You dont have javascript enabled! Please enable it! সেই রাজাকার কাই সিরাজ ও দুই ছেলেসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে একাত্তরের হত্যা লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযােগের মামলা - সংগ্রামের নোটবুক

সেই রাজাকার কাই সিরাজ ও দুই ছেলেসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে একাত্তরের হত্যা লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযােগের মামলা

কুষ্টিয়া, ৭ ফেব্রুয়ারি, নিজস্ব সংবাদদাতা ॥ অবশেষে দীর্ঘ ত্রিশ বছর পর একাত্তরে স্বাধীনতাবিরােধী ও কুষ্টিয়ার খােকসা-কুমারখালী অঞ্চলের আলােচিত সেই রাজাকার কমান্ডার ‘কাই সিরাজ ওরফে হাজী সিরাজুল ইসলাম এবং তার দুই ছেলেসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়েছে। হত্যা, লুণ্ঠন ও ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযােগের অভিযােগ এনে মঙ্গলবার কুষ্টিয়া আমলী আদালতে এই মামলা দায়ের করা হয়। মামলার বাদী ঘাতকদের হাতে নিহত খােকসা এলাকার নারায়ণ চন্দ্র সরকারের ছেলে এ্যাডভােকেট প্রদীপ কুমার সরকার। মামলার অপর চার আসামী হলাে কাই সিরাজের দুই ছেলে শফিকুল ইসলাম, নজরুল ইসলাম এবং মৃত এলাহী বক্সের ছেলে ইউনুছ ও কছিমউদ্দিনের ছেলে আমজাদ। উভয়ের বাড়ি কুষ্টিয়ার খােকসায়। এক সময়ের সামান্য কাঠখড়ি বিক্রেতা, মামলার প্রধান আসামী কাই সিরাজ ঢাকার নাহার প্লাজা ও মানিকগঞ্জের নাহার গার্ডেনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মালিক, দেশের অন্যতম ধনাঢ্য ব্যক্তি। শান্তি কমিটির লিডার রাজাকার সিরাজের বিরুদ্ধে এই মামলা জেলার মুক্তিযােদ্ধাসহ স্বাধীনতার সপক্ষের জনতার মধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। এ্যাডভােকেট প্রদীপ কুমার সরকার তাঁর আর্জিতে উল্লেখ করেন, মামলার আসামীরা হচ্ছে স্বাধীনতাবিরােধী পাকি বাহিনীর দোসর, রাজাকার, শান্তি কমিটির নেতা, নারী ধর্ষক, অগ্নিসংযােগকারী ও লুণ্ঠনকারী। তারা স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আগ্নেয়াস্ত্রে সজ্জিত হয়ে বাদীর খােকসা থানার ওসমানপুর গ্রামের বাড়ি ঘিরে ফেলে। এ সময় বাদীর বাবা স্বাধীনতাকামী নারায়ণ চন্দ্র সরকার প্রাণভয়ে পার্শ্ববর্তী পাটক্ষেতে লুকিয়ে থাকেন। এক পর্যায়ে পাকি হানাদার বাহিনীর দোসর উল্লিখিত আসামীরা তাকে দেখে ফেলে এবং তাকে সেখান থেকে ধরে এনে নিজ বাড়িতে দড়ি দিয়ে পিঠমােড়া করে বেঁধে রাখে। এ সময় রাজাকার কমান্ডার হিসাবে পরিচিত কাই সিরাজ হুকুম দেয় ‘শালাকে পিটাও’। হুকুম পাওয়া মাত্রই আসামী ছানা, নজরুল, ইউনুছ ও আমজাদ রাইফেলের বাট দিয়ে নারায়ণ চন্দ্র সরকারকে বেধড়ক পিটাতে থাকে।

এ সময় আসামী কাই সিরাজের হুকুমে অন্য আসামীরা তার বাড়ি থেকে প্রায় লক্ষাধিক টাকার সােনার গহনা লুটে নেয় এবং ঘরবাড়ি আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয়। তারা বাদীর বাবাকে নিয়ে যাবার চেষ্টা করলে বাদীর মা এ সময় ঠেকাতে আসে। তখন আসামী আমজাদ তাঁকে লাথি মেরে। ফেলে দেয় আর বলে এগিয়ে আসার চেষ্টা করলে তােকে গুলি করে মেরে ফেলব। পরে আসামীরা ওসমানপুর নিবাসী রাখাল চন্দ্র কর্মকার ও বাদীর বাৰা নারায়ণ চন্দ্র সরকার এই দু’জনকে পিঠমােড়া করে বেঁধে কুষ্টিয়ার খােকসা রেলস্টেশন সংলগ্ন ব্রিজের কাছে নিয়ে যায়। সেখানে এই দু’জনকে দাঁড় করিয়ে আসামীরা গুলি করে হত্যা করে। মঙ্গলবার কুমারখালী, খােকসা ও মিরপুর কুষ্টিয়ার ৩ নং আমলী আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট সুশান্ত কুমার কুণ্ডু ২০০ ধারামতে বাদী প্রদীপ কুমার সরকারের হলফ জবানবন্দী রেকর্ড করেন এবং মামলাটি এফআইআর হিসাবে গণ্য করে প্রতিবেদন দেয়ার জন্য খােকসা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেন। কুষ্টিয়ার আদালতে এই মামলাটির নং মিস১৩/২০০১। প্রসঙ্গত, একাত্তরে বিভিন্ন অপকর্মের কথা তুলে ধরে গত ২৭ জানুয়ারি দৈনিক জনকণ্ঠের সেই রাজাকার কলামে কাই সিরাজ সম্পর্কে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এ প্রতিবেদনে রাজাকার সিরাজের লেবাস উন্মােচিত হওয়ায় কুষ্টিয়ার খােকসা ও কুমারখালী এলাকা এবং মানিকগঞ্জে তােলপাড় সৃষ্টি হয়।

মানিকগঞ্জে তাকে অবাঞ্ছিত ঘােষণা করে তার কুশপুত্তলিকা দাহ এবং সেখানে তার প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। কুষ্টিয়ার। খােকসা থানার মােড়াগাছা গ্রামের সিরাজুল ইসলাম পাকি বাহিনীর পরাজয় আঁচ করতে পেরে তার পরিবারসহ দেশ স্বাধীনের পূর্বমুহূর্তে এলাকা ছেড়ে প্রথমে ঢাকায় পালিয়ে যায়। পরে সে মানিকগঞ্জে স্থায়ী ঘাঁটি গাড়ে। সাটুরিয়া থানার কামতা গ্রামে জমি কিনে গড়ে তােলে নাহার গার্ডেন। সিরাজ ও তার পরিবারের বসতবাড়ি এখানে। এক সময়ের সামান্য কাঠ বিক্রেতা সিরাজ এখন ঢাকার সােনারগাঁও রােডের নাহার প্লাজা মার্কেট, হােটেল স্কাই গার্ডেন, আরিফ গার্মেন্টস, এলিফ্যান্ট রােডে রীনা কনফেকশনারি, পপি ডিপার্টমেন্টাল স্টোর এবং মানিকগঞ্জে বিসিকের নাহার ফুড প্রডাক্টস ও নাহার গার্ডেনসহ ১০/১২টি প্রতিষ্ঠানের মালিক। অনেকের ধারণা, এই রাজাকার পরিবারটি বর্তমানে কমপক্ষে দু’শ’ কোটি টাকার সম্পত্তির মালিক। সামাজিক অবস্থা অনুকূলে না থাকায় এবং জীবনের নিরাপত্তাহীনতার কারণে ও বহুদিন। ধরে লাশ খুঁজে না পাওয়ায় মামলা দায়ের করতে বিলম্ব হয় বলে বাদী তার আর্জিতে উল্লেখ করেন। এ সময় বাদীপক্ষের আইনজীবীরা ছিলেন এ্যাডভােকেট শামসুল হুদা, এ্যাডভােকেট আখতারুজ্জামান মাসুম, এ্যাডভােকেট আমানউল্লাহ নান্টু, এ্যাডভােকেট শাহ বরকত, এ্যাডভােকেট তােফাজ্জেল হােসেন, এ্যাডভােকেট সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, এ্যাডভােকেট আবদুল জলিল প্রমুখ।

জনকণ্ঠ ॥ ০৮-০২-২০০১

সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন