু মিয়ার সঙ্গে কথা বলেছিল। আবার হয়ত রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হতে পারে তাই তাদের সঙ্গে কোন জরুরী আলাপ-টালাপ আছে এমন মনে করছিলাম। কিছু সময় পর ওরা অস্ত্র। নিয়ে ভেতরে যেতে চায় এবং ততক্ষণে ওরা বলেই ফেলেছে যে ওরা চার। নেতাকে হত্যা করতেই এসেছে। আমরা তাে সবাই অবাক হয়ে গেলাম।

আইজি ওদের বললেন, আচ্ছা, আমি ফোন করি। সবার সামনেই উনি ফোন করলেন। উনি কাকে ফোন করলেন ঠিক জানি না—আগে তাে একজন ব্রিগেডিয়ারের সঙ্গে তার কথা হয়েছিল, তার সঙ্গে নাকি মােশতাকের সঙ্গে ঠিক জানি না। ফোনে তাকে বলা হয়েছে, হ্যা, ওরা যা বলে তাই কর। আইজি সাহেব তখনই আমাকে এই কথাটি বললেন। তারপর ওরা ভেতরের দিকে রওনা দিল। কিন্তু ভেতরের গেটে গিয়ে আমার অস্থির লাগল, অস্ত্র নিয়ে ভেতরে যাওয়া এটা ঠিক না। এই ধরনের একটা ঘটনা জেলখানার ভেতরে হতে পারে । আমি তখন বাধা দিলাম। ভয় পাইছেন? ভয় পাইছেন?’ বলে মুসলেম আমাকে ধাক্কা দিল। আমাকে বলল, যান যান আপনি চলে যান। আপনি ভয় পাইছেন। আমি বললাম, এটা ভয়ের প্রশ্ন না, আমার ৩০ বছর চাকরি হয়েছে, কোনদিন। জেলের ভেতরে এমন ঘটনা হয়নি। এখানে মানুষকে আশ্রয়ে রাখা হয়, এখানে এই জেলখানার ভেতরে এমন ধরনের হত্যাকাণ্ড চলতে পারে না। এই বলে আমি ফিরে চলে আসছিলাম, আইজি সাহেব আমার হাত ধরে বললেন, না, না ওনাকে থাকতে হবে। তখন ওরা আগে আগে গেল, আমরা আস্তে আস্তে পেছনে পেছনে গেলাম। তবে জানি না, আমি যে রকম বাধা দিয়েছিলাম, সমস্ত স্টাফ যদি আর্মির সামনে আমাকে সাপাের্ট করত, কোঅপারেট করত তাহলে কি হত বলা মুশকিল।

যখন গুলি চালান হয় আমি তখন ঐ এলাকার লক-আপের সামনে বাইরে দাঁড়ান ছিলাম। আমার সঙ্গে আইজি সাহেবও ছিলেন। ঘাতকদের সবার হাতেই অস্ত্র ছিল। তাই কে ফায়ার করেছে জানি না। ওদের সঙ্গে জেলার এবং সুবেদার ছিল। এরপরে আমি শুনেছি, ওরা আবার এসেছিল। তখন আর বাধা দেওয়ার প্রশ্ন ছিল না। আমি তখন জেলগেট সংলগ্ন আমার অফিসে। নামাজ পড়ার পর শুনলাম, চার নেতার একজন জীবিত আছেন জেনে আধঘণ্টা পর আবার তারা এসে বেয়নট চার্জ করেছে। আমাকে জেলার, ডেপুটি জেলার বলেছে এই ঘটনা। সম্ভবত কেউ জীবিত থাকলে ওদেরকে খবর দেওয়ার কথা ছিল। পরে মৃতদেহগুলাে কি করব সেই জন্য আমি আইজি সাহেবকে ফোন করলাম। তিনি তাে সব দেখে গিয়েছেন, আগাগােড়াই ছিলেন এখানে। তার সঙ্গে কথা বলে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, জেলে এত বড় ঘটনা ঘটে গেছে, আমি থানায় কেস করব। আমি অনেক পরে ভেতরে গেলাম, ঠিক কি অবস্থায় লাশগুলাে দেখেছি মনে পড়ছে না। থানায় যাওয়ার আগে ডাক্তারদের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। তারা বলেছেন, সকলেই মৃত। আমাকে কে যেন একটু ভয় দেখাল আমি থানায় এজাহার দিতে যাচ্ছি, এতে আমার বিপদ আছে। কিন্তু এতগুলাে মানুষকে মেরে ফেলল আমি কিছুই করব না—আমি লালবাগ থানায় কেস দিলাম। ৪ তারিখে থানায় কেস দিয়েছিলাম।

সেখানে আমি ঐ চারজনের নাম দিয়েছিলাম। এই কেসের এক কপি দিলাম আইজিকে আর এক কপি স্বরাষ্ট্র সচিবকে। এই কেস দেওয়ার কিছুদিন পর পুলিশ এসে তদন্ত করে গেল। আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করল। এর কয়েক দিন পরেই দেখলাম এনকোয়ারি কমিটি গঠন করা হয়েছে। গেজেটে দেখলাম আমাকেই জেল কিলিং এনকোয়ারি কমিটির সেক্রেটারি করা হয়েছে। জাস্টিস আহসানউদ্দিন হলেন চেয়ারম্যান। আমি কোর্টে আহসানউদ্দিন সাহেবের সঙ্গে দেখা করলাম। কিছু স্টাফ, স্টেনােগ্রাফার আরাে লােকজন ইত্যাদির জন্য আমরা হােমে একটি ডিমান্ড দিলাম। গেজেট নােটিফিকেশান অনুযায়ী কেউ যদি সাক্ষ্য দিতে না আসে তবে তাকে যেন আসতে বাধ্য করা যায় সে ব্যাপারে নােটিফিকেশানের জন্য আবার একটি ডিমান্ড নােটিশ করেছিলাম। আবার হােমে (স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়) লিখলাম। হোেম আবার ‘ল’ মিনিস্ট্রিতে লিখে আমাদের কপি দিয়ে গেল। কিন্তু আমি যতদিন ডিআইজি ছিলাম, কমিশনের সেক্রেটারি ছিলাম, ততদিন আর কোন জবাব আসেনি। এরপর আমি আইজি হয়ে হােমে চলে যাই। আমাকে ওএসডি করা হয়। তখন যিনি ডিআইজি হয়েছিলেন আমি তাকে কমিশনের সেক্রেটারির দায়িত্ব বুঝিয়ে দেই।

আমিনুর রহমান

* জেলার : ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার, ১৯৭৫

আমি ১৯৭৫ সালে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার ছিলাম। ১৯৭৫ সালের নভেম্বর মাসের ২ তারিখ রবিবার দিবাগত রাতে সম্ভবত রাত আড়াইটায় আইজি। প্রিজনস আমাকে টেলিফোন করলেন। আমি রিংয়ের শব্দ শােনামাত্র ফোন। ধরলাম। আইজি বললেন, তুমি নিচে যাও, আমি আসছি। আমি সঙ্গে সঙ্গে তাঁর। নির্দেশমত নিচে এসে গেটের খাতায় সই করলাম। কিছুক্ষণ পর আইজি সাহেব। আসলেন, আমি তাকে রিসিভ করে ডিআইজি সাহেবের রুমে বসালাম। আমি রুমের বাইরে কিছুক্ষণ থেকে আমার রুমে চলে এলাম। সেই সময় এক সেপাই। আমাকে বলল যে, আইজি সাহেব টেলিফোনে কথা বলছেন। আমার এটা জানা। আছে যে, আইজি সাহেব ডিআইজি সাহেবকে খবর দিয়ে আনিয়েছিলেন। আর্মিরা আসবার পর আমি তাদেরকে জেল গেট থেকে ডিআইজি সাহেবের রুমে যেখানে আইজি সাহেব অবস্থান করছিলেন সেখানে নিয়ে গেলাম। এর। আগে আর্মিরা ভেতরে ঢুকবার সময় আমি গেট ওয়ার্ডারকে বললাম যে, খাতা। ধর, ওনারা সই করবে। ওরা সই করতে চাচ্ছিল না। তখন ডিআইজি সাহেবকে ডেকে আনলে তিনি এবং আমি বললাম, এটা নিয়ম এখানে সই করতেই হবে। তারপর ওরা সই করে ভেতরে গেল। আমি কিছু সময় রুমের ভেতরে ছিলাম। আর্মিরা শুধু হাঁটাহাঁটি করছে, আইজি সাহেব ডিআইজি সাহেব বসা। ওদের সাথে কথা বলছে। তারপর আমি আমাদের জেনারেল অফিসে কিছু সময় বসা। ছিলাম। এরপর পাশের ঘর থেকে স্যার, স্যার’ এমন শব্দ শােনা যাচ্ছিল, জানালাগুলাে খােলা ছিল। এক পর্যায়ে আমি আমার রুমে চলে গেলাম। এই সময় সম্ভবত আমার রুমে একটা ফোন আসে।

আইজি সাহেব আমার রুমে এসে আমাকে রুম থেকে বের করে তিনি ফোনে কথা বললেন। আমি দরজার সামনে দাঁড়ান, শুনলাম তিনি আবার ফোনে ‘স্যার, স্যার’ করছেন। তারপর তিনি আমার রুম থেকে বের হয়ে এসে বললেন যে, Let us go inside. আমরা। ভেতরের দিকে রওনা হলাম। তখন রাত, তাই বড় গেট না খুলে ছােট গেট দিয়ে আমরা ভেতরে ঢুকলাম । কিছু দূর যাবার পর যেখানে আমরা বাঁ দিকে। মােড় নেব সেখানে গিয়ে ডিআইজি সাহেব আমাকে বললেন, জেলার সাহেব, কাজটা তাে বেআইনী হচ্ছে অস্ত্র নিয়ে ভেতরে ঢােকা নিষেধ, বেআইনী। এই কথাটা ওরা শুনেছে, সাথে সাথে তারা খুব জঘন্য একটা গাল দিল এবং ধাক্কা দিয়ে ডিআইজি সাহেবকে মাটিতে ফেলে দিল। আমরা যারা তাঁর সাথে ছিলাম। তখন তাকে ধরে তুললাম। এরপর আমরা নিউ জেল বিল্ডিংয়ের একদম পাশে। গিয়ে দাঁড়ালাম। এই সেলের রান্নাঘরের পাশে একটা লাইট ছিল আধাে আলাে, আধাে ছায়া, একটা বড় গাছের ছায়ার জন্য ভাল আলাে ছিল না; ওখানে ওরা সব দাড়াল। এখানে আইজি সাহেব আমার হাতে একটা কাগজ দিলেন চারজনের নাম লেখা এবং মুখেও বললেন এই চারজনকে এক রুমে নিয়ে এস। আমি কিছুই জিজ্ঞাসা করি নাই—কি বা কেন। আমি জেল সুবেদার ওয়াহেদ মৃধাকে বললাম, চাবি কোথায় ? চাবি তাে তখন আমাদের কাছে থাকে না। পেট্রোলিং ডিউটিতে যে সেপাই থাকে তার কাছে চাবি। তাকে ডেকে ওয়াহেদ মৃধা চাবি এনে দরজা খুলল। সেই সময় চাবি দিয়ে দরজা খােলার সময় আমার ঠিক মনে নেই তাজউদ্দীন সাহেবই কিনা বা অন্য কেউ জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে জেলার সাহেব ? আমি বললাম, আর্মিরা এসেছে।

এদিকে আমার তখন ধারণা আর্মিরা যখন এসেছে ওরা হয়ত বসবে, কথা বলবে। এই চিন্তা থেকে আমি বসার জন্য দুই পাশে চৌকি ঠিক করে দিলাম আর বসবার জন্য দুই তিনটা টুল দিলাম। আমি নজরুল সাহেব আর তাজউদ্দীন সাহেবকে বললাম, আপনারা থাকেন আর অন্যরা অন্য রুমে চলে যান। একই সাথে পাশাপাশি আরাে দুটো রুম খুলে দিলাম, সেখান থেকে কামরুজ্জামান সাহেব, মনসুর সাহেব এলেন। তাজউদ্দীন সাহেব বাথরুমে গেলেন, ওজু করলেন, নামাজ পড়লেন, পানি খেলেন। চৌকি যেভাবে সাজিয়ে ছিলাম সেখানে একপাশে বসলেন নজরুল সাহেব তারপর তাজউদ্দীন সাহেব, কামরুজ্জামান সাহেব তারপর মনসুর আলি সাহেব বসলেন। এই সমস্ত কিছু করতে বেশ সময় লাগল। সেই রাতে এই যে তাদেরকে এক রুমে আনা, তারা সবাই কাপড় বদলিয়েছেন, ওজু করেছেন, নামাজ পড়েছেন। এসবে অনেক সময় লেগেছে। ঐ সময়টা আমি একেবারে দণ্ডায়মান (Stand-by), তবে ওয়াহেদ মৃধা ঐ রুমে ছিল একেবারে সারাক্ষণ। আমি তাে আবার দু’বার বাইরে খবর দিতে গেছি। মনসুর আলি সাহেব স্যুটকেস খুলে একটা ধােয়া পাঞ্জাবি পরে মুখে পাউডার মেখে বের হয়েছিলেন। মুখে পাউডার ছােপ ছােপ লেগেছিল, স্পষ্ট মনে আছে। তখন আমি বাইরে গিয়ে আইজি সাহেবকে বললাম, স্যার, তাদেরকে এক রুমে আনা হয়েছে। আমি এ কথা বলবার সাথে সাথেই আমার সাথে আর্মির দু’জন ঐ রুমের দিকে হাঁটা শুরু করল। আমার খুব স্পষ্ট মনে আছে ঐ দু’জন ওদের স্টেনগানটা একদম নিজেদের শরীরের সাথে লাগিয়ে রেখেছে। আমার তাে ধারণা কথাবার্তা হবে তাই ঘরে ঢুকে চার নেতার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে আমি মনসুর আলি সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলতে গিয়েছি—He is Mr. Mon…. পুরাে নামটা বলতে পারিনি সাথে সাথে ওরা দু’জন গুলি করতে শুরু করল। আমি দ্বিতীয় গুলিতে মাটিতে ওদের পেছনে শুয়ে পড়লাম। আর্মির বাকি যে দুই-তিন জন বাইরে ছিল ওরা গুলি করতে করতে ভেতরে ঢুকল। ওদের ঐ গুলিগুলােই জানালার শিকে রডে লেগেছে।

ওরা এলােপাতাড়ি গুলি করে। আমার যতটুকু মনে পরে ৫৭/৫৮ রাউন্ড গুলি | করেছিল ওরা। আমার ঐ রিপাের্ট বইতে সমস্ত লেখা আছে। সকালে আমি গুলির খােসাগুলাে তুলি। ওরা যখন গুলি করছিল তখন ফজরের আজান হচ্ছিল চকবাজারের বড় মসজিদে। এই হত্যাকাণ্ডের পর যার যার মত সবাই চলে গেছে। কারণ আমাদের কারাে মানসিক অবস্থা স্বাভাবিক ছিল না। এমন একটা unwanted ঘটনা, অস্বাভাবিক ঘটনা যে, কয়েকটা অস্ত্রধারী | লােক ভেতরে এসে ৪ জনকে মেরে ফেলল। আমি আমার অফিসে এসে নামাজ  পড়লাম। বের হবার সময় ওরা প্রায় দৌড়ে গিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা জীপে | ওঠে। এর কিছু সময় পর শুনলাম আবার আর্মি এসেছে ৩/৪ জন। তারা এসে। ভেতরে ঢুকেছে। আমি শুনেই ভেতরে ঢুকলাম। আমি যখন নিউ জেল-এর ৮  নম্বর সেলের পেছনে গিয়েছি তখন দেখি ওরা ফিরে আসছে, কেউ একটু আগে | কেউ পেছনে। ওরা দৌড়ে ফিরছে, একেবারে ডাবল মার্চ। গেট তাে খােলা ওরা | বের হয়ে গেল। আইজি সাহেব, ডিআইজি সাহেব আমরা সবাই তখন জেলেই। ওরা আবার এল, বেয়নেট চার্জ করল, কেমন একটা দুঃসহ অবস্থা। আমি পরে শুনেছি মনসুর আলি সাহেব নাকি নড়াচড়া করছিলেন, এই জন্য ওরা | এসে বেয়নেট চার্জ করে। আমার যা মনে হয় মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্যই ঘাতকেরা পরে আবার ভেতরে যায়। আমি সকাল ৯টার সময় একবার রাউন্ড দিতে ভেতরে গিয়েছিলাম। তখন|’ পাশের দুই রুমের সবাইকে বলেছি, আপনারা নাস্তা করেন। কিন্তু তখন সবারই | ভয়ে এমন অবস্থা যে, কেউ আমাকে একটা কথাও জিজ্ঞাসা করতে পারেনি।’ সেই রাতে আইজি, ডিআইজি এবং আমরা সকল স্তরের অফিসাররা উপস্থিত ছিলাম। আমাদের সবার চোখের সামনে এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। হত্যাকারীদের |হাতে ছিল চায়নিজ রাইফেল এবং স্টেনগান। তবে গুলি করেছে যতদূর মনে হয়।

চায়নিজ রাইফেল দিয়ে, ওরা প্রত্যেকেই খুব অস্থির ও অধৈর্য ছিল। এই ঘটনার | সময় আমাদের ওখানে অস্ত্রসহ বিডিআর সদস্য ছিল ২০০ জন—তারা ছিল  নিরাপত্তা রক্ষা করার জন্য। জেলে এলার্ম (পাগলা ঘণ্টা) বাজান হল এবং | দিবালােকের মত সমস্ত জানিয়ে শুনিয়ে এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, এটা সবাই | জানে। প্রেসিডেন্টের সাথে আমাদের আইজি প্রিজনসের কি কথা হয়েছে না| হয়েছে, সেটা আমি কিছু শুনিনি। তবে তিনি টেলিফোনের এই প্রান্ত থেকে। স্যার, স্যার’ বলছিলেন, আবার আমার রুম থেকে যখন কথা বলেন, তখনও  স্যার, স্যার’ বলছিলেন। আমি পরে আইজি সাহেবের কাছে এই ঘটনা সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলাম, তিনি বলেছিলেন, মেজর (কর্নেল) রশিদ বা ঐ কিলারদের লিডার কেউ বলেছিল, ওদেরকে পাঠান হয়েছে, ওরা যা করতে চায় ওদেরকে তা করতে  দেন। তখন আইজি সাহেব যে হেজিটেট করছিলেন, দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলেন তা ঘটনা থেকে বােঝা যায়। এই রুম থেকে ঐ রুমে এসে আবার একা একা ফোনে কথা বললেন। আইজি সাহেবের সাথে খন্দকার মােশতাকের খাতির ছিল। তিনি যেহেতু আগে ঢাকা জেলের জেলার ছিলেন এবং আমাদের আইজি সাহেবের সাথে আওয়ামী লীগের সবার সাথেই ভাল পরিচয় ছিল। আমি ভােরবেলা ভেতরে গিয়ে একটা সেপাইকে দিয়ে রান্নাঘরের পাশের ট্যাঙ্কি থেকে পানি এনে ঐ ঘরের সামনের দিকের ড্রেনের পাশের রক্তগুলাে একটু ধুয়ে রাখলাম। আবার ওদের কেউ গালাগালি করে না কি করে মনে এই চিন্তাও ছিল। যাইহােক আমার খুব খেয়াল আছে এই হত্যাকাণ্ডের পর রশিদ দুইবার ফোন করে বলেছিল, আমি রশিদ বলছি, সব ঠিক আছে তাে! আমি বলেছি, হ্যাঁ, ঠিক আছে। এদিকে আইজি সাহেব আমাকে ডেকে বললেন, তুমি আর ঐ দিকে যাবে না। যেমন আছে তেমনই সব পড়ে থাকবে।

সরকার থেকে যা অর্ডার আসবে সেই অনুসারে কাজ হবে। পরে সরকারের নির্দেশে আইজি বা ডিআইজি সাহেব বললেন যে, ভেতরে গিয়ে সব ঠিক করতে। আমি ভেতরে গিয়ে তাদের হাতের কারাে আংটি কারাে ঘড়ি এসব খুলে আলাদা করে রুমালে পােটলা করে বেঁধে রাখলাম। দুপুর ১২টা-১টার দিকে চা-পাতা বরফ কিনে আনা হল সবগুলাে মৃতদেহের জন্য। বরফ দেয়ার সময় আমি আর দেখতে পারছিলাম না, ওয়াহেদ। মৃধাই সে সময় এই সমস্ত কাজগুলাে করে। পরদিন সন্ধ্যার আগে দিয়ে ঠিক হল ৪ নেতার মৃতদেহের পােস্টমর্টেম করা হবে। এই ঘরেই পােস্টমর্টেম করা হল। এইভাবে ৩ তারিখ পুরাে দিন চলে গেল। রাতটা পার হল। পােস্ট মর্টেমের পর আমাকে জানান হয় কামরুজ্জামান সাহেবের মৃতদেহ হেলিকপ্টারে করে রাজশাহীতে নেয়া হবে। আহমেদ বাওয়ানী স্কুল মাঠে সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেবের নামাজে জানাজা হয়েছিল। এদিকে জেল হত্যাকাণ্ডের বেশ আগে কিন্তু একটি ঘটনা ঘটেছিল। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন যুগ্মসচিব মঞ্জুরুল করিম সাহেব আমাকে একদিন অফিস। টাইমে ফোন করে বললেন, আজকে আর্মিরা জেলখানায় যাবে, তুমি একটু দেখিয়ে দিও। তখন আমি আইজি সাহেবকে বিষয়টি ফোনে বললাম বা আইজি সাহেবই আমাকে একই বিষয়ে বলতে ফোন করল। আমি বললাম, কখন আসবে ওরা । উনি বললেন, রাতে। আমি বললাম, কত রাতে। উনি বললেন, রাত ১১টা-১২টার দিকে। দুই দিন এসেছিল আর্মির লােক। মােট তিন জন করে। মার্শাল বা এই জাতীয় কিছু লেখা ছিল ব্যাজে। ওরা এসে সেই গভীর রাতে হসপিটাল থেকে শুরু করে নিউ জেলসহ সম্পূর্ণ জেলখানাটা ঘুরে দেখল।

আমি ওদেরকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, স্যার, আপনারা এখানে কি দেখতে  এসেছেন, কি ব্যাপার? ওরা বলেছে, ঢাকা জেলের ভেতরে কোন ছােট বিমান | বা হেলিকপ্টার ল্যান্ড করতে পারে কিনা এটা দেখছি। এটা প্রথমবার । দ্বিতীয়বারও এসে একই কারণ বলেছে। তবে পরেরবার আগের একজন ছিল,  দুই জন নতুন। এছাড়া আমার অবর্তমানে আর কেউ ভেতরে গেছে কিনা আমি  জানি না, কিন্তু অফিসে আর্মির লােক এসেছে। এর পর আর একটা ঘটনা—যে দিন নেতৃবৃন্দকে মেরে ফেলল সেদিন সকাল  ৯টার দিকে আমি গােসল করতে যাচ্ছি একটা সেপাই সেই মুহূর্তে এসে বলল, স্যার, একটা লােক আপনাকে ডাকে। তখন আমি আমার দোতলার কোয়ার্টার  থেকে নিচে নেমে এলাম। গেটে সেন্ট্রি যেখানে দাঁড়ায় সেখানে একটা লােক বলল যে, যাদেরকে যে রাতের বেলা নিয়ে যাবার কথা ছিল তাে তারা চলে গেছেন। আমি শুধু বললাম, হ্যা, চলে গেছেন।  আমাদের নিয়ম হল ২৪ ঘণ্টায় যা ঘটে তা আমি আমার রিপাের্ট বইতে লিখে রাখব, সেটাই রুল।

আমি লিখেছি এবং সেটা ডিআইজকে দিয়েছি। সেই অনুযায়ী সেই ৩ তারিখের সমস্ত ঘটনার পুখানুপুঙ্খ বিস্তারিত বর্ণনা লেখা আছে পরিষ্কারভাবে। পরে অবশ্য আমি শুনেছিলাম আইজি এবং ডিআইজি সাহেবকে খালেদ মােশাররফ ডেকে সমস্ত শােনেন। তবে স্বরাষ্ট্র সচিব তসলিম সাহেব সবচাইতে প্রথম তাদেরকে ডেকে নেন এবং ডেকে নিয়ে সমস্ত বিস্তারিত শােনেন। তসলিম সাহবের কাছ থেকে ফিরে এসে আইজি এবং ডিআইজি সাহেব বলেছিলেন—আমিনুর রহমান, একটা বিষয় আমাদের কাছে সন্দেহ লাগছে যে, আমরা যে সময় গেলাম তসলিম সাহেব সে সময় রুমে ছিলেন না, কিন্তু টেবিলের উপর চার জন নেতার নাম লেখা কাগজ ছিল। তার মানে আমরা যাবার আগে স্বরাষ্ট্র সচিবকে নিশ্চয়ই কেউ বলেছে কে মারা গেছেন, তা না হয়। তিনি জানলেন কি করে! আমার যা মনে হয়, তাজউদ্দীন সাহেবের ডায়েরি জেলে আটক নেতৃবৃন্দের কারাে কাছেই হয়ত ছিল। কারণ জেল কোড অনুযায়ী ঘড়ি, আংটি এসব মূল্যবান জিনিস আমার রাখার কথা। অন্যগুলাের কথা আমার জানা নেই। জেল কোড অনুযায়ী আমাদের একটি সাপ্তাহিক রাউন্ড হত। রাউন্ডে ডিআইজি সাহেবসহ আমরা থাকতাম। এই সময় নেতৃবৃন্দের সাথে অনেক কথা হত । যেহেতু তারা মান্যগণ্য মানুষ ছিলেন তাদেরকে আমরা সমীহ করতাম। তারা তাদের সুবিধা-অসুবিধা বলতেন।

আমরা সব সময় আলাদাভাবে তাদের দিকে খেয়াল রাখতাম। সেই রাতে আইজি সাহেব বা ডিআইজি সাহেব যদি বলতেন যে, আমিনুর রহমান, ওরা ৪ জন নেতাকে মেরে ফেলতে এসেছে, এটুকু জানা থাকলে একটা গােলমাল সৃষ্টি করা বা বিডিআরকে বলা, ভাই, ওরা মারতে এসেছে, তােমরা ওদেরকে ঠেকাও। একটা ফাইট নিশ্চয়ই দেয়া যেত বা কিছু একটা হত। তাজউদ্দীন সাহেব খুব লেখাপড়া করতেন। জেলের লাইব্রেরি থেকে আমরা তাকে বই-পুস্তক দিতাম। আমার স্পষ্ট স্মৃতি আছে তার বাগান করার খুব শখ ছিল। দুইবার তিনি আমাকে দিয়ে ধানমন্ডি থেকে গােবর সার আনিয়েছিলেন। আমি তাজউদ্দীন সাহেবের বাসার ঠিকানায় এসে গােবর নিয়ে গেছি। তাজউদ্দীন সাহেব করতেন না, এমন কোন কাজ ছিল না। মাটির চুলায় লাকড়ি দিয়ে রান্না হত । তিনি রান্নার জন্য প্রায় রােজ লাকড়ি কাটতেন। নিজের কাপড় নিজে ধুয়ে ফেলতেন। নিজ হাতে দড়ি টানিয়ে কাপড় শুকাতেন। তাজউদ্দীন সাহেব যে কাপড় ধুয়ে মেলতেন তা অত্যন্ত সুন্দরভাবে টানটান থাকত, কোন কোনা ঝুলত না। তারপর কিভাবে বেঞ্চ বানাতে হয় তা শেখান, গাছ লাগান সব করতেন। খুব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতেন। বিশেষ করে মনে পরে ওনার দাতগুলাে খুব চমৎকার ঝকঝকে সুন্দর ছিল। পরবর্তীতে এই হত্যাকাণ্ডের বহু বছর পর আমি যখন ডিআইজি হয়ে আবার এই ঢাকা জেলে গেলাম, তখন দেখেছি ওনার হাতে লাগান তিনটা গাছ ছিল। তার মধ্যে একটা জবা ফুলের গাছ। মওসুমি ফুলের মধ্যে ডালিয়াসহ বহু গাছ তিনি লাগিয়েছিলেন সেই সময়টাতে । আর তাজউদ্দীন সাহেব তাে খুব রিজার্ভ কথাবার্তার মানুষ ছিলেন, আলতু ফালতু কথা একদম বলতেন না। আমরা লাইব্রেরির ক্যাটালগ ওনাকে দিতাম, তিনি তাতে মার্ক করে দিতেন। নজরুল সাহেবও বই পড়তেন।

আবদুল ওয়াহেদ মৃধা

* সুবেদার : ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার, ১৯৭৫

জেল সীমানার মধ্যেই আমার বাসস্থান ছিল। সম্ভবত রাত আড়াইটার সময় পাগলা ঘণ্টার আওয়াজ শুনে আমি দৌড়ে জেল গেটে চলে আসি। আমি তখন ডিউটিতে ছিলাম না, তাই আমার পরনে ছিল সিভিল পােশাক। জেল গেটে এসে দেখি সমস্ত অফিসার সেখানে। তারা যেন সবাই কিসের অপেক্ষায় আছেন। আমাকে দেখেই জেলার সাহেব বললেন, যান পােশাক বদলে আসেন। আমি কোয়ার্টারে গিয়ে কাপড় বদলে আসতে প্রায় তিনটা বেজে গেল। আবার জেলার সাহেব আমাকে বললেন, ভেতরে গিয়ে দেখেন কি হচ্ছে । কেন পাগলা ঘণ্টা বাজছে, কি ব্যাপার কিছুই বুঝতে পারছি না। ভেতরে আটজন এরিয়া জমাদার যার যার ভাগ করা এরিয়ায় ডিউটি করে। আমি তাদেরকে ডাক দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কি ব্যাপার? ওরা আমাকে বলল, স্যার, আমরা তাে কিছুই জানি না। ওদের সঙ্গে কথা বলে আমি আবার জেল গেটে এসে দেখি আর্মির লােক এসে গেছে। আইজি-ডিআইজি সবার সামনেই জেলার সাহেব আমার হাতে একটা কাগজ তুলে দিলেন। বললেন, এদের সবাইকে একসঙ্গে করুন । আমি ভেতরে গিয়ে এরিয়া জমাদারকে ডাকলাম, তার কাছে চাবি থাকে। ইতােমধ্যে আমাদের অফিসাররাও ভেতরে চলে এসেছেন। তাদের সামনেই গেট খােলা হল। ১ নম্বর রুমের তালা খােলার সময় তাজউদ্দীন সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কি ব্যাপার ? আমি বললাম, আর্মি এসেছে। লিস্টের নামের দুইজন ছিলেন ১ নম্বর রুমে, বাকি দুইজন ছিলেন ২ নম্বর ও ৩ নম্বর রুমে। বাকি দুই রুম খােলার সময়ও আমাকে সবাই জিজ্ঞেস করলেন, কি ব্যাপার? আমি তাে কিছুই জানি না, বললাম, বােধ হয় নতুন মন্ত্রিসভা গঠন।

হবে, তাই আপনাদের নিয়ে যাবে। ১ নম্বর রুমে ৪ জনকে একসঙ্গে করবার পর তাজউদ্দীন সাহেব তার তিন সঙ্গীর দিকে তাকিয়ে বললেন, সময় নেই ওজু করে আসেন। চারজনই বাথরুম থেকে ওজু করে এলেন। সৈয়দ সাহেবের চৌকিতে সবাই বসলেন। আমি রুমেই দাড়িয়ে ছিলাম। এমন সময় ঘাতক চারজন ঢুকল। ঢােকার সঙ্গে সঙ্গেই সামনাসামনিভাবে গুলি করল। প্রায় ৬০ রাউন্ড গুলির শব্দ। আমি আর্মিদের পেছনেই দাড়ান ছিলাম। ওরা গুলি শেষ করেই প্রায় দৌড়ের মত করে বের হয়ে জেল গেটের দিকে গেল, পেছনে আইজি, ডিআইজি সবাই। তখন সবকিছু অন্যরকম হয়ে গেল, আমি ভয়ে দৌড় দিয়ে ৩ নম্বর সেলের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। সেই সেলের এবং পাশের একটা আলাদা সেলে ছিলেন এসপি মাহবুব। সবাই ভয়ে আতঙ্কিত। কেউ কোন কথা বলছেন না। আমার তখন এমন অবস্থা যে নিজের অবস্থাই নিজে বলতে পারব না। তাই সেই ৩ নম্বর সেলের পেছনেই দাড়িয়ে ছিলাম। অনেকক্ষণ পর যখন জেলগেট অফিসের দিকে রওনা দিলাম তখন চারিদিকে কেউ নেই। ১ নম্বর রুমের দিকে তাকিয়ে দেখবার মত অবস্থা আমার ছিল না। আমি সােজা অফিসে এসে ডিআইজি সাহেবের রুমে ঢুকে কলসি থেকে এক গ্লাস পানি ঢেলে খেয়ে ঐ কলসির পানি দিয়েই ওজু করে নামাজ পড়লাম। তারপর কিছু সময়ের জন্য আমি আমার কোয়ার্টারে ছিলাম। ৬টার সময় আবার ডিউটিতে এলাম। সে সময় সমস্ত দিক আনলক করে শেষে  ঐ দিকটায় গেলাম। গিয়ে দেখি তালাবদ্ধ। আমি আর ভেতরে গেলাম না।

দুপুরের পর খবর এল নেতাদেরকে গােসল ইত্যাদি করাতে হবে। জেলের ভেতরে একটি ছেলে ছিল মৌলভি। ওর হাতে পানি গরম করিয়ে নেতাদের যে সাবান ছিল সেই সাবান দিয়ে ইসলামি কায়দায় গােসল করিয়ে রুমের সামনেই বারান্দায় ৪টা খাটে শুইয়ে তাদেরই ব্যবহৃত চাদর দিয়ে ঢেকে রাখা হল। আমরা ডিআইজি এবং জেলার সাহেবকে জানালাম, এইভাবে তাে মৃতদেহ রাখা যাবে না, বরফের ব্যবস্থা করতে হবে। কর্তৃপক্ষ বরফের ব্যবস্থা করলে সেই বরফ খাটের নিচে, চাদরের ওপর দিকে দিয়ে রাখা হল। এর মধ্যে বাইরে থেকে অনেক অফিসাররা এসে গেছে। সবাই সিভিল ড্রেসেই ছিল, তাই আর্মির লােক অথবা পুলিশের লােক বােঝা যায়নি। ওরা অনেকেই মৃতদেহের চাদর সরিয়ে দেখেছে। ১ নম্বর রুমের টেবিলে রাখা কোরআন শরিফ পর্যন্ত গুলিতে ফুটো হয়ে গিয়েছিল। ছাদের টিন, ফ্লোর, টেবিল গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল। স্টেনগান বা এলএমজি দিয়ে ওরা গুলি করে। রাতে বাইরের কেউ জেলের ভেতরে ঢুকতে পারে না, আর ওরা অস্ত্র নিয়ে ঢুকেছে, এটা খুব উঁচু মহলের নির্দেশেই ঘটেছে। খন্দকার মােশতাক না আর্মি হেডকোয়ার্টারের নির্দেশ ছিল, আমি ঠিক বলতে পারব না। এটা আইজি, ডিআইজি সাহেবরা বলতে পারবেন। তবে তাঁরা নির্দেশ পেয়েই জেল গেটে হাজির ছিলেন। পরে জেলেই কথায় কথায় শুনেছি চার নেতাকে হত্যার নির্দেশ এসেছিল খন্দকার মােশতাকের কাছ থেকে। আমি সেই রাতে ঘাতকদের পােশাক দেখেই বুঝেছিলাম একজন ছিল আর্মির সুবেদার আর তিনজন সেপাই। জেলের কথা বলতে গেলে একটা কথা আমার প্রায়ই মনে হয়, তাজউদ্দীন সাহেব বাগান করতেন। এই নৃশংস ঘটনার দুই-এক দিন আগে তিনি আমাকে বললেন, সুবেদার সাহেব, আমাকে কিছু ফুলের চারা দেবেন। আমি তাকে ৭০/৮০টা চারা দিয়েছিলাম।  তিনি দুই দিন ধরে সেই চারা লাগিয়েছিলেন। তাজউদ্দীন সাহেব অন্য ধরনের মানুষ ছিলেন। অত্যন্ত অমায়িক মানুষ ছিলেন তিনি। ‘৭৫-এ জেলখানায় চোখের সামনে ওই ভয়াবহ ঘটনা দেখার পর থেকেই আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছি। প্রতি বছর নভেম্বর মাস আসে, আমি খবরের কাগজ পড়তে গিয়ে চার নেতার ছবি দেখলে অস্থির হয়ে পড়ি। আমি এই হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই।

ডাক্তার রফিক

ডাক্তার ও জেল হাসপাতাল, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার, ১৯৭৫

আমি জেল সংলগ্ন আমার বাসায় ঘুমিয়ে ছিলাম। পাগলা ঘণ্টা এবং এরপর হঠাৎ ব্রাশ ফায়ারের শব্দে জেগে উঠে বসি। এর পরপরই জেলগেটে আমাদের যে অফিস আছে সেখানে আমি চলে আসি। তখনও সব চুপচাপ। আমার সঙ্গে দু’জন ডেপুটি জেলারের দেখা হয়। তখনও জেলের ভেতরে ঢুকবার দ্বিতীয় গেট তালাবদ্ধ। আমি অফিসের মধ্যে ঢুকে জিজ্ঞেস করি কি ঘটনা। কিন্তু তখনও পরিষ্কার করে কেউ কিছু বলছে না। তবে শুনলাম, বাইরে থেকে আর্মির কিছু লােক ভেতরে ঢুকে গুলি চালিয়েছে। সমস্ত সকাল অফিসেই কাটল। সকাল ১০টার দিকে অফিস থেকে বলা হল ভেতরে যে মৃতদেহগুলাে আছে তাদের পােস্টমর্টেম করতে হবে। আমি ধীরে ধীরে নিউ জেল বিল্ডিংয়ের ১ নম্বর রুমে ঢুকলাম। ঢুকে দেখি ঘরময় ছড়ান রক্ত। রক্তাক্ত চার নেতাকে সেই রুমেরই ৪টা চৌকিতে শােয়ানাে হয়েছে। দেয়ালে গুলির চিহ্ন। বাইরে থেকে অন্যান্য ডাক্তার তখনও এসে পৌছাননি, তাই পোেস্টমর্টেম করতে আরাে দেরি হবে। আমি তখন তাড়াতাড়ি চা পাতা ও প্রচুর বরফের ব্যবস্থা করতে বললাম। সে দিনই অথবা পরদিন দুপুরের পর এই ১ নম্বর রুমের ভেতরেই পােস্টমর্টেম করা হল। সেই সময়ে ঢাকার সিভিল সার্জন, ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের একজন ডাক্তার, আমি এবং আরাে বেশ কয়েকজন ডাক্তার উপস্থিত ছিলেন। আমাদের রিপাের্ট ছিল বুলেটের আঘাতই মৃত্যুর কারণ। সকলেই ছিলেন স্পট ডেড। তবে মনসুর আলি সাহেবের সমস্ত শরীরে বেয়নেট চার্জ করা হয়েছিল। জেলে তখন সবাই আতঙ্কিত। কোন ধরনের আলাপ কেউ করতে চায় না। তবুও কেউ বলছে ৪ জন, কেউ বলেছে ৫ জন সেই রাতে অস্ত্র নিয়ে ঢুকেছিল। এমনও শুনেছি ডিআইজি প্রিজনস ঘাতকদের অস্ত্র নিয়ে ভেতরে ঢুকতে বাধা দিয়েছেন। তবে স্বাভাবিকভাবেই জেল কর্তৃপক্ষ সবারই সেই রাতে জেলে উপস্থিত থাকবার কথা।

সূত্র : আমার ছোটবেলা ১৯৭১ এবং বাবা তাজউদ্দীন আহমেদ – সিমিন হোসেন রিমি