You dont have javascript enabled! Please enable it! প্রায় ২০/২৫ জন লোককে মারতে মারতে পায়খানায় নিয়ে যাচ্ছে - সংগ্রামের নোটবুক

এপ্রিলের ২৭ তারিখে বাসার খোঁজ নেবার জন্য শহরে চলে আসি। কিন্তু মায়ের অনুরোধে সেদিন বাসাতে রাত্রি কাটানোর জন্য থেকে যাই। কিন্তু সেই দিন রাত্রি দু’টার সময় পাকসেনারা আমাদের বাসাসহ আরও অনেকগুলো বাসা ঘেরাও করে এবং আমাদের বাসার ভিতরে যেয়ে দরজায় ধাক্কা মারতে থাকে। আমার আব্বা দরজা খুলে দেন। সঙ্গে সঙ্গে আমার আব্বাকে ধরে ফেলে এবং তার চোখ বেঁধে ফেলে। তারপর লাফ দিয়ে একজন আমার নিকট চলে আসে এবং আমাকে ধরে ফেলে এবং আমারও চোখ হাত বেঁধে ফেলে। তারপর আমাকে এবং আব্বাকে বাসার বাইরে নিয়ে যায়। আমি অনুনয়-বিনয় করে বলতে থাকি আমরা মুসলমান, আমরা মুহাজির। তারপর তারা আমাকে মুখ বন্ধ করতে বলে। আমি আর কোন কথা না বলে চুপ করে থাকি। আব্বা ধরা পড়ার সাথে সাথে জোরে জোরে কালেমা পড়তে থাকেন। আব্বার কালেমা পড়ার জন্য তাকে জোরে জোরে বন্দুকের বাঁট দিয়ে মারতে থাকে। আব্বার বয়স প্রায় ৮০/৮৫ বছর। তারপর তিনি ধীরে ধীরে কালেমা পড়তে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে আমাকেও রাইফেলের বাঁট দিয়ে মারতে থাকে এবং বলতে থাকে কালেমা মাত কর। আমাদের ঐ অবস্থা দেখে আম্মা কান্নাকাটি করতে থাকেন। আম্মার কান্নাকাটি করা দেখে একজন মিলিটারী বাসার মধ্যে চলে যায় এবং আম্মাকেও বন্দুক দিয়ে বাড়ি মারে। তার হাতের রিঙ খুলতে চেষ্টা করলে অন্য একজন মিলিটারী গিয়ে তাকে বাঁধা দেয় এবং সেখান হতে তাকে বাসার বাইরে নিয়ে আসে। আমার হাত এবং আব্বার হাত একত্র করে বেঁধে ফেলে। তারপর আমাদেরকে চোখ বাঁধা অবস্থায় ১০/১২ গজ হাঁটিয়ে নিয়ে এসে এক জায়গায় বসতে বলে। আমরা বসে পড়ি। এর মাঝে আমি পানি চাইলে আবার এসে মারা আরম্ভ করে। তারপর আমরা সেখানে বসে থাকি। তার ৪/৫ মিনিট পর আরও ৮/১০ জন লোককে ধরে মারতে মারতে আমাদের নিকট নিয়ে এসে রাখে। তারপর তারা সবাই একত্রিত হবার পর তাদের মধ্যে থেকে একজন মিলিটারী বলে ওঠে এ তো বুড্ডা একে নিয়ে কি হবে। আমাদের মধ্যে একজন ছোট ছেলে ছিল তাকে এবং আমার আব্বাকে তারা ছেড়ে দেয়।

তার প্রায় আধা ঘন্টা পর আমরা গাড়ির শব্দ পাই। একটা গাড়ি এসে আমাদের সম্মুখে থামে এবং মিলিটারীরা নিজেরাই ধরাধরি করে আমাদেরকে গাড়িতে উঠায়। তারপর গাড়ি ছেড়ে বেশ কিছু দূর গিয়ে গাড়ি থেমে পড়ে। আমাদেরকে গাড়ি হতে ধাক্কা দিয়ে নামিয়ে ফেলে। তারপর একটা ঘরের দরজার নিকট নিয়ে গিয়ে আমাদের সবার চোখ খুলে দেয় এবং ঘরের মধ্যে আমাদেরকে ঢুকিয়ে দেয়। ঘরের মধ্যে আমরা ঢুকে সবাই সবাইকে এক নজর দেখে নিলাম। তার পরপরই ভোরের আযানের শব্দ আমার কানে ভেসে আসতে লাগলো। আমরা জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখতে পাই প্রায় ২০/২৫ জন লোককে মারতে মারতে পায়খানায় নিয়ে যাচ্ছে আবার মারতে মারতে পায়খানা হতে নিয়ে আসে। তারপর আমাদেরকে পায়খানা করার জন্য বাইরে নিয়ে যায়। পায়খানা করা হলে সবাই অজু করে নেবার পর আবার উক্ত জায়গায় নিয়ে এসে রেখে দেয়। আমরা সবাই নামাজ পড়ে বসে আছি এমন সময় পাশের ঘর হতে মানুষের চিৎকার শুনতে পাই। তাতে আমরা ধারণা করলাম ওখানে মার আরম্ভ করে দিয়েছে। এর মধ্যে একজন মিলিটারী আমাদের রুমে চলে আসে এবং প্রত্যেকের পুরা ঠিকানা ও প্রত্যেকের পেশা একটা কাগজে লিখে নিয়ে যায়। সন্ধ্যার পর আমাদের জন্য খাবার নিয়ে আসে। আমরা খাবার পর সবাইকে ঘুমাতে বলে। আমরা কোন মতে রাত্রি কাটালাম।

তারপর দিন আমাদের দলের বদরউদ্দিন নামক একজন লোককে ঘর হতে বের করে নিয়ে যায়। তার সাথে কি যেন বলাবলি করার পর আবার আমাদের রুমে তাকে নিয়ে এসে রেখে যায় এবং আমাদের সবাইকে জানিয়ে যায় তোমরা কোন লোক বদরউদ্দিন সাহেবের সাথে কথা বলবে না। যদি কোন লোককে তার সাথে কথা বলতে দেখি তাকে আমরা গুলি করে মারবো। তারপর দিন রাজু নামক একজন লোককে নিয়ে যায়। কিছু সময় পর আবার তাকে নিয়ে এসে রেখে যায়।

তার তিনদিন পর আমাদের রুমে এসে জিজ্ঞাসা করে ফকু কোন হায়? তোতা কোন হায়? তারপর আমরা দুজন উঠে দাড়ালাম। তারপর আমাদেরকে বের করে নিয়ে যায়। একটা মাঠের মধ্যে নিয়ে গিয়ে আমাদেরকে শুতে বললে আমরা দুজন মাঠের মধ্যে শুয়ে পড়ি। তারপর আমাকে এমন জোরে একটা বেতের লাঠি দিয়ে পিঠে আঘাত করে যে আমি সহ্য করতে না পেরে ছুটাছুটি করতে থাকি। আবার আমাকে ডেকে নিয়ে শুতে বলে, আমি মাটিতে শুয়ে পড়ি। তারপর আমাকে কতকগুলি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে।

যেমনঃ-

(১) তোমার রাইফেল কোথায়।

(২) তুমি রাইফেল ধরেছ কিনা।

(৩) তোমার গ্রামে যে ১৫/১৬ জন লোক রাইফেল ধরেছিল তাদের নাম বলো। তাদের নেতা কে ছিল।

(৪) তোমাদের গ্রামের কারা ই,পি,আরদের খেতে দিয়েছে।

(৫) তুমি ছাত্রলীগ কিংবা আওয়ামী লীগ করো কিনা।

(৬) যশোরে মুজিবের মিটিং-এ তুমি ছিলে কি না।

(৭) মিটিং-এ সে কি বলেছিল।

(৮) মিছিলে কী কী বলা হয়।

(৯) জয় বাংলার মানে কী।

(১০) তোমার ভাই কোথায়।

(১১) তুমি কী কর।

(১২) তোমাদের গ্রামে যে মেজর যেত, তাকে তোমরা কেন মেয়ে জোগাতে না।

(১৩) ভারতে কে গিয়েছে।

সুবেদার মেজর শাহজি আমাকে সবগুলি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে। আমি মারে দরুন থাকতে না পেরে কিছু কিছু প্রশ্নের উত্তর স্বীকার করি আর যে গুলো বেশি জরুরী সেগুলো স্বীকার করি না। মারের নিয়মগুলো নিচে বর্ণনা করা হলো।

(১) প্রথমে মাটিতে উপুড় করে শুইয়ে দিত। তারপর বেতের লাঠি দিয়ে ঘাড়ে এবং পায়ের তালুতে মারতে থাকে। লাঠি দিয়ে মারা শেষ হলে আবার বুট দিয়ে পিঠের উপর উঠে খচতো বা পাড়াতো।

(২) দ্বিতীয় নিজ কায়দা হলো চুল ধরে ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে ঠাশ করে ঘাড়ে একটা চড় কশিয়ে দিয়ে ছেড়ে দিত।

(৩) পা উপরে দিয়ে মাথা নিচে দিয়ে একটা ঘরের মধ্যে রশির সঙ্গে লটকিয়ে রাখতো।

(৪) বস্তার মধ্যে পুরে দিয়ে বস্তার মুখ বেঁধে পিটিয়ে মেরে ফেলতো।

(৫) প্রত্যেক গিড়ায় গিড়ায় লাঠি দিয়ে এবং বন্দুকের বাঁট দিয়ে মারতো।

(৬) আট দশজন করে গাড়িতে তুলে নিয়ে বেয়োনেট চার্জ করে মেরে রেখে আসতো।

(৭) প্রত্যেক হাতের প্রতি আঙ্গুলে সূচ ঢুকিয়ে দিত।

(৮) নিল ডাউন করে রাখতো।

(৯) প্রতি ২৪ ঘন্টায় একবার খাবার দিত। আর পায়খনা প্রশ্রাব করাতে নিয়ে যাবার সময় মারতো আর নিয়ে আসার সময় মারতো। আমাদেরকে একমাস বার দিন রাখার পর আমাদের ১৭ জনের একটা দলকে সুবেদার মেজর শাহজি সবাইকে ডেকে লাইন করে তারপর একটা গাড়িতে আমাদেরকে উঠতে বলে। আমরা গাড়িতে উঠে পড়ি। তারপর আমাদের বাড়ির নিকট গাড়ি থামিয়ে আমাদেরকে নামিয়ে দেয়। আমাকে ধরে ২৭শে এপ্রিল আর ছেড়ে দেয় জুনের ১০ তারিখে।

স্বাক্ষর/-

মোঃ শহীদুল ইসলাম এ্যাডভোকেট

থানা- কোতোয়ালী, যশোর

১৭/০৩/১৯৭৩