ইয়াহিয়া খান ভারতের আকাশ পথ চান
পূর্ব বাংলায় রীতিমত গৃহযুদ্ধ চলছে। গণজীবনের স্বাভাবিক গতি থেমে গেছে। অফিস, আদালত, স্কুল, কলেজ সব বন্ধ। জনতা রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছে। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখার প্রতিবাদে সাধারণ মানুষ উত্তাল। সামরিক শাসকের নির্দেশ তারা মানছে না। কারফিউ অগ্রাহ্য করে জনতা মিছিল করছে। পাঞ্জাবী সৈন্যদের সঙ্গে তাদের সঙ্ঘর্ষ চলছে, শেখ মুজিবর বলেছেন, দুদিনে তিনশ নিহত হয়েছেন। আহতের সংখ্যা নির্ধারণ সম্ভব নয়। সরকারি সেন্সরশীপের বেড়াজাল ভেদ করে সত্য খবর বাইরে আসতে পারছে না। অবস্থা নিঃসন্দেহে ভয়াবহ। আগামী ক’দিনের মধ্যেই হয়ত গ্রামাঞ্চলে হাঙ্গামা ছড়িয়ে পড়বে। দু’ ডিভিসন পাঞ্জাবী সৈন্য পূর্ব বাংলায় রয়েছে। তাদের দিয়ে বাঙালীকে আয়ত্তে রাখা ইয়াহিয়া খানের পক্ষে অসম্ভব। ওখানে আরও সৈন্য পাঠান দরকর। তা না হলে পূর্ব বাংলায় তার শব সাধনা পূর্ণ হবে না। জাহাজে এবং বিমানে পশ্চিমা সৈন্য পাঠান ছাড়া উপায় নেই। ভারতের আকাশ পথ নিষিদ্ধ। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সিংহল ঘুরে সৈন্য যেতে সময় লাগবে। জাহাজের ঝুকি আরও বেশী। বন্দর কর্মীরা হরতাল করে বসে আছেন। জাহাজ ভিড়বে কোথায়?
নিজের জালে নিজে আটকে পড়েছেন ইয়াহিয়া খান। এখন তিনি ভারতের আকাশ পথ চাচ্ছেন। সােভিয়েট রাশিয়া, বৃটেন, আমেরিকা প্রভৃতি সব দেশের কাছে তার দরবার শুরু হয়েছে। দিল্লীর উপর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টির কসরত চলছে। ভারতীয় ছিনতাই বিমান নিয়ে লাহাের বিমানঘাটিতে নষ্টামী করার সময় নিজের অসুবিধায় কথা কি তার মনে ছিল না? পাকিস্তানের পশ্চিমা ডিকটেটররা ষড়যন্ত্র আঁটতে ওস্তাদ। তৈরী করেছিলেন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। ইয়াহিয়া খান পেতেছেন গােটা পূর্ব বাংলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র জাল। প্রতিপক্ষ জড়াতে চাচ্ছেন ভারতকে। ভুট্টো সহযােগিতায় পশ্চিম পাকিস্তানকে তিনি নামাচ্ছেন ভারতবিরুধী জেহাদে। ফারাক্কা নিয়ে পাঞ্জাবীচক্র দলে টানতে চেয়েছিল পূর্ব বাংলাকে। ব্যর্থ হয়েছে তাদের এই কুৎসিত ষড়যন্ত্র। এখন ইয়াহিয়া খান দিচ্ছেন নূতন চাল। তিনি চান ভারতের আকাশ পথ। এ পথে যাবে কারা? পাঞ্জাবী সৈন্যদল। তাদের কি কাজ? পূবের বাঙালী ঠ্যাঙান। এদের অপরাধ? পাঞ্জাবী শােষন মুক্তি। পাক-জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখার নির্দেশ এসব মৌল দাবীর প্রতি চরম বিশ্বাসঘাতকতা। আজ পূর্ব বাংলায় যা চলছে তা ইয়াহিয়া খানের নিজের সৃষ্টি। এটা পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ সমস্যা। ভারতের সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক নেই। পাঞ্জাবী সৈন্যরা পূর্ব বাংলায় গণহত্যা চালাবে, আর তাদের চলাচলের সুবিধা করে দেবেন দিল্লীর—এ প্রত্যাশা বাতুলতা। পূবের বাঙালীকে ঠ্যাঙাবার জন্য ভারতের আকাশ পথ পাক সামরিক বিমানের জন্য খােলা রাখার অর্থ পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ সমস্যায় দিল্লীর অনাবশ্যক নাক গলানাে। ওতে পূবের বাঙালী চটবে এবং ইয়াহিয়া খানের মনস্কামনা সিদ্ধ হবে।
এ ফাঁদে ভারত অবশ্যই পা দেবে না। পাঞ্জাবী চক্রের অতি পরিচিত অভিযােগ পাকিস্তানি রাজনীতির ওলট-পালটে দিল্লী আগ্রহী। ভারতের সঙ্গে যােগসাজসের মিথ্যা অভিযােগে তারা এক সময় মুজিবরকে জেলে পুরেছিল। জনমতের চাপে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ফেসে গিয়েছিল ইয়াহিয়া খান এখন ভারতের যােগসাজজে বাঙালী নিধন যজ্ঞ সম্পূর্ণ করতে উৎসুক। আকাশ পথ দাবী তারই ভনিতা। লাহাের বিমানঘাটিতে ভারতীয় ছিনতাই বিমান ধ্বংস, বােম্বেটেদের আশ্রয়দান এবং যাত্রীদের ভারতে ফেরত পাঠানাে কিম্বা তাদের শাস্তিদান, ভস্মীভূত ভারতীয় বিমানের ক্ষতিপূরণ ব্যবস্থা এবং ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি অবশ্য কাম্য। তাছাড়া পাকিস্তানের সঙ্গে আলােচনা চালান অর্থহীন। বর্তমানে পূর্ব বাংলায় যে অবস্থা চলছে তাতে পাক-সামরিক বিমান ভরতের আকাশ পথ অবশ্যই ব্যবহার করতে পারবে না। পাকিস্তানের গৃহযুদ্ধ যতদিন চলবে ততদিন পাক-সামরিক বিমান ভারতের আকাশ পথে নিষিদ্ধ থাকবে। তার আভ্যন্তরীণ সমস্যা মিটে যাবার পর পাক-সরকার যদি ভারতের বন্ধুত্ব চান তবে দিল্লী অবশ্যই তাতে সাড়া দেবেন। কোন অবস্থাতেই ভারত পূর্ব বাংলায় ইয়াহিয়া খানের গণহত্যায় সহযােগী হবে না।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৬ মার্চ ১৯৭১