বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা আগে থেকে কে কে জানতো? – মেজর রশিদের ভাষ্য
এমন সময় মেজর রশিদ আসলো এবং আমার রুমে সামনের সোফায় আমার মুখোমুখি বসল। সামরিক অভ্যুত্থানকারীদের মূল পরিকল্পনাকারীদের মধ্যে সে অন্যতম একজন। বলতে গেলে, মূল ব্যক্তি। একদিকে সে আর্টিলারি বাহিনীর কমান্ডিং অফিসার, আরেকদিকে খন্দকার মোশতাকের দূর দূরসম্পর্কে ভাগ্নে। অন্যান্য বিদ্রোহী আর্মার্ড গ্রুপের সেকেন্ড ইন কমান্ড বা ভারপ্রাপ্ত কমান্ডার হচ্ছে মেজর ফারুকউর রহমান। তারা ছিলো ভায়রাভাই। অর্থাৎ তাদের স্ত্রীরা আপন বোন ছিলো। মেজর রশিদ যখন আমার সামনে বসে ছিলো তখন তাকে আমি জিজ্ঞেস করলাম, “এরকম একটা কাজ কীভাবে করতে পারলা তুমি?” সে বলল, “স্যার, এটা লম্বা ইতিহাস।” আমি বললাম, “আমার সময় আছে।”
তারপর সে আমাকে বলল সফলার ক্ষীণ সম্ভবনা আছে ধরে নিয়েই তারা মিশনে নেমেছিল। তাদের জন্য এটা ছিলো জুয়া। তারা ধরে নিয়েছিলো যে যদি তারা ব্যার্থ হয় তবে ফাঁসিকাষ্ঠে যাবার আগে ঘটনার পেছনের সকল সিনিয়র আর্মি অফিসারদের নাম তারা বলে যাবে। এটাও তারা বলে দেবে যে তারা শুধুমাত্র তাদের সিনিয়রদের স্বার্থ হাসিল করার জন্যই এই মিশনে নেমেছিল। আমি তাকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “সকল সিনিয়র অফিসার” বলতে তুমি কী বোঝাচ্ছ?” সে বলল, “স্যার, ঢাকায় ‘আপনি’ ছাড়া সবার কাছেই যাওয়া হয়েছে এবং উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে।” আমি মেজর রশিদের এই তথ্যে হতবাক হয়ে গেলাম। সে আরও বলল, আমাকে জানানোর জন্যও সে চেষ্টা করেছিলো, কিন্তু আমার সাথে কথা বলার মত সাহস সঞ্চয় করতে পারেনি। বিস্তারিত বলতে গিয়ে সে বলল, “স্যার, আপনার কি মনে পরে গত ঈদের দিনে (ঈদ উল ফিতর) আমি আর আমার স্ত্রীকে আপনি সেনাভবনে (চীফের বাসভবন) ডেকেছিলেন?” আমি বললাম, “হ্যা, মনে আছে।” সে বলল, “স্যার, যদি মনে করতে পারেন, সেদিন আমি অনেক বিষয়ে আলোচনার ফাঁকে ভারতে আমার ট্রেনিং সম্পর্কে বলেছিলাম। কিন্তু আপনার বাড়ীতে যে উদ্দেশ্যে আমি গিয়েছিলাম সেটা সফল হয়নি।” সেদিন আপনাকে আমি আমাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলতে চেয়েছিলাম। আমি জিজ্ঞেস করলাম কেন তাহলে সে আমাকে বলেনি। সে বলল,
“স্যার, যদিও অনেকক্ষণ আমি আপনার সাথে ছিলাম, কিন্তু এই ব্যাপারটা আপনাকে বলার মত পর্যাপ্ত সাহস সঞ্চয় করতে পারিনি।” এরপর আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, অন্যান্য সিনিয়র অফিসার কারা এবং তাদের মতামত কী ছিলো। আমি এও জিজ্ঞেস করলাম যে তারা কি জুনিয়র অফিসারদের সাথে এই ব্যাপারে মুখ খুলেছিল কিনা। এবং সেক্ষেত্রে তারা কী ধরণের প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে? সবশেষে আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তারা বিষয়টা কোন লেভেলের জুনিয়র অফিসার পর্যন্ত আলোচনা করেছে এবং তাদের আনুমানিক সংখ্যাটা কত। তখন সে বলল যে, প্রথমে তারা মিড লেভেলের জুনিয়র অফিসারদের কাছে জিনিসটা বলেছে। অর্থাৎ লে কর্নেল থেকে মেজর। তার ভাষ্যমতে তারা সবাই এটাকে স্বাগত জানিয়েছে এবং প্রস্তাব করেছে যে যদি সিনিয়র অফিসারদের এর সাথে সংশ্লিষ্ট করা যায় তাহলে ভালো হয়। সিনিয়র অফিসারদের সমর্থন ছাড়া হয়ত তাদের মিশন সফল নাও হতে পারে। এই সাজেশন মাথায় রেখে তারা সিনিয়র অফিসারদের শরণাপন্ন হয়। সিনিয়র অফিসারদের নাম বলতে গিয়ে সে যেসব নাম বলেছে সেগুলো হচ্ছে ডেপুটি চীফ জেনারেল জিয়া, CGS ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ এবং ঢাকা ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়াৎ জামিল। এসব নাম শুনে আমি একবারে আকাশ থেকে পড়লাম। কাকে আমি এখন বিশ্বাস করব? আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, অফিসারদের থেকে তারা কী ধরণের প্রতিক্রিয়া পেয়েছে।
এপ্রশ্নের জবাবে সে বলল, ব্রিগেডিয়ার খালেদের কাছে সে সর্বপ্রথম প্রস্তাব নিয়ে যায়। যেদিন সে প্রস্তাব নিয়ে ব্রিগেডিয়ার খালেদের অফিসে যায় সেদিন সেখানে ঢাকা ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়াৎ জামিল ছিলো। সে তখন তাদের দুজনের কাছেই সরকার পতন ঘটানোর প্রস্তাবটি দেয়। তার ভাষ্যমতে ব্রিগেডিয়ার খালেদ তার কথাকে সিরিয়াসলি নেয় নাই এবং বলে যে, “চলে যাও, শিশুসুলভ কাজ করোনা।” এরপর সে একই প্রস্তাব নিয়ে জেনারেল জিয়ার কাছে যায়। জিয়া জানায় সিনিয়র অফিসার হিসেবে সে (জেনারেল জিয়া) সরাসরি তাদের সাথে যুক্ত হতে পারেনা। যদিও সে (জেনারেল জিয়া) তাকে চালিয়ে যেতে (Go ahead) বলে এবং এও জানায় যে যদি তারা সফল হয় তাহলে পরবর্তীতে সে (জেনারেল জিয়া) তাদের সাহায্য করবে। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে, মেজর রশিদ যাদের কাছে প্রস্তাব নিয়ে গেল এসব অফিসারদের কেউ আমাকে জিনিসটা জানায়নি।
মেজর রশিদকে আমার ডেপুটি জেনারেল জিয়া সর্বোতভাবে উৎসাহ দিয়েছে। এটা আশা করিনা যে মেজর রশিদের প্রস্তাবে একাত্মতা প্রকাশ করে জেনারেল জিয়া সেটা আমাকে জানাতে আসবে। কিন্তু ব্রিগেডিয়ার খালেদ আর কর্নেল শাফায়াৎ জামিলের কী হল? তারা কেন আমার কাছে এটা লুকাবে? এটা করার কোন কারণ নেই! এই অফিসারদের কেউ আমাকে মেজর রশিদের প্রস্তাব সম্পর্কে বলেনি – হোক সেটা শিশুসুলভ বা কৌতুকপূর্ণ। এমন একজন লোক যে নিজেই সফলভাবে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানোতে জড়িত, তার কাছ থেকে যে নামগুলো আমি শুনলাম তাদের উপর কিভাবে আমি বিশ্বাস রাখি? যদিও আমি তাকে (মেজর রশিদ) পুরোপুরি বিশ্বাস করছিনা, হতে পারে সে সিনিয়র অফিসারদের সম্পর্কে আমাকে বিষিয়ে তুলছে। কিন্তু যদি তাদের ব্যাপারে আমি ভিন্নভাবে ভাবি সেটাও কি ভুল হবে?
মেজর রশিদের থেকে এসব জানার পর সবকিছু পরিষ্কার হতে লাগলো। ১৫ আগস্ট ‘৭৫ সকালে কর্নেল শাফায়াৎ জামিলকে আমি সৈন্য পাঠিয়ে ব্যবস্থা নিতে বলার সুনির্দিস্ট নির্দেশনা দেই। তা সত্ত্বেও সে ট্রুপ্স মুভ করেনি। একই দিন বিকেলে কর্নেল (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল) এম এ মঞ্জুর খন্দকার মোশতাকের অনুমতি ছাড়াই নয়াদিল্লী থেকে ঢাকা আসে। জেনারেল জিয়া সকাল থেকে আমাকে প্রেসিডেন্ট হত্যাকাণ্ড থেকে দৃষ্টি সরিয়ে তথাকথিত সম্ভাব্য ভারত আগ্রাসনের সম্ভবনার দিকে আমার মনোযোগ ঘুরাতে চেষ্টা করে যাচ্ছে। সবকিছু আমার কাছে একদম স্পষ্ট হতে লাগলো। আমি কিছু আত্মকেন্দ্রিক ষড়যন্ত্রকারীদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে আছি। একারণে কাউকেই বিশ্বাস করা যাচ্ছেনা। ব্রিগেডিয়ার খালেদ, যাকে বিশ্বাস করলাম, সেও মনে হচ্ছে সঠিক পথে নেই। তার মনে ভিন্ন কোন পরিকল্পনা আছে কিনা তা আমার জানা নেই। তা না হলে এই পরিস্থিতিতে আমাকে না জানিয়ে কেন সে বিদ্রোহীদের ট্যাংকের জন্য গোলাবারুদ ইস্যু করবে? মনে করিয়ে দেই, এই ট্যাংকগুলো দিয়ে কোন রকম গোলা ছাড়াই সামরিক অভ্যুত্থান করা হয়েছিলো। আমি বুঝতে পারলাম না যে যখন বিদ্রোহীদের উপর কোন নিয়ন্ত্রণ আমাদের নেই সেই অবস্থায় তাদেরকে গোলাবারুদ ইস্যু করার কী যুক্তি থাকতে পারে।
Translated by – সংগ্রামের নোটবুক
Reference: 15th August A National Tragedy Major Gen K M Safiullah BU PSC