শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
২০। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমাধান প্রয়োজন – ওয়াশিংটনের ন্যাশনাল প্রেসক্লাবে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং এর ভাষণ | ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রকাশিত পুস্তিকা | ১৭ জুন, ১৯৭১ |
বাংলাদেশে রাজনৈতিক সমাধান দরকার
জাতীয় প্রেস ক্লাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং এর বক্তৃতা
ওয়াশিংটন, জুন ১৭, ১৯৭১
আমাকে আমন্ত্রণের জন্য আমি জাতীয় প্রেসক্লাবকে ধন্যবাদ জানাই। এর একটি বিশেষ কারণ আছে। আমি আপনাদের নেতাদের সাথে একটি সমস্যার শান্তিপূর্ন অস্থায়ী সমাধানের জন্য এখানে এসেছি। সমস্যাটি প্রেসে ইতোমধ্যে বিষদভাবে রিপোর্ট করা হয়েছে। তাই আমি আমেরিকান প্রেসের প্রতিনিধিদের মাঝে কথা বলার সুযোগ পেয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। নিশ্চই আমেরিকান প্রেস জনমত গঠনে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
পূর্ববাংলার ট্রাজেডি আজ ভারতের জন্য বড় সমস্যা। এশিয়ার জুড়েও এটা এখন গুরুত্তপূর্ন। আমাদের অঞ্চলে এটা শান্তি এবং উন্নতির পথে চরম হুমকি।
পূর্ববাংলার অবস্থা আপনারা ভালো জানেন। কিন্তু আমাদের জন্য এবং আমাদের পুরো অঞ্চলের জন্য এটি কত বড় সমস্যা সেই ব্যাপারে আমি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। আমাদেরকে মনে রাখতে হবে যে আজ যদি নিজেদের অসহায়ত্বের কারনে অথবা যারা এই ঘৃন্য কাজগুলো করছে তাদের উপর কোন বিশেষ দুর্বলতার কারনে, আমরা এই ঘটনাকে অবহেলা করি অথবা এই ঘটনাগুলোকে আরো বাড়তে দেই, তাহলে পুরো পৃথিবীকে এক সময় এর ফলাফল ভোগ করতে হবে।
পূর্ববাংলার অস্থিরতার জন্য যে উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা আমাদের সামনে হাজির হয়েছে তা শুধু ভারতের একার নয়। আপনাদেরও। পূর্ববাংলার ঘটনাবলির ধরণ ও মাত্রা এমন যে সেটি পাকিস্তানের সীমানা অতিক্রম করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে উদ্বেগের বিষয় হতে বাধ্য।
গণতন্ত্র নিষ্পেষিত
আমাদের দুই দেশের গণতান্ত্রিক নীতি ও মূল্যবোধের প্রতি একটি সাধারণ অঙ্গীকার আছে। এই একই মূল্যবোধ ও নীতিগুলোকে পূর্ববাঙলায় নৃশংসভাবে দমন করা হচ্ছে।
পূর্ববাংলায় সেনাবাহিনী গণতান্ত্রিক নীতির দমনে নিয়জিত থাকায় এটি সেখানে একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে রূপ নিচ্ছে। গত ডিসেম্বর সেখানে নির্বাচন হয়েছে একটি এসেম্বলি করে পাকিস্তানে সংবিধান প্রণয়ন করার জন্য। বৃহত্তর পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামীলীগ নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে এবং প্রাদেশিক শাসনকর্মে তাদের প্রাধান্য দাবি করে। এটা মনে রাখতে হবে যে আওয়ামী লীগের ৬ দফা দাবীগুলো বিচ্ছিন্নতাবাদী কিংবা স্বাধীনতার দাবি ছিল না, স্বাধীনতার দাবি ওঠার পেছনে ছিল উত্তাল মার্চ মাসের ঘটনা গুলো এবং ২৫শে মার্চের গণহত্যার শুরুর মাধ্যমে এই দাবি জোরালো হয়। এই ঘটনার পেছনে দায়ী পশ্চিম পাকিস্তানের একটি সংখ্যালঘু গোষ্ঠী যাদের হাতে ছিলো বিদেশী অর্থ ও অস্ত্র যেগুলোর মাধ্যমে জনতার রায়কে তারা পরিবর্তন এবং ধুলিস্যাৎ করতে চেয়েছিল।
সেনাসন্ত্রাসের এই রাজত্বের ফলে ৬ মিলিয়ন মানুষ পূর্ববাংলা থেকে তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছে এবং ভারতে শরণার্থী হিসেবে অবস্থান নিয়েছে। এবং এটি চলমান আছে। প্রতিটি দিন প্রায় ১ লাখ মানুষ আমাদের দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করছে – পূর্ববাংলার সীমান্ত জুড়ে পাকিস্তান আর্মিরা তাদের তারিয়ে দিচ্ছে। সহজ করে বললে প্রতি সেকেন্ডে ১ জন শরনার্থি আমাদের দেশে প্রবেশ করছে।
আমরা এই উদ্বাস্তুদের সামর্থ্য অনুযায়ী ত্রাণ দিচ্ছি। আমাদের পূর্ব বাংলার রাজ্যের শিশুদের স্কুলগুলো শরণার্থীদের আশ্রয় প্রদান করার জন্য বন্ধ হয়ে গেছে। আমাদের স্বাস্থ্য সেবা সীমিত এবং সেখানে পরিবহন ও তাঁবু, খাদ্য ও ওষুধ এবং অন্যান্য সম্পদ সংকট আছে। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে প্রত্যেক স্থানীয় বাসিন্দাদের বাড়িতে ১ জন পূর্ববাংলা থেকে আসা শরণার্থী অবস্থান নিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ, আগে থেকেই অনেক জনবহুল, তার উপর শরনার্থিদের ব্যাপক অণুপ্রবেশে অনেক বড় সমস্যা তৈরি হয়েছে।
খাদ্য, আশ্রয় ও ওষুধ প্রদান অগ্রাধিকারে রাখা আবশ্যক। ত্রাণ খরচ মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। আমরা বর্তমান বছরের জন্য আমাদের বাজেটে ৮০ মিলিয়ন ডলারের একটি টোকেন বরাদ্ধ রেখেছি, এবং এর জন্য আরও ৩০ মিলিয়ন অতিরিক্ত করের বোঝা অর্পিত করা হয়েছে যা আমাদের জনগণকে এই বছর বহন করতে হবে।
আমাদের সম্পদ সীমাবদ্ধতা আছে তবে যথাসাধ্য চেষ্টা করছি শরণার্থীদের দেখাশোনার ব্যাপারে। পাশাপাশি আমরা বিদেশি সরকারগুলোর থেকে ও নানারকম স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও সংস্থা থেকে এবং ব্যক্তিগতভাবে নাগরিকদের থেকে সাহায্য প্রার্থনা করেছি ও পাবো আশা করছি। যদি এই অবদান খুব বড় নাও হয় তবুও এর পেছনের আবেগকে আমাদের সরকার ও জনগণকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে এটাই সার্থকতা।
যাইহোক, এটি অনেক বড় কাজ। এমনিতেই ভারতে দারিদ্র্য ও বেকারত্ব নিয়ে ভুগছে। অতএব, আশা করি যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, উদার মানবিক প্রবৃত্তি নিয়ে এগিয়ে আসবে এবং পাশাপাশি বিশ্বের অন্যান্য সমৃদ্ধ দেশও এগিয়ে আসবে।
সামরিক অ্যাকশন এখনই বন্ধ করতে হবে
কিন্তু ত্রাণ শুধুমাত্র সাময়িক উপশমকারী; সমস্যার সমাধান নয়। তাই এই পরিস্থিতির মূলে ব্যবস্থা গ্রহণ সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ। তাই পাকিস্তান থেকে আরও উদ্বাস্তু অন্তঃপ্রবাহ অবিলম্বে থামাতে হবে। এবং সেটার জন্য পূর্ববাংলায় সামরিক কর্মকান্ড অবিলম্বে বন্ধ করা দরকার। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিৎ পাকিস্তান সরকারকে এই ব্যাপারে চাপ দেয়া।
পাশাপাশি, যারা তাদের বাড়িঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছে তাদের পূর্ব বাংলায় নিরাপদে ফেরত পাঠানোর জন্য অবস্থা তৈরি করতে হবে। পাকিস্তান সরকারকে এই শরণার্থীদের পুনর্বাসনের জন্য সঠিক দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। এই সময়ের মধ্যে পূর্ব বাংলায় তাদের সম্পদ সংরক্ষণ করতে হবে এবং তাদের প্রত্যাবর্তন আন্তর্জাতিক তত্ত্বাবধানে করা উচিৎ।
নিজ নিজ গৃহে প্রত্যাবর্তন এবং উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনে সময় লাগবে এবং ত্রাণ ব্যবস্থা প্রয়োজন হবে। তাই সেখানে প্রয়োজনে ক্যাম্প সেট আপ করতে হবে। আমাদের মত পূর্ব পাকিস্তানে অস্থায়ী ত্রাণ শিবিরে স্থাপন করা উচিত।
পাকিস্তান সরকার পূর্ব বাংলার শিবির বা অভ্যর্থনা কেন্দ্র স্থাপন করেছেন বলে দাবি করে, কিন্তু শরণার্থীরা সেখানে ফিরে যাচ্ছেনা। কারণ তারা দৃশ্যত পাকিস্তান সরকারের ক্ষমার ঘোষণা বিশ্বাস করে না। অতএব তদের ব্যক্তি ও সম্পত্তির নিরাপত্তা বিধান নিশ্চিত ও বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য সকল ব্যাবস্থা নিতে হবে।
আন্তর্জাতিক তত্ত্বাবধান
পাকিস্তান আন্তর্জাতিক তত্ত্বাবধানে উদ্বাস্তুদের জন্য অস্থায়ী ক্যাম্প বসাতে পারে।
মৌলিক সমস্যা হচ্ছে একটা রাজনৈতিক বিষয় এবং এটির রাজনৈতিক সমাধান দরকার। ভালো একটি সমাধান ছাড়া, শরনার্থিরা ফিরে আসার আস্থা ও নিরাপত্তার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করবেনা। এর জন্য দুটি অপরিহার্য শর্ত আছে –
প্রথমত, প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক সমাধান জরুরি ভিত্তিতে করা আবশ্যক, এবং দ্বিতীয়ত, সমাধান কার্যকর হতে হবে এবং পূর্ববঙ্গ ও তাদের নির্বাচিত নেতাদের ও জনগণের ইচ্ছার সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই তা করতে হবে।
পূর্ববাংলার জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গৃহীত যেকোন ব্যাবস্থা গ্রহণের চেষ্টা পরিস্থিতি তো ঠিক করবেই না বরং দূরত্ব আরও বাড়বে এবং এর ক্ষতিকর প্রভাব পুরো পূর্ববাংলায় পরিলক্ষিত হবে।
মুজিবের জন্য উদ্বেগ
আমরা মুজিবের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা এবং সুস্থতা নিয়ে চিন্তিত। তিনি খুব উচ্চ মর্যাদা এবং বিরল মানবিক গুণাবলির একজন মানুষ যিনি পূর্ব বাংলার সমগ্র জনগণের প্রাণপ্রিয় নেতা। আমরা আশা করি যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে পাকিস্তানের শাসকদের উপর সকল প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবেন এবং পূর্ব বাংলার মানুষের আশা, আকাঙ্ক্ষা ও উজ্জীবনের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করবেন যা প্রতিফলিত হয়েছিল গত ডিসেম্বরের শেষের দিকে। শুধু কারারুদ্ধ করে এটিকে নির্বাপিত করা যাবে না।
আমরা সামগ্রিকভাবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, এবং বিশেষ করে যেসব দেশের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক ভালো তাদের অনুরোধ করছি একটি রাজনৈতিক সমাধানের জন্য পাকিস্তান সরকারকে প্রভাবিত করতে।
পাকিস্তানে সামরিক সাহায্যের অনুদান বিষয়ে আমাদের অবস্থা স্পষ্ট। অবস্থা এখন এমন হয়েছে যে অর্থনৈতিক অনুদান বর্তমানে পাকিস্তানের জনগণকে দমন করার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। সুতরাং এ বিষয়টি পাকিস্তানের জনগণের জন্য উদ্বেগের। এটি যত দ্রুত সম্ভব শেষ করতে হবে। তাই আমরা যতদিন না একটি রাজনৈতিক সমাধান আসে ততদিন পাকিস্তানে তাদের মিলিটারি ও অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধ করার ব্যাপারে সকল দেশের প্রতি আহবান করছি।
ভারতকে হুমকি
আমি আশা করি যে এই দেশের মানুষ বুঝতে পারবে কেন আমরা পূর্ববাংলার পরিস্থিতির উপর আমাদের উদ্বেগ প্রকাশ করছি। মার্চ ২৫ থেকে পূর্ববাংলায় যে হত্যাকাণ্ড হচ্ছে তার ফলাফল আমাদেরকেও প্রভাবিত করছে। অবস্থা এখন এমন হয়েছে যে পাকিস্তানের সামরিক সরকারের কার্যক্রম আমাদের সমাজ ও আমাদের রাষ্ট্রের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশকে প্রভাবিত করছে। এর ফলে আমাদের এলাকায় সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে যার পরিণতি চিন্তার বাইরে।
আমরা ধৈর্য, সহিষ্ণুতা ও সংযমের সাথে আচরণ করছি। কিন্তু যদি আমাদের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক অবস্থা হুমকির সম্মুখীন হয় তবে আমরা বসে থাকব না।
আমাদের স্বাধীনতার পর থেকে ২৩ বছর ধরে, আমরা আমাদের গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থানের জন্য লড়াই করছি। আমরা আমাদের দেশ থেকে দারিদ্র্য ও ক্ষুধা এবং রোগ নির্মূল করতে সফল হইনি। কিন্তু আমাদের জনগণের জীবনযাপন গত আড়াই দশকের তুলনায় কিছুটা উন্নত হয়েছে। আমরা আমাদের খাদ্য উৎপাদন দ্বিগুণ করেছি। শিক্ষা, চিকিৎসা ও কাজের সুযোগের প্রাপ্যতা বিস্তৃত হয়েছে। আমাদের রপ্তানির বার্ষিক বৃদ্ধির হার গত বছরে ৭ শতাংশ মাত্রা স্পর্শ করে এবং আমাদের প্রবৃদ্ধির হার বার্ষিক শতকরা ৫ এ উন্নীত হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমাদের প্রচেষ্টাকে সাহায্য করেছে এবং আমি নিশ্চিত এই সাফল্যের তারাও অংশীদার।
পাকিস্তানের তৈরী সংকট
ফেব্রুয়ারিতে সাধারন নির্বাচনের পর, আমাদের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও আমাদের দল, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস, আমাদের প্রোগ্রামের জন্য জনগণের বিপুল সমর্থন পেয়েছে। আমরা আমাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার উপর একটি শক্তিশালী হুমকির আভাস পাচ্ছি। আর, তারপর এখন আসল পাকিস্তানের তৈরি সমস্যা যা আমাদের ফসলের উপর হুমকি এবং আমাদের শান্তি ও আমাদের সন্তানদের জন্য অগ্রগতির প্রত্যাশা হুমকির সম্মুখীন করে তুলেছে।
যেকোনো দায়িত্বশীল সরকারের জন্য এটি একটি অসহনীয় অবস্থা। তাই আমাদের উদ্বেগ অতি দ্রুত পূর্ব পাকিস্তানে একটি রাজনৈতিক সমাধান তৈরি করা যা বাঙালি এবং তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে গ্রহণযোগ্য। যাতে শান্তি ফিরে আসতে পারে এবং উদ্বাস্তুদের যারা আমাদের দেশে এসেছে তাদের বাড়িতে ফিরে যেতে পারে।
আমরা একটি মারাত্মক পরিস্থিতির সম্মুখীন। কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি যে বিশ্ব সম্প্রদায় সম্মিলিতভাবে এর একটি সন্তোষজনক সমাধান বের করবেন এবং ভারতের স্থিতিশীলতার জন্য এবং এই অঞ্চলের শান্তির জন্য হুমকি দূর করবেন।
এই আশায় আমি ওয়াশিংটনে সফরে এসেছি এবং আমি বুঝেছি যে ওয়াশিংটন আমাদের আশঙ্কা অনুধাবন করেছেন এবং আমরা তাদের সাহায্য সহানুভূতি পাব।
[উপরের বক্তৃতা প্রতিনিধি কর্ণীলিয়াস ই গালাঘার এর অনুরোধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেশনাল রেকর্ডে সংরক্ষণ করা হয়েছে]
বক্তৃতার পরে প্রশ্নোত্তর পর্ব —
প্রশ্নঃ আপনি গত রাতে বলেছেন যে আপনারা ৬ মিলিয়ন শরনার্থিকে ৬ মাস দেখভাল করবেন। যদি পাকিস্তান এই শরনার্থিদের নিতে অস্বীকৃতি জানায় তাহলে আপনারা কী করবেন?
পররাষ্ট্রমন্ত্রীঃ প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ। যদি সেখানে ৬ মিলিয়নের বেশী হয় তখন কী ঘটবে? সেটাই আমাদের উদ্বিগ্ন হবার কারণ। আমাদের প্রথম দাবি, আর যাই হোক না কেন, উদ্বাস্তুদের এই অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে হবে। আর এর জন্যে কোন বড় ধরণের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন দরকার পড়েনা। তাহলে এখন সেখানে প্রশাসনিক ও সামরিক যন্ত্রপাতি পরিচালনা করছেন তারা যদি কৌশলে জনগণকে পুশ করে, যদি অস্ত্র থামিয়ে জনগণের আস্থা আনতে পারেন, যে কোন মূল্যে অনুপ্রবেশ ঠেকানোর চেষ্টা করেন, তবেই তা বন্ধ হওয়া সম্ভব। পরিস্থিতি এতোই ভয়াবহ যে, আমি আমার বক্তৃতায় বলেছিলাম – এই অবস্থা চলতে থাকলে, আমরা অসহায়ভাবে বসে থাকতে পারব না। তাছাড়া এটি আমাদের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার পথে ক্রমবর্ধমান হুমকিস্বরূপ এবং শুধুমাত্র তাই নয় এটি আমাদের পুরো অঞ্চলের স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ঠেলে দেবে।
প্রশ্নঃ কেন আপনি পূর্ব পাকিস্তানকে পূর্ব বাংলা বলছেন? এটি কি পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার একীভুতকরণের ইঙ্গিত দেয়?
পররাষ্ট্রমন্ত্রীঃ আমি এটাকে পূর্ববাংলা বলি কারণ মূলত এটা পূর্ববাংলাই ছিল। বাংলার দুটি অংশ পূর্ব ও পশ্চিম। তাছাড়া এটি বলার আরেকটি কারণ হল আমরা পূর্ব বাংলার ৭৫ মিলিয়ন মানুষের আদর্শে একাত্মতা প্রকাশ করি। তারা মিলিটারি প্রভাব ও শোষণ থেকে মুক্তির জন্য লড়াই করে যাচ্ছে। এবং এগুলো মূলত পরিচালিত হয় পাশ্চিম পাকিস্তানীদের ও তাদের সংবিধান দ্বারা।
এটি বলার মানে এই নয় যে ভবিষ্যতে আমরা আমাদের পশ্চিমবাংলার সাথে পূর্ববাংলাকে একীভূত করতে চাই – যদি পূর্ববাংলা স্বাধীনও হয় তবুও এই একীভূতকরণ সম্ভব না। পশ্চিমবঙ্গ ভারতের একটি অংশ। ভারতের সংবিধানে পরিচালিত। কাজেই এখানকার জনগণের দুশ্চিন্তার কিছু নেই। পূর্ব বাংলার ভাগ্যে যাই ঘটুক না কেন- হয় তারা ৬ দফা আদায় করে সফল হোক অথবা তারা মিলিটারিদের বিরুদ্ধে সম্পূর্ন জয়লাভ করে স্বাধীন হিসাবে আত্মপ্রকাশ করুক – তাতে পশ্চিমবঙ্গের জনগণের দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই।
প্রশ্নঃ প্রেসিডেন্ট নিক্সন এখন পর্যন্ত প্রকাশ্যে পূর্ববঙ্গে গণহত্যার নিন্দা করেননি। তিনি কি তার সাথে আপনার ব্যক্তিগত আলোচনায় এটা করেছেন?
পররাষ্ট্রমন্ত্রীঃ আমি নিশ্চিত এইসব উদ্বেলিত শ্রোতা আমাকে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের পক্ষ হয়ে তার বক্তব্য আমি বলে দেই সেটা পছন্দ করবেন না। আপনি হয়ত জানতে চেয়েছেন রাষ্ট্রপতি নিক্সনের মনে কি আছে। তাই এটা বলা আমার পক্ষে কঠিন যে তিনি কী ভাবছেন বা ভাবছেন না। আমার কাজ হল আমার দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা। সেটা যেভাবেই হোক আমাকে আমার কথা প্রেসিডেন্ট নিক্সন এবং সরকারের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের কাছে তুলে ধরতে হবে এবং তারপরে তারা ভেবে দেখবেন তাদের মনোভাব তারা জনসম্মুখে প্রকাশ করবেন কি করবেন না। আমি এটা নিয়ে তাদের সঙ্গে কোনো বিতর্ক করতে চাই না।
প্রশ্নঃ কূটনৈতিক প্রতিবাদ ছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিম পাকিস্তান সরকারের উপর বাঙালিদের উপর অমানবিক অত্যাচার বন্ধের জন্য আর কী পদক্ষেপ নিতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
পররাষ্ট্রমন্ত্রীঃ আমার মনে কোন সন্দেহ নেই যে আপনার প্রশ্নে উল্লেখিত কূটনৈতিক প্রতিবাদ ছাড়াও শুধু যদি আমেরিকান সরকার ও জনগনের অসন্তুষ্টির ব্যাপারটা সঠিক ভাবে প্রকাশিত হয়, তাহলে সেটাই সামরিক শাসকদের উপর একটা বড় প্রতিক্রিয়া ফেলবে, এমনকি তা পশ্চিম পাকিস্তানের জনগনের উপরও ফেলবে, যারা সংবাদপত্র মাধ্যমের উপর নানা ধরনের কঠোর বিধিনিষেধ আরোপের কারনে আসলে কি হচ্ছে পুর্ব পাকিস্তানে সেটা জানে না। এবং এই অসন্তুষ্টির ব্যপারে একটি কঠোর ও পরিষ্কার ঘোষণা শুধু ভুক্তভোগীদের প্রয়োজনীয় ও প্র্যাপ্য সান্ত্বনা দিতেই অনেক সাহায্য করবে না, বরং চলমান সামরিক অভিযানের মাধ্যমে যারা এই ঘৃণ্য অপরাধগুলো করছে গনতন্ত্রের ও মুক্ত ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে, তাদের উপরেও চাপ সৃষ্টি করবে।
প্রশ্নঃ আপনি বলেছেন ‘ভারত চুপ করে বসে থাকবেনা’ – এর দ্বারা আপনি কি ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের ইঙ্গিত দিচ্ছেন?
পররাষ্ট্রমন্ত্রীঃ যুদ্ধ ছাড়াও আমাদের উদ্যেশ্য বাস্তবায়নের জন্য আমাদের আরও অনেক পথ আছে। তবে আমরা আশা করি সেসকল পদ্ধতি আমাদের নেয়ার দরকার পরবেনা। এবং এটাও আশা করি যে আপনারা সেসব সম্পর্কে আমাকে এখন কিছু বলতে বাধ্য করবেন না।
বর্তমানে আমরা জনমত গঠনের কাজে নিযুক্ত আছি- সরকারী ও বেসরকারি লেভেলে। আমরা মৌলিক সমস্যা গুলোর প্রতি মনোযোগ আকর্ষনের চেষ্টা করছি। আমরা অল্প চেষ্টাতেই এখন এই বিষয়টি যাচাই করতে পারছি। আমাদের দৃঢ় আশা ও বিশ্বাস যে এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ করার একমাত্র পথ হল আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় গুলোকে সরকারী – বেসরকারি উভয় পর্যায়ে এগিয়ে আসতে হবে। এই অবস্থায় যদি দেশগুলো নিশ্চুপ থাকে তাহলে মিলিটারি একশন আরও ভয়ানক রূপ ধারণ করবে। এবং এর ফলাফলও খুব তীব্র হবে।
প্রশ্নঃ জনাব মন্ত্রী, আপনি কি মনে করেন যে, পশ্চিমা দেশগুলোর পররাষ্ট্র অফিস থেকে পূর্ব পাকিস্তানের গণহত্যার সম্পর্কে সামান্যই বলার ছিল?
পররাষ্ট্রমন্ত্রীঃ আমি তাদের পক্ষ থেকে কথা বলতে পারি। কিন্তু কঠিন বাস্তবতা এই যে তারা স্বল্পভাষী। কিন্তু এখন তাদের বিবেকে নাড়া দেবার সময় এসেছে। সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুযায়ী তাদের বাইরে কথা বলা উচিত। এবং মূল বিষয়ের আশেপাশে না গিয়ে গভীরে গিয়ে মোকাবিলা করা উচিৎ।
প্রশ্নঃ হিন্দু শরণার্থীদের কি পূর্ব বাংলায় আসতে বলা হবে? আর আপনি একটি একীভূত পূর্ববাংলা বলতে কি বুঝিয়েছেন? এটি কি ভারত ও পাকিস্তান থেকে আলাদা কিছু?
পররাষ্ট্রমন্ত্রীঃ প্রথম প্রশ্নের উত্তরে বলা যায় একজন হিন্দু উদ্বাস্তু বা একজন মুসলিম শরণার্থী যেই হোক না কেন তাকে দেশে ফিরে যেতে হবে। আপনার সাথে আমি আরেকটি তথ্য যোগ করে বলতে চাই এই দুইটি ধর্মের লোক ছাড়াও খ্রিস্টান ও বৌদ্ধ ধর্মের শরনার্থিরাও সেখানে আছে। পাকসেনারা সকল সম্প্রদায়ের লোকদের উপরই অত্যাচার চালিয়েছে।
ফিরে যেতে বললেই শরনার্থিরা ফিরে যাবেনা। তারা যখন মনে করবে যে পরিস্থিতি যাবার মত হয়েছে কেবলমাত্র তখনি তারা ফিরে যেতে চাইবে। তাই জনে জনে জিজ্ঞেস করে এটা সম্পন্ন করা যাবেনা। বরং পূর্ব বাংলার মানুষের চাহিদাকে সন্মান করে কাম্য রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি হলে তারা যেতে উদ্বুদ্ধ হতে পারে। তারা তাদের মতামত গত নির্বাচনে দিয়েছে যেখানে আওয়ামীলীগ ১৬৯ টি আসনের ১৬৭ টি পেয়েছে। আমি মনে করি পৃথিবীর যেকোন মানদণ্ডে যেকোন স্থানের তুলনায় এটি একটি রেকর্ড, একটি বিশাল সফলতা।
তাই জনগণের আস্থা আসে এমন সরকারকে সেখানে প্রতিস্থাপন করতে হবে। এতে করে শরনার্থিদের ফিরে যাওয়ার পরিবেশ তৈরি হবে।
দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাব আমি ইতিমধ্যে দিয়েছি। পশ্চিমবঙ্গ, ভারত উপমহাদেশের একটি বিশেষ সম্প্রদায়, তাদের সমৃদ্ধ ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে দেশের উন্নয়ন প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। ভারতীয়দের জনজীবনে এটির বিশেষ দখল ও প্রভাব রয়েছে। পুর্ব বাংলায় যা কিছু হচ্ছে তাতে আমরা মনে করি এর প্রভাবে ঐ অঞ্চলের মানুষের সামনে এগিয়ে যাবার স্বপ্ন বহুগুণে পিছিয়ে যাবে এবং এর প্রভাব আমাদের অংশেও পড়বে।
প্রশ্নঃ মান্যবর, আপনি কি একটি রেডিও রিপোর্টের উপর মন্তব্য করবেন দয়া করে? সেখানে বলা ছিল আপনার সরকার পাকিস্তানি শরনার্থিদের জন্য আমেরিকান এয়ারলিফট এর প্রচারে প্রেসকে বাঁধা দিচ্ছে – অন্যদিকে একই ধরণের সোভিয়েত এয়ারলিফটকে কভারেজ এর অনুমতি দিয়েছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীঃ আমরা সম্পূর্ণরূপে এই দুই সুপার পাওয়ারের মধ্যে নিরপেক্ষ অবস্থানে আছি। আর আমি কোনো প্রান্তিকে সি -১৩০ প্লেন এর সাথে এ এম ১২ বা এ এম -১৪ প্লেন এর প্রতি বৈষম্য করছি এমন ধরনের অনুভূতি দুর করতে চাই। আমি নিজে আমেরিকান প্লেন সজ্জার একটি পূর্ণ রিপোর্ট দেখেছি। আমি নিশ্চিত যে, ভারতের প্রেস স্বাধীন – এমন একটি ভাবমূর্তি সেখানে রয়েছে। এগুলোর বেশিরভাগ কোন দাতব্য প্রতিষ্ঠান নয়। তবু তারা কখনো নালিশ করেনি যে সেখানে কোন অনিয়ম হয়েছে।
প্রশ্নঃ আপনি কি মনে করেন যে পাকিস্তান সরকার দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করবে?
পররাষ্ট্রমন্ত্রীঃ এ ব্যাপারে আমি সন্দিহান। এগুলো সত্যি অসহায় লোকদের হাতে পৌঁছাবে কিনা সেব্যাপারেও আমি নিশ্চিত নই। এই বিষয়টি আমি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে এবং ইউ এন সার্কেলে আলোচনা করেছি। এই কারণেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই ব্যাপারটি তদারকি করার জন্য জোর দিচ্ছে।
অভিজ্ঞতার কোন বিকল্প নেই। এটা সবার জানা যে কয়েক মাস আগে সাইক্লোনে যে ত্রাণ ক্ষতিগ্রস্থদের জন্য পাকিস্তান সরকারকে দেওয়া হয়েছিল তার একটি অংশ এখনো অব্যবহৃত রয়ে গেছে। তাছাড়া ত্রাণ কাজের জন্য সেই সময় যে স্পিড বোট দেয়া হয়েছিল সেগুলো পাকিস্তান সামরিক কর্তৃপক্ষ মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে ব্যাবহার করছেন।
প্রশ্নঃ জনাব মন্ত্রী, আপনি কি মনে করেন যে দুই পাকিস্তান একটি সরকারের অধীনে চলতে পারে?
পররাষ্ট্রমন্ত্রীঃ আমি ভবিষ্যতে কি হবে তার উপর মন্তব্য করতে চাই না। আমি বর্তমান সমস্যা নিয়ে আমাদের অবস্থান স্পষ্ট করতে চাই। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ এবং পূর্ববাংলার জনগণের মধ্যে চলমান ব্যাপারটিতে আমরা আমাদের অবস্থা তুলে ধরছি মাত্র। এব্যাপারে পূর্ববাংলার জনগণ তাদের ভবিষ্যতে নির্ধারন করবে। এবং আমরা খুশি হব যদি সেখানকার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের প্রশাসনে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়। তাছাড়া এই ব্যাপারে আমরা এখনো নির্দিস্ট কোন অবস্থান নেইনি।
প্রশ্নঃ আগের একটি প্রশ্নের জের ধরে জানতে চাই ভারত কি পূর্ব বাংলাকে তাদের একটি রাজ্য বানাতে চায়? আপনি বলেছেন পশ্চিম বাংলা দুই বাংলাকে একীভূতকরণে ভারত সরকারের প্রচেষ্টায় বাঁধা দেবেনা। এব্যাপারে এমনি মূল প্রশ্নের উত্তরটি দেবেন কি?
পররাষ্ট্রমন্ত্রীঃ আপনি প্রশ্নটি আবার করুন।
প্রশ্নঃ আগের একটি প্রশ্নের উত্তরের ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে চাই – সেটা হল – ভারত কি পূর্ববাংলাকে তাদের সাথে একীভূত করে নেবে কিনা? এই ব্যাপারে আপনি কি আর কিছু বলবেন দয়া করে?
পররাষ্ট্রমন্ত্রীঃ পূর্ববাংলার মুক্তিযোদ্ধারা তাদের স্বাধীনতার জন্য যেভাবে লড়াই করছে তাতে আমি কখনোই মনে করিনা যে তারা আবার ভারতের অংশ হয়ে অর্থাৎ অন্য একটি দেশের কাছে পরাধীন হয়ে থাকবে। তাদের স্বাধীনতার আখাঙ্খা এর থেকে অনেক শক্তিশালী।
এই অভিব্যাক্তির ব্যাবহার বোঝায় না যে পশ্চিমবংগ (যা ভারতীয় রাষ্ট্রসঙ্ঘের একটি সদস্য)স্বাধীন হয়ে গেলেও পূর্ববঙ্গের সাথে যোগ দেবার কোন ঝুকি আছে। তারা আমাদের দেশ, তথা মহান ভারতবর্ষের মত দেশে, যেখানে তারা রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অঙ্গনে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রেখেছে, সেখানে সমঅংশদারিত্ব হবার মূল্য বোঝে, এবং সেকারনেই আমার মনে হয়, পশ্চিমবঙ্গ, যা ভারতের একটি অংগ, তার জনগন কখনো ভারত হতে বের হয়ে যেতে চাইবেন, তা সে পূর্ব পাকিস্তানের ভাগ্য যাই হোক না কেন, সেটা আওয়ামীলীগের বর্নিত ৬ দফা অনুসারে অর্থনৈতিক স্বায়ত্ব শাসনই অর্জন করুক বা সামরিক জান্তা কতৃক জনগনের আশা আকাঙ্ক্ষা ক্রমাগতভাবে ভাবে চাপা দেয়া রাষ্ট্রতে পরিনত হোক।
প্রশ্নঃ আপনি কি সঠিক কোন সংখ্যা বলতে পারবেন যে ঠিক কতদিনের জন্য আন্তর্জাতিক মানবিক সাহায্য দরকার বলে ভারতীয়রা বিশ্বাস করে?
পররাষ্ট্রমন্ত্রীঃ এ প্রসঙ্গে আমি একটি বা দুইটি কথা বলতে চাই। প্রথমত, সবচেয়ে দরকারি যে কথাটা সবার আগে বলতে চাই তা হল যেসকল পূর্ব পাকিস্তানী নাগরিক আমাদের ভিতরে প্রবেশ করেছে তাদের দায়-দায়িত্ব স্পষ্টত পাকিস্তান সরকারের উপর বর্তায়। দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরও দায়িত্ব রয়েছে যার অংশ হিসেবে ভারত তার অংশটুকু দেখবে।
এবং যদি এই উদ্বাস্তুদের জন্য আন্তর্জাতিক ভাবে কোন ত্রাণ পাওয়া যায় সেটা ভারত নিজেদের ধরে নেবেনা। এটা পাকিস্তানকে দেয়া হয়েছে বলে ধরা হবে। কারণ এই ত্রাণের ফলে পাকিস্তান সরকারের উপর যে দায়িত্ব ও চাপ বর্তায় তা কিছুটা কমবে বলে ধরা যায়।
হিসেব করলে দেখা যায় যা এখন পর্যন্ত পাওয়া গেছে তা মূল চাহিদার থেকে খুবই সামান্য। তার চেয়ে গুরুত্তপূর্ন বিষয় হল আমাদের অঞ্চলে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। এই অবস্থা দীর্ঘায়িত হলে তা অদূর ভবিষ্যতে যে সমস্যার সৃষ্টি করবে তা শুধুমাত্র টাকা দিয়ে সমাধান করা বা মেটানো যাবেনা। এই বিষয়টা অবশ্যই আমাদের খেয়াল রাখতে হবে।
এই কারণেই আমরা বরাবরের মতো একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ আশা করছি পূর্ব পাকিস্তানে। কারণ মূল কারণের সমাধান না করে শুধু উদ্ভূত সমস্যার সমাধান করলেই বিষয়টা মিটে যাবেনা।
আমরা খেয়াল করেছি এখন পর্যন্ত অনেক উদার দাতারাও যে সাহায্য করেছেন তা মূল চাহিদার তুলমায় একেবারেই নগণ্য। এটা দিয়ে খুব সামান্য সংখ্যক উদ্বাস্তুকে সাহায্য করা যাবে। তবুও আমরা তাদের শ্রদ্ধা করছি – টাকার পরিমাণ যাই হোক – তাদের মনোভাবের জন্য।
প্রশ্নঃ চীন এর বিশ্বাসযোগ্যতা এবং বিশ্বের তার প্রভাব বিবেচনা করে সে যেভাবে পাকিস্তান সরকারের কাজকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে এর প্রভাবে আপনার মূল্যায়ন কী?
পররাষ্ট্রমন্ত্রীঃ নিশ্চয় যেকোনো কেউ যখন পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের সমর্থন করে – তা বিশ্বের যে অংশ থেকেই হোক, এতে তারা স্তুতি লাভ করবে, একগুঁয়েমিতে আরও উৎসাহিত হবে এবং গণপ্রজাতন্ত্রী চিন সরকারের কাছ থেকে এই সমর্থন স্পষ্টভাবে সমগ্র পরিস্থিতির উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
প্রশ্নঃ জনাব মন্ত্রী, উদ্বাস্তু এবং অন্যদের মধ্যে কলেরা পরিস্থিতি কি?
পররাষ্ট্রমন্ত্রীঃ সেখানে কলেরার ঘটনা ঘটছে। এবং আমি মনে করি যে, এটি থামানোর জন্য বড় কিছু পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে যাতে কলেরা ছড়িয়ে পড়ার সম্ভবনা কিছুটা কমে এসেছে। আমাদের সুবিশাল দেশ। আমাদের বিশাল সংখ্যক জনগণের স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করতে হয়। স্বাস্থ্য বিভাগ কলেরা নিয়ন্ত্রণে ভালো ব্যাবস্থা নিয়েছে ও তারা সফল হয়েছে। আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অত্যধিক কলেরা ছড়িয়ে পড়ার বিষয়ে উদ্বিগ্ন প্রকাশ করতে বলছিনা। আমরা মনে করি কলেরা সমস্যাকে বড় করে দেখিয়ে তারা মূল ঘটনা আড়াল করার চেষ্টা করছেন। তাই আমরা এই মহামারির কথা চিন্তা না করে বরং মূল সমস্যায় মনঃসংযোগ করতে বলি।
প্রশ্নঃ কমিউনিস্ট চীন কি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কোনো ভবিষ্যৎ বিবাদের ব্যাপারে ভারতকে কোনো সতর্কতা জারি করেছে?
পররাষ্ট্রমন্ত্রীঃ একটি শব্দে বলা যায় ‘না’।
প্রশ্নঃ শরণার্থীদের ত্রাণ কার্যের জন্য ভারতের কি তার বাজেট সংকুচিত করার সম্ভবনা আছে?
পররাষ্ট্রমন্ত্রীঃ আমার মনে হয় এটা বেশ স্পষ্ট যে উদ্বাস্তুদের সমগ্র ব্যয় আমাদের জন্য লাভজনক কিছু নয়। এবং, এটা মেটানোর জন্য আমাদের কিছু উন্নয়ন খাতের বাজেট কর্তন করতে হবে। ফলে আমাদের দেশের উন্নয়ন ব্যাঘাত ঘটবে যেটা আমাদের জন্য উদ্বেগের বিষয়।
প্রশ্নঃ জনাব মন্ত্রী, কিভাবে এই অবস্থায় ইন্দো-আমেরিকান সম্পর্ক উন্নয়ন করা যায়?
পররাষ্ট্রমন্ত্রীঃ এটার উত্তর দেয়া কঠিন। তবে এটা বলতে পারি আপনারা সবাই যদি আমাকে সমর্থন দেন তাহলে তার প্রভাব খুব বড় হবে। (হাসতে হাসতে বলেন)।
প্রশ্নঃ আপনার দেশের কত শতাংশ লোক প্রতি রাতে ক্ষুধার্ত অবস্থায় বিছানায় যায়? আপনার দেশে আপনার মানুষের খাদ্যের মধ্যে প্রয়োজনীয় প্রোটিন প্রদান এর জন্য মাছের ব্যাবস্থা আছে কি? আপনি কি জনসংখ্যা বিস্ফোরণকে একটি বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করতে চান? পাশাপাশি, ভারতে জন্মনিয়ন্ত্রণ এর অগ্রগতি সম্পর্কে কিছু কি বলতে পারেন?
পররাষ্ট্রমন্ত্রীঃ বেশ কিছু প্রশ্ন একসাথে সমন্বিত করা হয়েছে। সম্ভবত এই ব্যাপারে যদি বিস্তারিত বলতে যাই তাহলে আমাদের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ও উন্নয়ন এর একটি পূর্ণ অবস্থা অনুধাবন করা সম্ভবপর হবে।
কিন্তু, আমি যত সংক্ষেপে পারি বলার চেষ্টা করছি। প্রথম প্রশ্ন ছিল কর জন লোক রাতে না খেয়ে ঘুমাতে যায়? আমার একটাই উত্তর – যেহেতু গত বছর আমাদের খাদ্য উৎপাদন ১ মিলিয়ন টন পাইল ফলক অতিক্রম করেছে। কেন্দ্রিয়ভাবে আমাদের অবস্থান ভালো। আমরা আমাদের খাদ্য আমদানি অনেকটা কমিয়ে আনতে সক্ষম হতে পেরেছি। তবে আমরা কিছু পরিমাণ আমদানি করছি রিজার্ভ ঠিক রাখার জন্য।
দ্বিতীয় প্রশ্নটি ছিল আমিষের যোগানদাতা হিসাবে মাছের ভূমিকা নিয়ে। এটাই কি আসলে বুঝিয়েছেন?
প্রশ্নঃ হ্যাঁ, স্যার. আপনার দেশের মৎস্য সম্পদ কি আপনার মানুষের খাদ্যের মধ্যে প্রয়োজনীয় প্রোটিন প্রদান করছে?
পররাষ্ট্রমন্ত্রীঃ আমাদের চাহিদা মাফিক যথেষ্ট মাছ উৎপাদন হয়না তবে আমরা আরও বাড়াতে চাই। এবং আমরা মাছ আহরণের জন্য আরও জোরালো ব্যাবস্থা গ্রহণ করছি।
আমাদের মাছ খাওয়াতে কোন সমস্যা নেই। আপনারা যদি মাছ পরিবেশন করেন এবং দেখেন যে ইন্ডিয়ানরা কাঁটাচামচ দিয়ে মাছকে কেমন করে বাগে আনছে, তাহলেই এর উত্তর পেয়ে যাবেন।
পরের প্রশ্ন?
প্রশ্নঃ আপনি কি মনে করেন জনসংখ্যা বিস্ফোরণ আজ বিশ্বের একটি বড় সমস্যা?
পররাষ্ট্রমন্ত্রীঃ হ্যা। এবং পাশাপাশি একটি কথা আমি বলতে চাই জনসংখ্যা সমস্যা যেমন পুরো বিশ্বকে ভাবাচ্ছে – এটাকে যেমন ভাগ করে নেয়া যাচ্ছেনা – সবাই মিলেই সমাধান করতে হচ্ছে তেমনি শান্তিকেও ভাগ করে দেয়া যাবেনা – সবাই মিলেই শান্তির জন্য এগিয়ে আসতে হবে। একারণেই সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে শান্তি প্রতিষ্ঠায়। যার যার পক্ষে যতটুকু করা সম্ভব তা করতে হবে। তা না হলে তুলনামূলক গরীব দেশে যদি জনসংখ্যা বাড়ে এক সময় সেটা যেসব দেশে উন্নত জীবন যাপন বজায় রয়েছে সেখানেও একসময় প্রভাব ফেলতে শুরু করবে।
আর, আমরা আমাদের পক্ষে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ সম্পূর্ণরূপে নিয়েছি। এবং আমি এই চিন্তাটা আপনাদের সাথে শেয়ার করতে চাই যে ভারতের এই ব্যাপারে কোন বাঁধা নেই। এটা নির্ভর করে আমরা কি কার্যকর পদ্ধতিতে আমাদের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি এগিয়ে নিতে সক্ষম হব তার উপর।
প্রশ্নঃ আপনি রাজনৈতিক সমস্যার কথা বলছিলেন। ইউ এস সরকার তো ত্রাণ, অর্থ ও অন্যান্য সাহায্যের কথা বলেছে। তাহলে এগুলো কি বধিরের প্রলাপ মাত্র?
পররাষ্ট্রমন্ত্রীঃ যদি এটাই চুক্তি হত তাহলে কিছুই শোনা যেত না। এবং আলোচনা বন্ধ হতে হলে দুজনকেই বধির হতে হয়। আমি মনে করিনা যে উভয় আচরণ অসঙ্গত। আমেরিকা সরকার তাদের যে ত্রাণের কথা উল্লেখ করেছেন তার জন্য আমি তাদের স্বাগত জানাই।
আমরা কিন্তু শুধুমাত্র উপসর্গ নয় মূল সমস্যা মোকাবিলার তাগিদ দিয়েছি। আমি যদি বলি আমি যা বলেছি সব বধিরের সামনে বলা হয়েছে তাহলে এটা ভুল বলা হবে।
চেয়ারঃ মহামান্য, চূড়ান্ত প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করার আগে, আমি আপনার আগমন উপলক্ষে একটি স্মৃতিরক্ষা সনদ উপহার দিতে চাই।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীঃ আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
চেয়ারঃ পাশাপাশি জাতীয় প্রেস ক্লাবের অফিসিয়াল নেকটাই দিতে চাই। তবে দুঃখিত যে এটা কিন্তু আপনাকে ওয়েস্টার্ণ পোশাকের সাথে পড়তে হবে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীঃ আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
প্রশ্নঃ শেষ প্রশ্ন, স্যার, এটা সত্য যে আপনি একবার একটি অ্যালার্মঘড়ি রাষ্ট্রদূত কেন কেটিং (Ken Keating) কে দিয়েছিলেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীঃ একটি অ্যালার্ম ঘড়ি.
চেয়ারঃ আমি এর গুরুত্ব জানিনা।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীঃ খুব আরামপ্রদ একটি বিষয় উত্থাপিত হয়েছে। প্রথমে আমি আপনাকে ধন্যবাদ দেই, মিস্টার প্রেসিডেন্ট। আপনার ভাবুকতা ও প্রশ্ন স্ক্রীনিং করে যতটা সম্ভব উপস্থাপনযোগ্য এবং রুচিকর আকারে উপস্থাপন করার চেষ্টার জন্য। এবং আমি আপনার চিন্তা এবং বিবেচনার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
দ্বিতীয়ত, আমি এই স্যুভেনিরকে অনেক মূল্যায়ন করি যা আমার জন্য তুলে ধরা হয়েছে। এটি সর্বদা আমাকে একটি খুব আরামপ্রদ ও স্মরণীয় অনুষ্ঠানের কথা মনে করিয়ে দেবে যে আমি এমন একটি মুক্ত আলোচনায় অংশ নিয়েছিলাম এবং আমি প্রেসকে একটিভ দেখতে চাই। কিছুক্ষণের জন্য আমি এই বিষয়টা মিস করছিলাম কারণ আমি এই মুহূর্তে প্রায় ১০ দিন ধরে আমার পার্লামেন্ট ও প্রেস থেকে দূরে আছি। দেশে গিয়ে এই অতিথিপরায়ণতার কথা খুব মনে পড়বে। দেশকে ও দেশের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরতে অসাধারণ এই সুযোগটি আমার কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
শেষ প্রশ্ন ছিল রাষ্ট্রদূত কেটিং কে একটি অ্যালার্ম ঘড়ি দেয়া সম্পর্কে। আমি বলতে চাই যে, জনাব রাষ্ট্রদূত সিনেটর কেটিং আমাদের কূটনৈতিক কোরের মধ্যে সবচেয়ে পছন্দ এবং সম্মানিত রাষ্ট্রদূতদ। আমি স্বীকার করি যে তিনি আমাদের দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের, তাদেরকে শক্তিশালী করার জন্য চমৎকার কাজ করেছেন। এবং যেখানে ফলপ্রসূ সহযোগিতা এবং একত্রীকরণ করার চেষ্টা করেছেন। আমি আপনাকে আশ্বস্ত করতে চাই যে, মানুষ হিসেবে আমরা যুক্তিসঙ্গতভাবে বিনীত হতে চাই, এবং আমরা এলার্ম ঘড়ির মত হাস্যকর কিছু উপহার দিয়ে কাউকে বিব্রত করতে চাইনা।
আর, জনাব কেটিং খুব সতর্কবান মানুষ। তার জাগার জন্য এলার্ম ঘড়ির প্রয়োজন হয় না। তিনি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কদাচিৎ ঘুমান। তাই ঘড়ির এলার্ম দিয়ে তাকে উঠিয়ে দেবার প্রয়োজন নেই। সকল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তিনি সদা জাগ্রত।
আর, হতে পারে, আমি তার জন্য কিছু ঘুমের বড়ি কিনতে পারি। কিন্তু আমি বলতে চাই যে জনাব কেটিং আমেরিকার ঐতিহ্যবাহী জীবন যাপনে অভ্যস্ত। এবং, আমি খুবই আনন্দিত যে তিনি চমৎকার কাজ করছেন।
কিন্তু, তারপরেও কাঠামোবদ্ধ প্রশ্নের ফাঁকে এমন একটি ছেলেমানুষি প্রশ্নের সুযোগ রাখা যেতেই পারে।
ধন্যবাদ।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, নয়াদিল্লী।