সেই রাজাকার মুন্সী মনছুরের পক্ষে সাফাই গেয়ে বিজ্ঞাপনের রহস্য উন্মােচিত
জনকণ্ঠ রিপাের্ট ॥ অবশেষে নারায়ণগঞ্জের কুখ্যাত রাজাকার মুন্সী মনছুরের পক্ষে সাফাই গেয়ে ৮ মুক্তিযােদ্ধার নামে দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত বিজ্ঞাপনের প্রকৃত রহস্য উন্মােচিত হয়েছে। এই ঘৃণ্য রাজাকার প্রতারিত করেছে ৮ নিঃস্ব মুক্তিযােদ্ধাকে । স্বাধীনতার ৩০ বছর পরও অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত ৮ নিঃস্ব মুক্তিযােদ্ধাকে প্রতারণার জালে ফেলে ফায়দা লুটেছে কোটিপতি রাজাকার মুন্সী মনছুর। এই ৮ মুক্তিযােদ্ধা এখনও যুদ্ধ করছে বেঁচে থাকার জন্য। তারা একেবারেই নিঃস্ব। পেশায় কেউ রিক্সাচালক, কেউ ড্রাইভার, কেউ গার্মেন্টস শ্রমিক, কেউ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, কেউবা বেকার। ১ মে রাতে মুক্তিযােদ্ধা সংসদের নারায়ণগঞ্জ জেলা কমান্ড অফিসে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে এই ৮ মুক্তিযােদ্ধা। এ সময় হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা ঘটে। তারা বলেন, আমরা স্বেচ্ছায় এ ধরনের বিবৃতিতে স্বাক্ষর করিনি। প্রতারণার শিকার হয়েছি। আমরা। দারিদ্র্যের সাথে সংগ্রাম করেছি কিন্তু কখনও বিপথগামী হইনি। একজন মুক্তিযােদ্ধা হিসাবে বুকভরা অহঙ্কার নিয়ে জীবনযাপন করছিলাম। কিন্তু স্বাধীনতার ৩০ বছর পর ঘূণ্য রাজাকারের প্রতারণার শিকার হয়ে আমরা স্তম্ভিত, হারিয়ে ফেলেছি মুখের ভাষা। এ সময় মুক্তিযােদ্ধা সংসদের জেলা কমান্ডের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। ১৬ এপ্রিল দৈনিক জনকণ্ঠে সেই রাজাকার কলামে ঘৃণিত রাজাকার মুন্সী মনছুরের স্বরূপ।
উন্মােচন করে তথ্যসমৃদ্ধ সংবাদ প্রকাশিত হয়। এই রিপাের্ট নারায়ণগঞ্জ শহরে আলােড়ন সৃষ্টি করে। রিপাের্ট প্রকাশের পরপরই মুন্সী মনছুরকে বাঁচানাের জন্য তৎপর হয়ে ওঠে প্রভাবশালী কিছু ব্যক্তি। তারা প্রমাণ করার চেষ্টা করে জনকণ্ঠের প্রকাশিত সংবাদ সঠিক নয়। মুন্সী মনছুরের পক্ষে সাফাই গাওয়ার লােক ঠিক করার জন্য মাঠে নামে এই চক্রটি। এরই অংশ হিসাবে ২৭ এপ্রিল দৈনিক ইনকিলাবে প্রথম পৃষ্ঠায় শহরের হাজীগঞ্জ ইউনিয়নের তল্লা এলাকার বাসিন্দা ৮ মুক্তিযােদ্ধার নামে সাফাই গেয়ে। বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়। বিজ্ঞাপনে বলা হয়, মুন্সী মনছুর রাজাকার নয়। হিন্দুবাড়ি দখল করেনি। এই বিজ্ঞাপন প্রকাশের পর শহরে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। ২৮ এপ্রিল দৈনিক জনকণ্ঠে ৫ বিশিষ্ট মুক্তিযােদ্ধা ও রাজনীতিকের প্রতিক্রিয়া প্রকাশিত হয়। এই ৫ বিশিষ্ট ব্যক্তি হলেন- নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান নাজিমউদ্দিন মাহমুদ, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও সাবেক সংসদ সদস্য গােলাম মােরশেদ ফারুকী, বিশিষ্ট মুক্তিযােদ্ধা হাজীগঞ্জ এলাকার সাবেক পৌর কমিশনার আবদুস সাত্তার, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদের জেলা সভাপতি ও মুক্তিযােদ্ধা কমান্ডার গােপীনাথ দাস এবং আওয়ামী লীগ নেতা রােকন উদ্দিন আহমেদ। তারা জনকণ্ঠের ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন, মুন্সী মনছুর রাজাকার, এটা সর্বজনবিদিত। এ নিয়ে যারা প্রশ্ন তােলে কিংবা তার পক্ষে সাফাই গায় তাদের চরিত্র নিয়েই প্রশ্ন ওঠে। দৈনিক ইনকিলাবে বিজ্ঞাপন প্রকাশের পর পরই মুক্তিযােদ্ধা সংসদের নারায়ণগঞ্জ থানা কমান্ড প্রকৃত রহস্য উন্মােচনের জন্য তদন্ত শুরু করে। হাজীগঞ্জ ইউনিয়নের তল্লা এলাকার বাসিন্দা এই ৮ মুক্তিযােদ্ধার মধ্যে খলিল রিক্সাচালক, মােহাম্মদ হােসেন ড্রাইভার, মহিউদ্দিন গার্মেন্টস শ্রমিক, জামাল হােসেন ও সৈয়দ মজিবর রহমান ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এবং আমানউল্লাহ, মােঃ আজিজ ও আবুল কাশেম বেকার। তারা যৌথভাবে এক লিখিত বিবৃতিতে বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের ৩০ বছর পর আমরা ঘূণিত রাজাকার মুন্সী মনছুরের প্রতারণার শিকার হয়েছি।
প্রকৃত ঘটনা হলাে, আমরা কেউ জানি না আমাদের নামে ঘৃণিত রাজাকার মুন্সী মনছুরের সাফাই গেয়ে ইনকিলাবে বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হবে। মুন্সী মনছুরের মুখােশ উন্মোচন করে দৈনিক জনকণ্ঠে খবর প্রকাশের কথা আমাদের জানা ছিল না। তাকে ব্যক্তিগতভাবে কেউ চিনিও না। ২০ এপ্রিল রাতে সে তল্লার একটি বাড়িতে আসে এবং আমাদের ডেকে আনে। সে আমাদের একটি সাদা কাগজে স্বাক্ষর দিতে অনুরােধ জানিয়ে বলে, সই করলে তার উপকার হবে। আমরা বিস্তারিত না জেনেই সরল বিশ্বাসে স্বাক্ষর করি। এই ঘৃণিত রাজাকার দ্বারা প্রতারিত হয়ে আমাদের জীবন আজ বিপর্যস্ত। এই ৮ মুক্তিযােদ্ধা মুক্তিযােদ্ধা সংসদ জেলা কমান্ড অফিসে বসে বিবৃতিতে স্বাক্ষরের সময় বাংলাদেশ মুক্তিযােদ্ধা সংসদের কেন্দ্রীয় কমান্ডের সাবেক মহাসচিব মােঃ গিয়াসউদ্দিন বীর প্রতীক, থানা কমান্ডার আবু হােসেন সিদ্দিকী প্রমুখ নেতা উপস্থিত ছিলেন। মুক্তিযােদ্ধা সংসদ নারায়ণগঞ্জ জেলা কমান্ডের ডেপুটি কমান্ডার সামিউল্লাহ মিলন জনকণ্ঠকে বলেন, এই ৮ মুক্তিযােদ্ধা একেবারেই নিঃস্ব। তাঁরা দেশের স্বাধীনতা এনেছে কিন্তু তাদের জীবনে অর্থনৈতিক মুক্তি আসেনি। জীবনসংগ্রামে তারা এতােটাই ব্যস্ত যে, অন্য কোন খবর রাখা তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়। এই সুযােগই নিয়েছে ঘৃণ্য রাজাকার মনছুর ও তার সহযােগীরা। প্রতারণার ফাঁদে ফেলেছে তাদের।
জনকণ্ঠ ॥ ০৫-০৫-২০০১
সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন